জেন অস্টেন : জীবনকথা
- 16 December, 2024
- লেখক: সৌভিক ঘোষাল
জেন অস্টেনের জন্ম ১৭৭৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর। জেন ছিলেন বাবা মার সপ্তম সন্তান। জেনের বাবা জর্জ অস্টেন (১৭৩১ – ১৮০৫) এবং মা ক্যাসান্দ্রা লেই (১৭৩৯ - ১৮২৭) এর বিয়ে হয় ১৭৬৪ সালের ২৬ এপ্রিল, ইংলন্ডের বাথ শহরে। সেই সময় জর্জ অস্টেন ছিলেন ইংলিশ চার্চের এক রেভারেন্ট। ডিন রেক্টরি ও স্টিভেনটন রেক্টরি – হ্যাম্পশায়ার কাউন্টির দু জায়গাতেই তিনি রেক্টর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জেন ও তার কয়েকজন দাদা, ভাই ও দিদির জন্ম স্টিভেনটনে হলেও জর্জ ক্যাসান্দ্রার প্রথম তিন ছেলের জন্ম হয়েছিল ডিন এ।
জর্জ ও ক্যাসান্দ্রা অস্টেনের ছেলেমেয়েদের কথা জানার আগে তাদের পারিবারিক ইতিহাস একটু জেনে নেওয়া যাক। জর্জ অস্টেন জন্মেছিলেন ১৭৩১ সালের ১ মে, কেন্ট কাউন্টির টনব্রিজে। বাবা ছিলেন শল্যচিকিৎসক উইলিয়াম অস্টেন (১৭০১ – ১৭৩৭), মা ছিলেন রেবেকা হ্যাম্পসন (১৬৯৫ – ১৭৩৩)। জন্মের পর বেশিদিন বাবা মায়ের সান্নিধ্য জর্জ অস্টেন পান নি। মা রেবেকা মারা যান ১৭৩২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, জর্জ অস্টেনের বয়স তখনো এক হয় নি। ১৭৩৬ তে উইলিয়াম অস্টেন বিয়ে করলেন আবার। কিন্তু দ্বিতীয় স্ত্রী সুসান্না কেল্কের সঙ্গেও তার দাম্পত্যজীবন দীর্ঘ হয় নি। বিয়ের পরের বছর ১৭৩৭ এর ডিসেম্বরে উইলিয়াম অস্টেন মারা যান। সৎ মা সুসান্না জর্জ অস্টেন ও তার দুই বোন ফিলাডেলফিয়া ও লিওনোরার দায়িত্ব নিতে রাজি হন নি। তিনটি ছোট ছেলেমেয়ের দায়িত্ব নেন তাদের জ্যেঠু উইলিয়াম অস্টেনের বড়দা ফ্রান্সিস অস্টেন (১৬৯৮ – ১৭৯১)। ফ্রান্সিস ছিলেন কেন্টের সেভেনওক অঞ্চলের এক প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী। তিনি বিয়ে করেন নি। কিছুদিন পর তিনি প্রয়াত মেজ ভাই উইলিয়ামের তিন ছোট ছেলেমেয়েকে নিয়ে চলে এলেন তাদের ছোট ভাই স্টিফেনের কাছে লন্ডন শহরে। স্টিফেন তখন লন্ডনে বই ব্যবসা ও প্রকাশনা সংস্থা খুলে জীবিকা নির্বাহ করেন। স্টিফেন বিবাহিত, ফলে প্রয়াত মেজো ভাইয়ের ছেলেমেয়েগুলিকে দেখভাল করার সুবিধে হবে, এরকম ভাবনা নিয়েই বড় ভাই ফ্রান্সিসের ছোট ভাই স্টিফেনের কাছে লন্ডন শহরে চলে আসা।
১৭৪১ সালে জর্জ অস্টেন টনব্রিজ স্কুলে পড়াশুনো শুরু করেন। ১৭৪১ এ ভর্তি হন অক্সফোর্ড এর সেন্ট জন কলেজে। ১৭৫১ সালে এখান থেকেই তিনি অর্জন করলেন বি এ ডিগ্রী, তারপর ১৭৫৪ সালে মাস্টার্স ডিগ্রী। সেইসঙ্গে তিনি যাজকবৃত্তির উপযুক্ত ডেকন হিসেবে মনোনীত হলেন। পরের বছর ১৭৫৫ তে কেন্টের অন্তর্গত রচেস্টারের প্রিস্ট হিসেবে মনোনীত হন। তবে ১৭৫৮ সালে আরো উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি অক্সফোর্ডে ফিরে আসেন। ১৭৬০ সালে তিনি এখান থেকে ডিভিনিটি ডিগ্রী পান। ১৭৬১ সালে তাঁর আত্মীয় প্রথম থমাস নাইট হ্যাম্পশায়ার কাউন্টির স্টিভেনটনে তাঁর একটি থাকার জায়গার বন্দোবস্ত করে দেন। ১৭৬৪ সালে জর্জ অস্টেন ক্যাসান্দ্রা লেইকে বিয়ে করেন ও স্টিভেনটনের যাজকবৃত্তি গ্রহণ করেন। জর্জ ক্যাসান্দ্রার যখন বিয়ে হয় তখনো স্টিভেনটন রেক্টর হাউসের বাড়িটি ঠিক বসবাসযোগ্য গোছানো ছিল না, তুলনায় ডিন রেক্টর হাউস ছিল অনেকটা গোছানো। ফলে দু জায়গায় রেক্টর হিসেবে কাজ করলেও জর্জ ক্যাসান্দ্রা থাকতে শুরু করেন ডিন এ। স্টিভেনটন ও ডিনের দূরত্ব দু কিলোমিটার। ডিনের রেক্টর হাউসের ব্যবস্থাটি জর্জ অস্টেনকে করে দিয়েছিলেন তার জ্যেঠু ফ্রান্সিস অস্টেন। অন্যদিকে সংসার খরচ চালানোর জন্য স্টিভেনটন ও ডিন এর দুটি খামার থেকে বার্ষিক ২১০ পাউন্ড আয়ের ব্যবস্থা থমাস নাইট করে দিয়েছিলেন। স্টিভেনটনের খামারটি থমাস দিয়েছিলেন ১৭৬১ সালে আর ডিনেরটি ১৭৭৩ সালে।
জর্জ অস্টেন ছিলেন মেধাবী ছাত্র ও নিবেদিত শিক্ষক। নিজের সন্তানদের লেখাপড়ার দিকেও তিনি বিশেষ মনোযোগী ছিলেন। বড় ও চতুর্থ সন্তান জেমস ও হেনরিকে তিনি অক্সফোর্ডে পড়ার জন্য তৈরি করেছিলেন। ষষ্ঠ ও অষ্টম সন্তান ফ্রান্সিস ও চার্লসকে তৈরি করেছিলেন রয়্যাল নেভিতে প্রবেশের জন্য। যাজকবৃত্তির পাশাপাশি তিন চারটি ছেলেকে তিনি বাড়িতে রেখে পড়াতেন। এই কাজ তিনি যাজকবৃত্তি থেকে অবসর নেওয়ার আগে অবধি চালিয়ে গিয়েছিলেন। এ থেকে তার কিছু অতিরিক্ত আয়ও হত। জেন তার বাড়িতে মেয়েবেলায় পরিবারের মানুষদের পাশাপাশি সবসময়েই কয়েকজন নবীন শিক্ষার্থীকে দেখত।
তেত্রিশ বছর বয়সে জর্জ অস্টেন বিয়ে করেন চব্বিশ বছরের ক্যাসান্দ্রা লেইকে। স্টিভেনটনের খামারে যে ডেয়ারী এবং পোলট্রির ব্যবসা চলত, তার দেখাশুনোর দায়িত্বে ছিলেন মিসেস ক্যাসান্দ্রা অস্টেন। তাকে প্রায়ই দেখা যেত একটা সুঁচ হাতে, সেলাইয়ের কাজ করে চলেছেন।
ডিন এ থাকাকালীন জর্জ ও ক্যাসান্দ্রার তিন ছেলের জন্ম হয়েছিল। ১৭৬৫ তে জেমস, ১৭৬৬ তে জর্জ এবং ১৭৬৭ তে এডওয়ার্ড এর জন্ম হয়। চতুর্থ পুত্র হেনরির জন্মের আগে ১৭৭১ সালে জর্জ অস্টেন সপরিবার চলে আসেন স্টিভেনটনে। সেখানে জর্জ ক্যাসান্দ্রার পাঁচ ছেলে মেয়ের জন্ম হয়। ১৭৭১ এ হেনরি, ১৭৭৩ এ জেনের প্রিয় দিদি ক্যাসান্দ্রা (মায়ের নামেই রাখা হয় তার নাম), ১৭৭৪ সালে ফ্রান্সিস, ১৭৭৫ সালে জেন এবং ১৭৭৯ সালে চার্লস এর জন্ম হয়।
