গানের কাঁটাতার, কাঁটাতারের গান
- 15 August, 2021
- লেখক: শ্রাবন্তী ঘোষাল
ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সমার্থক হিসেবে দেশভাগ শব্দটি ইতিহাসের বিষাদকে মথিত করেছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতা, ঔপনিবেশিক শাসনের বশ্যতা মুক্তির খোলা হাওয়ার পরিবর্তে নিয়ে এসেছে দেশভাগের রক্তাক্ত গ্লানি। ধর্মের ভিত্তিতে দ্বিখণ্ডিত ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ শুধুমাত্র সামাজিক নিরাপত্তার জন্য ভিটেমাটি ছেড়ে পূর্ব-পরিকল্পনা অনুসারে বা রাতারাতি নব্য-স্বাধীন ভূ-খন্ডে বসতি গড়ে তুলেছে। তাদের কাছে এই "স্বাধীনতা" এক প্রতিশ্রুতি মাত্র যার অলীক মোহে দেশভাগের-দেশত্যাগের বেদনা, তারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে নিয়ে গেছেন।
বৃটিশ ঔপনিবেশিক সরকার নিযুক্ত স্যার শেরিল র্যাডক্লিফ প্রায় ৮.৮ কোটি মানুষের বসতি ও সর্বমোট ১,৭৫,০০০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃৃত বাংলা ও পাঞ্জাব উভয় প্রদেশের জনবিন্যাসগত সুষ্ঠু বিভাজন পরিকল্পনার যুগ্মসভাপতি হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন৷ তার প্রস্তাবিত র্যাডক্লিফ লাইন বা র্যাডক্লিফ রেখা হল ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি ও পাঞ্জাব প্রদেশকে বিভাজন করে নবগঠিত ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারনকারী রেখা৷ এই সীমারেখা ব্যবহার করেই অবিভক্ত ভারত ভেঙে ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দে ১৫ই আগস্ট ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হয়। ধর্মভিত্তিক এই বিভাজনের লক্ষ্য ছিল হিন্দু-মুসলিম এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা যাতে তারা নিজেদের মধ্যে হানাহানিতে লিপ্ত থাকে এবং কখনোই অন্য কোন বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে মাথা তুলে না দাঁড়াতে পারে। মুসলিম লীগ ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার কারণে এই "পোকা-খাওয়া" মানচিত্রকেই নিজেদের দেশ হিসেবে মেনে নিয়েছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই নতুন দুই রাষ্ট্র নিজেদের জাতীয়তার নির্মাণে গভীর মনোযোগী হয়ে ওঠে।
উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত বা হিন্দুস্তানী রাগ সঙ্গীতের ক্ষেত্রে স্বাধীনতাজনিত দেশভাগ গভীর প্রভাব বিস্তার করে। আনুমানিক ১২শ শতক থেকে এই সংগীতধারা পশ্চিমে গুজরাট থেকে পূর্বে বারাণসী এবং উত্তরে সিন্ধুপ্রদেশ থেকে দক্ষিণে মধ্যপ্রদেশ পর্য্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। মুঘল রাজদরবারে প্রচলনের মধ্য দিয়ে কন্ঠসংগীত বা খেয়াল প্রসিদ্ধি ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। ভারততত্ত্ববিদ উইলিয়াম জোনসের গবেষণামূলক রচনার মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে এই ধারা বহির্বিশ্বে পরিচিত হয়। শুধুমাত্র কণ্ঠসংগীত নয় মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত সুরবাহার, সেতার প্রভৃতি যন্ত্রও মনোরঞ্জনের জন্য রাজসভায় বাজানো হত।যন্ত্রের তুলনায় কন্ঠের গতিময়তা অনেক বেশি বলে "খেয়াল -গান" সহজেই জনপ্রিয় সংস্কৃতির অংশ হতে পেরেছে।
