নারীর মুক্তি ও নানা বিতর্ক : স্বাধীনতা আন্দোলনের আগে পরে

স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর সামনেই। দেশের স্বাধীনতা উৎযাপনের সঙ্গে সঙ্গে দেশের নাগরিক হিসেবে একটা চাওয়া পাওয়ার হিসেবও সামনে চলে আসে। এই প্রেক্ষিতে শুধু নাগরিক নয় নারী অধিকারের প্রশ্নটাও গুরুত্বপূর্ণ। নারী অধিকারের জন্য আন্দোলন আজকের নয়। ভারতীয় নারী আন্দোলনের ইতিহাস সুদীর্ঘ ও বিচিত্র। এই লেখায় আমি ভারতীয় নারী আন্দোলনের গতিপ্রকৃতিকেই বোঝার চেষ্টা করেছি। আমি এখানে দেখাবার চেষ্টা করেছি সাম্প্রতিক ভারতীয় নারীবাদী আন্দোলন মূলধারার গণআন্দোলনের সঙ্গে একযোগে কাজ করছে, তা সে নাগরিকপঞ্জিকে ঘিরে আন্দোলন হোক বা কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন। এই দুই আন্দোলনেই নারীর অংশগ্রহণ স্বতঃস্ফুর্ত। প্রশ্ন উঠেছে নারী আন্দোলন কতটা তার স্বকীয়তা বজায়ে রাখছে বা কতটা তা অন্য গণআন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে উঠছে। এর জন্য প্রয়োজন ভারতীয় নারীবাদী আন্দোলনের একটা ঐতিহাসিক মূল্যায়ণ।  

    ভারতীয় নারী আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি পশ্চিমের থেকে একটু ভিন্ন। ভারতীয় নারী আন্দোলনকে পশ্চিমের মত ‘ফার্ষ্ট ওয়েভ’  ‘সেকেন্ড ওয়েভে’ বিভাজিত করা মুশকিল। নারী আন্দোলনের চরিত্র বুঝতে গেলে তার  ঔপনিবেশিক পটভূমিকে মাথায় রাখতে  হবে। ভারতীয় নারী আন্দোলনের সূত্রপাত সমাজ সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে থেকে যা শুরু  হয়েছিল  উচ্চবর্ণের শিক্ষিত পুরুষদের নেতৃত্বে। উনিশ শতকের গোড়ার দিক থেকেই বাংলা ও মহারাষ্ট্রে সমাজ সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে বাল বিবাহ, বর্ণ প্রথা, সতী দাহ ইত্যাদি প্রাক আধুনিক প্রথার সমালোচনা দেখা যায়। পশ্চিমী শিক্ষার প্রসারের ফলে এক নতুন শ্রেণী তৈরী হয়ে যারা ব্রিটিশ প্রভুদের আস্থাভজন হয়ে ওঠে এবং এরাই এই সমাজ সংস্কার আন্দোলনের পুরোধা। ১৮১৫ খ্রীষ্টাব্দে আত্মীয়সভায়ে মহিলাদের শিক্ষার প্রসঙ্গটা প্রথম ওঠে। সেই বছরই রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে লেখা শুরু করেন। ১৮৫০ এর গোড়ার দিকে ঈশ্বচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের পক্ষে জনমত সংগ্রহ করতে শুরু করেন। মহারাষ্ট্রে এই সময় জ্যাতিরাও ফুলে বর্ণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ও নারী শিক্ষার পক্ষে সরব হন। 

