দেশভাগের যন্ত্রণা : কোমলগান্ধার ছবির দুটি দৃশ্য

স্বাধীনতা দিবস আসে, স্বাধীনতা দিবস যায়। ইতিহাসের যে কোনো মুহূর্তই জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক উপাদানের অংশ হয়ে ওঠা মাত্র তাতে যে বিভ্রম আর বিস্মৃতির রং লাগে, বলা বাহুল্য, স্বাধীনতা দিবসও তার ব্যতিক্রম নয়। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ইউনিফর্ম পড়ে স্কুলে পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সঙ্গীত, খান দুই স্বাধীনতা সংগ্রামীর জীবনকথা আর মিষ্টির প্যাকেট – ওহ, কোভিডকে ‘নরম্যাল’ করে ফেলা পৃথিবীতে বোধহয় এও অনলাইনেই ঘটবে – সে যাই হোক, ঘুম চোখে অনলাইনে অ্যাটেনডেন্স দিয়ে গুগল মিটে স্কুলছাত্র থেকে পার্লামেন্টের সদস্য পর্যন্ত – স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করবেন দেশের সকলেই। লালকেল্লায় তেরঙ্গা উঠবে, ছুটির সকালে তাবৎ মধ্যবিত্ত পায়ের উপর পা তুলে লুচি খেতে খেতে জুলুজুলু চোখে ‘লালকেল্লা’ লিখে গুগল সার্চ করবেন, হোয়াটসঅ্যাপে চালাচালি হবে অগুন্তি দেশভক্তির মেসেজ, আর দেশের জন্য ফেনিয়ে ওঠা হঠাৎ ভক্তিকে কয়েকশো দিয়ে গুণ করে তুমুল বিক্রমে ঘোষিত হবে, ‘হিন্দু খঁতরে মে হ্যায়’। আপাতত, এ বিষয়ে আমার মত অর্বাচীনের বিশেষ কিছু না বলাই ভালো, সেকশন ১২৪এ জ্বলজ্বল করছে। তাই রাষ্ট্রকে বা জাতিকে বিন্দুমাত্র অসম্মানের স্পর্ধাটুকুও না দেখিয়ে আমরা মনোনিবেশ করতে পারি অন্য একটি প্রসঙ্গে, যা ২০২১’র ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস, ২০২২’র ৭৬ তম স্বাধীনতা দিবস, ২০২৩’র ৭৭তম … অর্থাৎ ল্যাজা মুড়ো ধরে যতরকম যতভাবে স্বাধীনতা দিবস আমরা পালন করব, তার প্রতিটাতেই জ্বলজ্বল করবে। তেরঙ্গা উত্তোলন করে দেশভক্তিতে উদ্বেলিত হতে হতে প্রতিবার আমরা ভুলে যাবো, ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট – ভারত নামক জাতি-রাষ্ট্রের স্বাধীনতা প্রাপ্তির দিনই – ভারত সহ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে অন্যতম নিষ্ঠুর, ভয়াল একটি মুহূর্তের একইরকম ৭৫, ৭৬, ৭৭ … তম দিন। বলা বাহুল্য, তা পার্টিশন, দেশভাগ। লালকেল্লায় পতাকা উত্তোলনের সময় আমরা কেউই মনে রাখব না, ৭৫ বছর আগে আজকের দিনেই এ উপমহাদেশের প্রায় দুই কোটি মানুষের আজন্ম কালের বাসভূমি তছনছ হয়ে গেছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার গৌরব কাহিনী এবং স্বাধীনতা পরবর্তী নিয়ত উন্নতির বিপুল মায়াময় আখ্যানে প্রতিবার আমাদের ভুলে যেতে হবে দুই কোটি মানুষের চূড়ান্ত হতবাক পরিস্থিতিতে হঠাৎ দেশহীন হয়ে যাওয়ার কথা, ভুলে যেতে হবে ‘এপার-ওপার’ শব্দগুলোর নতুন ঐতিহাসিক দ্যোতনার কথা, ভুলে যেতে হবে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আর উদ্বাস্তু হয়ে ওঠার যন্ত্রণাদায়ক কাহিনীর কথা।

বস্তুত, ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে স্বাধীনতা-দেশভাগের এই দ্বৈত প্রসঙ্গটি টেনে আনার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র এই নয় যে ঋত্বিক নিজে আজীবন দেশভাগের প্রসঙ্গটিকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন। বরং আমাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন উপরোক্ত এই কাঠামোর আঙ্গিকে – কীভাবে স্মরণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, নির্ভর করে থাকে বিস্মরণের উপর। অর্থাৎ মনে রাখা এবং ভুলে যাওয়া একে অপরের বিপ্রতীপে – ইতিহাসের একটি ক্ষণকে স্মরণে আনতে (এবং উদযাপন করতে) আমাদের প্রয়োজন হয় সক্রিয় বিস্মরণের। ভুলে না গেলে, এবং একই সাথে জলজ্যান্ত বাস্তবতাকে স্মৃতিমেদুরতার নিছক অতীতে পর্যবসিত করে না ফেললে যেন স্মরণের উদযাপন যথেষ্ট প্রাণ পায় না, লালকেল্লার তেরঙ্গা যথেষ্ট পতপত করে ওড়ে না।

এ প্রবন্ধে আমরা দেখব, কীভাবে ঋত্বিক ঘটক তাঁর আজীবনের সৃষ্টিকর্মে জোর দিয়ে এসেছেন এই ভুলে যাওয়ার এবং স্মৃতিমেদুরতার বিকল্প আখ্যানে – স্মরণের উদযাপনের ফলে অতীতের নির্বাচিত বিস্মরণ যেভাবে সংস্কৃতির সর্বত্র পূজ্য হয়, তার খোলনলচে ধরে নাড়া দেওয়ার বাসনায়। বস্তুত বিস্মরণের এই আখ্যানকে আন্ডারলাইন করতে ঋত্বিক কী ধরণের সিনেমাটিক স্ট্র্যাটেজি ব্যবহার করতেন, কী ধরণের ইমেজ-সাউন্ড ব্যবহার করতেন, তা খানিক বুঝে নেওয়াই হবে আমাদের এ লেখার উদ্দেশ্য।

স্মরণের প্রয়োজনে বিস্মরণ তো হল – কিন্তু বিস্মৃত অতীতকে ফিরিয়ে আনা যায় কী করে? প্রতিবছর ১৫ই আগস্টকে স্বাধীনতা দিবস না বলে দেশভাগ বললেই কী আমাদের অভীষ্ট সাধন হয়ে যাবে? কিংবা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পাশে দেশভাগের দুই কোটি উদ্বাস্তু মানুষের দু’চারজনকে নিয়ে স্মারক নির্মাণ করলেই কী বিস্মরণকে ফিরিয়ে আনা যায় স্মরণের আওতায়? বলা বাহুল্য, অতীতকে ফিরে দেখা, স্মৃতিতে আনা – এ অতি জটিল এক প্রক্রিয়া। যেহেতু আমরা মূলত সিনেমার এক শিল্পীকে নিয়ে কথা বলছি, আমাদের মনে পড়তে পারে, অতীত ইতিহাসের বড় বড় কাহিনীকে পর্দায় ‘ফিরিয়ে’ আনার কাজ যে ইন্ডাস্ট্রি সবচেয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে করে, তার নাম হলিউড – যেখানে ‘হিস্টোরিকাল’ ফিল্ম নামে পৃথক একটি ঘরানা আছে। সেখানে চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায় রোম সাম্রাজ্য থেকে হিটলারের জার্মানীর মানুষজন, রূপোলী পর্দার ঝাঁ চকচকে ম্যাজিকে প্রায় নিখুঁত পুনর্নির্মিত হয় কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। বলা বাহুল্য, পুঁজির দেখনদারিতে নির্মিত অতীতের এই ধরণের বিস্ময়কর ‘ফিরে আসা’র কথা আমরা বলছি না। একটু তলিয়ে ভাবলেই আমরা দেখতে পাবো, ঋত্বিক ঘটকের সাথে দেশভাগ শব্দটি জুড়ে দিয়ে যতই আমরা লাফালাফি করি না কেন, দু একটি জায়গা ছাড়া সরাসরি দেশভাগ বা উদ্বাস্তু মানুষের কথা তাঁর ছবির বিষয়বস্তু বা ‘কন্টেন্ট’ হিসেবে আসেনি। তিনি জনপ্রিয় ‘হিস্টরিকাল’ ঘরানার একটি ছবিও করেননি, তাঁর প্রায় সব ছবির চরিত্রই ঘোর বর্তমানে, সেই মুহূর্তের পথিক। নাগরিক (১৯৫২) থেকে যুক্তি তক্কো ও গপ্পো (১৯৭৪) অবধি ছবির গুলির বিন্যাসে বারবার বলা হয়েছে তৎকালীন মানুষের কথা, তাঁদের লোভ, হিংসা, আশা, আকাঙ্ক্ষা, প্রেম, মৃত্যু, আর বেঁচে থাকার কথা।

তবে দেশভাগ এবং বিস্মরণের যে কথা আমরা শুরুতেই বললাম, তার স্থান কোথায়? ঋত্বিক ঘটক যদি প্রায় কোনো ছবিতেই দেশভাগকে প্রধান বিষয় না করে তোলেন, তবে তাঁর ছবিতে দেশভাগের আখ্যান কীভাবে বিন্যস্ত হচ্ছে? ১৯৫২ থেকে ১৯৭৪ সাল অবধি বিন্যস্ত তাঁর সৃষ্টিকর্মে কীভাবে ইতিহাসকে চিহ্নিত করা সম্ভব?

