দেশভাগ : হিংসা, ক্ষত, মানব মনস্তত্ত্ব
- 15 August, 2021
- লেখক: পাঞ্চজন্য ঘটক
আরেকটি স্বাধীনতা দিবস | আরেকটি দেশভাগ দিবস | স্বাধীনতা দিবস নিয়ে নানা উৎসবের ভেতর দেশভাগের কথা ভাবে এখনো কেউ ? আমি প্রত্যেক বছর ১৫ই আগস্ট বিলেতের এক প্রান্তে বসে স্বাধীনতা দিবসের সঙ্গে দেশভাগের কথাও ভাবি | ছেলেকে বলি দেশভাগের কথা | দেশভাগ এখনো খুবই প্রাসঙ্গিক বলেই চিন্তা ভাবনা গুলো মাথায় ভিড় করে আসে | কেন প্রাসঙ্গিক ? দেশভাগের দগদগে ক্ষত এখনো ভীষণভাবে বর্তমান | কাশ্মীর সমস্যার এখনো সমাধান তো হয়ই নি -- নানা ভাবে জটিল হয়ে উঠছে ক্রমশঃ | এখনো কে কোন দেশের নাগরিক -- তার নথিপত্র নিয়ে হিসেব নিকেশ শেষ তো হয়ইনি, বরং নতুন করে বাগ বিতন্ডা তৈরী হচ্ছে | নতুন বিল আসছে | তার ফলশ্রুতি কি হবে এখনো পরিষ্কার নয় | জাতি ধর্মের ফাটল নতুন করে দেখা দিচ্ছে | দেশভাগের ফলে সৃষ্ট তিনটি দেশের ভেতর স্বাভাবিক যাতায়াত দূরে থাকুক, দিনকে দিন রাজনৈতিক দূরত্ব বাড়ছে | চিকিৎসা - শিক্ষা - সামাজিক খাতে যেই অর্থ খরচ হতে পারতো, সেই খরচ হচ্ছে যুদ্ধের প্রস্তুতিতে | ইউরোপীয় অনেক দেশের ভেতর এই বৈরীভাব ছিল বহুদিন পর্যন্ত | কমে এসেছে এখন | সহযোগিতার বাতাবরণ কমবেশি দেখা গেছে বেশ কিছু দশক ধরে | একটা কথা চালু আছে – Those who forget history find themselves condemned to repeat it. আমরা বোধহয় ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে পারিনি | বরং সোশ্যাল মিডিয়াতে ইতিহাস বিকৃতির মারাত্মক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে | বহুমাত্রিক জটিল সমস্যার অতিসরলীকরণ করা হচ্ছে অনেক সময় | মানুষ ইতিহাসের বিভিন্ন সূত্র না পড়ে, না জেনে বিশ্বাস করে নিচ্ছেন সোশ্যাল মিডিয়ার উদ্দেশ্য প্রণোদিত বিকৃত তত্ত্ব ও তথ্য | আমার মনে হয় দেশভাগ নিয়ে জানতে গেলে একটা emotional distance গড়ে তোলা দরকার বিষয়টি সমন্ধে | কাজটি সোজা নয় | বিষয়টি স্পর্শকাতর | অনেক পরিবারে, অনেক সম্প্রদায়ে দেশভাগের বীভৎস অভিজ্ঞতা শুনে অনেকে বড়ো হয়েছেন | তার থেকে বেরিয়ে আসা সোজা নয় | তবে বেরিয়ে না আসতে পারলে একটা সম্যক ধারণা গড়ে তোলা মুশকিল এই ব্যাপারে | দেশভাগের বিভিন্ন দিক যদি আমরা প্রতিফলন করতে না পারি আজকেও, তাহলে সমস্যা চলতেই থাকবে |
ইতিহাসের কিছু আপেক্ষিকতা আছে -- যাকে রিলেটিভিটি অফ ফ্যাক্টস বলা যেতে পারে |
দেশভাগের ইতিহাস চার ভাগে বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে:
১ | সরকারি স্তরে যে রাজনীতি হয়েছিল -- ব্রিটেনে এবং দিল্লিতে
২ | দেশভাগের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব -- জিন্নাহ, গান্ধীজি, নেহেরু, প্যাটেল, মাউন্টব্যাটেন, মৌলানা আজাদ প্রভৃতির ব্যক্তিত্ব, তাঁদের দ্বন্দ্ব ও সংঘাত
৩ | দেশভাগ সংক্রান্ত হিংসা ও আগ্রাসন
৪ | দেশভাগের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব
