দেশভাগ বনাম দুর্বল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো

ঠিক যেরকম দেশভাগ আরএসএস-হিন্দু মহাসভা চেয়েছিল, তেমন হয়নি। মহাত্মা গান্ধী তা হতে দেননি। যে গান্ধীজী জায়াকার এবং মুনজেকে এত প্রশ্রয় দিয়েছিলেন, তিনিই কি না শেষে এসে এভাবে তরী ডোবাবেন তা আরএসএস-এর কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন সফলভাবে হল না। হিন্দু মুসলিম জনগণ ভৌগোলিকভাবে অবিচ্ছেদ্য। প্রতিটি গ্রাম, প্রতিটি মহল্লায় তারা একসাথে বসবাস করতেন। ফলে দেশভাগ সহজ ছিল না। ভৌগোলিক বিচ্ছেদের জন্য দাঙ্গা দরকার ছিল। কলকাতার রাস্তায় ৬ হাজার লাশ পড়লো, হিন্দুরা মুসলিম প্রধান অঞ্চল ছেড়ে পালালেন। মুসলিমরাও একইভাবে মুসলিম প্রধান অঞ্চল বেছে নিলেন। অর্থাৎ দেশভাগের কাজ এগোলো, রিহার্সাল হল। কিন্তু কাজটা সুসম্পন্ন হতে দিলেন না গান্ধী। নোয়াখালিতে গিয়ে তিনি বসে পড়লেন, দাঙ্গা থামালেন। আরএসএস-এর ভাষায় হিন্দুদের আত্মরক্ষা করার সুযোগ দিলেন না তিনি। ফলে মুসলিমদের মনে যে চূড়ান্ত ভীতি জন্ম নিয়েছিল তা কিছুটা প্রশমিত হল। ভিটে ছাড়লেন না অনেকেই, গান্ধীজীর আবেদনে সাড়া দিয়ে। ভারতে থেকে গেলেন তারা। হিন্দু রাষ্ট্রের বাস্তব ভিত্তি থাকল না। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বিজেপি আজও জিততে পারছে না। এই বাংলায় এখন প্রায় ৩০% মুসলিম মানুষ। গান্ধীজীকে যে খুন হতেই হবে, তা বলাই বাহুল্য। দেশভাগ যে ‘সফল’ হল না তার জন্য নেহরুও কম দায়ী নন। শেষ বেলায় এসে নেহরুকে করা হল দলের সভাপতি, প্যাটেলকে কিছুতেই নয়। কারণ যিনি সভাপতি হবেন তিনিই প্রথম প্রধানমন্ত্রী। নাস্তিক নেহরুকে আসন্ন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পেয়ে মুসলিমরা নিশ্চিন্ত হলেন, এদেশে থেকে গেলেন। নেহরু নাস্তিক, তাই কিছুতেই হিন্দুত্ববাদী নন। হিন্দু রাষ্ট্রের বাস্তব ভিত্তি আবার চুরমার হল।

আরএসএস যেমনটা চেয়েছিল, তেমন না হলেও, তবু দেশভাগ হয়েছিল।

দেশভাগ অবশ্যম্ভাবী ছিল না

দেশভাগ আটকানো যেত। লুজ কনফেডারেশান বা দুর্বল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকেই একমাত্র বিকল্প কাঠামো হিসেবে হাজির করলে দেশ ভাগ হতো না। শিশু রাষ্ট্র হিসেবে কয়েক বছর দুর্বল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বহাল রেখে আগামী দিনে ফেডারেশান বা তুলনায় শক্তিশালী কেন্দ্রের দিকে এগোতে পারতো ঐক্যবদ্ধ ভারত। সবল রাজ্য ও দুর্বল কেন্দ্র, এই কাঠামোর পক্ষে যদি কম্যুনিস্টরা জোরদার সওয়াল করতে পারতেন তবে পরিস্থিতি অন্যরকম হতো। কম্যুনিস্ট পার্টি শেষ পর্যন্ত এই আওয়াজ তুলেছিল। ১৯৪২ সালে, যখন যুদ্ধে জেতার দরকার হয়েছিল, যখন জোটের দরকার হয়েছিল। কিন্তু, সাম্রাজ্যবাদী ক্রীপস মিশন ও ক্যাবিনেট মিশনের সমান্তরালভাবে তারা সেই প্রস্তাব দিয়েছেন। যার অর্থ হল সাম্রাজ্যবাদের মধ্যস্থতায় কোনো আপোষ হবে না। এবং শেষবেলায় পৌছে কংগ্রেস নেতৃত্ব এই যুক্তিতেই ক্যাবিনেট মিশন প্রত্যাখ্যান করে। অথচ ভারতের মুসলিম ও দলিত মানুষদের (মুসলিম সম্ভ্রান্ত ও ধনীদের পিছনে ছিল জনগণ, অস্পৃশ্য নিম্নবর্ণের ক্ষেত্রেও তা সত্যি) কাছে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের মধ্যস্থতায় অধিকার আদায় করা ছিল প্রথম শর্ত। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, এই দুর্বল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর দিকে এগোনোর চেষ্টা করেনি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি। তাও আবার সমাজতন্ত্র বা সামন্ততন্ত্র বিরোধিতার অজুহাতে! আরও দুর্ভাগ্য হল পরাধীন ভারতের মুসলমান ও অস্পৃশ্য নিম্নবর্ণের জনগণ দেখলেন যে ভারতের কম্যুনিস্ট ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির তুলনায় ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ বেশী ‘গণতান্ত্রিক’। স্বাধীন ভারতের কেন্দ্র সরকার অতি দুর্বল হলে রাজন্য বর্গ প্রশ্রয় পাবে, তাই এই ফর্মূলা মানা যাবে না--- শেষ পর্যন্ত এটাই ছিল ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির অজুহাত। যদিও আসল কারণ ছিল মুসলিম লীগ, আম্বেদকার, পেরিয়ার সহ প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সাথে সর্বদলীয় জোট সরকার করার অনীহা। যে ফাঁদে কম্যুনিস্টরা সহজেই পা দিয়েছিলেন। সংবিধানসভার মাথা হিসেবেই স্বাধীন ভারতে আম্বেদকার বলেছিলেন, “ভারতীয়দের মধ্যে সংবিধান নিয়ে একটাই বিরোধের জায়গা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোটি কেমন হবে। যুগ্ম তালিকার বিষয়গুলো কি হবে, কেন্দ্রের হাতে যাবে নাকি রাজ্যের হাতে”। তিনি ভালোই জানতেন যে এই বিরোধের জন্ম পরাধীন আমল থেকেই। ১৯১৯ সাল থেকেই তিনি ইংরেজদের কাছে স্মারকলিপি জমা দিচ্ছেন পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর দাবীতে। ১৯০৯ সাল থেকে মুসলিম নেতারাও তাই চেয়েছিলেন স্মারকলিপি মারফত। ক্রমেই সেই পৃথক নির্বাচকমন্ডলীর দাবি বদলে গেল রাজ্যের বিন্যাস, দুর্বল কেন্দ্র, স্বশাসিত রাজ্যের কাঠামোর দাবীতে। শেষ পর্যন্ত যা স্বশাসিত রাজ্যগুলির পৃথক হওয়ার অধিকার, দুটি জাতি হিসেবে কেন্দ্রে সমান প্রতিনিধিত্বে গিয়ে শেষ হয়। নীতিগত ভাবে ভারতের কম্যুনিস্টদের অসুবিধা হওয়ার কথা ছিল না। ১৯২২ সালে কমরেড মানবেন্দ্রনাথ রায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সপক্ষে লিখেছেন। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের অধীনে একটি দেশে, স্বাধীনতা না পেয়েই সাম্রাজ্যবাদ অনুসৃত সংস্কারকে সমালোচনামুলক সমর্থন করার কথা তারা ভাবেননি।

কম্যুনিস্টদের কাছে বিড়ম্বনা নিশ্চয়ই এটাই ছিল যে সাম্রাজ্যবাদের প্রশাসকরাই এই কাঠামোকে ভারতের একমাত্র সমাধান হিসেবে হাজির করেছিলেন। সে কুপল্যান্ড হোন বা পেন্ডেরেল মুন। মিশর ও আয়ারল্যান্ডের মডেল তাদের ছিল। তাদের ঠিক কি কি উদ্দেশ্য ছিল, তা এখানে আলোচ্য নয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের অর্থনীতি ধ্বসে গেছিল। ফলে এদেশে দুর্বল কেন্দ্রের সুযোগ নিয়ে রাজন্য বর্গের সাহায্যে সৈন্য মোতায়েন রাখার জন্য তাদের এই প্রস্তাব ছিল, তা বাস্তবসম্মত নয়। যাই হোক্‌, সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করা আর দেশভাগ আটকানো দুটো একসাথে সম্ভব নয়, এই রাস্তাতেই ইতিহাস হাঁটল।

নিজের দেশ ইংল্যন্ড প্রসঙ্গে কমরেড রজনী পাম দত্ত বলেছিলেন, যে ধরণের সংস্কার মানুষ লেবার পার্টির থেকে আশা করে, সেগুলোই করছে বৃটিশ দক্ষিণপন্থী দলটি। অতএব বুর্জোয়া সংস্কার ও সন্ত্রাসের মধ্যে তফাত তিনি বুঝতেন। ভারতের ক্ষেত্রে কিন্তু এটা আর তাঁদের মাথায় থাকলো না। যা দুর্ভাগ্যজনক।

ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংরক্ষণ

গান্ধীজী জানতেন দলের নেতৃত্ব হাতে নিতে হলে, মুসলিম সমাজকে পাশে পেতেই হবে। খিলাফত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিনি অবিসংবাদী নেতা হয়েছিলেন। তার পর থেকে মাত্র চারবার কংগ্রেস নেতৃত্ব ‘ধীরে চলো নীতি’ প্রত্যাখ্যান করেছিল। ঠিক যে সন্দিক্ষণগুলিতে ভারত শাসনের কাঠামোয় সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে ইংরেজরা প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে। কিন্তু কখনোই সাম্রাজ্যবাদী সংস্কারের সরাসরি বিরোধিতা তারা করেননি। কিন্তু কার্যত অন্যান্য কারণ দেখিয়ে আসলে বিরোধিতাই করেছেন।

সাম্রাজ্যবাদের প্রতিনিধি দল মুসলিম লীগ এবং আম্বেদকারদের প্রস্তাবকেই পেশ করেছে, বলাই বাহুল্য, মুসলিম জনগণ বা অস্পৃশ্যদের ভালবেসে নয়। ভাগ করে শাসন চালানোর জন্য। কিন্তু সমস্যা হল, সাম্রাজ্যবাদ ভাগ করতে চাইলো, আর আমরা ভাগ হয়ে গেলাম। ১৯১৯-২০, ১৯৩০, ১৯৪২ (যখন জাপান নতুন প্রভু হয়ে উঠতে চাইছে, ইংরেজ প্রতিদ্বন্দ্বিদের ভারত ছাড়া করতে চাইছে) ও সবশেষে ক্যাবিনেট মিশন, ১৯৪৬, ভারতের মুসলিম ও নিম্নবর্ণের প্রজারা ঠিক এই চারটি সন্দিক্ষণে কংগ্রেস দলের আকস্মিক বিপ্লয়ানা বা চরমপন্থাকে ভাল চোখে দেখলেন না। প্রতিবারই হিন্দু মহাসভা ও আর এস এস-দের শক্তিবৃদ্ধি ঘটলো। মুসলিম সম্ভ্রান্তদের প্রতিনিধি বা নিম্নবর্ণের প্রতিনিধিদের কাছে ধীরে চলো নীতি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্তই থেকে গেল একমাত্র বিকল্প। ইংরেজদের মধ্যস্থতায় ধনী বর্ণহিন্দুদের কাছ থেকে রাজনৈতিক অধিকার কিছুটা কেড়ে নেওয়া, এই ছিল তাদের অভিপ্রায়। কিন্তু কম্যুনিস্টদের ভরসাস্থল ইংরেজরা নয়, জনগণ। তাই ইংরেজ শাসকদের আপাত প্রগতিশীলতার মুখোশ ছিঁড়ে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল তাদেরই। সংস্কার বিরোধিতার পরাকাষ্ঠা হিন্দু মহাসভা, মদন মোহন মালব্যদের মুখোশ ছিঁড়তে পারতেন বামপন্থীরাই। তা বদলে ধর্মনিরপেক্ষ ও বাম শক্তি মালব্যদের কাছেই আত্মসমর্পণ করেছিল। ফলে দেশে ভাগ রোখা যায়নি। দুর্বল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো যে হিন্দু সম্ভ্রান্ত নেতারা মানবেন না, ধর্মনিরপেক্ষ-বামপন্থী শক্তি বিভ্রান্ত হবেন তা কি ইংরেজরা জানতেন না? অবশ্যই জানতেন। কমরেড পিসি যোশী ঠিকই বলেছিলেন, “তোমরা ক্রীপসকে ব্রাত্য করলে আর ওয়াভেলকে নিয়ে আদিখ্যেতা করলে। ওয়াভেল তোমাদের বোকা বানালো। সে সফলভাবে ভারতীয় দলগুলির কাদা ছোঁড়াছুড়ি উন্মোচন করলো, সাধু সন্তের মতন সব দোষ নিজেদের কাঁধে তুলে নেওয়ার ভন্ডামি করে তোমাদের টা টা করতে করতে চলে গেল।” কংগ্রেস ও লীগকে এক জায়গায় আনার জন্য কম্যুনিস্টদের ভূমিকা কতটা সদর্থক ছিল? এই যে সাম্রাজ্যবাদ সাধু সাজার সুযোগ পেল, তার দায় কি কম্যুনিস্ট পার্টি নেবে না? অথচ কমরেড যোশী নিজেই বলছেন, “১৯৩৯ থেকেই ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াতে যে বিরতি এসেছে তার কারণ আগামী দিনের সংবিধান নিয়ে ভারতীয়রা ঐক্যমতে আসতে পারেনি”।

পুঁজিবাদে দক্ষিণপন্থী দলগুলির পারস্পরিক জোটের জন্য কম্যুনিস্ট পার্টির দরকার হয়। পার্টির জন্মের কুড়ি বছর পর্যন্ত, চল্লিশের দশকের আগে কম্যুনিস্ট পার্টি সেরকম ভূমিকা নেওয়ার কথা ভাবেইনি। কিন্তু কম্যুনিস্ট পার্টিকে মাঝখানে রেখেই হয়তো কংগ্রেস-লীগের জোট গড়ে ঊঠতো। দেশভাগ হতো না। উপরন্তু স্বাধীন ভারত পেত জিন্নাহ-নেহরু-আম্বেদকার-পিসি যোশিদের একটি যৌথ মন্ত্রিসভা। 

কিন্তু সেই আশায় জল ঢেলে ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য সংগ্রাম সম্পর্কে সিপিজিবি এককথায় বলে দিয়েছে, 

… not by any zeal of philanthropic effort will the crudities of religion disappear from India; they will vanish only under Socialism before the tractor and the factory machines….

ভারতের পার্টি বলেছে,

…sheerest guarantee against communalism is the mobilization of the masses on the basis of their economic interests class lines cut deeply across the superficial and often artificially drawn communal lines..

শোলাপুর কম্যুনের এক মাসের মাথাতেই কানপুরের বিভৎস দাঙ্গা, নৌবিদ্রোহের কিছুদিনের মধ্যেই কুৎসিত দাঙ্গা হল, ১৯২০, ১৯৩০ ও ১৯৪০-র দশকের উত্তাল শ্রেণী সংগ্রামগুলির আগে পরে দাঙ্গা কম্যুনিস্টরা দেখেছিলেন। তা সত্ত্বেও কম্যুনিস্টরা মনে করেছেন, শ্রেণী সংগ্রাম যদি জোরকদমে চলে তবে পরিচিতি সত্ত্বার ঊর্দ্ধে উঠে ভিন্ন ধর্মের জনগণ নিজ নিজ সমাজের ধনিক শ্রেণির ষড়যন্ত্রকে ধুলিস্যাত করে দেবে। ফলে কম্যুনিস্টরা শ্রেণী সংগ্রামে মনোনিবেশ করেছিলেন।  আন্দামান সেলুলার জেল তাদের নিয়ে ভর্তি ছিল। কিন্তু সেই ত্যাগ তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে তারা দেশভাগ আটকানোর চেষ্টা করেছিলেন, তা বলা খুব শক্ত। তাদের শ্রেণী সংগ্রাম মেহনতী মানুষের শ্রেণী সত্ত্বাকে নিশ্চয়ই শক্তিশালী করেছিল, কিন্তু পরিচিতি সত্ত্বা ধুয়ে মুছে সাফ তো হয়ইনি, বরং দেশভাগ হয়েছিল। দেশভাগ রোখার ক্ষেত্রে নিজেদের ব্যর্থতা নিয়ে আমরা, অর্থাৎ বাম শিবির আজও উদাসীন। কারণ আজও যখন ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক মুসলিম্লীগকে দেশভাগের জন্য দায়ী করে আমরা এর সজোরে বিরোধিতা করতে পারিনা। রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, মহাত্মা ফুলে রা ছিলেন ইংরেজদের পক্ষে, মহারাষ্ট্রের মাহার সম্প্রদায় ইংরেজ সৈন্যতে নাম লিখিয়ে পেশোয়াদের পরাজিত করেছিলেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই সত্যি। যেহেতু এই উদাহরণগুলি ছিল সাম্রাজ্যবাদের যুগের আগে তাই, রামমোহন-মাহার-বিদ্যাসাগর-মহাত্মা ফুলেদের কেউ বিশ্বাসঘাতক বললে কিন্তু জবাব দিতে আমাদের দেরী হয় না। সহজেই বলতে পারি যে সেই সময় সাম্রাজ্যবাদী যুগ ছিল না। কিন্তু আম্বেদকার বা জিন্নাহ-র ক্ষেত্রে নিরুত্তর থাকি। যেহেতু তা বিংশ শতাব্দীর ঘটনা।

