সইকথা - জেন অস্টেনের উপন্যাসে মেয়েদের বন্ধুত্ব

উনিশ শতকের প্রথম দিক। ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ারের ছোট্ট গ্রাম চাওটন। মধ্য ত্রিশের  লেখিকা জেন অস্টেন তাঁর উপন্যাস Sense and Sensibility র চূড়ান্ত খসড়া তৈরি করছেন। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এই লেখিকা লিখতে এবং আগের খসড়া পরিমার্জন করে জন্ম দিতে চলেছেন বেশ কয়েকটি উপন্যাসের, যা পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে বিশ্বসাহিত্যের আলোচনার কেন্দ্রে রয়ে যাবে। এগুলির নাম এখন সবারই জানা – Sense and Sensibility, Pride and Prejudice, Emma, Mansfield Park, Northanger Abbey এবং Persuasion। প্রতিটি উপন্যাস নারী কেন্দ্রিক - আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বিবাহ কেন্দ্রিক। প্রতি উপন্যাসেই প্রায় দেখা যায় ইংল্যান্ডের সম্ভ্রান্ত বংশীয় কিন্তু আর্থ-সামাজিক দিক থেকে অসুরক্ষিত নারী কিভাবে বিবাহ অভিযানের মাধ্যমে  নিজের সাংস্কৃতিক বলয়ের মধ্যে তার  নিরাপত্তাকে সুরক্ষিত করছে। কিন্তু সুকৌশলী জেন গল্পের নায়িকার রোমান্টিক স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশার এক রূপকথার  কাঠামোর পরতে পরতে বলে চললেন এক ভিন্নতর গল্প - যে গল্পের প্রতিপাদ্য শুধুমাত্র নারী- পুরুষের সম্পর্কের রসায়ন নয় , নারীর সাথে নারীর - তাদের বন্ধুত্বের, তাদের না হওয়া বন্ধুত্বের।

Henry James তাঁর The Ambassadors এর পূর্বকথায় বলেছিলেন প্রতিটি উপন্যাস একই সাথে দুটি গল্প বলে - নায়কের গল্প এবং লেখকের সৃষ্টিসচেতন সত্তার গল্প। উনিশ শতকে লেখাকে নেশা এবং পেশা হিসেবে নেওয়া অবিবাহিতা জেন বিবাহের মাধ্যমে নারীর অস্তিত্ব রক্ষার তাড়নাকে কৌতুক কটাক্ষ করে বলে চললেন এক অকৃত্রিম ভালবাসার গল্প। কিন্তু এরও সমান্তরালে লেখা হতে থাকলো অন্য এক কথন - সই কথা, নারীর একান্ত সাহচর্যের গল্প। উনিশ শতাব্দীতে উপন্যাসের মতো পুরুষ নির্দেশিত genre এও জেন এক মেটা ন্যারেটিভ তৈরি করতে পারলেন।

সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি

১৮১১ সালে জেন তার দিদি ক্যাসান্দ্রা কে লেখা চিঠিতে জানান, Sense and Sensibility সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করার জন্য তিনি কখনোই খুব বেশি ব্যস্ত নন, " I can no more forget it then a mother can forget her sucking child..."। সন্তান সম এই সৃজনের  নানা মুহূর্তে অস্টেনের ব্যক্তি জীবনের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই।  আমৃত্যু জেন এর সঙ্গে থাকা তার দিদি ক্যাসান্দ্রার সাহচর্য এই উপন্যাসের দুই নায়িকার সম্পর্কেও প্রতিফলিত হয়েছে। এমন ভাবেই এসেছে জ্যেষ্ঠ সন্তানের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারের ফলশ্রুতিতে অন্যান্য সন্তানদের আর্থিক অনিশ্চয়তার জটিল সামাজিক পরিকাঠামো।  যাজক পরিবারের সপ্তম সন্তান জেন তার নিজের সামাজিক অবস্থান থেকে বুঝেছিলেন বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটি তার সমকালীন অনেক নারীর কাছেই এক আর্থ সামাজিক রক্ষাকবচ। জেনের নিজের বিবাহ প্রস্তাব এসেছিল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তা ফিরিয়েও দিয়েছিলেন। ভাইঝি ফ্যানি কে চিঠিতে লিখেছিলেন, " Anything is to be preferred or endured rather than marrying without affection"। তাঁর এই ব্যক্তিগত বিশ্বাসের চরিত্রায়ন করেছে তাঁর নায়িকারা। পতনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তারা বিবাহকে  বাধ্যতামূলক সামাজিক বিধি হিসেবে নেয়নি। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সমীকরণ জেনেই তারা এগিয়েছে প্রিয় পুরুষের দিকে।