বস্তুত এখানেই আমাদের কাছে জরুরী, স্মরণ-বিস্মরণের এই আঙ্গিকগত গুরুত্বের কথা। বিস্মৃত অতীত, ঋত্বিকের শিল্পপ্রকল্পে সরাসরি টেক্সটের শরীরে উঠে আসে না, বরং তা থেকে যায় অবতলে। ইতিহাসের এই বিস্মৃত মুহূর্ত প্রসঙ্গে একধরণের চ্যুতি বা বিচ্ছেদের কথা আমরা ভাবতে পারি, যেখানে সময়ের প্রবাহে দেশভাগের মতো একটি ঘটনা সরাসরি অতীতের এক ছেদবিন্দু হিসেবে আমাদের সামনে উঠে আসে। অর্থাৎ দেশভাগ বিংশ শতকের উপমহাদেশের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে জরুরী একটি ক্ষণ – তিন তিনটি পৃথক জাতি-রাষ্ট্রের জন্ম হওয়াই শুধুমাত্র নয়, এই মুহূর্ত অতীতের কার্যকারণ সম্পর্কে রচিত সময়ের ধারণাকেও ভেঙেচুরে তছনছ করে দেয়। ঋত্বিক ঘটকের শিল্প এই চ্যুতির মুহূর্তকে চিহ্নিত করতে চায়, একধরণের সিনেমাটিক আঙ্গিক নির্মাণ করতে চায় যা তার শরীরে এই বিচ্ছেদের ক্ষতচিহ্ন রেখে যাবে। আর তাই তার ফিল্ম নিজের শরীরের নানান ভাঁজে ভাঁজে বুনে দিয়ে যায় এই ক্ষতের কথা, চ্যুতি এবং বিচ্ছেদের কথা। এই মুহূর্তগুলোই চিৎকৃত স্বরে আমাদের জানান দেবে, (অবশ্যই সরাসরি নয়) ১৫ই আগস্ট শুধুমাত্র স্বাধীনতা উদযাপনের দিন নয়, তা দেশভাগেরও দিন। ইতিহাস শুধুমাত্র স্বাধীন ভারতের তথাকথিত প্রগতি (?)-র ইতিহাস নয়, বরং প্রদীপের তলায় জমে থাকা অজস্র অন্ধকারেরও আখ্যান।

চলচ্চিত্রবিদ্যা বিষয়ের অধ্যাপক মৈনাক বিশ্বাস এক ইউরোপীয়ান শিল্পীর চলচ্চিত্র বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে জরুরী একটি প্রসঙ্গ এনেছিলেন, “তাঁর ছবিতে ঐতিহাসিক ট্রমা শুধুমাত্র প্লটের অন্তর্গত ‘বিষয়’ হিসেবে থাকে না, বরং ঐতিহাসিক ট্রমাকে চলচ্চিত্রের পর্দায় ধাক্কা দেওয়ার একটি পদ্ধতিকে তিনি নিখুঁত করে গড়ে তোলেন। এই পদ্ধতি সাধারণ ভাবে চলচ্চিত্রের পর্দায় সামাজিক বিষয়ের সরাসরি প্রতিচ্ছবি নির্মাণ বা স্বীকৃতিদানের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে” (বিশ্বাস ২০১৪)। অর্থাৎ, সংশ্লিষ্ট শিল্পীর কাজে তিনি সামাজিক রাজনৈতিক বিষয়ের সরাসরি উপস্থাপনার বদলে অন্য এক ধরণের রাজনৈতিক নির্মাণের আখ্যান খুঁজে পান যেখানে ইতিহাস শুধু ‘বিষয়বস্তু’তেই ‘ইতিহাস’ হয়ে সরাসরি উপস্থিত থাকে না, বরং চলমান চিত্রমালার অবতলে এসে ধাক্কা মারে, তার কাঠামো নড়বড়ে করে দেয়, যা আমরা ঋত্বিক ঘটকের ছবি প্রসঙ্গে প্রস্তাব রাখতে চাইছি। যার ফলে, সরাসরি গল্পে, চরিত্রে বা ঘটনায় হয়তো ইতিহাসের উপস্থিতি সেইভাবে স্পষ্ট থাকে না, কিন্তু, আমরা একটু আগেই যা আলোচনা করলাম, ইতিহাস বয়ে চলে ফল্গুধারার মত; তার আক্রমণ হয় অতর্কিতে, চকিতে, চুপিচুপি।

আমাদের উদ্দেশ্য, কীভাবে ইতিহাস এসে ঋত্বিক ঘটকের ছবিগুলোর কাঠামোয় ধাক্কা মেরে চিড় তৈরি করছে, তা বোঝার চেষ্টা করা। নাগরিক থেকে যুক্তি তক্কো আর গপ্পো অবধি ঋত্বিকের সব ছবিতেই কমবেশি বিষয়গত ভাবে রাজনৈতিক বয়ান রয়েছে, কিন্তু শুধুমাত্র সেই রাজনীতিটুকু দিয়েই; শুধুমাত্র সুবর্ণরেখা-য় (১৯৬২) অভিরাম দলিত, অতএব ঋত্বিক লিখিত রামায়ণ প্রতিস্পর্ধী; কোমলগান্ধার-এ (১৯৬১) সেই বিখ্যাত ‘দোহাই আলি’ আর্তনাদ, তা মুসলমান জনসমষ্টির বয়ান ইত্যাদি – শুধুমাত্র এই ধরণের যুক্তিতে, বিষয়গত রাজনৈতিক বয়ানে এই ধাক্কা মারা ইতিহাসের কথা সম্পূর্ণরূপে বোঝা যাবে না। কারণ একটি টেক্সটে ‘বিষয়বস্তু’ যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ততটাই গুরুত্বপূর্ণ তার আঙ্গিক – এ কথা শিল্পের যে কোনো মাধ্যমের মতই চলচ্চিত্র সম্পর্কেও সত্য। তাই বিষয়ের রাজনীতিতে থেমে গেলে অর্ধেকটুকু পড়া হয় মাত্র – আঙ্গিকের রাজনীতি কখনও যে বিষয়ের রাজনীতিকে ভোঁতা করে দিতে পারে, বা কখনও উল্টো কথাও বলতে পারে – এ জিনিসগুলো আমাদের ভাবনার বাইরে থেকে যায়। তাই আমরা ভাবতে চেষ্টা করব, ঋত্বিকের টেক্সটগুলিতে কখন এই ঐতিহাসিক ট্রমার চকিত ধাক্কা তৈরি হচ্ছে, কোন মুহূর্তে সেই অমোঘ বিচ্ছেদ টেক্সটের শরীরে তার ক্ষতচিহ্ন খোদাই করে দিয়ে যাচ্ছে।