আজও আমরা এই সত্য স্বীকার করতে চাই না যে মুসলিমদের কাছে ইংরেজ সংস্কারগুলি গ্রহণযোগ্য ছিল, নিম্নবর্ণের কাছে ‘কম্যুনাল’ এওয়ার্ড আকাংখিত ছিল, ঠিক ততটাই যতটা মেয়েদের কাছে সতীদাহ বাতিল আইন। যদিও সিপিজিবি নেতা সাপুরজী সাখলাতওয়ালা (ইনি টাটা পরিবারের সদস্যও বটে, সম্পত্তি ত্যাগ করে কম্যুনিস্ট হয়েছিলেন) নিজেই স্বীকার করেছেন যে এই প্রস্তাব মুসলিমদেরকেও আকর্ষণ করছে, মুসলিম সম্ভ্রান্ত ও তার মধ্য দিয়ে মুসলিম জনগণকে। অথচ উনারাই সাম্রাজ্যবাদের ‘তল্পিবাহক’ বলে গাল পেড়ে আসলে সাম্রাজ্যবাদকেই মহান করে তুললেন। সাইমন কমিশনের বিরোধিতা করার স্বার্থ ছিল হিন্দুত্বের আড়ালে আকা ক্ষমতালোভীদের। কিন্তু আম্বেদকার বা জাস্টিস পার্টিকে তল্পিবাহক বলা গুরুতর অপরাধ। শুধু তাই নয়, এই এক চোখা অবস্থানের ফলে মুসলিম জনগণকে তাদের ধনী প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী প্রতিনিধিনিদের থেকেও বিচ্ছিন্ন করতে পারিনি আমরা।

যদিও এমন নয় যে কম্যুনিস্টরা আসলে হিন্দু মৌলবাদী ছিলেন। আফগানিস্তানে মুসলিমরা চলে যাচ্ছেন, পেশোয়ারে ষড়যন্ত্র মামলা হচ্ছে, কম্যুনিস্টরা নিঃশর্তে মুসলিম নেতাদের পক্ষে দাঁড়ালেন এবং পার্টি দলিলে বলা হল যে ভারতের মত দেশে ধর্ম সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আরও বলা হলো, যেমন শিখ সমাজ নিজেদের ধর্মই একমাত্র শাসন করবে এই স্লোগান তোলেন ইংরেজ শাসক বিরোধিতায়। যেমন বঙ্কিমমচন্দ্র বন্দেমাতরম স্লোগান তোলেন, তেমনই মুসলিমরাও ইসলাম রক্ষা করতে নামেন। পার্টি জানালো যে এর মধ্যে অন্যায় নেই।

অরাজনীতির চাষ

এদেশে ভোট আর সাম্প্রদায়িকতার জন্ম একই সাথে। সাল তারিখ বিচার করলে ১৮৬১ সাল থেকে, এদেশের সম্ভ্রান্তদের নির্বাচনে লড়ার ও ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশের সুযোগ তৈরী করল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ, পরিচিতি সত্ত্বার বিচারে হিন্দু-মুসলিম ধনীরা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলেন এবং তাদের পিছু পিছু হিন্দু-মুসলিম জনগণও। দেখাও গেলো ১৮৮৫ থেকে ১৮৯৩ পর্যন্ত বহু দাঙ্গা হচ্ছে। আবার পরে যখন মর্লেমিন্টো সংস্কারের জন্য আলোচনা শুরু হল এবং সংস্কারের পর, নির্বাচন চালু করার প্রস্তাব এসে গেল, ১৯০৭ থেকে ১৯১৪, দাঙ্গা হল। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কংগ্রেস নেতৃত্ব বাংলার মুসলিম সমাজের সম্ভ্রান্তদের সাথে বোঝাপড়া না করেই ইংরেজ শাসকদের সাথে গিয়ে আলোচনা সেরে এলেন। মুসলিম সম্ভ্রান্তরা এই একতরফা সিদ্ধান্তে বিচলিত হলেন, মুসলিম লীগ তৈরী করা হল। লীগের প্রস্তাবকে গুরুত্ব দিয়ে (1906 সালে লেবার পার্টি ইংল্যন্ডের সংসদে বসেছিল এবং সংস্কারের জন্য উদ্যোগী হয়েছিল) মর্লে মিন্টো সংস্কার করা হলো, যা মুসলিমদের (জনগণের নেতা হিসেবে মুসলিম ধনীদের) পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী প্রদান করলো। ৬৯ টি প্রতিনিধির মধ্যে ৮ টি আসন মুসলিমদের জন্য সংরক্ষিত হলো। নাইরোজি-গোখেল-জিন্নাহ-দের কংগ্রেস তা মেনে নিল, অন্যদিকে হিন্দু কট্টরপন্থীরা, বলা ভালো সংকীর্ণ ক্ষমতা লোভীরা বেঁকে বসলেন। তৈরী হল হিন্দু মহাসভা। খেয়ালে রাখা ভাল, মুসলিম লীগ গঠনের প্রতিক্রিয়ায় হিন্দু মহাসভা তৈরী হয়েছে যারা বলছেন তারা সত্য বিকৃত করছেন। আসলে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী কংগ্রেস মেনে নিয়েছিল্, তাই মহাসভা তৈরী হয়েছিল। এই পর্যায়ে কম্যুনিস্ট পার্টি ছিল না। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী কম্যুনিস্ট পার্টি যেদিন জন্ম নিলো সেদিন থেকেই ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে, সাম্রাজ্যবাদ প্রদত্ত সংস্কারগুলি সম্পর্কে তাদের অবস্থান থাকার কথা। ভারতে সংবিধান তৈরীর সাম্রাজ্যবাদী প্রতিনিধি দল দশ বছর অন্তর আসার কথা, কম্যুনিস্ট পার্টি তৈরীর আগেও দুই বার আসা হয়ে গেছে। তা নিয়ে দলের অবস্থান কী, মতামত কী? দেখা যাক্‌। সিপিজিবির সদস্য ক্লিমেন্স দত্ত ‘লেবার মান্থলি’ পত্রিকায় লিখলেন যে পৃথক নির্বাচনী মণ্ডলীর মধ্য দিয়ে শ্রেণী ঐক্য বিঘ্নিত হচ্ছে। সিপিজিবি বলছে, Of the numerous safeguards for British rule in India contrived by the Labour Ministers and endorsed by their successors, few are more important than the division of the electorate into water-tight compartments. -----Communal electorates for the Moslems were accordingly established and the principle of divide and rule accepted as an integral part of representative government. কম্যুনিস্টদের অবস্থান ছিল এমনই বিধ্বংসী। অথচ তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্ব কিন্তু সরাসরি এই দুটির বিরোধিতা করেননি। ১৯০৯ সালে তা করার প্রশ্নও নেই, তখন গান্ধীজী আসেননি। কিন্তু ১৯১৯ সালের ক্ষেত্রে গান্ধীজীর বিরুপ বক্তব্য থাকলেও, কংগ্রেস যখন এই সময় জঙ্গী আন্দোলনে নামলো, তা করা হল রাওলাট আইন ও পাঞ্জাব হত্যাকাণ্ডকে সামনে রেখে। প্রথমত ১৯১৬ সালে কংগ্রেস নীতিগতভাবে মুসলিমদের জন্য রাজনৈতিক সংরক্ষণ কংগ্রেস মেনে নিয়েছিল। মুসলিম লীগের সঙ্গে চুক্তির মধ্য দিয়ে। রাতারাতি তা অগ্রাহ্য কংগ্রেস করেনি। কংগ্রেস অত বোকা নয়। বোঝা দুষ্কর নয় যে মুসলিম আবেগকে সরাসরি চটাতে চায়নি কংগ্রেস নেতারা। যে কোনো রাজনৈতিক দল, যারা নিজেদের হিন্দু মৌলবাদী হিসেবে প্রতিফলিত করতে চায় না, তাদের এই সংস্কার সরাসরি নাকচ করা শোভা পায় না। শুধু কৌশলের কারণেই নয়, নীতিগতভাবেও নয়। গান্ধীজী জানতেন দলের নেতৃত্ব হাতে নিতে হলে, মুসলিম সমাজকে পাশে পেতেই হবে। কিন্তু আমাদের কম্যুনিস্টদের কাছে ‘মুসলিম’ জিতে নেওয়ার কোনো তাড়না নেই, ছিল না। ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্দ্ধে উঠে শ্রেণী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে হিন্দু-মুসলিম জনগণকে জিতে নেওয়াই আমাদের লক্ষ্য। ফলে আমাদের শ্রদ্ধেয় কমরেডরা সেদিন ভারতের চলমান রাজনীতি নিয়ে মাথা আদৌ ঘামাননি। যদি ঘামাতেন তাহলে হয়তো দেশভাগ হতো না।

মুসলিম সমাজের নেতা হওয়ার সুযোগ নষ্ট করলো কম্যুনিস্ট পার্টি

দশ বছর অন্তর সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য প্রতিনিধি দল আসবে। সুতরাং কম্যুনিস্ট দলের প্রথম দায়িত্ব ছিল সেগুলি সম্পর্কে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করা ও পরের সাংবিধানিক দল ভারতে পদার্পণ করার আগেই বিকল্প রাজনৈতিক কাঠামোর প্রস্তাব প্রস্তুত করে ফেলা। ইচ্ছা করলেই কম্যুনিস্ট পার্টি কংগ্রেস বা লীগের আগেই তা হাজির করতে পারত। পরিস্থিতি অন্য রকম হয়ে যেতো নিঃসন্দেহে।