অস্টেন পরিবারের বড় ছেলে জেমস অস্টেন বাবার মতোই যাজকের জীবিকা বেছে নিয়েছিলেন। ১৮০০ সালের পর জর্জ অস্টেন রেক্টরের পদ থেকে অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। ১৮০১ সালে স্টিভেনটন রেক্টরিতে বাবা জর্জের স্থলাভিষিক্ত হন ছেলে জেমস অস্টেন। তিনি তাঁর নিজের পরিবার নিয়ে স্টিভেনটন রেক্টর হাউসেই থাকতে শুরু করেন। স্ত্রী ও কন্যাদের নিয়ে অবসর যাপনের জন্য স্টিভেনটন থেকে বাথ শহরে চলে আসেন জর্জ অস্টেন।
জেমস অস্টেনের প্রথম স্ত্রী অল্প বয়সে মারা যান। এই বিবাহজাত কন্যা আনা অস্টেন (১৭৯৩ – ১৮৭২) খানিকটা অবহেলার মধ্যে দিয়েই বড় হয়েছিল, কারণ জেমসের দ্বিতীয় স্ত্রী মেরি লয়েড তার প্রতি খুব একটা মনোযোগী ছিলেন না। এই আনাও একজন তার পিসি জেনের মতো লেখিকা হতে চেয়েছিলেন। ১৮৩৩ সালে তার একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল। তবে তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন জেন অস্টেন বিষয়ক স্মৃতিকথাটির জন্য। ১৮৬৪ সালে লেখা তাঁর ‘রিকালেকশান অব আন্ট জেন’ – জেন অস্টেনের জীবন চরিতের গুরুত্বপূর্ণ আকর।
বড়দা জেমস অস্টেনের একমাত্র পুত্র জেমস এডওয়ার্ড অস্টেন লেই জেন অস্টেনের খুব স্নেহের ভাইপো ছিলেন। জেন অস্টেন সম্পর্কে প্রথম উল্লেখযোগ্য পূর্ণাঙ্গ জীবনী – ‘এ মেমোয়ার অব জেন অস্টেন’ তিনি লেখেন ১৮৭০ সালে। অস্টেন চর্চায় এই বইটির গুরুত্ব অপরিসীম।
ক্যারোলিন মেরি অস্টেন (১৮০৫ – ১৮৮০) ছিলেন জেনের বড়দা জেমস ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী মেরির সন্তান। ক্যারোলিন অস্টেনকে লেখা জেন অস্টেনের নটি চিঠি পাওয়া গেছে। জেন অস্টেনের মতোই তার এই ভাইঝিও সারাজীবন অবিবাহিত ছিলেন। মা মেরির মৃত্যু অর্থাৎ ১৮৪৩ সাল অবধি তিনি মায়ের সঙ্গেই থাকতেন। তারপর তাঁর ভাই তথা জেন অস্টেনের জীবনীকার জেমস এডওয়ার্ড অস্টেনের কাছে চলে যান। ১৮৬৭ সালে লেখা তাঁর ‘মাই আন্ট জেন’ এবং ১৮৭২ সালে লেখা ‘রেমিনিসেন্স’ জেন অস্টেনের সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়।
জর্জ ও ক্যাসান্দ্রা অস্টেনের দ্বিতীয় পুত্র জর্জ ছিলেন প্রতিবন্ধী এবং জন্মের কিছুদিন পর থেকে আমৃত্যু তিনি পরিবারের বাইরে বিশেষ আশ্রয়ে ছিলেন। তার সম্পর্কে তেমন কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। এটুকু জানা যায় ১৮৩৮ সালে বাহাত্তর বছর বয়সে তিনি মারা যান।
তৃতীয় সন্তান এডওয়ার্ডের বয়েস যখন ষোল বছর তখন জর্জ অস্টেনের আত্মীয় দ্বিতীয় থমাস নাইট ও তার স্ত্রী ক্যাথরিন তাকে দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। যথেষ্ট ধনী ও সামাজিক খ্যাতির অধিকারী থমাস ও ক্যাথরিন ছিলেন নিঃসন্তান। তাঁদের বিপুল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন এডওয়ার্ড। থমাস নাইটের সম্পত্তির উত্তরাধিকার সূত্রেই এডওয়ার্ড নাইটদের চাওটনের বাড়িটি পেয়েছিলেন, যা জেন অস্টেনের জীবনের ও সাহিত্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হ্যাম্পশায়ার কাউন্টির স্টিভেনটন ও চাওটন ছাড়াও থমাস নাইটদের বিপুল সম্পত্তি ছিল কেন্ট কাউন্টির গডমার্শাম পার্কে। কেন্টের এই খামার থেকে এডওয়ার্ডের বার্ষিক আয় ছিল পাঁচ হাজার পাউন্ড আর হ্যাম্পশায়ারের খামার থেকে আয় ছিল এরও দ্বিগুণ, বার্ষিক প্রায় দশ হাজার পাউন্ড। জেন তার উপন্যাস ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এ নায়ক মিস্টার ডার্সির আয়ও দেখিয়েছিলেন দশ হাজার পাউন্ড। হ্যাম্পশায়ার কাউন্টি ও কেন্ট কাউন্টির সম্পত্তি ছাড়াও লন্ডনের মে বিল্ডিং এ নাইটদের তথা এডওয়ার্ডের একটি আবাস ছিল।
১৭৮৩ সাল থেকে এডওয়ার্ড থাকতেন থমাসদের বাড়ি কেন্ট কাউন্টির গডমার্শামে। ইউরোপ ভ্রমণ করে ফেরার পর ১৭৯১ সালের ২৭ ডিসেম্বর তিনি বিয়ে করেন এলিজাবেথ ব্রিজেসকে। তাঁদের এগারোটি সন্তান সন্ততি ছিল। সতেরো বছরেরও কম সময়ের ব্যবধানে এলিজাবেথ এগারো সন্তানের জননী হয়েছিলেন। ফলে তাঁর দেখভাল ও যত্নের বিশেষ দরকার হত। জেনের দিদি ক্যাসান্দ্রা অস্টেন এলিজাবেথ ও ছোট সন্তানদের দেখাশুনো করতে প্রায়ই গডমার্শামে যেতেন। মাঝে মাঝে জেনও দিদির সঙ্গে এসে থাকতেন। ১৮০৮ সালে কনিষ্ঠ সন্তান ব্রুক জনের জন্মের পরই এলিজাবেথ মারা যান। সেই সময়ে ক্যাসান্দ্রা সেখানে ছিলেন।
এডওয়ার্ডের সন্তানদের একজন ছিলেন মেরি বা ম্যারিয়ানে নাইট। অনেকে বলেন জেন অস্টেনের চেহারা ও স্বভাবের সঙ্গে তার ভাইঝি মেরির অনেক মিল ছিল। মেরি জেন অস্টেনের নয়নের মণি ছিলেন। তাঁর প্রথম উপন্যাসের অন্যতম নায়িকার নাম অস্টেন রেখেছিলেন ম্যারিয়ানে। মেরি বা ম্যারিয়ানের বোন লাউসিয়াও ছিলেন জেনের খুব প্রিয় এক ভাইঝি।
