নাৎসী জমানার দিনকাল : গুন্টার গ্রাসের আখ্যান বেড়াল ও ইঁদুর

১. ধুলো বালি জমে স্মৃতির শহরে

উত্তর পোল্যান্ডের একটি শহর। নিতান্তই সাধারণ মধ্যবিত্তের বাস। ক্রমশ বাতাস ভারি হচ্ছে যুদ্ধের গন্ধে।  শৈশব শেষ হয়ে কৈশোর ছুঁই ছুঁই দিনগুলোয় তাদের কৌতূহল, জীবনকে আবিষ্কারের আনন্দ, সদ্য জেগে ওঠা যৌন চেতনা সব কেমন ভেসে যাচ্ছে এক তীব্র অযৌক্তিক আবেগে...দেশপ্রেম নাম দিয়ে যা মাতিয়ে তুলছে তাদের নিষ্ঠুর হত্যালীলায়... গুন্টার গ্রাসের ডানৎসিগ ত্রয়ীর  দ্বিতীয় উপন্যাস 'ক্যাট অ্যান্ড মাউস' । ১৯৫৯ এ 'টিন ড্রাম' প্রকাশের পর ১৯৬১ তে আবার ফিরে দেখলেন তাঁর ফেলে আসা সময়কে, দেখালেন গোটা বিশ্বের পাঠককে তরুণ প্রজন্মকে কীভাবে গ্রাস করে নিচ্ছে নাৎসি মৌলবাদ । পিলেনৎস নামে এক বন্ধু লিখল মালকের গল্প...তার স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের কাহিনী , যেখানে পিলেনৎস নিজেকে কিছুটা দায়ী করলেও পাঠক বোঝে সে দায় যতটুকু ব্যক্তির তার চেয়ে অধিক রাষ্ট্রের, সেই নিষ্ঠুরতা ক্ষমতার। দেশ, কালের সীমানা পেরিয়ে যা আজও তাড়িয়ে বেড়ায় যুবসমাজকে এক চরম নৈরাজ্যের পথে, ঠেলে দেয় ধ্বংসের মুখে। মালক যেদিন প্রথম সাঁতার শিখল সেদিনের ঘটনার উল্লেখে শুরু আমাদের গল্প।ওরা শুয়েছিল ঘাসের উপর। পিলেনৎস দাঁতের ব্যথা উপেক্ষা করে বন্ধুদের অনুরোধে। ও চলে গেলে ম্যাচ জেতা হবে না।কেয়ারটেকারের কালো বিড়ালটা মাঠের উপর হেঁটে বেড়াচ্ছিল অথচ কেউ কিচ্ছু ছুঁড়ে মারল না তাকে। কয়েকজন ছেলে ঘাসের শীষ মুখে পুরে চিবচ্ছিল, কেউ শুধুই ছিঁড়ে ফেলছিল...অলস সময়। মালক ঘুমিয়ে পড়েছিল। সেই সময় একটি বিমান চক্কর কাটছিল আকাশে ; ধীরে কিন্তু সশব্দে। কালো বিড়ালটি মালকের স্পষ্ট হয়ে থাকা দীর্ঘ কন্ঠনালীর সচলতায় তাকে ইঁদুর ভেবে নেয়...শুরু হয় ইঁদুর বিড়াল খেলা। মালক ঘুমিয়ে থাকে। ঘুমিয়ে থাকি আমরাও। অথচ  অজান্তেই এমন ক্ষমতা ও ক্ষমতাহীনের নিশ্চিত হারের খেলায় জড়িয়ে পড়ি‌। শিকারী ও শিকার... নিয়ত পালাবদল হয়।

 গল্প শুরুতে আমাদের সামনে এক মায়া জগতের ছবি আঁকতে চায়। যে ঘোরে আমরাও ভুলে থাকি সময়কে।উপেক্ষা করি তার অসহনীয়তাকে।

...যেন সব ঠিক আছে। ছেলেদের স্কুল... তাদের আধ ডোবা জাহাজ (মাইন সুইপার যা শত্রুপক্ষের লুকিয়ে রাখা মাইন খুঁজে বের করার কাজ করে) থেকে তুলে আনা আশ্চর্য সব জিনিসপত্র...সেই আধডোবা জাহাজেই নিজস্ব একটা জায়গা খুঁজে পায় মালক। জল প্রবেশ করে না সেখানে।মালক তার চিলেকোঠার বস্তুসামগ্রীর কিছু কিছু সেখানে এনে রাখে। তৈরি করে নিতে চায় নিজস্ব জগৎ। লোকচক্ষুর অন্তরালে। জাহাজ থেকে তুলে আনা স্ক্রু ড্রাইভার আর ভার্জিন মেরীর লকেট গলায় ঝুলিয়ে রাখা মালক বড় হয়ে কি না ক্লাউন হতে চায় !

" I'm going to be a clown and make people laugh, no one laughed in the classroom...and I myself was frightened."

