জেন অস্টেনের 'ম্যান্সফিল্ড পার্ক' প্রসঙ্গে

সময়টা ১৮১৪। প্রকাশিত হলো জেন অস্টিনের উপন্যাস ম্যান্সফিল্ড পার্ক। স্ট্যাটাস, ক্লাস, প্রেম, ফ্লার্টিং, বিয়ে, পরকিয়া, সামাজিক বহিষ্করণ, হ্যাপি এন্ডিং এসব কিছুর জটিল সমীকরণ নিয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ সমাজের দলিল ম্যান্সফিল্ড পার্ক প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠক মহলে হট কেকের মতন বিক্রি হয়ে গেল। তবে ক্রিটিক মহল বিশেষ উৎসাহ প্রকাশ করল না। অবশ্য তাৎক্ষণিক ভাবে বিশেষ সাড়া না পেলেও পরবর্তীকালে জেন অস্টিনের লেখা সুদীর্ঘ এই উপন্যাস বহু সমালোচকের সমালোচনার মধ্যে দিয়ে তাঁর লেখা অন্যতম বিতর্কিত উপন্যাসে পরিণত হয়েছে।

উপন্যাসটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এর প্রধান চরিত্র ফ্যানি প্রাইসকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। নিতান্ত দরিদ্র বাবা মায়ের বড় মেয়ে ফ্যানিকে দশ বছর বয়সে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তার বড়লোক মাসির বাড়িতে। অর্থ চিরকালই সামাজিক স্ট্যাটাসের ধারক ও বাহক। এই উপন্যাসেও তার ব্যতিক্রম দেখা যায় না। দরিদ্র বাবামায়ের সন্তান হওয়ার কারণে ফ্যানি বিত্তশালী মাসির বাড়িতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। সেখানে তার চারজন কাজিন ভাইবোন আছে। সেখানে তার খারাপ থাকার তো কথা নয়। কিন্তু ফ্যানি পৌঁছানর আগেই তার মেসোমশাই স্যর টমাস বার্ট্রাম এই নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন যে ফ্যানি যেন নিজেকে তার মাসতুতো ভাইবোনদের সমকক্ষ না ভেবে ফেলে। অর্থাৎ কাজিন ভাইবোন একসঙ্গে এক বাড়িতে বড় হয়ে উঠলেও ফ্যানি সেই বাড়িতে দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ। সে ঠিক কাজের লোক নয়, কিন্তু বাড়ির সদস্যদের সমকক্ষও নয়। ছোট ছেলে এডমন্ড ছাড়া সেই বাড়ির সকলেই ফ্যানিকে কিছুটা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে। সময়ে সময়ে মনে পড়িয়ে দেয় যে সে এই পরিবারের আশ্রিত একজন মাত্র। একমাত্র এডমন্ডের সঙ্গেই ফ্যানির এক বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দৃঢ়তর  হয়ে ওঠে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার মধ্যে দিয়ে।

তৎকালীন ব্রিটিশ সমাজে মেয়েদের সামাজিক অবস্থান এই উপন্যাসে বেশ স্পষ্ট ভাবেই দেখা যায়। ধনী ঘরের মেয়েরা পড়াশোনা শিখবে, সামাজিক মেলামেশা করবে, কোর্টশিপ শেষে একজন ধনী পুরুষকে বিয়ে করবে, চাকরবাকর দিয়ে সংসার সামলাবে, বাচ্চাদের বড় করে তুলবে; ইত্যাদি অনেক কাজের মধ্যে নিজের যোগ্যতায় অর্থ উপার্জন করার কিন্তু কোনও উপায় নেই। তাই একজন ধনী পুরুষকে বিয়ে করাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে মেয়েদের জন্য। জেন অস্টিনের আরও অন্যান্য উপন্যাসের মতোই ম্যান্সফিল্ড পার্ক উপন্যাসেও বিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ফ্যানি ছাড়াও বার্ট্রাম পরিবারের দুই মেয়ে মারিয়া, জুলিয়া, ছোট ছেলে এডমন্ড, আর ম্যান্সফিল্ড পার্কের পাদ্রির আত্মীয় মেরি ও হেনরি ক্রফোর্ডের রোম্যান্টিক জটিলতা এই উপন্যাসের এক বড় অংশ দখল করে রাখে। চার্মিং স্বভাবের কারণে মেরি ও হেনরি ম্যান্সফিল্ড পার্কে এসেই খুব দ্রুত বার্ট্রাম পরিবারের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। হেনরি একইসঙ্গে মারিয়া ও জুলিয়া দুজনের সঙ্গেই ফ্লার্ট করে। মারিয়া ততদিনে জেমস রাসওর্থের সঙ্গে এনগেজড। তবুও সে হেনরির প্রেমের খেলার টানকে অগ্রাহ্য করতে পারে না। এদিকে মেরির আগ্রহ এডমন্ডকে ঘিরে। এতো সব চরিত্রের ভিড়ে ফ্যানি থেকে যায় প্রায় ব্রাত্য হিসেবে। তার অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্ট্যাটাসের কারণেই কেউ তার ভালো লাগার বিষয়ে আগ্রহী নয়।