খেয়াল শব্দটির মূল উৎস পার্সীয়-আরবী ভাষায়, যেখানে এর সমনাম বলতে কল্পনা, ভাবজাগতিক গতিময়তা, সৃষ্টিশীলতা আরো বেশ কিছু ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে। পন্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখন্ডে, যিনি সর্বপ্রথম খেয়ালের মুদ্রিত বই রচনা করেন,বলেছেন, খেয়াল শব্দটির মধ্যে এক ধরনের স্বীকৃতি দেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।ওই সময়ে বহুল প্রচলিত ধ্রুপদ গানে নিয়মনিষ্ঠ এক মান্য কাঠামো ছিল যার বাইরে শিল্পীর নিজস্বতা বা উদ্ভাবনের পরিসর ছিল না। খেয়ালের মধ্যে "আপন মনের মাধুরী মিশায়ে" গান গাওয়ার আনন্দ আছে।
১৩শ শতকের কিংবদন্তী কবি-সুরকার আমীর খসরুর হাত ধরে খেয়াল জনপ্রিয় হতে শুরু করে। কথিত আছে যে তার বাবা ছিলেন মুসলমান ও মা হিন্দু। রাজদরবারে প্রচলিত দেবতা ও রাজার প্রশস্তিসূচক বাণীতে, রাগে বাঁধা ধ্রুপদ গানের লয়বদ্ধ গাণিতিক কাঠামো থেকে আপন খেয়ালে গানের কথার উপর ভিত্তি করে সুরের স্বাধীন চলনের যে ধারা তিনি তৈরী করেন তা খেয়াল নামে সমধিক পরিচিতি অর্জন করেন। যদিও ঠাকুর জয়দেব সিংহ এই প্রসঙ্গে বলেছেন ভারতে এই ধারা অতীতেও ছিল। অষ্টম বা নবম শতকে "সাধারণী শৈলী" হিসেবে খেয়ালের রূপক-আলাপ প্রকরণটি প্রচলিত ছিল।আমীর খসরুর উদ্যোগে খেয়াল মুঘল রাজদরবারের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেম এছাড়াও সেই সময় সুফী সাধনার অঙ্গ হিসেবে কাওয়ালি নামে বৃন্দ গানের প্রচলন ছিল যা মূলত: সুফী পীরের দরগায়,মাজারে গাওয়া হত।আমীর খসরু দিল্লীর নিজামুদ্দীন আউলিয়ার মুরীদ অর্থাৎ শিষ্য ছিলেন। তিনি নিজে অনেক কাওয়ালি গানের বাণী রচনা করেন। তার মাধ্যমেই এই সম্প্রদায়ের গায়নরীতিতে খেয়ালের প্রকরণ প্রচলিত হয়।জৌনপুরের সুলতান হুসেন মুহাম্মদ শরাকি (১৪৫৮-১৪৯৯) থেকে শুরু হয়ে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্য্যন্ত দিল্লির সুলতান মহম্মদ শাহের শাসনামলে খেয়াল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মহাম্মদ শাহের সভাগায়ক সদারঙ্গ ও অদারঙ্গ অজস্র বন্দিশ (খেয়াল গানের পদ) রচনা করেন। সুফী ও ভক্তি এই দুই ধারার প্রভাব একই সাথে খেয়াল ও কাওয়ালিতে লক্ষ করা যায়। হযরত নিজামুদ্দীনের দরগায় দূর দুরান্ত থেকে মানুষ আসতেন। তাদের মাধ্যমেই এই গান ছড়িয়ে পড়ে যা ক্রমশ বিভিন্ন অঞ্চলের লোকসঙ্গীতের ধারার সাথে মিশে ঘরানার জন্ম দেয়। প্রতিটি অঞ্চলের মানববিন্যাস, খাদ্যাভ্যাস, জলবায়ু প্রভৃতি সূচক ঘরানার গায়নরীতিকে স্বাতন্ত্র দিয়েছিল। যেমন-পাঞ্জাবের পাতিয়ালা অঞ্চলের দীর্ঘদেহী পুরুষদের মধ্যে কুস্তি খেলার অভ্যাস ছিল। দাপুটে আওয়াজ এবং সপাট তানের ব্যবহার এই ঘরানার শিল্পীদের বৈশিষ্ট্য। সঙ্গীত গবেষক অমিয়নাথ সান্যাল ধ্রুপদ থেকে খেয়াল গানের এই প্রচলন ও প্রসার সম্বন্ধে বলেছেন, ধ্রুপদ এর সময় যে সঙ্গীত 'aristocratic' ছিল, খেয়ালে এসে তা 'democratic' হলো।
স্বাভাবিকভাবেই মনে করে যায়, যা কিছু রাজদরবারের তা যদি আমজনতার মধ্যে জনপ্রিয় হয়, তবে তা "মুখে মুখে ফেরা মানুষের গান" হয়ে দেশ পাড়ি দেয়। রাজতন্ত্র বদলে যখন সত্যিই দেশে জন-গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বাধীনতা আসে তখন রাষ্ট্রের কাছে শিল্পীর প্রত্যাশা স্বল্পই থাকে যেমন বলেছিলেন,কবি শামসুর রহমান, "স্বাধীনতা তুমি" কবিতায়,
"স্বাধীনতা তুমি
বাগানের ঘর, কোকিলের গান,
বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার
কবিতার খাতা"
স্বাধীন দেশে শিল্পীর ও শিল্পের বিকাশ প্রসঙ্গে তথা উত্তর-স্বাধীনতা সময়ে পাকিস্তানে রাগ সঙ্গীতের অবস্থা নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাতা ইউসুফ সাইদকে লাহোরের ন্যাশনাল কলেজ অফ আর্টসের বর্ষীয়সী অধ্যাপিকা আরিফা সায়েদার দেয়া সাক্ষাৎকারে এই কথারই প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। খেয়াল গানের ক্রমশ জনপ্রিয়তা হারিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, পরাধীন দেশে যে গানের এত রমরমা ছিল, দেশ স্বাধীন হলে তার আরো বিকাশ হবে এটাই তো রাষ্ট্রের কাছে কাম্য। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
১৯৪৭ এর স্বাধীনতা তথা দেশভাগের পর পাঞ্জাব প্রদেশের মুসলিমপ্রধান অঞ্চল পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হলো। সাম চুরাশি (চুরাশিটি গ্রাম নিয়ে গঠিত অঞ্চল) সেই ভাগাভাগিতে পাকিস্তানে গেল এবং ওই অঞ্চলের খেয়াল ঘরানার অপমৃত্যু হলো। বিখ্যাত খেয়ালিয়া নাজাকাত আলি খান ও সালামত আলি খান ভ্রাতৃদ্বয় পাকিস্তানে চলে যান এবং সত্তরের দশকে তাদের মৃত্যুর পর এই ধারা বিলুপ্ত হয়। পাঞ্জাবের শিখ ধর্মগুরু নানক যখন কীর্তণ গাইতেন, তার মুসলিম শিষ্য মর্দানা রবাব নামক তারযন্ত্র বাজাতেন। ক্রমশ ওই অঞ্চলে খেয়ালের যন্ত্রানুসঙ্গ হিসেবে রবাব বাদনের চল শুরু হয়। দেশভাগের পর অধিকাংশ রবাবশিল্পীরা, যারা মুসলিম ছিলেন,পাকিস্তানে চলে যান। শুধুমাত্র পাঞ্জাব নয়, দিল্লী ঘরানার বহু শিল্পী যাদের মধ্যে তবলিয়া ও সারেঙ্গীবাদক অনেকে ছিলেন, তারাও পাকিস্তানে পাড়ি জমান।
দেশভাগকে কেন্দ্র করে কিভাবে খেয়াল গানের ধারায় পরিবর্তন এল সেই বিষয়ে ২০০৭ সালে একটি প্রামাণ্য তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন দিল্লী নিবাসী সঙ্গীত গবেষক ইউসুফ সাইদ। "খেয়াল দর্পণ" নামের এই ছবিতে তিনি ভারত-পাকিস্তান সীমানার কাঁটাতারকে দর্পণ হিসেবে কল্পনা করে তিনি সেখানে খেয়ালের প্রতিবিম্ব দেখতে চেয়েছেন। স্বাধীনতার প্রায় ষাট বছর পরেও পাকিস্তানে গিয়ে এই ধরনের কাজ করে আয়াসসাধ্য ছিল না। কাশ্মীর সমস্যা,সীমান্ত যুদ্ধ,ক্রিকেট প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া ভারতের জনমানসে পাকিস্তান সম্বন্ধে কোন ধারণা নেই। অথচ স্বাধীনতার আগে দুই দেশের সাঙ্গীতিক সম্পর্ক অনেক সহজ ছিল। লাহোরের বর্ষীয়ান খেয়ালিয়া বদরুজ্জামান বলছেন যে, সেই সময় লাহোরে বিভিন্ন অঞ্চলের মসজিদে শুক্রবারের জুম্মার নামাজের পর "জুম্মে কা তাকিয়া" নামে গানের ম্যহফিল হতো। কারো বাড়ির বড় ছাদে কখনো বা মসজিদের চাতালে এই সঙ্গীত সমারোহে বিপুল জনসমাগম হতো এবং অনেকবার পাতিয়ালা ঘরানার কিংবদন্তী বড়ে গুলাম আলী খান সেখানে গেয়েছেন। সাধারণ মানুষ গানের সমঝদার না হলেও স্বত:স্ফূর্ত ভাবে ভালো পরিবেশনকে প্রশংসা করতেন। বিয়ের অনুষ্ঠানে খেয়াল গানের আসর বসতো। এছাড়াও অনেক হিন্দু শিল্পী করাচি রেডিও স্টেশনে চাকরি করেছেন। খেয়াল গান শেখার আগ্রহও ছিল উল্লেখযোগ্য এবং সেই কারণেই সম্ভবত ১৯০১ সালে পন্ডিত বিষ্ণু দিগম্বর পালুস্কর করাচিতে প্রথম সংগীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