চ্যুতির মুহূর্ত, আমরা আপাতত খুঁজব কোমল গান্ধার ছবিতে। ভারতীয় গণনাট্য আন্দোলনের সময়ের দুই নাটকের দলের পারস্পরিক প্রতিযোগিতা এবং শকুন্তলা নাট্যপ্রযোজনার সূত্রে ভৃগু ও অনুসূয়া নামক দুই চরিত্রের কাছাকাছি আসার এ কাহিনীর সঙ্গে আশা করি প্রায় সব পাঠকই পরিচিত। তাই গল্পের আর পুনরুক্তি করব না, আমরা বরং আলোচনা করব এ ছবির বিখ্যাত ‘বাফার শট’র অংশটি নিয়ে। পরিপ্রেক্ষিত সকলেই জানেন – নাট্যদলের সকলে পদ্মাপারে ঘুরতে ঘুরতে কথা বলছেন – ইমেজে, সংলাপে, গানে, ভেসে আসছে দেশভাগ পূর্ববর্তী অখণ্ড বাংলা এবং তৎকালীন ‘ওপার বাংলা’র কথা। আমরা বুঝতে চাইছি, ছবির এই মুহূর্ত কীভাবে একধরনের চ্যুতি বা বিচ্ছেদের মুহূর্ত হিসেবে নির্মিত হতে পারে - টেক্সটের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশে ঋত্বিক কীভাবে একধরণের ফাটল তৈরি করেন, যে ফাটল গল্পকে চুঁইয়ে টেক্সটের মধ্যে ঢুকে একধরণের বিক্ষেপ নির্মাণ করে।

কিন্তু এ অংশের নিবিড় পাঠে যাওয়ার আগে আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, ‘দোহাই আলি’ আর্তনাদের সঙ্গে সঙ্গে রেললাইন ধরে ক্যামেরার এই ট্র্যাকিং শট এবং সবশেষে ভেঙেচুরে যাওয়া এই ইমেজ কিন্তু কোমলগান্ধার-এর একটিমাত্র অংশে নেই। ছবির শেষেরদিকে, প্রায় একই ক্যামেরা মুভমেন্টে, একইরকম ক্ষিপ্রতায় ফিরে আসে আরেকটি দৃশ্য, যেখানে রেললাইনের বদলে সিঁড়ির উপর দিয়ে এই অংশকে অব্যর্থভাবে মনে করিয়ে দিয়ে ফিরে আসে অনুসুয়ার একটি ইমেজ (চিত্র ক) – তাই একটি টেক্সটকে পাঠ করা এবং তার আঙ্গিকগত রাজনীতির অনুসন্ধান বুঝতে গেলে আমাদের প্রয়োজন এই দুইকেই একই সাথে আলোচনার পরিসরে নিয়ে আসা।

 

চিত্র কঃ ছবির দুই অংশে সাউন্ডট্র্যাকে ‘দোহাই আলি’ সহযোগে একই ধরণের ক্যামেরা মুভমেন্ট

আপাতত প্রথম অংশ। এই দৃশ্যটিকে একভাবে পড়া যায় তার গানের প্রয়োগ দিয়ে। অন্তত চারটি স্তরে নানান গান ব্যবহার করে এ দৃশ্যে জটিল একটি পলিফোনিক বিস্তৃতি তৈরি হয়, যা এখানকার আঙ্গিকের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিয়ের গান ‘আমের তলায় ঝামুর ঝুমুর’, বিজন ভট্টাচার্য্যের গলায় রণেন রায়চৌধুরীর গাওয়া গান, ‘এ পার পদ্মা, ওপার পদ্মা রে’, নাটকের দলের ছেলেদের নৌকা চালাতে চালাতে সমবেত ‘হেঁইও হেঁইও’ গান এবং সবশেষে নন-ডায়জেটিক ‘দোহাই আলি’ আর্তনাদ দৃশ্যটিকে প্রায় শব্দ দিয়ে মুড়ে রেখেছে বলা চলে। একের পর এক গানের পলিফোনিক প্রয়োগ শব্দের দিক থেকে (সাউন্ড ডিজাইন) গল্পে যে ফাটল ধরবে, তা আমাদের জানিয়ে দিতে থাকে – কারণ ছবিতে এর অব্যবহিত আগে বা পরে আমরা এত জটিল বিস্তৃত শব্দের প্রয়োগ পাইনি। একই সাথে সমান্তরালে চারটি গানের সুর দর্শকের কাছে মূল গল্পের সাথে মেলোড্রামা ফর্মের শর্ত অনুযায়ী ‘এক্সেস’ হিসেবে অনেকগুলি স্তর একটু একটু করে খুলে দেয়, যেখানে ইতিহাস ক্রমশঃ করে ধাক্কা মারার সুযোগ পাবে। একই সাথে, এখানে দুইবাংলার এককালীন মিলনাবস্থার স্মৃতিরও উদ্রেক হতে থাকে, যেখানে বিশেষত এই গানের পলিফনিক নেটওয়ার্কের গুরুত্ব অপরিসীম (বন্দোপাধ্যায় ২০১৫, ২৯৯)। অনুসুয়া ভৃগুকে পূর্ববাংলার কথা বলতে থাকে – আমরা এখানে প্রতিটা শট আলাদা আলাদা করে দেখে ফিরে পড়ার চেষ্টা করব। 

 

চিত্র খ

প্রথম শট – যেখানে ভৃগু ওইপারে তার দেশের বাড়ির কথা বলছে (চিত্র খ)। মিঁজসিন আমাদের জন্য জরুরী – আমরা ভৃগুর পিছনে ক্রমাগত গাছপালা নড়তে দেখি। অভিজ্ঞান-শকুন্তলম  নাটক (কালিদাস ২০১৩) এবং রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ (ঠাকুর, ১৯০৭), যা এই ছবির অন্যতম ‘আকর’ – তার একটি স্পষ্ট রেফারেন্স এখানে দেওয়া আছে, ঋত্বিক শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রার সময় অরণ্য দুলে উঠে আপত্তি জানানোর বিষয়টিকে বাড়িয়ে তুলেছেন এবং এক অর্থে বৈপরীত্যে প্রয়োগ করেছেন – কারণ ভৃগু-অনুসুয়া কোথাও চলে যাওয়ার কথা বলছে না, বরং ছেড়ে আসার কথা বলছে। অর্থাৎ - বিষয়বস্তু হিসেবে এখানে দেশভাগ উপস্থিত থাকলেও ভিতরে গভীরতর কোনো ট্রমা’র স্মৃতি আন্দোলিত হচ্ছে ছবির মিঁজসিনে। ওদের তো এই পদ্মাপার ছেড়ে চলে যেতে হবে না, যে পারে ওরা আছে সেই ভারতবর্ষ তো ওদেরই – তাহলে কেন এখানে শকুন্তলার কেঁদে ওঠা অরণ্যের রেফারেন্স? এই বৈপরীত্যের স্পষ্ট কোনো উত্তর আমি দিতে চাই না, কারণ এই ধরণের বৈপরীত্যের একটিই কোনো ‘নির্দিষ্ট’ অর্থ হয় না। বরং আমাদের জন্য জরুরী আন্দোলিত ট্রমার কথা।

 

চিত্র গ

পরের শট – অনুসুয়াকে ক্যামেরা একটা নিউট্রাল অ্যাঙ্গেলে দেখে (চিত্র গ)। লক্ষ্যণীয় পিছনে পাতার আন্দোলন অনেক মিনিমালিস্টিক, ভৃগুর ইমেজে যেরকম দ্রুত আন্দোলনে পাতা ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল, এই কম্পোজিশন তুলনামূলক বেশ কিছুটা শান্ত। এখানে অনুসুয়া কোনো কথা বলে না, সাউন্ডে ভৃগুর একটানা সংলাপ আমরা শুনতে পাই (কে কথা বলছে আর কে শুনছে, সেটি মাথায় রাখা প্রয়োজন, কারণ পরবর্তী অংশে এটা প্রায় উল্টো হয়ে যাবে)। 

এরপর একটি লংটেক আসে, যার অন্তত তিনটে আলাদা আলাদা নির্দিষ্ট কম্পোজিশন তৈরি হয় ভৃগু-অনুসুয়ার মধ্যে (চিত্র ঘ)।

চিত্র ঘ

সংলাপে জরুরী জিনিসগুলো এখানে মূলত আন্ডারলাইনের কাজ করে – ভৃগুর রুক্ষতার কথা স্পষ্ট ভাষায় বলে দেওয়া থাকে এখানে। তিনটি আলাদা কম্পোজিশনে আমরা ঋত্বিক ঘটকের সিগনেচার খুঁজে পাই – যেখানে মানুষের চেয়ে আকাশ এবং প্রকৃতি তাঁর ফ্রেমিং-এ প্রধাণ জায়গা নিতে চায়। আমরা পরে কয়েকটি আমরা শট একসাথে রাখব –

 