ফ্যানি ভারী ভালো মেয়ে। তার চরিত্রের গঠন বড় নরমসরম। সে জানে পরিবারে, সমাজে, পরিবারে তার স্থান কোথায়। তাই তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনাপ্রবাহে সে আঘাত পেলেও কাউকে জানতে দেয় না। সবকিছু মুখ বুজে মেনে নিয়ে সয়ে যাওয়াই তার জোরের জায়গা। উপন্যাসে যখন নাটকে অভিনয়ের প্রসঙ্গে আসে তখন সে বারে বারে বলে, ‘I can’t act’ – পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগে সে অভিনয়ের কথা বলছে নাকি নিজের ইচ্ছেতে কোনও কিছু করার কথা বলছে! এই নাটক অভিনয়ের সময় ফ্যানির কাজিন আর ক্রফোর্ড ভাইবোনের যে নীতিগত স্খলন দেখা যায় তা ফ্যানি কিছুটা নিস্ক্রিয় ভাবে দূর থেকে দেখে যায়। সেটাই তার আরেক জোরের জায়গা। তার নৈতিকতা বোধ – এই জায়গায় সে পাঠককে কখনই প্রশ্ন করার সুযোগ দেয় না। বৈভব ও নীতিহীন মানুষের ভিড়ে সে তার নৈতিক দৃঢ়তার কারণেই একলা হলেও পাঠকের মনে জায়গা করে নেয়।   

নৈতিকতার প্রশ্নে মেরি ও হেনরি দুজনেই যেন ফ্যানির একদম বিপরীতে অবস্থান করে। মেয়েদের সঙ্গে ফ্লার্টিং বড়লোক হেনরির জন্য বিনোদন। তাই সে মারিয়া বা জুলিয়া কারোর সঙ্গেই ফ্লার্ট করতে ছাড়ে না। এমনকি মারিয়া যে জেমস রাসওর্থের বাগদত্তা, তা জেনেও সে ফ্লার্ট করে যায়। এনগেজড মহিলার সঙ্গে ফ্লার্টিং বরং বেশি নিরাপদ, এতে পরবর্তীতে বিপদের সম্ভাবনা কম, সে এই মতে বিশ্বাসী। মেরিও এতে কোনও দোষ দেখতে পায় না। উপন্যাসের শেষ দিকে যখন বিবাহিত মারিয়া হেনরির সঙ্গে পালিয়ে যায়, তখনও মেরির আর কোনও অসুবিধে নেই, তার একমাত্র আপত্তি এখানে যে ওদের কেচ্ছার কাহিনী সবাই জানতে পেরে গিয়েছে।

যেহেতু তৎকালীন ব্রিটিশ সমাজে মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দের একমাত্র উপায় ছিল বড়লোক ছেলেকে বিয়ে করা, তাই এই বিত্তশালী পরিবারের মেয়েদের দিন কাটত এই বিয়ের চিন্তাতেই। হেনরির ছল চাতুরিতে ধাক্কা খেয়ে মারিয়া বোকাসোকা কিন্তু বিত্তশালী জেমস রাসওর্থকে বিয়ে করে এই একমাত্র কারণেই। আবার মেরি এডমন্ডের প্রতি আকর্ষিত হলেও এডমন্ড যে বার্ট্রাম পরিবারের ছোট ছেলে সেই বিষয়ে মেরি চিন্তিত। এডমন্ড শুধু যে পরিবারের ছোট ছেলে তাই নয়, সে তার পেশা হিসেবে পাদ্রি হওয়াকে বেছে নিয়েছে, সেটাও মেরির জন্য এক সমস্যা। কারণ একজন পাদ্রির স্ত্রী হিসেবে সে যে বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্থ তা হারাবে সেই সম্ভাবনা মেরিকে স্বস্তি দেয় না। ফ্যানি এডমন্ডকে ভালোবাসে, কিন্তু, she can’t act! মনের কথা মনেই রেখে এডমন্ড ও মেরির মধ্যে গড়ে ওঠা রোম্যান্টিক সম্পর্ক, মেরির বড়লোকি নাকউঁচু মনোভাব ও এডমন্ডের পেশার কারণে সেই সম্পর্কে টানাপড়েন সবই লক্ষ্য করে যায় ফ্যানি।