দেশভাগের মনস্তত্ব নিয়ে খুব একটা বেশি বই লেখা হয়েছে কি না আমার ঠিক জানা নেই | তবে সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে এই বিষয়টি নিয়ে অনেকটা চিন্তা ভাবনা করি আমি | আমার কাজ মানুষের অপরাধ আর হিংসামূলক ব্যবহার নিয়ে | দেশভাগের আগে ও পরে মানুষের হিংসা আমাকে খুব ভাবায় | হত্যা ধর্ষণের সীমাহীন সংখ্যা আমাকে ভাবায় | ভাবায় হত্যার বীভৎসতা | বাঙালি ৪৩ এর দুর্ভিক্ষে মারা যায় লাখে লাখে | সেই সময়ের খুব একটা হিংসার কথা পড়া যায় না | কি হলো তার বছর তিনেকের ভেতর যাতে মানুষ বদলে গেল আমূল ? কি হয়েছিল ৪৩ আর ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্টের সেই দুপুরের ভেতর ? সেদিন দুপুরে যেই হিংসা শুরু হয়, বন্ধ হয়েছে কি তা এখনো ? Great Calcutta Killing এ পাঁচ দিনেই আনুমানিক ৪ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয় | তারপর ৪৬ এর অক্টোবরে নোয়াখালির দাঙ্গা | পাঞ্জাব - বিহারের দাঙ্গা | ৬৪, ৭১, ৯২ , ২০০২ এর দাঙ্গা | মৃত্যু মিছিল শেষ হয়নি | ব্রিটিশ ভেদনীতি আর বৃহত্তর রাজনীতির দাবার চাল দিয়ে কি এই হিংসার পুরোপুরি ব্যাখ্যা হয় ? নাকি মনের অন্ধকার কোণে উঁকি মেরে দেখার জন্য দরকার মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা ? এই বিষয়ের স্টাডি ডিসাইন করা সোজা নয় | সময়ের খাদে হারিয়ে গেছে অনেক স্মৃতি | অনেক জীবন | তবু প্রয়োজনীয়তা থেকেই যায় |
মানুষ যে হিংস্র প্রজাতি তা নিয়ে বোধহয় কোনো সংশয় নেই | কিছু ইঁদুরশ্রেণীর প্রজাতি ছাড়া, তেমন কোনো কারণ ছাড়াই নিজের প্রজাতিকে ধ্বংস করার উদাহরণ জীবজগতে খুব বেশি নেই | হিংস্র ব্যবহারকে জান্তব বলায় তাই আমার ঘোর আপত্তি | এই ধ্বংসাত্মক মানব ব্যবহার ইতিহাসের বিভিন্ন সময় ঘনীভূত হয়েছে | যেমন হয় দেশভাগকে কেন্দ্র করে |
হিংস্রতা কি জন্মগত ? Instinct না learned behaviour ? এই নিয়ে মনোবৈজ্ঞানিকদের ভেতর বিতর্ক আছে | অন্যান্য জন্তুদের মতো, বিভিন্ন অবস্থায় মানুষের physiology র রকমফেরে শরীরের ভেতর নানা জৈবরাসায়ণিক প্রকাশ হয় হিংস্রতার ভেতর দিয়ে | এই ব্যবহারকে instinctive ধরা যেতে পারে | দুটি ক্রুদ্ধ বেড়ালের ব্যবহারে খুব একটা তফাত দেখতে পাওয়া যায় না | দুটি ক্রোধান্বিত মানুষের physiological বিক্রিয়া এক হলেও, ব্যবহারের বহিঃপ্রকাশে কিন্তু তফাত থেকে যায় | তাই মানুষের হিংস্রতাকে পুরোপুরি instinctive বলে ধরে নেওয়া একটু মুশকিল |
ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত হিংস্রতার তফাত আছে | একটি সমষ্টি - দেশ, জাতি বা ধর্ম, অন্য একটি সমষ্টির আক্রমণের মুখে নিজেদের বিভেদ বা ব্যক্তিগত সত্তা ভুলে অনেকটাই এক হয়ে যায় | নিজের সমষ্টির রক্ষণার্থে | একটি সমষ্টির আপাত শান্তিপ্রিয় মানুষ যদি মনে করে তার গোষ্ঠী বা সমষ্টি আক্রান্ত, তার ব্যবহার পাল্টে যেতে সময় লাগে না | এমনি সময়ে হয়তো একটা মুরগিও যে কাটতে পারেনি, দেশভাগের সময় তার হাতেই খুন হয়েছে একাধিক মানুষ -- এরকম উদাহরণের অভাব নেই | নিজের সত্তাকে বিসর্জন দেওয়ার এই প্রবণতা দেখা যায় নিজের গোষ্ঠীর প্রতি real বা perceived threat অনুভব করলে | দেশভাগের সময় এই বোধ তুঙ্গে উঠেছিল |