এলিনর এবং মারিয়ান এই নামে প্রথম খসড়া হলেও পরে  এই উপন্যাসের নামকরণ হয় Sense and Sensibility। ড্যাশউড পরিবারের তিন কন্যা এলিনর, মারিয়ান এবং মার্গারেট। সুন্দরী এলিনরের বিবাহের বয়স প্রায় অতিক্রান্ত, মারিয়ান সদ্যযুবতী, সুন্দরী , প্রাণ চঞ্চল এক নারী। Primogeniture এর জটিলতায় তাদের সদ্যবিধবা মাকে নিয়ে তারা প্রায় নিজগৃহে পরবাসী। কারণ এই আইন অনুসারে শুধুমাত্র জ্যেষ্ঠ সন্তানের সম্পত্তিতে অগ্রাধিকার। তাদের বৈমাত্রেয় ভাই হেনরি  ড্যাশউড বর্তমান নর্ল্যান্ড এস্টেটের মালিক। হেনরির স্ত্রী ফ্যানি তার ভাই এডওয়ার্ডের সঙ্গে এলিনরের ঘনিষ্ঠতা  সুনজরে দেখেনা। মিসেস ড্যাশউডকে তাই তিন মেয়েকে নিয়ে চলে যেতে হয় বার্টন পার্ক। সংযত, সুসংহত এলিনর বোঝে এডওয়ার্ডের সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়ে ওঠা সহজ নয়। কারণ মিসেস ফেরার্স কখনোই সম্পত্তিহীন কোন নারীর সাথে তার ছেলের বিবাহ দেবেন না। বার্টন পার্কে তাদের সমাদরে অভ্যর্থনা জানান সার জন, লেডি মিডলটন এবং তার মা মিসেস জেনিংস। লেডি মিডলটনের পরিশীলিত শীতল বন্ধুত্বের বৈপরীত্যে মিসেস জেনিংসের ঈষৎ স্থুল কিন্তু উষ্ণ বন্ধুত্ব সদ্য আগত  তিন নারীর মধ্যে ভিন্ন মাত্রায় উপস্থিত হয়। প্রাণবন্ত, উচ্ছল মারিয়ানের জীবনে এ সময় নাটকীয় প্রবেশ ঘটে উইলোবীর। Damsel in distress কে উদ্ধার করে তরুণ সুপুরুষ উইলোবী ম্যারিয়ানের মনে নায়কের আসন দখল করে। সে প্রেমে পড়ে উইলোবির। এলেনার এর সাবধানবানী সত্ত্বেও ম্যারিয়ান উইলোবীর ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। সে মনে করে অতি সংযত ব্যবহার  এলিনরের পরিণয় প্রস্তাবের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে বয়সে সামান্য বড় ,সংযত কর্নেল ব্র্যান্ডন  মারিয়ান এর রূপে মুগ্ধ। মেরিন যখন উইলোবির কাছ থেকে বিবাহ প্রস্তাব পাবার প্রত্যাশা করে আছে সেই সময়েই হঠাৎ উইলবী তাকে ছেড়ে লন্ডন চলে আসে। অনুভূতির চরম  সীমায় থাকা মারিয়ান প্রবল ভাবে বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে স্যার জনের বাড়িতে এলিনরের সাথে সাক্ষাৎ হয় লুসি স্টিলের- যে জানায় সে এডওয়ার্ড ফেরার্সের বাগদত্তা এবং এই কথা গোপন রাখার জন্য  এলিনর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। সম্পত্তির অধিকারহীন দুই বোনের বিবাহের মাধ্যমে সুস্থ সমাজ জীবনে প্রবেশের অধিকার হঠাৎ করেই অধরা হয়ে যায়। এই সময় থেকেই এলিনার এবং ম্যারিয়ানের শোকযাপনের ইতিহাস পরস্পরের বৈপরীত্যে অবস্থান করতে থাকে।

মিসেস জেনিংস এ সময় প্রস্তাব দেন তিনি এলিনর মারিয়ান এবং লুসি কে নিয়ে লন্ডন যাবেন। ম্যারিয়ান খুশি হয়ে ওঠে কারণ সে উইলোবীর সঙ্গে দেখা করতে পারবে। লন্ডনে এসে এক বল ড্যান্সের মাঝে সে উইলবীকে দেখতে পায়।  কিন্তু তার প্রেমিক উইলবী শুধুমাত্র সৌজন্য বিনিময় টুকুই করে এবং পরে চিঠিতে জানায় সে অন্য কোন রকম সম্পর্কে উৎসাহী নয়। পরে জানা যায় সে বহু সম্পত্তির অধিকারিনী একটি মেয়েকে বিয়ে করতে চলেছে। তুমুল বিষাদ গ্রাস করে ম্যারিয়ানকে। তার স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। তাকে নিয়ে এলিনর ফিরতে চায় বাড়িতে। ইতিমধ্যে লুসি - এডওয়ার্ড  সম্পর্ক সকলের সামনে আসে এবং মিসেস এডওয়ার্ডকে সম্পত্তিচ্যুত করেন। কর্নেল ব্র্যান্ডন এই সময় এলিনরের মাধ্যমে এডওয়ার্ড কে তার প্যারিশ (খানিকটা গ্রাম স্বশাসনের মতো) এর দায়িত্ব দিতে চান। ফলে এডওয়ার্ড লুসির বিবাহে আর কোন বাধা থাকে না। সমস্ত ঘটনা ম্যারিয়ান কে স্তম্ভিত করে দেয়, আরও বিস্মিত সে হয় এটা বুঝে এমন তীব্র শোক এলিনর একা বহন করে গেছে তাকে বুঝতে না দিয়ে । ভগ্ন স্বাস্থ্য মারিয়ান কে নিয়ে এলিনর বাড়িতে ফেরার সময় সে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। এই সময় অভিভাবকের মত তাদের পাশে থাকে কর্নেল ব্র্যান্ডন । ফিরে এসে মারিয়ান এলিনারকে জানায় সে নিজের আচরণের সঙ্গে এলিনারের আচরণের তুলনা করছে। দুজনেই প্রেমে প্রত্যাখ্যাত। কিন্তু যে শান্ত মর্যাদার সঙ্গে ইলিনর এই প্রত্যাখ্যান গ্রহণ করেছে মারিয়ান সেটা পারেনি। এইখান থেকেই আমরা দুই বোনের পারস্পরিক নির্ভরতার, কষ্টকে ভাগ করে নেওয়ার এক অবিস্মরণীয় আখ্যান শুরু হতে দেখি। পুরুষের জন্য প্রতিযোগিতায় জর্জরিত দুই নারী তাদের পরস্পরের মধ্যে মানসিক স্থিতাবস্থা খুঁজে পায়। লুসি স্টিলের এলিনরের প্রতি মেকি বন্ধুত্ব কখনোই সাবলীল হয়ে উঠতে পারে না কারণ একটি মাত্র পুরুষের  দুজনের জীবনের উপস্থিতির জন্য।

