গুন্টার গ্রাসের টিন ড্রাম ও নাজি জার্মানীর দিনকাল
- 16 October, 2022
- লেখক: সৌভিক ঘোষাল
হেনরিক হাইনে ১৮২৭ সালে প্রকাশিত তাঁর আইডিয়াজ [Ideen: das Buch le Grand] নামের বইটিতে ড্রাম এর প্রসঙ্গ এনেছিলেন বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে। ১৯৫৯ এ গুন্টার গ্রাসের টিন ড্রাম [Die Blechtrommel] উপন্যাসে আরেকবার ড্রাম উঠে এল জার্মান সাহিত্যের কেন্দ্রবিন্দুতে। হাইনের আইডিয়াজ বইটি ছিল ফরাসী বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে লেখা। গ্রাসের ‘টিন ড্রাম’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিনকালে। আইডিয়াজ এ নেপোলিয়ানকে দেখি তিনি আক্ষেপোক্তি করছেন তার ছয় লক্ষ সেনা রাশিয়ার ঠান্ডায় কসাকদের কাছে হেরে গেল বলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তথা গুন্টার গ্রাসের এই উপন্যাসে দাপিয়ে বেড়ানো পরাক্রান্ত নাজি বাহিনীও শেষপর্যন্ত পরাস্ত হয় রাশিয়ার কাছে। আর পাঠক জানেন এই যুদ্ধেরও অন্যতম নির্ধারক ছিল রাশিয়ার সেই কালান্তক ঠান্ডা।
গুন্টার গ্রাসের ‘টিন ড্রাম’ উপন্যাসটি ইতিহাসের সবচেয়ে আলোড়ন তোলা পর্বগুলির একটি নিয়ে রচিত। কিন্তু বাইরের বড় বড় ঘটনা এর মূল বিষয়বস্তু নয়। সেই সব বড় ঘটনার অভিঘাতে কীভাবে জীবন, সমাজ, পরিবার, শহর বদলে যাচ্ছে তার অন্তরঙ্গ ভাষ্য তুলে ধরে ‘টিন ড্রাম’। ডানজিগ এমন এক শহর যেখানে কাশুভিয়ানরা ছিল, ছিল পোলরা এবং জার্মানরা। সেই বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক সামাজিক বিন্যাসটা নাজি জমানায় কীভাবে ছাড়খার হয়ে গেল এই উপন্যাস তার এক মর্মান্তিক ছবি রয়েছে। ইহুদী নির্যাতন ও হত্যা তথা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের ভয়াবহতা পোল্যান্ড ও ডানজিগের এই পর্বের ইতিহাসের এক ভয়াবহ বাস্তবতা। কিন্তু সেই ভয়াবহতাকে দু একটি অধ্যায়ে দু একটি প্রেক্ষিতে কেবল আভাসিত করা হয়েছে৷ মার্কুসের দোকান ভাঙচুর ও তার আত্মহত্যা এরকম একটি দৃশ্যপট তৈরি করেছে৷ আর একটি উল্লেখ রয়েছে ডানজিগ থেকে যখন মারিয়া চলে যাচ্ছে অস্কার আর কুর্টকে নিয়ে। বলা হয়েছে যে ট্রেনে তারা যাচ্ছে একদা সেই ট্রেনেই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে লোক পাঠানো হত।
একদিকে সাম্রাজ্যবাদ ও অন্যদিকে ফ্যাসিবাদ - নাজিবাদ এবং এই দুই যুদ্ধমান শিবিরেরই সাধারণ শত্রু সোভিয়েত সমাজতন্ত্র বিশ শতকের প্রথমার্ধ জুড়ে পরস্পরের যে মহড়া নিয়েছে, তার সবচেয়ে মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক পরিণতি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। প্রায় আট কোটি লোক এই যুদ্ধে মারা যায়। আহত, পরিবার স্বজন হারানো, নানাভাবে বিধ্বস্ত মানুষের সংখ্যা ছিল অগণিত। বিশ্বযুদ্ধের এই ভয়াবহতাকে বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বের নানা শিল্পমাধ্যম, বিশেষ করে সাহিত্য ও সিনেমা নানাভাবে বিশ্লেষণ করেছে। যুদ্ধোত্তর ইতালিতে গড়ে উঠেছিল সিনেমার এক নতুন ধারা। সেই নিও রিয়ালিজম গোটা বিশ্বের সিনেমার ইতিহাসকেই বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছে। যুদ্ধের মাঝে দাঁড়িয়েই চ্যাপলিন তৈরি করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত ছবি ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’। যুদ্ধ শেষ হবার দু বছরের মাথায় ১৯৪৭ সালে ফরাসী ভাষায় আলবেয়ার কাম্যু লিখলেন তাঁর ক্লাসিক আখ্যান মারী (দ্য প্লেগ)।