      অনেকক্ষেত্রেই নারীর দুর্দশা মোচনের পিছনে ছিল সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের চোখে নিজেদের ‘সভ্য’ প্রমাণের প্রচেষ্টা। তবে এই সমাজ সংস্কার আন্দোলনই ছিল স্বাধীন নারী আন্দোলনের বীজ। এই সমাজ সংস্কারের ফল দেখা যেতে শুরু করে উনিশ শতকের শেষের দিকে। ১৮৮২ তে তারাবাঈ সিন্ধের “স্ত্রী পুরুষ তুলনা” প্রকাশ পায় পুনে থেকে। ১৮৮৭ সালে  রমাবাই লেখেন “The High Caste Hindu Women”। দুটো লেখাই পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোতে মেয়েদের অবস্থান স্পষ্ট করে তলে। এই সময় থেকে অল্প হলেও মহিলারা বাইরে বের হতে শুরু করেন। ১৮৮৯ এর কংগ্রেস অধিবেশনে দশজন মহিলা অংশগ্রহণ করেন। তবে ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দলোনেই মহিলারা প্রথম অনেক সংখ্যায়ে বাইরে বের হন। 

    নারী আন্দোলনের এই পর্যায় চলে উনিশ শতকের মধ্যেভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশক পর্যন্ত। ১৯২৭ এ অল ইন্ডিয়া উইমেনস কনফারেন্স গঠনের মাধ্যমে পুরুষের নেতৃত্বের বাইরে স্বাধীন নারী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকেই স্বশাসিত নারী সংগঠনের সূত্রপাত এবং ১৯৩০ এর দশক থেকেই সামাজিক ক্ষেত্রে নারীর সক্রিয়তা স্পষ্ট হতে থাকে। এই সময় থেকে নারী সক্রিয়ভাবে  গণআন্দোলনে অংশগ্রহণ করছে মূলত স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে। গোড়ার দিকের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে মাদাম কামা ও অ্যানি বেসান্তের নাম অবশ্য উল্লেখ্য। পরের দিকে গান্ধির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোনল শুরু হলে মহিলারা তাতে ব্যাপক হারে অংশগ্রহণ করে। ১৯২৫ সালে সরোজিনী নাইডু কংগ্রেসের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯১০-২০ র দশকে সর্বভারতীয় মহিলা সংগঠন স্থাপণের একটা প্রচেষ্টা দেখা যায়।  ১৯০৮ এ মাদ্রাজে মহিলা পরিষদ বা লেডিস কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। এটাকেই প্রথম সর্বভারতীয় নারী সংগঠন বলা যায়ে। ১৯১৭ তে অ্যানি বেসান্ত প্রতিষ্ঠা করেন ওম্যানস ইন্ডিয় অ্যাসোসিয়েশন। এই সমস্ত সংগঠন গুলোর সম্মিলিত রূপ আমরা দেখি ১৯২৭ এর  অল ইন্ডিয়া ওম্যানস কনফারেন্স প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ১৯৩০-৪০ দশকের  নারী আন্দোলনের প্রধান মুখপাত্র হয়ে ওঠে অল ইন্ডিয়া ওম্যানস কনফারেন্স।  ১৯৩০র পর থেকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপেও মহিলাদের অংশগ্রহণ দেখা যায়। শান্তি ঘোষ, সুনীতি চৌধুরী, প্রীতিলতা ওয়াদেদর প্রভৃতিরা গুরুত্বপূর্ণ  ভুমিকা নেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই ভারতীয় নারীকে মাতৃমূর্তি  বা  দেশজননী হিসেবে দেখা শুরু হয়। সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ডে মায়ের প্রতিরক্ষামূলক রূপ গুরুত্ব পায় তো গান্ধিবাদী আন্দোলনে মায়ের আত্মত্যাগকে গৌরবান্বিত করা হয়। 

