বলিভিয়ায় মুভমেন্ট ফর সোসালিজমের বিপুল বিজয়ের প্রেক্ষাপট ও তাৎপর্য
- 16 November, 2020
- লেখক: সৌভিক ঘোষাল
২০১৯ এ প্রায় একটি প্রতিবিপ্লবী ক্যু এর মধ্যে দিয়ে নির্বাচনে জিতে আসার পরও ইভো মোরালেসকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। এক বছরের মধ্যেই বলিভিয়ার জনগণ এর যোগ্য জবাব দিলেন। ইভো মোরালেসের দল মুভমেন্ট ফর সোসালিজম বিপুল জয় পেয়ে ফিরে এল বলিভিয়ার ক্ষমতায়।
এক বছরের মধ্যেই বলিভিয়ায় ঘুরে দাঁড়ালেন বামপন্থীরা। ২০০৬ সালে বলিভিয়ার নির্বাচনে জয় পেয়ে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন মুভমেন্ট ফর সোসালিজমের নেতা ইভো মোরালেস। দেশের আদিম জনগোষ্ঠীর কোনও প্রতিনিধির সেটাই ছিল প্রথমবারের জন্য বলিভিয়ার রাষ্ট্রপতির আসনে বসা। সেই সময়টা গোটা লাতিন আমেরিকাতেই বাম ঝোঁক সম্পন্ন সরকারদের একে একে ক্ষমতায় আসার পর্ব ছিল, যাদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল ছিলেন ভেনেজুয়েলার হুগো স্যাভেজ।
এরপর অনেক বদলে গেছে লাতিন আমেরিকা ও বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্র। জোর করে নির্বাচনে হারিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বাম ঝোঁক সম্পন্ন সরকারের প্রধানদের। কোথাও কোথাও তাদের বিরুদ্ধে ক্যু করার চেষ্টা হয়েছে, সেনাবাহিনী তাতে মদত দিয়েছে কর্পোরেট ও মার্কিনি ইঙ্গিতে। গত বছর ইভো মোরালেসের বিরুদ্ধেও এই ঘটনা ঘটে। ২০১৯ এর নির্বাচনে মোরালেস বিজয়ী হবার পরেও মার্কিন রাষ্ট্র ও কর্পোরেট মদতে সেই জয়ের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার চলে। জনগণের একাংশকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয় কর্পোরেট প্রচারযন্ত্র। ইভো মোরালেস বাধ্য হন দেশ ছেড়ে চলে যেতে। নির্বাচনে জিতেও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ে একটা গোটা বছর কাটাতে হয় তাকে।
কিন্তু এই চক্রান্তর সাফল্য দীর্ঘমেয়াদি হল না। মাত্র এক বছরের মধ্যে পুনরায়োজিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় পেলেন ইভো মোরালেসের দল মুভমেন্ট ফর সোসালিজম এর রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী লুইস আর্ক। যিনি আগে মোরালেসের শাসনকালে বলিভিয়ার অর্থমন্ত্রী ছিলেন। আর্ক শুধু যে জিতেছেন তাই নয়, এই জয়ের মার্জিন বুঝিয়ে দিয়েছে একবছর আগের দক্ষিণপন্থী চক্রান্তর চাকাকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিতে বলিভিয়ার জনগণ কতটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। লুইস আর্ক যেখানে ৫২ শতাংশ মতো ভোট পেয়েছেন, দ্বিতীয় স্থানে থাকা কার্লোস মেসা সেখানে পেয়েছেন ৩১ শতাংশের মতো। মনে রাখতে হবে মোরালেস ও মুভমেন্ট ফর সোসালিজম বিরোধী ভোট যেন ভাগ না হয়, তাই নিয়ে বিরোধিরা যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন। মোরালেস বিরোধী ক্যু এর পর প্রেসিডেন্ট হিসেবে যিনি দায়িত্ব নেন, কনজারভেটিভ পার্টির সেই নেতা জেনাইন আনিয়েজ নিজেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন থেকে সরিয়ে নেন। কিন্তু এতদ সত্ত্বেও কার্লস মেসা মুভমেন্ট ফর সোসালিজম প্রার্থী আর্ককে যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলতে পারলেন না, পিছিয়ে থাকলেন বিরাট ব্যবধানে।