হিটলারের নাজি জার্মানী ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে বড় কারণ এবং যুদ্ধে সববৃহৎ ক্ষয়ক্ষতি যাদের হয়েছিল জার্মানী ছিল তার অন্যতম। ১৯৩৩ এ হিটলারের ক্ষমতা দখলের পর থেকেই জার্মানীর ভেতরে নাজিবিরোধী, ইহুদী, অশক্ত, ভিন্ন যৌনতার মানুষজনের ওপর মারাত্মক আঘাত নেমে আসে। পোল্যান্ড সহ নানা দেশের ইহুদীরা জার্মান আগ্রাসনের পর মারা যায় দলে দলে। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা ছিল কম করেও অর্ধ কোটির কাছাকাছি। জার্মানী যুদ্ধ শেষ হবার পরেই দ্বিধাবিভক্ত হল। পূর্ব জার্মানী এল সোভিয়েত প্রভাবে আর পশ্চিম জার্মানীর ওপর আধিপত্য থাকল ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকার। ক্রমশ দুই জার্মানীতেই শুরু হল পুনর্গঠন। আবার ঠান্ডা যুদ্ধের আবহ পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানীকে পরস্পরের থেকে সরিয়ে রাখল অনেকটা দূরে। বার্লিনের দেওয়াল হয়ে উঠল ঠান্ডা যুদ্ধের অন্যতম প্রতীক। এই জটিলতা পেরোতে পেরোতেই জার্মানী ক্রমশ ফিরে তাকাল তার ভয়াবহ নাজি অতীতের দিকে। সাহিত্যে এর শুরুটা হল যুদ্ধোত্তর কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জার্মান উপন্যাস গুন্টার গ্রাসের ‘টিন ড্রাম’ দিয়ে। ১৯৫৯ সালে বইটি প্রকাশের পর তা নিয়ে নানা বিরূপ সমালোচনা কোথাও কোথাও হল বটে, কিন্তু অচিরেই সেটি পেয়ে গেল ধ্রুপদী সাহিত্যের মর্যাদা। শুধু জার্মানীতে নয়, এর ইংরাজী অনুবাদ ইউরোপ আমেরিকা সহ সারা বিশ্বেই নজর কাড়ল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর ইংরাজী অনুবাদ বিক্রি হল চার লক্ষেরও বেশি এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার বেস্ট সেলার লিস্ট এ এটি টানা তিন সপ্তাহ এক নম্বরে থাকল।
উপন্যাসটি প্রকাশের কুড়ি বছর পরে যখন এর চলচ্চিত্রায়িত রূপটি ১৯৭৯ সালে ভোলকার শিলিন্ডর্ফের পরিচালনায় ও গ্রাসের অনুমোদন সহ আত্মপ্রকাশ করল, তখন সেই সিনেমাও আলোড়ন তুলল। বিপুল কলেবর টিন ড্রাম উপন্যাসটি পড়েন নি এমন অসংখ্য মানুষ এই আড়াই ঘন্টার সিনেমাটি দেখলেন এবং টিন ড্রাম এর মধ্যে দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে আরো বেশি প্রচারিত হল।
টিন ড্রাম উপন্যাসের নায়ক অস্কার মাৎসেরাট তার কাহিনী শোনায় ১৯৫২-৫৪ সাল জুড়ে। ১৯৫৪ তে তার বয়েস যখন ত্রিশ, তখন সে তার কাহিনী শেষ করে। মূলত অস্কারের জবানীতে এখানে তিন প্রজন্মের কাহিনী আছে। অস্কারের নিজের, তার মা আগনেসের এবং দিদিমা আনার। কাহিনীর শুরু ১৮৯৯ সালে, যখন অস্কারের দিদিমা আনা ব্রনস্কির সঙ্গে পরিচয় হয় তার দাদামশাই কালিয়াইচেকের। এই পরিচয়ের মুহূর্তটি নাটকীয়। আনা পারিবারিক আলু খেতে বসে তখন চাষের কাজ করছেন। আনার এক বিচিত্র অভ্যাস ছিল চারটে ঘাঘরা একসঙ্গে একটার ওপর আরেকটা পরার। সেইরকম ভাবে আলু খেতে বসে কাজ করতে করতে আর আলু পুড়িয়ে খেতে খেতে আনা দেখেন একজন লোক ছুটে পালানোর চেষ্টা করছে। তার পেছনে ধাওয়া করছে দুজন উর্দিধারী পুলিশ। খানিকটা ব্যবধান বাড়িয়ে সেই পলাতক আনার কাছে চলে আসে ও তার ঘাঘরার নিচে ঢুকে পড়ে। বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না। উর্দিধারীরা কিছুক্ষণ পরে এসে আনাকে পলাতক বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। আনা দূরে আঙুল দেখিয়ে একটা লোকের যাবার কথা বললেও তাদের সন্দেহ যায় না। তারা ঘোরাফেরা ও অনুসন্ধান করতে থাকে আধঘন্টারও বেশিসময় জুড়ে। আর এই গোটা সময়টা তাঁবুর মতো হয়ে থাকা আনার ঘাঘরার নিচে থাকে সেই আগন্তুক। সেখানেই সে আনার সঙ্গে যৌনতায় লিপ্ত হয় ও তার ফলে আনা সন্তানসম্ভবা হয়। পরের বছর জন্ম হয় তাদের কন্যা আগনেসের। উর্দিধারীরা চলে গেলে সেই আগন্তুক কালিয়াইচেককে নিয়ে আনা তার দাদা ভিনৎসেন্টের বাড়িতে উপস্থিত হয় ও সেই রাতেই যাজককে ডেকে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের পরেই ঘোড়ার গাড়িতে করে রাতের অন্ধকারে কালিয়াইচেক তার নব বিবাহিতা স্ত্রী আনাকে নিয়ে পালায়। কালিয়াইচেককে খোঁজা হচ্ছিল অনেকগুলো কাঠের কলে অগ্নিসংযোগ করার অপরাধে। কিছুদিন কালিয়াইচেক লুকিয়ে থাকে। পালটায় তার চুলের সিঁথির ধরন, ফেলে দেয় গোঁফ। মুখের খানিকটা ভোলবদল করে সে নেয় এক নতুন নাম পরিচয়। ইয়োসেফ ভ্রাংকা নামে বের করে কাগজপত্র। উগ্র স্বভাবটিকে বদলে ফেলে হয়ে ওঠে শান্ত ধীর স্থির। নতুন করে জীবন শুরু করে, মাঝি মাল্লার কাজে যোগ দেয়। কিন্তু তার ওপর সন্দেহ দেখা দিলে আবার নতুন করে শুরু হয় অনুসন্ধান। সেইসময় পালাতে গিয়ে তার মৃত্যু ঘটে। ইয়োসেফ কালিয়াইচেকের মৃত্যুর কিছুদিন পর তার দাদা গ্রেগর কালিয়াইচেককে বিয়ে করেন আনা। কিন্তু গ্রেগরও কিছুদিন পর মারা যান ডেঙ্গু জ্বরে। অস্কারের মা আগনেসের সঙ্গে প্রথম যৌবনে প্রেম ছিল মামাতো দাদা ইয়ানের। কিন্তু আগনেসের সঙ্গে তারপর প্রেম ও বিয়ে হল হেয়ার মাৎসেরাটের। ইয়ান বিয়ে করল হেডভিগকে। তারা সবাই থাকতে লাগল ফ্রি সিটি ডানজিগ এ।