প্রায় সব জন্তুর মতো, মানুষ নিজের territory বা অঞ্চল রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর | এই territory মানুষের নিজের বাড়ি, ধর্ম, রাজ্য বা দেশ হতে পারে | Territory র জটিলতার সঙ্গে তার রক্ষা করার প্রক্রিয়াও জটিলতর হয়ে ওঠে | একটি ছোট বাড়ির রক্ষা একটি তালা দেওয়া দরজা দিয়েই হতে পারে | একটি ধর্ম বা দেশের রক্ষার জন্য কিন্তু প্রয়োজন হয় নানা নিয়মের জটাজাল | সুসংবদ্ধ সৈন্যদল | Security বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা সাধারণত ত্রি-স্তরীয় -- physical , procedural ও relational | একটি বাড়ির সুরক্ষার জন্য একটি পাঁচিল লাগে, একটি দেশের সুরক্ষার জন্য লাগে কাঁটাতার, সীমান্তরক্ষী -- এটা physical security | একটি ধর্মের মানুষ অন্য একটি ধর্মের মানুষকে বিয়ে করতে পারবে না, ধর্মের স্বাতন্ত্র বজায় রাখার জন্য -- এটা procedural security | একটি পরিবার বা জাতি যদি নিজেদের সদস্যদের ভেতর ভালো সম্পর্ক আর বোঝাপড়া বজায় রাখে -- তাহলে এই সদস্য সমষ্টির বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করবে না -- এটা relational security |
এই মনোবৈজ্ঞানিক চিন্তা দেশভাগের ক্ষেত্রে কিভাবে কার্যকর হয়েছিলো, তার দিকে একটু তাকানো যাক | মানসিক ক্ষত (trauma) মাপা সহজ নয়, তবে কিছু পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে ক্ষতের ব্যাপ্তি নিয়ে খানিক ধারণা করা যেতে পারে | দেশভাগের হিংসায় অনুমান করা হয় প্রায় এক লক্ষ মানুষ মারা যান | আশিস নন্দীর সাম্প্রতিক গবেষণায় মৃতের সংখ্যা ২ লক্ষ বলা হয়েছে | জয়ন্তী বসুর মতে এই সংখ্যা ৩.৫ লক্ষ | গৃহহীন হন ১ কোটি ৬০ লক্ষ থেকে ১ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ | পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম আর হয় নি | হিন্দু, মুসলিম , শিখরা মূলত ছিন্নমূল হন - বহু প্রজন্মের ভিটেমাটি থেকে | এর ওপর ছিল নারীদের ওপর বীভৎস যৌন উৎপীড়ণ | ১ লাখের বেশি নারী ধর্ষিতা হন | ৩০ হাজারের বেশি নারীকে অপহরণ করা হয় যৌন লিপ্সা পূরণের জন্য | এঁদের বেশির ভাগের কোনো হদিশ পাওয়া যায় নি |
এই ছোট লেখায় বিশদে যাওয়ার সুযোগ কম | তাই কিছু বুলেট পয়েন্ট দেওয়ার চেষ্টা করছি দেশভাগের নিয়ে :
১ | হিন্দু -মুসলিমের ভেতর বৈরীভাব বহু পুরোনো | ভারতে ইসলামের প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই শুরু হয় হিংসা |
২ | ইংরেজরা থিতু হয়ে বসার আগেও বহু সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয়েছে |
৩ | ব্রিটিশদের Divide and Rule policy মূলত দায়ী হিন্দু-মুসলিমদের বৈরীভাবের জন্য -- এটি অতিসরলীকরণ | ব্রিটিশরাজের অবসানের বহু বছর পরেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে | হয়ে চলেছে | ব্রিটিশরাজের নীতি অবশ্যই এই সমস্যায় আগুন যুগিয়েছে | তবে আগুন আগেও ছিল, পরেও আছে |
৪ | ব্রিটিশরাজের আগে দীর্ঘকাল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ছিল মুসলিম শাসকের অধীনে | কিন্তু হিন্দুদের সামাজিক ছুৎমার্গের নীতির ফলে দুই ধর্মের মানুষের দুস্তর দূরত্ব ছিল | এই ছুৎমার্গ মুসলিম সমাজের ভেতর দীর্ঘকালীন trauma জিইয়ে রেখেছে |