লুইস আর্ক মোরালেস সরকারের অর্থ মন্ত্রী হিসাবে হাইড্রোকার্বন, টেলিযোগাযোগ, খনি জাতীয়করণের কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ফলে তার বিরুদ্ধেও বহুজাতিক সংস্থাগুলির ক্ষোভ ছিল যথেষ্ট। মোরালেস বিরোধী ক্যু এর পর মোরালেসের মতো তিনিও দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। দু মাস পরে অবশ্য তিনি দেশে ফিরে আসেন। তখন অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছেন শত শত মানুষ। তাকে দমনে নয়া সরকার উদ্যত। মুভমেন্ট ফর সোসালিজমের কর্মী, সমর্থকদের বিরুদ্ধে নামিয়ে আনা হয় পুলিশি সন্ত্রাস, অনেককে কারারুদ্ধ করা হয়। সাকাবা, সেনকাটা, পেদ্রেগাল, ইয়াপাচানি সহ দেশের নানা প্রান্তে সরকার গণহত্যা চালায় প্রতিরোধ দমন করতে। শহীদ হন অনেক তরুণ। কিন্তু আন্দোলন তাতে স্থিমিত হয় নি, বরং গড়ে ওঠে শ্রমিক, কৃষকদের বড় বড় গণসংগ্রাম। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে চলতে থাকা নিরন্তর লড়াই শেষপর্যন্ত একবছরের মধ্যেই পরিস্থিতিকে বদলে দিতে সক্ষম হল সদ্য সমাপ্ত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে। ইভো মোরালেসকে এই নির্বাচনে নিষিদ্ধ ঘষণা করা হলে তার বদলে তার সরকারের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী লুইস আর্ক প্রার্থী হয়েছিলেন। আর্কের বিপুল বিজয় স্বাভাবিকভাবেই মোরালেসের বলিভিয়ায় প্রত্যাবর্তন ও মুভমেন্ট ফর সোসালিজমের দেশজোড়া শ্রেণিশক্তির ভারসাম্য বদলানোর চলমান লড়াইকে সাহায্য করবে।
লাতিন আমেরিকায় বাম ঝোঁক সম্পন্ন সরকার গঠন ও জনপ্রিয় গণ আন্দোলনের প্রবাহ একবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্ন থেকেই এক নতুন বাতাবরণের জন্ম দিয়েছিল। সেখানে উচ্চকিত হয়ে ওঠে ‘একুশ শতকের সমাজতন্ত্রের’ কথা। কিউবার চে ফিদেলের পরবর্তী সময়ে ভেনেজুয়েলার স্যাভেজ, বলিভিয়ার ইভো মোরালেস বা ব্রাজিলের লুলা লাতিন আমেরিকার গণ্ডী ছাড়িয়ে সারা বিশ্বের রাজনৈতিক মহলের চর্চার বিষয় হয়ে ওঠেন। ১৯৯৮ সালে ভেনেজুয়েলার নির্বাচনে প্রথম বারের জন্য বিজয়ী হয়ে রাষ্ট্রপতি হন হুগো স্যাভেজ। এর পরে বিভিন্ন নির্বাচনে বারবার বিজয়ী হয়ে তিনি গোটা লাতিন আমেরিকার বামমুখী পটপরিবর্তনের অন্যতম কাণ্ডারীর ভূমিকা পালন করেন। তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর উত্তরসূরী মাদুরোকে মার্কিন মদতপুষ্ট দক্ষিণপন্থী প্রার্থী পরাস্ত করতে পারেন নি। ভেনেজুয়েলার বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাদুরো স্যাভেজের একুশ শতকের সমাজতন্ত্রের স্বপ্নকেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। কিউবা এবং ভেনেজুয়েলার পাশাপাশি লাতিন আমেরিকার নানা দেশে আমরা গত এক দশকে বিভিন্ন মাত্রার বামঝোঁক সম্পন্ন সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে দেখেছি। ২০০২ সালে চিলেতে রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচনে বিজয়ী হন রিকার্ডো লাগোস, ব্রাজিলে লুলা। ২০০৩ সালে আর্জেন্টিনার নির্বাচনে বিজয়ী হন নেসটর কির্কনার, উরুগুয়েতে ২০০৫ সালে নির্বাচনে জেতেন তাবারে ভাজকুয়েজ। ২০০৬ সালে চিলেতে মিশেল বাশালেত, বলিভিয়ায় ইভো মোরালেস, ইকুয়েডরে রাফায়েল কোরেয়া ও নিকারাগুয়ায় ড্যানিয়েল ওর্তেগা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ২০০৭ সালে আর্জেন্টিনায় ক্রিস্টিনা ফের্নানদেজ ও গুয়েতমালায় আলভারো কলোম