জার্মানী, পোল্যান্ড ও সংলগ্ন ইউরোপের বিশ শতকী ইতিহাস ‘দ্য টিন ড্রাম’ এ বারবার এসেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নায়কের মা আগনেস বড় হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কাহিনীর নায়ক অস্কার। আগনেস আর ইয়ানের প্রেমের প্রথম দিনগুলোয় ইয়ানের যুদ্ধে যাবার আশঙ্কা, যুদ্ধ শেষে আগনেস আর মাৎসেরাটের দাম্পত্যর দিনগুলোয় মন্দার ছায়াপাত আর তার বিরুদ্ধে লড়াই এর ছবি রয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি আটকানোর জন্য যখন রেনটেনমার্ক চালু হয়, তখন আগনেস আর মাৎসেরাট একটা দোকান কিনে নেয় ও ব্যবসা দাঁড় করানোর কাজে মনপ্রাণ ঢেলে দেয়। আগনেসের মা আনা ততদিনে দ্বিতীয় স্বামীর মৃত্যুর পর ফিরে গেছেন পারিবারিক জমিতে, আবার কৃষিকর্মে ও মুরগি পালনে যুক্ত হয়েছেন।
অস্কার ঠিক করে সে আর বড় হবে না। এই সিদ্ধান্ত থেকে স্ব ইচ্ছায় তার তিন বছরের জন্মদিনে সিঁড়ি থেকে সে পড়ে যায়। তারপর থেকে রুদ্ধ হয়ে যায় তার শারীরিক বিকাশ, যদিও মানসিক বিকাশ অব্যাহত থাকে। কাহিনী কথনের সময় অস্কারের শরীর তিন বছরের আয়তনে সীমায়িত, মন মানসিকতা আঠাশ ত্রিশের যুবকের। খুব ছোটবেলা থেকেই অস্কারের সব সময়ের সঙ্গী ছিল একটা টিন ড্রাম। সে সেই ড্রামটা বাজায় প্রায়শই, কখনো বা খালি গলায় চিৎকার করে। দেখা যায় সে এক আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী। গলার আওয়াজের সাহায্যে সে যে কোনও কাঁচের জিনিস ইচ্ছেমত ভেঙে দিতে পারে। এই দক্ষতার আশ্চর্য দিক নিয়ে প্রবন্ধ লিখে বেশ খ্যাতি পেয়ে যান তার চিকিৎসক। অস্কারের এই বিশেষ দক্ষতাই তার স্কুল জীবনের প্রথম দিনটিকে শেষ দিন করে তোলে। ছয় বছর বয়সে সে তিন বছরের মতো বিকশিত শরীর নিয়ে গিয়েছিল স্কুলে। শুরুটা হয়েছিল বেশ ভালোভাবেই। কিন্তু গোলমাল বাঁধল যখন স্কুলের মিস তার ড্রামটা তার থেকে নিয়ে নিতে চাইলেন। সুতীক্ষ্ণ চিৎকারে সে ক্লাসঘরের জানলার সব কাঁচগুলো ভেঙে দিল, চিরে দিল দিদিমণির চশমার কাঁচ। স্কুলে মহা হট্টগোল যখন চলছে, তখন লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে মা অ্যাগনেস তাকে নিয়ে এলেন বাড়িতে। এরপর তাকে আর কেউ স্কুলে পাঠানোর কথা ভাবে নি। তবে বাড়িতে পড়াতে আসতেন গ্রেটশেন। তিনি উল বুনতেন, অস্কারের মার সঙ্গে রুশ মিস্টিক মানুষ (আসলে ভণ্ড) রাসপুটিন নিয়ে মুগ্ধভাবে চর্চা করতেন। মিস আর মা দুজনেই ভাবতেন অস্কার কিছুই শিখছে না। অস্কার কিন্তু শিখেছিল অনেক কিছুই। সবজি বিক্রেতা গ্রেফ এর বাড়িতে সে যেত, যেখানে শুধুই বইয়ের সাম্রাজ্য। নানা বিষয়ের নানা ধরনের বই তার আগ্রহকে উশকে দিয়েছিল। অস্কারকে প্রভাবিত করেছিলেন একদিকে গ্যয়ঠে, অন্যদিকে রাসপুটিন। অনেক পরে, বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর, সে আবার নতুন করে পড়াশুনো চালিয়েছিল। নাইট স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। আবারো নানারকম বইপত্র পড়া শুরু করেছিল।
অস্কার ড্রাম বাজাত আবার ড্রাম নষ্টও করত। তারপর দরকার পড়ত নতুন একটি ড্রাম যা আসত মার্কুসের দোকান থেকে। স্মৃতি কথায় সে নিজেই জানিয়েছে সাত থেকে দশ বছরের সময়কালে একটা ড্রামকে শুইয়ে ফেলতে তার দুসপ্তাহ লাগত। দশ থেকে চোদ্দ বছর পর্যন্ত সময়ে একটা ড্রামকে তুবড়ে ফেলতে তার একসপ্তাহও লাগত না। পরের দিকে একটা ড্রামকে একদিনের মধ্যেই সে বর্জ্যে পরিণত করতে পারত। তবে ক্ষমতার ভারসাম্য এসে যাবার পর ব্যাপারটা যায় বদলে। তিন চার মাস টানা ড্রাম বাজালেও রঙের সামান্য ছিলা বের করা ছাড়া ড্রামের আর কোনও ক্ষতি তখন আর সে করত না। অস্কার তার মায়ের মামাতো ভাই তথা প্রেমিক ইয়ান ব্রনস্কির সঙ্গে মায়ের প্রেমের উত্তাপের দিনগুলোর