জেন অস্টেনের 'এমা' প্রসঙ্গে দু চারটি কথা
- 16 December, 2024
- লেখক: তৃষিতা ঘোষ
'এমা' জেন অস্টেনের উপন্যাসধারায় একটু অন্যরকম। পাঠকেরা একটু তলিয়ে ভাবলেই দেখবেন এক দিক থেকে এই উপন্যাস জেন অস্টেনের আর পাঁচটি উপন্যাসের থেকে একদম আলাদা। জেন অস্টেনের সবকটি উপন্যাসেই নায়িকারা শুরুতে কোণঠাসা অবস্থায় থাকে। সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটির এলিয়নর ও ম্যারিয়ানে, প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস এর জেন ও এলিজাবেথ, ম্যান্সফিল্ড পার্ক এর ফ্যানি প্রাইস, নর্দাঙ্গার অ্যাবির ক্যাথরিন মোরল্যান্ড, পারসুয়েশন এর অ্যানে এলিয়ট – সকলেরই হয় অর্থ সম্পত্তির সমস্যা, না হয় প্রেম ভেঙে যাওয়ার সঙ্কট। কিন্তু এমার এসব সঙ্কট নেই। সে অভিজাত বংশের এবং প্রভূত সম্পদের অধিকারিনী। বিয়ে করার ইচ্ছে বা বাধ্যবাধকতা – কোনওটাই তার নেই। এমার জীবনেও অবশ্য সঙ্কট আসে, কিন্তু তার প্রকৃতি আলাদা। সেটা আসে খানিকটা তার অহংকার, আর খানিকটা অন্য মানুষ ও তাদের জীবন পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে যাবার অদম্য আগ্রহ থেকে। সেই চারিত্রিক সমস্যা থেকে আত্ম-উপলব্ধির সূত্র ধরে এমার উত্তরণই হল এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু। 'সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি'র নায়িকা ম্যারিয়ানের আবেগ সর্বস্ব রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গীর বদল বা 'নর্দাঙ্গার অ্যাবি'র নায়িকা ক্যাথরিনের গথিক নভেলের স্বপ্ন জগৎ সম্পর্কিত ধারনা পরিবর্তন থেকে এমার আত্মোপলব্ধির বিষয়টি একেবারে আলাদা ধরনের এক ব্যাপার।
এমার আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য এর উপস্থাপণের আলাদা ধরন। এই গল্পের চরিত্রগুলোকে জেন অস্টেন অনেক সময়েই বিদ্রুপ মিশিয়ে উপস্থাপণ করেছেন, যা জেন অস্টেনের অন্যান্য উপন্যাসে সচরাচর দেখা যায় না। হয়ত এজন্যই জেন অস্টেনের নিজেরও খানিক সন্দেহ ছিল তাঁর এই নায়িকা যথেষ্ট জনপ্রিয় হবেন কীনা। লেখিকার কৌতুকপ্রদ উক্তি আমাদের জানা আছে - "I am going to take a heroine whom no one but myself will much like." তবে অস্টেনের এই আশঙ্কা সত্যি হয় নি। সেকাল থেকে একাল, সাধারণ পাঠক থেকে ধীমান সাহিত্য সমালোচক – সকলেই ‘এমা’কে অসামান্য সৃষ্টি বলে স্বীকার করে নিয়েছেন।