রাষ্ট্রপতি পদে বসেন। প্যারাগুয়েতে ২০০৮ সালে ফের্নাদো লুগা এবং এল সালভাদোরে ২০০৯ সালে মরিসিও ফুয়েনেস রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। উরুগুয়েতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন হোসে মুজিকা। ২০০৯ সালে ইকুয়েডরে রাফায়েল কোরেয়া ও বলিভিয়ায় ইভো মোরলেস দ্বিতীয় বারের জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ২০১৯ পর্যন্ত মোরালেস বলিভিয়ায় একটানা রাষ্ট্রপতি থাকেন, মাদুরোও স্যাভেজ পরবর্তী সময়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে সমর্থ হন ভেনেজুয়েলায়। অন্যান্য দেশে পট পরিবর্তন ঘটে। স্বাভাবিকভাবেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও বৈশ্বিক কর্পোরেট শক্তি এই দুই দেশে পালাবদলের জন্য প্রবল সক্রিয়। ভেনেজুয়েলাতে বারবার ক্যু এর চেষ্টা চলছে মাদুরোর বিরুদ্ধে। বলিভিয়াতে ২০১৯ এ তারা সফলও হয়। যদিও ২০২০ র রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জনগণ আবার দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাতে সফল হল।
২০২০ র বলিভিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের গুরুত্ব ও মুভমেন্ট ফর সোসালিজমের ক্ষমতায় ফিরে আসার তাৎপর্যকে বুঝতে বলিভিয়ার সাম্প্রতিক ইতিহাসের দিকে পরিশেষে একটু ফিরে তাকানোর দরকার আছে। বিশ শতকের প্রথম ত্রিশ বছর একটা রাজনৈতিক সুস্থিতির পর বিরাট আর্থিক অসাম্য ও মূলত পিছিয়ে পড়া মানুষদের ব্যাপক বঞ্চনার সূত্রে দানা বাঁধে বিপ্লবী জাতিয়তাবাদী আন্দোলন (রিভোলিউশনারি ন্যাশানালিস্ট মুভমেন্ট বা MNR )। ১৯৫২ সালে এম এন আর ক্ষমতা দখল করে, রাষ্ট্রপতি হন ভিক্তর পাজ। পাজ লেসঁ ফেয়ার নীতি থেকে সরে এসে অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করেন, পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও সংস্কার সাধিত হয়। এই সময়েই চালু হয় সর্বজনীন ভোটাধিকার। ব্যাপক ভূমিসংস্কার কর্মসূচী গৃহীত হয়, গ্রামীণ জনগণের শিক্ষার বিকাশে বিশেষ জোর দেওয়া হয় আর অত্যন্ত গুরূত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে টিনের খনিগুলির জাতীয়করণ করা হয়।
বলিভিয়ার ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে অর্থনীতির ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ আর লেসঁ ফেয়ার নীতির দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করা যায়। এম এন আর শাসনের বারো বছরের মাথায় দেশে একটি প্রতিবিপ্লবী ক্যুর মধ্য দিয়ে মিলিটারি জুন্টা ক্ষমতা দখল করে। এই মিলিটারি শাসনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ। এই জুন্টার শাসনকালেই চে গেভারা গেরিলা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বলিভিয়া মুক্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন, ধরা পড়েন এবং তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মিলিটারি জুন্টার পরে বেশ কিছু অস্থায়ী সরকার কিছুদিনের জন্য শাসন করে, কিন্তু দেশের রাজনৈতিক সুস্থিতি ছিল অধরা। নব্বইয়ের দশকে গঞ্জালো স্যাঞ্জেজ নয়া উদারবাদ নির্দেশিত নীতির ভিত্তিতে দেশ চালানো শুরু করেন। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির পঞ্চাশ শতাংশ পর্যন্ত মালিকানা ও পরিচালনার নিয়ন্ত্রণ ব্যক্তি মালিকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়, যাদের অধিকাংশই ছিলেন বিদেশী। পরবর্তী রাষ্ট্রপতি বেনজারের সরকারও একইভাবে নয়া উদারবাদী নীতি গ্রহণ করে। অন্যান্য বিভিন্ন নীতির সঙ্গে কোকো উৎপাদন বন্ধের একটি বিশেষ নীতি এই সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল ক্ষোভের জন্ম দেয় এবং সেই বিক্ষোভ আন্দোলনের প্রধান কাণ্ডারী ইভো মোরালেসকে গণ আন্দোলনের ওপর ভর করে আমরা ২০০৫ সালে বলিভিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ক্ষমতায় আসতে দেখি।
বলিভিয়ার একটি প্রধান কৃষিপণ্য হল কোকো। এটি ওষুধ তৈরির উপকরণ হিসেবে জরুরী, আবার বলিভিয়ার অনেক অঞ্চলে এটি সাংস্কৃতিক প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই কোকোকেই আবার অনেকে ব্যবহার করেন মাদক কোকেন তৈরির কাজে। মূলত মাদক কোকেনের ব্যবহার বন্ধ করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের নির্দেশে বলিভিয়ার এই পর্বের মার্কিন অনুগত সরকার কোকো উৎপাদনকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। রুটি রুজির প্রধান অবলম্বন কেড়ে নেওয়ার এই স্বৈরাচারী নীতির বিরুদ্ধে কোকো উৎপাদনকারীরা পথে নামেন। মূলত কোকাবাম্বা অঞ্চলে বিক্ষোভ তীব্রতম চেহারা নেয়, কারণ এখানকার অধিবাসীদের অধিকাংশই কোকা উৎপাদনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন। কোকা উৎপাদন কতটা জনপ্রিয় ছিল তা বোঝা যাবে কোকাম্বার অন্তর্গত এল চাপারে প্রদেশের জনগণনার হিসেব থেকে। ১৯৮১ সালে এল চাপারের জনসংখ্যা ছিল ৪০,০০০। ১৯৯৮ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ২,১৫,০০০ এ। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বলিভিয়ানরা দলে দলে এখানে আসেন কোকা উৎপাদনের আগ্রহে, যার দাম ছিল ক্রমশই উর্ধমুখী আর বছরে চারবার যার চাষ করা সম্ভব ছিল। ইভো মোরালেসের পরিবারও পরিযায়ী হয়ে এখানে আসেন এবং মোরালেস কোকা উৎপাদকদের ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৮০ তে চরম দক্ষিণপন্থী লুই গার্সিয়া ক্ষমতা দখল করেন এবং ১৯৮১ থেকে কোকেন পাচারের অভিযোগে কোকো উৎপাদকদের ওপর সেনাবাহিনীর অত্যাচার শুরু হয়। ১৯৮২ তে বামপন্থী হারমান জুয়াজোর সরকার ক্ষমতায় আসে কিন্তু তারাও দ্রুত আমেরিকি চাপের কাছে নতিস্বীকার করে। কোকা উৎপাদন বন্ধে বলিভিয় সরকারকে সাহায্যের জন্য আমেরিকা সেনাবাহিনী পর্যন্ত পাঠায়। কোকা উৎপাদনের প্রশ্নটি ক্রমশই বলিভিয়ার সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায় এবং মার্কিনীদের দেখা হতে থাকে সাম্রাজ্যবাদী হিসেবে। কোকা উৎপাদকদের ইউনিয়ন সরাসরি রাজনীতিতে প্রবেশ করবে কিনা এ নিয়ে দীর্ঘ বিতর্কের পর অবশেষে তারা প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। কোকা উৎপাদকদের নেতা হিসেবে মোরালেসকে অনেকবার জেল খাটতে হয়েছে, ১৯৮৯ সালে তাকে একবার প্রচণ্ড মারধোর করে মরণাপন্ন করে ফেলা হয়।
মোরালেস কোকাকে আন্দিয়ান সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করেন এবং কোকা ও কোকেনের পার্থক্যকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার জন্য প্রচার অভিযানে সামিল হন। কোকা উৎপাদকদের নিয়ে কোকাকাম্বা থেকে বলিভিয়ার রাজধানী লা পাজ পর্যন্ত ৬০০ কিমি দীর্ঘ রাস্তা তিনি পাড়ি দেন। ইউরোপে প্রচারে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “ আমি ড্রাগ পাচারকারী নই। আমি কোকা উৎপাদক। এটা একটা প্রাকৃতিক সম্পদ। আমি তা থেকে কোকেন বানাই না। কোকেন আন্দিয়ান সংস্কৃতির অঙ্গ নয়”। ১৯৯৫ থেকে মোরালেস তাঁর আন্দোলনকে অভিহিত করেন ‘মুভমেন্ট ফর সোস্যালিজম’ নামে।