কথা তার স্মৃতিতে ধরে রাখে। অবশ্য ইয়ানই মায়ের একমাত্র প্রেমিক ছিল না। মায়ের এক গুণমুগ্ধ ছিল সিগিসমুণ্ড মার্কুস। তার দোকান ছিল ডানজিগ শহরের কোলেনমার্কট ছাড়িয়ে অস্ত্রাগার ভবনের গলিতে। সেখানে মা গেলেই মার্কুস বাছা বাছা প্রশংসায় মাকে তৈলাক্ত করত, নানা উপহার তুলে দিত। জিনিসপত্রের দাম এত কম নিতে যে তা ছিল প্রায় বিনামূল্যে দেওয়া উপহারের মতোই। অস্কারের জন্যও সামান্য দামে টিন ড্রাম থাকত। অস্কার বুঝত মায়ের সঙ্গে বিয়ের কথাটা পাড়বার জন্যই মার্কুসের এইসব কাজকারবার। মা অবশ্য মার্কুসের দোকানে প্রতি বৃহস্পতিবার অস্কারের দু ঘন্টার জন্য রেখে চলে যেত এক গোপন অভিসারে। সেই অভিসারের কথা অস্কারের কাছে অবশ্য গোপন ছিল না৷ টিসলারগাসে একটা সস্তা লজের ঘরে মা তার প্রেমিক ইয়ানের সঙ্গে মিলিত হত। প্রথমদিকে লজ অবধি গিয়ে সিঁড়িতে থাকত অস্কার, পরে মার্কুসের দোকানেই। এরকমই এক দিন মার্কুসের অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে অস্কার বেরিয়ে পড়ে দোকান থেকে। নানা রাস্তা পেরিয়ে সূচিমিনারে উঠে পড়ে। পরীক্ষা চালায় পুর নাট্যশালার বাড়ির কাঁচগুলোর ওপর। এর আগে সে শুধু সে চাপে পড়েই চিৎকার করেছিল এবং ভেঙেছিল নানা কাঁচ। কিন্তু এইদিন চাপে পড়ে চিৎকারের বদলে দায়হীন চিৎকার করল। নিজের কন্ঠস্বরের জোর ও ক্ষমতাকে পরীক্ষা করতে চাইল। পরপর কয়েকবার সে চিৎকার করল নিশানা স্থির রেখে। পনেরো মিনিট পর দেখা গেল পুর নাট্যশালার লবির সমস্ত জানলা এবং কিছু দরকার কাঁচ খসে পড়েছে। তবে বিরাট ঝাড়বাতিটা সেদিন চূর্ণ হয়ে যায় নি। সেটাকে আগামী কোনও একদিনের নিশানা হিসেবে স্থির করে রাখে অস্কার। পরের কয়েকদিন গবেষণা চলল কাঁচভাঙার রহস্য নিয়ে৷ কেউ আলোচনা করলেন মহাজাগতিক রশ্মির কথা নিয়ে, কেউ বললেন সৌররশ্মির প্রভাবের কথা। অস্কারকে নিয়ে একবার তার মা অ্যাগনেস গিয়েছিলেন সার্কাসে। সেখানেই এক বামন খেলা দেখাত। তার নাম ছিল বেব্রা। সে দশ বছরের পর বাড়েনি আর। তিপ্পান্ন বছরেও দশ বছরের চেহারা নিয়েই খেলা দেখিয়ে যাচ্ছে সার্কাসে। তিনবছরের পর শরীরে আর না বলা অস্কারকে সে টানতে চেয়েছিল সার্কাসের মঞ্চে। তার কাঁচকাটার প্রতিভার প্রকাশ্য উন্মোচন চেয়েছিল। অস্কার তখন রাজি হয় নি। কিন্তু বেব্রার কথাটা সবসময় তার কানে বাজত। "বামনদের মঞ্চ দখল করতে হবে"। অস্কার সেই আগ্রহ থেকেই ক্রমশ ডানজিগে নাজিদের মঞ্চে ভিড়ে যায়।
ডানজিগ শহরের ভবিষ্যৎ যে বদলাচ্ছে মার্কুস তা অস্কারের মা অ্যাগনেসকে জানিয়ে দেয়। নিষেধ করে পোলিশ হয়ে যাওয়া ইয়ান ব্রনস্কির সঙ্গে মেলামেশা করতে। কারণ নাজি জার্মানরা এসে পড়লে পোলদের দফারফা হবে। অনুনয় করে বলে অ্যাগনেস হয় তার জার্মান স্বামী মাৎসেরাটের সঙ্গে থাকুক বা মার্কুসের কাছে চলে আসুক। অস্কারকে নিয়ে তারা একসঙ্গে বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়ানো ডানজিগ ছেড়ে চলে যাবে লন্ডনে। অস্কারের স্মৃতিকথা এখানে আশ্চর্যভাবে ধরেছে তার শহর ডানজিগ ও তার দেশ পোল্যান্ডকে৷
"আমি পোলদের সেই দেশটিরই খোঁজ করছি যেটা হারিয়েগেছে এবং যা এখনো হারায় নি। অন্যেরা নানান রকম কথা বলে, বলে নিমেষেই হারাল, আগেই হারিয়ে গেছে, আবার হারিয়ে গেল। এদেশে লোকে আজকাল পোলদের দেশকে খুঁজতে শুরু করেছে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে, লাইকা, কম্পাস, রাডার, ডাইভিং রড, ডেলিগেশন, মানবতা, বিরোধীপক্ষ এবং তাড়া খাওয়া সাইলেশীয়, পোমেরানীয় ও পূর্ব প্রুশীয় সমিতির পোকায় খাওয়া ইউনিফর্ম ব্যবহার করে। আত্মানুসন্ধানের তাগিদে লোকে যখন পোলদের দেশটাকে খোঁজে,বুকে খানিকটা শোপ্যাঁ, খানিকটা প্রতিশোধের স্পৃহা - তখন তারা পোল্যান্ড নামেরপ্রথম চারটি দেশভাগের পর পঞ্চম দেশভাগের ফন্দী আঁটে, যখন তারা এয়ার ফ্রান্সের প্লেনে ওয়ারশ উড়ে গিয়ে বিবেকযন্ত্রণার ঘেঁটোয় মাল্যদান করে, যখন এখানে বসেই তারা পোলদের দেশটাকে রকেট দিয়ে খুঁজতে শুরু করে, তখন আমি পোল্যান্ডকে খুঁজি আমারড্রামের মধ্যে দিয়ে।... পোল্যান্ড শেষ, সব হারালো দেখছ তবু হারালো কই পোল্যান্ড দেশ?”