৫ | ব্রিটিশরাজের আমলে হিন্দুদের শিক্ষা - আর্থ - সামাজিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া, মুসলিমদের পক্ষে যন্ত্রণাময় ছিল | দেশের শাসনভার থেকে ধীরে ধীরে পিছলে যাওয়া, মুসলিমদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হয় নি |
৬ | স্বাধীনতা, ২০০ বছরের ব্রিটিশরাজের ফলে বদলে যাওয়া ইতিহাসের point of restitution বা সামাজিক অবস্থানের পুনরুদ্ধারের সিযোগ নিয়ে আসে দুই সম্প্রদায়ের সামনে |
৭ | এই যুগসন্ধিক্ষণে বহু রাজনৈতিক প্রক্রিয়া - রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জটিল জ্যামিতিতে উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ঘোলাটে হয়ে ওঠে |
৮ | এই সব কিছুর প্রেক্ষাপটে আমাদের হিংসার মনোবিজ্ঞানকে বোঝার শক্ত কাজ করতে হবে | যদি এতে চলতে থাকা সাম্প্রদায়িক বিষাক্ত পরিবেশ খানিকটা তরল হয় | ইতিহাস যেন ফিরে না আসে আবার |
এই কাজ সহজ নয় | প্রাথমিক সমস্যা - ইতিহাসের সঙ্গে মনোবিজ্ঞানের সম্পর্ক বেশ জটিল | ইতিহাস মূলত সংখ্যা, ঘটনাপ্রবাহের মতো বাহ্যিক দিক বোঝার চেষ্টা করে | মনোবিজ্ঞান মানুষের ভেতরের চিন্তাধারা বোঝার চেষ্টা করে | কিভাবে মনের ভেতরের চিন্তার বহিঃপ্রকাশ হয় বহির্জগতে -- সেই যোগসূত্র পাওয়া সহজ নয় | মনোবিজ্ঞানীদের সুযোগ হয় না ইতিহাসের প্রধান ব্যক্তিদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের | গান্ধী বা জিন্নার মতো মানুষদের মনের ভেতরে কি আছে, তা অধরাই থেকে যায় | Hypothesise করতে হয় তাঁদের চিন্তার বহিঃপ্রকাশ দেখে | তাঁদের কার্য তাঁদের চিন্তার প্রতিফলন করবে সব সময় -- তার কোনো মানে নেই |
সাধারণ মানুষের চোখ বা স্মৃতি দিয়েও দেশভাগের ক্ষত বা হিংসা বোঝা সহজ নয় | যত দিন যায় -- স্মৃতির ওপর ততো প্রলেপ পড়ে | কখনো বা আরো দগদগে হয়ে ওঠে স্মৃতি | ঠিক সেই ঐতিহাসিক ক্ষণে মনের অবস্থা কেমন ছিল, তা বোঝা শক্ত হতে পারে তার জন্য | মূলত কেস history মূলক রিসার্চের ভিত্তিতে বোঝার চেষ্টা করেছেন জয়ন্তী বসের মতো কিছু মনোবৈজ্ঞানিক | ওঁর Reconstructing The Bengal Partition বইটি পড়া দরকার -- যাঁরা এই বিষয়ে একটু গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করতে চান |
এই লেখার শুরুতে মানব ব্যবহারের মনোবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা নিয়ে কিছু কথা বলেছিলাম | দেশভাগের পটভূমিতে এই psychological driving factors একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক |
স্বাধীনতার প্রাক্কালে স্বাধীনোত্তর ক্ষমতা কার হাতে থাকবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয় | সমষ্টি বিপন্ন -- এরকম এক ধারণা মানুষের ভেতর ঢুকে যায় | ধার্মিক সমষ্টি যখন বিপন্ন বোধ করে, তার রক্ষার্থে মানুষ অনেকদূর যেতে পারে | ইতিহাসে বার বার দেখা গিয়েছে -- ক্যাথলিক - প্রোটেস্টান্টদের লড়াইতে, Crusade এর সময় | মানব ইতিহাস ধর্মযুদ্ধের নরমেধ যজ্ঞে দীর্ণ | এই বিপন্নতার সমাধান সূত্র হিসেবে গতি পায় দ্বি-জাতিতত্ব | এই ধারণার আভাস ছিল লালা লাজপতের ভাবনায় ১৯২৫ সালে | ১৯৩০ এ ইকবালের মননে দানা বাঁধে এই তত্ব | পরবর্তীকালে জিন্না এই তত্বকে এগিয়ে নিয়ে যান | নানা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত করেন | মুসলিম সাম্প্রদায়িক ভাবনা আর ব্রিটিশ ভেদনীতির সাথে উচ্চশ্রেণীর হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক ভাবনার ভূমিকাও মনে রাখা দরকার | জয়া চ্যাটার্জি তাঁর Bengal Divided বইতে এই বিষয়ে তাঁর গবেষণালব্ধ দৃষ্টিভঙ্গি বিশদে লিখেছেন |
