বিহারের নির্বাচন ও বামপন্থা

বিহার নির্বাচনে বামেদের সাফল্য ও তার সূত্র ধরে সারা দেশে এবং বিশেষভাবে বাংলায় বামপন্থীদের নিয়ে ও বামপন্থীদের মধ্যে নানা ধরনের আলাপ আলোচনা বিতর্ক জমে উঠেছে। আমরা নানাদিক থেকে সেই বিতর্ক ও আলাপ আলোচনাকে ধরতে চাইছি। মতামত লেখকদের ব্যক্তিগত।

করোনাকালের মতো একটা কঠিন সময়ে এবং বিহারের মতন একটা সংকটগ্রস্থ রাজ্যে বিপন্ন মানুষ কীভাবে রুখে দাঁড়াতে পারেন এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রশ্নগুলো কীভাবে একটা নির্বাচনে এজেন্ডা হয়ে উঠতে পারে এটা বিহারের নির্বাচন এবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। বিহারের নির্বাচন বস্তুত একটা গণ আন্দোলন হয়ে উঠেছিল। একটা যুবশক্তির আন্দোলন, এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের আন্দোলন এবং সেই আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল বলেই বামপন্থীদের ফলাফলটা তুলনামুলকভাবে বিহারে ভালো। কারণ মানুষ লকডাউনের সময় অভিজ্ঞতা… অভিজ্ঞতা যেটা মানুষের হলো যে কোন সরকার মানুষের পাশে ছিল না, সেখানে বামপন্থী কর্মীবাহিনীই - তাঁরা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এবং সেটা বামপন্থার যে ঐতিহ্য, দীর্ঘদিন ধরে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর, মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা, থেকে রাজনীতি করা, তো সেটা আবার মানুষ সেটা দেখলেন। বিহারের নির্বাচন এটাও দেখাল যে আজকের এই যে বিজেপির দাপট, যে বিজেপি মানেই তাকে নির্বাচনে তা অপরাজেয়, এবং কেন্দ্রের সরকার এবং বিভিন্নভাবে যে পুরো ভারতবর্ষের যে সিস্টেমটা, পলিটিক্যাল সিস্টেম, সেখানে আর কোনও গণতন্ত্রের জন্য জায়গা নেই, সাধারণ মানুষের জন্য আর কোনও জায়গা নেই, এই যে একটা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, সেখানে এখনও মানুষের মূল্য আছে এবং গণতন্ত্রর জন্য লড়া যায়, সেই লড়াই করে রুখে দাঁড়ানো যায় বিহার সেটা দেখিয়ে দিল। অবশ্যই শেষরক্ষা হয়নি। সরকারটা বদলে যাওয়া উচিত ছিল। সেটা হতে পারেনি। কিছু সীট কম পড়ল। কিন্তু আমার মনে হয় যে বিহার যে একটা বার্তা দিল সেটা গোটা দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগামী দিনগুলোতে, আগামী বছরের শুরুতে বিহারের পরে পশ্চিমবাংলা নির্বাচন, আসামে নির্বাচন, তামিলনাড়ু, কেরালা