মারিয়ার বিয়ের পরে জুলিয়াও ওদের সঙ্গে লন্ডনে চলে যায়। এরপর হেনরির চোখ যায় ফ্যানির উপর। মূলত ফ্যানির নিঃস্পৃহতাই হেনরিকে ফ্যানির দিকে টেনে আনে। মেয়েদের সঙ্গে ফ্লার্ট করা হেনরির জন্য বিনোদন। তাই ফ্যানিকে নিজের প্রেমে পড়তে বাধ্য করা হয়ে ওঠে হেনরির নতুন খেলা। ততদিনে হেনরির স্বভাব ফ্যানির জানা হয়ে গিয়েছে। সে নিজের চোখে দেখেছে মারিয়া ও জুলিয়ার সঙ্গে হেনরির আচরণ। তাই হেনরি যখন ফ্যানির জন্য আবেগ প্রকাশ করে তখন ফ্যানি সেটা সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে ও হেনরির প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। হেনরির জন্য এই প্রত্যাখান নতুন। সে মেয়েদের কাছে প্রত্যাখ্যাত হতে অভ্যস্ত নয়। তাই আরও বেশি উদ্যমে সে ফ্যানিকে জয় করতে উঠে পড়ে লাগে।

হেনরি ফ্যানিকে বিয়ের আগ্রহ প্রকাশ করলে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। স্যর বার্ট্রাম এই ভেবে খুশি হয়ে ওঠেন যে এই হেনরিকে বিয়ে করে ফ্যানি সামাজিক ভাবে এক প্রতিপত্তির জায়গায় পৌঁছে যাবে। সে এক বিলাসবহুল জীবন যাপন করতে পারবে। তাই এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া না করে স্যর বার্ট্রাম এই বিয়েতে এক কথায় রাজি হয়ে যান। অন্যদিকে মেরি একটু অবাক হয় এই ভেবে যে হেনরির মতন বড়লোক, কেতাদুরস্ত পুরুষ ফ্যানির মতন এক সাধারণ ঘরের মেয়েকে পছন্দ করেছে। ফ্যানি তো শুধু গরিব ঘরের মেয়ে তাই নয়, সে বার্ট্রাম পরিবারে আশ্রিত, তাই অর্থনৈতিক স্ট্যাটাস বা সামাজিক ক্লাস কোনটাই তার নেই। তবে এই বিয়ে হলে এডমন্ডের সঙ্গে তার নিজের মেলামেশার সুযোগ বেড়ে যাবে এই ভেবে মেরি শুধু খুশি হয়ে ওঠে তাই নয়, সে ফ্যানিকে হেনরিকে বিয়ে করতে রাজি করাতে রীতিমত উদ্যমী হয়ে ওঠে।