১৯৩৩ সালে জার্মানীতে হিটলার ক্ষমতায় এলেন। পোল্যান্ড ও ডানজিগও বদলাতে শুরু করল। বড় বড় সমাবেশ ও মশাল মিছিল হতে থাকল নাজিদের। মাৎসেরাট পরিবর্তন বুঝে নিয়ে ১৯৩৪ এ নাজি পার্টিতে যোগ দিল। ঘরের ভেতরের অঙ্গসজ্জার পরিবর্তনের একটি বর্ণনা বদলের মাত্রাটাকে বুঝিয়ে দেয়।
"বিষণ্ণ বেটোফেন এর ছবিটা পেরেক থেকে খুলে নিয়েসেই পেরেকেই হিটলারের একইরকম বিষাদময় দৃষ্টি চোখের সামনে তুলে ধরা হয়েছে।"
বেটোফেন এর ছবিটাকে অস্কারের সঙ্গীতপ্রিয় মা অ্যাগনেস একেবারে সরিয়ে ফেলতে রাজি ছিল না। তার দাবি হল ছবিটা সোফার ওপর না হোক অন্ততসাইনবোর্ডের মাথায় টাঙাতেই হবে। দুকুল রেখে অবস্থাটা দাঁড়ায় এরকম –
"হিটলার আর বেটোফেন মুখোমুখি ঝুলতে থাকে পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে, একে অন্যের দৃষ্টি ভেদ করে, কিন্তু দুজনের কেউ তাতে খুশি হয় না।"
এই অংশ থেকেই টিন ড্রাম সমকালীন রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে প্রবলভাবে প্রবেশ করে। চরিত্র ও পরিবারের ভেতরের বদলগুলো দেখাতে শুরু করে। ক্রমশ মাৎসেরাট নাজি পার্টির উর্দিতে নিজেকে সজ্জিত করতে শুরু করল। একে একে কিনতে লাগল বিভিন্ন অংশ। প্রথমে সে কিনেছিল পার্টির ক্যাপটুপিটা। তারপর খাঁকি শার্ট, তারপর উঁচু বুট জুতো। এইভাবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মাৎসেরাট এসে গেল পুরোদস্তুর নাজি উর্দিতে। প্রতি রবিবার এই পোষাকে সজ্জিত হয়ে মাৎসেরাট নাজিদের শক্তি প্রদর্শনমূলক ড্রিল প্যারেডে অংশ নিত। মঞ্চ বেঁধে যে বড় বড় সমাবেশ হত নাজিদের, তার শুরুর দিনগুলোর কথা এখানে এসেছে বিস্তারিত অনুপুঙখে।
"মঞ্চটা প্রতিসাম্যে এবং সামঞ্জস্যে একেবারে অতুলনীয়। উঁচু থেকে নিচু পর্যন্ত স্বস্তিকা চিহ্ন দেওয়া ছটা ব্যানার পাশাপাশি। এরপর সার সার পতাকা - সঙ্কেত পতাকা, আনুগত্য পতাকা। এরপর কালো উর্দি এস এস গেস্টাপো, তারপর দুই সারি এস আ। গান বা বক্তৃতার সময় তারা বেল্ট এর বকলসে হাত দিয়ে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। তারপর অনেক সারি শুধুই ইউনিফর্ম পরা পার্টি সদস্য।"
অস্কার তার ড্রাম নিয়ে এইসব নাজি সমাবেশে হাজির হত, সেখানে বাজাত এবং ক্রমশ তার বাজনা জনপ্রিয়তাও পেতে শুরু করে। তখন তার বয়েস বছর এগারো। বছর পাঁচেক, উনিশশো আটত্রিশ পর্যন্ত সে এইভাবে ডানজিগের নাজি সমাবেশগুলোতে নিয়মিত ড্রাম বাজিয়ে যেত। প্রথম খণ্ডের শেষদিকে অস্কারের মা অ্যাগনেস মারা যান। এ ছিল অনেকটা স্বেচ্ছামৃত্যু। কাঁচা মাছ দিনের পর দিন খেয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে সে লিভারটাকে নষ্ট করছিল বেশ কিছুদিন ধরে। চূড়ান্ত অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করার তিন দিনের মধ্যেই অ্যাগনেসের মৃত্যু হল। মায়ের মৃত্যুর পর অবহেলা আর একাকিত্বের অন্ধকার অনেকটাই ঘিরে ধরল অস্কারকে। সিগিসমুণ্ড মার্কুসের দোকানে নতুন ড্রাম কিনতেও কেউ তাকে নিয়ে যেত না। মাৎসেরাট বা ইয়ান ব্রনস্কি দুজনেই জীবন সম্পর্কে অনেকটা নিরাসক্ত হয়ে উঠেছিল, অস্কারের দিকে কেউই বিশেষ নজর আর দিত না। হেয়ার্বাট ট্রুৎসিনস্কিই এই পর্বে হয়ে উঠেছিল তার প্রধান সহায়। ট্রুৎসিনস্কির বড়ছেলে হার্বাট অসমবয়সী হলেও অস্কারের অন্যতম বন্ধু হয়ে ওঠে। ট্রুৎসিনস্কির কনিষ্ঠাসন্তান মারিয়া ছিল অস্কারের সমবয়সী। মারিয়ার সঙ্গে অস্কারের প্রেম সম্পর্ক স্থাপিত হয়, অবশ্য তা ছিল একমুখী, কেবল অস্কারের দিক থেকে। প্রথম স্ত্রী তথা অস্কারের মা অ্যাগনেসের মৃত্যুর পর মারিয়াকে বিয়ে করে অস্কারের বাবা মাৎসেরাট। ফলে অস্কারের প্রেমিকা এবং সৎ মা - দুই ই হয়ে ওঠে মারিয়া।
সিগিসমুণ্ড মার্কুসও ছিল মায়ের মৃত্যুর পর অস্কারের আরেক নিকটজন। মার্কুসের দোকানে গেলে সে আগের মতোই একটি করে নতুন ড্রাম দিত অস্কারকে। ইহুদী হওয়ায় সে বাঁচতে পারল না নাজিদের হাত থেকে। তার আগেই ডানজিগ শহর জুড়ে নাজিবাহিনী একের পর এক ইহুদী উপাসনালয় সিনাগগ ধ্বংস করেছে, আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে সেগুলোকে শেষ করে দিয়েছে। তারপর তারা সিগিসমুণ্ড মার্কুসের মতো ইহুদীদের দোকানগুলোতে হানা দিয়েছে। দোকানের কাঁচ ভাঙার আগে লিখে দিয়েছে তার ইহুদী পরিচয়, গালমন্দ করেছে। তারপর খোলা দোকানেরই দরজা ভেঙে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে। তারা ঢোকার ঠিক আগে মার্কুস আত্মহত্যা করে। মায়ের মৃত্যুর পর সিগিসমুণ্ড মার্কুসের মৃত্যুতে অস্কার আরো রিক্ত হয়ে পড়ে।