      ১৯৩০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত নারী আন্দোলনে নারী পুরুষ সমতাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। অর্থাৎ কিনা নারী পুরুষের সঙ্গে সমানাধিকারের দাবীদার কারণ নারী মানুষ হিসেবে পুরুষের সমান। পরবর্তী পর্যায় গুরুত্ব পায় নারী পুরুষের ভিন্নতা। নারী পুরুষের থেকে পৃথক এবং নারীর পৃথক চাহিদা ও গুরুত্ব রয়েছে। ১৯৭০ থেকেই নারী আন্দোলনের এই চরিত্র বদল দেখা যায়। এই  সময় থেকেই নারী আন্দোলনে নারীকেন্দ্রিক বিষয় গুরুত্ব পায়। স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারতীয় মহিলাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলে সংবিধানে নারীর সামানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্বাধীন ভারতে মহিলারা প্রথম থেকেই ভোটাধিকার পান। পশ্চিমে যে অধিকারের জন্য মহিলাদের আলাদা করে লড়াই করতে হয়েছিল ভারতে সেই অধিকার মহিলারা পান গণআন্দোলনে অংশ গ্রহণের স্বীকৃতি স্বরূপ। স্বাভাবিক ভাবেই স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রের কাছে মহিলাদের প্রত্যাশা ছিল যথেষ্ট। সেই কারণেই স্বাধীনতউত্তর ভারতে মহিলারা তাদের নারী পরিচিতির উর্দ্ধে উঠে সামগ্রিক ভাবে দেশ গঠনের  দিকে মন দিয়েছিলেন।  

    স্বাধীন ভারতে নারী আন্দোলন তাই সেভাবে দানা বাঁধেনি। তবে ৪৬-৪৭ এর তেভাগা ও তেলাঙ্গানা আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। ৭০ এর দশকের গোড়ার দিকে বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত আন্দোলন দেখা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শাহাদা, চিপকো, SEWA ও নব নির্মাণ আন্দোলন । শাহাদা আন্দোলন মূলত ভূমিহীন ভীল জনগোষ্ঠীর আন্দোলন। এই আন্দোলন ছিল আঞ্চলিক ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে। মহিলাদের ব্যাপক অংশগ্রহণ এই আন্দোলনকে লিঙ্গ সাম্যের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তুলেছিল। স্ত্রীর উপর অত্যাচার ও মদের বিরোধিতার মত বিষয় এই আন্দোলনের মুখ্য কর্মসূচীর মধ্যে চলে আসে। ১৯৭২ এ আমেদাবাদে ইলা ভাটের নেতৃত্বে  টেক্সটাইল লেবর অ্যাসোসিয়েশন এর মহিলা শাখা সেল্ফ এমপ্লয়েড ওম্যান অ্যাসোসিয়েশন (SEWA) মহিলা শ্রমিকদের সুরক্ষার উদ্দেশ্যে আন্দোলন সংগঠিত হয়। ১৯৭৪ এ নব নির্মাণ আন্দোলন ছিল মূলত কালবাজারি, মূল্যবৃদ্ধি, দূর্নীতির বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন। পরবর্তী কালে এটা একটা গণআন্দোলনের রূপ নেয় যেখানে বহু মধ্যবিত্ত মহিলা অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৩ এ গাড়োয়াল, কুমায়ন আঞ্চলে গাছ সংরক্ষণকে ঘিরে একটা আন্দোলনের সূত্রপাত হয় যা চিপকো আন্দোলন নামে পরিচিত। সুন্দরলাল বহুগুনা ও চণ্ডি প্রসাদের  নেতৃত্বে এই আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল প্রচুর। তবে এই গণআন্দোলনগুলোর কোন সার্বিক চরিত্র নেই। কখনও এই আন্দোলনগুলো লিঙ্গসাম্যের প্রশ্নকে আত্তীকরণ করতে সক্ষম কখনও বা পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোকে প্রশ্ন না করেই অধিকারের লড়াইয়ে সোচ্চার। 