এরপর এক চরম নাটকীয় মোচড়ে এডওয়ার্ড আসে ফিরে এলিনরের জীবনে, জানায় লুসি বিবাহ করেছে তার ভাই রবার্ট ফেরার্সকে এবং এডওয়ার্ড এখন প্রতিশ্রুতি থেকে মুক্ত। এলিনর বিবাহ করে এডওয়ার্ডকে। পরবর্তী ক্ষেত্রে ব্রান্ডনের অবিচল, নীরব প্রেম গৃহীত হয় ম্যারিয়ানের কাছে। বিপুল সম্পত্তির অধিকারিণী হয় সে।

জেন অস্টেন তার ব্যক্তিগত জীবনেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মধ্যে এক নারীবৃত্তীয় ঘেরাটোপে বাস করতেন। তাঁর বোন ক্যাসান্দ্রা, ভাইঝি ফ্যানি, গভারনেস অ্যান শার্প যে চিন্তাশীল নারীদের বন্ধুত্ব পরিমণ্ডল গঠন করেছিল - তা তাঁর প্রাথমিক দুই উপন্যাসে নিশ্চিত ছাপ ফেলেছে। এলিনর এবং ম্যারিয়ানের সাবলীল বন্ধুত্বের সমীকরণ পরস্পরকে ঋদ্ধ করে - তারা একে অন্যের মাপকাঠিতে নিজেকে যাচাই করে। এই বন্ধুত্ব প্রায় কষ্টিপাথর হয়ে দাঁড়ায় অন্যান্য  নারীদের সম্পর্ক গুলোর স্বচ্ছতা জানার জন্য।  এমনই পারস্পরিক নারী সম্পর্কের অভিযোজন আমরা দেখতে পাই Pride and Prejudice এও।

প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস

প্রায় মিনিয়েচার আর্টিস্টের এর দক্ষতায় জেন যখন ইংল্যান্ডের গ্রামীণ সম্ভ্রান্ত নারীদের জীবনের  ছবি এঁকে চলেছেন, তার প্রিয়তম চরিত্রের কথা বলতে শুরু করেন Pride and Prejudice উপন্যাসে। প্রাথমিকভাবে এই উপন্যাসের নামকরণ করা হয়েছিল First Impresssions, 1813 সালে লেখা এক চিঠিতে তিনি পুনরায় সেই মাতৃত্বের রূপক ব্যবহার করে একে বলেন , "my own darling child"। এই উপন্যাস শুরুই হয় এক আলোড়ন তোলা বাক্য দিয়ে- "It is a truth universally acknowledged that a single man in posession of a good fortune must be in want of a wife." এই উপন্যাস বলে এলিজাবেথ এবং মিস্টার ডার্সির গল্প , তাদের দম্ভ - তাদের পারস্পরিক ভ্রান্ত ধারণাকে পেরিয়ে পরস্পরকে ভালোবাসার গল্প। কিন্তু একই সাথে এই উপন্যাস সমান্তরালে বয়ে নিয়ে যায় এলিজাবেথ এবং শার্লটের এর গল্প- এলিজাবেথ এবং জেনের গল্প এমনকি অন্যান্য বেনেট বোনেদের গল্পও।

যে সমস্যা নিয়ে Sense and Sensibility শুরু হয়েছিল সেই সমস্যাটির পুনরাবৃত্তি হতে দেখি এই উপন্যাসেও। কিন্তু এখানে পিতা মৃত নন অথচ তার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার সম্ভাবনা তার মেয়েদের নেই। এমতাবস্থায় নেদারফিল্ড আসেন মিস্টার বিংলে এবং মিস্টার ডার্সি - বিপুল সম্পদের উত্তরাধিকারী দুই সুপুরুষ তরুণ। মিসেস বেনেটের তার মেয়েদের বিয়ে দেবার অত্যুগ্র বাসনা প্রায় ক্যারিকেচারের মতো লাগলেও তা এক ভয়ঙ্কর সামাজিক সত্যকে উন্মোচন করে। সম্পত্তিহীন অবিবাহিতা নারীর অন্যের সংসারে দায় হিসেবে কাটানোর ভবিষ্যতে মায়ের আশঙ্কা। একাধিক বল ডান্সের আসরে এই দুই পুরুষের সাথে পরিচিত হতে থাকে বেনেট বোনেরা- মূলত এলিজাবেথ এবং জেন। বিংলে প্রকৃতভাবেই আকৃষ্ট হয় জেনের প্রতি। মিস্টার ডার্সি প্রাথমিকভাবে এলিজাবেথকে অগ্রাহ্য করলেও সেও আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এলিজাবেথের প্রতি। বিংলের বোনেদের আমন্ত্রণে জেন তাদের বাড়িতে উপস্থিত হলে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং এলিজাবেথ যায় তাকে দেখতে। মিস্টার ডারসি কে নিয়ে মিস বিংলের এলিজাবেথের প্রতি সূক্ষ্ম ঈর্ষা আর অনুচ্চার থাকে না। এই সময় নেদারফিল্ডে আসেন তাদের সম্পত্তির পরবর্তী উত্তরাধিকারী মিস্টার কলিন্স। তিনি ক্ষতিপূরণের হিসাবে এলিজাবেথকে বিবাহ প্রস্তাব করেন। স্থুল, হাস্যকর কলিন্সের সাথে বিবাহ এক স্থিতিশীল জীবনের সূত্রপাত করতে পারে জেনেও এলিজাবেথ মুহূর্তের মধ্যে তা নস্যাৎ করে দেয়। কারণ সে কলিন্সকে না ভালোবাসে, না শ্রদ্ধা করে। অন্যদিকে মিস্টার ডারসির তীব্র উন্নাসিকতায় এলিজাবেথের মনে চরম বিরাগের জন্ম হয়। এই সময় তার বান্ধবী  শার্লট মিস্টার কলিংস এর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়ে তার নিকট হতে বিবাহ প্রস্তাবকে সুরক্ষিত করে। এযাবৎকাল এলিজাবেথের সাথে শার্লটের নিখাদ বন্ধুত্বে এক অদ্ভুত ছেদ করে এই ঘটনা। শার্লট তাকে জানায়, সে বিবাহের রোমান্টিকতায়  বিশ্বাস করে না, বয়স্ক অনূঢ়া শার্লটের কাছে বিবাহ  জীবনধারণের উপায় । অন্যদিকে মিসেস বেনেটকে আশাহত করে মিস্টার বিংলেও চলে যায় লন্ডনে। কারণ বেনেট পরিবারের সঙ্গে যে কোন সম্পর্ক বিংলের বোনেদের কাছে একেবারেই কাম্য নয়। এই সময় তাদের জীবনে আসে উইকহ্যাম -এক নবীন সৈন্য যে জানায় ডার্সির দ্বারা সে বিভিন্নভাবে অপদস্ত হয়েছে। ফলে ডারসির বিরুদ্ধে এলিজাবেথের মনোভাব আরো সুদৃঢ় হয়। উইকহামের সাথে বন্ধুত্ব বাড়তে থাকলেও এলিজাবেথ জানে বিবাহ পর্যন্ত অগ্রসর হওয়ার আর্থিক নিশ্চয়তা উইকহ্যাম তার মধ্যে দেখবে না।