দেশভাগের পর আফতাব-এ-মৌসিকি বড়ে গুলাম আলি খান পাকিস্তানে চলে গেলেও ১৯৫০ এর দশকে বোম্বেতে গণপতি উৎসবের অনুষ্ঠানে গাইতে আসেন এবং তার পরে তার বিশেষ অনুরোধ ক্রমে তৎকালীন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী মোরারজী দেশাই তার ভারতীয় নাগরিকত্বের ব্যবস্থা করে দেন।তিনি ভারতেই থেকে যান। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় উস্তাদ আলাউদ্দিন খান এর কথা।দেশভাগের পর তিনি পাকাপাকিভাবে মাইহারে থিতু হন। সাম্প্রতিক কালে মহারাষ্ট্রের একটি হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল মুম্বাইতে পাকিস্তানী গজল শিল্পী গুলাম আলীর অনুষ্ঠান বন্ধ করার জন্য প্রায় দাঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এবং এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানে সরকারী নির্দেশে ভারতীয় টিভি চ্যানেল ও ছায়াছবির প্রদর্শন বন্ধ করে দেয়া হয়। কয়েক বছর আগেই বাংলাদেশের ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়াতে উস্তাদ আলাউদ্দিন খানের পৈতৃক ভিটেতে তার ব্যবহৃত যন্ত্রের প্রদর্শনশালায় মুসলিম মৌলবাদী সংগঠণ আগুন ধরিয়ে দেয় ও ব্যাপক ধ্বংস কার্য চালায়।এসবই যে দেশভাগ নামের বিষবৃক্ষের ফল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
দেশভাগের পরেই ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেই নিজেদের জাতীয় পরিচয় নির্মাণের তোড়জোর শুরু হয়ে যায়। যদিও ভারতের ক্ষেত্রে এই উদ্যোগ সিপাহি বিদ্রোহ পরবর্তী সময় থেকেই দেখা গিয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতার লক্ষ্যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ভারতবাসীকে গৌরবময় অতীতে ফিরিয়ে আনার তত্ত্বে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে। এ অতীত কোন অতীত? এ এক গল্পকথার অতীত, এ সেই সময় যখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীরা দিল্লিতে মসনদ স্থাপন করতে আসে নি। জানকী বাখলে "Two men and Music : Nationalism and the Making of Indian Classical Tradition" প্রবন্ধে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, হিন্দু অতীত পুনুরুত্থানের লক্ষ্যেই বিষ্ণু দিগম্বর পালুস্কর পাকিস্তানে এই উপমহাদেশের প্রথম খেয়াল শেখার বিদ্যালয় স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছিলেন।
স্বাধীনতা পাকিস্তানের জন্ম দিয়েছিল। পাক অর্থাৎ পবিত্র যে স্থান তার পবিত্রতা রক্ষায় এই নতুন রাষ্ট্র প্রথম থেকেই সক্রিয় ছিল। তাই, যা কিছু অ-মুসলিম ও ভারত থেকে আগত তা ছেঁটে ফেলতে সরকার কসুর করেন নি। খেয়ালের শান-শওকত ক্রমে মুছে যেতে লাগল। ইসলামী আদর্শে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে সরকার নিয়ন্ত্রিত বেতার অনুষ্ঠানে খেয়াল অপেক্ষা কাওয়ালি এবং গীত অপেক্ষা গজল বেশি গুরুত্ব পেল। হিন্দু দেবদেবীর নামে নাম থাকার কারণে দুর্গা, শিবরঞ্জনী, শঙ্করা এসব রাগে গায়ন-বাদন নিষিদ্ধ হলো। কাওয়ালি ও গজল গানে খেয়ালের উপাদান অর্থাৎ আলাপ, সরগম, ছুটতান, ধ্রুপদের আঙ্গিকে বোলবিস্তার ইত্যাদি শুরু হয়। খেয়ালের পাশাপাশি উপজাত হিসেবে প্রচলিত ঠুমরী গানের আঙ্গিকেও এল উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। কত্থক নাচের অভিনয় প্রকরণের সাঙ্গীতিক ভাষ্য হিসেবে ঠুমরী গানের উদ্ভব হয়েছিল। এর নামের মধ্যেই ঘুঙুরের ধ্বনি আর শৃঙ্গার রস সম্পৃক্ত। ইসলাম ধর্ম মোতাবেক নাচ হারাম। তাই ঠুংরি গানের লগগি, লচত, অড়ায়েগি, নখরা এসব অংশ বাদ গেল। এদিকে ভারতেও ঠুমরীর বিষয় ও গায়কীতে পরিবর্তন এল। ভক্তিরসের ধারায় তাকে রসসিক্ত করার প্রয়াস শুরু হল। গানের বাণীতে এমন পরিবর্তন আসে যে "রঙরসিয়া কানহা মুরলীওয়ালে", ভগবানরূপে ভক্তের সাথে ঈশ্বরীয় প্রেমে মত্ত হন। মূলত, বাঈজি ও তবায়েফদের মধ্যে ঠুমরী বেশি প্রচলিত ছিল।