কিছু ভিন্নতা সত্ত্বেও এই উপন্যাস জেন অস্টেনের সিগনেচার স্টাইলের বাইরের বিষয় একেবারেই নয়। জেন অস্টেনের অন্যান্য সমস্ত উপন্যাসের মতো এখানেও রয়েছে অস্টেনের কৌতুক মেশানো প্রসন্নতার পরিচিত স্পর্শ। নানা সামাজিক স্তরের শ্রেণি বৈশিষ্ট্যগুলো অস্টেনের উপন্যাসে সব সময়েই সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। এমাও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে অস্টেনের উপন্যাসে ইংলণ্ডের সেকালের নোবেলিটি ও ল্যান্ডেড জেন্ট্রিদের কথাই সাধারণভাবে বেশি করে আসে। এখানে আমরা পাই রবার্ট মার্টিন নামের এক সাধারণ কৃষক ও তার পরিবার সম্পর্কে বিস্তারিত কথাবার্তা। এই দিক থেকেও অস্টেনের উপন্যাসধারায় ‘এমা’ খানিকটা ব্যতিক্রমী।
আসা যাক এমা চরিত্রটির কথায়। একুশ বছরের যুবতী এমা উডহাউস এই উপন্যাসের প্রোটাগনিস্ট। সে তার বাবার সঙ্গে হাইবেরির এক কাল্পনিক গ্রাম হার্টফিল্ডে থাকে। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান এমাকে লেখিকা কিছুটা যেন 'স্পয়েল্ড চাইল্ড' হিসাবেই তুলে ধরেছেন বলে অনেকে মনে করেন। এমা মনে করে দুনিয়া সম্পর্কে সে তার চারপাশের মানুষদের থেকে একটু বেশিই অবগত। আর এই নিয়ে তার রয়েছে এক অসম্ভব তৃপ্তি ও গরিমা। সে নিজের চারপাশে এক ফ্যান্টাসির জগৎ তৈরী করে নেয় ও সেই ফ্যান্টাসির দুনিয়ায় বেশিরভাগ সময় অতিবাহিত করে। সেই কাল্পনিক বুদবুদের জগতে সে সর্বজ্ঞানী। তার আশেপাশের মানুষদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার তার আছে বলে সে ধরে নেয়। অবতীর্ণ হয় তাদের প্রেম ভালোবাসার ঘটক হিসেবে।
মানুষের মনস্তত্ত্ব বুঝতে পারা নিয়ে এমার রয়েছে এক বিরাট অহংকার। যদিও বাস্তবে এমার মধ্যে এই গুণ আদৌ কতটা আছে, সে সম্পর্কে পাঠক ক্রমেই সন্দিহান হতে থাকেন। সম্পর্কের জটিলতা বা গভীরতার বাস্তবতা না বুঝেই এমা তার আশেপাশের মানুষের ঘটকালির দায়ভার নিয়ে নেয়। তার রাশভারী অহমিকাই তাকে এই অ্যাডভেঞ্চারের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। পরিশেষে অনেক সময়েই দেখা যায় এই অ্যাডভেঞ্চারের পরিণাম তার এবং তার পার্শ্ববর্তী মানুষদের জন্য খুব একটা সুখকর হচ্ছে না। সে যেভাবে হ্যারিয়েটকে প্রভাবিত করে তাকে রবার্ট মার্টিনের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিজের ইচ্ছাপূরণের জন্য ফিলিপ এলটনের দিকে ঠেলে দেয়, তা এলটন, মার্টিন, হ্যারিয়েট - সবার জীবনকেই প্রভূত সংকটে ফেলে। এখানেই চলে আসে জেন অস্টেনের অন্য ধারার বিদ্রুপাত্মক রচনারীতিটি। এই উপন্যাস তিনি নায়িকার দৃষ্টিকোণ দিয়ে লেখেন নি। বরং নায়িকার প্রতি কথকের স্বরটি সমালোচনা ও হালকা ভারি বিদ্রুপে পরিপূর্ণ। মিস্টার নাইটলে, উপন্যাসে দীর্ঘ সময় জুড়ে যিনি মূলত এমার আত্মীয়, প্রতিবেশী, বন্ধু এবং সমালোচক, তার স্বরই বরং কথকের স্বরের কাছাকাছি। উপন্যাসে শেষে নায়িকার আত্মোপলব্ধি এবং চরিত্র বদল ঘটে আর এই পরিবর্তন মিস্টার নাইটলের প্রতিবেশী বন্ধু থেকে প্রেমিক ও স্বামীতে রূপান্তরের সঙ্গে মিলে যায়।