বাবা জর্জ অস্টেনের মৃত্যুর পর মা ও দুই বোন যখন একটি ভালো বাড়ির সন্ধানে এদিক ওদিক ঘুরছেন, এখানে ওখানে অস্থিতিশীল জীবন যাপন করছেন, তখন এডওয়ার্ড তাদের চাওটনের বাড়িটিতে এসে থাকতে বলেন। ১৮০৯ সালে জেন অস্টেন তাঁর মা ও দিদি ক্যাসান্দ্রার সঙ্গে এখানে চলে আসেন। জেন অস্টেনের সাহিত্য জীবনের সবচেয়ে ফলবান ও উল্লেখযোগ্য দিনগুলি কাটে এই চাওটনের বাড়িতে। এই বাড়িটিতে জেন তার জীবনের শেষ দশকটি ছিলেন ও প্রধান সাহিত্যকীর্তিগুলির কয়েকটি পরিমার্জনা করেছিলেন আর কয়েকটি নতুন করে লিখেছিলেন। এই বাড়িটি বর্তমানে জেন অস্টেন মিউজিয়াম হিসেবে সংরক্ষিত এবং দর্শনার্থীদের আগ্রহের জায়গা।
এডওয়ার্ডের উত্তরাধিকারীদের কাছে জেন অস্টেনের অনেক চিঠি ছিল। তাঁরা সেগুলি প্রকাশ করেন। জেন অস্টেনের জীবন সম্পর্কেও তাঁরা কেউ কেউ লিখেছেন। ১৮৮৪ সালে লর্ড এডওয়ার্ড কাচবুল ব্রেবোর্ন (জেন অস্টেনের সেজদা এডওয়ার্ডের কন্যা তথা জেনের ভাইঝি ফ্যানির ছেলে) প্রকাশ করেন ‘লেটার্স অব জেন অস্টেন’। ১৯১৩ সালে উইলিয়াম (ভাইপো এডওয়ার্ডের ছেলে) লেখেন জেন অস্টেন : লাইফ অ্যান্ড লেটার্স। ১৯২০ সালে মেরি অ্যাগুস্তা (ভাইপো এডওয়ার্ডের মেয়ে) লেখেন ‘পারসোনাল অ্যাসপেক্টস অব জেন অস্টেন’।
জর্জ অস্টেনের চতুর্থ সন্তান ছিলেন হেনরি থমাস অস্টেন। বাবা ও বড়দা জেমসের মতো তিনিও অক্সফোর্ডে পড়াশুনো করেছিলেন, তবে পাঠান্তে প্রথমেই যাজকবৃত্তিতে প্রবেশ করেন নি। তিনি প্রথম জীবনে ফ্রান্স ইংলন্ড যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে গঠিত অক্সফোর্ড মিলেশিয়াতে ক্যাপ্টেন ও অন্যান্য পদে আট বছর কর্মরত ছিলেন। এরপর ব্যাঙ্কার হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। তখন তিনি লন্ডনে থাকতেন। তাঁর লন্ডনের বাড়িটিতে জেন ও ক্যাসান্দ্রা অনেকবার এসেছেন। দিদি ক্যাসান্দ্রা ছাড়া জেনের সঙ্গে তার এই দাদার সম্পর্কই ছিলেন সবচেয়ে আন্তরিক। ব্যাঙ্কের সঙ্কট দেখা দিলে হেনরি অস্টেন বাবা জর্জ অস্টেন ও বড়দা জেমস এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে যাজকবৃত্তিতে প্রবেশ করেন। জেন অস্টেনের মৃত্যুর ছ মাস পরে তার উদ্যোগেই অস্টেনের দুটি অপ্রকাশিত উপন্যাস – ‘নর্দাঙ্গার অ্যাবে’ ও ‘পারসুয়েশান’ প্রকাশিত হয়। সেখানে লেখা একটি ভূমিকায় তিনি বোন তথা লেখিকা জেন অস্টেনের সঙ্গে বাইরের পৃথিবীর প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। ১৮১৮ সালে প্রকাশিত হেনরি অস্টেনের ‘বায়োগ্রাফিকাল নোটস অব জেন অস্টেন’ এবং ১৮৩৩ সালে প্রকাশিত ‘মেমোয়ার অব মিস অস্টেন’ অস্টেনের জীবন সম্পর্কে লেখা প্রথম দুটি রচনা, ফলে এগুলির ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। হেনরি অস্টেন দুবার বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু তিনি ছিলেন নিঃসন্তান।
অস্টেন পরিবারের পঞ্চম সন্তান ছিলেন ক্যাসান্দ্রা অস্টেন। মায়ের নামেই তার নাম রাখা হয়। দিদি ক্যাসান্দ্রা ছিলেন পরিবারের সপ্তম সন্তান ও দ্বিতীয় কন্যা জেনের জীবনের সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু। তাঁরা উভয়েই সারাজীবন অবিবাহিত ছিলেন। দিদি ক্যাসান্দ্রা যখন অক্সফোর্ডে পড়তে যান, তখন বায়না ধরে ছোট্ট জেনও তার সঙ্গী হন। তাদের মা মজা করে একবার বলেছিলেন যে জেন দিদিকে এমন ভাবেই অনুসরণ করে যে দিদির যদি মাথা কাটা যায়, বোন জেনও তার মাথা কেটে ফেলতে বলবে। জেন অস্টেনের নানা উপন্যাসে, বিশেষ করে ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’র এলিয়নর ও ম্যারিয়ানে এবং ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এর জেন ও এলিজাবেথ ভগিনীদ্বয়ের মধ্যে যে গভীর অনুরাগ ও বন্ধুত্ব দেখা যায়, তাতে ক্যাসান্দ্রা অস্টেন ও জেন অস্টেনের ব্যক্তিগত রসায়নের অনেক প্রভাব রয়েছে। এই ক্যাসান্দ্রার কোলে মাথা রেখেই অসুস্থ জেন অস্টেন মাত্র একচল্লিশ বছর বয়েসে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন।
জর্জ অস্টেনের এক প্রাক্তন ছাত্র টম ফাওলে স্নাতক হবার পর যাজকবৃত্তিতে প্রবেশের মনোনয়ন পান। জীবিকার ব্যবস্থা হলে তিনি ক্যাসান্দ্রাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। সম্ভবত জর্জ অস্টেনের বাড়িতে থাকার সময়েই তিনি ক্যাসান্দ্রার প্রতি অনুরক্ত হয়েছিলেন। ক্যাসান্দ্রা টম ফাওলের প্রস্তাবে ইতিবাচক সম্মতি দেন। বিয়ের কথাবার্তা চূড়ান্ত হবার পর তম ফাওলে এক সামরিক অভিযানে যান ওয়েস্ট ইন্ডিজে। সেন্ট ডোমিঙ্গোতে তিনি ইয়েলো ফিভারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। দয়িতের মৃত্যুর পর ক্যাসান্দ্রা সারাজীবন অবিবাহিত থেকে যান।
অস্টেন পরিবারের ষষ্ঠ ও অষ্টম সন্তান হলেন যথাক্রমে ফ্রান্সিস অস্টেন ও চার্লস জন অস্টেন। তারা দুজনেই ব্রিটিশ রয়াল নেভির অ্যাকাডেমিতে পড়াশুনো করেন ও তারপর নেভির চাকরীতে যোগ দেন। তারা উভয়েই দুটি করে বিয়ে করেন এবং উভয়েরই অনেক সন্তান সন্ততি নিয়ে ছিল বেশ বড়সড় পরিবার। চার্লস নেভির কাজে জাহাজেই বেশি থাকতেন। জেন অস্টেন তার এই ছোট ভাইয়ের সঙ্গে খুব বেশি সময় কাটানোর সুযোগ পান নি।