বন্ধু ক্লাউন হতে চাইলে গোটা ক্লাসে কেউ হেসে ওঠে না কেন? কেন ভয় পেয়ে যায় পিলেনৎস? তবে কি মালকের শারীরিক বিশেষত্ব যা বন্ধুদের ঠাট্টা তামাশায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার কাছে (কন্ঠনালীকে ইঁদুর বলে বিড়ালকে এগিয়ে দেওয়া) তা কোথাও অপরাধবোধের জন্ম দেয়। তাছাড়া কে না জানে মঞ্চে ক্লাউন দর্শককে হাসালেও তার অদ্ভুত কার্যকলাপ জীবনের বেখাপ্পা, বেমানান দিকগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়... কখনও জাগিয়ে তোলে ঘুমিয়ে থাকা বিবেককে। আমাদের গল্প শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পরে পরেই তখন মালক  চোদ্দ বছরে পড়েছে... কয়েকদিন পরেই সে Hitler Youth' এ যোগ দেয়...

... which embraced the whole male population from fourteen to twenty...he made himself useful in the " special activities "

 লেখক স্বয়ং সতেরো বছর বয়সে যোগ দেন নাৎসি বাহিনীতে। অকপটে স্বীকার করেছেন দলের মতাদর্শে তাঁর বিশ্বাসের কথা। সবসময় মাথায় ঘুরত তাঁদের মাতৃভূমি বিপদগ্রস্ত...তাই এই ধ্বংসলীলা জরুরি। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মালক চিঠি লিখত।তার নিচে আঁকা থাকত ছবি।এমন একটি চিঠিতে সে লেখে...

"You can't imagine how run down everything is here, how wretched the people are and all the many children. No electricity or running water. Sometimes I begin to wonder what it's all for, but I suppose it has to be..."

উপন্যাসের পাতায় যুদ্ধের গন্ধ...পিলেনৎসের দাদা যুদ্ধে মারা যাওয়ার পর তার ছবির পাশে তার মেডেল, ভায়োলিন, স্বরলিপি লেখা পাতা সব সাজানো...

'' I felt at the time was mostly jealousy on account of that altar ; I visualized my own enlarged photo thus framed in black."

রণক্ষেত্রে মৃত্যু হল না তার...তাকে বেঁচে থাকতেই হল মালকের গল্প বলতে। হয়ত তার ব্যবহারেই প্রথম মালকের মনে দেহের গঠনগত ত্রুটিকে নিয়ে অস্বস্তি জাগে তার সেটাকে ঢাকতেই যাবতীয় ঘটনা পরম্পরায় জড়িয়ে পরে সে। এমনকি জলের নিচে তার নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও নিজের দায় এড়িয়ে যেতে পারে না পিলেনৎস। মালকের এই পরিণতি তাকে অস্থির করে তোলে...

 ফাদার আলবেন তাকে গল্প লেখায় উৎসাহ দিলেন।

২. কোন অতলের হাতছানি

মালক ক্রমশ আড়াল করতে চায় নিজের কন্ঠনালী। এটি যেন তাকে আলাদা করে রাখে অন্যদের থেকে। দৈহিক ত্রুটি কখন যেন মনকেও গ্রাস করে নেয়।সে এমন কিছু করতে চায় যাতে সকলের মনোযোগ ওর কন্ঠনালীকে ছাপিয়ে সেই দিকে আকৃষ্ট হয়। স্কুলে ভাষণ দিতে আসা সেনা অফিসারের মূল্যবান আয়রন ক্রশ চুরি করে মালক। পরে অপরাধ স্বীকার করে নেয় সে। স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয় তাকে । অন্য স্কুলে ভর্তি হয় মালক। অল্পদিনের মধ্যেই নাৎসি জার্মানির এক বিশেষ বিভাগে যোগ দিয়ে যুদ্ধে সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ অর্জন করে আয়রন ক্রস। ফিরে আসে পুরোনো স্কুলে। নিজের কৃতিত্বের কথা বর্তমান ছাত্রদের জানাতে চায় সে‌। কিন্তু প্রিন্সিপাল সম্মতি দেন না। বর্তমান সম্মান অতীত অপরাধকে মুছে দেয়না...আশাহত, অপমানিত মালক ফিরে আসে...

" As a soldier,Mahlke, you ought to realize. No, the cleaning women were scrubbing the benches for no particular reason, not for you, not for your lecture. Your plan may have been excellently conceived, but it can not be executed. Remember this Mahlke : There are many mortals who love expensive carpets but are condemned to die on plain floorboards. You must learn renunciation, Mahlke."