এমা উপন্যাসে অস্টেন চরিত্রগুলোর মধ্যে বিভিন্ন আলোছায়ার বুনন এনেছেন। হ্যারিয়েটকে ঘিরে চরিত্রগুলোর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব, মতভেদ চরিত্রগুলোর মানসিকতা বিশ্লেষণের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক যা লেখক সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। সামাজিক স্তরে শ্রেণি বৈষম্য অনুসারে মানুষের মধ্যে সূক্ষ্ম বিভেদ নজরে পরে।
উপন্যাসের দ্বিতীয় অংশ এমার সেই অহমিকা – সে নাকী সহজে মানুষের মনস্তত্ত্ব বুঝে ফেলে এবং তাদের ভাগ্যের উপযুক্ত নির্মাতা হতে পারে - প্রশ্নর মুখে পড়ে। এখানে এমা চার্চিল এবং জেনের চরিত্র বিশ্লেষণে ব্যর্থ হয়। ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার পরিবর্তে এমার করে যাওয়া ভুলের পুনরাবৃত্তি শুধু তার চারপাশের দুনিয়াকে নয়, নিজেকে চেনার অক্ষমতাকেও তুলে ধরে। তবে প্রথমদিকে এমার এই অক্ষমতা তার কাছে স্পষ্ট ছিল না। বরং মানুষ চেনার এবং মানুষের সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করতে পারা সম্পর্কে এক অলীক আত্মবিশ্বাসজাত অহমিকা তার ছিল। উপন্যাসে সেই অহমিকা ধীরে ধীরে নানা বাধাবিঘ্ন, অপমান, বিদ্রুপ, ঘাত প্রতিঘাতের মুখোমুখি হতে থাকে। ক্রমশ এমা আত্মবিশ্লেষণ এবং আত্মউপলব্ধির পর্যায়ে উর্ত্তীর্ণ হয়।
এমার ভুল থেকে সঠিক পথে প্রত্যাবর্তনের ছকটি অন্যান্য অস্টেন উপন্যাসের থেকে আলাদা। অস্টেনের অন্যান্য নায়িকারা – যেমন সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটির ম্যারিয়ান ড্যাশউড - উইলোবির মতো ভুল মানুষের প্রেমে পড়ে নাস্তানাবুদ হয়। প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস এর এলিজাবেথও অনেক ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে অবশেষে সঠিক মানুষকে বেছে নেয় জীবনসঙ্গী হিসেবে। কিন্তু এমা এখান থেকে আলাদা। তার প্রেম সম্পর্কে উদাসীনতাই এই ভিন্নতার কারণ। কিন্তু উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্বর শেষে নাটকীয়ভাবে এমা নিজেকে এক নতুন জায়গায় খুঁজে পায়। তার মনে হয় সে যেন চার্চিলের প্রতি অনুরক্ত।
উপন্যাসের তৃতীয় তথা শেষ পর্বে এসে লেখক সুন্দরভাবে কাহিনীর সব জটগুলো খুলেছেন। প্রত্যেকটি ঘটনার তাৎপর্য স্ফটিকের মতো সামনে এসেছে। প্রতিটি চরিত্রের সীমাবদ্ধতা উন্মোচিত হয়েছে। শেষলগ্নে এসে এমার আত্ম-উপলব্ধি, অতীতের ভুলের জন্য অনুশোচনা তাকে অহংকার থেকে আত্মজ্ঞানের দিকে নিয়ে যায়। দুজন মানুষের পরস্পরের প্রতি সম্মান, বিশ্বাস এবং উন্নতস্তরের বোঝাপড়াই যে সম্পর্কের মূল চাবিকাঠি – সে কথা জেন অস্টেন তাঁর সব লেখাতেই বলেন ও বোঝান। এমাতেও জেন অস্টেন আরেকবার সে কথাই এক অন্য ছকে ও ভঙ্গীতে বললেন।