অস্কারের জীবনের ভাঙচুর দিয়ে টিন ড্রাম উপন্যাসের প্রথম পর্বের সমাপ্তি। আর দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ডানজিগের পোলিশ ডাকঘরের ওপর নেমেআসা ভয়াবহ আক্রমণের কথা দিয়ে। দ্বিতীয় পর্বের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ডানজিগের পোলিশডাকঘরের ওপর শুরু হল নাজি আক্রমণের অনুপুঙ্খ বর্ণনা রয়েছে। অস্কার তখন সেখানেগেছিল তার ড্রাম ঠিক করাতে। আর ডাকঘরের আধিকারিক হিসেবে সেখানে উপস্থিত ছিল ইয়ান ব্রনস্কি ও তার সহকর্মীরা। ইয়ান হয়ত ছিল পোলিশ আন্ডারগ্রাউন্ড রেজিস্ট্যান্স গ্রুপের এক সক্রিয় সদস্য, তবে গোপন বলেই অস্কারের তা জানার কথা নয়। কিন্তু পাঠক আখ্যান থেকে এরকম অনুমান করতে পারেন। বোমাবর্ষণে ইয়ান আহত ও রক্তাক্ত হয়, গুরুতর আহত কোবিয়েলাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। কনরাডকে পাওয়া যায় মৃত অবস্থায়। যুদ্ধ নেমে এসেছে বুঝতে পেরে তখন ইয়ানরা অপেক্ষা করতে থাকে ফরাসী আর ব্রিটিশদের সাহায্যের জন্য। অস্কার এই ঘটনার পরেই প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হয় ও তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অনেকদিন থাকতে হয় তাকে। হাসপাতালে শুয়ে সে শুনতে পায় বোমা বিস্ফোরণের শব্দ। একদিন হঠাৎ খেয়াল করে সে তার ড্রামটার কথা অনেকদিন ভাবেনি। এই প্রথম অস্কার উপলব্ধি করে যে টিনের ড্রামের বাইরেও একটা অন্য বড় জগৎ রয়েছে। এই পর্বেই ইয়ান সহ যারা ডানজিগের পোলিশ ডাকঘরটা রক্ষা করার চেষ্টা করেছিল, তাদের গুলি করে হত্যা করে নাজিরা। ক্রমশ রিক্ত ও নিঃসঙ্গ হতে থাকে অস্কার।
ডানজিগ ও গোটা বিশ্বে যখন বড় বড় ঘটনা ঘটছে তখনো টিনড্রাম উপন্যাসে তার ন্যারেটিভ প্যাটার্নকে পরিবর্তন করেন নি গুন্টার গ্রাস। নাজি জার্মানীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হওয়ার উচ্চকিত বর্ণনা দেন নি। অস্কারের রোজকার জীবনযাপনের কথা বলতেই বলতেই সে সবের আভাস দিয়ে গেছেন। কাঁচ ভাঙার শব্দের মতোই তা তীব্র ও তীক্ষ্ণ, কিন্তু উচ্চনাদী নয়। একটা উদাহরণ দেখা যাক।
“ঊনিশশো চল্লিশের জুলাই মাসে ফ্রান্সে জার্মানদের অভিযান দ্রুত সফল হল। তার বিশেষ ঘোষণা কানে আসতেনা আসতেই বাল্টিক সাগরের পূব পারে শুরু হয়ে গেল স্নানার্থীদের মরসুম। মারিয়ার ভাইফ্রিৎস এখন কর্পোরাল, প্যারিস থেকে সে এই সময়ে পাঠাল ছবিওয়ালা পোস্টকার্ড। এদিকে মাৎসেরাট আর মারিয়া মিলে ঠিক করল অস্কারকে সমুদ্রে নিয়ে যাবে, হাওয়ায় ওর উপকার হবে।”
এইখানেই মারিয়ার সঙ্গে অস্কারের প্রথম যৌন সংসর্গের বর্ণনা রয়েছে। অস্কার মনে করে মারিয়ার সঙ্গে অস্কারের যৌন সংসর্গের সুবাদেই মারিয়া গর্ভবতী হয়, জন্ম হয় কুর্টের। মাৎসেরাটের ধারণা ছিল সন্তান তারই, কিন্তু অস্কার মনে করত কুর্টের আসল পিতা সেই। তার সংশয় ছিল তার নিজের পিতৃপরিচয় নিয়েও। মাৎসেরাট না ইয়ান ব্রনস্কি কে তার প্রকৃত পিতা এই নিয়ে তার আজীবন দোলাচলতা ছিল।
অস্কার এরপর বেব্রার অনুরোধে যোগ দেয় নাজিদের সঙ্গে। বেব্রা তখন জার্মান সেনার মনোরঞ্জক দলের সঙ্গে যুক্ত। সেই দলেই যুক্ত করে নেওয়া হয় ড্রামবাদক অস্কারকে। বেব্রার সঙ্গিনী সিনিওরা রোশভিতা রাগুনার সঙ্গেও প্রেমসম্পর্ক গড়ে ওঠে অস্কারের। টিন ড্রাম উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্বের দশম অধ্যায়, যার নাম ‘বেব্রার ফ্রন্ট থিয়েটার’ – অস্কারের সঙ্গে নাজিদের প্রত্যক্ষ সংসর্গের সূত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তবে একথা ভাবলে ভুল হবে যে নাজিদের প্রতি অনুরাগে অস্কার তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। তার বাবা মাৎসেরাটের নাজি সংযোগেরও তেমন কোনও ভূমিকা এখানে ছিল না। পিতৃসম ইয়ান ব্রনস্কির সক্রিয় নাজি বিরোধী সংগ্রাম ও শহীদ হওয়াও তাকে নাজি দলে যোগ দেওয়া থেকে প্রতিহত করে নি। তার নাজি সংযোগে ভূমিকা নিয়েছিল যাকে সে গুরু মানত সেই বেব্রার অনুরোধ এবং বেব্রার সঙ্গিনী সিনিওরা রোশভিতা রাগুনার প্রতি অস্কারের অমোঘ আকর্ষণ। এই দুই ব্যক্তির প্রভাবেই সে নাজি সেনাদের মনোরঞ্জনের জন্য তৈরি দলে ভিড়ে যায় এবং ঘুরে আসে প্যারিস। টিন ড্রাম উপন্যাস থেকে বিশ্বযুদ্ধের দিনগুলোয় অস্কারের নাজি সংসর্গের ছবিটা তুলে আনা যাক।