চিত্র ঙ

প্রতিটা শট নিয়ে আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই, কিন্তু গল্পের কাঠামোয় ফাটল ধরিয়ে যে বিক্ষেপের কথা আমরা আগেই বলেছিলাম, দৃশ্যগত ভাবে তার স্পষ্ট প্রমাণ এখানে পাওয়া যায়। বস্তুত না বলে দিলে এখানে বোঝা সম্ভবই না যে শটগুলি, অন্তত চিত্র ঙ(৩) এরটি বাদ দিলে সবকটাই একধরণের শট-কাউন্টারশটের যুক্তিতে তৈরি। শট কাউন্টার শট – কিন্তু ফিল্মের হলিউডি ব্যাকরণের অনেক দূরে তার অবস্থান। বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় চিত্র ঙ(২) ও চিত্র ঙ(৪) শট দুটি – যেখানে একই জায়গায় অনুসুয়াকে ফ্রেম করা হয়েছে, (অন্তত শট ডিভিশনে কোনো ইঙ্গিত নেই যে অনুসুয়া জায়গা পরিবর্তন করেছে) কিন্তু প্রেক্ষাপট ব্যাপক ভাবে বদলে গেছে। আবার, চিত্র ঙ(৫) আর চিত্র ঙ(৭) শট একই ভাবে ভৃগুর শট – কিন্তু শটদুটি তোলা কিছুমাত্র ইঙ্গিত না দিয়ে বিপরীত দিক থেকে, যার ফলে একদিকে বিস্তৃত আকাশ এবং অন্যদিকে ঝাউবন – যখন যে প্রেক্ষাপট প্রয়োজন ঋত্বিক তখন সেদিকে ক্যামেরা ঘুরিয়ে দিয়েছেন দর্শককে বিন্দুমাত্র পরিচিতির সুযোগ না দিয়েই। যার ফলে – সংলাপে যখন দেশভাগের স্পষ্ট রেফারেন্স আসে, ভৃগু তার বাবামায়ের মৃত্যুর কথা বলে, পদ্মাপারে বসে শাখঘন্টার শব্দ শোনার কথা বলে – তখন ইমেজে ঋত্বিক চকিত এই নাশকতা চালাতে থাকেন, যেখানে কন্টিনিউটি এডিটিং ভেঙ্গে পড়ে, বিন্দুমাত্র আভাস না দিয়ে প্রেক্ষাপট বদলে যায়, ক্যামেরার দেখার দিক পরিবর্তিত হয়ে যায়। আমরা বুঝতে পারি, টেক্সটিতে একই সাথে দুটো জিনিস ঘটছে – একদিকে বিষয়গত ভাবে ভৃগুর ব্যক্তিগত বিচ্ছেদ ইতিহাস হয়ে সংলাপে উপস্থিত, অন্যদিকে গভীরে, আঙ্গিকে এই ঐতিহাসিক ট্রমা দৃশ্যের অবতলে ধাক্কা মারছে, যা, একটু পরেই দেখব আমরা – ন্যারেটিভে ফাটল ধরিয়ে প্রায় ‘নন-ডায়জেটিক’ একটি ‘শট’ হিসেবে পরিপূর্ণতা লাভ করবে (বাফার শট)। আমরা খানিক আগেই বলেছিলাম, বিষয়বস্তুর অর্থকে কীভাবে আঙ্গিক পরিপূর্ণতা দান করে (কখনও কাউন্টারপয়েন্টের যুক্তিতে) এ দৃশ্যটি তার অনবদ্য একটি প্রকাশ।

 

     

 

                        চিত্র চ (১)                                                          চিত্র চ (২)

পরবর্তী অংশটির উপস্থাপনা এভাবে স্থিরচিত্র দিয়ে লিখিত টেক্সটে করা অসম্ভব – কারণ এই সেই ফাটলের অন্তিম মূহুর্ত যা ঋত্বিক তাঁর সর্বশক্তি দিয়ে নির্মাণ করেন। আমরা ভৃগুকে দেখি অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে, ক্যামেরা ডানদিকে প্যান করে, ঝাউপাতার আন্দোলন বেড়ে যেতে থাকে। স্থিরচিত্রে সবসময়েই সাউন্ড হারিয়ে যায়, তাই ক্রমবর্দ্ধমান হাওয়ার শব্দ আর দোহাই আলি আর্তনাদ – পাঠককে আরেকবার ছবিটা চালিয়ে দেখে নিতে অনুরোধ করি (কোমল গান্ধার, ৩৬.৩৭ – ৩৭-১১)। ক্যামেরা ডানদিকে প্যান করতে করতে সেই বিখ্যাত বাফার শটটি শুরু হয় এবং সঙ্গের ‘দোহাই আলি’ বাড়তে থাকে। দৃশ্যটি শেষ হয় ইমেজ অন্ধকার হয়ে গিয়ে, সাউন্ডে আমরা শুনতে পাই তীব্র এক ভাঙচুরের শব্দ।

পরপর শটগুলি দেখতে থাকলে বোঝা যায়, শেষ এই দুটি শট ন্যারেটিভে গল্পের যুক্তিতে এখানে আসতে পারে না, কারণ খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাদের এখানে গল্পকে কিছু দেওয়ার নেই। গল্পাংশ শেষ হয়ে যায় অনুসুয়ার ‘আমিও বড় একা’ সংলাপ এবং ‘কী হল’ বলতে বলতে ভৃগুর এগিয়ে যাওয়াতেই। পরবর্তী অংশে, আমরা আলফ্রেড হিচককের ভাষা ধার করে বলতে পারি, ‘পিওর সিনেমা’ তৈরি হয় এবং এই দুটো শট চ্যুতির যে ক্ষতচিহ্ন খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলাম, তার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসেবে রচিত হয়। মৈনাক বিশ্বাস ঋত্বিক ঘটকের ছবি আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, “ঋত্বিকের ছবি স্মৃতিকে খুঁড়ে যতটা না শিকড়ে প্রবেশ করা (যেভাবে সাধারণত ভাবা হয়), তার চেয়ে বেশী ঐতিহাসিক বিচ্ছেদ, স্থানচ্যুতির মুহূর্তকে চেতনায় ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া– যার ফলে কিছু মুহূর্ত তৈরি হয় যেখানে ট্রমাটিক ব্যক্তিরা বুঝতে পারেন না কীভাবে সেই বিচ্ছেদকে আবার মনে করবেন” (বিশ্বাস ২০০৪)। এই ‘বাফার শট’, এই ধরণের মূহুর্তের শ্রেষ্ঠ একটি নিদর্শন যেখানে বিচ্ছেদকে চেতনায় ফিরিয়ে আনার কাজ করতে থাকে অনুসূয়া এবং ভৃগু, এবং সাথে সাথেই একধরণের অসম্ভব স্মৃতির কুঠুরি তৈরি হয় – যেখানে তারা বুঝতে পারে না কীভাবে আবার ইতিহাসের সেই চ্যুতি চেতনায় এসে হানা দেবে। এখানে বিচ্ছেদ হিসেবে দেশভাগ – পার্টিশন তো স্পষ্ট ভাবে রয়েইছে – কিন্তু তলায় তলায় ভৃগু অনুসুয়ার ব্যক্তিগত স্মৃতিরাও ভিড় করে আসে, যা স্পষ্ট ভাবে ফিল্ম টেক্সটের উপরিতলে নেই। এবং ফিরে মনে করবার গোটা প্রক্রিয়াটি রাজনৈতিক হয়ে ওঠে ‘দোহাই আলি’র ঐ আর্তনাদে – অর্থাৎ দুইজন মানুষ থেকে ইতিহাস, ব্যক্তি থেকে গোষ্ঠীতে ছড়িয়ে যায় এই নামহীন ট্রমা। এই অংশটি – এতগুলি দ্যোতনা একসাথে করে ঠিক কী বলতে চাইছে – তার কোনো স্পষ্ট উত্তর হয় না – কারণ ঋত্বিক ঘটকের শিল্প উপরিতলের এই স্পষ্টতায় কাজ করে না। এই অংশে ‘দোহাই আলি’ শব্দবন্ধের অর্থই শুধুমাত্র নয়, বরং আঙ্গিক, প্রয়োগের কৌশল জরুরী হয়ে ওঠে, কারণ পলিফোনিক এতগুলো উপাদানে ‘দোহাই আলি’ আর একটি উপাদান মাত্র – কিন্তু অত্যন্ত জরুরী উপাদান। ন্যারেটিভে ফাটল ধরিয়ে ইতিহাস ধাক্কা মারার কাজে এবং বিচ্ছেদের ক্ষতচিহ্ন ফিরে মনে করবার ব্যর্থতা – এই দুইই জরুরী এই অংশের অর্থ নির্মাণ করতে এবং তা থেকে রাজনীতিতে পৌঁছতে। আমরা তা করব, কিন্তু তার আগে, আমাদের এই আলোচনায় জরুরী একটি বিক্ষেপ করা দরকার।