নির্বাচন। তো সমস্ত জায়গাতেই আমার মনে হয় বিজেপি একটা বিরাট বড় বিপদ এই মুহূর্তে দেশের গণতন্ত্রের জন্য, সংবিধানের জন্য, আইনের শাসনের বিরুদ্ধে… তো পশ্চিমবাংলাতেও একদিকে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আছে, তাদের যে গণতন্ত্রবিরোধী আচরণ, সে রাজ্যে পশ্চিমবাংলাতেও যে দুর্নীতির প্রশ্নগুলো আমাদের কাছে আছে, কিন্তু তবুও আমি বলব যে পশ্চিমবাংলাতেও বিজেপিকেই একনম্বর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে বামপন্থীদের অবশ্যই নিতে হবে। কারণ এরা… ত্রিপুরা বিজেপির হাতে চলে গিয়েছে, আসাম বিজেপির হাতে চলে গিয়েছে, বিহারে বিজেপিকে আবার বিজেপি ক্ষমতায় ফিরে এল, ঝাড়খণ্ড কোনওমতে বিজেপির থেকে কিছুটা অব্যাহতি পেয়েছে। তো পশ্চিমবাংলায়  বিজেপির যেভাবে দাপট বেড়ে উঠছে, লোকসভা নির্বাচনের পরে সেটা বাংলার মানুষ দেখছে। তো পশ্চিমবাংলার বুকে বামপন্থীরা বিহার থেকে উৎসাহ নিয়ে আরও বেশি করে তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে, শক্তিশালী হয়ে তাঁরা লড়াই করুন, এবং গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে, সাধারণ মানুষের লড়াইয়ের প্রতিনিধি হিসেবে বামপন্থীরা উঠে দাঁড়ান, এটা বিহারের মানুষও দেখতে চায়। তো যেরকম বিহার থেকে… বিহারকে বামপন্থীরা উৎসাহ দিয়েছে গোটা দেশের, তো এবার বিহারও চায় যে পশ্চিমবাংলা রুখে দাঁড়াক। এবং আরেকটা কথা হচ্ছে আজকে গোটা দেশে যেভাবে কেন্দ্র সরকার একটা বুলডোজার চালাচ্ছে - ভারতবর্ষের ফেডারাল স্ট্রাকচার, সেটা বিপন্ন। রাজ্যে রাজ্যে রাজ্য সরকারগুলো তাদের ক্ষমতা হারাচ্ছে। তো সেখানে পশ্চিমবাংলা, বিহার আমাদের যে পূর্ব ভারত, সেই পূর্ব ভারতের যে ফেডারাল রাইটস, আমার মনে হয় এটা একটা বড় প্রশ্ন, তো সেখানে বাংলার মানুষ, পশ্চিমবাংলা, বিহার, আসাম এসমস্ত রাজ্যের মানুষ একসাথে ঐক্যবদ্ধ ভাবে লড়াই করুন গণতন্ত্রের প্রশ্নে, সংবিধান রক্ষার প্রশ্নে, ভারতবর্ষের ফেডারিলিসমের প্রশ্নে, এবং খেটে খাওয়া মানুষের অধিকারের প্রশ্নে। এটা সময়ের দাবি। আমার মনে হয় বিহারের আন্দোলন, বিহারের নির্বাচন সেই বার্তা দিয়েছে। আমরা সেই বার্তা নিয়ে গোটা দেশে বামপন্থীরা এগিয়ে যাব, এটাই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। বামপন্থী আন্দোলন গণতন্ত্র রক্ষার চ্যাম্পিয়ন হিসেবে কাজ করুক।

