প্রাচীন ভারতের উত্তরাধিকার : হিন্দুত্ববাদীদের হাতেই ছেড়ে দেবেন সেকুলার - বামেরা ?
- 16 November, 2020
- লেখক: বিশ্বজিৎ রায়
বিজেপির সবচেয়ে শক্তির জায়গাগুলির অন্যতম দেশের ঐতিহ্যর আত্তীকরণের কথা ক্রমাগত বলে যাওয়া। যারা বিজেপির সঙ্গে লড়তে চান, সেই সেকুলার ও লেফটরা কীভাবে দেখবেন আমাদের ইতিহাস, অতীত ও ঐতিহ্যকে ?
১
হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়তে চাও, তো রামায়ণ-মহাভারত পড়েছ ? গুহক চণ্ডাল কে, শুদ্রক কে, জানো? না জানলে লড়াইটা করবে কি ভাবে? লড়াইটা চৈতন্যের স্তরে। গান্ধী তুলসীদাসের রামচরিতমানস থেকে হরিজনের ধারণা নিয়েছিলেন। রাম আর তার রাজত্ব একটা প্রতীক কিন্তু ওটাই শেষ নয়। এর উত্তরণ ঘটাতে হবে। আজকের রাম হল ঢোঁড়াইচরিত মানসের ঢোঁড়াই। সতীনাথ রামচরিতমানসের জনপ্রিয়তাকে মাথায় রেখে সমসাময়িক দেশের রাজনীতি এবং প্রান্তিক জনের চেতনা ও অভিজ্ঞতার আলোয় নতুন রামকে এঁকেছিলেন। ধর্মের ইতিহাস বহুস্তরীয়।এটা একটা মহাফেজখানা। ভারতে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ধর্মের ধারা শুধু অন্ত্যজ বা দলিতদের মধ্যেই নয়, সমাজের অন্য স্তরেও ছিল। সঙ্ঘ পরিবারের বিরুদ্ধে লড়তে হলে ধর্মকে নিয়ে ওঁদের আধিপত্যবাদী বয়ানের পাল্টা প্রতিবাদী বা অন্তর্ঘাতকারী বয়ানগুলিকেও জানতে-বুঝতে হবে। এটা ধর্মের ‘ইন্সট্রুমেন্টালিস্ট’ ব্যবহার থেকে থেকে আলাদা। ইতিহাস দিয়ে রাম- দুর্গা প্রমাণ বা অপ্রমাণ করা যাবে না। রবীন্দ্রনাথ যাকে কবির মনোভূমি বলেছেন, লড়াইটা সেখানেও।
বক্তা প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র যিনি নিম্নবর্গীয় ইতিহাসচর্চার অন্যতম পরিচিত মুখ।
২
হিন্দু ধর্ম তথা প্রাচীন ভারত থেকে আমাদের সময়োপযোগী নেওয়ার মতো কি আছে? জাতপাতের অচলায়তন আর নারী- বিদ্বেষ ছাড়া! ধর্মের নিন্দা করতে চাই না। কিন্তু মনুস্মৃতির বিরোধিতা তো করতেই হবে। উমা চক্রবর্তী একবার বলেছিলেন আমি তো এক জন ভালো হিন্দুই হতে চাই। কিন্তু সেটা কোথায়? হিন্দু ধর্মের নামে এখন বিজেপি –আর এস এস যা সব করছে, তার বিরুদ্ধে কোনও হিন্দু প্রতিষ্ঠান প্রতিবাদ করছে কি? তাছাড়া প্রাচীন ভারত বা হিন্দু ধর্ম নিয়ে আমরা বলতে গেলে ওরা শুনবে কেন? ওরা তো বলে: কমিউনিস্টরা ধর্মশাস্ত্র জানে না, রামায়ণ-মহাভারত জানে না। তা ওরাও তো জানে না। প্রাচীন ভারতের সঙ্গে প্রাচীন গ্রিসের তুলনা টানতে গেলেই তেড়ে আসবে। চার্বাকদের নিয়ে বলতে গেলে ওরা উড়িয়ে দেবে। তাই প্রতিবাদের প্রশ্নে আমরা ধর্মকে ব্যবহার করব না। পুরোন বামপন্থী ধ্যানধারণা থেকে সাধারণ মানুষের রুটি-রুজি, জীবনসংগ্রামের ইস্যুগুলিকে সামনে আনতে হবে। প্রতিবাদের পুরোন ভাষার গুরুত্ব আজও আছে। হ্যাঁ, পরিস্থিতি অনেকটা বদলে গেছে এটা ঠিক। কিন্তু আধুনিকতা তথা সংবিধান, আইনের শাসন, গণতন্ত্রের কথা বলতেই হবে। তবে একটা তাস নিয়ে খেললে হবে না। ওরা ঘন ঘন তাস বদলাচ্ছে। আমাদের স্ট্রাটেজিও একটাই হবে না।
বক্তা প্রখ্যাত বামপন্থী ইতিহাসবিদ তনিকা সরকার যার আর এস এসের অন্দরমহল নিয়ে গবেষণা দেশজ ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী সংগঠনটির হাইড্রাসুলভ কার্যকলাপ সম্পর্কে আমাদের ওয়াকিবহাল রেখেছে।
৩
এদেশে হিন্দুত্ববাদ একটি শক্তিশালী মতাদর্শ হয়ে উঠছে। ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির একটা ঐতিহ্য আছে। কিন্তু সংস্কৃত ভাষায় লেখা শাস্ত্রভিত্তিক ঐতিহ্যের আবেদন সীমিত। সে জন্য আর এস এস শাস্ত্র নিয়ে বেশি কপচায় না। বদলে ওরা একটা সোনার ভারতের বানানো ইতিহাস বলে শোনায়। সেখানে ফিরলেই আজকের সমস্যামুক্তির কথা বলে লোককে ভোলায়। এর বিরুদ্ধে বামপন্থীদের লড়াইতে হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির বস্তুবাদী- যুক্তিবাদী ব্যাখ্যার একটি ঐতিহ্য আছে। হিন্দু ধর্মের প্রধান গ্রন্থগুলির বিশ্লেষণের পাশাপাশি ব্রাহ্মণ্যবাদী ধারার প্রতিস্পর্ধী দর্শন ও ধর্মমতের ইতিহাস নিয়ে ডি ডি কোসাম্বি থেকে সুকুমারী ভট্টাচার্য, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, জানকী বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে গেছেন। আজকের বামেদের তা থেকে শিখতে হবে, তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। হিন্দুত্ববাদীদের শিবিরে প্রকৃত ইতিহাসমনস্ক, শিক্ষিত লোক নেই। আমরা হিন্দুত্বের সংজ্ঞা (রি-ডিফাইন) বদলে দিতে পারি।
বক্তা প্রখ্যাত মার্ক্সবাদী সাহিত্য সমালোচক ও বামপন্থী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাসকার শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। মুসোলিনির বন্দিশালায় মৃত আন্তনিও গ্রামশ্চি ও হিটলারের মুরুব্বিদের হাতে গুমখুন রোজা লুক্মেমবুরগ, এই দুই ব্যতিক্রমী কমিউনিস্ট বিপ্লবীর মননভুবনকে পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের কাছে হাজির করার কাজেও শমীকবাবু অন্যতম পথিকৃৎ।
৪
এটা দুঃখের বিষয় যে ডি ডি কোসাম্বী, রোমিলা থাপার, রামশরণ শর্মাদের পর প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস নিয়ে গবেষণা নতুন প্রজন্মের বামপন্থী ইতিহাসবিদরা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। ফলস্বরূপ প্রাচীন ভারত চর্চা বা সাধারণ মানুষের কাছে এ নিয়ে বলার অধিকার ও সুযোগ এখন হিন্দুত্ববাদীদের একচেটিয়া। বেদ- উপনিষদ- পুরানের কাল সম্পর্কে যা খুশি তাই গালগল্প বলে বেড়াচ্ছে।
বক্তা ইতিহাস ও তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক কুণাল চট্টোপাধ্যায় যার বলশেভিক বিপ্লব নিয়ে পড়াশুনোর ব্যপ্তি ও গভীরতা পরিচিত।
প্রথম তিনটি বক্তব্য ( আমি যতটুকু বুঝেছি) ফ্যাসিবাদ ও আজকের ভারত নিয়ে সাম্প্রতিক এক ধারাবাহিক বক্তৃতামালায় শোনা। চতুর্থ জনের মন্তব্য দিল্লির জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ধারার বাম ছাত্র আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়দের সঙ্গে কলকাতায় এক আলোচনা সূত্রে। প্রসঙ্গ হিন্দুত্ববাদী তান্ডবের বিরুদ্ধে মার্ক্স- ভগত সিং- আম্বেদকর-পেরিয়ার-ফুলেদের সূত্রে বাম ও দলিত আন্দোলনকে মেলানোর প্রয়াস।
বামপন্থার বিভিন্ন ঘরানার চার ইতিহাসবিদ কমবেশি রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্টও বটেন। তাদের মতামতে অধুনা রাষ্ট্রক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদীদের আগ্রাসনের মোকাবিলায় প্রাচীন ভারতের প্রধান ও গৌণ- প্রান্তিক ধর্মগুলি, ধর্মাশ্রিত সংস্কৃতি, দর্শনের বিভিন্ন ধারা নিয়ে চর্চার প্রয়োজনীয়তা এবং তা থেকে আমাদের শস্ত্র সংগ্রহের গুরুত্ব নিয়ে বাম বৌদ্ধিক মহলের মতবিরোধ প্রতিফলিত। এই তর্কের ধারাবাহিকতায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসের প্রতি বাম-সেকুলারদের মনোভাবের কথা অবধারিতভাবেই আসে।
গণেশের দুগ্ধপান বা তার নেয়াপাতি ভুড়ি শোভিত ধড়ের উপর হস্তিমুন্ডের নেপথ্যে প্রাচীন শল্যচিকিৎসার চমৎকারিত্ব, মাধ্যাকর্ষণ-বিজয়ী মুনি-ঋষিদের শূন্যভ্রমণ, রাম না হতেই রামায়ণের মতোই ব্রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের বহুকাল আগেই, দেবতা এবং দেবাংশী পুরুষদের পুষ্পক রথে বিমানবিহার, সুলক্ষণযুক্ত পুত্রলাভে গর্ভসংস্কার বা গো-মূত্র তথা পঞ্চগব্যের রোগনিবারণ ক্ষমতা—ইত্যাদি নিয়ে নরেন্দ্র মোদী – মোহন ভাগবতের নেতৃত্বে গৈরিক বাহিনীর সাম্প্রতিক উবাচগুলি দেশবাসীর কাছে বহুলপ্রচারিত। আম জনতা তো বটেই, ইতিহাসবিদ ও বৈজ্ঞানিক মহলেও সঙ্ঘ-প্রাণিত হিন্দু সভ্যতার গৌরবগাথা প্রতিষ্ঠায় পদার্থবিদ্যা- রসায়ন- গণিত থেকে শুরু করে শারীরবিদ্যা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রাচীন ভারতীয় আবিষ্কার- উদ্ভাবন বা জ্ঞানের ঐতিহ্য বিষয়ে নানা দাবি তোলা হচ্ছে সরকারি মদতে। টেলিভিশনে যোগগুরু বাবা বা মায়েদের কল্যাণে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী এই দাবিগুলির প্রধান সমর্থক ও সামাজিক ন্যায্যতার উৎপাদক।