চলচ্চিত্রে কোনো ইমেজেরই যেমন একটি মাত্র ‘অর্থ’ হয় না, তেমনই, স্রষ্টার অভিপ্রায় ব্যতিরেকেও কোনো ইমেজে এমন অনেক অর্থের দ্যোতনা জন্ম নিতে পারে যাতে পরবর্তীকালে সেই ইমেজ পড়তে আমাদের সুবিধে হয়। উল্লেখযোগ্য ভাবে, ঋত্বিক ঘটক আলোচ্য এই বাফার শটে যে ভঙ্গিতে ক্যামেরা ব্যবহার করেন, আমাদের মনে পড়তে বাধ্য সিনেমার আদিযুগের একটি জরুরী শট-টেকিং পদ্ধতি – ‘ফ্যান্টম রাইড’। এই পদ্ধতিতে সদ্য আবিষ্কৃত চলমান ক্যামেরাকে সিনেমাটোগ্রাফারেরা ট্রেনের সামনে বসিয়ে রাখতেন, যার ফলে ট্রেন চললে চালকের আসন থেকে দেখা দৃশ্যের অনুরূপ ইমেজ তৈরি হত ক্যামেরায়। লুমিয়ে ভাই সহ এই ফ্যান্টম রাইডের বেশ কিছু ছড়ানো ছেটানো উদাহরণ আদিযুগের চলচ্চিত্রে অনেক দেখা যায়, তবে এর প্রথম নাটকীয় প্রয়োগ ঘটে ১৮৯৯ সালে ব্রিটিশ চলচিত্রকার জর্জ স্মিথের কিস ইন দ্য টানেল  ছবিতে। একটি ট্রেন টানেলে ঢুকছে এবং বেরোচ্ছে – এই গোটাটা দেখানো হয় দুটি আলাদা আলাদা ফ্যান্টম রাইড সিকোয়েন্সের মাধ্যমে। স্বাভাবিক ভাবেই আদিযুগের চলচ্চিত্রের ‘আকর্ষণীয়’ দিকের (সিনেমা অফ অ্যাট্রাকশনস) অন্যতম ছিল এই গতির আকর্ষণ, যেখানে ‘ট্রেন’ এবং ‘ক্যামেরা’ – এই দুই আধুনিক যুগের যন্ত্রের পারস্পরিক দেওয়া নেওয়া বেশ জরুরী হয়ে ঊঠেছিল।

পশ্চিম ইউরোপে ধণতন্ত্র বিকাশের জরুরী এই সময়ে যখন এই ট্রেন-ক্যামেরা পারস্পরিক মেলবন্ধন ঘটছে এবং মানুষ নির্মল আনন্দ পাচ্ছেন (কতকটা ভৃগুর আগের জীবনের বর্ণণার মত), তখনই ইতিহাসে যেন অপেক্ষা করেছিল পরপর দুই ভয়ানক যুদ্ধ এবং তার সবচেয়ে ভয়াল প্রকাশ – কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প-র জন্য। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির নিখুঁত যে মেলবন্ধন একদিকে ইউরোপীয় রেনেসাঁস এবং অন্যদিকে প্রযুক্তিবিদ্যার আশ্চর্য তুলনাহীন যন্ত্র ট্রেন এবং ক্যামেরা তৈরি করেছে, তারাই এবার যেন মানুষকে ঠেলছে আউসভিৎসের দরজায় – আমরা অ্যালা রেনে পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র নাইট অ্যান্ড ফগ  (১৯৫৬) -এ যেন পাব এরকম এক ইতিহাসের ছোঁয়া। ইহুদীদের নিয়ে যাওয়া রেলের ট্র্যাকের কথা বলতে বলতে ছবিতে ক্যামেরা ট্র্যাক করতে থাকে লো এঙ্গেলে, রেললাইনের দিকে তাকিয়ে, যেখানে মাথা তুললে দেখা যায় আউশভিৎসের দরজা (নাইট অ্যান্ড ফগ, ৮.৪০ – ৯.০৭)।

চিত্র

আমাদের আলোচনার জন্য জরুরী এই দ্বিতীয় ছবিটি, চিত্র ছ(২) – যেখানে দূরে ভ্যানটেজ পয়েন্টে দেখা যাচ্ছে আউশভিৎস ক্যাম্প, কোমল গান্ধার-এর ইমেজটির ভ্যান্টেজ পয়েন্টে যেভাবে থাকে কাঠের লাইনের শেষ বিন্দু, কাঠের একটি পাটাতন [চিত্র ছ(৩)] । ঋত্বিক নাইট অ্যান্ড ফগ দেখেছিলেন কীনা জানিনা, ঋত্বিকের সময় সম্ভবত ভারতে স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবির ডিস্ট্রিবিউশন সেভাবে সুলভ ছিল না। কিন্তু নাইট অ্যান্ড ফগ -র ছয় বছর পরে বানানো কোমল গান্ধার-এ, সম্ভবত ঋত্বিকের অভিপ্রায় ব্যতিরেকেই চলে আসে এই ইমেজটির দ্যোতনা, বিশেষত দুজনেই যেখানে এমন এক স্মৃতি নিয়ে কথা বলছেন, “যেখানে ট্রমাটিক ব্যক্তিরা বুঝতে পারেন না কীভাবে সেই বিচ্ছেদকে আবার মনে করবেন”। বস্তুত রক্ত, হত্যা আর নিষ্ঠুরতার এই ভয়ানক ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে দুই অত্যরের (auteur) ক্যামেরা একই স্ট্র্যাটেজি নেয় – টেক্সটে ফাটল তৈরি করা এবং সেই ফাটলে ঢুকে আসা ইতিহাসের ধাক্কাকে জায়গা করে দেওয়া। ঋত্বিকের ইমেজ নির্মাণে তাই দ্যোতনা হিসেবেও জুড়ে থাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের নিষ্ঠুরতার ইতিহাস, যা ইমেজের অন্যান্য অর্থ নির্মাণে আমাদের সাহায্য করতে পারে। 

        কিন্তু আমরা আগেই যা বলেছি, কোমল গান্ধার-এর ‘দোহাই আলি’ দৃশ্য নিয়ে কথা বলতে গেলে শুধু এইটুকুতেই থেমে গেলে হবে না, ফিল্ম টেক্সটে জরুরী আর একটি প্রয়োগও একইরকম গুরুত্ব দিয়ে আমাদের পাঠ করা প্রয়োজন। ভৃগু-অনুসুয়াদের নাট্যদল যখন নানান অন্তর্দন্দ্ব এবং ঝগড়াঝাটি পেরিয়ে আবার একসাথে কাজ করার উদ্যোগ নেয় – এবং ইতিমধ্যে ভৃগু এবং অনুসুয়ার ব্যক্তিগত মানসিক একটি ঘনিষ্ঠতার স্পষ্ট প্রকাশ আমরা দেখতে পাই – তখনই, ছবির একেবারে শেষ প্রান্তে, আমরা জানতে পারি অনুসুয়ার প্রেমিক প্যারিস থেকে চিঠি লিখে অনুসুয়াকে এ দেশ ছেড়ে তার কাছে চলে যেতে বলেছে। [অবধারিত ভাবে এ প্রসঙ্গে ছবির ‘আকর’ সেই প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য, রবীন্দ্রনাথের শকুন্তলা, যেখানে দ্য টেমপেস্ট-র মিরান্দা এবং অভিজ্ঞানম-শকুন্তলম নাটকের শকুন্তলা চরিত্রের মূল পার্থক্যের কথা রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন – দ্বিতীয়জন দেশের মাটির সাথে দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত, প্রথমজন তা নয় (ঠাকুর, ১৯০৭)] এই দৃশ্য এক অর্থে সদ্য আলোচিত ভৃগু-অনুসুয়ার কথপোকথনের দৃশ্যের প্রায় আঙ্গিকগত রিপিটেশন বলা যায়। আমরা দেখি নাটকের রিহার্সালের ঘরে অনুসুয়া ভৃগুকে তার কথা বলছে এবং চকিতে ঋত্বিক ভৃগুর ক্লোজ-আপ ইমেজে নিয়ে আসছেন – যা ভীষণই মনে করায় পদ্মাপারে ওদের আগের সংলাপ-দৃশ্যে (চিত্র ঙ)। এই দৃশ্যের শট-বাই-শট আলোচনা করে এ লেখার ভার বৃদ্ধি করব না – পাঠককে খালি এটুকু স্মরণে রাখতে বলি – কীভাবে একই দৃশ্যে পাশাপাশি পাঁচটি শটে ঋত্বিক চকিতে আলোর প্রয়োগের তারতম্য ঘটিয়ে আগের মতই নাশকতা সৃষ্টি করছেন (চিত্র জ)।