‘তেতাল্লিশের ১২ জুন পুত্র কুর্টের জন্মদিনে ডানজিগে থাকা অস্কারের পক্ষে সম্ভব হল না, সে চলে গেল রোমানদের পত্তন করা পুরনো একটা শহর মেৎস এ। তার অনুপস্থিতিটা এতই লম্বা হতে শুরু করল যে চুয়াল্লিশের ১২ জুনও কুর্টের তৃতীয় জন্মদিনে হাজির হওয়া সম্ভব হল না। সবসময় একটা আতঙ্ক, এই বুঝি বোমা পড়ে, তাই ফেরাই হল না নিজের শহরে। কী এমন কাজ ছিল যা আমায় এমন তাড়না করে নিয়ে চলেছিল ? আজেবাজে না বকে সরাসরিই বলে ফেলি : পেস্টালোৎসি স্কুলটা ইদানীং বায়ুসেনাদের ব্যারাকে পরিণত হয়েছিল – এই স্কুলের সামনেই গুরু বেব্রার সঙ্গে আমার দেখা হয়। বেব্রার ক্ষমতা ছিল না আমাকে বাড়ি ছাড়তে রাজি করায়। কিন্তু বেব্রার বাহুলগ্ন হয়েছিল রাগুনা, সিনিওরা রোশভিতা, সেই বড় মাপের দিব্যদ্রষ্টা।’ রাগুনা অস্কারকে বলে, “এটা সত্যি যে রাগুনা কোনওদিন আপনার ড্রামহৃদয় টলাতে পারবে না, কিন্তু প্যারিস আলবৎসেটা পারবে – চলে আসুন আমাদের সঙ্গে।” শেষমেষ বেব্রাও তাকে আহ্বান করে ফ্রন্ট থিয়েটারের পরিচালক ও প্রধান ব্যক্তি হিসেবে। - “আমাদের এখানে এসে উঠুন। ড্রাম বাজান। বিয়ারের গ্লাস আর ইলেকট্রিক বাল্বগুলো গান গেয়ে গুঁড়িয়ে দিন। ঐ যে সুন্দর প্যারিস শহর, ঐ যে চিরযৌবনা প্যারিসের দখলদার সেনানী, তারা আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাবে, হাততালি দেবে।” খানিক চিন্তাভাবনার পর অস্কার সম্মত হয় এবং বেব্রাকে জানিয়ে দেয়, “প্রকৃতি আমাকে পরামর্শ দিচ্ছে আপনার প্রস্তাবটা সমর্থন করতে। এবার থেকে আপনার ফ্রন্ট থিয়েটারের একজন সদস্য হিসেবেই দেখতে পাবেন আমাকে।”
নাজি থিয়েটারে ড্রাম বাজানোর কাজ ছেড়ে পঁয়তাল্লিশের ১২ জুন তার ছেলের তিন বছর পূর্ণ হবার জন্মদিনের আগের দিনই অস্কার আবার মারিয়া মাৎসেরাটের পরিবারে ফেরৎ আসে। ছেলে কুর্ট অবশ্য টিন ড্রামটার প্রতি একেবারেই উৎসাহ দেখায় না। ডানজিগে ফেরার পর রাস্তায় একদিন অস্কার মুখোমুখি হয় ডাস্টার নামের এক দলের ছেলেপিলেদের সঙ্গে। এই ডাস্টাররা ছিল মূলত স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছাত্র। প্রবল দুর্বৃত্ত এই দলটি নানা জায়গায় হামলা লুঠপাট করে বেড়াত। পুলিশ বা নাজি যুব দলের সদস্যরা ডাস্টারদের ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। বেশ কয়েকটা ডাস্টার দল ছিল। তারা নিজেদের মধ্যে এলাকা ভাগ করে নিয়েছিল। টাকা পয়সা, সেনাবাহিনীর মেডেল ও অস্ত্রশস্ত্র সহ নানা রকম জিনিস তারা চুরি করত, সবচেয়ে বেশি অভিযান চালাত রেশন দোকানগুলোতে। অস্কারের কাঁচ ভাঙার দক্ষতার হাতেগরম প্রমাণ পাওয়ার পর তারা অস্কারকে তাদের গুরুর আসনে বসায়। রাতের অন্ধকারে অস্কার তার চিৎকারে কাঁচ ভেঙে দিত, সেই ফাঁক দিয়ে ডাস্টারদের দলবল ঢুকে পড়ত বাড়ি, ব্যারাক বা নানা জায়গায় আর হাতিয়ে নিত জিনিসপত্র। উনিশশো পঁয়তাল্লিশের গোড়ার দিকে তাদের সব সম্পত্তি নাজিদের কাছে সমর্পণ করতে হয়।
নাজি নীতি অনুসারে বিকলাঙ্গ অসুস্থদের মেরে ফেলা হত। অস্কারকেওমেরে ফেলার জন্য তার বাবার সম্মতি চেয়ে চিঠির পর চিঠি পাঠানো হচ্ছিল স্বাস্থ্য বিভাগ। দীর্ঘদিন তার বাবা মাৎসেরাট বিষয়টা ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। শেষে তিনি বাধ্য হন মৃত্যুর সম্মতিসূচক স্বাক্ষরটি করতে। তবে চিঠি যাবার আগেই ডানজিগ মিত্রশক্তি দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং অস্কারের প্রাণবেঁচে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তিম লগ্নে ডানজিগ দখল করে রুশরা। জার্মানদের হারিয়ে তখন তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে ফেলেছে। রুশ সৈন্যদের হাতে মাৎসেরাট নিহত হন। বিধ্বস্ত ডানজিগে কিছুদিন থাকার পর ১৯৪৫ এর ১২ জুন ডানজিগ ত্যাগ করে মারিয়া অস্কার ও কুর্টকে নিয়ে চলে যায় তার বোনের কাছে রাইনল্যান্ডে।
টিন ড্রাম উপন্যাসের প্রথম খণ্ডটি প্রাক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্বের। দ্বিতীয় খণ্ডটি বিশ্বযুদ্ধ পর্বের। আর তৃতীয় খণ্ডটি যুদ্ধোত্তর সময়কালের ঘটনা নিয়ে। এই খণ্ডের প্রথমদিকে অস্কার, মারিয়া ও তার পরিবারের নতুন সময়ে আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই চলে। ক্রমশ তারা থিতু হয়। যুদ্ধোত্তর জার্মানীর তখন চলছে নতুন গঠনপর্ব। মারিয়া একটি দোকানে সেলস ও ক্যাশিয়ারের কাজ করার পর ক্রমশ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হয়ে ওঠে। অস্কার প্রথমে রোজগার করতে থাকে একজন মডেল হিসেবে৷ তারপর কিছুদিন পাথরের কাজও করে। শেষমেষ ড্রামবাদক হিসেবে যোগ দেয় বেব্রার প্রতিষ্ঠিত এক মিউজিক কোম্পানীতে। এর কিছুদিন পরে বেব্রার মৃত্যু হয়। নিজের আইডলকে হারিয়ে ফেলে আরো একবার বেদনায় ডুবে যায় অস্কার৷ ইতোমধ্যেই মারিয়া তার বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে৷ মারিয়া আর কুর্টের থেকে আলাদা থাকে অস্কার। ক্রমশ সে হারিয়ে যেতে থাকে স্বাভাবিক জীবনের গতিধারা থেকে।