হিন্দু - মুসলিম ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশরাজের সময়কালে একটি unstable equilibrium এ থাকতো | এই অনিশ্চয়তার মুখে দুটি আলাদা দেশ এক নিরাপত্তার চিন্তা রোপণ করে | দেশ মানেই এক নিরাপত্তা -- physical , procedural ও relational | এই বোধ মানুষের ভেতর একবার ঢুকে গেলে, বেরোনো খুব মুশকিল | ইতিহাসে তাই দেখা যায় নতুন নতুন দেশের দাবি | রক্তক্ষয়ী দীর্ঘসংগ্রাম | মানচিত্রের পরিবর্তন | দেশ মানেই কিছু মানুষের নেতা থেকে দেশনেতা হয়ে ওঠা | নেতৃত্ব, শাসন, ক্ষমতাভোগ | ক্ষমতার অলিন্দে থাকার সুবিধে | দেশের সম্ভাব্য নেতৃত্ব, মানুষকে খেপিয়ে তুলে যদি নতুন দেশের ব্যবস্থা করে ফেলতে পারেন -- নেতাদের রাজনৈতিক ক্ষমতাভোগের ব্যবস্থা পাকা হয় | দেশের আবেগের সঙ্গে যদি যোগ হয় ধর্মীয় আবেগ - এক নিদারুণ দ্বিমাত্রিক উন্মাদনার সৃষ্টি হয় | এই উন্মাদনার সব উপাদানই ভারতীয় উপমহাদেশে সেই সময়ে ছিল | এর ফলশ্রুতি তাই হয় ভয়ানক |
দেশভাগের দাঙ্গায় নারীদের প্রতি যৌন নির্যাতন নিয়ে বিশদ আলোচনা প্রয়োজন | তৎকালীন কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক নেতা কি এই যৌন উৎপীড়নের কথা বলেছেন ? তবু ভীষণভাবে হয়েছে ধর্ষণ | শিশুদের জ্বলন্ত তন্দুরে ফেলে হত্যা | যারা এই অপরাধ করেছে, তাদের বেশির ভাগ কিন্তু দাগি আসামী বা যৌন অপরাধী ছিল না | দেশভাগের আগে মোটামুটি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতেন এরা | পরেও হয়তো ফিরে গিয়েছেন স্বাভাবিক জীবনে | Psychoanalyst মনোবৈজ্ঞানিকরা যৌনতার সঙ্গে হিংস্রতার সম্পর্ক নিয়ে অনেক কাজ করেছেন | মোটামুটিভাবে বলা যায় , যৌন আবেগ মানুষ স্বাভাবিক সামাজিক ও ন্যায়ের বাঁধনের জন্য অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখে | দাঙ্গার ডামাডোলে যেখানে ন্যায়ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, সেই সময় বহু মানুষ তাদের অবদমিত যৌন ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রয়োজন মনে করে না | লিপ্ত হয় যৌন উৎপীড়নে | ধর্ষণে |
দেশভাগের হিংসার গভীর মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে | এই লেখায় কিছু বিষয় ছুঁয়ে গেলাম মাত্র | এই গভীর সমস্যার সমাধান সম্ভব যুক্তিনির্ভর বোঝাপড়ার মাধ্যমে | দেশভাগের পর তৃতীয় প্রজন্ম এসে গেছে | এবার চলুন , আমরা একসাথে বাঁচি | পৃথিবী, নিজেদের দেখিয়ে দি -- আমরা একসাথে বাঁচতে পারি |
তথ্যসূত্র :
জয়া চ্যাটার্জি - Bengal Divided
Anthony Storr - Human Aggression
কল্যাণ মণ্ডল - ১৯৪৬ - ৪৭ এর ধর্ম -সাম্প্রদায়িক গণনাশন
শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় - দাঙ্গার ইতিহাস