চিত্রঃ জ

বলা বাহুল্য ছয়টি ফ্রেমই একই স্থানে, একই সংলাপের সময় নেওয়া – যেখানে চকিতে আলোর বাড়া-কমা প্রকট হয়ে আসে। সঙ্গে কালীমূর্তির দীর্ঘ, ভয়ানক একটি ক্লোজ-আপ ঋত্বিক নিয়ে আসেন যা প্রায় নন-ডাইজেটিক ইমেজের আমদানি ডায়জেটিক বিশ্বে (আগে আলোচিত, টীকা ৬ দ্রষ্টব্য) – এরও অর্থনির্মাণ নিশ্চই কোনো ঋত্বিক গবেষক তাঁর পাঠে করবেন। আমরা আপাতত মন দেব বিষয়বস্তু এবং আঙ্গিকের সম্পর্কে, যেখানে আগের অংশের কথোপকথনের দৃশ্যের থেকে জরুরী একটি পার্থক্য ঘটে গেছে। আমরা আগে যে কথা বলেছিলাম – বিষয়গত ভাবে ভৃগুর ব্যক্তিগত বিচ্ছেদ ইতিহাস হয়ে সংলাপে কাজ করছে, অন্যদিকে গভীরে, ইমেজে, আঙ্গিকে এই চ্যুতির মুহূর্ত, বিচ্ছেদের ক্ষতচিহ্ন অঙ্কিত হচ্ছে – এখানেও তাই হয় – কিন্তু আখ্যানের কেন্দ্রে চলে আসে অনুসুয়া স্বয়ং। ভৃগুর থেকে আখ্যানের মূল সঙ্কটের কেন্দ্রটি অনুসুয়ার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার এই অত্যন্ত জরুরী সিদ্ধান্তটি আমাদের মাথায় রাখতেই হবে – কারণ, আমরা আগেই বলছি পরবর্তী 'দোহাই আলি'র দৃশ্যে একইভাবে ক্যামেরার ট্র্যাকিং শট এবং শব্দপটে হুবহু একই পলিফনিক শব্দ রাখা থাকে, কিন্তু ইমেজে সেখানে রেললাইন, যোগচিহ্ন-বিয়োগচিহ্ন-কাঁটাতার বা আমাদের পাঠে হলোকাস্টের দ্যোতনা – কিছুই থাকে না। ভাবতে অবাক লাগে, আগে আলোচিত বাফার শটের শব্দপটের হুবহু একই শব্দপট এই ট্র্যাকিং শটেও (চিত্র ঝ) রেখে দিয়ে ঋত্বিক ফিল্ম-টেক্সটের বৃহত্তর কাঠামোয় কোন দ্যোতনা বুনে দিতে চাইলেন, যেখানে, একইসাথে দৃশ্যের কেন্দ্র ভৃগুর থেকে সরে গেল অনুসুয়ার দিকে?

 

                              

                            চিত্র ঝ (১)                                       চিত্র ঝ (২)


 

ঋত্বিক ঘটকের শিল্পবিশ্ব আলোচনায় শিবাজী বন্দোপাধ্যায় অত্যন্ত জরুরী একটি ভাবনায় আমাদের দৃষ্টি দিতে বলেন, যেখানে 'স্মরণ' থেকে ঋত্বিকের ছবির যাত্রা যেন হয় 'প্রতিস্মরণে' (বন্দোপাধ্যায় ২০৫, ২৯০-২৯২)। অর্থাৎ স্বরণ যদি হয় অতীতকে ছুঁয়ে থাকা, অতীতের অনুপস্থিতিতে মানসকল্পনায় অতীতের নির্মাণ করে সেই 'স্মৃতি সংগ্রহ এবং সংরক্ষণে' সুখবিহার করা – প্রতিস্মরণ সরাসরি স্মরণকে আক্রমণ করে – কল্পলোকের এই সুখকর স্মৃতিকে আঘাত করে ইতিহাসের চ্যুত মুহূর্তকে, ক্ষতচিহ্নকে বারবার মনে করিয়ে দেয়। এ প্রসঙ্গে মৈনাক বিশ্বাসের লেখার ঐ দুটি লাইন আবারও পাঠককে মনে করাই – যেখানে একদিকে ‘স্মৃতিকে খুঁড়ে শিকড়ে প্রবেশ’ অন্যদিকে ‘ঐতিহাসিক বিচ্ছেদ, স্থানচ্যুতির মুহূর্তকে চেতনায় ফিরিয়ে আনা'। মৈনাক আর শিবাজীর পাঠ মিলিয়ে পড়লে মনে হয়, মৈনাকের এই দুই ভাবনা যথাক্রমে শিবাজীর ভাবনার 'স্মরণ' আর প্রতিস্মরণ'-এরই অনুরূপ। শিবাজী লেখেন, "ক্রিয়ার আবেগ ছাড়া, প্রতিরোধের তাগিদ ছাড়া, প্রতিস্মরণ সম্ভব হয় না। সাধারণগ্রাহ্য চিহ্নব্যবস্থা এলোমেলো করাতেই তার সার্থকতা। প্রতিস্মরণের চারনেরা তাই বিধিবধ শৃঙ্খলার শ্রী চায় না, চায় কেবল বর্তমানের বিপর্যাস। ...(প্রতি)স্মরণপন্থা যে একধরণের অঘোরপন্থাও" (বন্দোপাধ্যায় ২০১৫, ২৯২)। আমরা বুঝতে পারি, বাস্তবতার স্থিতিশীলতাকে আক্রমণ করতে প্রতিস্মরণ স্মরণের বিপ্রতীপে যে তীব্র আঘাত করে – সেইখান থেকেই প্রথম অংশে আমাদের আলোচ্য বাফার শট ইতিহাসের এই চ্যুতি হিসেবে প্রকট হয়ে ওঠে। আর ছবির অন্তিমে আখ্যানের ভরকেন্দ্র যখন সরে এসেছে অনুসুয়ার দিকে, সেই মূহুর্তটিতে ঋত্বিক যেন আবার এই একই শট ব্যবহার করে অনুসুয়ার ব্যক্তিগত জীবনের একটি সিদ্ধান্তকে দেশভাগের তুল্য প্রতিস্মরণ মুহূর্তের সাথে তুলনা করেন। বিষয়বস্তু হিসেবে এই দুটো জিনিস সম্পূর্ণ আলাদা – একটি সরাসরি ইতিহাসের চ্যুতির মুহূর্ত – আরেকটি একজন ব্যক্তি মানুষের আগামী জীবনের সিদ্ধান্ত। অথচ, আঙ্গিকের প্রয়োগে এই দুই মুহূর্ত হয়ে যায় এক – আমাদের ফিরে ভাবতেই হয়, কেন দেশভাগের চ্যুতির ক্ষত ফিরে আসছে ব্যক্তিমানুষের জীবনের কাহিনীতে (অথবা, দেশভাগের চ্যুতি কেন ব্যক্তিমানুষের আগামী চ্যুতির সম্ভাবনার সঙ্গে তুলনীয়)।