 

 

বিহার নির্বাচনের পরে কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের বক্তব্য বাম এবং অফ্যাসিবাদী শিবিরে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।  দীপঙ্কর এতো সুসমঞ্জস ভাবে একদম সময়োপযোগী মূল বিষয় টিকে সামনে এনে হাজির করেছেন যা এতদিন বাম বলে পরিচিত মহলে অনেকটাই সংগুপ্ত ছিল।  তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক, কৌশলগত এবং প্রায়োগিক দিককে একদম পরিমিত ভাবে যে কৌশল কে বলা হয়েছে তা সমস্ত রকমের বিশ্লেষণের মূল সত্তাকে তুলে ধরেছে।  কমিউনিস্ট তথা বামপন্থী হিসেবে পরিলক্ষিত ঘটনা বা ফেনোমেনন কে উপলক্ষ করে মূল রাজনীতি এবং ভবিষ্যতের রণকৌশল কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির কাজ, দীপঙ্কর এবং সি পি আই (এম এল) সেটিই করতে চাইছেন। 

দীপঙ্করের একটা মন্তব্য  কিন্তু একদিকে বুর্জোয়া  ফ্যাসিবাদী ক্ষমতালোলুপ দল গুলোর মধ্যে ঈর্ষা এবং তজ্জনিত হতাশার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে, তারা তাদের স্বভাবসিদ্ধ কায়দায় শুধুই গাজোয়ারি assertion  দিয়ে সামাজিক মাধ্যমগুলো ভরেছেন , অন্যদিকে ‘আগুনখোরদের’ মধ্যেও তা ঈর্ষা, হতাশা এবং অভিমানের কদর্য বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। প্রতিষ্ঠিত বাম দলগুলো যেমন অকিঞ্চিৎকর হয়ে পড়ছে এবং তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখবার একটা পথ দীপঙ্কর ও তেজস্বী তাদের জোটের মাধ্যমে করে দিয়েছেন সেটা হজম করে মেনে নিতে গিয়ে অনেকটাই বদহজম এর পরিণত হচ্ছে। যাদের একমাত্র মঞ্জিল বিধানসভা সেখানে তাদের এবার বিরোধী এবং বাম শিবিরে মালের নেতৃত্বেই চলতে হবে এই হিসেব, যা  কিছুতেই একসময়ের ডন দের গায়ে সইছে না। তাই তারা কংগ্রেসের মধ্যে ইতিবাচক দিক খুঁজে পাচ্ছে আর অন্য বাম শক্তিগুলোকে চেপে রাখতে চাইছে , মানুষ কিন্তু কংগ্রেসের প্রয়োজনিয়তাকে আর গুরুত্ব দিতে নারাজ।

জোট যে একটা স্থায়ী কাঠামোর দিকে এগোতে শুরু করেছে এবং তার মধ্যে ওনাদের উপস্থিতিটি একেবারেই ক্ষুদ্রতম তরফের হয়ে যাচ্ছে সেটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে এককালীন বাবুদের।  সিপিআই অনেকটাই নম্র , একদম নিচে থেকে শুরু করতে প্রস্তুত কারণ সিপিআই তবুও অনেকটাই তত্ত্ব ও রাজনীতির চর্চা করে চলে , তাই কানহাইয়া কে এখনো তেজস্বী সহ অনেকেই অন্যতম মুখ হিসেবে দেখতে রাজি। কানহাইয়া যে দেশে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ সেটা মালে প্রতিষ্ঠা করে চলেছে নিজেদের সংগঠনের মধ্যেও, এটা  অত্যন্ত ইতিবাচক দিক। 