     কিন্তু ১৯৭৪ এ ‘Towards Equality Report’ নারীবাদীদের মোহভঙ্গ করে। সংবিধানের প্রতিশ্রুতি ও বাস্তব অবস্থার মধ্যে ফারাকটা চোখে পড়ে। শিক্ষা, রাজনীতি, সামাজিক সর্বক্ষেত্রে নারীর অদর্শন নতুন করে সত্তরের দশকে  নারী সমস্যাকে সামনে নিয়ে আসে। দ্রুত বর্ধনশীল নারী সংগঠন গুলো নারীর উপর ঘটতে থাকা হিংসাকে প্রশ্ন করে। এই সময় থেকে দেখা যায় ধর্ষন, পণ, ভ্রুণহত্যা ও ঘরোয়া সহিংসতার মত বিষয় নারী আন্দোলনের কেন্দ্রে আসছে। সত্তরের দশকের শেষভাগ থেকেই পরিবারের ভিতর নারী নির্যাতনকে পারিবারিক সমস্যা বা ব্যাক্তিগত বিষয়ের গন্ডি থেকে বের করে আনার চেষ্টা হতে শুরু করে। ১৯৭৯ থেকে পণপ্রথার বিরুদ্ধে জনমত গঠন শুরু হয়। এই একই সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে  মহিলাদের উপর ভূস্বামী, মালিক থেকে পুলিশ ও সামরিক বাহিনী কতৃক ধর্ষনের ঘটনা সামনে আসতে থাকে। কিন্তু এই সমস্ত ঘটনার প্রতিবাদ ছিল আঞ্চলিক। ১৯৮০র দশকে মথুরা রেপ কেসের পর ধর্ষনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সর্বভারতীয় মাত্রা পায়। 

     উনিশশো সত্তর থেকেই   নারীর নিজের শরীরের উপর অধিকার ও তার সঙ্গে সম্পর্কিত রাজনীতি গুরুত্ব পায়। এই সময় থেকেই পশ্চিমের নারী আন্দোলনের জনপ্রিয় স্লোগান ‘personal is political’ ভারতের প্রেক্ষাপটেও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। বিবাহিত সম্পর্কের ভিতর ধর্ষন, যৌনকর্মীর ধর্ষন, প্রযুক্তি দিয়ে মহিলাদের শরীরে প্রজনন নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয় গুলো উঠে আসতে শুরু করে। এই আন্দোলন গুলো সরাসরি পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোকে প্রশ্ন করতে সক্ষম এবং উনিশ শতকের মত বিষয় গুলো আর বৃহত্তর সমাজ সংস্কারের অংশ নয়। বরঞ্চ নারীর অধিকারের প্রশ্ন। অনেক ক্ষেত্রে এগুলো ছিল শহরের শিক্ষিত মহিলাদের দাবী। চরিত্রগত দিক থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের পর্যায় থেকে এই দাবীগুলো ছিল ভিন্ন। এখানে  জাতিসত্তা গোষ্ঠীসত্তার চেয়ে গুরুত্ব পেয়েছ নারীসত্তা।  

       আশির দশকের মধ্যভাগ থেকেই ভারতে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিকাশ দেখা যায় এবং নারী আন্দোলনকে পশ্চিমী, শহুরে ও উচ্চবর্ণের মহিলাদের আন্দোলন বলে চিহ্নিত করা শুরু হয়ে। এই সময় যেহেতু পরিবারের ভিতর নারীর অবস্থান নারী আন্দোলনের প্রধান উদ্বেগ হয়ে ওঠে, তাই বিবাহ বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার ইত্যাদি বিষয়গুলো সামনে আসতে থাকে। ভারতে এই বিষয়গুলো ‘ব্যাক্তিগত আইনের’ অধীন যা ধর্ম ও গোষ্ঠী ভিত্তিক। ১৯৮৫ তে শাহবানু মামলায় সুপ্রীম কোর্ট পঁচাত্তর বছর বয়সী শাহ বানুর রক্ষণাবেক্ষণের ভার তার স্বামীকে নিতে  বাধ্য করে। নারী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এটা গুরুত্বপূর্ণ  রায় হলেও এই রায় ব্যাক্তিগত আইন নিয়ে বিতর্কের সূচনা করে। একদিকে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির দাবী, অপরদিকে ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার লড়াইয়ের মধ্যে নারীর অধিকারের প্রশ্নটা গৌণ হয়ে ওঠে। ১৯৮৪ পরবর্তী রাম জন্মভূমি আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এই বিতর্ক বিশেষ মাত্রা পায়। ১৯৮৭ এ রাজস্থানে রূপ কানোয়ারের সতী হবার ঘটনা নারী আন্দোলনকে আবারও  ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য, গোষ্ঠীর সায়ত্ত শাসন, রাষ্ট্র ও আইনের ভূমিকা ইত্যাদি প্রশ্নে বিতর্কের মধ্যে ফেলে। মোটের উপর দেখা যায় আশির দশক থেকেই নারী আন্দোলনকে প্রবলভাবে মৌলবাদী শক্তির মোকাবিলা করতে হয়। উনিশশো আশির দশকে নারী সংগঠনগুলো বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী রাজনিতীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। বর্ণ, ভাষা, ধর্ম ইত্যাদির নিরিখে নারীর অবদমনকে দেখার প্রয়োজন তৈরী হয়। ফলে নারী আন্দোলনে একটা দোটানা দেখা যায়। সামগ্রিক ভাবে নারী হিসেবে বঞ্চনার অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে নাকি বর্ণ,ধর্ম, সম্প্রদায় ইত্যাদির ভিতর থেকে উঠে আসা খণ্ড আত্মপরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়া হবে - এই নিয়ে বিতর্ক চলে।