এর দুইটি স্পষ্ট ব্যাখ্যা হয়। একদিকে আছে কোমল গান্ধার-এর 'আকর'-এ প্রাথমিক সেই বাইনারীর কথা – মিরান্দা না শকুন্তলা – কোন জীবনের ভবিতব্য অনুসুয়া বেছে নেবে (ঠাকুর, ১৯০৭)। অর্থাৎ মিরান্দার মত নিজের স্থান ছেড়ে অনুসুয়া কী খুব সহজেই তার প্যারিসের প্রেমিকের সাথে চলে যেতে পারবে, নাকী শকুন্তলার মত তাকেও অরণ্য থেকে উপড়ে নিতে হবে, যেখানে কান্না করে উঠবে গাছের পাতাটিও? একজন ব্যক্তির জীবনের স্থানচ্যুতির প্রশ্নকে ইতিহাসের দ্যোতনার সাথে মিলিয়ে দেওয়ার আরও গভীর ব্যাখ্যা – আমার মতে দ্বিতীয় কারণটি, যা ঋত্বিকের আগের ছবি মেঘে ঢাকা তারা-র প্রায় ‘থিসিস' হিসেবে দাবি করা যায়। একজন নারী যখন বিয়ের সময় তার ভিটে ছেড়ে আসেন – সেই ভিটে হারানোর অপরিসীম যন্ত্রণার দ্যোতক হিসেবে মেঘে ঢাকা তারা জুড়ে যেভাবে 'আয় লো উমা কোলে লই' বেজে চলে – তাতে আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয় না, প্রায় মর্ডানিস্ট শিল্পের একটি ডিভাইস – 'অ্যালিগরি' ব্যবহার করে ঋত্বিক দেশভাগের যন্ত্রণাকে নীতার ভিটে ছেড়ে পাহাড়ে চলে যাওয়ার যন্ত্রণার সাথে তুলনা করছেন। সেখানে নীতার জন্ম জগদ্ধাত্রী পুজোর দিনে – তাই পাহাড় যাত্রা ঋত্বিকের জটিল মিথ-নির্মাণের নেটওয়ার্কে কৈলাস পর্বতে উমার যাত্রার সঙ্গে তুলনীয় – আর তাতেই যেন সারা বাংলা কেঁদে কেঁদে গৌরীদানের গান গাইছে। তাই এক নারীর নিজের ভিটে ছেড়ে যাওয়ার সঙ্গে যে দেশভাগের উদ্বাস্তু মানুষের যন্ত্রণা মিলতে পারে – আর একই সাথে যে পিতৃতান্ত্রিক নিয়মরীতি ইতিহাসের আদিযুগ থেকে বিয়ের সময় কোটি কোটি মেয়েকে তাদের যৌবনে উদ্বাস্তু বানিয়ে ফেলে - এহেন প্রায় বৈপ্লবিক একটি থিসিস ঋত্বিকের ছবিতে প্রকাশ পায়, মূলত আঙ্গিকের মাধ্যমে। আমার বিনীত প্রস্তাব, কোমল গান্ধার –এর দুইটি বাফার শটের বৃহত্তর দ্যোতনা পেতে গেলে আমাদের এই উদ্বাস্তুকরণের কথা মাথায় রাখতে হবে – যেখানে সম্ভাব্য বিয়ের জন্য (যে বিয়ে প্রেমের বিয়ে হলেও) অনুসুয়া নিজের ভিটে ছেড়ে যদি চলে যায় – সে চলে যাওয়া হবে পদ্মাপারের বাফার শটের বিচ্ছেদ বিন্দুর তুলনীয়। অনুসুয়ার ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বিচ্ছেদের মূহুর্তকে দেশভাগের চ্যুতির সঙ্গে তুলনা করেন ঋত্বিক এই শটের মাধ্যমে – যেখানে শব্দপটে আবার আছড়ে ওঠে 'দোহাই আলি' – মূহুর্তে দেশ-কাল-ইতিহাস আর পিতৃতান্ত্রিক শোষণে নারীর কথন এক সারিতে উন্নীত হয়। ইতিহাসের চ্যুতির মূহুর্ত, তার প্রতিস্মরণ, চলে আসে অনুসুয়ার সম্ভাব্য চুতির মূহুর্তে। ক্যামেরা ট্র্যাক করতে করতে অনুসুয়ার মুখের ক্লোজআপে [চিত্র ঝ(২)] (প্রায় বিশ দশকের সোভিয়েত আভা গার্দ চলচ্চিত্রের ইমেজের দ্যোতনা নিয়ে) চলে আসে, দৃশ্য অন্ধকার হয়ে যায়, শব্দপটে ফিরে আসে সেই ভাঙনের শব্দ। ইতিহাস আর ব্যক্তির দুইটি রেখাকে ঋত্বিক জুড়ে দেন আঙ্গিকের প্রয়োগে।

“স্মরণপন্থা যে একধরণের অঘোরপন্থাও”

শিবাজী বন্দোপাধ্যায় (২০১৫, ২৯২)

‘অঘোরপন্থা’ – যে শব্দটির জন্য আমি একান্তই শিবাজী বন্দোপাধ্যায়ের প্রবন্ধটির (যা গ্রন্থপঞ্জীতে উল্লেখিত) কাছে ঋণী – তা নিয়ে ভাবতে বসলে মনে হয়, ঋত্বিকের প্রতিস্মরণের প্রকল্পকে এর চেয়ে ভালো ব্যাখ্যা করতে পারে, এমন শব্দ খুব কমই আছে। সংসদ বাংলা অভিধান শব্দটির দুইটি ভিন্ন অর্থ সূচিত করে – একদিকে তা যেমন “বীভৎস আচারে অভ্যস্ত শৈব সম্প্রদায় বিশেষ”, অন্যদিকে তা “অতি ঘোর, ভীষণ, প্রচন্ড, অত্যধিক”। বস্তুত এই দুইকে এক করে ঋত্বিক ঘটককের ছবি পাঠ করা আলাদা স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রবন্ধ দাবি করে – আমরা আপাতত এর বিশালতা এবং রাগী আক্রমণের দিকে নজর রাখতে চাইছি।

অঘোরপন্থায়, অর্থাৎ চ্যুতির দুই ক্ষণ, এবং তুলির একটানের মতো ইতিহাসের সঙ্গে নারীর ভাষ্য মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার এই ভয়াল মুহূর্ত ঋত্বিকের ছবিতে বারবার ফিরে এসেছে আমাদের সাংস্কৃতিক সুখসন্ধ্যাকে আক্রমণের জন্য। যে মুহূর্তে পদ্মাপারের মেদুরতা দর্শককে মাতাল করে তুলছে, সে মুহূর্তে তিনি নাশকতা চালাতে চাইছেন রেললাইনের বিয়োগচিহ্ন’র দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে – আঙ্গিকে এই সচেতন সক্রিয় বিক্ষেপ নির্মাণ, বলা চলে, ঋত্বিকের আজীবনের চলচ্চিত্রচর্চার সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন। অর্থাৎ স্বাধীনতা না দেশভাগ – এই প্রশ্ন ঋত্বিকের কাছে তীব্র রাজনৈতিক – এখানে পক্ষ নেওয়ার সাথে মিশে আছে তাঁর চেতনাবিশ্বের প্রতিস্মরণ এবং বিচ্ছেদের ক্ষতচিহ্নের দাগ। তাঁর ছবিগুলির নিবিড় পাঠের মাধ্যমে, আমরা খানিকটা আঁচ পেতে পারি, এই চ্যুতির মুহূর্তগুলি নির্মাণের আঙ্গিকগত গুরুত্বের কথা। আঙ্গিকের মধ্যে ফাটল, আর তাতে বিচ্ছেদকে চুঁইয়ে বহমান করে তোলা – এই ছিল ঋত্বিকের অঘোরপন্থার প্রধাণতম সিনেমাটিক হাতিয়ায়।

শেষ করব প্রায় ধাঁধার মত একটা প্রশ্ন দিয়ে। এতক্ষণ আমরা স্বাধীনতা না দেশভাগ – এই বাইনারি নিয়ে কথা বলেছি। একইরকম আরেকটি বাইনারি, তিনি সুবর্ণরেখা ছবির একদম শুরুতে, প্রায় খোলাখুলি দর্শকের জন্য রেখে গেছেন – যা প্রথমদিন চলচ্চিত্রবিদ্যার ক্লাসরুমে শিক্ষক অনিন্দ্য সেনগুপ্ত, আমাদের অনিন্দ্যদা দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়ে মাথায় ধাঁধা লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সুবর্নরেখা-র প্রথম টাইটেলটি পরার পরেই – এই লেখাটি আসে (চিত্র ঞ) –