উল্টো দিকে "প্রকৃত" বিপ্লবী, দল এবং শ্রেণী খুঁজতে যাওয়া আগুনখোর রা পোকিত [poqitoঅর্থাৎ ক্ষুদ্র] হতে হতে বিলীয়মানদের  রেজিস্টার এর দৈৰ্ঘ্য  বাড়িয়ে চলেছেন।  ইতিহাস এর বিচারে তাঁদের এই পোকিত  বা poqito হওয়া  আমরা শুধু একটি ক্ষেত্রে [চীন] ছাড়া প্রত্যেকটি বিপ্লবী উদাহরণে দেখেছি, প্রত্যেকটি বিপ্লবে মানুষের জনসমাবেশ কোনো একটি প্রকৃত/পোকিত  দলের চালনায় হয় নি, পরিচালনায়  নিশ্চয় সেই কমিউনিস্ট পার্টিগুলোই ছিল কিন্তু চালনা  করেছে একধরণের জোট শক্তি তা সে পারী কমুনে থেকে রুশ বিপ্লব [RSDLP র নেতৃত্বে] এবং ভিয়েতনাম বা কুবা  যাই হোক না কেন কমিউনিস্ট পার্টি কিন্তু একটা জোট পার্টি কে সামনে রেখেই এগিয়েছিল।  RSDLP  আমাদের শিক্ষক, কারণ অনেক বিবদমান গোষ্ঠী এবং এমনকি পরস্পরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা গোষ্ঠী গুলো ও এক সাথে হেঁটেছিলো বিপ্লব এবং আন্দোলনের জন্যে।  সেখানে শুদ্ধতা বা "প্রকৃত" খুঁজতে গিয়ে পোকিত  হয়ে পড়ার আগেই বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল।  প্রকৃত থেকে পোকিত  র এই পরিব্রজন  আসলে বূর্জোয়া  উদারবাদীদের ফ্যাসিবাদ এর দিকে সমাজ ও রাজনীতিকে ধাবিত করার যে প্রকরণ সেটা বিশ্বের কমিউনিস্ট রা অনুধাবন করতে পারলেও ভারতীয় রা করি না , কারণ আমাদের সমাজে বেঁচে ওঠা এবং জ্ঞান আহরণের পথে প্রায়োগিক দিকের থেকে তত্ত্ব বানানোর [তথ্য থেকে সত্যি শুধু না, তত্ত্ব ও বটে] পদ্ধতির বদলে আমরা জোর দিয়েছি দর্শানো বা দর্শনধারী "আর্য " উন্মেষিত বচনের ওপর।   আমরা অন্তঃসত্ত্বা কে একমাত্র সত্য এবং "বাহ্য জগৎ মিথ্যা" এই ধরণের চিন্তা থেকেই আমরা প্রায়োগিক-বৈদগ্ধ বা praxis  এর পদ্ধতি কে ব্রাত্য করে রেখেছি।

যাই হোক , রাজনৈতিক বিষয় তা গুরুত্ব  দিয়ে ভাবা যাক।  জোট হয়েছিল ভোটের লক্ষে , কিন্তু ব্যাপক জনসমর্থন জোটকে potent force  [মার্ক্সের লবজে ] দাঁড় করালো  , মানুষ সবজায়গাতেই যুগপৎ সবুজ এবং লাল ঝান্ডা নিয়ে পথে নেমে পড়লো, নির্বাচনের সমাবেশ গুলো হয়ে উঠলো স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল এবং মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মঞ্চ।  মানুষই এটাকে একটা কাঠামোহীন মোর্চা বানিয়ে ফেললেন।  "জয় ভীম লাল সালাম" দিল্লী, হায়দরাবাদ এর ছাত্র রা শুরু করেছিলেন , তাঁরা "আজাদী" স্লোগান কে চালু করিয়েছিলেন , কিন্তু বিহারের নির্বাচনে গাঁয়ে গাঁয়ে , প্রতিটি মিছিলে মানুষ তাকে পোটেন্ট  ফোর্স হিসেবে রূপ দিলেন।  ভারতের আন্দোলনের তথা রাজনৈতিক ইতিহাসে এটা  একটা মুহূর্ত তো বটেই। 