স্বাধীনতার আগের কয়েকটি বছরে মহাত্মা গান্ধীর শুদ্ধতাবাদী সাংস্কৃতিক আদর্শের বিপুল জনপ্রিয়তার ফলে তাদের অনেকেই পেশা পরিবর্তন করেন। দেশভাগের পর তাদের মূল পৃষ্ঠপোষক রাজন্যবর্গ ও অভিজাত শ্রেণির জীবনে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা উদ্ভুত হওয়ার কারণে তারা পরের প্রজন্মকে অন্য পেশায় নিয়ে আসেন। যেমন-জদ্দান বাঈয়ের কন্যা নার্গিস সবাক চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন। মালিকা-ই-তারান্নুম নামে খ্যাত নায়িকা - গায়িকা নূরজাহান পাকিস্তানে চলে যান।
এভাবে দুই দেশেই এক সাঙ্গীতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়।
১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে স্বাধীন ভারত নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির উদগাতা হিসেবে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে উদ্যোগী হয়েছে। পাকিস্তানের সাথে একটি বিষয়ে তার গভীর মিল। উভয় দেশের সরকারই নিজেদের বিপ্রতীপ (binary) অবস্থান সুনির্দিষ্ট করতে চেয়েছে এবং তাকেই দেশীয় সংস্কৃতি নামে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছে।
"Nations and Nationalism" গ্রন্থে আর্নেস্ট গেলনার এরকম জাতীয়তাবাদ এর প্রসারের কারণ হিসেবে আধুনিকতার সাথে জাতীয়তাবাদের ধারণা সম্পৃক্তির কথা উল্লেখ করেছেন। শিল্পনির্ভর সমাজে রাষ্ট্র যখন উৎপাদনের দায়িত্ব নেয়, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের পাশাপাশি, সংস্কৃতিতে যে সমজাতীয়তার (homogeneity) উপাদান থাকে তা এ ধরনের জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। বহির্বিশ্বে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রসার ও দেশীয় সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতার লক্ষ্যে ১৯৫০ সালের ৯ই এপ্রিল মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী Indian Council for Cultural Relations(ICCR) প্রতিষ্ঠা করেন। অর্থাৎ আশা করা যেতেই পারে যে, রাজা-মহারাজা, নবাব-সুলতানের পরিবর্তে সরকার এবার শিল্পীদের ভাত-কাপড়ের দায়িত্ব নিলেন। কিন্তু লক্ষ্যনীয় বিষয় এই যে,স্বাধীন দুইদেশেই খেয়ালের সমঝদার ছাড়াও আমজনতার যে স্বত:স্ফুর্ত অংশগ্রহণ ছিল,তাতে ক্রমশ ভাটা আসতে শুরু করলেন। পন্ডিত রবিশঙ্কর একটি টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে সেই সময়ে কলকাতা শহরে সাধারণত শীতকালে প্রেক্ষাগৃহে স্বল্পমূল্যের টিকিটে উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর হত। উদ্যোক্তারা একটি লাউডস্পিকারের মুখ হলের বাইরে ঘুরিয়ে দিতেন যাতে টিকিট কাটতে না পারা বিপুল সংখ্যক মানুষ গান- বাজনা শুনতে পান। শীত উপেক্ষা করে রাস্তায় বসে মানুষ সংগীত উপভোগ করতো।