নজরুল ইসলাম যখন লাঙল বের করছেন সেই পর্যায়ে শুধু বাংলার মুসলিম সমাজই নয়, দেশ জুড়ে মুসলিম সমাজের মধ্যে উদ্দীপনা দেখা দিয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর্যায়ে খলিফাকে বাঁচানোর উদ্দীপনা শুধু নয়, ইংরেজ বিরোধী তুমুল ঐক্য তখন বিদ্যমান। যুদ্ধ শেষেও ইংরেজ বিরোধী ক্ষোভে ফুটছে মুসলিম সমাজ, হয়তো খলিফার হেরে যাওয়া একটা কারণ। যদিও ক্রমেই লীগ সহ মুসলিম জনগণ বুঝেছিলেন যে তাদের বোকা বানানো হল।

মুসলিম নেতাদের প্রত্যাশা ও হিন্দু প্রতিযোগিদের আশংকা ছিলই যে মন্টফোর্ড সংস্কার মর্লেমিন্টোর থেকে আরও চওড়া করবে। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব গান্ধীর হাতে সবে এসেছে। তিনি লাজপত রাই-দের মত হিন্দু মহাসভার লোক নন। আগেই বলেছি, তিনি এটাও জানতেন যে দলের নেতৃত্ব হাতে নিতে হলে মুসলিম সমাজকে পাশে পেতে হবে। ফলে সেই মুসলিমদের কাছে আকর্ষণীয় ১৯১৯ সালের সংস্কারকে সরাসরি বিরোধিতা করার প্রশ্নই ছিল না। কিন্তু তারা মুসলিম লীগ বা আম্বেদকারদের ক্ষমতার ভাগ দিতেও নারাজ। সুযোগ এনে দিয়েছিল জালিয়ানওলাবাগ হত্যাকান্ড আর রাওলাট আইন। কম্যুনিস্টরা তখন বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তৈরী হওয়া অর্থনৈতিক সংকটের বিরুদ্ধে তীব্র দুঃখ, কষ্ট, বিক্ষোভ দেখে বিচলিত। তাই কংগ্রেস এতদিনের ‘ধীরে চলো নীতি’ আচমকাই ত্যাগ করে পূর্ণ স্বরাজের ডাক দিতেই কম্যুনিস্টরা সন্তুষ্ট। জঙ্গীত্ব থাকলেই আমাদের খুশী হওয়ার রোগ চিরকালই ছিল, আছে। ভারতের প্রথম ভোট শেষ হওয়া পর্যন্তই যদিও সেই জঙ্গীত্বের আয়ু। বিতর্কটা অহিংসা-হিংসার ছিল না। কম্যুনিস্ট পার্টি যাই বুঝুক, লীগের কাছে এর মর্মার্থ দাঁড়ালো, সাম্রাজ্যবাদের সংস্কারগুলির সুবিধা যাতে লীগ না পায়, উদ্দেশ্য ছিল এটাই।

১৯২০-র প্রথম নির্বাচনে যৌথ নির্বাচন বয়কট করেছিল কংগ্রেস ও লীগ। খিলাফতের ঐক্য তখনো ভাঙেনি। ভোট বয়কটের ফলে ১৯১৯-র সংস্কারের সুবিধা ওঠাতে পারেনি মুসলিম লীগ। অথচ দ্রুতই কংগ্রেস সেই ফাঁকা ময়দানে গোল দিয়ে বেরিয়ে গেল। কংগ্রেসের মধ্য থাকা হিন্দু মহাসভার লোকেরা একদিকে আর অন্যদিকে চিত্তরঞ্জন দাস ও মোতিলাল নেহরুর মত উদার অংশ, দুই পক্ষের যৌথতায় তৈরী হল ‘স্বরাজ পার্টি’। ১৯২৩-র নির্বাচনে সেই দল বহু আসন জিতলো। আর অন্যদিকে মুস্লিমরা তাদের সংরক্ষিত নির্বাচকমণ্ডলী থেকে প্রবেশ করলেন ক্ষমতার অলিন্দে কিন্তু সবই ব্যক্তি হিসেবে। লীগ বুঝলো যে তাদের ঠকানো হল। খিলাফত আন্দোলনের সুযোগে তাদের ক্ষমতার অলিন্দ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। ১৯১৯ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত লীগ কার্যত কংগ্রেস দলে মিশে গেছিল। তাদের কোনো পৃথক দলীয় বৈঠক হয়নি। উপরন্তু তুরস্কে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার ফলে এদেশের খিলাফতপন্থীরা হতাশ।

ঠিক এই পর্যায়ে মুসলিম সমাজের পাশে কম্যুনিস্ট পার্টি সহানুভূতি নিয়ে (যেমনটা আফগানিস্তানের দিকে পালিয়ে যাওয়া ইসলামী রাষ্ট্রের আওয়াজ তোলা মুসলিম যুবাদেরর প্রতি তারা ছিলেন) দাঁড়ালে গান্ধীজীর পাশাপাশি, কম্যুনিস্ট পার্টিও দেশের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে একটি বিকল্প নেতৃত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারতো। মৌলবাদের সাথে আপোষ করার দরকার ছিল না।

সেই সুযোগে জিন্নাহ-র সাথে সুসম্পর্কও (যদিও ১৯২৪-১৯৩৪ সাল পর্যন্ত কমিন্টার্ন দলীয় ঐক্য আর শ্রেণী ঐক্যকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল) গড়ে তুলতে পারতেন কম্যুনিস্টরা। কংগ্রেস সদস্য ও দলের আগামী নেতৃত্বের অন্যতম দাবীদার জিন্নাহ খিলাফত আন্দোলনে কংগ্রেসের যোগদান করা নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন, ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে মেশাতে বারণ করেছিলেন তিনি। তুরস্কের রাজতন্ত্রকে বা খলিফাকে টিকিয়ে রাখার দাবীকে প্রশ্রয় দিতে বারণ করেছিলেন। ফলে স্বজাতির মৌলবাদীদের দাপটে মুসলিম সমাজে তিনি কিছুটা কোণঠাসা ছিলেন। জিন্নাহ ১৯০৯ সালে মুসলিম লীগের সদস্য হতে রাজী হননি। যখন হিন্দুমহাসভার নেতারা বলছেন যে হিন্দুরা আগে হিন্দু পরে ভারতীয়। লীগের মৌলবাদী পাঞ্জাব অংশের নেতারা বলছেন যে তারা আগে মুস্লিম পরে ভারতীয়। তখনও জিন্নাহর শর্ত ছিল, লীগের সংবিধান বদলাতে হবে। দলের উদ্দেশ্য হিসেবে স্ব শাসন লিখতে হবে। লীগ যখন তা মেনে নিল তখনই তিনি লীগের সদস্য হলেন। কিন্তু তবু জিন্নাহ-কে ধরে রাখতে পারেনি কংগ্রেস। বোঝাপরা তৈরি করার চেষ্টা করতে পারতো একমাত্র কম্যুনিস্ট পার্টি। অপ্রাসঙ্গিক হবে না এই তথ্য যে ১৯২৪ সালে কানপুর ষড়যন্ত্র মামলায় জিন্নাহকে উকিল হিসেবে পেতে চেয়েছিল কম্যুনিস্ট পার্টি।

খিলাফত আন্দোলনে যোগদান করার সময় হিন্দু মহাসভার কংগ্রেসী নেতাদের তীব্র বিরোধিতার উত্তরে গান্ধীজী বলেছিলেন যে হিন্দু ভারতীয়দের যদি সত্যিই মুস্লিম ভারতীয়দের সাথে আঁটোসাঁটো বন্ধুত্ব করতে হয় তবে নিঃশর্ত ভাবেই হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। সেটা তারা যদিও করে উঠতে পারেননি। গান্ধীজী যেটা মুখে বলেছিলেন সেটাই করে দেখাতে পারতেন কম্যুনিস্টরা। এবং দেশভাগের যে বীজ রোপিত হয়েছিল সেইদিন তা যাতে বৃক্ষে রূপান্তরিত না হয় সেই নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারতেন।