বৈচিত্র্যের এই ভারতে যেখানে অগ্নিযুগ, স্বাধীনতা আন্দোলন বা বাম সশস্ত্র  আন্দোলনগুলো পরিপূর্ণ ভাবে ধর্মীয়-নিপীড়িত, [সংখ্যালঘু বলে নয় শুধু], জাতিগত ব্রাত্য বা মার্জিনালাইজেড অংশ , নারীদের  নেতৃত্বে পেলাম না, [গোষ্ঠীগত ভাবে তো নয়ই]।  আমরা ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনগুলোকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে  পরিণত করতে পারলাম না [আজকের আমাদের অসমাপ্ত গণতান্ত্রিক বিপ্লব কিন্তু এই একটিমাত্র কারণেই বিপ্লবীদের কাছে অধরা রয়েই  গেলো], শুধুমাত্র জোট গড়ার লক্ষ্যকে অপ্রধানের নামে একেবারে গুরুত্বহীন করার প্রক্রিয়াতেই এই নতিজা।  তেভাগা তেলেঙ্গানাতে তো কমিউনিস্ট পার্টি কাউকে ধরে কাছে ঘেঁষতেই দিলো না , আর নকশালবাড়ি আন্দোলনে বামবিতর্ক  কে সমাজের সব অংশের বিতর্কে পরিণত করা হল।  নকশালবাড়ি আন্দোলন তখন উত্তরপূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহগুলোকে মৌখিক স্বীকৃতি দিলেও দলিত বা আদিবাসীদের মধ্যে সহমর্মী যৌথ মঞ্চ গড়ে তুললো না।  বামবিতর্ক  এক বিস্তৃত সমাজবিতর্কের বাতাবরণ খুলে দিতেই পারতো, সমস্ত সমাজে "আন্তর্জাতিক মহা বিতর্ক" কেই প্রতর্ক  হিসেবে খাড়া করলো।  মানুষ যখন শুনতে আর অনুসরণ করতে রাজি তখন বিপ্লবী রা সঠিক ভাবেই মতাদর্শগত বিতর্ক কে সামনে নিয়ে এলেন কিন্তু সমাজে সেই বিতর্কের সম্পূরক কোনো ডিসকোর্স বা প্রতর্ক  খাড়া করতে পারলেন না , চেষ্টাই করলেন না। একধাপে একেবারে চূড়ান্ত সমাজতন্ত্র গোড়ার অভীপ্সা একেবারে প্রকৃত থেকে pokito/ পোকিততে নিয়ে গেলো।  বিহারে ভোজপুর থেকে শুরু করতে হলো আবার সেই মতাদর্শগত লড়াইয়ের প্রায়োগিক প্রক্রিয়া, যা শুরু করতেই হলো সশস্ত্র সংগ্রাম দিয়ে , কিন্তু ডিগনিটি , অস্মিতা এবং মেহনতের ইজ্জত এর লড়াই নকশালবাড়ি আন্দোলনে এক নতুন ধারা আনলো।  দলিতের সামাজিক ন্যায়ের দাবি তাদের আর্থিক ন্যায়ের দাবির সঙ্গে মেলানোর পথ ধরলো, ধরালো কমিউনিস্ট পার্টি।  আজকে এতো দিন পরে দিল্লী , অন্ধ্র , বিন্ধ্যাচল , জঙ্গলমহলের অনেক ছোট ছোট সাফল্য এবং বড়ো  বড়ো  অসাফল্যর অভিজ্ঞতায় এখন তেজস্বীকেও এই পথের কথা বলতে হচ্ছে।  তেজস্বী থেকে জিগনেশ ,উমর থেকে কানহাইয়া, চন্দ্রু  থেকে রোহিত হয়ে আজ   মনোজ মঞ্জিল , সন্দীপ  সৌরভ কে দাঁড় করিয়ে দিলো।  ডিগনিটি এবং ডেভেলপমেন্ট এখন সমন্বিত হয়ে ডেমোক্রেসি বা গণতন্ত্রের নতুন সংজ্ঞা অর্থাৎ জনমানুষের সংজ্ঞা তে রূপায়িত হয়েছে।  এটাই বিহার নির্বাচনের রাজনৈতিক শিক্ষা।  ফ্যাসিবাদ যেখানে ক্ষমতায় সেখানে গণতান্ত্রিক শক্তি যারা ক্ষমতার বাইরে তারা পথ হাঁটতে হাঁটতেই অনেকটা মানুষের গণতন্ত্রের দাবিগুলো আদায়ের পথে নামতে বাধ্য হয়। 