মোটামুটিভাবে পঞ্চাশের দশক থেকে বিশ্বব্যাপী দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সক্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। আমেরিকা ও ইউরোপে ভারতীয় সংস্কৃতির বিষয়ে আগ্রহ তৈরী হয়। ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের কাছে যন্ত্রসংগীতই বেশি সমাদর পায়। ভারত থেকে অনেক বিখ্যাত শিল্পী আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বাস করে,সেই দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে হিন্দুস্তানী সঙ্গীতের শিক্ষাদান করতে শুরু করেন। বিশ্বের বাজারে খেয়াল গানের চাহিদা তুলনামূলক কম হওয়ার কারণে ভারতীয় যন্ত্রসঙ্গীত পাশ্চাত্যের উপযোগী অভিযোজন করে বিদেশে প্রভুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে।বাজার-অর্থনীতির মানদন্ডে গানের মূল্যায়ন শুরু হয়।তাই হিন্দুস্তানী উচ্চাঙ্গ সংগীত, উচ্চমূল্যের দর্শনীর বিনিময়ে শোনা, সমাজের উপরের তলার সংস্কৃতিতে পরিণত হয়।
কোন সমাজেই উচ্চ সংস্কৃতি (High Culture) ও নিম্ন সংস্কৃতির ( Low Culture) এর শ্রেণিভেদ অপ্রচলিত নয়। এ বিষয়ে সামগ্রিক ধারণা এই যে, শিল্পী যখন গ্রাসাচ্ছদনের কোনও চিন্তা ছাড়াই শুধুমাত্র শিল্প সৃষ্টির তাগিদে যে সংগীত, সাহিত্য,চিত্রকলার সৃষ্টি করেন তাই বিশুদ্ধ সংস্কৃতির উপাদান হিসেবে অভিজাত সমাজের প্রশংসা অর্জন করে। আর এর ঠিক বাইরে Low Culture বা জনপ্রিয় সংস্কৃতির ক্ষেত্র। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সাফল্যের জন্য শিল্পী যা নির্মাণ করেন,তা বহুমাত্রিকতার কারণে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। মিশেল ফুকো বলেছেন, যে সংস্কৃতির এই দুই পরিসরেই রাষ্ট্রশক্তি সমান ক্রিয়াশীল। তাই বর্তমান পাকিস্তানের কাওয়ালি শিল্পী বিখ্যাত ঠুংরি "বাজুবন্ধ খুল খুল যায়", কাওয়ালির আঙ্গিকে পরিবেশন করেন। আর পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে "টিকাটুলির মোড়ে সিনেমাহল রয়েছে" নামের চটুল জনপ্রিয় গানে কাওয়ালির আঙ্গিক লক্ষ্য করা যায়।
উভয়দেশের ক্ষেত্রেই আন্তেনিও গ্রামসির Cultural Hegemony র ধারণা এ আলোচনায় প্রাসঙ্গিক। দেশভাগের পর পাকিস্তানে হিন্দুস্তানী সঙ্গীত, রাষ্ট্র নির্ধারিত কাঁচি পার হয়ে মৌসিক-ই-পাকিস্তানী তে পরিণত হয়েছে। আর ভারতে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে হিন্দুস্তানি সঙ্গীত ক্রমশ: হিন্দু সঙ্গীতে পর্যবসিত হয়েছে। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির প্রগতিশীল, আধুনিকতার উত্তরপুরুষ ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী,প্রমথ চৌধুরীর সাথে সহগ্রন্থনায় "হিন্দুসঙ্গীত" নামে যে বই লেখেন সেখানে খেয়ালের প্রসঙ্গে মুঘল শিল্পকলার, সংগীত ধারার অণুষঙ্গের কোন উল্লেখ নেই। মজলিশি আড্ডার গল্পের (সত্যকাহিনী থাকতে পারে) যে সব বই বেস্টসেলার হয়ে বাজার মাতিয়েছে সেখানেও দেশভাগ উত্তর বাস্তবতা কিভাবে গানে প্রভাব ফেলতে শুরু করল,তার বিশেষ ধারণা পাওয়া যায় না। এমনকী কৃতবিদ্য সঙ্গীতবিদগণও এই বিষয়ে বিশেষ আলোকপাত করেন নি। বরঞ্চ দৃশ্যত বিনয়ী স্বনামখ্যাত জনপ্রিয় পন্ডিত তকমাধারী শিল্পী রবীন্দ্রনাথের গানের স্বত্ব উঠে যাওয়ার খোলা হাওয়ায়,তাঁর গানের খেয়ালি রাগরূপ শুদ্ধি করণের প্রয়াসে এক ক্যাসেট গান বাজারজাত করেন। "লাল গানে নীল সুর " হাসি হাসি গন্ধের বদলে সমীহ আর সম্ভ্রম আদায় করে। বাজার অর্থনীতির যুগে এই তো চাই!