আবার সুযোগ নষ্ট

বাংলাতে মুসলিমদের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগির দরজা খুললেন চিত্তরঞ্জন দাস, না করে উপায়ও ছিল না। পৃথক নির্বাচকমন্ডলীর বিরাট সুবিধা মুসলিম প্রতিনিধিদের বাংলাতে পাওয়ার কথা। কিন্তু দেশজুড়ে সেই মডেল অনুসরণ করলো না কংগ্রেস। বা কম্যুনিস্ট পার্টিও তেমন পরামর্শ  দিল না। যে সুযোগ নিয়ে কট্টর মুসলিম বিদ্বেষী, তথাকথিত হিন্দুত্ববাদীরা শক্তিশালী হল। ১৯২৫ সালে আরএসএস তৈরী হল। অথচ সেই পর্যায়ে স্বরাজ পার্টি নিয়ে কম্যুনিস্ট পার্টির জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নেতারা অনেক কিছু লিখেছেন। চিত্তরঞ্জন দাসের স্বরাজ ভাবনা-বামমনস্কতা নিয়ে কম্যুনিস্টরা আশান্বিত ছিলেন, কিন্তু স্বরাজ ও সার্বজনীন ভোটাধিকার ছাড়াই যে ভোট ব্যবস্থা  সেখানে অংশগ্রহণ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করতে ভোলেননি। যদিও ১৯৩৭ সালের ভোটে কম্যুনিস্টরা অংশ নিয়েছিলেন! ১৯২২ সালে শ্রদ্ধেয় এমএন রায় লিখছেন, ১৯০৯ সালে যে উদারপন্থী সাম্রাজ্যবাদ নিজের সংস্কারের ডংকা বাজিয়েছিল, ১৯১৯ সালে তার সূচনাও হয়েছিল। এইসব সংস্কারকে যারা জাতীয় সমস্যার সমাধান হিসেবে দেখবেন তারা সকলেই সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহক হিসেবেই গণ্য হবেন। প্রথম অসহযোগ আন্দোলনের অন্যতম কর্মসূচী হিসেবে নির্বাচন বয়কটে খুশী হয়েছিলেন কম্যুনিস্টরা। কম্যুনিস্টদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে শুধু ইংরেজ তল্পিবাহক ছাড়া সকলেই নাকি প্রথম নির্বাচনটিকে বয়কট করেছেন!! লীগ বয়কট করেছিল, কিন্তু সমগ্র মুসলিম সমাজের মধ্য সংশয় থাকবেই। ১৯৩২ সালের পুনা চুক্তিকেও নিশ্চয়ই আম্বেদকার নিজে স্বাক্ষরকারী হলেও ভাল চোখে দেখেননি। ঠকে গেছেন তা টের পেয়েছিলেন।

লীগ আর কংগ্রেসের দূরত্ব তৈরী হল দ্রুতই। অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারিত হতেই মালাবার অঞ্চলে  জমিহারা কৃষকদের তীব্র সংগ্রাম শুরু হল, যা ইংরেজ প্রশাসনকে টলিয়ে দিয়েছিল। নাগাড়ে ৩ মাস মালাবার গ্রামাঞ্চল বিদ্রোহিদের দখলে ছিল।  এবং শেষ পর্যন্ত শুধু হত্যালীলা চালিয়েই নয়, (শোনা যায় সিপাহী বিদ্রোহ আর সাঁওতাল বিদ্রোহের পর এত বড় হত্যাকাণ্ড আর হয়নি) হিন্দু জমিদার বনাম মুসলিম কৃষক, এই বিরোধ কদর্য দাঙ্গায় পর্যবসিত হল। এদেশে বহু জায়গায় দাঙ্গা হল, এবং সেই দাঙ্গার জন্য কংগ্রেসের অভ্যন্তরে এবং বাইরে থেকে মুসলিম নেতাদের দায়ী করা হল। যার সত্যতাও ছিল।  হিন্দু মহাসভা সুযোগ নিল। অথচ কম্যুনিস্টরা ‘শ্রেণী সংগ্রামে’ ব্যস্ত। দুই দলের মধ্যে সেতু হিসেবে দাঁড়ানোর চেষ্টা তারা করলেন না।

এমনকি সাবরমতি চুক্তি নিয়েও কম্যুনিস্ট পার্টি প্রায় কিছুই বলে নি। মুনজে, জায়াকার, কেলকার মালব্য, লাল লাজপত রাই, এই চুক্তির মধ্য দিয়ে সবাই যেভাবে প্রশ্রয় পেলো তা ঘৃণ্য ছিল।

বেঙ্গল প্যাক্টকে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের মডেল হিসেবে গ্রহণ করতে হবে, ওই পর্যায়ে এই আওয়াজ কম্যুনিস্টরা যদি তুলতেন, দেশভাগ বিরোধী মতবাদ শক্তিশালী হতো। মুসলিম সমাজ মৌলবাদের কবল থেকে পরিত্রানের সুযোগ পেত।

এবারও নষ্ট

১৯২০-র প্রথম আন্দোলন নিয়ে কমরেড এমএন রায় বললেন যে কংগ্রেসের পূর্ণ স্বরাজের দাবী থেকে মোটেই সরে আসা উচিত নয়। কিন্তু পূর্ণ স্বরাজের দাবীর আড়ালে মন্টফোর্ড সংস্কারের বিরোধিতা লুকিয়ে ছিল কি না, সেই বিষয়ে কোনো বিশ্লেষণ তাঁর লেখায় চোখে পড়লো না। ….the policy of liberal imperialism heralded in 1909 by Morley Minto reforms and inauguarated in 1919 by the introduction of the government of India Act will culminate sooner or later in home rule or dominion status for India….those who look upon any such eventuality as a solution of the national question are counted to be henchmen of imperialism… দুর্ভাগ্যজনক। ওনার মত প্রজ্ঞা যদি এই নিয়ে মাথা ঘামাতেন, দেশভাগ আটকে যেতো। ১৯১৯ সালের মন্টফোর্ড কমিশনের কিছু সময়ের মধ্যেই কম্যুনিস্ট পার্টির জন্ম। জন্ম নিয়েই প্রথমত (তাদেরই ভাষায়) উদারপন্থী সাম্রাজ্যবাদী সংস্কারকে সমালোচনামুলক সমর্থন জানিয়ে রাজনীতির মঞ্চে দাপুটে হওয়ার সুযোগ ছিল। এর পর বেঙ্গল প্যাক্ট-কে সমর্থন করার কথা ছিল।

উপরোক্ত সুযোগগুলি হারানোর পর এল ১৯২৭ সাল, দেশভাগ রোখার পরবর্তী সুযোগ। গান্ধীজীর দেখানো পথে মুসলিম সমাজের বন্ধু হওয়ার সুযোগ। দেশের ও মেহনতী মানুষের ঐক্য রাখার লাগাম নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার সুযোগ। ১৯২৭ সালে এসে মুসলিম লীগ প্রথম পর্যায়ের পৃথক নির্বাচকমন্ডলীর দাবী আর ধরে রাখেনি। ১৯২৪ সাল থেকেই জিন্নাহ সবল কেন্দ্রের বিপক্ষে কথা বলতে শুরু করেছেন। তিনি মুসলিম নেতাদের সাথে দিল্লিতে সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ২৭ মার্চ ১৯২৭ সালে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। হিন্দু মুসলিম ঐক্যের ডাক দিয়ে লীগ পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী থেকে সরে এল।  জিন্নাহ-র চাপে লীগের পাঞ্জাবের মৌলবাদী গোষ্ঠী পিছু হঠলো। লীগের মধ্যে বিরাট ফাটলও ধরলো। শোনা যায় মোতিলাল নেহরু নাকি তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে পৃথক নির্বাচকমন্ডলীর দাবি থেকে যদি তারা সরে আসেন তবে কংগ্রেস লীগের বাকী দাবীগুলি মেনে নেবে। তবে শুধু ওই অনুরোধ নয়, নিশ্চয়ই জিন্নাহর কাছেও ক্রমে স্পষ্ট হয়েছিল যে শুধু পৃথক নির্বাচকমন্ডলী থাকলেই লীগ ক্ষমতার ভাগ পাবে না। বাঙলা পাঞ্জাবে অনেক সীট থাকলেও কিছু হবে না, যদি না মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে কিছু রাজ্য গড় ওঠে। এবং রাজ্যগুলি স্বায়ত্ত্বশাসিত হয়। ফলে রাজ্যগুলির বিন্যাস নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হল। রাজ্যগুলির হাতে বেশী ক্ষমতা থাকুক, সেই দাবীও জোরদার হলো। তার পর থেকে শেষ দিন পর্যন্ত, রাজ্য-কেন্দ্রর সম্পর্কই থাকলো হিন্দু মুসলিম সম্পর্কের টানাপোড়েনের মূল কারণ, সমাধান না হওয়ায় দেশভাগেরও কারণ। যেহেতু ১৯২৭ সালে লীগ অনেকটা নমনীয় হয়েছে, কংগ্রেসের সাথে সাইমন কমিশন বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিতে লীগের জিন্নাহ গোষ্ঠীর অসুবিধ হল না। এদিকে ইংরেজদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ভারতীয়রা ঐক্যবদ্ধভাবে সাংবিধানিক রূপরেখা হাজির করার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু লীগের এই নতুন অবস্থানে কংগ্রেস রীতিমত প্যাঁচে পড়ে গেছিল। কংগ্রেস হিন্দু মহাসভার নেতাদের কোর্টে বল ঠেলে দিল। মুনজে, জায়াকার, মালব্য এরাই হয়ে উঠলেন সেই ঐক্যবদ্ধ সাংবিধানিক রূপরেখা হাজির করার বৈঠকগুলিতে হর্তা কর্তা বিধাতা। ভারতের সর্বদলের বৈঠক মুসলিম প্রশ্নে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারলো না। সিন্ধ পৃথক রাজ্য, এক তৃতীয়াংশ প্রতিনিধিত্ব, রাজ্যগুলির স্বায়ত্ত্বশাসন, কিছুই মানা হল না। লখনৌ চুক্তির বোঝাপড়া থেকেও সরে আসা হল। মোতিলাল নেহরুর নামেই সেই খসরা তৈরী হল। নেহরু রিপোর্ট হিসেবে যা গোল টেবিল বৈঠকেও পেশ হল লণ্ডনে। মুসলীম লীগের দাবি মানাই হল না। স্রেফ ভোটাভুটি করে হারিয়ে দেওয়া হল। হিন্দু মহাসভার ভোট পেল কংগ্রেস। সুতরাং মুসলিম লীগের দিল্লি সম্মেলনের গৃহীত সিদ্ধান্ত পিছু হঠলো। কোণঠাসা হয়ে পড়া মৌলবাদী অংশ আবার শক্তিশালী হল। ১৪ দফা দাবী পেশ করলো মুস্লিম লীগ। সিন্ধু প্রদেশকে বম্বের থেকে আলাদা করার প্রস্তাব, কেন্দ্রীয় আইনসভায় এক তৃতীয়াংশ মুসলিম সংরক্ষণ, রাজ্যের হাতে স্বশাসন। শুধুমাত্র যে সব রাজ্যে মুস্লিম জনসংখ্যা কম সেখানেই নয়, বাংলা ও পাঞ্জাবেও আসন সংরক্ষণ। মূলত দুর্বল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ফর্মূলা ছিল প্রস্তাবটি। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী হিন্দু ও মুসলমান দুটি জাতি, তাই সম আসনে বসাতে হবে। দুটি জাতির মধ্যে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু সম্পর্ক হবে না। এটাই ভারতের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে যুগ সন্ধিক্ষণ হতে পারতো, ইতিবাচক ভাবে।  সমস্ত দল ঐক্যবদ্ধভাবে সাম্রাজ্যবাদের মোকাবিলা করতে প্রতিশ্রুতি নেওয়ার সুযোগ তৈরী হল। কিন্তু কম্যুনিস্টরা আবার নিষ্ক্রিয় রইলেন।