এই দাবিগুলিকে দেশীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রকৃত ইতিহাসের আলোয় বিচার- বিশ্লেষণ করে ‘দুধ কা দুধ, পানি কা পানি’ আলাদা করে জনসমক্ষে প্রতিস্পর্ধী প্রতর্ক গড়ে তোলার তাগিদ আজকের বাম-সেকুলারদের মধ্যে বিশেষ দেখছি না। বরং সাধারণভাবে আজকের বামপন্থী বা যুক্তিবাদী- বস্তুবাদী ঘরানার ইতিহাসবিদ- বৈজ্ঞানিকরা তা অদ্ভুত বিশ্বাসপ্রসূত উদ্ভট বলে নাকচ করে তাদের দায়িত্ব শেষ করছেন। হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রপ্রকল্পের অতীতনির্মাণের প্রতি এই অতিপ্রতিক্রিয়ায় ‘বাথ ওয়াটার’-এর সঙ্গে ‘বেবি’-কেও ছুঁড়ে ফেলার তাড়নাই প্রবল। আমরা যারা ইতিহাসবিদ বা বৈজ্ঞানিক নই, তারাও রাজনৈতিক ঘরানার সূত্রে নিয়ে পাড়ার চায়ের দোকানে বা নিজেদের আড্ডায় সঙ্ঘী অন্ধ বিশ্বাস, কুসংস্কার ও অপবিজ্ঞান নিয়ে হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠছি। আমজনতার মনোজগতে এইসব দাবি বা বিশ্বাস আজ আরও বেশি করে শেকড় পেলেও আমরা তাদের থেকে নিজেদের অগ্রণী ভেবে আত্মশ্লাঘায় ভুগছি। কেন না এতকাল ধরে আমাদের স্বঘোষিত বামপন্থা, আধুনিকতা এবং বিজ্ঞানসন্মত ধ্যানধারণা যে সমার্থক। জনসংস্কৃতিতে শাসকের মতাদর্শ- সংস্কৃতির আধিপত্য নিয়ে মার্ক্স থেকে গ্রামশি কপচালেও চেতনার স্তরে পাল্টা ইতিহাসটা হাজির করা দূরে থাক, এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে চর্চার ধারাটিও শুকিয়ে গেছে।
মজা হচ্ছে, এরই মধ্যে আমরা নিজেদের মধুমেহ- রক্তচাপ, হাঁটু সহ অন্যান্য অস্থি-গ্রন্থি বা মুত্রথলির সমস্যা সামলাতে ‘যোগা’ করছি। কারণ এটা শারীরবিজ্ঞানসন্মত। আয়ুর্বেদ মেনে গাছ-গাছড়ার শিকড়-বাকড় জোগাড় করে সেদ্ধ বা ভিজিয়ে খাচ্ছি। কারণ এর পিছনে উদ্ভিদবিজ্ঞানের অনুমোদন আছে। তার সঙ্গে আছে পরম্পরাগত লোকজ্ঞানের প্রতি নবার্জিত আস্থা। দ্বিতীয়টি পশ্চিমি ধ্রুপদী আধুনিকতা ও বিজ্ঞানভাবনার উৎসজাত না হলেও ইদানীং পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থা, সর্বপ্রাণঘাতী প্রযুক্তি ও ভোগবাদের বিষময় ফলাফল নিয়ে বিশ্বজুড়ে পরিবেশ আন্দোলনের ফল। তার প্রভাবে দেরিতে হলেও নবীন বামপন্থীদের একাংশের মধ্যে সমাজপ্রগতি তথা মানবসভ্যতার অভীষ্ট যাত্রাপথ নিয়ে পুরোন স্বতঃসিদ্ধগুলিকে ফিরে দেখার দায়বোধ দেখা দিচ্ছে। এই ‘এক্লেক্টিজম’ বা বিভিন্ন উৎসজাত ধ্যানধারণাকে প্রতিদিনের জীবনে আমরা মেলাই, অনেক সময়ই সে সময়ে সচেতন না থেকেই। একে কেন্দ্র করে নিজেদের বিশ্বাস ও অভ্যাসগুলি পুনর্বিচারের দায় ও টানাপড়েন থাকে না। কিন্তু এটা ভাবের ঘরে চুরি বললে কম বলা হয়। এ আসলে আমাদের সামগ্রিক বৌদ্ধিক বন্ধ্যাত্ব এবং তা স্বীকারে অনীহার প্রকাশ।
হিন্দু ধর্ম-সমাজ, সঙ্ঘ পরিবার ও চলতি সেকুলার-বাম দৃষ্টিকোণ
শুধু প্রাচীন ভারতে বস্তুবাদ ও বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস নয়, নয়ের দশক থেকেই দেখছি সেকুলার-লিব্যারাল রাজনীতি, বিশেষত বাম মহল ইসলাম-পূর্ব ভারতের সামগ্রিক ইতিহাসের উপর সঙ্ঘ পরিবারের মৌরসিপাট্টা কার্যত মেনে নিয়েছে। একাদেমিয়া ও অ্যাক্টিভিজমের মধ্যে পূর্বতন সাঁকোটি ভেঙ্গেচুরে যাওয়ায় কিছু বহুব্যবহারে জীর্ণ লব্জের বাইরে প্রতিস্পর্ধী প্রতর্ক হাজির করার তাগিদ ও ক্ষমতা আমাদের নেই।
ঔপনিবেশিক কালে প্রাচীন ভারত ঘিরে মেকলে- ম্যাক্সমূলরের তাচ্ছিল্য- মুগ্ধতার দ্বৈত বয়ানের সঙ্গে আমরা পরিচিত। রোমিলা থাপারের মতো ইতিহাসবিদরা এই দুটি ধারাকেই বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস চর্চার পক্ষে বিপদজনক মনে করেন। এর জেরে স্বাধীনতা আন্দোলনের পর্বে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক ইংরেজ প্রশাসক-ইতিহাসবিদ এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের নানা ঘরানার মধ্যে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের ভাল-মন্দ এবং দেশজ ঐতিহ্য ও পশ্চিমি আধুনিকতার সংঘাত-সংশ্লেষ নিয়ে নানা বিতর্ক, বলা ভালো বিতণ্ডা চলেছিল। ভারত সম্পর্কে মেকলে ঘরানার ব্রিটিশ ইতিহাসবিদদের ঔপনিবেশিক তাচ্ছিল্য ও দম্ভের জবাবে ম্যাক্সমূলর ঘরানার প্রভাবে বঙ্কিম থেকে তিলক- রাণাডে, রমেশ মজুমদার থেকে ভান্ডারকর বস্তু ও ভাবজীবনে প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার অর্জনকে কার্যত আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতার সমতুল্য প্রমাণের চেষ্টা চালিয়েছেন। সে দাবিতে সঙ্ঘ পরিবার আরও কট্টর ও মুক্তকচ্ছ। তবে এটা মনে রাখা জরুরি হিন্দুত্ববাদীরা মুখে ম্যাক্সমুলরপন্থী হলেও আসলে হিটলারপন্থী।
অন্যদিকে এদেশের বাম-সেকুলার চিন্তকদের কয়েকজনকে বাদ দিলে অধিকাংশই মেকলে-পন্থী। স্বাধীনতার আগে এস এ ডাঙ্গে বা ই এম এস নাম্বুদ্রিপাদের মতো প্রথম যুগের ভারতীয় কম্যুনিস্ট নেতারা সমসাময়িক কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা গোত্রীয় হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে তর্ক- বিতর্কের প্রয়োজন প্রাচীন ভারত নিয়ে পড়াশুনো করতেন। ডাঙ্গে তাঁর ‘ ঈন্ডিয়া ফ্রম প্রিমিটিভ কমুনিজম টূ স্লেভারি , এ মারক্সিস্ট স্টাডি অফ এনসিয়েন্ট হিষ্ট্রি ইন আউটলাইন’ বইতে লেখেনঃ “এটা আমার দৃঢ ধারণা যে হিন্দু ধর্মীয় শাস্ত্রাদি, সামাজিক রীতিনীতি এবং অতিকথা (মাইথোলজি)র বিশাল সম্ভার সম্পর্কে চর্চা জরুরি। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের আলোয় পড়লে এবং ব্যাখ্যা করলে হিন্দু রক্ষণশীল ও বুর্জোয়া দর্শনের প্রবক্তারা লজ্জা পাবে।” নিজেদের তত্ববিশ্বাস মোতাবেক সেই চেষ্টাটাও আজকের মার্ক্সবাদীরা করেন না। উলটে বাম ভাবনার সঙ্গে হিন্দুত্ববাদীদের ভাবনা বিপরীত মেরুতে থাকলেও সেই সময়কে ‘এসেন্সিয়ালাইজ’ করার প্রশ্নে দুই তরফেই সমাপতন লক্ষ্যনীয়।
আমাদের পাথুরে বাম বয়ানে প্রাচীন ভারত ছিল এক ভাববাদী কল্পস্বর্গ যা শাস্ত্রবেত্তাদের বাগাড়ম্বরের আড়ালে অলঙ্ঘনীয় বংশানুক্রমিক বর্ণব্যবস্থা, মায়াবাদ ও কর্মফলবাদ ভিত্তিক ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের যুগলবন্দিতে দীর্ঘস্থায়ী দমন-পীড়ন, কদাচার-কুসংস্কারে ন্যুব্জ, স্থবির। রাজসভা, পুরোহিত ও নগরশ্রেষ্ঠীদের বৈভব ও ক্ষমতার প্রদর্শনীর আড়ালে গ্রামভারত এক অচলায়তন যেখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী সময় থমকে ছিল। ঔপনিষদিক ঔদার্য আসলে আধিভৌতিক বিশ্বচেতনার বুদ্বুদ মাত্র যা ভাববাদী দর্শনের আড়ালে কুৎসিত ও হিংস্র সামাজিক প্রকাশগুলিকে সাময়িক চাপা দেয়। অনেক কাল পরে এই অহল্যাভূমির প্রাণ ফেরে পশ্চিমি ঔপনিবেশিক জাদুকাঠির ছোঁয়ায়।
সন্দেহ নেই, নাজিবাদ ও ফ্যাসিবাদের আগে জার্মান রোমান্টিসিজম যদি হয় হিন্দুত্ববাদের পূর্বসূরি, তবে সিপাহি বিদ্রোহের কালে মার্ক্স- এঙ্গেলসের ভারতদর্শন, তথা ‘এশিয়ান মোড অফ প্রোডাকশন’ ও ‘ওরিয়েন্টাল ডেসপ্টিজম’-এর ধারণা আমাদের বামমার্গীদের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদন সম্পর্ককে কেন্দ্র করে ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা তথা শ্রেণীসংগ্রামের গতিশীল প্রবাহের ধাক্কায় কালসন্ধিতে সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের অনিবার্যতার মার্ক্সীয় সূত্রগুলির বৌদ্ধিক অভিঘাত অবশ্যই যুগান্তকারী। ইতিহাসচর্চার পুরোন ধোঁয়াটে প্রদীপ ও কালিমাচ্ছন্ন লণ্ঠনগুলিকে হঠিয়ে একটি দূরগামী ও জোরালো সার্চলাইটের আলোয় অতীত ও ভবিষ্যৎ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সে যে সুড়ঙ্গের মধ্যে আলো, তাই সুড়ঙ্গের দেওয়ালই সেই আলোর সীমানা আর আমাদের দূরদৃষ্টির সীমা --- এই বোধ ক্রমে ক্রমে সঞ্চারিত হয়েছে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়েই।
মার্ক্সবাদের জনকেরা উপনিবেশিক বর্বরতাকে ধিক্কার ও শোষিত-নিপীড়িত কালো-বাদামি মানুষের প্রতি সহানুভূতি জানালেও তাঁদের চোখে মানবসভ্যতার প্রগতির ভরকেন্দ্র ইউরোপ। এই প্রগতিতে পরিবর্তনশীল উৎপাদন ব্যবস্থা ও সমাজ-সম্পর্ক, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভূমিকা সম্পর্কে তাঁদের বিশ্লেষণও ইউরোপকেন্দ্রিক। যার সূত্রে পশ্চিমি ঔপনিবেশবাদ ও পুঁজিবাদ বিশ্ব-ইতিহাসের সারথি হয়ে দাঁড়ায়। যে ব্যাখ্যায় নবীন পুঁজিবাদী প্রতীচ্যের ঔপনিবেশিক ধর্ষণের ফলে দীর্ঘ বন্ধ্যাত্বের পর অসূর্যস্পশ্যা গতযৌবনা প্রাচ্যের বৈপ্লবিক গর্ভসঞ্চার ঘটে। অপরিমেয় রক্তপাত এবং দুঃসহ যন্ত্রণা সত্ত্বেও আখেরে তা ধর্ষিতার পক্ষে মঙ্গলজনক হয়ে ওঠে। যেহেতু বস্তুর চলমানতায় বলের ভূমিকা অনস্বীকার্য, তাই এশিয়া-আফ্রিকা- লাতিন আমেরিকার এহেন বলাৎকার তথা ইউরোপীয় শিশ্নক্ষুধাকে ইতিহাসের অনিবার্য সুধাক্ষরণের উপায় জ্ঞানে ধারণ করাই বিধেয় হয়ে ওঠে।