জীবন ক্রমশ জটিল এক গোলকধাঁধায় পরিণত হয়।

মালক এই অপমানের শোধ নিতে চায়। এক বিকেলে পিলেনৎসকে সঙ্গে নিয়ে প্রিন্সিপালকে সপাটে থাপ্পর মেরে আসে। তখন বিকেল গড়িয়ে আসছে। গাছগুলোর গায়ে বাসা বাঁধছে আঁধার। মালক আশ্চর্য রকম শান্ত হয়ে যায়। বন্ধু পিলেনৎসকে সে জীবন ও সময়কে বুঝতে কিয়ের্কেগাদ ও দস্তয়েভস্কি পড়তে বলে । মালক নিজেও হয়ত তার সময় ও সংকটকে বুঝতে চাইছিল...

তার বৃহৎ কন্ঠনালী, ভার্জিন মেরীর প্রতি তীব্র আসক্তি আর পুরোনো স্কুল থেকে বহিষ্কারের ঘটনাই মালকের জীবন নিয়ন্ত্রণ করেছে। নিঃসঙ্গ করেছে । নিরাসক্ত করে তুলেছে জীবনের স্বাভাবিক দাবির প্রতি। নিজেকে প্রমাণ করে ভুলতে চেয়েছে অপমানিত অধ্যায়...

অবশেষে আশ্রয় নিতে চেয়েছে নিজের মধ্যেই...ডুবন্ত মাইনসুইপারে তার একান্ত আপনার জগৎ...সে আর ভার্জিন মেরী ,তার আশ্রয়  ,অনুরাগ। আবার যেন ফিরে যেতে চাওয়া মাতৃগর্ভের পরম নির্ভরতায়। ভেসে থাকা জলের নিরাপদ ঘেরাটোপে...তা কি পুনর্জন্মের আকাঙ্ক্ষায়? সে জানতে চেয়েছিল,

"Is there life after death? Do you believe in transmigration?"

পিলেনৎস তাকে খুঁজতে থাকে বাইরের পৃথিবীতে। পায় না। হারিয়ে গিয়েও তার সঙ্গে থেকে যায় মালক... একদিন ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে তার ঈশ্বরের প্রতি অবিশ্বাস, ভার্জিন মেরীর প্রতি একমাত্র বিশ্বাসের তীব্র ঘোষণা পিলেনৎস ভুলতে পারে না। পরে যখন কোনো ব্রিজ পার হতে যায় সে ; নিচে শুনতে পায় জলের শব্দ, উপর থেকে ছুঁড়ে ফেলা আবর্জনায় ধাক্কা খেয়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে যখন তারা , মালক এসে দাঁড়ায় তার পাশে। এক গম্ভীর ক্লাউন। চিরকালীন ইঁদুর বিড়াল যুদ্ধের উর্দ্ধে উঠে তার অটুট বিশ্বাসে বলে চলেছে তার বিশ্বাস, অবিশ্বাস ।

 গুন্টার গ্রাস এক চিঠিতে লিখেছেন মালকের এই গল্পে তিনি পাঠকের সামনে হাজির করেছেন  চার্চ, স্কুল, বীরত্ব এবং সমকালীন গোটা সমাজের প্রকৃত চেহারা।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, নাৎসি জার্মানি তার ধ্বংসলীলা, তার কৈশোর পেরোনো নাগরিকদের জীবন, সংকট ,সংশয়...পাঠক ক্ষণিক স্তব্ধ হয়‌। বিড়াল আর ইঁদুরের এই লড়াই বাইরের লড়াই থাকে না। ব্যক্তি আটকে পড়ে তার ভিতরে। একসময় যে মালক ইঁদুর এবং কখনও পিলেনৎস , কখনও তার প্রিন্সিপাল, কখনও সমাজ বিড়ালের ভূমিকা নেয় ; সেই মালক নিজেই বিড়াল হয়ে ওঠে... প্রচ্ছদের সাদা কালো বিড়াল তার প্রমাণ। এই ছবি ছড়িয়ে আছে গোটা উপন্যাস জুড়ে। পিলেনৎস তার গল্প বলার শৈলিতে কখনও মুগ্ধ করে পাঠককে আবার কখনও বিরক্ত। কেননা অসংখ্য অসঙ্গতি এবং সর্বনাম ব্যবহারের ধারাবাহিকতা বিঘ্নিত হলে পাঠক দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে... ফিরতে হয় পুনর্পাঠে। মালক হারিয়ে যায় যুদ্ধের প্রায় শেষদিকে। তাই যুদ্ধকালীন প্রেক্ষাপট আঁকা হয় তাকে ঘিরে আর যুদ্ধ পরবর্তী অনুতপ্ত ,নিন্দার্হ দেশ পিলেনৎস...

সে খুঁজতে থাকে মালককে, তার গল্পের সমাপ্তি:

" Who will supply me with a good ending?"

এর উত্তর একমাত্র অনন্ত সময়ের হাতে...

তথ্য ঋণ:

1. Cat and Mouse : Gunter Grass , translated from the German by Ralph Manheim

2. The Narrative Works of Gunter Grass : Noel Thomas