নেহরু রিপোর্ট যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো শব্দটি লিখলেও কার্যত কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থার কথাই বলেছে, অবশিষ্ট অধিকার সমূহকে কেন্দ্রের হাতেই তুলে দিতে চেয়েছে, সবল কেন্দ্র গড়ে তুলতে চেয়েছে। তা নিয়ে কম্যুনিস্টরা নীরব থাকলেন। নেহরু রিপোর্ট নিয়ে তারা কিছু বলেননি তা নয়। কমরেড স্প্র্যাটের নেহরু রিপোর্ট নিয়ে বক্তব্য সোজা সরল,    it is at present impossible to draw a constitution which will be of any permanent value to the labour movement. We cannot predict in what circumstances labour will come into power I India and what kind of constitution it will then be desirable or possible to establish…we should not attempt to bring about modifications of the report at the cost of our political independence..।

অর্থাৎ নেহরু রিপোর্ট যেমন আছে থাক। এর মধ্যে কোনো দোষ খেঁজে পাননি কম্যুনিস্ট পার্টি। আর সাপুরজি সাখলাতওয়ালা নেহরু রিপোর্টকে চমকপ্রদ (spectacular) বলেছেন।  

ইংরেজদের সাথে গোল টেবিল বৈঠকে হেডগেওয়ারের দীক্ষা গুরু মুনজেকে গুরুত্ব দিল কংগ্রেস। মুসলীম লীগের সাথে প্রথম পর্বের ঝগড়ার দায়িত্ব তার কাঁধেই অর্পন করা হল। কংগ্রেসের প্রতিনিধি দলে মাঝারী মাপের নেতা উপস্থিত হলেন না। মুনজে কংগ্রেসের প্রশ্রয় পেয়ে বৈঠকের সদব্যবহার করলেন। লীগের সাথে কংগ্রেসের দূরত্ব বাড়িয়ে তিনি লন্ডন থেকে ইতালি গিয়ে মুসোলনির সঙ্গে দেখা করে পায়ের ধুলো নিয়ে আসলেন। ইংরেজদের স্পষ্ট জানানো হল যে নেহরু রিপোর্টের ভিত্তিতে যদি সংবিধানের রূপরেখা না হয় তবে কংগ্রেস আন্দোলনে নামবে। এবং হিন্দু মহাসভা সমর্থন প্রত্যাহার করে নেবে। যথারীতি লীগের আবার নতুন করে মৌলবাদী ঐক্য সাধিত হল। ওই বছরকে বিচ্ছেদের বছর (পার্টিং অব ওয়েজ) হিসেবে চিহ্নিত করেছেন জিন্নাহ। গোলটেবিল বৈঠকে ভারত পেল না কোনো মানবেন্দ্রনাথ রায় রিপোর্ট, বা মুজফফর আহমেদ রিপোর্ট। তার বদলে আমরা জানলাম সিপিজিবির বেন ব্র্যাডলির বক্তব্য,  The question of Federation became the centre-point of these gathering issues within the movement. The Congress stood committed to a policy of resisting and preventing the introduction of the Federal Constitution, which would represent, not in any sense even a limited constitutional advance, but a strengthening of reaction and of the grip of imperialism in India. The acceptance of office in the Provinces was clearly understood and stated in all official documents to represent not an acceptance of constitutionalism, but a stage of preparation for future mass struggle to win complete independence on the basis of a Constitution framed by a freely elected Constituent Assembly.

১৯৩৩ সালে কম্যুনিস্ট পার্টির কর্মসূচীতে সোভিয়েত ধরণের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর যে দাবী ছিল, তার সাথে ইংরেজ প্রেরিত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রস্তাবগুলির মিল-অমিল কিন্তু ভারতের শ্রমজীবী বুঝতে পারলো না। অথচ এক ব্যক্তি এক ভোট, শক্তিশালী কেন্দ্র যে ভারতকে ঐক্যবদ্ধ রাখতেই পারবে না, মুসলিমরা যে ঐ কাঠামোকে হিন্দু রাষ্ট্রের ভ্রুণ হিসেবেই দেখবে, সেই ইঙ্গিত আবুল কালাম আজাদের ‘ভারত স্বাধীন হল’-বইতেও আমরা পাই। অথচ সিপিজিবি বলছে

Accordingly at the first Round Table Conference we find the principles of electorates for religious communities further extended by representation for the Sikhs, Indian Christians and the Depressed Classes. By this manoeuvre the Government hoped not only to paralyse the new Councils when formed, but to weaken and confuse the National Congress in the present struggle. ---- The Backward Areas apart, it divided the electorate into upwards of twelve separate categories, some with dual votes. The award is indeed a reductio ad absurdum of the principle of divide and rule; officialdom would seem to have ridden its hobby to death.

রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী নয়, প্রধানমন্ত্রী চাই-- কম্যুনিস্টরাই এই দাবি তুলতে পারতো

১৯৩৭ এর পর থেকে পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হতে শুরু করলো। তখন লীগ এমনকি হিন্দু মহাসভার সাথে সরকার গঠন করতেও পিছুপা হচ্ছে না। অন্যদিকে ১৯৩২ সালের পুনা চুক্তি আম্বেদকারের আতংককে আরও শক্তিশালী করেছে। আম্বেদকার বনাম জিন্নাহ, জিন্নাহ বনাম কংগ্রেস, কম্যুনিস্ট বনাম জিন্নাহ- এই ধরনের সমীকরণের ফাঁক গলে সাম্রাজ্যবাদ সকল নিপীড়িত অংশের মুক্তিদাতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। একদিকে হিন্দু মহাসভা বলছে যে তারাই হিন্দুদের প্রতিনিধি, আর মুসলিম লীগ বলছে তারাই মুস্লিমদের প্রতিনিধি। যদিও তা বাস্তব ছিল না। বহু মুসলিম দল তখন ছিল, পাঞ্জাবে, বাংলায়, উত্তর পশ্চিম সীমান্তবর্তী রাজ্যে। এবং প্রতিটি দলই যথেষ্ট শক্তিশালী। যার ফলে জিন্নাহর তখনো নমনীয় হওয়ার বাধ্য বাধকতা ছিল। লীগকে মুসলিম সমাজের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে নেহরু সঠিকভাবেই অনমনীয় থেকেছেন। একমাত্র কম্যুনিস্টরাই ইংরেজদের মধ্যস্থতায় দুর্বল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রস্তাব দিয়ে লীগকে মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারতো। ১৯২৭ সালের মতোই জিন্নাহ-র বন্ধু প্রয়োজন ছিল।