তবে ভারত ইতিহাসের অন্যতর বস্তুবাদী পাঠগুলি ভিন্ন কথা শোনায়। তারা জানায়ঃ প্রাগার্য, প্রাক- বৈদিক পর্ব থেকে শুরু করে আর্য – অনার্য পারস্পরিক বৈরিতা ও আত্তীকরণ সূত্রে অর্থনীতি- রাজনীতি, ধর্ম-সংস্কৃতি এবং সামাজিক অনুশাসনের বিবর্তন সূত্রে আজকের গতিতে না হলেও উপমহাদেশের সমাজ ছিল চলমান। প্রাচীন কালের নানা পর্বে হিন্দু- বৌদ্ধ-জৈন- লোকায়তিক ও উপজাতীয় ভারতের ভিতরে বর্ণ- গোষ্ঠী- ভাষা ও অঞ্চল ভেদে বিশ্বাস ও যুক্তির বহুস্বর প্রতিধ্বনিত হয়েছে বারংবার। রমাপ্রসাদ চন্দ, অতুলকৃষ্ণ সুর, ডি ডি কোসাম্বী, ভান্ডারকর, রোমিলা থাপার, রামশরণ শর্মা, রাহুল সাংকৃত্যায়ন, নীহাররঞ্জন রায়, সুকুমারী ভট্টাচার্য প্রমুখ নৃতত্ত্ববিদ, সমাজতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদদের গবেষণায় তা আমরা জেনেছি।
রোমিলা থাপার তাঁর ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস—১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ – ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দ’ (ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯৮০) বইতে স্পষ্টতই ‘ওরিয়েণ্টাল ডেস্পটিজম’ বা প্রাচ্যদেশীয় স্বেচ্ছাচার-এর তত্ত্বপ্রসূত ‘ভারতীয় সংস্কৃতি(র) বহু শতাব্দী ধরেই অপরিবর্তিত ও জড়বৎ’ দশার ধারণাকে ‘অতিশয়োক্তি’ বলে নিন্দা করেছেন। “জাতিভেদ প্রথা, ভূমি ব্যবস্থা ও বাণিজ্যিক কাজকর্মের কয়েক শতাব্দী ব্যাপী ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে পরিবর্তনশীল সামাজিক সম্পর্কের সামান্য বিশ্লেষণ করলে প্রমাণ হয়ে যেত যে, ভারতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক গঠন, আর যাই হোক, মোটেই স্থিতিশীল ছিল না... আশ্চর্য লাগে উনবিংশ শতকে ইউরোপে যেমন সেখানকার ইতিহাসের ক্রমবিবর্তনের ধারা আবিষ্কারের উপর প্রচণ্ড জোর দেওয়া হয়েছিল, এশিয়ার ইতিহাস অনুসন্ধানের সময় এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়নি”।( সূত্র ঐ)।
যদিও আজকের নানা গবেষণায় প্রমাণিত যে শিল্পবিপ্লব কালের ইউরোপের গতিশীলতার তুলনায় স্থবির হলেও প্রাচীন ভারত বা চিন ও জাপান যে রেনেসাঁ ও রিফরমেশন- পূর্ব তো বটেই, তার পরবর্তী কালের ইউরোপের থেকে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মানদণ্ডে পিছিয়ে ছিল না। কৃষি ও নগরসভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সমুদ্র ও স্থলবাণিজ্য, পর্যটন-পরিব্রাজন সূত্রে তথ্য, জিজ্ঞাসা ও জ্ঞান বিনিময়ে বাকি বিশ্বের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ । থাপার বা তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের রণবীর চক্রবর্তীর মতো (প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সন্ধানে, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৩৯৮) ইতিহাসবিদেরা দেখিয়েছেন আনুমানিক ২০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকে ৩০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্বে রোম সামাজ্য তথা ভূমধ্যসাগরীয় গ্রেকো-রোমান সভ্যতা এবং পশ্চিম এশিয়া তথা আরব জগতের সঙ্গে বানিজ্যিক সম্পর্ক সূত্রে ভাবজগতের আদান-প্রদানও সজীব হয়ে ওঠে। পূবে চিন ও ইন্দো-চায়না কাছে আসে। ইথিওপিয়া থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত এই দেওয়া-নেওয়ার সূত্রে জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, চিকিৎসাবিদ্যা, ধাতুবিদ্যা, স্থাপত্যবিদ্যা, জাহাজনির্মাণ, সমুদ্রবিদ্যা, মানচিত্র ও মুদ্রা ব্যবস্থার বিকাশ ঘটেছে। প্লিনি- টলেমি-মেগাস্থিনিস থেকে তাভারনিয়ের-বারনিয়ের-মানুচ্চি, হুয়েন সাং থেকে আল বেরুনি-- পশ্চিম ও পুবের ভারত- পর্যটকদের বিবরণী তার সাক্ষ্য দেয়। কৃষি ও বাণিজ্যিক অর্থনীতির বিকাশের সঙ্গে নগর-লাগোয়া গ্রামাঞ্চলে বা নগরের প্রান্তে নানা পেশার দক্ষ কারিগর- শিল্পীদের সঙ্ঘ বা গিল্ড জাতীয় সমাজ- সংগঠনের বিস্তার ঘটেছে ইউরোপের প্রাক-পুঁজিবাদী সমাজের মতোই। মৌর্য থেকে মুঘল যুগে মণিমুক্তোয় মোড়া, সুগন্ধি মসলায় ম ম ভারতীয় সমৃদ্ধির কিংবদন্তীর নেপথ্যে কিছু ঐতিহাসিক সত্যতা তো প্রমাণিত। সেই ভারতের প্রতি ভাসকো দা গামা- কলম্বাসদের আকর্ষণ সোনায় মোড়া ইনকা-আজতেক সভ্যতার প্রতি করতেস-পিজেরোদের লুটেরা লুব্ধতার থেকে কম ছিল না।
প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞান ও বস্তুবাদ
সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর ‘ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য’ ( ইংরেজি ‘লিটারেচার ইন ভয়েস এজ’ এর অনুবাদ) বইতে অথর্ববেদ নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে প্রাচীন ভারতে ব্যাধি ও চিকিৎসার কথা উল্লেখ করেছেন। পূর্বকালের বৈদিক সাহিত্যের তুলনায় অথর্ববেদে অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে বস্তুবাদী চর্চা বাড়ার ইঙ্গিত। পশুপালক আর্য সমাজ কৃষিজীবী হয়ে ওঠার এই পর্বে রোগযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ইন্দ্রজাল ও ধর্মাচরণ তথা মন্ত্রপাঠ ও যাগযজ্ঞের মাধ্যমে দেবদেবীদের তুষ্টিসাধনে বিশ্বাসের প্রাধান্য থাকলেও ক্রমে ভেষজবিদ্যা তথা আয়ুর্বেদ চর্চার মাধ্যমে প্রাকৃতিক উপায়ে রোগ- নিরাময় বা তার প্রকোপ প্রশমনের চেষ্টা বাড়ে। এমন কি শল্যবিদ্যারও শুরু সে সেসময়ে। ইন্দ্রজালের সঙ্গে বিজ্ঞানের জন্মকথার সম্পর্ক যে আধুনিক গবেষক মহলে স্বীকৃত সেটাও সুকুমারী উল্লেখ করেছেন।
“ অথর্ববেদের অন্যতম শাখা চরণবৈদ্যকে যে চরক – সংহিতার লুপ্ত উৎস রূপে মনে করা হয়ে থাকে তা বিশেষ ভাবে স্মরণীয়। আনুষ্ঠানিক নির্দেশগুলি বা বিনিয়োগগুলিতে আমরা লক্ষ্য করি যে ওষধি , ধাতু এবং রাসায়নিক পদার্থ ঔষধ প্রস্তুত করার জন্য ব্যবহৃত হত; শিশু চিকিতসা, ধাত্রীবিদ্যা ও শল্যচিকিৎসার ঊপাদানগুলি খুবি প্রাথমিক স্তরে হলেও বিদ্যমান ছিল”। (সূত্র ঐ)। স্রেফ দেবানুগ্রহ তথা মন্ত্রের শক্তিতে বিশ্বাসী আর্য পুরোহিতদের ভেষজবিদ্যার প্রতি প্রবল তাচ্ছিল্য ছিল। অথর্ববেদ যে দীর্ঘকাল বৈদিক সাহিত্যের অংশ বলে স্বীকৃতি পায়নি তার অন্যতম প্রধান কারণ এতে ‘চিকিৎসা- সংক্রান্ত বহু মন্ত্র রয়ে গেছে’। শুধু তাই নয়, ‘পরবর্তী কালে মৈত্রী ঊপনিষদে চিকিৎসকদের জন্য স্বর্গের দ্বার রুদ্ধ করা হয়েছে।“ কিন্তু কালান্তরের বৈদিক সাহিত্যে এই ‘ভিষক’ বা ভেষজবিদরা সন্মানিত পেশাগুলির অন্যতম।
থাপার তাঁর পূর্বোক্ত বইতে আদি বৈদিক যুগে অঙ্কের চর্চার শুরু প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ “ বলিদানের অনুষ্ঠানের থেকে প্রসঙ্গত কয়েকটি বিষয়ের চর্চা আরম্ভ হয়। বলিদানের জায়গায় বিভিন্ন উপকরণ রাখবার সঠিক ক্ষেত্র নির্ণয়ের জন্য বিস্তারিত আঙ্কিক হিসেবের দরকার হত। এ থেকে অঙ্কের চর্চা বাড়ল। আবার ঘন ঘন বলিদানের জন্য পশুর দৈহিক গঠনতন্ত্রের সম্পর্কে জ্ঞানার্জনে সুবিধে হল। তাঁর ফলে বহুদিন পর্যন্ত শারীরবৃত্তি বা রোগ- নিরূপণ বিদ্যার চেয়ে দৈহিক গঠনতন্ত্র সম্পর্কিত জ্ঞান অনেক বেশি অগ্রসর ছিল। ( দ্বিতীয় অধ্যায়, আর্য সংস্কৃতির প্রভাব) । “(ঋগবেদের) সৃষ্টি স্ত্রোত্রে যে সংশয় ব্যক্ত হয়েছে তা সে যুগের জ্ঞানপিপাসা ও আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসার একটি উদাহরণ মাত্র। এর একটি পরিণতি হল বৈরাগ্য। ... ... সন্ন্যাসী জীবন সব সময়ই পলায়নী মনোভাবের পরিচায়ক মনে করলে ভুল হবে। উপনিষদ পড়লেই বোঝা যায় এই ঋষিদের মধ্যে অনেকেই জীবনের কিছু কিছু মূল প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের চেষ্টা করছিলেন। কোথা থেকে এসেছিল এই জগতসংসার ? একই নক্ষত্র জতের কোন সঙ্গমের ফলে সৃষ্টি? তাপ থেকে? তপশ্চরজা থেকে? আত্মা বলে কি কিছু আছে? আত্মা তাহলে কি? মানব-আত্মার সঙ্গে জগত-আত্মার কি তাহলে সম্পর্ক?”