৯০ এর দশকের একটা গুরুত্বপূর্ণ  পদক্ষেপ হল বিশাখা রায়। ১৯৯৭ এ কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে এই বিল পাশ করা হয়। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দাবী এই সময় উঠে আসে তা হল মহিলা সংরক্ষণ বিল। এই বিল সরকারের বিভিন্ন স্তরে মহিলাদের জন্য ৩৩% সংরক্ষণ দাবী করে। ১৯৯৬ এ এই বিল প্রথম উত্থাপিত হলেও আজও লোকসভায়ে এই বিল পাশ হয়েনি। একবিংশ শতাব্দীর  গুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্তির মধ্যে হল ২০০৫ এ গার্হস্থ্য হিংসা আইন ও ২০১৯ এ তিন তালাক রোধ। এছাড়াও বেশ কিছু আন্দোলনের কথা বলা যায়। ২০১২ তে নির্ভয়া রেপ কেসকে ঘিরে আন্দোলন বা ২০১৫ এ জামিয়া মিলিয়ার ছাত্রী আন্দোলন পিজ্ঞ্ররা তোর ইত্যাদি। ২০১৮ এ স্যানিটারি ন্যাপকিনে জি এস টি ছাড় বা সাবরিমালা মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশাধিকারের মত বিষয়ে আন্দোলন দেখা যায়। এই সমস্ত বিক্ষিপ্ত আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে সর্বভারতীয় স্তরে দেখা যায় এন আর সি বিরোধী আন্দোলন। ২০১৯ থেকে শাহিনবাগ আন্দোলন এরই বহিঃপ্রকাশ। 

আসলে ভারতীয় নারী আন্দোলনের চরিত্র বহুবিধ ও বহুমাত্রিক। একটা কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে একে বেঁধে ফেলা যায়না। তবে এটা বলা যায় সত্তরের দশকের পর থেকে লিঙ্গসাম্যের প্রশ্নটাতে নারীর স্বতন্ত্র আত্মপরিচয় যতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে জাতীয় আন্দোলনের পর্যায় তা দেখা যায়নি। সাম্প্রতিক গণআন্দোলনও যেন অনেকটাই জাতীয় আন্দোলনের আদলেই প্রকাশ পাচ্ছে। নাগরিক অধিকারকে কেন্দ্র করে যে গণআন্দোলন তা যেন এক বিষাক্ত মৌলবাদী পৌরুষের বিরুদ্ধে নারীসুলভ বিরোধিতা।  