অস্টেনের অনেক উপন্যাসে মিলেশিয়া ও নেভি ও সেখানে কর্মরতদের অনেক প্রসঙ্গ এসেছে। ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এর গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র উইকহ্যাম মিলেশিয়াতে কর্মরত, তা ছাড়াও মিলেশিয়াতে কাজ করা বেশ কয়েকজনের কথা এখানে আছে। নর্দাঙ্গার অ্যাবেতেও এসেছে সেনাবাহিনীর এক জেনারেল ও এক ক্যাপ্টেনের কথা, যারা নায়ক হেনরি টিনলের বাবা ও দাদা। তবে সেনাবাহিনী বিশেষ করে নেভিতে কর্মরত মানুষজনের কথা সবচেয়ে বেশি করে এসেছে ‘পারসুয়েশান’ উপন্যাসে। সেনাবাহিনী ও নেভি সম্পর্কে নানা ধারণা ও তথ্য সংবাদপত্রের পাতা বা বইপত্র থেকে যেমন জেন অস্টেন পেয়ে থাকবেন, তেমন ই পেয়েছেন তার দাদাদের মুখ থেকে শোনা নানা বর্ণনা ও কাহিনী থেকে।
জেন অস্টেনের উপন্যাসে এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে যাজকদের দেখা যায়। তাঁদের অনেকেই উপন্যাসের নায়ক। যেমন নর্দাঙ্গার অ্যাবের হেনরি টিনলে বা ‘ম্যান্সফিল্ড পার্ক’ এর এডমন্ড বারটার্ম। ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এর গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মিস্টার কলিন্সও একজন যাজক, যদিও তাকে উপন্যাসে বেশ বিদ্রুপভরেই উপন্যাসে উপস্থাপন করা হয়েছে। জেন অস্টেনের বাবা ও বড়দা জেমস ছিলেন যাজক, পরে আর এক দাদা হেনরিও যাজকের বৃত্তি গ্রহণ করেছিলেন। ফলে পরিবার সূত্রে যাজকদের সম্পর্কে অত্যন্ত নিবিড় ও বিস্তারিত ধারনা জেন অস্টেনের আবাল্যই ছিল।
বাবা, মা, দাদা, ভাই, বোনেরা ছাড়াও ভাইপো, ভাইঝি, মাসতুতো পিসতুতো ভাইবোন ও তাদের সন্তান সন্ততিরা জেন অস্টেনের জীবনের সঙ্গে অনেকটাই জড়িয়ে ছিলেন। জেন অস্টেনের শেষ উপন্যাস পারসুয়েশানে, নায়িকা অ্যান এলিয়টকে আমরা দেখি তার বিবাহিত বোন মেরী মুসগ্রোভের বাড়িতে বোনপো বোনঝিদের সঙ্গে খেলা খুনসুটিতে মিশে যেতে। এই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন জেন অস্টেনও।
দাদা ও ভাইদের ছেলেমেয়েরা যেমন জেনের আদরের ভাইপো ভাইঝি হয়ে উঠেছিল, তেমনি মাসতুতো বোন ও বোনঝির সঙ্গেও তার ছিল নিবিড় সম্পর্ক। জেন অস্টেনের মা মিসেস ক্যাসান্দ্রা অস্টেনের নিজের বোন হলেন মিসেস জেন কুপার। তাঁর মেয়ের নামও এক, তবে তিনি হলেন মিস জেন কুপার। ১৭৮৩ সালে জেন যখন তার দিদির সঙ্গে অক্সফোর্ডে পড়তে যান, তখন তাদের সঙ্গী হন তাদের মাসতুতো বোন মিস জেন কুপার। সেখানে তারা ভর্তি হন মিসেস কাউলের স্কুলে। কিছুদিন পর মিসেস কাউল তার স্কুলটিকে সাউথ হ্যাম্পটনে স্থানান্তর করেছিলেন। সাউথ হ্যাম্পটনে আসার পর জেনরা তিন বোনই মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। মিসেস কুপার ছুটে গিয়ে তাঁদের উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। কিন্তু রোগ তার মধ্যে সংক্রমিত হয়। ছোট মেয়ে তিনটি বেঁচে গেলেও জেন অস্টেনের মাসী মিসেস কুপার টাইফাস জ্বরে মারা যান। মা হারা ছোট্ট মিস কুপার অসহায় হয়ে পড়লে অস্টেন পরিবার তার দেখাশুনোর দায়িত্ব নেয়। মা আগেই মারা গেছিলেন, বাবাও মারা গেলে জেন কুপারকে তার মাসি মিসেস ক্যাসান্দ্রা অস্টেন ১৭৯২ সালে অস্টেন পরিবারের সঙ্গে থাকার জন্য স্টিভেনটনে নিয়ে আসেন। মাসতুতো বোন জেন অস্টেনের সঙ্গে মিস কুপারের গভীর হৃদ্যতার সম্পর্ক তৈরি হয়।
মিসেস কাউলের স্কুলের পাঠপর্ব দুর্ভাগ্যজনকভাবে সমাপ্ত হবার বছর খানেক পর ১৭৮৫ সালে ক্যাসান্দ্রা, জেন অস্টেন, ও জেন কুপার ভর্তি হন অ্যাবে স্কুলে। সেখানে সকালের দিকে পড়াশুনো হত। প্রতিটি মেয়ের বার্ষিক পড়ার খরচ ছিল পঁয়ত্রিশ পাউন্ড। ১৭৮৬ সালে জর্জ অস্টেনের ষষ্ঠ সন্তান ফ্রাঙ্ক ব্রিটিশ রয়াল একাডেমিতে প্রবেশ করে। সেখানে পড়ার খরচ ছিল বার্ষিক পঁচিশ পাউন্ড। তাছাড়াও অন্যান্য নানা খরচ নিয়ে সেটা পৌঁছত বার্ষিক পঞ্চাশ পাউন্ডে। এই বাড়তি খরচের সামনে পড়ে জেন ও তার বোনেদের স্কুল থেকে সরিয়ে আনতে হয়। জেনের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনোর ইতি ঘটলেও তিনি বাড়িতেই পড়াশুনো শুরু করেন। বাবা জর্জ অস্টেনের সমৃদ্ধ লাইব্রেরিটি তাঁকে প্রচুর রসদ জুগিয়েছিল। এইসময় থেকেই জেন অস্টেন তার কৈশোরকালীন লেখালিখি শুরু করেন। তিনটি খাতায় তিনি কিশোরীবেলার লেখাগুলি লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে সেগুলি জুভেনালিয়া নামের এক সংকলন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে।
জর্জ অস্টেনের বোন ফিলাডেলফিয়া ও তার সন্তান সন্ততিরা অস্টেন পরিবারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত ছিলেন। ১৭৫২ সালে জর্জ অস্টেনের বোন ফিলাডেলফিয়া অস্টেন বোম্বে ক্যাসেল নামক জাহাজে করে ভারতের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন। জানুয়ারির ১৮ তারিখ তার যাত্রা শুরু হয়। চেন্নাইতে তিনি পা দেন প্রায় সাড়ে সাত মাস পর, অগস্টের ৪ তারিখ। ১৮৬৯ সালের ১৭ নভেম্বর সুয়েজ খাল উদ্বোধনের আগে ইংলন্ড বা ইউরোপ থেকে ভারত যাত্রায় এমনই দীর্ঘ সময় লাগত, কারণ গোটা আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে যেতে হত। ১৭৫৩ সালে ফিলাডেলফিয়া অস্টেন বিয়ে করেন টাইসো সাউল হ্যানকককে। হ্যানকক তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর এক শল্য চিকিৎসক হিসেবে মাদ্রাজে কর্মরত ছিলেন। ১৭৫৯ সালে পলাশীর যুদ্ধে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাংলা বিজয়ের দু বছর পর জেন অস্টেনের পিসি ও পিসেমশাই, ফিলাডেলফিয়া ও মিস্টার হ্যানকক চলে আসেন কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে। এখানেই তাঁদের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্ব হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারী তথা ভবিষ্যৎ গভর্নর জেনারেল (১৭৭৩- ১৭৮৫) ওয়ারেন হেস্টিংস এর (১৭৩২ – ১৮১৮)। ১৭৬১ সালে ফিলাডলফিয়া ও হ্যানককের মেয়ে তথা জেন অস্টেনের পিসতুতো দিদি এলিজাবেথ হ্যানককের জন্ম হয় কলকাতায়। ওয়ারেন হেস্টিংসের স্ত্রী মারা গেলে তিনি তাঁর ছেলে জর্জ হেস্টিংসকে ইংলন্ডে লেই পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেন। ক্যাসান্দ্রা লেইয়ের বাবার মৃত্যুর পর বিধবা মিসেস লেই জর্জ হেস্টিংসকে নিয়ে মেয়ে জামাইয়ের সংসারে স্টিভেনটনে চলে এসেছিলেন। এই সূত্রে ওয়ারেন হেটিংসের সঙ্গে অস্টেন পরিবারের পরিচয় আরো নিবিড় হয়। ওয়ারেন হেস্টিংস জেন অস্টেনের লেখার গুণগ্রাহী ছিলেন। জেনের পিসতুতো দিদি এলিজাবেথ হ্যানকক কলকাতা থেকে ইংলন্ডে ফেরার পর জেন অস্টেন ও তার পরিবারের সঙ্গে এলিজাবেথের ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরি হয়। ইংলন্ডে ফিরে এলিজাবেথ হ্যানকক বিয়ে করেন Comte de Feuillide নামের এক ফরাসী অভিজাতকে। এলিজাবেথের সন্তানের নাম রাখা হয় হেস্টিংস। এলিজাবেথ ইংলন্ডে ফেরার পর থেকেই অস্টেনদের স্টিভেনটনের বাড়িতে নিয়মিত যেতেন। জেনের সঙ্গে তার সুস্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস উপন্যাসের নায়িকার নাম জেন অস্টেন রাখেন এলিজাবেথ। জেনের বড়দাদা জেমস এর উৎসাহে স্টিভেনটনের বাড়িতে যে শখের থিয়েটারের মহড়া ও অভিনয় হত, এলিজাবেথ ছিলেন তার এক নিয়মিত সদস্য। জেমসের সঙ্গে এলিজাবেথের গভীর বন্ধুত্ব ছিল। পরে জেমসের ভাই হেনরীর সঙ্গে এলিজাবেথের নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয়। এলিজাবেথ হেনরির থেকে দশ বছরের বড় ছিলেন। তাছাড়া তখনো তিনি Comte de Feuillide এর বিবাহিতা স্ত্রী। ফরাসী বিপ্লবের সময় Comte de Feuillide কে গিলোটিনে হত্যা করা হয়। তারপর হেনরি এলিজাবেথকে বিয়ে করেন। এই পারিবারিক প্রেক্ষাপটের অনেক উপাদান জেন অস্টেন তার ‘ম্যানসফিল্ড পার্ক’ উপন্যাসে ব্যবহার করেছিলেন।
বিয়ের পর জর্জ অস্টেন তার স্ত্রী ক্যাসান্দ্রা লেই অস্টেনকে নিয়ে প্রথমে ডিন রেক্টরিতে থাকতে শুরু করেন। প্রথমে এই বাড়িটি তিনি ভাড়া নিয়েছিলেন মিস্টার হ্যামিলটনের কাছ থেকে। ১৭৭৩ সালে হ্যামিলটন মারা যাবার পর জর্জ অস্টেন এটা কিনে নেন। অবশ্য তার আগেই তিনি ডিন রেক্টরির এই বাড়িটি ছেড়ে স্ত্রী পুত্রদের নিয়ে স্টিভেনটন রেক্টরির বাড়িটিতে চলে এসেছেন। ১৭৮৬ থেকে ১৭৮৮ সাল অবধি ডিন এর বাড়িটিতে ভাড়া থাকতেন মিস্টার ইগার্টন ব্রিজেস ও তার স্ত্রী। মিস্টার ব্রিজেসের বোন মাদাম লেফ্রয়ের প্রেমে পড়েন জর্জ অস্টেনের বড় ছেলে জেমস। মাদাম লেফ্রয়কে প্রেম নিবেদন করে কিছু প্রেমের কবিতাও লিখেছিলেন জেমস। কিন্তু মাদাম লেফ্রয়ের দিক থেকে ইতিবাচক সাড়া আসে নি।
১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ডিনের বাড়িটি থেকে হ্যামিলটনেরা চলে যান। বাড়িটি এরপর ভাড়া নেন মিসেস মার্থা লয়েড। তিনি ছিলেন রেভারেন্ড নোয়ে লয়েডের বিধবা পত্নী। তখন সদ্য সদ্য রেভারেন্ড লয়েড প্রয়াত হয়েছেন। দুই মেয়ে মার্থা ও মেরিকে নিয়ে মিসেস লয়েড ডিনের বাড়িটিতে থাকতে শুরু করেন। অস্টেন পরিবার ও লয়েড পরিবারের মধ্যে এই সময় থেকে এক নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয়।
১৭৯২ সালে জর্জ অস্টেনের বড় ছেলে জেমসের বিয়ে হয়। এরপর তার জন্য একটি আলাদা বাড়ির দরকার হলে মিসেস লয়েডদের ডিনের বাড়িটি ছেড়ে দিতে হয়। স্ত্রী অ্যানেকে নিয়ে জেমস অস্টেন ডিনের বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। এখানেই ১৭৯৩ সালের ১৫ এপ্রিল তাদের মেয়ে আনার জন্ম হয় ।
১৭৯৫ সালে জেমসের স্ত্রী অ্যানে হঠাৎ করেই মারা যান। কিছুদিন পর লয়েড পরিবারের ছোট মেয়ে মেরিকে বিয়ে করেন জেমস। জেমসের বিয়ের সূত্রে যে লয়েডদের ডিনের বাড়িটি ছেড়ে যেতে হয়েছিল, সেই বাড়িতেই আবার তিনি জেমসের প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর প্রবেশ করলেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে। জেমস ও মেরির পুত্র জেমস এডওয়ার্ড অস্টেনের জন্ম হয় ১৭৯৮ সালের ১৭ নভেম্বর। পরবর্তীকালে তিনিই পিসি জেন অস্টেনকে নিয়ে প্রথম উল্লেখযোগ্য জীবনীটি লিখেছিলেন।