বামপন্থী থাপারের বইতে এই উদ্ধৃতিগুলি সবই এ এল ব্যাশামের ‘ দা ওয়ান্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া’ থেকে। ব্যাশাম মোটেই মার্ক্সবাদী ছিলেন না। জন্মমাত্র পুরুষানুক্রমিক জাতপাতের জোয়াল কাঁধে নিয়ে গতজম্মের কর্মফলের মূল্য চোকাতে এ জীবনে সকল শোষণ- শাসন-লাঞ্ছনা মেনে নেওয়ার ধর্মীয় দর্শন এবং সামাজিক অনুশাসনের ক্রমকাঠিন্য ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেওয়ার প্রক্রিয়াটি থাপারের চোখ এড়িয়ে যায়নি। পাশাপাশি একই সমাজের নানা স্তরে বস্তু ও ভাব জীবনের টানাপড়েনে উঠে আসা জীবন ও জগত ঘিরে জিজ্ঞাসাকেও তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। কেন না ঐতিহাসিক সত্য এটাই যে ঐ জিজ্ঞাসার পথ বেয়েই বিজ্ঞানচেতনার শুরু। পূবে বা পশ্চিমে কোথাও হঠাৎ একদিন আকাশ থেকে বস্তুবাদী ভাবনার বর্ষণ শুরু হয়নি।
উদ্দালক আরুণি
প্রাচীন ভারতে বস্তুবাদী দর্শন এবং প্রকৃতিচেতনা তথা বিজ্ঞানচেতনার উন্মেষের ইতিহাস বিষয়ে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের দুটি আকর গ্রন্থ – হিস্ট্রি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইন এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া’ এবং ‘লোকায়ত, এ স্টাডি ইন এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়ান মেটেরিয়ালিজম’ বামপন্থী মহলে আদৃত। ১৯৯১ সালে প্রথম বইটির প্রকাশের পাঁচ বছর আগে আর একটি বইতে অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায় প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সাধনার ইতিহাসের একটি উপক্রমনিকা লেখেন। মুখবন্ধ জোসেফ নিডহ্যামের।
দেবীপ্রসাদের বর্ণনায় খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৫০ সাল নাগাদ বৈদিক সভ্যতার অনেক আগে সিন্ধু সভ্যতাকে ঘিরে নগর- সভ্যতার প্রথম পর্বে ইজিপ্ট ও মেসওপ্টেমিয়ার মতো এই উপমহাদেশেও গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার হদিশ মেলে। খ্রিষ্ট –পূর্ব ষষ্ট ও সপ্তম শতকে দ্বিতীয় নগরায়ণ পর্বে বস্তুবাদী প্রকৃতিচেতনার উষালগ্নে আদি ঔপনিষদিক কালের উদ্দালক আরুণিকে দেবীপ্রসাদবাবু এদেশের তো বটেই, বিশ্বের বিজ্ঞান চর্চার জনকের স্থান দিতে চেয়েছেন। পদ্ধতিগত ভাবে পর্যবেক্ষণ- পরীক্ষা নির্ভর বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম পথিকৃৎ আরুণিকে তিনি মানুষ ও প্রকৃতির পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে একটি সংহত তত্বভাবনার ভ্রুণ স্থাপনের কৃতিত্ব দিয়েছেন। আরুণি একজন ব্যক্তির নাম বা গোতমী গোষ্ঠীর ভাষ্যকারদের কৌলিক পরিচয়, তা নিয়ে ধন্দ থাকলেও দেবীপ্রসাদের মতে তিনি বা তাঁরা বস্তু ও জীবজগত ঘিরে সে যুগের প্রশ্নারত, চিন্তাশীল মননের অন্যতম প্রতিনিধি। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা তাঁর চিন্তা-চেতনাকে ভাববাদী ধরমিয় দর্শনের ধুম্রজালে আচ্ছন্ন করে প্রচার করেছে অনেক কাল। অন্যদিকে আধুনিক কালের ইউরোপীয় পন্ডিতেরা আরুণির বিশ্লেষণকে বস্তুবাদী ভাবনার ঊষাকিরণ বলে স্বাগত জানাননি।
এর নেপথ্যে সাহেবদের ইউরোপকেন্দ্রিক ইতিহাসচেতনাকেই দায়ী করেছেন মার্ক্সবাদী দেবীপ্রসাদ। তবে একই সঙ্গে ভি যে চিল্ডে, নিডহ্যাম, জে ডী বারনাল, হেরম্যান জ্যাকোবি প্রমুখের ব্যতিক্রমী মানসিকতাকেও প্রশংসা করেছেন। সেকুলার জ্ঞান চর্চা তথা বিজ্ঞানভাবনার বিকাশে প্রাচ্যের সভ্যতাগুলির অবদান এঁরা স্বীকার করেছেন। দেবীপ্রসাদবাবুর পাঠঃ আরুণির সমসাময়িক যাজ্ঞবল্ক্যরা যখন অনুমান-উপলব্ধি নির্ভর জ্ঞানের পূজারী তখন উদ্দালক প্রত্যক্ষ- সংবেদন ও পর্যবেক্ষণ-পরীক্ষা নির্ভর প্রকৃতি পাঠের কথা বলেছেন। এটাই তাঁকে তাঁর সময় থেকে এগিয়ে রেখেছিল।
পরম ব্রহ্ম নয়, প্রাণের জন্মকথায় আরুণির উৎসনির্দেশঃ “তেষাং খল্বেষাং ভূতানাং ত্রীণ্যেব বীজানি ভবন্ত্যান্ডজং জীবজমুদ্ভিজ্জমিতি’-- সেই ভূতগণের উৎপত্তির তিনটি কারণ—ইহারা অণ্ডজ, জীবজ, এবং উদ্ভিজ্জ’’। ( ছান্দোগ্য উপনিষদ, ষষ্ট অধ্যায়। সূত্র উপনিষদ, অখণ্ড সংস্করণ, হরফ প্রকাশনী)। পেটে ভাত না পড়লে যে বেদস্মৃতি মন থেকে মুছে যায় বা ব্রহ্মচেতনা ঊধাও হয়, নিজ সন্তান ও বেদাভিমানী শ্বেতকেতুকে সেটা হাতে কলমে বোঝান উদ্দালক। বাবার নির্দেশ মতো ছেলে কিছুদিন উপোষী থাকার পর জানান যে তাঁর বেদসূত্র মনে পড়ছে না, চেতনাও লুপ্তপ্রায়। খাদ্যগ্রহণের পর তাঁর স্মৃতিশক্তি ফিরে এলে আরুণি বলেনঃ ‘অন্নময়ম হি সোম্য; মনঃ আপোময়ঃ প্রাণ তেজোময়ী বাক ইতি-- হে সৌম্য, মন অন্নময়, প্রাণ জলময়, বাক তেজোময়”। (সূত্র ঐ)। খাদ্যের সঙ্গে স্মৃতি- চেতনা তথা মনের সম্পর্ক নিয়ে এহেন পরীক্ষাভিত্তিক বিশ্লেষণ সে যুগে ছিল অভাবনীয়। এভাবে বিজ্ঞানের সত্যকে আরুণি এই ক্ষুৎপিপাসারহিত তপস্যা বা কঠোর কৃচ্ছসাধনের দেশে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন।
দেবীপ্রসাদ উল্লেখ না করলেও তৈত্তিরীয় উপনিষদেও অন্নের গুরুত্ব নিয়ে একাধিক শ্লোক রয়েছে। “ অন্নাদ্বৈ প্রজা প্রজায়ন্তে। যা কাশ্চ পৃথিবীং শ্রিতা... অদ্যতেহত্তি চ ভূতানি। তস্মাদন্নং তদচ্যুতে ইতি-- অন্ন হইতে প্রজাগণ জন্মে—যে অন্ন(খাদ্য) গ্রহণ করা যায় তাই জীর্ণ হইয়া রস-রক্তাদি ক্রমে শুক্রে পরিণত হয়, সেই শুক্র হইতে প্রাণিগণ জন্মে। জীবের দেহ ধ্বংস হইলে উহা পঞ্চভূতে পরিণত হয়। ঐ পঞ্চভূত হইতে আবার ব্রীহিষবাদি অন্ন জন্মে... ভূত দেহের উপাদান সমূহ এই প্রকারে অন্নের অন্তর্ভুক্ত হয় বলিয়া বলা হইয়াছে অন্ন ভূতগণকে ভক্ষণ করে”। (তৈত্তিরীয় উপনিষদ, দ্বিতীয় অধ্যায়, ২ অনুবাক, সূত্র ঐ)। অন্নভক্ষক থেকে ভূতভক্ষক অন্নে জীবজগতের চক্রবৎ যাত্রার এই প্রাচীন উপলব্ধি ও তার কাব্যিক সূত্রায়ণে কি জীবন ও প্রকৃতির আন্তঃ সম্পর্ক (মিথস্ক্রিয়া?) নিয়ে অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণলব্ধ চেতনা নেই, যাকে আমরা আধুনিক বৈজ্ঞানিক সত্যের খুব কাছাকাছি ভাবতে পারি?