সকলের সব ইচ্ছেয় জল ঢেলে ফ্যানি তার নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। এই একবার তাকে নিজের ইচ্ছেতে কিছু করতে দেখে যায়। স্যর বার্ট্রাম, মেরি, এমন কী এডমন্ডও তাকে এই বিয়েতে রাজি করাতে পারে না। হেনরিকে বিয়ে করলে ওর কতটা সামাজিক উত্তরণ হতে পারে, সেই সবের তোয়াক্কা না করে ফ্যানি নিজের সিদ্ধান্তে স্থির থাকে। ফ্যানির কাছে অর্থ নয়, ভালোবাসাই বিয়ে করার কারণ হওয়া উচিত। সে যে শুধু হেনরিকে বিশ্বাস করে না তাই নয়, সে তো এডমন্ডকে ভালোওবাসে! যেখানে মারিয়া অর্থের কারণে বিত্তশালী জেমস রাসওর্থকে বিয়ে করে, মেরি পাদ্রি এডমন্ডকে বিয়ে করতে দ্বিধান্বিত হয়, স্যর টমাস বার্ট্রাম চান ফ্যানি হেনরিকে বিয়ে করুক, সেখানে ফ্যানি নৈতিকতার জায়গায় কোনও আপস করতে রাজি নয়। তাতে যদি তাকে স্ট্যাটাস হারাতে হয় তবুও। স্যর বার্ট্রাম তাকে মনে করিয়ে দেন যে ফ্যানি তাঁর সাহায্যেই বড় হয়েছে, তাই তার বাধ্য থাকাটা অবশ্য কর্তব্য। মেরি ও এডমন্ডও ফ্যানিকে এই বিয়ের সামাজিক ও অর্থনৈতিক তাৎপর্য বোঝাতে কসুর করে না। তখনও ফ্যানির বক্তব্য, কোন পুরুষ পছন্দ করেছ বলেই যে একজন মেয়েকেও বিয়েতে রাজি হতে হবে, এরকম কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।

এরপর নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আসে উপন্যাস। ফ্যানির থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে হতাশ হেনরি আবার মারিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। মারিয়া তার স্বামী জেমস রাসওর্থকে ছেড়ে হেনরির সঙ্গে ইলোপ করে। জেমস রাসওর্থ ও মারিয়ার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। হেনরি কিন্তু মারিয়াকে বিয়ে করে না। তাই শেষ পর্যন্ত মারিয়া তার সামাজিক প্রতিপত্তি, সমাজ ছেড়ে দূরে গিয়ে থাকতে বাধ্য হয়। মেরির নানান কার্যকলাপে শেষ পর্যন্ত এডমন্ড মেরির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। উপন্যাসের শেষে দেখা যায় এডমন্ড ফ্যানির প্রতি তার টান ও ভালোবাসা বুঝতে পারে ও ফ্যানি ও এডমন্ড শেষ পর্যন্ত বিয়ে করে। দ্য হ্যাপি এন্ডিং!

দুশো বছর আগে প্রকাশিত ম্যান্সফিল্ড পার্ক আজও পাঠক সমাজে যথেষ্ট সমাদৃত এক সাহিত্য সৃষ্টি। সামাজিক আধারে রচিত উপন্যাসটি তৎকালীন ব্রিটিশ সমাজের চিত্র তুলে ধরে। বিত্ত ও বৈভবশালী সমাজের নীতিহীনতা, দেখনদারি, সামাজিক উত্তরণের সিঁড়ি হিসেবে বিয়ের ব্যবহার, এসবকিছুর সঙ্গে প্রেম ও যৌনতার মিশেল ম্যান্সফিল্ড পার্ক উপন্যাসটিকে এক অনন্য মাত্রা দান করেছে। দুশো বছর আগে যে বিত্তশালী সমাজের কথা, ক্লাস, স্ট্যাটাসের বুনন এই উপন্যাসে স্থান পেয়েছে, সে সব কিছুই আজও সমানভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। তাই আজও দেখা যায় বড়লোকের বাড়ির বিয়ে নিয়ে মাতামাতি, আজও মনে করা হয় মেয়েদের জন্য বিয়ে – বিশেষ করে বিত্তশালী পরিবারে বিয়ে তাদের  সামাজিক অবস্থানকে মজবুত করে।   

বিত্তশালী পরিবারে বড় হয়ে ওঠা ফ্যানির মধ্যবিত্ত নৈতিক গঠন তাকে এক অন্যরকম ভালোত্ব দেয়। আজকের সমাজেও আমরা সাধারণত মেয়েদের মধ্যে এই ভালোত্ব খুঁজতে চাই। ফ্যানির সময়ে মেয়েদের আইনি অধিকার প্রায় কিছুই ছিল না বলা চলে। আজকে মেয়েদের অবস্থান সেদিক থেকে অনেকটাই উন্নত হয়েছে। মেয়েদের, বিশেষ করে বিবাহিত মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার, কাজের অধিকার, নিজস্ব মতামতের অধিকার, এরকম অনেক কিছুই আজ আইনত স্বীকৃত। কিন্তু আমাদের চারিপাশে তাকালে আজও নরমসরম, নিজের ইচ্ছেয় কিছু না করা, অনেক অন্যায় মুখ বুজে সয়ে যাওয়া অজস্র ফ্যানিকে কি দেখতে পাই না?