মার্কস বলেছিলেন আদর্শ এবং কর্মসূচি যখন মানুষ নিজের বলে গ্রহণ করে তখন তা পোটেন্ট  ফোর্স হয়. বিহারে স্লোগান এবং "পার্টি আমার " এই স্পিরিট এখন পেটেন্ট ফোর্স ["তিন তারা ঝান্ডা/ নিশানওয়া  হামারবা "- এটা  ব্যাপক মানুষের নিজের ভাষায় assertion , ব্যক্তির নয় সমন্বয় এর] এটাই ঠিক করে দিলো বাম মহলে কে পার্টি আর সমাজে বামদের অবস্থান কিভাবে নেতৃত্ব নিতে পারে। ফ্যাসিবাদীরা একেবারে যথার্থই চিহ্নিত করতেপেরেছে শত্রু কে - [সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলের জমিদারের বেটা  নাড্ডা একেবারে কোমর বেঁধে নেমে ভোট কারচুপি করলো আমলাকুল কে দিয়ে - খুবই স্বাভাবিক এবং "প্রত্যাশাব্যঞ্জক"] .

জোট ছাড়া প্রকৃত খোঁজা একধরণের উদারবাদ, ঠিক উল্টো লবজে , অর্থাৎ আগুনে ধোঁয়ায় উদারবাদ যা মানুষকে সমন্বিত হতে বাধা দেয়  এবং এই প্রক্রিয়াতেই তা ফ্যাসিবাদ কে সাহায্য করে।  উদারবাদ এখানে একই ব্রাকেটে স্বৈরাচার আর অধিষ্ঠিত ফ্যাসিবাদ কে রাখে যাতে লড়াইয়ে কেন্দ্রীয় বর্ষমুখ দিশাহীন হয়ে যায় , শুধু তাই নয়, এর মধ্যে দিয়ে উদারবাদ ফ্যাসিবাদের একটা নিষ্ক্রমণ পথ বা এক্সিট রুট  তৈরী করে , আজ জেক তেজস্বী "চোর দরওয়াজা " বলছে সেটা কিন্তু বাম আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক গণ-আন্দোলনেও খুব প্রকট।  অধো-প্রধান [অপ্ৰধান  নয়] স্বৈরাচার কে প্রধান শত্রুর সঙ্গে এক আসনে বসলে প্রধান শক্তি কে যে কিছুটা আড়াল করা হয় , সেটা বিহার প্রমান করে দেখালো।  চৌ স্বৈরাচারী ছিলেন , জাপ সাম্রাজ্যবাদএর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাঁকে নামিয়ে, কিছুটা হয়তো জাতীয়তাবাদী চিত্রিত করেও চেয়ারম্যান মাও  চীন থেকে জাপান কে তাড়ালেন এবং পরিশেষে কুওমিনটাং  কেও দেশছাড়া করলেন।  এই ধারা তো কেরেন্সকির ক্ষেত্রে আমরা তারও আগেই দেখি।  ল্যাটিন আমেরিকা তে অনেক বারই দেখেছি, আজ ইউরোপের গণআন্দোলন গুলোতে দেখছি।  এগোতে হলে ছোট তরফ কে পিটিয়ে বড়ো  তরফ কে বাড়ি থেকে তাড়ানো যায় না, উল্টো টাই  করতে হয়. এই মুহূর্তে বাংলায় স্বৈরাচার জনগণের ঠিক যেই অংশটি কে নিয়ে বামপন্থা কেই অপাঙেতেও করে দিচ্ছে, তার কাছে থেকে মানুষের সেই অংশ কে নিজের দিকে ঘোরাতে হবে এবং সেটা রাজনৌতিক এবং মতাদর্শগত প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়েই। একটা বড়ো  অংশ আবার হতাশায় ভুগে ফ্যাসিবাদের কোলে গিয়ে পড়ছে , মনে করছে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্যে নাকি কোনো স্বাবলীল নেতা বা ন্যাচারাল লিডার গড়ে ওঠেনি, এই আগে তাদের হাত ধরে তবে নিজের রাজ্যের স্বৈরাচার কে সরাতে হবে অর্থাৎ নেকড়ে কে তাড়াতে আমাকে বাঘের সঙ্গে ঘর করতে হবে ? বাঘ ঘর করবে তো ? এই রকম ভয়ঙ্কর রণকৌশল তো ইউরোকমুনিজম  এর সময়তেও কেউ ভাবতেও পারে নি, জার্মান SDLP  তও ভাবতেও সাহস করে নি।  সুতরাং আর কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না।  এই পুরো মানসিকতা হচ্ছে "আমি সবার থেকে বুদ্ধিমান আর অবশ্যই জনগণ থেকে বেশি বুদ্ধিমান " , "রাজনীতি মানেই কূটকৌশল" - ঠিক এই মানসিকতা থেকে বুর্জুয়া রা জনহিতকর কাজ কে রাজনৈতিক কাজের বাইরে রাখার কথা আওড়ায় আর রাজনীতিকে "নোংরা" হিসেবে আখ্যায়িত করে , এটা  আসে মানুষ কে সমাজ বিচ্ছিন্ন করে ইন্ডিভিজুয়াল হিসেবে দাঁড় করানোর এক বুর্জুয়া চিন্তা থেকে।  তা সে যাই হোক বামমনস্ক বলে যাঁরা নিজেদের দিকে ঝোল টানতে চেষ্টা করেন , তারা আবার উল্টো দিকে কর্মকৌশল কে রননীতি এবং মতাদর্শগত অবস্থান থেকে নির্লিপ্ত রাখতে চায়।  তারা দেখায় যে কর্মকৌশলগত তাগিদে অনেক কিছুই করা যায় যা রণনীতি বা মতাদর্শের  অধীনস্ত হবে এটাই প্রাগমাটিসম বা প্রয়োগবাদ।  তাই রণনীতির ধার না ধরে কংগ্রেস এর সঙ্গে জোট বানানোই যায় আবার একেবারে মাঠপর্যায়ে বুথে বুথে বিজেপির সঙ্গে টেবিল ভাগ করাই  যায়। এটাকেই কিন্তু অমিত শাহ উল্লেখ করেছে বাংলায় এসে। এখানেই কিন্তু বিভাজনরেখা বা ফল্টলাইন টেনেছেন দীপঙ্কর।