আরুণি প্রসঙ্গে ফিরে আসি। দেবীপ্রসাদ লিখছেন, প্রাচীন ভারতে জগত ও প্রাণের উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে প্রকৃতিঋদ্ধ ভাবনার জনক আরুণি কার্যকারণ সূত্রে ছন্দোবদ্ধ বিশ্বের অস্তিত্বের মৌলিক কারণ বা উৎসের সন্ধানে আগ্রহী ছিলেন। দৃশ্য ও শ্রাব্য বস্তুজগতে ঘটনা ক্রমের নেপথ্যে পারস্পর্য বা ধারাবাহিকতায় প্রথম বা আদি কারণ( আল্টিমেট কজ)কে জানতে চেয়েছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বস্তুর প্রত্যক্ষ রূপের গভীরে পরম বা মূল বস্তু বা ‘সৎ’-এর ধারণা আনেন। তাঁর মতে এই ‘সৎ’ খাদ্য, তেজ ও অপ(জল)-এর উৎস। বস্তুর অজস্র রূপের গভীরে মৌল কণাদের অস্তিত্বের ইঙ্গিত এভাবেই তাঁর প্রাচীন মননে ধরা পড়েছিল। ছান্দোগ্য উপনিষদের ষষ্ট অধ্যায়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকে তাই আমরা পাইঃ
“ সদেব সোম্যেদমগ্র আসীদেকমেবা দ্বিতীয়ম। তদৈধক আহুরসদেবেদমগ্র আসীদেকমেবা দ্বিতীয়ং তস্মাদসতঃ সজ্জায়ত--- সৌম্য, প্রথমে এই জগত এক ও অদ্বিতীয় সৎ রূপে বর্তমান ছিল। কেহ কেহ বলেন, প্রথমে এই জগত এক ও অদ্বিতীয় ‘অসৎ’ রূপে বর্তমান ছিল। এবং সেই অসৎ হইতে সৎ উৎপন্ন হইয়াছে”। (সূত্র ঐ)। কিন্তু এর পর আরুণি দ্বিতীয় মতকে খন্ডন করছেন। “ কৃতস্তু খলু সৌম্যেবং স্যাদিতি হোবাচ কথম সতঃ সজ্জায়েতেতি/ সত্বেব সোম্যেদমগ্র আসীদেকমেবাদ্বিতীয়ম”-- কিন্তু সৌম্য , ইহা কি করিয়া হইতে পারে? কি করিয়া অসৎ হইতে সৎ উৎপন্ন হইতে পারে? এই জগত পূর্ব এবং অদ্বিতীয় সৎ রূপেই বিদ্যমান ছিল”। (সূত্র ঐ)। দেবীপ্রসাদের মতে, এই সৎ বলতে আরুণি আদি বস্তু ( primeval matter) কে বুঝিয়েছেন। এই সূত্রেই তিনি ‘from nothing to being’ বা অনস্তিত্ব জাতক অস্তিত্বের ধারণা নাকচ করেছেন।
আয়ুর্বেদ- বিজ্ঞান না অপবিজ্ঞান
আয়ুর্বেদকে দেবীপ্রসাদ ‘system of rational medicine’ যুক্তিবাদী চিকিৎসা ব্যবস্থা বলে মান্যতা দিয়েই ক্ষান্ত হন নি। পূর্বোক্ত বইতে তিনি লিখেছেনঃ “ ভেবেচিন্তেই যুক্তিবাদী তকমাটি ব্যবহার করা হচ্ছে যাতে (আয়ুর্বেদ) খাস বিজ্ঞানের মর্যাদা পায়”। ( ফ্রম ম্যাজিক টু মেডিসিন, সূত্র ঐ) চরক সংহিতা ও শুশ্রুত সংহিতা এবং অষ্টাঙ্গ সংগ্রহ এবং পরবর্তী যুগের ভাষ্যগুলি উদ্ধৃত করে তিনি আয়ুর্বেদকে কেন্দ্র করে প্রাচীন ভারতে অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, এমব্রায়োলজি, সার্জারি থেকে ফার্মাকোলজি, টক্সিকোলজি ইত্যাদি চিকিৎসাবিদ্যায় সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে বিশেষ জ্ঞানচর্চার ভ্রুণগুলির জন্মকথা শুনিয়েছেন। আধুনিক চিকিৎসা শিক্ষা-ব্যবস্থায় যা আজও গৃহীত নয়, সেই সংহত প্রকৃতিচেতনার সঙ্গে মানুষের রোগ ও চিকিৎসার ওতপ্রোত সম্পর্ক নিয়ে ভাবনা থেকেই বটানি ও জুওলজি এমনকি ক্লাইমেটালজির চর্চাও এর সঙ্গে যুক্ত। অ্যালকেমি বা প্রাচীন রসায়ন বিদ্যা থেকে আফ্রোডিজিয়াকস বা যৌনক্ষমতাবর্ধক তথা কামকলা ও রতিসুখ বৃদ্ধির চর্চাও বাদ যায়নি।
আরুণির মতোই চরক আসলে এক জন ব্যক্তিবিশেষ না চরণবৈদ্য নামে অভিধাপ্রাপ্ত ভ্রাম্যমান চিকিৎসকদের কৌলিক পরিচয় এনিয়ে বিদ্বান মহলে মতভেদ রয়েছে। তবে এটা স্পষ্ট মধ্য বৈদিক যুগ থেকে বৌদ্ধ-জৈন যুগ-- এই দীর্ঘ কাল পরিক্রমায় প্রজম্মের পর প্রজন্ম ধরে চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতাজারিত জ্ঞানে পুষ্ট ও পরিমার্জিত হয়েছে আয়ুর্বেদের ঐতিহ্য।
শুধুমাত্র আটটি পুঁথির ১২৬টি অধ্যায় সম্বলিত চরক সংহিতার বিষয়বস্তু বিশ্লেষণে দেবীপ্রসাদ দেখিয়েছেনঃ তিরিশটি অধ্যায় জুড়ে প্রাচীন চিকিৎসা বিদ্যার ইতিহাস, মূল নীতি বা সিদ্ধান্তসমূহ; আটটি অধ্যায়ে নানা রোগের উপসর্গ এবং কারণ বর্ণনা। পরের আটটি অধ্যায় জুড়ে খাদ্যাখাদ্য সূত্রে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক বা প্রাণিজ বস্তুর রেচনপ্রক্রিয়া ইত্যাদি, অপর আট অধ্যায়ে শারীরতন্ত্র, শল্যবিদ্যা ও ভ্রুণবিদ্যা। এর পর বারোটি অধ্যায়ে নানা রোগ নির্ণয়, তিরিশটি অধ্যায় নিয়ে ঔষধি, পথ্য, আরোগ্যের প্রক্রিয়া, পরের বারটি অধ্যায়ে ভেষজবিদ্যা ইত্যাদি এবং সবশেষে মল-মুত্রঘটিত সমস্যার সমাধান ইত্যাদি।
সুশ্রুত সংহিতার মূল বিষয় সার্জারি বা শল্যচিকিৎসা। পাঁচটি পুঁথিতে ১২০ টি অধ্যায়ের মধ্যে সূত্র-স্থানে ৪৬টি অধ্যায় জুড়ে চিকিৎসা শাস্ত্রের সাধারণ নীতিমালা এবং শল্যবিদ্যার সঙ্গে তার প্রয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির নির্মাণ ও ব্যবহার প্রসঙ্গ। এর পর নিদান-স্থানে ১৬টি অধ্যায়ে রয়েছে রোগ ও রোগের কারণ নিয়ে আলোচনা। পরের শরীর-স্থানে ১০ টি অধ্যায়ে অ্যানাটমি ও এমব্রায়োলজি। অনুবর্তী চিকিৎসা স্থানে ৪০টি অধ্যায়ে নানা থেরাপি চর্চা এবং কল্প-স্থানে বিষক্রিয়া নিয়ে আলোচনা।
শুধু তাই নয়, এই চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জনের উদ্দেশ্য -প্রকরণ নিয়ে সামগ্রিক একটি এপিস্টেমোলজি বা জ্ঞানতত্ত্বের চর্চাও শুরু হয়। ন্যায়- বিশেষিকা ধারার বস্তুবাদী দর্শন দ্বারা প্রাণিত এই জ্ঞানতত্ত্বে চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি নিয়মিত পারস্পরিক সংলাপ- অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং তর্ক-বিতর্কে উৎসাহিত করা হয়। এই ধারা প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞানের দর্শনের দিকেও আলোকপাত করে। মৃতদেহ জোগাড় এবং তার নিয়ন্ত্রিত পচনের পর সরেজমিন কাটাকুটিতে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অন্দরমহলকে জানার প্রক্রিয়া, অতঃপর কঙ্কাল থেকে অস্থিবিদ্যায় জ্ঞানলাভ-- শবব্যবচ্ছেদের পদ্ধতির এহেন পুঙ্খানুপুঙ্খ থেকে স্পষ্ট, আয়ুর্বেদ শুধু বায়ু- পিত্ত- শ্লেষ্মা প্রশমনে শেকড়বাকড় ব্যবহারের শাস্ত্র ছিল না।
আয়ুর্বেদ সংক্রান্ত প্রামাণ্য পুস্তকগুলির পরতে পরতে সমসাময়িক ভাববাদ ও বস্তুবাদের মিশেল থেকে দেবীপ্রসাদ দেখানোর চেষ্টা করেছেন কিভাবে রাজকীয় আনুকূল্য, পুরোহিততন্ত্রের অনুমোদন লাভের প্রয়োজনে নিজেদের পর্যবেক্ষণ- পরীক্ষালব্ধ বিশ্লেষণকে ভাববাদী মোড়কে ঢাকতে বাধ্য হয়েছেন প্রাচীন চিকিৎসক তথা ভেষকবিদরা। অন্যদিকে কালান্তরে জনপ্রিয় চিকিৎসাবিজ্ঞানকে নিজেদের শাস্ত্রমালায় জায়গা দিতে গিয়ে ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যবাদীরা তাদের পছন্দসই ব্যাখ্যা চাপিয়ে দিয়েছে। তাই কর্মফলবাদ, গো- অর্চনা, ব্রাহ্মণদের দানধ্যানে পুণ্যলাভ, মোক্ষলাভ ইত্যাদিও আয়ুর্বেদে জায়গা পেয়েছে। জল থেকে দুধকে আলাদা করার দায় পালন করেছেন পরবর্তী প্রজম্মের ভাষ্যকাররা কেউ কেউ। তাঁদের ধারাবাহিকতায় আজ মোদি-ভাগবতদের হাত থেকে চরক- সুশ্রুত-জীবকদের ঐতিহ্য তথা আয়ুর্বেদকে রক্ষা করার দায় আমাদের নয় কী?
দ্বিতীয় পর্ব
হিন্দু ধর্ম একটি নির্দিষ্ট ধর্মই নয় ?
হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও কট্টর হিন্দুত্ববাদের নির্মাণ ঘটেছে ব্রিটিশ শাসনের গর্ভে, বিশেষত উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এবং বিংশ শতকের প্রথমার্ধে। কিন্তু হিন্দু ধর্ম ও সমাজ কী শুধুই বঙ্কিম-বিবেকানন্দ, তিলক- মালব্য, দয়ানন্দ সরস্বতী- সাভারকর-হেডগেওয়ার-গোলওয়ালকরদের নির্মাণ? সেকুলার-বামেরা, বিশেষত বাম বুদ্ধিজীবীদের একটি প্রভাবশালী অংশ হিন্দু ধর্মকে একটি ধারাবাহিক এবং সংহত ধর্মের স্বীকৃতি দিতেই রাজি নন। সেই ধারাবাহিকতায় আজকের তরুণ বামপন্থীদের কাছে হিন্দু ধর্ম একটি ‘পলিটিক্যাল কন্সট্রাক্ট’ মাত্র। ভয়ঙ্কর বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা এবং অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীলতা সত্ত্বেও নানা গভীরশায়ী বৈশিষ্ট্যের কারণে বৃহত্তর দক্ষিণ এশিয়ায় হিন্দু ধর্ম ও সমাজের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রয়েছে। বিভক্ত ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ আমজনতার জীবনে এর গভীর প্রভাব আজও বিদ্যমান। এর কারণগুলো সম্পর্কে তন্নিষ্ট অনুসন্ধানের বদলে সেকুলার-বাম ক্রমবর্ধমান উন্নাসিকতার কারণে সঙ্ঘ পরিবার হিন্দুত্বের ঠিকাদারি নিতে পেরেছে।
এটা ঠিক অবিসংবাদী প্রফেট ও পবিত্র পুঁথিনির্ভর সেমিটিক ধর্মগুলির তুলনায় হিন্দু ধর্ম ও সমাজের গড়ন ও বিকাশ আলাদা। এর আওতায় একই সঙ্গে ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব প্রশ্নে অস্তিবাদী, নাস্তিবাদী ও অজ্ঞেয়বাদীদের প্রতিস্পর্ধী অথচ পাশাপাশি অবস্থান। এমনকি আস্তিকদের মধ্যেও সাধ্য ও সাধনপথের অনেকান্ততা। বৈদিক- পৌরাণিক যুগ এবং পরবর্তী বৌদ্ধ- জৈন- লোকায়তিক পর্বে ভাববাদ ও স্বভাববাদ পাশাপাশি চলেছে। এসব কারণে একে আমরা ধর্মমত ও দার্শনিক গোষ্ঠীগুলির মল্লযুদ্ধের মঞ্চ, বড়জোর একটি জগাখিচুড়ি ধর্মবিশ্বাসের বেশি গুরুত্ব দিইনি বা দিই না।