    লেখাটা শেষ করতে চাই সাম্প্রতিক নারী আন্দোলনের চরিত্র অনুধাবন করে।  যদি সাম্প্রতিকতম নারীআন্দোলনের কথা বলতে হয় তবে বোধহয় শাহিনবাগ আন্দোলনের কথাই উল্লেখ করতে হয়। শহিনবাগ আন্দোলন মূলত এন আর সি বিরোধী আন্দোলোন হলেও কৃষক আন্দোলনের সমর্থক।  শাহিনবাগ আন্দোলনে বহুল সংখ্যক মেয়েদের অংশগ্রহণ একটা ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। প্রশ্নটা হল বহুল পরিমাণ মেয়েদের অংশ গ্রহণই কি আন্দোলনকে নারীবাদী করে তুলতে পারে ? আন্দোলনকারীরা বহুল সংখ্যায় মহিলা হলেও কোন নারী বিষয়ক প্রশ্ন কিন্তু এই আন্দোলন থেকে উঠে আসছেনা। এখানে প্রকাশ পাচ্ছে দেশচ্যুত হবার উদ্বেগ বা অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবার উদ্বেগ। নারীর  পৃথক সত্ত্বার কথা আন্দোলনকারীরা একবারও তুলে ধরছেন না। বরঞ্চ তারা বলছেন আইন ও ন্যায়ের কথা। প্রশ্ন উঠেছে আইন কি ন্যায়ের জন্য নাকি আইন ন্যায়ের পরিপন্থী। যেটা দেখার বিষয় এখানে খন্ড আত্মপরিচয়ের উর্দ্ধে নাগরিকের সত্তা প্রধান হয়ে উঠেছে। তাই  ন্যায়ের জন্য যে আইন অমান্য সেখানে বহুল অংশে নারীর অংশগ্রহণ হলেও নারীর লিঙ্গ পরিচয় গুরুত্ব পাচ্ছে না। নারী এখানে  লড়াই করছে দমনমূলক রাষ্ট্রে বিরুদ্ধে তার নাগরিক অধিকারের জন্য। এই আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করছে বিভিন্ন স্তরের মেয়েরা। ছাত্রী,  আইনজীবী, সমাজকর্মী থেকে গৃহবধূ সবাই। অনেকেই এই প্রথম কোন জনসমাবেশে যোগদান করছেন। এদের অনেকেরই বাইরের জগতে বেরোনোর অভিজ্ঞতা প্রায় নেই। কিন্তু কেন এই অংশগ্রহণ ? এন আর সি বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে ভাবা যেতেই পারে যে নতুন নাগরিকপঞ্জিতে  অঙ্গীভূত হবার জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্র মহিলাদের কাছে তুলনামূলক ভাবে কম রয়েছে । জমিজমার দলিলে অনেকক্ষেত্রেই মেয়েদের নাম থাকে না এবং বিবাহসূত্রে ঠিকানা বদল ও নাম পরিবর্তন বিষয়টাকে আরও জটিল করে তুলেছে। তাই মহিলাদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বেশী। কিন্তু  মহিলারা যে শুধুমাত্র তাদের নাগরিক অধিকার নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ তা নয়। তারা পরিবার তথা  সন্তানের ভবিষ্যৎ  নিয়েও ভাবিত। বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি পরিবারের স্বার্থে মহিলারা গণআন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছে। বেতন বৃদ্ধি থেকে পরিবেশ রক্ষা সমস্ত আন্দোলনেই আমরা দেখেছি মহিলারা এসেছেন পরিবার পরিজনের কথা ভেবে। তবে এই গণআন্দোলন গুলোর নারীবাদী চরিত্র কোথায় ? আদেও কি কোন ভাবে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোকে প্রশ্ন করা  হচ্ছে ? এটা ঠিকই যে সব গণআন্দোলনের  চরিত্র পিতৃতন্ত্র বিরোধী হয়না। কিন্তু ব্যাপকহারে নারীর অংশগ্রহণ নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যাকে দেখতে বা আন্দোলনের গতিপথকে লিঙ্গসাম্যের দিকে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। এর  একটা বড় উদাহরণ  বোধহয় আমাদের সংবিধানে লিঙ্গসাম্যের অঙ্গীকার। জাতীয় আন্দোলনে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণই স্বাধীনতাউত্তর এই সাংবিধানিক সাম্যকে নিশ্চিত করতে পেরেছে।  যদিও কার্যক্ষেত্রে তার যথাযথ প্রয়োগ হয়নি। শাহিনবাগ আন্দোলনের ক্ষেত্রে বলা যায় নারীর এই ব্যাপক অংশগ্রহণের পিছনে রয়েছে সামাজিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের বহিষ্করণের  অভিজ্ঞতা। মেয়েরা তাদের জীবনের অভিজ্ঞতায় সহজ ভাবেই বোঝে বাদ পড়ে যাবার রাজনীতি তাই নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়ে যাওয়া যে  কি ভয়ানক হতে পারে তাদের কাছে স্পষ্ট। নারী হিসেবে যে অ-সাম্য তারা সহ্য করে এসেছে সেই অভিজ্ঞতা দিয়েই তারা নাগরিক অধিকারের প্রশ্নটার সঙ্গে একাত্ম হয়। আর তাই শাহিনবাগের  আন্দোলন নারীবাদী চরিত্র পায়।  