এরপর শার্লটের আমন্ত্রণে এলিজাবেথ যখন তাদের বাড়িতে যায় তার পুনরায় দেখা হয়ে যায় মিস্টার ডার্সির সাথে। মিস্টার  ডার্সি তাকে জানান তার নিম্নরুচির পারিবারিক সংস্রব সত্ত্বেও তিনি এলিজাবেথকে ভালবাসেন এবং বিয়ে করতে চান। চূড়ান্ত অপমানিত এলিজাবেথ অবিবাহিত জীবন প্রায় নিশ্চিত জেনেও এই প্রস্তাব অক্লেশে ফিরিয়ে দেয়। এইখানেই আমরা দেখি যে শার্লটের সঙ্গে সে আগে ডার্সির প্রথম অপমান ভাগ করে নিয়েছিল এখন সে শার্লটকে আর কিছুই বলে না। দুই বন্ধুর মধ্যে দুরত্ব স্পষ্ট হতে থাকে। যেমন স্পষ্ট হতে থাকে এলিজাবেথের সঙ্গে জেন ব্যতীত অন্যান্য বেনেট বোনেদের দূরত্বও। লিডিয়া এবং কিটির অসংযত, বেহিসাবি আচরণ সম্ভ্রান্ত  সমাজে তাদের বারবার অপদস্থ করে। এই অপমান চূড়ান্ত হয় যখন লিডিয়া  উইকহ্যামের সাথে পালিয়ে যায় এলিজাবেথ সেই সময় পুনরায় দেখা পেয়েছে ডার্সির। তার বিশাল এস্টেট তার মনে এক অদ্ভুত মুগ্ধতার জন্ম দিয়েছে। ডার্সির বোন এলিজাবেথের প্রতি অকপট বন্ধুত্ব প্রকাশ করেছে। ইতিমধ্যে ডার্সির চিঠিতে উইকহ্যামের সত্য চরিত্র উন্মোচিত হয়েছে এলিজাবেথের কাছে।  এই সময় ডার্সি পরিত্রাতা হয়ে উইকহ্যামকে  বাধ্য করে লিডিয়াকে বিয়ে করতে । ফলে বেনেট ফ্যামিলি এক নিদারুন কলঙ্কের হাত থেকে বেঁচে যায়।