প্রাচীন সংস্কৃত থেকে পালি, কোন ধর্মসাহিত্যেই ‘হিন্দু’ শব্দটি নেই এবং আরব ও গ্রিক- সূত্রে সিন্ধু তীরের বাসিন্দাদের ঐ পরিচিতি নেহাত স্থানবাচক, জাতি বা ধর্মীয় সম্প্রদায়বাচক নয়—এসব বলে আমরা হিন্দু ধর্মের অস্তিত্ব বা প্রাচীনতা সম্পর্কেই প্রশ্ন তুলি বটে। কিন্তু এটা আমাদের বালখিল্য ওজর মাত্র। কেননা প্রাচীনতর ব্যবিলনিয়- মেসোপটেমীয়-অ্যাসিরীয় পশুপালক- কৃষি সমাজের সর্বপ্রাণবাদী ও অন্যান্য ‘প্যাগান’ ধর্মগুলির পাশাপাশি গ্রেকো-রোমান নগরসভ্যতার বহুদেবতাবাদী ধর্মগুলির পরিচয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানবাচক। ‘আহলে কিতাব’ বা পবিত্র ধর্ম গ্রন্থগুলির অনুসারী প্রধান সেমিটিক ধর্মগুলি তথা ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমান সম্প্রদায় সহ বিশ্বের প্রধান ধর্ম সম্প্রদায়গুলিও নানা উপ- সম্প্রদায়ে বিভক্ত। আলাদা ধর্মসম্প্রদায় হিসেবে খ্রিস্টানদের পরিচিতি খ্রিস্টের বহু পরে। গলগাথায় ক্রুশবিদ্ধ যীশু তৎকালীন ইহুদি পুরোহিততন্ত্র ও রোমান উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে নিম্নবর্গীয় নানা ধর্মচিন্তার এক প্রতিভূ। পরবর্তী কালের খ্রিস্ট ধর্মে পরম পিতা- তাঁর পুত্র- ও পবিত্র আত্মার ‘হোলি ট্রিনিটি’ বা ইসলামের কট্টর একেশ্বরবাদ এমনকি বৌদ্ধ ধর্মের অজ্ঞেয়বাদও স্বীয় ধর্মমতের অনুসারীদের বিভাজন ঠেকাতে পারেনি। তাই বিভাজন দিয়ে হিন্দু ধর্মের সাধারণ ঐক্য সূত্রগুলিকে নস্যাৎ করার প্রবণতা অনৈতিহাসিক।
এটা ঠিক প্রাচীন ভারতে উত্তরে মৌর্য –গুপ্ত বা দক্ষিণে চোল- চালুক্য- বিজয়নগর ইত্যাদি সাম্রাজ্যের কালেও বিন্ধ্যের দুপারেই রাষ্ট্রনৈতিক, ভাষিক- সামাজিক ও ধর্মাচরণে বিপুল বৈচিত্র্য। এই কারণে হিন্দু ধর্ম কোনও আসমুদ্রহিমাচল কেন্দ্রীভূত সাম্রাজ্য ও চার্চ নিয়ন্ত্রিত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম হতে পারেনি। এর ফলে আজকের ভারত জুড়ে আম হিন্দুদের কোনও শিলীভূত ডগমার মাধ্যমে মৌলবাদীরা সহজে কুক্ষিগত করতে পারবে না। হিন্দু ধর্মের এই তথাকথিত দুর্বলতার জায়গাটাই আমাদের অন্যতম জোরের জায়গা হয়ে উঠতে পারত। আজকের হিন্দু ফ্যাসিবাদী শক্তি হিন্দু ধর্ম ও সমাজের স্বঘোষিত রক্ষাকর্তা হয়ে উঠতে পারত না। যদি সেকুলার-লিব্যারাল- বামেরা দেশ জুড়ে জাতপাত, ভাষা, এথনিক ও আঞ্চলিক ভাবে বহুবিভক্ত হিন্দু মানসের অভ্যন্তরীণ ঘাত-প্রতিঘাতের পাশাপাশি তার ন্যূনতম ঐক্যচেতনা, যুগে যুগে ঘর ও বাহিরের ভিন্নতাকে আত্তীকরণের ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দিতেন।
দক্ষিণ এশিয়া তথা অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশে বিবিধতার মধ্যে মিলন, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সাধনার শুরু অতি প্রাচীন কালেই, যা পরে আসা জনগোষ্ঠীগুলি ও পর্যটকদের কাছে হিন্দু সমাজ ও ধর্ম বলে পরিচিতি পেয়েছে। তুর্কি- আফগান- মুঘল শাসনে, বিশেষত আকবরের কালে যা শাসকীয় সহিষ্ণূতার সুযোগে নিম্ন বর্ণের হিন্দু-মুসলমানের ভক্তি আন্দোলন বা মিশ্র ধর্মসংস্কৃতিতে বিকশিত হয়। উচ্চকোটির উপনিষদিক জিজ্ঞাসা থেকে নিম্নকোটির নানক-কবীর- রবিদাস-রজ্জব হয়ে লালনের কাল পর্যন্ত এই অভিযোজন-ক্ষমতাই রবীন্দ্রচেতনায় ভারতীয় সভ্যতার আধারস্বরূপ। যা সঙ্ঘী হিন্দু রাষ্ট্রবাদ বা সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের চালচিত্রে আঁটা ভারতমাতার প্রতিমা থেকে মৌলিক ভাবে আলাদা। হিটলার- মুসোলিনি প্রাণিত সঙ্ঘী যুদ্ধবাজ জাতীয়তাবাদের বিপরীতে সেকুলার-বাম মহল রবীন্দ্রনাথের বিশ্বমানবতার জয়গানকে সঠিক ভাবেই তুলে ধরেন। কিন্তু তাঁর ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে’- এই ইতিহাসচেতনা তথা সভ্যতাদর্শনে উপমহাদেশের হিন্দু অতীত বিশেষত ঔপনিষদিক পর্বের ভাববাদী দর্শনের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতার ভূমিকা আমরা ভুলে যাই।
আধো-চেনা আধো-জানা বহুস্তরান্বিত সেই প্রাচীনের পরতের পর পরত খুলে আধুনিকতার নানা নিরিখ--- ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ, বাকস্বাধীনতা, তর্কপ্রিয়তা, সহিষনুতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র চেতনার উন্মেষকথা রবীন্দ্রনাথ থেকে অমর্ত্য সেন শুনিয়েছেন। পাশাপাশি প্রকৃতি ও পুরুষ, জীবন ও জগত নিয়ে ভাববাদী দার্শনিক অনুসন্ধিৎসার গর্ভে প্রতিস্পর্ধী বস্তুবাদী জিজ্ঞাসা তথা পর্যবেক্ষণ-অনুমান-পরীক্ষা-প্রমাণের ভিত্তিতে বিজ্ঞানচেতনার ইত্যাদির ভ্রুণদশার কথা শুনিয়েছেন অক্ষয় কুমার দত্ত, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, রাজেন্দ্রলাল মিত্রের ধারাবাহিকতায় দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সমরেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখ। দূর অতীতের জ্ঞান ও বিজ্ঞান চর্চার ঐতিহাসিক সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরার কাজটি জটিল ও পরিশ্রমসাপেক্ষ।
বৈদিক সাহিত্যে সমসাময়িক সমাজ- সময় ও মানবচেতনার আখর খোঁজার বদলে তাকে আদিম পশুপালক জনগোষ্ঠীর শিশুসুলভ প্রকৃতি- ভীতি ও বিহ্বলতাজারিত দৈবী অনুগ্রহকামনা, তাদের ইন্দ্রজাল- যাগযজ্ঞের ধুম্রজালে আচ্ছন্ন ঐহিক ও পারত্রিক কামনাবাসনাকে গালগল্প বলে ব্যঙ্গ করা সহজ এবং সেটাই রেওয়াজ। উপনিষদসমূহ ও রামায়ণ- মহাভারতের সাহিত্য- মূল্য স্বীকার করলেও তাদের সমসাময়িক ও আধুনিক দার্শনিক ও ঐতিহাসিক মূল্য এবং সামাজিক- রাজনৈতিক প্রভাবকে পাত্তা না দেওয়ার প্রবণতাই প্রবল। ইউরোপের ভাবজগতে প্রাচীন গ্রেকো- রোমান প্রভাব নিয়ে চর্চা ঔপনিবেশিক সূত্রে হিন্দু ভদ্রলোক ও সেকুলার-বাম চেতনার অবশ্যম্ভাবী অংশ ছিল এই সেদিনও। গ্রিক রাষ্ট্র ও সমাজদর্শন এবং নাটক-সাহিত্যের নানা ধারণা আমাদের আঁতেল আড্ডার লব্জে এবং জনপ্রিয় সিনেমা-নাটক-সাহিত্যেও এখনও ছড়িয়ে। কিন্তু প্রাচীন ভারতে দর্শন, নাটক-সাহিত্য-শিল্প জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে চর্চা শুধু বিশেষজ্ঞ মহলের ব্যাপার। সেই স্তরেও প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার বিবর্তন এবং আধুনিক সময়ে তার প্রভাব নিয়ে চর্চার আগ্রহ কার্যত শুকিয়ে গিয়েছে। এতে সঙ্ঘ পরিবারের পোয়া বারো হয়েছে।
ধর্ম ও মার্ক্সবাদী বিতর্ক
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ও গৌণ ধর্মগুলির ইতিহাস চর্চা সেকুলার জ্ঞানচর্চার অঙ্গ বলে পশ্চিমে স্বীকৃত হলেও আমাদের বাম বৌদ্ধিক ও রাজনৈতিক মহলে এ বিষয়ে নাক- সিঁটকানো বিজ্ঞান ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসের পরাকাষ্ঠা বলে পরিচিত। অথচ ধর্ম, বিশেষ করে ক্রিস্টানিটি তথা খ্রিষ্ট ও তস্য মাতা ভার্জিন মেরিকে নিয়ে মার্ক্স-এঙ্গেলস ও তাদের সমসাময়িক অন্যান্য সমাজতন্ত্রী এবং পরে ইউরোপীয় মার্ক্সবাদীদের মধ্যে ধারাবাহিক তর্ক চলেছে। বুর্জোয়া বিপ্লবোত্তর শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লব তথা সমাজতন্ত্রের সাধনায় রিলিজিয়ন ও সেকুলারিজম নিয়ে সে বিবাদের ইতিহাস ঘাঁটলে মনে হতে বাধ্য—তোমার মহাবিশ্বে প্রভু হারায় না তো কিছু।
ক্রিস্টান ইউরোপের ইতিহাসের প্রেক্ষিতে সেকুলারিজম (মূলত ধর্মবিযুক্ত রাষ্ট্র, ব্যক্তিগত পরিসরে ধর্ম এবং পরে ধর্মহীন সমাজ ও ঈশ্বরহীন মানুষের প্রয়োজনীয়তা ও অনিবার্যতা) আর আমাদের মতো সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতা ( গান্ধীর সর্বধর্মসমভাব বা সদ্ভাব, নেহরুর সকল ধর্ম থেকে দূরে আধুনিক রাষ্ট্রধর্ম বা নিম্নবর্গীয় ভক্তি আন্দোলনের ধর্মসমন্বয় বা ব্যক্তিগত ঈশ্বর ) নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গেও সে বিতর্ক প্রাসঙ্গিক।
অন্যদিকে এদেশের নিম্নবর্গীয় ইতিহাসচর্চার বিশেষ ধারার সুবাদে আমরা প্রথাগত ভাববাদ- বস্তুবাদ বাইনারির বাইরে বেরিয়ে ঔপনিবেশিক কালে দেশজ হিন্দু-মুস্লিম উচ্চকোটির ভাব ও বস্তুজগতের সমান্তরালে কৃষকচৈতন্যে দ্রোহচেতনার নেপথ্যে ধর্মীয় ও সেকুলার দুই উপাদানের বিচিত্র রসায়নের ভূমিকা জানতে পেরেছি। এমন উদাহরণ ইউরোপের প্রাক-বুর্জোয়া কৃষক বিদ্রোহগুলিতেও অজস্র। অন্য মহাদেশের ঔপনিবেশিক ও প্রাক- ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতাও বলে ঈশ্বরহীন বা দৈবী প্রেরণা ও আশীর্বাদহীন কোনও কৃষক বিদ্রোহ বা জনজাগরণ একেবারেই বিরল।