  আশি বা নব্বইয়ের দশকের নারী আন্দোলনে নারী হিসেবে বঞ্চনা যতটা সামনে এসেছে এই আন্দোলনগুলো তা নয়। তবে একটা কথা এ প্রসঙ্গে বলা ভাল নারীর খন্ড আত্মপরিচয়ের উর্দ্ধে উঠে আন্দোলনে যোগদান,  সামগ্রিক ভাবে গোষ্ঠী বা জাতির জন্য সাম্যের লড়াই সবসময় রাজনৈতিক ভাবে ফলপ্রসু না-ও হতে পারে। অনেকক্ষেত্রেই খন্ড আত্মপরিচয়ের ভিত্তিতে রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অনেক সময় এইসব খন্ড আত্মপরিচয়ের মধ্যে সংঘাতও সৃষ্টি হয়। আবার  অনেক ক্ষেত্রে একাধিক খন্ডপরিচয় পরিপূরকতা পায় যেমন পরাধীন ভারতের প্রেক্ষাপটে লিঙ্গসাম্যের  রাজনীতির সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনীতি। তবে বর্তমানের গণআন্দোলনের নারীবাদী চরিত্র অনেকটাই জাতীয় আন্দোলনের  সময়কার নারী অভ্যুত্থানের কথাই মনে করিয়ে দেয়। এই জাতীয় সংকটের মুহুর্তে নারী হিসেবে পরিচিতি যেন ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরঞ্চ ভারতীয় নাগরিক এই পরিচিতিই গুরুত্বপূর্ণ।  

আজ যখন ভারতীয় নারী আন্দোলনের ইতিহাস আলোচিত হচ্ছে তখন একটা প্রশ্ন উঠে আসছে। প্রশ্ন হল, সাম্প্রতিক নারীআন্দোলনের চরিত্র কি কোথাও নারীর খণ্ড আত্মপরিচয় থেকে বেড়তে গিয়ে স্বকীয়তা হারাচ্ছে? আমার মনে হয়ে প্রশ্নটা আরেকটু জটিল করে দেখা উচিত। আমাদের মাথায়ে রাখা উচিত ভারতীয় নারীআন্দোলনের ধারা বিবিধ ও বহুমাত্রিক। কোন ক্ষেত্রে তা পিতৃতান্ত্রিক বয়ানের বিরুদ্ধে নারীকেন্দ্রিক দাবীতে সোচ্চার, কখনও বা পিতৃতান্ত্রিক বয়ানের ভিতর থেকেই বিভিন্ন অসাম্যের বিরোধিতা করে। তাই বিভিন্ন গণআন্দোলনের সঙ্গে অঙ্গীভূত হওয়া নারীআন্দোলনের কোন চটজলদি মূল্যায়ণ উচিত নয়। আমাদের মাথায়ে রাখতে হবে নারী তার বঞ্চনার অভিজ্ঞতা দিয়ে বিবিধ অসাম্য বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে আত্মস্থ হতে পারে এবং সেই আন্দোলনকে লিঙ্গ রাজনীতির প্রতি সহানুভূতিশীল করে তুলতে পারে।