আসন্ন ১৯৩৭ সালের নির্বাচন। লীগ ও কংগ্রেস ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে লড়তে পারতো। ১৯২৮ সালে নেহরু রিপোর্টের মধ্য দিয়ে হিন্দু মুসলিম সম্পর্কের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি সত্ত্বেও সেই সুযোগ ছিল। লীগের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো ছিল এমনই যাতে কংগ্রেসের সাথে জোট সরকার গঠন করা যায়। প্রতি রাজ্যের নির্বাচিত প্রধান আসলে মুখ্যমন্ত্রী নয়, সে ‘প্রধানমন্ত্রী’, এই নীতিতে এককাট্টা হলেই আবার হিন্দু মুসলিম ঐক্যর সুযোগ তৈরী হত। কিন্তু কোনো সুযোগই কাজে লাগানো হল না। বদলে যা হল তার ফলে জিন্নাহ নামক বাল্মীকী রত্নাকরে রূপান্তরিত হলেন, পৃথক রাষ্ট্রের যে দাবি লীগের একাংশ তাকে বার বার বোঝানোর চেশটা করে গেছে এতদিন তা সফল হল। যাইহোক্‌ ফিরে যাই নির্বাচনে। উত্তরপশ্চিম সীমান্ত, আসাম, পাঞ্জাব ও বাংলা, এই চারটি মুসলিম প্রধান রাজ্যের মধ্যে মুসলিম লীগ ভালো ফল করেনি ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে। কিন্তু সংযুক্ত প্রদেশে তারা ভালো করলো, অর্থাৎ যেখানে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ না হলেও সম্ভ্রান্ত।  ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের বিররুধ্বে বিষোদগার করা সত্ত্বেও এই ফলাফল দেখে কংগ্রেস সরকার গঠন করে ফেললো বেশিরভাগ রাজ্যে। কিন্তু জোট সরকার করতে রাজী হল না। লীগের বিজয়ী সদস্যদের দল ছেড়ে আসতে বলা হল। এই অপমানে দেশের মুসলিম সমাজ আতংকিত হল। ইংরেজরা থাকাকালীনই যদি এই অবস্থা হয় তবে না জানি স্বাধীন দেশে কী হবে!! তাছাড়া রাজ্য এরাজ্যে কংগ্রেস সরকারগুলির আক্রমণ আতংক বাড়িয়ে তুললো। আতংকের ও মেরুকরণের প্রতিফলন হিসবে সিকন্দর হায়াত খাঁ-র ইউনিয়নিস্ট দল পুরোটা মুসলিম লীগে মিশে গেলো, বাংলার ও আসামের মুসলিম নেতারাও তাই করলেন। অর্থাৎ সকলেই মুসলিম লীগের ছাতার তলায় আশ্রয় নিল। ১৯২৮ সালের পর থেকে জিন্নাহ যে দাবী করে আসছিলেন তা সত্য হল। এবার সত্যিই লীগ সমস্ত মুসলিমদের প্রতিনিধি হল। কংগ্রেস যতই হিন্দু মুসলিম সকলের প্রতিনিধি হিসবে নিজেকে দাবী করুক বাস্তবে দেখা গেলো যে কংগ্রেসের ৪৮২ টি প্রার্থীর মধ্যে মাত্র ৫৮ জন মুসলিম। জিন্নাহ এবার সরাসরি আশ্রয় নিলেন লীগের মৌলবাদী সাফি গোষ্ঠির কোলে। কংগ্রেস সরকারের সুযোগ বুঝে লীগ এমনকি হিন্দু মহাসভার সাথেও সরকার গঠন করে ফেললো! সাভারকার আর লীগের কথা যেন মিলে মিশে গেলো। জিন্নাহ কোনো বিরোধী পক্ষ রাখলেন না। সিকন্দরকে সরানো হল, ফজলুল হক কেও। অন্য মুসলিম দলগুলিকে গুঁড়িয়ে দিলেন জিন্নাহ। ১৯৪৫ সালের সিমলা বৈঠক জিন্নাহ ভেস্তে দিলেন একই যুক্তিতেই। প্রতিনিধিদের মধ্যে অর্ধেক হবে মুসলিম আর সেই মুসলিমদের নাম দেবে একমাত্র লীগ। অন্য কোনো মুসলিম দল বা কংগ্রেস নয়। 

এই পর্যায়েরই ফলশ্রুতি ১৯৪০ সালের পাকিস্তান প্রস্তাব। কিন্তু ইতিহাসবিদ সুমিত সরকার বলছেন, কংগ্রেস যদি নীতিগতভাবে দুর্বল কেন্দ্র ও সবল রাজ্যের ফর্মূলা মেনে নিতে রাজী থাকতো তবে লাহোর প্রস্তাবকেও স্বশাসিত রাজ্যের প্রস্তাবে রূপান্তরিত করা যেতো। 'স্টেটস' শব্দকে যেহেতু রাজ্য ও রাষ্ট্র, দুই অর্থেই ব্যবহার করা যায়। কিন্তু কংগ্রেস তার চেষ্টা করেনি।  কিন্তু প্রশ্ন হল কম্যুনিস্টরা কি করছিলেন?

১৯৩৭-এর নির্বাচন যাতে জোট সরকারের জন্ম দিতে পারে, লীগের ১৯৩৭ সালের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোর নমনীয়তাকে ব্যবহার করে জোট সরকারের ইচ্ছা যে তাদের ছিল তেমন দলিল কোথায়? কেউ বলতে পারেন, দলিল নিশ্চয়ই ছিল। ১৯৩৯ সালে কম্যুনিস্ট পার্টি বলছে যে যুক্তফ্রন্ট সরকার হওয়া উচিত। কংগ্রেস ও মুসলীম লীগের। কিন্তু সেটা কংগ্রেসের কর্মসুচী মেনে!! formation of coalition ministries wherever possible on the basis of the Congress election programme…

কিন্তু কম্যুনিস্টদের সামনে সুযোগ ছিল। ১৯৩৫ সালের ভারতের বিকল্প সংবিধানকে দাসত্বের দলিল বললেও তারা ভোটে অংশ নেওয়ার সিদ্ধাত নিয়েছিলেন। পদ না নিয়ে বাইরে থেকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তারা। অথচ এই প্রক্রিয়ায় লীগের সাথে অপমানজনক আচরণ নিয়ে কোনো প্রতিবাদ করা হয়নি। ১৯৩৭ সালে নির্বাচনে কম্যুনিস্টরা কংগ্রেসের পতাকাতলেই অংশ নিলেন। ভারত শাসন আইনের অন্তত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর দিকটিকে কম্যুনিস্ট পার্টি সমর্থন জানালে, বাকি সমস্ত বিরোধিতা জনমানসে গুরুত্ব অর্জন করতে পারতো। তার বদলে ১৯৩৬ সালে পার্টি প্রকাশিত একটি পুস্তিকায় বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের অধীনে থাকা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরোধিতা করা হল। করদ রাজ্যের রাজা মহারাজাদের তুষ্ট করার রাজনীতি হিসেবে চিহ্নিত করা হল। ১৩৪টি সংরক্ষিত আসনকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই দেখানো হল। একে কংগ্রেসের সরকারকে সমর্থন, তায় আবার যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে দাবি করা, ফলে আর মুসলিম সমাজের নেতা হওয়া হল না কম্যুনিস্টদের।

ঠিক এর পরই অধ্যায়ে কম্যুনিস্ট পার্টি রাজনৈতিক গুরুত্ব পেতে শুরু করলো। কংগ্রেসের মধ্যে তাদের প্রতিনিধিরা গুরুত্ব পেলেন, কংগ্রেস অধিবেশনে যে সমস্ত দলিল পেশ করলো কম্যুনিস্টরা সেগুলি গুরুত্ব পেতে শুরু করলো। কংগ্রেসের মধ্যে বাম লবি শক্তি সংগ্রহ করতে শুরু করলো। এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে সমাজতন্ত্রের যুক্তিকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর চূড়ান্ত বিরোধিতা শুরু হল।

যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কট্টর বিরোধিতার এই পর্যায়ে হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক আরও তিক্ত হল। কংগ্রেসের সরকারগুলির মুসলিম আচরণ যেমন তার কারণ আবার অন্যদিকে হরিপুরা ও ত্রিপুরী কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে কট্টর যুক্তরাষ্ট্রীয়্য কাঠামোর বিরোধিতা নিশ্চয়ই তার অন্যতম কারণ।

এদিকে কম্যুনিস্টদের সাথেও কংগ্রেসের টানাহেঁচড়ার সম্পর্ক চলছে। কংগ্রেস সরকারগুলির শ্রমিকদের উপর অত্যাচার, কিন্তু অন্যদিকে বন্দি মুক্তি, একদিকে সুভাষ-জওহরলাল নেহরু চাইছেন সোভিয়েত ধাঁচের শিল্পায়ন, রাজন্য বর্গের ক্ষমতা হ্রাস, ইয়োরোপে তারা কুম্যুনিস্ট পার্টির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখছেন, আর অন্যদিকে প্যাটেল গান্ধী রা চাইছেন রাজন্য বর্গের গায়ে যেন আঁচড় না লাগে। স্বাভাবিক অবস্থায় কম্যুনিস্টরা যা করেছেন, যেভাবে দুই হাত তুলে নেহরু-সুভাষ লবিকে সাহায্য ও সমর্থন করেছেন তার মধ্যে কোনো ভুল ছিলনা। কমরেড রজনী পাম দত্তের প্রেরিত চিঠিটি ছিল এরকম--- The Haripura Session of the Congress will consider the question of the efforts of the Government to impose the Federal side of the Constitution. … The question of the attitude of the vast mass of the Indian people towards the Federal Government will be decided, not by a formula satisfactory to certain elements in India and to the British Government, but by the Indian National Congress representing the vast masses of Indian people. ……Very careful consideration will undoubtedly be given by the Haripura Session to the attitude of the Congress to the introduction of the Federal Government. The question is raised in this connection of the need to support the struggle of the people in the Indian States for democratic rights and civil liberties. 