তবে এই প্রবন্ধের সীমিত পরিসরকে মনে রেখে আমি ইতিহাসের সেই সব পরত খুলছি না। শুধু রূপরেখা হিসাবে এটুকুই মনে রাখতে চাই মার্কসের নিজের অবস্থান তাঁর ইতিহাসবীক্ষার সামগ্রিকতায় মেলে। এঙ্গেলসের আগেই তিনি নাস্তিক হন। ঈশ্বরনির্ভরতা ছেড়ে মানুষের প্রজাতিগত ও ব্যক্তিগত প্রকৃত সম্ভাবনায় উত্তরণে বিশ্বাসী হলেও তিনি ধর্মকে শুধুই ‘জনগণের আফিম’ বলে নস্যাৎ করেননি। রাষ্ট্রধর্ম ও রাজধর্ম হয়ে ওঠার আগে খ্রীস্টধর্মের জনপ্রিয়তার নেপথ্যে আমজনতার ভূমিকাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। ধর্মকে ‘নিপীড়িতের দীর্ঘশ্বাস’, বিচ্ছিন্নতা(এলিয়েনেশন) জনিত ‘ ভ্রান্ত চেতনা (ফলস কনসাসনেস)’, শোষণ- শাসনের কঠোর বাস্তবতাকে হজম করতে প্রয়োজনীয় ‘বিভ্রম ( ইলিউশন)’ বা ‘বাস্তবতার জলছবি (ইনভারটেড রিয়েলিটি)’ বলে সহানুভূতিও জানিয়েছেন। তাঁর মতেঃ ধর্ম সমাজের অসুখের লক্ষণ, তাঁর কারণ নয়। অসহনীয় যন্ত্রণাকে সহনীয় করে তোলে বলে রোগের চিকিৎসার তাগিদটা মেরে বা ঝিমিয়ে দেয়। ঈশ্বরের নামে বা দেব-দেবীর নামে স্তোকবাক্য দিতে হবে না। কিন্তু রুগী বাঁচিয়ে রোগের চিকিৎসা করতে হবে। এই ভাবনার নেপথ্যে তাঁর পরিবারের ইহুদি অতীত কাজ করে থাকতে পারে। ব্রুনো বাউয়েরের মতো তিনি ধর্মহীন রাষ্ট্র হলেই সমাজ ঈশ্বরমুক্ত হবে বলে বিশ্বাস করতেন না। আমজনতার ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে কামান দাগার চেয়ে তার আধিপত্যের উৎস রাষ্ট্র ও সমাজ তথা উৎপাদনব্যবস্থার খোল-নলচে বদলানোর মাধ্যমে ঈশ্বর ও তাঁর বার্তাবহনের দাবিদারদের অপ্রাসঙ্গিক করে তোলাতেই জোর দিয়েছেন তিনি।
এঙ্গেলস লিখেছিলেন রোম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে স্পারটাকাসের নেতৃত্বে দাস-বিদ্রোহ বিফল হতে আমজনতা খ্রিষ্টধর্মকে আঁকড়ে ধরে। অবশ্য আমরা জানি খ্রিষ্টকে ঘিরে কৃষকদের দ্রোহচেতনা বহু প্রাচীন ও আধুনিক বহু উদাহরণ আছে। দুজনেই জানতেন ফরাসি বিপ্লবের পর্বে ‘এনশিয়েন রেজিম’-এর অংশীদার চার্চের বিরুদ্ধে আমজনতার যুগান্তের ঘৃণা থাকলেও র্যাডিকাল বুর্জোয়া জ্যাকোবিন নেতাদের একাংশও চার্চ –মুক্ত খ্রিস্টের ধারণায় বিশ্বাস করতেন। সাধারণ জনমনেও তা প্রভাবশালী ছিল। এমনকি প্যারি কমিউনকে ঘিরে প্রলেতারীয় বিপ্লবচেতনার উন্মেষকালেও। এরপর ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লবের পর বুর্জোয়া বিপ্লবগুলিতে কৃষি থেকে উচ্ছেদ শহরে অভিবাসী শিল্প-শ্রমিকদের দুর্দশার অভিঘাতে রোম্যান্টিকতা-জারিত খ্রিষ্টীয় সমাজতন্ত্র বা ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রের ধারণা প্রবল হয়। বুর্জোয়াদের শ্রেণীগত সীমাবদ্ধতা তথা শ্রমজীবীদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার পাশাপাশি ফেবিয়ানদের অন্তসারশূন্যতার বিরুদ্ধে কলম ধরেন দুই বন্ধু। মার্কসের বক্তব্যঃ খ্রিষ্ট ধর্মের সামাজিক নীতি শুধুই কাপুরুষতা, আত্মঘৃণা, আত্মদমন, হতাশা, বশ্যতা—এককথায় দাসত্ব শেখায়। অন্যদিকে প্রলেতারিয়েত শুধু রুটির জন্য লড়ে না। সে আত্মবিশ্বাসী, সাহসী ও স্বাধীনতাপ্রিয়। এই মাটির পৃথিবীতেই স্বর্গকে নামিয়ে আনতে চায়।
কিন্তু তাঁরা এটাও জানতেন আদি কমুনিজমের ধারণা এমনকি এলিয়েশনের ধারণাও ইহুদি-খ্রিষ্ট ধর্ম থেকে এসেছে। আদি কমুনিজমের ধারণার নেপথ্যে মুসা-ইসার আমলে ভিনধর্মী সাম্রাজ্যের দ্বারা দলিত-পীড়িত, দ্ররিদ্র আদি বিশ্বাসীদের গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়গত জীবনের স্মৃতি এবং বিশ্বাসীদের সমাজে সেই মূলে ফেরার আকাঙ্খা।মার্ক্স- এঙ্গেলস তাকে সমসাময়িক নৃতাত্বিক, সমাজতাত্বিক গবেষণার প্রেক্ষিতে পশুপালক, উপজাতীয় সমাজের সম্পতিগত যৌথতা ও সাম্য থেকে ব্যক্তিগত সম্পত্তিভিত্তিক শ্রেণীবিভক্ত ধনতান্ত্রিক সমাজের অসাম্যের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় হাজির করলেন। শুধু তাই নয়, যুগে যুগে উৎপাদন উপকরণ তথা সম্পত্তি ও তাকে ঘিরে সমাজ-সম্পর্কের দ্বন্দ্বের সূত্রে ঐ মূলে ফেরার তাগিদটাকে মানুষের ইতিহাসের এক মৌলিক তাড়না এবং অনিবার্য পরিণাম বলে এক বস্তুবাদী বিশ্বাসের জন্ম দিলেন।
একইভাবে আদম ও ইভের আদি পাপের কারণে তস্য সন্তানদের ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্নতা এবং তদজনিত মানুষের আবহমানের দুঃখকষ্টের ধারণা ইহুদি-খ্রিষ্ট ধর্মের অন্যতম ভিত্তি।। মার্ক্স তাঁকে সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতা দিলেন। তিনি বললেনঃ মুনাফাখোর, পণ্যরতিসর্বস্ব বুর্জোয়া সমাজে পুঁজি-দাসত্বের জেরে শ্রমের ফসলের অধিকারহীন, মানুষের মর্যাদাহীন, প্রায় যন্ত্রে পর্যবসিত শ্রমজীবীদের বিচ্ছিন্নতাবোধের কথা। এর সঙ্গে জুড়লেন প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্নতা, মানুষে মানুষে এবং ব্যক্তি মানুষের নিজের সঙ্গেও দূরত্বের কারণগুলিও এই শেকড়ে জড়ানো। মানুষ যুগে যুগে এই বিচ্ছিন্নতার বেদনা থেকে মুক্তি চেয়েছে। ধর্ম থেকে শিল্প- সাহিত্যে এই বেদনাজাত দীর্ঘশ্বাস। এতে আশু অর্থনীতির দাবি পেরিয়ে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বরূপ উন্মোচন ও তার উৎসাদনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব মানবসভ্যতার দীর্ঘকালীন সামাজিক ও নৈতিক প্রণোদনাগুলির সমর্থন পেল। ধর্মীয় ব্যাখ্যায় যে জীবন ছিল জন্মজোয়াল টানার নিয়তিতাড়িত, মৃত্যুতেই সম্পূর্ণ হত পরিত্রাণহীন বেদনার বৃত্ত; তাকে পেরিয়ে নতুন আশাবাদের জন্ম হল। আর কোনও ঐশী অবতারের অপেক্ষা নয়; এবার প্রলেতারীয় মুক্তিদূতদের পদভারে মাটির পৃথিবী কেঁপে উঠবে।
মার্ক্স- এঙ্গেলসের ভাবশিষ্যদের প্রধানত দুটি ধারা। জার্মানিতে ভিলহেল্ম ভিটলিং- রোজা লুক্সেমবার্গ থেকে লাতিন আমেরিকায় লিবারেশন থিয়োলজির প্রবক্তারা চৈতন্যের স্তরে আধিপত্যের লড়াইতে ধর্মের ভূমিকা মেনেছেন। ভাববাদ- বস্তুবাদ বাইনারির বদলে এক ও বহু ঈশ্বরের স্বরূপ নির্ণয় ও তাঁর বার্তাবাহকদের ঘিরে দ্বন্দ্ব- ধন্দে দেশি শ্রেণীসংগ্রাম থেকে বিদেশি-শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ছায়া-প্রচ্ছায়া খুঁজেছেন। অন্যদিকে বেবেলের নেতৃত্বে জার্মান কমিঊনিস্টদের একাংশ ও লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা ধর্মের ইতিহাসের পাঠান্তরে তাকে শুধুই শাসক- শোষকদের বিশ্বস্ত সেবাদাস, প্রকৃত মুক্তিচেতনার প্রধান শত্রু তথা প্রতিক্রিয়ার অন্যতম দুর্গ বলে অভিহিত করেন। ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসকে ঝাড়ে-বংশে নিকেশ না করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র গড়া যাবে না বলে তাঁরা নিদান দিয়েছেন। এঁদের তর্কটাও মূলত খ্রিষ্ট ধর্ম, ভ্যাটিকানকেন্দ্রিক খ্রিস্টীয় মৌলবাদ ও ক্রিস্টান ইউরোপ ঘিরে।
মধ্য এশিয়ায় সোভিয়েত শাসন-পর্বে তা ইসলাম ও স্থানীয় ঐস্লামিক সমাজ নিয়ে গড়ালেও তা বৃহত্তর মুসলিম জাহানকে ছোঁয়নি। তবে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ও আরব জাতীয়তাবাদের উন্মেষের পর থেকে পশ্চিম এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ায় ইসলামিক মৌলবাদ, সেকুলার জাতীয়তাবাদ, মার্কসবাদের মধ্যে টানাপড়েন আজও অব্যাহত। অন্যদিকে আমাদের দেশি সেকুলার-বামেদের মধ্যে স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে বিভক্ত ভারতে ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতার দেশজ স্বরূপ নিয়ে বিতন্ডাও ফুরোয় নি।
মার্ক্সবাদের সমালোচকরা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের সঙ্গে খ্রিষ্ট ধর্মের অনেক মিল খুঁজে পান। ইতিহাস নামক নিরাকার ঈশ্বরের মানুষের উপর অনতিক্রম্য নিয়ন্ত্রণ, অভিকর্ষ- মহাকর্ষের মতো তাঁর অমোঘ নিয়মকানুন, বার্তাবাহকদের সূত্রে আসা ঐশী প্রত্যাদেশের আকর পবিত্র পুঁথিসকল, মুক্তিদূতেদের পুনরুত্থান ও শুভ- অশুভের মহাযুদ্ধের শেষে আমাদের হৃদয়-রাজের রাজত্বের প্রতিষ্ঠা। এটা ঘটনা মস্কো-কেন্দ্রিক ভ্যাটিকান মার্কসবাদকে একটি সেকুলার মৌলবাদে পরিনত করেছিল। তারপর নানা কূটকচালিতে ডগমা-ভিত্তিক সাম্প্রদায়িক বিভাজন বেড়ে মিলটা আরও প্রকট হয়েছে। এদেশে তো আদিগুরুর বিগ্রহে পেন্নাম ঠুকে তাঁর পুঁথির দোহাই দিয়ে বিপ্লবের ব্যাকরণ নিয়ে টুলো পন্ডিতদের চুলোচুলির ফাঁকে আমাদের দিন গেল। এর চেয়ে মার্কসের মুক্তিচেতনার মধ্যে যুগ- যুগান্তের ধর্মবিশ্বাসী আমজনতার দীর্ঘশ্বাস এবং আবহমানের আকাঙ্খাগুলির অনুরণন শুনতে পাওয়া ঢের ভালো নয় কি?