কোকা উৎপাদক অঞ্চল থেকে তিনি সংসদে নির্বাচিত হন। কিন্তু ২০০২ সালে কোকা উৎপাদকদের ওপর সেনা আক্রমণ হলে তিনি খোলাখুলি উৎপাদকদের পক্ষে দাঁড়িয়ে সেনা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের কথা বলেন। এজন্য সংসদ থেকে তাকে বরখাস্ত করা হয়। এই বছরেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করন এবং দেশের রাজনৈতিক মহলে বিষ্ময় তৈরি করে দ্বিতীয় স্থান পান। গোটা লাতিন আমেরিকা জুড়ে মূলবাসী স্বাদেশিক আন্দোলনের অন্যতম কন্ঠস্বর হিসেবে মোরালেসের পরিচিতির শুরুও হয় এই সময় থেকেই।
কোকা উৎপাদনের স্বপক্ষে ও নয়া উদারবাদী নীতির বিরোধিতায় মোরালেসের আন্দোলন চলতে থাকে। ২০০৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মোরালেস বিপুল সমর্থন নিয়ে বিজয়ী হন এবং এই বছরেই পালিত হয় ‘মুভমেন্ট ফর সোশ্যালিজম’ এর দশম বর্ষপূর্তি। আদিবাসী মানুষের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ও তার আন্দোলন অবশেষে মোরালেসের রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে সাফল্য পায়। অভিষেক ভাষণে মোরালেস জানান ‘ ৫০০ বছরের ঔপনিবেশিকতার অবসান হলো’। দেশের পুনর্গঠনের কাজ শুরু করার প্রতিশ্রুতিও তিনি দেন পরবর্তীকালে নিষ্ঠার সঙ্গে কর্পোরেট লবি ও তাদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার তুমুল বিরোধিতা স্বত্ত্বেও সে কাজ তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন। মোরালেসের মন্ত্রীসভায় আদিবাসী মানুষ ও বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের আধিক্য প্রথম থেকেই তাঁর দৃষ্টিকোণ স্পষ্ট করে দিয়েছিল। মোরালেস সরকার প্রথমেই বলিভিয়ার ব্যাপক দারিদ্রের প্রকোপ সীমায়িত করার দিকে নজর দেয়। প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যেই দারিদ্রসীমার হার ৩৫ শতাংশ থেকে ২৭ শতাংশে নেমে আসে। অশিক্ষা দূরীকরণেও বিশেষ নজর দেওয়া হয়। অনেক গুরূত্বপূর্ণ আর্থিক উৎপাদন ক্ষেত্রের জাতিয়করণ করা হয়, যার মধ্যে ছিল তেল, খনি, প্রাকৃতিক গ্যাসের পাশাপাশি যোগাযোগ ক্ষেত্র। সামাজিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক ব্যয় বরাদ্দ করা হয় সরকারের তরফে। বয়স্কদের পেনসনের ব্যবস্থা করা হয়, এজন্য আগে থেকে অর্থ প্রদানের কোনও প্রয়োজন ছিল না। শিশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও শিক্ষার জন্য মায়েদের বিশেষ ভাতা দেওয়া হয়। কৃষকদের শয়ে শয়ে ট্রাক্টর বিনে পয়সায় বিলি করা হয়। জ্বালানী ও খাদ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা হয়, খাদ্য রপ্তানীর পরিবর্তে স্থানীয় বাজারে খাদ্য বিক্রির ওপর জোর দেওয়া হয়। ভরতুকি মূল্যে খাদ্য সরবরাহের জন্য একটি সরকারী সংস্থাও গঠন করা হয়। ২০০৬ আহূত নতুন সংবিধান সভার মাধ্যমে তৈরি হয় নতুন সংবিধান এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে স্বীকৃতি দিয়ে তার নতুন নাম হয় ‘প্লুরিন্যাশানাল স্টেট অব বলিভিয়া’। ২০০৯ সালের নির্বাচনে আরো বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করেন মোরালেস, ভোটের শতাংশ মাত্রা ২০০৫ থেকে বেড়ে হয় ২০০৯। পুঁজিবাদ, নয়া