চিত্র ঞ

ভেবে দেখুন – ছবিটি বানানো ষাটের দশকের শুরুতে – ততদিনে দশ বছরেরও বেশী হয়ে গেছে, ২৬শে জানুয়ারী, ১৯৫০ থেকে দেশ জুড়ে পালিত হচ্ছে প্রজাতন্ত্র দিবস। আর জালিয়ানওয়ালাবাগ দিবস, সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের দিন – তার কী নির্দিষ্ট কোনো দিবস আছে? দেশভাগ দিবস তৈরি করার যেমন প্রয়োজন হয়নি, তেমনই, এও তলিয়ে গেছে বিস্মরণের তলায়। কোন তারিখে হয়েছিল সেই ঘটনা? ১৩ই এপ্রিল, ১৯১৯ – যার সাথে ২৬শে জানুয়ারীর কোনো কষ্টকল্পিত সংযোগও নির্মাণ করা যাবে না। অতএব অঘোরপন্থী ঋত্বিক বললেন, তোমরা যদি প্রজাতন্ত্র দিবস নির্মাণ করতে পারো, আমি তবে জালিয়ানওয়ালাবাগ দিবস বলব – এই আমার প্রচলিত ইতিহাসকে কাউন্টার করার পথ। প্রায় সুকুমার রায়ের মত শব্দের অর্থ বিচ্যুতি ঘটিয়ে দেশ তথা রাষ্ট্রীয় স্মৃতির শিকড়ে সরাসরি নাশকতা চালানোর উদাহরণ এই টাইটেলটি। বস্তুত বলা বাহুল্য – এই নাশকতার জোর এতটাই, ঋত্বিকের অঘোরপন্থা নিয়ে ভাবতে বসলে, এই অংশটি যেন দর্শকের চেতনাতেও আঘাত হানতে থাকে সর্বদা – এর কোনো নির্দিষ্ট ব্যাখ্যায় পৌঁছানো অসম্ভব, তার দরকারও নেই। বরং পাঠককে ভাবার অভ্যেস করার অনুরোধ করেই, এ আলোচনার ইতি টানি।

(ইংরেজী উদ্ধৃতাংশের বাংলায় অনুবাদ সমস্তটাই বর্তমান লেখকের)

(আমার বন্ধু শিমুল সেনের সঙ্গে ঋত্বিক বিষয়ে এক দীর্ঘ আড্ডা এবং সৌম্যদীপ বসুর মতামত লেখাটিকে পরিমার্জনাকরতে সাহায্য করেছে)

 

টীকাঃ

১) স্মৃতিমেদুরতা এবং বিস্মরণ অবশ্যই এক জিনিস নয়। এ নিয়ে এ প্রবন্ধের শেষ অংশে খানিক আলোচনা আছে। আমি “নস্টালজিয়ার বিপ্রতীপেঃ ঋত্বিক ঘটকের পঁচানব্বইতম জন্মদিনে” নামক একটি লেখায় এ প্রসঙ্গে খানিক আলোচনার চেষ্টা করেছিলাম। এই লিংক থেকে পাওয়া যাবেঃ https://sayantankatha.wordpress.com/2020/11/04/%e0%a6%a8%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%9f%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a6%9c%e0%a6%bf%e0%a7%9f%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%aa%e0%a7%87%e0%a6%83-%e0%a6%8b/

 

২) ঋত্বিক জোরালো ভাবে প্রচলিত ১৮০ নিয়মকে লঙ্ঘন করেন, যেমন চিত্র ঙ(১) ও চিত্র ঙ(২) পাশাপাশি দুটো শট-কাউন্টার শট। নিয়মমাফিক হওয়ার কথা ছিল, পারস্পরিক যে স্থানিক যুক্তিতে তাতে তারা দাঁড়িয়ে আছে, তাতে প্রথম শটে ভৃগু ডানদিকে তাকাবে, পরের শটে অনুসুয়া বাঁদিকে। ঋত্বিক এই বিষয়টি উল্টে দেন, ফলে দ্যোতনা তৈরি হয়, অনুসুয়া ভৃগুর দিকে তাকানোর পরিবর্তে বিপরীত দিকে তাকাচ্ছে।

 

৩) ফিল্মে সাধারণত নন-ডায়জেটিক শট বলে কিছু হয় না – কারণ চলচ্চিত্রের গ্রামার বলে, যা দৃশ্যে আছে, ফ্রেমের মধ্যে আছে, তাই ডাইজেটিক – সাধারণত বাইরে থেকে কোনো শব্দ যদি শোনা যায় যে শব্দ ফ্রেমের মধ্যেকার কোনো চরিত্র শুনতে পাচ্ছে না, বা যে শব্দের উৎস ফ্রেমের মধ্যেকার বা কাছাকাছি কোনো স্পেস থেকে আসছে না – তাহলে সেই শব্দকে ‘নন-ডায়জেটিক’ শব্দ বলে। কিন্তু – ঋত্বিক বাফার শটটি (পরের দৃশ্যে একটি কালীমূর্তি) এমনভাবে দৃশ্যের মধ্যেই ব্যবহার করেন, যা যেন দৃশ্যে থেকেও নেই – অর্থাৎ ওঁর ক্যামেরা ব্যবহার ইমেজে যে দ্যোতনা তৈরি করে তা যেন প্রায় নন-ডায়জেটিক ইমেজ হয়ে যায়, চেনা স্থানকে দেখেও মনে হয় বাইরে থেকে আমদানি করা।

 

৪) এ প্রবন্ধেই খানিক পরে আমরা আলোচনা করব এই দুটি পার্সপেক্টিভ পরস্পরের বিপ্রতীপে অবস্থিতঃ ‘স্মৃতিকে খুঁড়ে শিকড়ে প্রবেশ’ আর ‘ঐতিহাসিক বিচ্ছেদ, স্থানচ্যুতির মুহূর্তকে চেতনায় ফিরিয়ে আনা'।

 

৫) তাত্ত্বিক পরিভাষায় যাকে ‘আর্লি সিনেমা’ নামে ডাকা হয়, যেখানে গল্পের যুক্তির বদলে স্পেকট্যাকল নির্মাণ করে ছবি বানানোই প্রধাণ ব্যাপার ছিল (গানিং, ১৯৯০)।

৬) ফরাসী নবতরঙ্গের পরিচালকদের নিয়ে তাঁর বেশ সমস্যা ছিল – একজায়গায় অ্যালা রেনে’র জোর নিন্দেও করেছেন। কিন্তু তাতে আমাদের পাঠের কিছু পরিবর্তন হয় না (ঘটক ২০০৭, ১৭৭)।

 

৭) যেমন ফ্রানৎস কাফকার মেটামরফোসিস, যেভাবে একজন মানুষের পোকা হয়ে যাওয়ায় আধুনিক সভ্যতার ক্লিষ্টতার দ্যোতনা পোরা থাকে।

 

৮) অনিন্দ্য সেনগুপ্ত তাঁর লেখায় বিষয়টি বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন (সেনগুপ্ত ২০১৯)।

 

সহায়ক গ্রন্থ ও প্রবন্ধতালিকাঃ

  • কালিদাস, ২০১৩, ডঃ সত্যনারায়ণ চক্রবর্তী সম্পাদিত, অভিজ্ঞান-শকুন্তলম। সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার। অষ্টম সংস্করণ।

 

  • গানিং, টম ১৯৯০, “দ্য সিনেমা অফ অ্যাট্রাকশনসঃ আর্লি সিনেমা, ইটস স্পেকটেটরস অ্যান্ড দ্য আভা-গার্দ”, টমাস এলসেসার এবং অ্যাডম বার্কার সম্পাদিত আর্লি সিনেমাঃ স্পেস, ফ্রেম, ন্যারেটিভ। ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট, ৫৬-৬২

 

  • ঘটক, ঋত্বিককুমার, ২০০৭, “ছবির ছন্দ ও গ্রন্থনা”, “সমাজে চলচ্চিত্রের স্থান”, চলচ্চিত্র মানুষ এবং আরো কিছু। দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১২৩-১২৫, ১৭৭-১৭৮।

-------------------, ২০০৬, অন দ্য কালচারাল ফ্রন্ট। ঋত্বিক মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, তৃতীয় সংস্করণ।

 

 

  • বিশ্বাস, মৈনাক, ২০০৪, “হার মাদার’স সান: কিনশিপ অ্যান্ড হিস্টরি ইন ঋত্বিক ঘটক”। রুজhttp://www.rouge.com.au/3/ghatak.html
    --------------, ২০১৪ “ফর আ পলিটিকাল সিনেমা টু কাম” ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি, ৩৩: ২৩-২৬।

 

  • বন্দোপাধ্যায়, শিবাজী, ২০১৫, “ঋত্বিক ঘটকের নাগরিকঃ নির্বাস বিরহী যক্ষ”, আলিবাবার গুপ্তভাণ্ডার, গাংচিল। দ্বিতীয় সংস্করণ, দ্বিতীয় সংস্করণ, ২৮৭-৩১০