অন্যদিকে বিজ্ঞানের ছাত্র না হয়েও সাধারণ পড়াশুনোয় যতটুকু বুঝেছি পশ্চিমী বিজ্ঞানের পজিটিভিস্ট দর্শনে দীক্ষিতরা যেমন ভাবে ভাবেন বিজ্ঞানের বিকাশ সেভাবে মোটেই ঘটেনি। প্রাকৃতিক আনুকূল্য ও প্রতিকূলতার টানাপড়েনে আদিম মানবের বাঁচার লড়াই; খাদ্য- বস্ত্র- বাসস্থানের সন্ধানের ধারাবাহিকতাতেই মোটা দাগের ধর্মীয় বিশ্বাস, রিচুয়াল, ইন্দ্রজাল, ছোট ছোট প্রযুক্তিচর্চা থেকে উচ্চতর প্রকৃতিদর্শন ও বিজ্ঞানচেতনা বা প্রযুক্তিভাবনার জন্ম। উচ্চ কোটি ও নিম্ন কোটির জীবনের সর্বস্তরে র্যাশানালের নির্মাণে ইর্যাশানালের ভূমিকা বা দুটির সহাবস্থান আজ আর অজানা বা অস্বীকৃত নয়। পরিশীলিত বৈজ্ঞানিক মননেও সামাজিক-রাজনৈতিক বিশ্বাস বা অন্ধ কুসংস্কারের ভূমিকা কত ভয়ঙ্কর, তা দুটি বিশ্ব যুদ্ধে বা পরবর্তী ঠাণ্ডা যুদ্ধে প্রমাণিত। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বিকাশের বিভিন্ন পর্বে আগের যুগের স্বতঃসিদ্ধগুলি বা চলতি ‘প্যারাডাইম’ গুলির আধিপত্যের নেপথ্যে বিশুদ্ধ পরীক্ষালভ্য প্রমাণ বা অকাট্য গাণিতিক নির্ণয়ের বাইরেও সমসাময়িক বিশ্ববীক্ষার অভিঘাত যে স্পষ্ট, তার ঐতিহাসিক রেখাচিত্র বিজ্ঞানের দর্শন নিয়ে টমাস কুন ও সমমনস্কদের চর্চায় আমরা পেয়েছি। সে সব মনে রাখলে বিশুদ্ধ বিজ্ঞানবাদ শুধু একটি সোনার পাথরবাটি মাত্র নয়, একটি সেকুলার মৌলবাদ বলে মনে হয়।
ধর্মের ইতিহাস চর্চা, ধর্মীয় ও সেকুলার মৌলবাদ
প্রাচীন ভারতের ধর্মীয় জীবন নিয়ে এক আলোচনা( কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা, সম্পাদনা ডি সি সরকার, ১৯৭২) অধ্যাপক এন এন ভট্টাচার্য প্রশ্ন তুলেছিলেনঃ চার্বাক- লোকায়তিক, ন্যায়- বৈশেষিক- মীমাংসা দর্শনে এবং জৈন ও হীনযান বৌদ্ধ ধারায় নাস্তিবাদী দর্শনের এত তাত্ত্বিক সম্ভার থাকলেও কেন বাস্তবে ভারতের জনজীবনে তার প্রভাব নেই? উত্তর খুঁজতে গিয়ে আল-বেরুণির পর্যবেক্ষণ মতো অভিজাত হিন্দুদের শ্রেণী স্বার্থরক্ষায় আমজনতার অশিক্ষিত রাখার ব্যবস্থাকে অনেকটা দায়ী করেছেন। একই সঙ্গে এ প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ধারণা উল্লেখ করেছেন তিনি। তাঁর ‘ইন্ডিয়ান এথেইজিম’ বইতে দেবীপ্রসাদ লিখেছিলেনঃ নাস্তিবাদীরা তাঁদের দর্শনে সদর দরজায় ঈশ্বর নামে বিভ্রমকে ঢুকতে না দিলেও খিড়কিতে তাঁর সঙ্গী ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কারের প্রবেশ আটকাতে পারেননি। তাঁদের নিজেদের মধ্যে প্রবল বিরোধ ছিল। আসলে কেঠো মার্ক্সবাদীরা বোঝেন না যে ভাববাদ ও বস্তুবাদের যাত্রা রেললাইনের মতো সমান্তরাল পথে নয়। চুলের বিনুনির মতো একে অপরের সংলগ্ন হয়ে এঁকে বেঁকে চলে এঁরা আজকের চেহারা পেয়েছে এবং জনমনে ঠাঁই নিয়েছে। এটা পূবে যতটা সত্যি, পশ্চিমেও ততটাই।
আমরা ভুলে গেছি ধর্মের ইতিহাসও শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস। প্রতিটি ধর্মের মধ্যে ভাববাদ ও বস্তুবাদের লড়াই ছিল ও আছে। ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্টের প্রথাগত ধর্মীয় ব্যাখ্যার বাইরেও গত শতাব্দীতে আবিষ্কৃত ‘ডেড সি স্ক্রোল’ ও অন্যান্য নব-লব্ধ পুঁথিপত্র ও প্রত্নপ্রমাণের সূত্রে যীশু ও তাঁর সমসাময়িক ইহুদি বস্তু ও মানসজগত এবং পরে বাইবেল ঘিরে ক্রিস্টীয় বিশ্বাসের বিবর্তন নিয়ে মুক্তচেতন গবেষণা ইউরোপ ও আমেরিকায় অব্যাহত। পপুলার সাহিত্য- সিনেমায়ও তা চর্চিত। ক্রিস্টীয় মৌলবাদী বিশ্বাস ও চার্চের ঐতিহ্যের বাইরে খ্রিস্ট-জীবনের নানা দিক নিয়ে বিতর্ক চলছে। যদিও ইসলামিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও পশ্চিমি সভ্যতা রক্ষার নামে খ্রিষ্টীয় মৌলবাদ ও শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের রমরমা বাড়ছে।
মুহম্মদ ও তাঁর ধর্ম ইসলামকে কেন্দ্র করে ইসলামিক জগতে নানা সময়ে আত্মজিজ্ঞাসা ও পরিপ্রশ্ন শোনা গেলেও আজ তার পক্ষে প্রধান বাধা ইসলামিক মৌলবাদ। একে ঐতিহাসিক ভাবে শক্তিশালী ও জনপ্রিয় করেছে পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদ ও খ্রিষ্টানি মৌলবাদ। তবু অন্দরের প্রশ্নগুলিকে মেরে ফেলা যায়নি। প্রাচীন ইহুদি ধর্ম ও সমাজ তার প্রাচীনতর উৎস থেকে দূরে ফারাওয়ের ইজিপ্টে ও পরে খ্রিস্টান ইউরোপে ঘৃণা ও দমন-পীড়িত ছিন্নমূল জীবন কাটানর নানা পর্বে বারংবার বিশ্বাসের জগতে বহু স্বর ধ্বনিত হতে শুনেছে। কিন্তু আজ পশ্চিমি রাজনীতি ও অর্থনীতির কল্যাণে ইসলামিক জগতের বৈরিতা ও আধিপত্যবাদী ইহুদি রাষ্ট্রের প্যারানইয়ার জেরে তা রুদ্ধপ্রায় হলেও ফল্গুধারা শুকিয়ে যায়নি।
হিন্দু ধর্ম ও সমাজ ঘিরে এমনই এক অবরুদ্ধতার ইতিবৃত্ত নির্মাণ করেছে হিন্দু মৌলবাদীরা যাদের বয়ানে ইসলাম ও মুসলিম সমাজ হল অন্দরের অবরোধকারী তথা ট্রোজান ঘোড়া। এই অবরোধের মুখে হিন্দু ধর্ম ও সমাজের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ এবং প্রতিবেশি সমাজের প্রতি তার মনোভাব নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলা যাবে না। জিন্নার দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ ও পাকিস্তান গঠন এই বয়ানকে হিন্দু মানসে শক্তিশালী ও জনপ্রিয় করেছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাজত্ব হিন্দু ও মুসলমান বৈরিতার আগুনে ধুনো ছিটিয়ে গেছে। অতীতকে ধামাচাপা দিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির হিংস্র ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না।
ধ্রুপদী ফ্যাসিবাদের মতোই ঔপনিবেশিক শাসনের গর্ভজাত আধুনিক ধর্মীয় মৌলবাদ-- তা সে হিন্দুত্ববাদী হোক বা তা তার ইসলামিক- খ্রিষ্টীয়- ইহুদি রকমফের-- এক একরৈখিক ও সমসত্ব অতীত সভ্যতার গরিমাগাথা শোনায়। এতে ইতিহাস আর অতিকথার সীমানা ইচ্ছাকৃতভাবে ধূসর রাখা হয় বর্তমানের রাজনীতি- অর্থনীতির প্রয়োজনে। সভ্যতা-সংস্কৃতিগুলির ধারাবাহিক আদান-প্রদান, সঙ্ঘাত- সমন্বয়ের ইতিহাসের বদলে দেশ-কাল, সমাজ-সময় নিরপেক্ষ মৌলবাদী বয়ানে নিজ গোষ্ঠী অপর জাতি-ধর্ম- ভাষাগোষ্ঠীর দ্বারা আক্রান্ত ও দূষিত, দুঃসময় পেরিয়ে দেবাংশী মুক্তিপুরুষদের হাত ধরে প্রাচীন মহিমায় ফের উদ্ভাসিত হওয়ার অপেক্ষায়।
বিশ্ব জুড়ে সব ধরণের ধর্মীয় মৌলবাদীদের পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জেরে ধর্ম ও সমাজ পরিবর্তন নিয়ে মুক্তচিন্তার পথে ক্রমশ দুস্তর বাধা। এই পরিস্থিতিতে ইসলাম-পূর্ব ভারতে ধর্মীয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক ভাবে বহুধাবিভক্ত হিন্দু সমাজের ইতিহাস চর্চা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই জরুরি প্রাচীন ভারতের অনেকান্ততা, সহিস্নুতা ও তর্কশীলতার ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার। দেশ ও কালের সীমানা পেরিয়ে যা কিছু খারাপ তাকে বর্জনের পাশাপাশি যা কিছু ভালো তাঁকে গ্রহণের মানসিকতাই মুক্তচেতনা । আধুনিকতার নামে পশ্চিমের অন্ধ নকলনবিশি জঙ্গি জাতীয়তাবাদ বা ধর্মীয় মৌলবাদের মতোই আর একটি মৌলবাদ। এক মৌলবাদ দিয়ে আরেক মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায় না। যাচ্ছেও না।
প্রাচীন পাঠ্যের পুরোন বয়ানের বিনির্মাণ থেকে নতুন বয়ানের নির্মাণ, লেখক ও পাঠক বা বক্তা ও শ্রোতার নিজস্ব ‘সাবজেক্টিভিটি’-কে স্বীকার করেই ‘টেক্সট’ ও ‘কন্টেক্সট’ মধ্যে মিলনসূত্র খোঁজার মাধ্যমে অতীত ও বর্তমানের সংযোগসাধনে হারমেনিউটিক্স ইত্যাদি আধুনিক বিদ্যা পশ্চিমি মননবিশ্বের সূত্রে এদেশেও সমাদৃত। কিন্তু এর সঙ্গে দেশজ জ্ঞানতত্ব ও যুক্তিবিদ্যাকেও জেনে প্রাচীন ভারতকে বোঝা-জানা এবং বর্তমান ভারতের সঙ্গে তার সংযোগ- সূত্রগুলিকে খোঁজার চেষ্টা ফ্যাশনদুরস্ত নয়।
কেন না আমাদের বাম-চেতনায় ঐ প্রাচীন ‘প্রি-হিস্ট্রি’ মাত্র, যাকে আমাদের নাড়ী-কাটা আধুনিক অস্তিত্ব মাতৃগর্ভ বা ধাত্রীক্রোড় রূপে চিনতে পারে না, পারলেও স্বীকার করতে লজ্জা পায়। যেটুকু প্রাচীনচর্চা দরকার ছিল তা কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের মধ্যে ডাঙ্গে- নাম্বুদ্রিপাদ কিছুটা আর বৌদ্ধিক স্তরে কোসাম্বি- কারভে- থাপার-মুখিয়া-শর্মারা করে গেছেন। এখন সঙ্ঘ পরিবার ভারত ইতিহাসের লাশঘর থেকে মধ্য বা আধুনিক যুগের মুর্দা টেনে বের করলে আমরা পাল্টা সুরতহালে আছি। কিন্তু প্রাচীনে নেই। সংরক্ষণের অভাবে সেই যুগের লাশ এতটাই গলে-পচে গেছে যে তার হালতামামি আমাদের কাছে ফালতু কাজ। ফলে সেই লাশের উপর বসে এখন গেরুয়া-বাহিনির শব-সাধনা চলছে।