এলিজাবেথ এবং মিস্টার ডার্সির প্রেম পরিণতি পায় যখন লেডি ক্যাথরিন দি বুর এলিজাবেথকে অপমান করে তার কাছ থেকে কথা নিতে চান সে কখনোই ডার্সির বিবাহ প্রস্তাবে সাড়া দেবে না। এলিজাবেথ এমন কোন প্রতিশ্রুতি দেয় না। নেদারফিল্ডে পুনরায় ফিরে আসেন মিস্টার ডার্সি আর মিস্টার বিংলে। জেনকে বিবাহ প্রস্তাব দেন বিংলে। ডার্সিও এলিজাবেথকে জানান তার প্রতি ডারসির মনোভাব অপরিবর্তিত আছে। এলিজাবেথের কাছে তার বিবাহ প্রস্তাব সাগ্রহে গৃহীত হয়। সমগ্র উপন্যাস জুড়ে দুই প্রধান নায়ক নায়িকার পারস্পরিক মনোভাবের বিভিন্ন ওঠাপড়ার সাথে সাথেই এলিজাবেথের সাথে জেনের , শার্লটের এবং মিসেস গার্ডিনারের সম্পর্কও নায়িকার  চিন্তাজগতের এক ক্রমোন্নতির সূচক হতে থাকে। একদিকে এলিজাবেথ যেমন মেনে নিতে পারে না শার্লটের পেশাদারী বিবাহের মনোভাব কে, আবার মনে মনে সেও জানে জেনের নম্র ,শান্ত প্রেম প্রায় অনুচ্চার প্রেমের শামিল , যা তার বৈবাহিক ভবিষ্যতকে সংকটময় করতে পারে। অন্যদিকে মিসেস গার্ডিনারের ভদ্র ,শিক্ষিত ব্যবহার  ডারসির  সামনে তাকে সম মর্যাদায় উন্নীত করে। মিসেস গার্ডিনারের থেকে পাওয়া চিঠির মাধ্যমে সে তার প্রত্যাখ্যাত প্রেমিককে নতুন আলোকে দেখতে শুরু করে। অন্যান্য নারীদের মূল্যায়ন এলিজাবেথকে  ডারসির পুনর্মূল্যায়নেও সাহায্য করে।  মিস্টার বেনেটের আপাত উপেক্ষা এবং মিসেস বেনেটের কুরুচিকর বিবাহ প্রবণতার মাঝে এলিজাবেথের একমাত্র নিশ্চিন্ত নির্ভরস্থল হয়ে দাঁড়ায় জেনের বন্ধুত্ব। অপরিনামদর্শী লিডিয়া, অপরিণত কিটি এবং সামাজিক অভিযোজনে ব্যর্থ মেরি কেউই এলিজাবেথের বন্ধুত্বের পৃথিবীতে প্রবেশ করতে পারে না। বন্ধুত্ব হয় না মিস বিংলের সাথেও- কারণ আর্থিক কৌলিন্যের অভাব এবং একই পুরুষের জন্য প্রতিযোগিতা। নারীদের বন্ধুত্বের ক্ষেত্রেও আর্থিক এবং শ্রেণীসাম্যের প্রয়োজনীয়তা ধীরে ধীরে পরিস্ফুট হতে থাকে। এই কারণে লেডি ক্যাথরিনের সঙ্গে শার্লটের  সম্পর্ক গ্রহণযোগ্য হলেও তা নিতান্তই প্রতিপালক এবং অনুগৃহীতের হয়ে থেকে যায়। এই শ্রেণীবিভেদকে সহজেই অতিক্রম করেন মিস ডারসি তার সারল্যে এবং এলিজাবেথও ডার্সি পরিবারের উন্নাসিকতা সম্পর্কে তার ধারণা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য  অস্টেন এখানে ভ্রান্ত বন্ধু নির্বাচনের ভয়াবহ পরিণতিও সামনে এনেছেন মিসেস ফরস্টার এবং লিডিয়ার বন্ধুত্বের মাধ্যমে। এই বন্ধুত্ব যেন এক moral  fable যা অলঙ্ঘনীয় সীমারেখাকে নির্দেশ করে। তবে Sense and Sensibility র এলিনর ম্যারিয়ানের পরিপূরক বন্ধুত্ব, Pride and Prejudice এর এলিজাবেথ ও জেনের সাবলীল বন্ধুত্বের থেকে অস্টেন  তার পরবর্তী উপন্যাস গুলিতে অনেকটাই সরে আসেন। ক্রমশই আমরা দেখতে পাই নারীদের বন্ধুত্ব তাদের প্রেম এবং বৈবাহিক জীবনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। Emma এবং Persuasion এ তা অত্যন্ত সুস্পষ্ট।

এমা

সঙ্গত কারণেই Janet Todd অস্টেনের পরবর্তী উপন্যাসগুলোতে এক "distrust of (female) friendship " কে চিহ্নিত করেছেন। Emma উপন্যাসে নায়িকার সামাজিক অবস্থান কিন্তু ভিন্নতর।  এমা বিত্ত, প্রতিপত্তির জোরে হাইবেরি সমাজের সাংস্কৃতিক বলয়ের শিরোমনি। যেহেতু বিবাহ তার কাছে বাধ্যতামূলক নয়, তার থেকে ভিন্ন সামাজিক অবস্থানে থাকা নারীদের বিবাহের মাধ্যমে সমাজে সুরক্ষিত করাকে তার অবসেশন করে তোলে। এক্ষেত্রে তার প্রথম নির্বাচন হয় বংশ পরিচয়হীন হ্যারিয়েট স্মিথ। এমার সাথে তার প্রাক্তন গভরনেস মিসেস ওয়েস্টানের সম্পর্ক যে অনাবিল বন্ধুত্বের সূচনা করেছিল মিস্টার  ওয়েস্টানের সাথে বিবাহ তাতে সামান্য যতি টানে। হারিয়েটের সাথে এমার সম্পর্ক সমান সামাজিক মর্যাদার নয় -  নির্ভেজাল বন্ধুত্বেরও নয়। তাই হ্যারিয়েটের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তাকে বিবাহে প্রতিষ্ঠিত করায় এমার  বিলক্ষণ আত্ম প্রসাদ আছে। এমার নজরে আসে স্থানীয় ভিকার যাকে সে হারিয়েটের পানিপ্রার্থী হিসেবে স্থির করে নেয়। এমার প্রভাবে হ্যারিয়েট ফিরিয়ে দেয় সম্পন্ন কৃষক রবার্ট মার্টিনের প্রস্তাব। কিন্তু অচিরেই এমার ভুল ভাঙে কারণ মিস্টার এলটনের নজরে আছে এমা নিজেই , হ্যারিয়েট নয়। এমা এলটনকে প্রত্যাখ্যান করে। অপমানিত এলটন যখন ফেরে তখন সে বিবাহিত। হারিয়েটের জীবনের উপর এমার  নিয়ন্ত্রণকে প্রবল সমালোচনা করেন এমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও পরম বন্ধু মিস্টার নাইটলি। তীব্র তিরস্কার তিনি তখনও করেন যখন এমা সকলের সামনে মিস বেটসের বৌদ্ধিক তুচ্ছতা নিয়ে উপহাস করে ।