রাজ্য এর প্রয়োজন বা প্রেক্ষিত কেন্দ্রীয় প্রেক্ষিত থেকে আলাদা হতেই পারে , কিন্তু তা কখনোই কেন্দ্রীয় বা দেশের দাবি বা প্রধান স্লোগান থেকে  বা প্রধান প্রয়োজনের বিপরীতে দাঁড়াতে পারে না।  কমুনিস্টরা সব সময়েই দেশের ঐক্যের প্রয়োজনকেই সম্মান ও গুরুত্ব দেয়, খুব বড় কিছু না হলে দেশ ভাঙার দাবি করে না। ভারতের ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে কখনই সে কোনো ভাবেই ফ্যাসিবাদী  শক্তিকে কোনো রাজ্যে কোনো রকম ছাড় দেবে না বা তাকে অপ্রধান হিসেবে দেখবে না বা, অন্য কোনো শক্তিকে প্রধানশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করবে না, বা এমনকি প্রধান শত্রুর অবস্থান কে অন্য কারো সঙ্গে ভাগ করবে না। ঠিক এইখানেই দীপঙ্কর বলেছেন যে বাংলায় বামেরা আঞ্চলিক আর দেশীয় বিষয়কে গুলিযে  ফেলেছে।

বিহার নির্বাচনের বোধহয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট হচ্ছে যে নির্বাচনের প্রয়োজনে যে "জোট" তৈরি হয়েছিল তা কিন্তু নির্বাচনের পরে আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো।  এখনো AIMIM এর মত  শক্তিকে approach  করার বা তাঁদেরও এই জোটভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।  অর্থাৎ নিকট ভবিষ্যতে জোটের গঠন, তার বর্ধন, তার প্রয়োজনীয়তা বাড়বে বই কমবে না। ভাবতে বাম রাজনীতির রণকৌশল নিশ্চিত ভাবেই এক সমৃদ্ধতর ধারায় প্রভাবিত হতে চলেছে।