১৭৯৫ সালে জেন অস্টেনের জীবনে এসেছিল প্রথম এবং সম্ভবত শেষ প্রেম। প্রেমিকের নাম ছিল টম লেফ্রয়। জেনের বয়েস তখন উনিশ, টমও তার সমবয়সী। রেভারেন্ড জর্জ অস্টেনের বন্ধু রেভারেন্ট জর্জ লেফ্রয় থাকতেন অ্যাশে রেভারেন্সিতে, তার ভাইপো ছিলেন টম। স্টিভেনটন থেকে অ্যাশের দূরত্ব ছিল কয়েক মাইল। বয়সের অনেকটা ব্যবধান সত্ত্বেও জর্জ লেফ্রয়ের স্ত্রী অ্যানে লেফ্রয়ের সঙ্গে জেনের হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল। জেন অনেকবার অ্যাশেতে গেছেন, সেখানে বল নাচের আসরে অংশ নিয়েছেন। এই বল নাচের আসর টম ও জেনের সম্পর্ককে নিবিড় করে। দিদি ক্যাসান্দ্রাকে লেখা একটি চিঠিতে জেন লিখেছিলেন কীভাবে জেন ও টম বল নাচের আসরে অনেকগুলো নাচ একসঙ্গে নাচায় টমের ভাইবোনেরা – সতেরোর লুসি, চোদ্দর জর্জ, এগারোর এডওয়ার্ড তাদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করেছিল। ১৭৯৬ সালে হ্যাম্পশায়ার ছেড়ে টম লেফ্রয় লন্ডনে আইন পড়তে চলে যান। এরপর কোনও কারণে তাদের সম্পর্ক আর এগোয় নি। এই সময়েই জেন অস্টেন তাঁর জনপ্রিয়তম উপন্যাস ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এর প্রথম খসড়া ফার্স্ট ইম্প্রেশন লিখতে শুরু করেন।
স্টিভেনটনের বাড়িটি থেকে দাদা জেমস এর এই আবাসটির দূরত্ব ছিল প্রায় দু কিলোমিটার। এই বাড়িটিতে জেন ও ক্যাসান্দ্রা পায়ই চলে আসতেন পায়ে হেঁটে। এখানে বল নাচের আসরে তারা অংশ নিতেন। জেন নাচতে ভালোবাসতেন। তাঁর নানা উপন্যাসেই বলনাচের প্রসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে এসেছে।
১৮০০ সালে জেনের বাবা জর্জ অস্টেন রেক্টরের দায়িত্ব থেকে অবসর নেবার সিদ্ধান্ত নেন। স্টিভেনটন চার্চের নতুন রেক্টর হন তাঁর বড় ছেলে জেমস অস্টেন। জর্জ অস্টেন ঠিক করেন স্ত্রী ও দুই কন্যা ক্যাসান্দ্রা ও জেন অস্টেনকে নিয়ে বাথ শহরে চলে যাবেন। বাথ শহরটি তখন ইংলন্ডের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। এর জল শরীরের পক্ষে খুব উপযোগী ও জলে নানা উপকারী খনিজ দ্রব্য মিশে আছে – এই ধারণা থেকে চিকিৎসার প্রয়োজনে অনেকেই সে সময় বাথ শহরে আসতেন। এছাড়াও শহরটি ছিল হরেক পণ্যের বিকিকিনির জন্য বিখ্যাত। সেকালে পাওয়া যায় এমন সব পণ্যই নাকী বাথের রাস্তাঘাটে দোকানীদের কাছ থেকে পাওয়া যেত। শহরে থিয়েটার, বল নাচ, গানের অনুষ্ঠান, তাসের আড্ডা সহ নানা ধরনের চিত্তবিনোদনের হরেক বন্দোবস্ত ছিল।
বাথ শহরে বাবা মা কে রেখে জেন ও তার দিদি ক্যাসান্দ্রা মাঝেমাঝেই চলে আসতেন স্টিভেনটনের বাড়িটিতে। সেখানে তখন তাঁদের দাদা জেমস অস্টেন থাকেন। স্টিভেনটনের পুরনো প্রতিবেশীদের বাড়িতেও তারা যেতেন, গল্পগুজব করে সময় কাটাতেন। এই প্রতিবেশীদের মধ্যেই ছিলেন দুই বোন ক্যাথারিন গিগ ও আলেথিয়া বিগ। একবার জেন আর ক্যাসেন্দ্রা যখন বাথ থেকে স্টিভেনটনে ফিরে বিগদের বাড়িতে গেছেন, ক্যাথারিন ও আলেথিয়ার ভাই হ্যারিস বিগ জেনকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। তখনকার মতো জেন কোনও কারণে সম্মতি দিয়েছিলেন। কিন্তু স্টিভেনটনে নিজেদের বাড়িতে ফিরে এক বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে তিনি বুঝতে পারেন এই বিয়ে অর্থহীন হবে, এর পেছনে কোনও প্রেমের উত্তাপ নেই। জেন কেন হঠাৎ রাজী হয়েছিলেন তা বলা কঠিন, কিন্তু এক রাতের ব্যবধানেই তিনি মত বদলে ফেলেন এবং পরদিন সকালেই দিদি ক্যাসান্দ্রাকে সঙ্গে নিয়ে স্টিভেনটন ছেড়ে বাথে ফিরে যান। এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়তে পারে ‘নর্দাঙ্গার অ্যাবে’ উপন্যাসে নায়িকা ক্যাথারিন মোরল্যান্ডকে তার বন্ধু ইসাবেলার ভাই জনের প্রেম প্রস্তাব দেওয়া ও ক্যাথারিনের সেই প্রস্তাব দৃঢ়ভাবে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গটি।
১৮০৩ সালের নভেম্বরে জর্জ ও ক্যাসান্দ্রা অস্টেন তাদের দুই মেয়ে জেন ও ক্যাসান্দ্রাকে নিয়ে লাইম রেজিসে বেড়াতে যান। ডরসেট ও ডেভন এর সীমান্তে অবস্থিত এই সৈকত শহরটি ততদিনে বেশ বিখ্যাত হয়ে উঠেছে ছুটি কাটানোর আস্তানা হিসেবে। ব্রিঘটন, সাউথ হ্যাম্পটন বা ওয়েমাউথের মতো সমুদ্র সৈকতের মত বিখ্যাত না হলেও লাইম রেজিসে এগুলির চেয়ে কম খরচে থাকা সম্ভব ছিল বলেই সম্ভবত অবসরপ্রাপ্ত জর্জ অস্টেন একে বেছে নিয়েছিলেন। এরপরেও একবার জেন বাবা মায়ের সঙ্গে লাইম রেজিসে যান, তবে দিদি ক্যাসান্দ্রা সেবার জাননি। লাইম রেজিস থেকে দিদিকে জেন অস্টেন যে সব চিঠি লিখেছিলেন সেখানে তিনি লাইম রেজিস ভ্রমণের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন। ১৮০৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বরে দিদি ক্যাসান্দ্রাকে লেখা জেনের একটি চিঠিতে বল নাচের অভিজ্ঞতার বিস্তারিত বর্ণনা আছে। বাথ শহর ছাড়াও লাইম রেজিসকে জেন অস্টেন তাঁর শেষ উপন্যাস ‘পারসুয়েশন’ এর প্রেক্ষাপট হিসেবে বর্ণনা করেন।
বাথ শহরে এসে প্রথমে অস্টেন পরিবার উঠেছিলেন ৪ সিডনি প্লেস। তিন বছরের চুক্তিতে বাড়িটি জর্জ অস্টেন ভাড়া নিয়েছিলেন। চুক্তি শেষ হবার পর ১৮০৪ সালে নতুন একটি বাড়ির খোঁজ করতে থাকে অস্টেন পরিবার, কারণ সিডনি প্লেস এর বাড়িটির ভাড়া ছিল অনেকটা বেশি। এরপর অস্টেন পরিবার চলে এল বাথের ৩ গ্রিন পার্ক বিল্ডিং ইস্ট এ। বাড়িটি কিছুটা সস্তা হলেও ততটা স্বাস্থ্যকর ছিল না। বৃষ্টির জল জমত বাড়ির পাশে। দ্বিতীয়বার লাইম রেজিস ভ্রমণ সেরে ফেরার অল্প কদিন পরেই জর্জ অস্টেন হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হন ও কদিনের মধ্যেই মারা যান। মৃত্যুর তারিখ ছিল ২১ জানুয়ারি ১৮০৫। মিসেস ক্যাসান্দ্রা অস্টেন লেই দুই মেয়ে ক্যাসান্দ্রা ও জেনকে নিয়ে আতান্তরে পড়েন। ১৮০৫ সালের মার্চে অস্টেন পরিবার আবারো বাড়ি বদলায়, আরো সস্তার বাড়িতে তাদের চলে যেতে হয়। তবে পাকাপাকিভাবে বাথ ছাড়ার কথাও তারা ভাবতে থাকেন। জেনের দাদারা মিলে মা ও দুই বোনের খরচের জন্য বার্ষিক ৪৫০ পাউন্ডের ব্যবস্থা করে দেন।