ইতিমধ্যে সম্ভাব্য বৈবাহিক সম্পর্কগুলো নতুন মাত্রা পেয়েছে হাইবেরী সমাজে মিস্টার ওয়েস্টনের প্রথম পক্ষের পুত্র ফ্রাঙ্ক চার্চিলের আবির্ভাবে। সাময়িকভাবে এমা চার্চিলের প্রতি আকৃষ্ট হলেও সে হ্যারিয়েটের পরবর্তী পাত্র হিসেবে চার্চিলকে ভাবতে থাকে। নারী পুরুষের সম্পর্কের সাজানো অংককে  জটিলতর করে দেয় মিস বেটসের আত্মীয়া জেন ফেয়ারফ্যাক্স এর  উপস্থিতি । অনাথা কিন্তু মার্জিত, পরিশীলিত জেনের উপস্থিতি এমার আত্মগরিমাকে ঘা দিয়ে যায়। জেনের মধ্যেই যেহেতু এমা তার প্রতিপক্ষকে খুঁজে পায় সেটাই বুঝিয়ে দেয় একমাত্র জেনই তার প্রকৃত সখী হতে পারতো। অপরদিকে জেনও মনে মনে আহত হতে থাকে চার্চিলের এমার প্রতি  পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের কারণে । একদিকে এমার যেমন আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরতে থাকে যখন হারিয়েট জানায় সে চার্চিলকে পছন্দ করেনা বরং এমার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সে নজর দিয়েছে আরো উঁচুতে তার পছন্দের পাত্র মিস্টার নাইটলি। মুহূর্তের মধ্যে এমা বুঝতে পারে সারা জীবন সে ভালোবেসেছে মিস্টার নাইটলিকেই।

সুতীব্র আক্ষেপে এমা বুঝতে পারে সে আত্মশ্লাঘা এবং গর্বের সাথে অন্যের জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে করতে নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। এই মুহূর্তে অর্থনৈতিকভাবে বিপরীত মেরুতে থাকা জেন ফেয়ারফ্যাক্স এবং এমা উডহাউস এক লিঙ্গ সাম্যের দিকে এগোয় - দুজনেই আত্মসমর্পণ করে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের কাছে। জেন ফ্র্যাংককে বিবাহ করতে বাধ্য কারণ বিবাহ তার বাঁচার রসদ- এমা স্বীকার করে তার বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত ভ্রান্ত,সে যথার্থভাবে মিস্টার নাইটলির পিতৃতান্ত্রিক অনুশাসনে শিক্ষিত হয়ে ওঠে। জেন বিয়ে করে তার থেকে নৈতিকভাবে হীনতর ফ্রাংককে। এমাকে মেনে নিতে হয় তার   স্বতঃপ্রণোদিত  বিবাহ নিরপেক্ষ সত্তা পরিবর্তিত হয়ে গেছে। সাহিত্য সমালোচক রুথ পেরি এই প্রসঙ্গে বলছেন -"This meta narrative the story of the story of Emma reveals how much the imperative to marry costs woman -how it inhibits their range of possible relationships with other woman, makes them dependent on male approval and limits their imaginative and social autonomy."

তাই এমার গল্প শেষ হয় তিনটি বিবাহ দিয়ে, হ্যারিয়েট, জেন, এমা যারা পরস্পরের বন্ধু হয়ে উঠতে পারত তারা হয় কৃপাধন্য অথবা প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে বিবাহ প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে।