বিংশ শতকের শুরুর দিকে রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীত প্রসঙ্গে যা লিখেছিলেন তা ভবিষ্যতের ছবি তুলে ধরে। তাঁর পর্যবেক্ষণ অনায়াসে বর্তমান সময়ের সাথে মিলে যায়।
"আমাদের দেশে সংগীত এমনি শাস্ত্রগত, ব্যাকরণগত, অনুষ্ঠানগত হইয়া পড়িয়াছে, স্বাভাবিকতা হইতে এত দূরে চলিয়া গিয়াছে যে, অনুভাবের সহিত সংগীতের বিচ্ছেদ হইয়াছে, কেবল কতকগুলা সুসমষ্টির কর্দম এবং রাগরাগিণীর ছাঁচ ও কাঠামো অবশিষ্ট রহিয়াছে; সংগীত একটি মৃত্তিকাময়ী প্রতিমা হইয়া পড়িয়াছে-তাহাতে হৃদয় নাই, প্রাণ নাই। এইরূপ একই ছাঁচে-ঢালা, অপরিবর্তনশীল সংগীতের জড়প্রতিমা আমাদের দেবদেবীমূর্তির ন্যায় বহুকাল হইতে চলিয়া আসিতেছে।"
এভাবেই দেশভাগের বিয়োগব্যথা বুকে নিয়ে স্বাধীনতা পঁচাত্তরের প্রৌঢ়ত্ব অর্জন করে। আখতারপ্রিয় নবাবের জন্মদিনের দুশোতম বছরে তার নির্বাসিত জীবনের মাটির শহর মেটিয়াবুরুজের ইমামবড়ার গম্বুজের পূর্বকোণে ভোর হয়। নিজের আঙিনা বিদেশ হয়ে যাওয়ার বিয়োগব্যথার সুর ছেনে ললিত রাগে "যোগিয়া মেরে ঘর আয়ে" ধরেন উস্তাদ আমীর খান যিনি বলেছিলেন, সঙ্গীত ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি নয় বলে তার বাঁটোয়ারা হয় না। সঙ্গীত আসলে সুর যা কাঁটাতারের সীমানা না মেনে অবিরাম অনন্তের পথে বয়ে চলে।উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতের শেষ কিংবদন্তী এই কলাকার এ বছরের ১৫ই আগস্টে ১১০ বছরে পা দিলেন।
সহায়ক বইপত্র
১/ সুরের সন্ধানে - অমিয়নাথ সান্যাল
২/ স্মৃতির অতলে - ঐ
২/ সঙ্গীতচিন্তা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৩/ মজলিশ - কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
৪/ কুদরত রঙ্গিবিরঙ্গী - ঐ
৫/ তহজীব-ই-মৌসিক - জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ
৬/ Hindustani Music : A tradition in transition - Deepak Raja
৭/ Indology and Ethnomusicology : Contours of the Indo-British Relationship - Ashoke Da Ranade
এছাড়া vimeo.com এর সহায়তায় পাওয়া "Khayal Darpan" তথ্যচিত্র এবং গুগল অনুসন্ধানের সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য।
পরিশেষে আমার শ্রুতি ও স্মৃতি যারা আলোকিত করেছেন সেসব সঙ্গীতকারদের শিল্পের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।