১৮০৫ সালের জুনে কেন্ট ও হ্যাম্পশায়ারের কয়েকজন আত্মীয়র বাড়িতে মিসেস ক্যাসান্দ্রা স্টেন তার দুই মেয়েকে নিয়ে কিছুদিন করে থাকেন। ১৮০৬ সালের মার্চে তারা আবার বাথে ফেরেন ও একটি উপযুক্ত বাড়ির সন্ধান করতে থাকেন। কিন্তু সস্তায় মনোমতো বাড়ি সেখানে তারা খুঁজে পান নি। মিসেস ক্যাসান্দ্রা অস্টেন মার্থা লয়েডকে তার মায়ের মৃত্যুর পর তার সঙ্গে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানান। মার্থা লয়েড এসে পৌঁছলে মাকে তার কাছে রেখে জেন ও ক্যাসান্দ্রা বাথ ছাড়তে সক্ষম হন।
মিসেস ক্যাসান্দ্রা অস্টেন তার আত্মীয় রেভারেন্ড থমাস লেইকে তাদের বাড়িতে এসে কিছুদিন কাটিয়ে যেতে বলেন। থমাস লেই তার বোনের সঙ্গে থাকার সময়েই খবর আসে যে রেভারেন্ড লেই বিরাট পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়েছেন। উত্তরাধিকার বুঝে নিতে তিনি বোন ক্যাসান্দ্রা লেইকে নিয়ে স্টোনলেই অ্যাবেতে যান। জেন ও ক্যাসান্দ্রাও মায়ের সঙ্গী হন। এর আগে এডওয়ার্ডের কেন্টের যে বাড়িতে জেন থেকেছেন, সেটিও বেশ বড়সড়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে বিরাট অট্টালিকায় জেনের থাকা এই প্রথম। বাড়িটির নব নির্মিত অংশেই ছিল বিরাট মাপের ছাব্বিশটি ঘর। বাড়িটির সঙ্গে ছিল সাড়ে চার একরের এক বিশাল বাগান। এই অট্টালিকায় থাকার অভিজ্ঞতা প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস পুনর্লিখনের সময় মিস্টার ডার্সির বাড়ির বর্ণনায় জেনকে প্রভাবিত করে থাকবে।
স্টোনলেই এর বিরাট অট্টালিকায় কিছুদিন কাটানোর পর অস্টেন পরিবার চলে এলেন স্ট্যাফোর্ডশায়ারে মিসেস অস্টেনের ভাইপো এডওয়ার্ড কুপারের বাড়িতে। সেখানে তারা মাসখানেক থাকেন।
এরপর কয়েক বছরের জন্য সাউথ হ্যাম্পটনে চলে আসেন অস্টেন পরিবার। জেনের দাদা ফ্রান্সিস তখন ব্রিটিশ রয়াল নেভিতে কর্মরত। ফ্রান্সিস সাউথ হ্যাম্পটনের ক্যাসেল স্কোয়ারে একটি বিরাট বাড়ি ভাড়া নিয়ে সে সময়ে থাকতেন। তিনি মা ও দুই বোনকে সেই বাড়িতে এসে থাকতে বলেন। এই বাড়িটি পুরনো দিনের হলেও বাড়ির সঙ্গে একটি বড় বাগান ছিল। সেটা মিসেস অস্টেন ও তার দুই মেয়ের বেশ পছন্দ হয়। সাউথহ্যাম্পটন শহরটিও ছিল বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। থিয়েটার হল, বিচিত্র পসরায় সাজানো আকর্ষণীয় নানা দোকান, ভালো ভালো গ্রন্থাগার, আড্ডা আমোদের ব্যবস্থা – সবই ছিল এখানে।
১৮০৯ সালে আবার বাসাবদল। এবার জেন অস্টেন, তার মা ও দিদি ক্যাসান্দ্রা চলে এলেন ভাই এডওয়ার্ডের চাওটনের বাড়িতে। জর্জ অস্টেনের আত্মীয়, বিরাট ধনী থমাস নাইট এডওয়ার্ডকে দত্তক নিয়েছিলেন। সেই উত্তরাধিকার সূত্রেই আরো কয়েকটি বাড়ির সঙ্গে চাওটনের বাড়িটি পেয়েছিলেন এডওয়ার্ড অস্টেন নাইট। এডওয়ার্ডের স্ত্রী এলিজাবেথ তাদের এগারোতম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। এডওয়ার্ড দ্বিতীয় বিবাহ করেন নি। তিনি মা ও দুই বোনকে চাওটনের বাড়িতে এসে থাকতে বলেন। এই বাড়িটিতে এডওয়ার্ড খুব বেশি সময় থাকতেন না, কেন্টের বাড়ি সারাই এর কাজকর্ম হলে মাঝেমধ্যে এসে থাকতেন।
নতুন বাসা বদল ও চাওটনের মতো নিরিবিলি পরিবেশে বসবাসের সুযোগ জেনকে খুব খুশি করে। এর আগে স্টিভেনটনের প্রথম বাড়িতে বেশ খুশি মনে ছিলেন জেন। সেখানে কিশোরী বয়সের লেখাগুলি ছাড়াও তিনটি উপন্যাসের প্রাথমিক পাণ্ডুলিপি তৈরি করে ফেলেন। কিন্তু স্টিভেনটন ছাড়ার পর মাঝের আট বছরে, বাথে বা সাউথ হ্যাম্পটনে জেন অস্টেন সেরকম উল্লেখযোগ্য কিছু লিখে উঠতে পারেন নি। চাওটনে এসে আবার লেখার জগতে ডুব দিলেন তিনি। আগের উপন্যাসগুলির প্রয়োজনীয় রদবদল করলেন, সেগুলির প্রকাশে নতুন করে উদ্যোগ নিলেন।
১৮১১ সালে খানিকটা আর্থিক ঝুঁকি নিয়েই প্রকাশিত হয়েছিল সাহিত্য সমাজে তখনো অবধি একেবারেই অপরিচিত জেন অস্টেনের ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’ উপন্যাসটি। এর আগে প্রকাশকদের কাছে উপন্যাসের খসড়া পাঠিয়েও একাধিকবার প্রত্যাখ্যানের অভিজ্ঞতা হয়েছিল জেন অস্টেনের। ফলে উপন্যাস প্রকাশের বাস্তব রাস্তা নিয়ে তিনি গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেন। বই প্রকাশের প্রচলিত চারটি উপায় ছিল তাঁর সামনে। প্রথমটি হল নিজের খরচে বই প্রকাশ করা ও বিক্রির মাধ্যমে সেই খরচ তুলে নেওয়া। দ্বিতীয়টি হল বই প্রকাশের আগেই গ্রাহক তৈরি করা ও গ্রাহকদের থেকে পাওয়া টাকায় বই ছাপা। তৃতীয়টি হল কপিরাইট প্রকাশকের হাতে তুলে দেওয়া। চতুর্থটি হল প্রকাশকের সঙ্গে কমিশন চুক্তি প্রথায় বই বের করা। জেন এই চতুর্থ রাস্তাটি নেন। তিনিই দেন মুদ্রণ খরচ। কমিশনের বিনিময়ে বিজ্ঞাপন ও বিপণনের ব্যবস্থা করেন প্রকাশক থমাস ইগার্টন। ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’ উপন্যাসটি প্রকাশের পরে বেশ সাড়া ফেলে। কিছুদিনের মধ্যেই এর প্রথম সংস্করণ নিঃশেষিত হয়ে যায়। প্রকাশকের কাছ থেকে কমিশন বাবদ জেন পান ১৪০ পাউন্ড।
‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’র সাফল্য জেন অস্টেনকে যেমন আত্মবিশ্বাস জোগাল, তেমনি তার পরের উপন্যাস প্রকাশের পথকেও সুগম করে দিল। ১৮১১ সালের ৩০ অক্টোবর ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’ প্রকাশিত হয়। তার পরেই ‘ফার্স্ট ইম্প্রেশন’ এর পুরনো পাণ্ডুলিপিটির পরিমার্জন শুরু করেন অস্টেন। পুরনো নাম বদলে নতুন নাম রাখেন ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’, আর পাঠিয়ে দেন প্রকাশকের কাছে। ১৮১২ সালে প্রকাশক থমাস ইগার্টন ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এর কপিরাইট কিনে এটি প্রকাশে সম্মত হন। ১৮১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ প্রকাশিত হয়।
‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ প্রকাশের পর অস্টেন তাঁর তৃতীয় উপন্যাস ‘ম্যানসফিল্ড পার্ক’ লেখার কাজ এগিয়ে নিয়ে যান। ১৮১৩ সালের নভেম্বরেই প্রকাশক ইগার্টন ‘ম্যানসফিল্ড পার্ক’ ছাপার বিষয়ে তাঁর আগ্রহ জানিয়ে দেন। ১৮১৪ সালের ৯ মে এটি প্রকাশিত হয়।
ম্যানসফিল্ড পার্ক প্রকাশের আগেই জেন অস্টেন তাঁর চতুর্থ উপন্যাস ‘এমা’ লেখার কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। ১৮১৪ র জানুয়ারি মাসেই ‘এমা’ লেখার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল, আর তা শেষ হল ১৮১৫ সালের ২৯ মার্চ। ১৮১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে এমা প্রকাশিত হল। জেন অস্টেনের প্রকাশক বদলাল এইবার। ‘এমা’ প্রকাশ করলেন জন মারে।
‘এমা’ প্রকাশের আগেই একটি পুরনো পাণ্ডুলিপির রূপান্তরের কাজ শুরু করেন জেন অস্টেন। ১৭৯৮-৯৯ সালে ‘সুসান’ নামে যে আখ্যানটি তিনি লিখেছিলেন, ১৮১৫-১৬ সালের রূপান্তরে তা বর্তমানে পরিচিত ‘নরদ্যাঙ্গার অ্যাবে’র চেহারা নেয়। ১৮১৬ সালে একটি নতুন উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিও জেন অস্টেন সম্পূর্ণ করেন, যার নাম ‘পারসুয়েশন’। তবে ‘নরদ্যাঙ্গার অ্যাবে’ ও ‘পারসুয়েশন’ এর প্রকাশ তিনি দেখে যেতে পারেন নি। ১৮১৭ সালের ১৮ জুলাই জেন অস্টেন মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পরে ১৮১৭ সালের ডিসেম্বরে জেনের দাদা হেনরী অস্টেনের ভূমিকা সহ প্রকাশিত হয় এই দুটি উপন্যাস। এই উপন্যাস দুটিতেই লেখক হিসেবে প্রথম নাম ছাপা হল জেন অস্টেনের। সেইসঙ্গে জানিয়ে দেওয়া হল তিনিই ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’, ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ ইত্যাদি উপন্যাসের লেখিকা। জীবদ্দশায় প্রকাশিত উপন্যাস সমূহের ‘এ লেডি’ নামের আড়াল ভেঙে পাঠক জানতে পারল তাদের লেখকের প্রকৃত নাম।
চাওটন থেকে মাঝেমাঝেই জেনকে লন্ডনে তার দাদা হেনরীর বাড়িতে এসে থাকতে হত প্রকাশিতব্য বইয়ের প্রুফ দেখা, নতুন বইয়ের জন্য প্রকাশকের সঙ্গে চুক্তি ইত্যাদি ব্যাপারে। আর এক ভাই এডওয়ার্ডেরও লন্ডনে বাড়ি ছিল। তিনিও তার সন্তানদের নিয়ে লন্ডনে আসতেন। বইয়ের কাজের ফাঁকে ফাঁকেই তিনি ভাইপো ভাইঝিদের নিয়ে লন্ডনের নানা জায়গায় যেতেন। ক্যাসান্দ্রা চাওটনেই মূলত থাকতেন। প্রিয় দিদিকে বইপ্রকাশ ও অন্যান্য নানা খবরাখবর দিয়ে জেন নিয়মিত চিঠি লিখতেন। যদিও জীবিত অবস্থায় প্রকাশিত কোনও বইতেই লেখিকা হিসেবে জেন অস্টেনের নাম ছাপা হয় নি, কিন্তু বোনের গর্বে গর্বিত হেনরি বন্ধুবান্ধবদের অনেককেই সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি বা প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস এর লেখিকা কে তা জানিয়ে দিয়েছিলেন। নানা জায়গায় ছড়ানো ছেটানো অস্টেন পরিবারের সদস্যরা এবং তাদের মাধ্যমে আরো অনেকে জেনে গিয়েছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এর লেখিকা আসলে কে। ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ উপন্যাসটি কতটা জনপ্রিয় হয়েছে তা জেন অস্টেন বুঝেছিলেন লন্ডনে এক চিত্র প্রদর্শনীতে প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিসের চরিত্রদের ছবি আঁকা হয়েছে দেখে। নানা পত্রপত্রিকাতেও বইটি সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা বেরিয়েছিল।
১৮১৭ সালের গোড়ার দিকে জেন অস্টেন ‘স্যান্ডিটন’ নামের একটি নতুন উপন্যাস লেখার কাজে হাত দেন। কিন্তু এই সময় থেকেই অসুস্থতা তাঁকে গ্রাস করতে থাকে। তিনি লেখার ক্ষমতা হারান। এগারোটি অধ্যায় লেখার পর ‘স্যান্ডিটন’ অসমাপ্ত থেকে যায়। মে মাসে দিদি ক্যাসান্দ্রা তাকে নিয়ে রওনা হন উইনচেস্টারে। সেখানকার হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলতে থাকে। উইনচেস্টারের একটি বাড়িতেই জেনকে নিয়ে থাকতেন দিদি ক্যাসান্দ্রা, বাড়িটির ঠিকানা ছিল ৮ নং কলেজ স্ট্রিট। মাঝে মাঝেই যেতে হত হাসপাতালে। ডাক্তারদের সব রকমের চেষ্টা সত্ত্বেও ১৮ জুলাই বাড়িতে প্রিয় দিদির কোলে মাথা রেখে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন জেন অস্টেন। তাঁর বয়েস তখন মাত্র একচল্লিশ।