নর্দাঙ্গার অ্যাবে

"How uncomfortable it is not to have a single acquaintance here" Northanger Abbey র এই বাক্যই বাথের কেতাদুরস্ত পরিবেশে বন্ধুহীন নারীদের অসহায়তা কে প্রকট করে দেয়। নায়িকা ক্যাথরিন মরলান্ড বন্ধুর পেতে উদগ্রীব। তাই মিসেস অ্যালেনের বাল্যবন্ধু  মিসেস থর্পের মেয়ে ইসাবেলা যখন তার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়ায়, সে নির্ভাবনায় হাত ধরে। দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বের সেতু রচনা করে বই পড়ার অভ্যাস , অবশ্য গথিক উপন্যাস । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য Sense and Sensibility  তে লেডি মিডলটন এলেনর এবং মেরিয়ান কে খানিক অপছন্দ করতেন কারণ," They were fond of reading ."  তাই পাঠকের প্রত্যাশা জাগতেই পারে চিন্তাশীল নারীর বৌদ্ধিক আদান-প্রদানের দিকে তাকিয়ে। এরপর এক বল ডান্স এ ক্যাথরিন এর পরিচয় হয় হেনরি টিলনির সাথে। দুজনেই পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে। কিন্তু থর্প পরিবার এই সম্পর্ক খুব ভালো করে নেয় না। জন থর্প এর আপত্তি সত্ত্বেও ক্যাথরিন থর্প পরিবার ও  টিলনি  পরিবারের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলে। ক ক্যাথরিনের ভাই জেমস এবং ইসাবেলা পরস্পরের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। কিন্তু জেমস এর জন্য  যে বার্ষিক অর্থ ধার্য হয় তাতে ইসাবেলা বিমর্ষ হয়ে পড়ে। ক্যাথরিনকে তা বুঝতে দেয় না এবং বলে দু'বছর অপেক্ষা করার বিষয়টাই তাকে বিষন্ন করে তুলেছে। ক্রমশ ইসাবেলা ফ্রেডরিক টিলনির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ওঠে‌। এই সময় জেনারেল টিলনি ক্যাথরিনকে আমন্ত্রণ জানান নর্দাঙ্গের অ্যাবিতে গিয়ে কয়েক দিন কাটানোর। এতদিন বইতে পড়া সমস্ত  গথিক কল্পনা  তার মনে ভিড় করে আসে। এফবিতে পৌঁছানোর পর সে কল্পনা করে নেয় মিসেস টিলনিকে জেনারেল টিলনি এই অ্যাবিতেই কোথাও অত্যাচার করে বন্দী করেছেন বা খুন করেছেন।  শুরু হয় এলিনার এবং হেনরির সাথে তার এক সুন্দর বন্ধুত্ব। এর মধ্যেই সে জানে ফ্রেডরিকের সাথে সম্পর্কের জন্য জেমসের সাথে সম্পর্ক ভেঙে দিয়েছে ইসাবেলা। কিন্তু এলিনর তার দাদাকে খুব ভালোই চেনে। সে বোঝে এটাও ইসাবেলার মিথ্যে স্বপ্ন। ক্যাথরিনের বেলাগাম কল্পনায় রাশ পড়ে সেই দিন যেদিন হেনরি তাকে  মৃদু তিরস্কার করে । এরপর জেনারেল টিলনি অকস্মাৎ ফিরে এসে হেনরির অনুপস্থিতিতে ক্যাথরিনকে প্রায় একবস্ত্রে বাড়ি থেকে বার করে দেন। একা ক্যাথরিন নিঃসঙ্গ অবস্থায় ফিরে আসে তার বাড়িতে। ক্যাথরিন এতদিনে  বুঝতে পারে গথিক উপন্যাসের মাধ্যমে বাস্তবকে যাচাই করার ভ্রান্তি। অবশেষে হেনরি আসে ক্ষমা চায় এবং বিবাহের প্রস্তাব দেয়। হেনরি বলে ক্যাথরিন এর বাস্তব অনুমান ছিল ভুল কিন্তু প্রবৃত্তি ছিল ঠিক। সত্যই তার মা নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে মারা গিয়েছেন। জেনারেল টিলনি প্রথমে ক্যাথরিনকে বিত্তশালী বলে ভুল করেছিলেন এবং পরে জেনেছিলেন সে কপর্দকহীন।  অবশেষে ক্যাথরিন এর পরিবারের আর্থিক সংগতি জেনে জেনারেল বিবাহে মত দেন। গল্পের প্রাথমিক পর্যায়ে নায়িকাদের বৌদ্ধিক আদান-প্রদানের যে সম্ভাবনা প্রজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল তা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে থাকে। ইসাবেলা পরিণত হয় শিকারী থেকে শিকারে, ক্যাথরিন  বোঝে উদ্ভট কল্পনার জগতের থেকে বাস্তবের ফারাক,  শেখে ভ্রান্ত বন্ধু নির্বাচনের ঝুঁকি। গথিক উপন্যাসের প্যারোডি করেও সচরাচর নায়িকাদের থেকে ভিন্নমাত্রার ক্যাথরিন তার আগের প্রজন্মের আরেক নারীর নির্মম নিয়তি কে সঠিক আন্দাজ করতে ভুল করে না। ঠিক একইভাবে সে ভুল করে না ইসাবেলার পরিবর্তে এলিনরকে বন্ধু হিসেবে বেছে নিতে। ঠিক বন্ধুত্বের কথোপকথন না হলেও এই সই নির্বাচন নিঃসন্দেহে ক্যাথরিন মরল্যান্ড কে একটি অমীমাংসিত স্থানে রেখে দেবে।

Persuasion উপন্যাসেও আমরা পাই অ্যান এলিয়টকে- সম্ভ্রান্ত কিন্তু পড়তি অবস্থার ব্যারন মিস্টার এলিয়টের সন্তান। বন্ধু অভিভাবিকা লেডি রাসেলের পরামর্শে একসময় ক্যাপ্টেন ওয়েন্টওয়ার্থের বিবাহ প্রস্তাব ফিরিয়ে সে আজও শোকম্লান- আজও অনূঢ়া। ঘটনার নাটকীয় উত্থান শুরু হয় যখন ক্যাপ্টেনের পুনঃপ্রবেশ ঘটে তার জীবনে।