উদারবাদ ও আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মোরালেস ও বলিভিয়ার সংগ্রাম পরবর্তী দশক জুড়েও চলতে থাকে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শিল্পক্ষেত্রকে রাষ্ট্রীয় আঙিনায় নিয়ে আসতে থাকে ইভো মোরালেসের নেতৃত্বাধীন মুভমেন্ট ফর সোশালিজম আর সেই পর্ব জুড়ে অর্থমন্ত্রী হিসেবে এই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা নেন সরকারের অর্থমন্ত্রী লুইস আর্ক। ২০১৯ সালে নির্বাচনে জনরায়ের মধ্যে দিয়ে মোরালেস পুনর্বার ক্ষমতায় ফেরেন। ২০১৯ এর অক্টোবর মাসে এই নির্বাচন হয় ও নভেম্বরের গোড়াতেই এক জার্মান বহুজাতিকের সাথে লিথিয়াম নিষ্কাশন সংক্রান্ত চুক্তি বাতিল করে দেয় নতুন সরকার। মোরালেস সরকার চীনা ও রুশ সংস্থাগুলোর সাথে নতুন চুক্তিতে আবদ্ধ হন, কারণ সেগুলো বলিভিয়ার অর্থনীতির জন্য অপেক্ষাকৃত লাভজনক ছিল। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার অটোমোবাইল থেকে সেল ফোন, আজকের বাণিজ্যের নানা গুরুত্বপূর্ণ পণ্যর অন্যতম ভিত্তি ব্যাটারি তৈরিতে লিথিয়ামের গুরুত্ব অপরিসীম। আন্দিজ পর্বতমালার ওপরে অবস্থিত 'সালার দে উইয়ানি' নামের বিশাল লবণাক্ত প্রান্তর সহ পৃথিবীর মোট লিথিয়ামের ২৫-৪৫% রয়েছে বলিভিয়ার ভৌগলিক সীমার মধ্যে। ছোট ও সম্পদশালী বলিভিয়ার এই 'বাড়াবাড়ি' মার্কিন কর্তাব্যক্তি ও কর্পোরেটরা মেনে নিতে পারে নি। বলিভিয়ার মিলিটারি জেনারেল উইলিয়ামস কালিমান ও বিরোধী নেতা ফার্নান্দো কামাচো সহ দক্ষিণপন্থী রাজনীতিবিদ, কর্পোরেট প্রসাদধন্য মিডিয়া ও মার্কিন তাঁবেদারদের কাজে লাগিয়ে ক্যু করে বাধ্য করা হয় ইভো মোরালেসকে পদত্যাগ করতে। তবে শেষরক্ষা যে হয় নি তা বোঝাই যাচ্ছে। গণ আন্দোলনের ঢেউয়ে চেপে বলিভিয়ার সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে আবার ক্ষমতা ফিরে পেয়েছে মুভমেন্ট ফর সোশালিজম।
বলিভিয়ার নির্বাচনের এই ফলাফল দেশে ও লাতিন আমেরিকা জুড়ে কি পরিমাণ প্রেরণা আগ্রহী চোখ থাকবে আমাদের। তবে অনেকেই যে এই বিজয়কে ঘিরে আশাবাদী সেই বার্তা আসতে শুরু করেছে। মোরালেসের মতোই ক্যু এর শিকার হয়ে ২০০৯ সালে অপসারিত হন্ডুরাসের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ম্যানুয়েল জেলায়া ক্যু এবং প্রতারণাকে পরাভূত করার জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন বলিভিয়ার মানুষকে। হুগো স্যাভেজ পরবর্তী সময়ে ভেনেজুয়েলার চলমান বলিভারিয়ান বিপ্লবের দায়িত্ব যার কাঁধে, সেই রাষ্ট্রনায়ক নিকোলাস মাদুরো বলেছেন, ‘মহান জয়! ঐক্যবদ্ধ ও সতর্ক বলিভিয়ার জনগণ আমাদের সহোদর ইভোর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানকে পরাস্ত করতে ভোটকে ব্যবহার করেছেন।’ কাস্ত্রো পরবর্তী সময়ে কিউবাকে যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেই রাষ্ট্রপতি মিগুয়েল দিয়াজ ক্যানেল বলেছেন, ‘সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের নির্দেশে যে অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল তা ফিরিয়ে এনেছেন বলিভিয়ার জনগণ। কিউবা এই আনন্দের অংশীদার’। সাইমন বলিভার কে স্মরণ করে তিনি বলেছেন এই জয় বলিভিয়ারান মতাদর্শের জয়। বলিভারিয়ান মতাদর্শ হল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিকদের নাছোড় লড়াইয়ের মতাদর্শ, আর সে কারণেই তা এত গুরুত্বপূর্ণ।