টিন ড্রাম উপন্যাসের তৃতীয় পর্বে মারিয়া ও অস্কারকে বিপ্রতীপে স্থাপণ করেন গুন্টার গ্রাস। মারিয়া যেখানে পশ্চিম জার্মানীর পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় মিশে যেতে পারে ও নব্য বুর্জোয়া গোষ্ঠীতে ঢুকে পড়তে সক্ষম হয়, সেখানে থিতু হতে হতেও শেষপর্যন্ত এক গভীর মনস্তাপের মধ্যে বন্দী হয়ে যায় অস্কার। এক বেদনাবোধ ও আত্মধিক্কার থেকেই সে নিজেকে হত্যাকারী ভাবতে থাকে। বলতে থাকে তার বাবা, মা, কাকা, বান্ধবী - সবার হত্যাকারী সে। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকায় আঠাশ বছর বয়সে এসে তার ঠাঁই হয় এক মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে। সেখানেই দু বছর ধরে সে লেখে তার আত্মকথা। তার তিরিশ বছরের জন্মদিনে এসে সেই আত্মকথা ও টিন ড্রাম উপন্যাসের সমাপ্তি।
গুন্টার গ্রাস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও নাজি জার্মানীর দিনকাল সংশ্লিষ্ট উপন্যাস রচনার যে ধারাটি জার্মান সাহিত্যে শুরু করলেন, তা ধরে পরে আরো অনেকে লিখলেন বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে। ইউরেক বেকার, হাইনরিখ ব্যোল, বিলার্ড উম, হালবৎসেন, উভে ইয়নসন, উইবার ইয়াকব, পেটার ভাইস, ক্রিস্টা ভলভ প্রমুখের কথা এই প্রসঙ্গে মনে করা যায়।
আকর প্রসঙ্গে
আমরা এই লেখায় গ্রাসের টিন ড্রাম উপন্যাসের আলোচনায় ২০১৫ সালে প্রকাশিত মূল জার্মান থেকে করা দেবব্রত চক্রবর্তীর বাংলা অনুবাদটির ওপরেই মূলত নির্ভর করেছি। তবে কিছু কিছু শব্দ বদলে নিয়েছি। যেমন যে শহরকে কেন্দ্র করে টিন ড্রাম উপন্যাসটি লেখা তার নাম ডানৎসিগ লিখেছেন জার্মান বিশেষজ্ঞ দেবব্রত চক্রবর্তী, আমরা বাংলায় পরিচিত ডানজিগ বানানটিই লিখেছি। কাহিনীর নায়কের নাম দেবব্রতবাবুর প্রতিবর্ণীকরণে ওস্কার, আমরা অস্কার ই রেখেছি। এই ধরনের কিছু বদল কানের অভ্যাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে করা হয়েছে। এছাড়াও আমরা সাহায্য নিয়েছি দুটি ইংরাজী অনুবাদের। ১৯৬১ সালে করা র্যালফ ম্যানহেইমের ইংরাজী অনুবাদটি এই উপন্যাসটিকে প্রথম বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছিল। ২০০৯ সালে ‘টিন ড্রাম’ প্রকাশের পঞ্চাশ বছর উপলক্ষ্যে নতুন একটি ইংরাজী অনুবাদ প্রকাশিত হয়। এটি করেন ব্রেয়ন মিচেল।
গ্রাস সম্পর্কিত আলোচনা বাংলায় খুব বেশি হয় নি। দেবব্রত চক্রবর্তীর অনুবাদ গ্রন্থটিতে গ্রাস সম্পর্কে একটি মূল্যবান নিবন্ধ ও টীকা অংশ রয়েছে। সেটি আমাদের সবিশেষ সাহায্য করেছে। পিটার ও আরনডস এর লেখা রিপ্রেজেন্টেশন, সাবভার্সন অ্যান্ড ইজেনিক্স ইন গুন্টার গ্রাসেস দ্য টিন ড্রাম নামক সমালোচনার বইটি মূলত বাখতিনিয় ধারায় গ্রাসের বিশ্লেষণ। গ্রাস কীভাবে এই উপন্যাসে বহুস্বরিকতাকে এনেছেন এই বইতে সেই সম্পর্কে মূল্যবান আলোচনা রয়েছে। নোয়েল থমাসের লেখা দ্য ন্যারেটিভ ওয়ার্কস অব গুন্টার গ্রাস : এ ক্রিটিক্যাল ইন্টারপ্রিটেশন – নামক বইটিও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই বইটি টিন ড্রাম উপন্যাস ও তার চলচ্চিত্ররূপকে পাশাপাশি রেখে উপন্যাসের ন্যারেটিভ টেকনিকের বিশেষত্বর দিকটিকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছে, নানা কারণেই এর চলচ্চিত্র রূপকে যা থেকে সরে আসতে হয়েছিল। রি ম্যাপিং রিয়েলিটি (গ্যয়ঠে, নীৎসে, গ্রাস) – নামে জন এ ম্যাকার্থির লেখা বইতে বাস্তবতাকে গ্রাস কীভাবে তুলে ধরেন এবং তা জার্মান সাহিত্যের ধারায় কী অর্থে বিশিষ্ট তার মূল্যবান আলোচনা রয়েছে। গ্যয়ঠের প্রকৃতির মধ্যে ঈশ্বরকে দেখা আর নীৎসের ঈশ্বর থেকে মানুষের সরে আসার কথা বলাকে গ্রাস টিন ড্রামে কীভাবে মিলিয়েছেন সেই আলোচনা এখানে রয়েছে। আবার জার্মান সাহিত্যের বিখ্যাত বিল্ডুংসরোমার ধারা থেকে কীভাবে গ্রাস সচেতনভাবে তার ‘টিন ড্রাম’কে সরিয়ে এনে আলাদা পথ তৈরি করেছেন সেই আলোচনাও ম্যাকার্থি এখানে করেছেন। সবশেষে বলতে হয় স্টুয়ার্ট স্ট্যাবার্নারের সম্পাদিত কেমব্রিজ কম্পানিয়ন টু গুন্টার গ্রাস বইয়ের প্রবন্ধগুলির কথা।