সহোদরাদের কাছে প্রায় বাতিল অ্যান নিশ্চুপ অক্ষমতায় দেখে নব্যধনী ওয়েন্টওয়ার্থ কে নিয়ে বোন মেরির ননদ হেনরিয়েটা আর লুইসার  উচ্ছ্বাস। নিতান্ত নিঃসঙ্গ অ্যান বাধ্য হয় তার বোনের পরিবারের সাথে উপকূলবর্তী লাইম শহরে আসতে। সেখানে লুইসা ঘটনাচক্রে পড়ে আহত হলে, স্থিরবুদ্ধির অ্যান তার সেবার ভার তুলে নেয়।  সেখানেই সে দেখতে পায় মিস্টার এলিয়টকে -তার বাবার সম্পত্তির পরবর্তী উত্তরাধিকারী। এর পরে অ্যানের সাথে মিস্টার এলিয়টের দেখা হয় বাথ শহরে ,যেখানে স্যার  ওয়াল্টার ইলিয়ট থাকতে শুরু করেছেন।  বংশগরিমায় আবিষ্ট স্যার ওয়াল্টার এবং সুন্দরী এলিজাবেথ সাথে এনেছেন  বিধবা মিসেস ক্লে কে। মিস্টার এলিয়ট অ্যান এর প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দিতে শুরু করলে লেডি রাসেল অচিরেই এক বিবাহ সম্ভাবনাকে দেখতে পান।। কিন্তু অ্যানের মন  জুড়ে আছে ক্যাপ্টেন। এরপর তার বান্ধবী মিসেস স্মিথ মিস্টার এলিয়টের আসল অভিসন্ধি তার কাছে  ফাঁস করে। এলিয়টের সাথে গোপন সম্পর্ক প্রকাশ হয় ।নানা ঘটনার ঘাট প্রতিঘাতে অবশেষে অ্যান এবং ক্যাপ্টেন ওয়েন্টওয়ার্থের মিলন ঘটে। এই পুরো উপন্যাস জুড়ে আছে অ্যানের বন্ধুহীন নিঃসঙ্গতা। লেডি রাসেল স্নেহপ্রবণ হয়েও বন্ধু হয়ে উঠতে পারেননি তার অবিবেচক রক্ষণশীলতায়। অন্যদিকে মিসেস স্মিথ বন্ধু হয়েও মিস্টার এলিয়টের চরিত্র প্রাথমিকভাবে প্রকাশ না করে প্রায় এক ক্ষতিকর সংযমের পরিচয় দিতে চলেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে এখানে একমাত্র বন্ধু অ্যান পেয়েছে ক্যাপ্টেন ওয়েন্টওয়ার্থ কে -  যে তার ক্লান্তি অনুভব করে, তার বৃষ্টিতে এগিয়ে দেয় ছাতা, আশাহত হয়েও নতুন করে আশা করে থাকে তার জন্য।

পারসুয়েশান

Persuasion এ নারীদের সমলিঙ্গের যে বন্ধুত্বের মোটিফ প্রায় অপসৃয়মান তারই ছায়া দেখা যায় Mansfield Park এ। স্যার এবং লেডি বারট্রাম সম্বলহীন ফ্যানিকে আশ্রয় দেন । সাথে সাথেই শুরু হয় Cinderella আধারের এক আধুনিক রূপকথা। রূপক অর্থে ভাবতে গেলে স্যার বার্ট্রাম এবং মিসেস নরিস যেভাবে অনুপস্থিত বাবা ও দুষ্ট সৎমার আঙ্গিকে পড়ে যান তেমনি ভাবে দুষ্ট বোনেদের মতো না হলেও অবহেলায় উপেক্ষায় জুলিয়া ও মারিয়া ফ্যানীকে কখনোই নিজেদের শ্রেনীভুক্ত করে না। যে নারীর বন্ধুত্ব ও সাহচর্য  ফ্যানীর জীবনে ভালো পরীর আশীর্বাদ এর মত আসতে পারতো সেই লেডি বারট্রাম নিজের আলস্য ছেড়ে ফ্যানীর দিকে দেবার মনোযোগ দিতে পারেন না। মা বোনের সঙ্গবিচ্যূত ফ্যানি শুধু এডমন্ড এর মধ্যেই তার আশ্রয় পায়। কখনো লেখার কাগজ, কখনো বা ছোট ঘোড়া-- ম্যান্সফিল্ড পার্কে ফ্যানীর জীবনকে সহনীয় করে তোলে এডমন্ড। কিন্তু শহুরে , ঝকঝকে মেরি এবং হেনরি  ক্রফোর্ডের আগমন এক ঝড় তুলে দেয়। মিস্টার রাশওর্থের বাগদত্তা হওয়া সত্ত্বেও মারিয়া প্রেমে পড়ে হেনরির। জুলিয়াও বাদ থাকে না।  এডমন্ডও মেরি কে তার জীবনসঙ্গী নির্বাচন করার কথা ভাবে। কিন্তু সকলকে অবাক করে হেনরি ফ্যানির পানিপ্রার্থনা করে। মুহূর্তে নাকচ করে  ফ্যানী। শাস্তি স্বরূপ ফেনীকে যেতে হয় নির্বাসনে- তার পিতৃগৃহে। দারিদ্র্যের চরম ভয়াবহতাও  ফ্যানীর সিদ্ধান্ত পাল্টায় না ,তবে পার্কে পাল্টে যায় অনেক কিছু । ফ্যানীও ফিরে আসে বারট্রাম পরিবারে টম অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিবাহিতা মারিয়া হেনরির পরকীয়ায় লিপ্ত হয়। এডমন্ড উপলব্ধি করে মেরি ক্রফোর্ডের সর্বৈব ভ্রান্ত নীতিবোধ। রোমান্টিক উপসংহারে এডমন্ড  ফ্যানীর মিলন হয়। এই উপন্যাসে নারীদের বন্ধুত্বের রসায়ন এতটাই দুর্বল যে তারা প্রত্যেকে প্রত্যেকের প্রতিদ্বন্দী। কখনো যৌন ঈর্ষা, কখনো গুপ্ত প্রেম, কখনো বিপুল সম্পত্তির   প্রলোভন বহুধায় বিভক্ত করে রাখে নারীদের। বিবাহ এখানে সম্পূর্ণভাবে নারীদের বন্ধুত্বের antithesis রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

যে সই কথা একসময় অস্টেনের উপন্যাসে প্রায় মূলাধার জুড়ে থেকেছিল, যা নারীর বিকল্প অস্তিত্বের আশ্বাস হতে পারত বাস্তববাদী লেখিকা তার পরিসর ক্রমেই ছোট করেছেন। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর নিজস্ব বৃত্তের প্রয়োজনীয়তা জেন নিজে পেলেও তার সকল নায়িকাদের দিতে পারেননি।

তথ্যসূত্র:

1. Ruth Perry:  Interrupted Friendship in Emma.

2. Janet Todd: Female Friendship in Austen

3. Complete works of Jane Austen (Kindle edition)