কমরেড ব্র্যাডলি থেকে শুরু করে মাও সেতুং-এর পার্টি, সকলে ত্রিপুরীতে সুভাষের কংগ্রেসকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠালেন। কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল না। হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকেছিল। দেশভাগের দিকে ভারত এগোচ্ছিল। ফলে রাজন্য বর্গের রোগ সারাতে যে ওষুধ দেওয়া হল তাতে যে মুসলিম সমাজও মারা পড়ছে সেটা না বোঝার কোনো কারণ ছিল না।

কংগ্রেস-লীগ জোট সরকার কম্যুনিস্টরা চাইলেন, কিন্তু ইংরেজদের মধ্যস্থতা নয়

ফ্যাসিবাদ বিরোধী যুদ্ধ, অনাক্রমণ চুক্তি ভঙ্গ, এর পরেই গঙ্গাধর অধিকারীর থিসিস কাকতালীয় ঘটনা নয়। পার্টির দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নেতারা প্রত্যেকেই দুর্বল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সপক্ষে স্পষ্ট মতামত দিলেন। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, লীগের ধর্মের ভিত্তিতে রাজ্য গঠনকে সমর্থন জানানো হল। এমনকি পৃথক হওয়ার অধিকারকেও। এতদিনে যুদ্ধে নেমে পার্টির হুঁশ ফিরলো। জোটের গুরুত্ব তারা বুঝলেন। মুসলিম সমাজকে পাশে নেওয়ার গুরুত্বও। যেটা ১৯১৬ সালেই গান্ধী বুঝেছিলেন। কিন্তু এগুলি ছিল পার্টির কৌশল। নীতিতে বদল এলো না আর তাই স্বশাসিত রাজ্য, বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার, কংগ্রেস-লীগ জোট সরকার তারা চাইলেন অথচ একই সাথে ক্রীপস মিশনকে সমর্থন কিছুতেই জানানো হল না। কারণ ওটা সাম্রাজ্যবাদের প্রস্তাব। সেখানে সার্বজনীন ভোটাধিকার নেই, শ্রমিক কৃষকের অধিকার নেই, সবচেয়ে বড় কথা ইংরেজদের মধ্যস্থতা আবশ্যিক বলা হয়েছে। তাই ক্রীপস মিশন বাতিল--- গান্ধীর কথা আর কম্যুনিস্টদের কথা মিলে গেল। আর মুসলিম সমাজ আতংকিত হল। অর্থাৎ নীতি একই থাকলো, শুধু কৌশল হয়ে গেল নীতি বিরোধী।   

ক্রীপস মিশন ও ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রামকে কেন্দ্র করে নতুন ও উচ্চতর জোট হওয়ার সুযোগ তৈরী হয়েছিল। এই প্রথম বৃটিশ মিশন ঘোষণা করলো যে ভারতীয়দের হাতেই কাঠামো তৈরীর স্বাধীনতা দেওয়া সম্ভব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে কংগ্রেস ফ্যাসিবাদবিরোধী ফ্রন্টে থাকার সিদ্ধান্ত নিল। গান্ধীজীর তাতে মত ছিল না, কিন্তু নেহরু-আজাদ তা অমান্য করেছিল। গান্ধীজী প্রথম থেকেই জাপানের দিকেই থাকতে চেয়েছিলেন। আর নেহরু ও আজাদ ১৯৪১ সালের পর, যখন জাপান সিঙ্গাপুর হয়ে ভারতে ধেয়ে আসছে, তখন ফ্যাসিবাদ বিরোধী ফ্রন্টে থাকার সিদ্ধান্ত নাকচ করে ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’-র ডাক দেওয়া হল। জাপান যাতে ভারত দখল করতে না পারে, কংগ্রেস নেতারা যাতে জাপানের দিকে ঢলে না পরে সেই আতংকে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ১৯৪২ সালে ক্রীপসের লোভনীয় প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। যুদ্ধান্তে স্বাধীন ভারতের প্রস্তাব। যুদ্ধ চলাকালীনই প্রশাসন হস্তান্তরের প্রস্তাব। শুধু যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে ইংরেজরা। আর যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, দুর্বল কেন্দ্র, সবল রাজ্য। কিন্তু মানা হল না।  গান্ধীজী ক্রীপসকে ‘টাউট’ গালাগালি দিয়ে তাড়ালেন। ক্রীপস মিশনের প্রস্তাব মেনে নিয়ে কংগ্রেস-বাম-লীগ যদি যৌথভাবে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তো, যেমনটা খিলাফতের যুগে তারা করেছিল, তা হলে আবার এক ঐক্য গড়ে উঠতো। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ যদি কথার খেলাপ করতো, তাতেও অসুবিধা ছিল না। কারণ ঐক্য বজায় থাকতো জনগণের। ক্ষমতা হস্তান্তরের বদলে জনগণ ক্ষমতা কেড়ে নিতো তাদের।  কিন্তু এই দিকে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল না কংগ্রেসের। কংগ্রেস সমাজতন্ত্রীদের হাতে যুদ্ধের দায়িত্ব দিয়ে কংগ্রেস নেতারা কারাবরণ করলেন। ইতিহাসবিদ সুমিত সরকার বলছেন, সেটাই কংগ্রেসের কৌশল ছিল। বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিলেন তারা। আর তাই চীন ও রুশ জনগণের দাক্ষিণ্যে হিটলার ও জাপানের পরাজয়  দেখে কংগ্রেস নেতৃত্ব জেল থেকে বেরিয়ে আবার ইংরেজদের সাথে বৈঠকে বসলেন, ভারত ছাড়ো-র দাপট তখন আর নেই। আবার তারা নরমপন্থী হয়ে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে ক্রীপসের প্রস্তাবটিকেই হুবহু গান্ধী পেশ করলেন শুধু দুর্বল কেন্দ্র আর সবল রাজ্য নিয়ে নীরবই থাকলেন। এদিকে জিন্নাহ সজোরে পাকিস্তান নামক দেশের কথা বলছেন ভাষণে, সর্বত্র। এই উত্তাল চল্লিশ জুড়ে কম্যুনিস্টরা শ্রেণী সংগ্রাম করছেন, জোর দিয়ে কংগ্রেস লীগ জোট সরকারের কথা বলছেন। কিন্তু আগে ইংরেজরা যাক, তার পর একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার ও সংবিধানসভা গ্রহণ, এই সহজ সরল দাবি কম্যুনিস্টদের।

এক অদ্‌ভুত পরিস্থিতি তৈরী হল। কম্যুনিস্ট পার্টি লীগের দাবি মেনে নিয়েছে, কিন্তু ইংরেজদের উপস্থিতিতে চুক্তিতে রাজী নয়--

We were the first to see and admit a change in its character when the league accepted complete independence as its aim and began to rally the Muslim masses behind its banner. we held a series of discussions within our party and came to the conclusion in in 1941 42 that it had become an anti imperialist organisation expressing the freedom urge of the Muslim people, that its demand for Pakistan was a demand of self determination and that for the freedom of India and immediate joint front between the Congress and the league must be forged as the first step to break imperialist deadlock.

ইংরেজরা চলে গেলে, জোট সরকার সংবিধান বানিয়ে, সীমানা নির্ধারণ করে, রাজ্যের বিন্যাস করে রাজ্যগুলিকে বিচ্ছিন্নতার অধিকার দেবে।

The question is whether to find out a peoples solution to the problem, which will be the basis of the congress league joint front for freedom, or whether we allow an imperialist solution to be imposed upon us in the absence off the former..

কুপল্যান্ড আর চার্চিল মিলে যে চক্রান্ত করলেন তা সফল হল। কম্যুনিস্ট পার্টির উপরোক্ত যুক্তিকেই শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস ব্যবহার করলো ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব শেষ বেলায় বাতিল করে। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস ও দেশভাগের সূচনা করে।

প্রিন্সিস্তান ও দেশভাগ, দুটোই হল

চার মাস ধরে বৈঠক চললো ক্যাবিনেট মিশনের সাথে কংগ্রেস ও লীগের। প্রথমেই লীগের পাকিস্তান প্রস্তাবকে বাতিল করল মিশন। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর এক নির্দিষ্ট রূপকেও হাজির করা হল। দুর্বল কেন্দ্র আর সবল রাজ্য। পাশাপাশি রাজ্যগুলিকে ধর্মের ভিত্তিতে তিনটি group করার স্বাধীনতা দেওয়া হল। পশ্চিমের মুসলিম প্রধান রাজ্য, হিন্দু রাজ্য আর পূর্বের বাংলা আসাম। গ্রুপ বদল করার স্বাধীনতা থাকলো। লীগ গ্রুপ বদল করার প্রস্তাব মানতে রাজী নয়। শেষ পর্যন্ত তিন পক্ষে বোঝাপড়ার অভাবে সাম্রাজ্যবাদ যে প্রস্তাব দিল জিন্নাহ সেটাই মেনে নিলেন। অর্থাৎ লীগ রাজ্যগুলির বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারকেও ত্যাগ করল।

কংগ্রেস অধিবেশনে আজাদের সভাপতিত্বে সিদ্ধান্ত হল যে তারাও মেনে নেবে। কিন্তু রাতারাতি পিছিয়ে গেল কংগ্রেস নেতৃত্ব। তারা আবার বিপ্লবী হয়ে উঠলো। ইংরেজদের মধ্যস্থতায় কোনো সিদ্ধান্তই তারা মেনে নিতে রাজী নয়!! দুর্বল কেন্দ্রে তারা রাজী নয়। এই আচমকা বিপ্লবীয়ানা, আচমকা ‘বামপন্থা’ এমনকি কংগ্রেস সভাপতি আজাদও মানতে পারেননি। ১৯২৭ সালে ‘পার্টিং অব ওয়েজ’ হয়েছিল জিন্নাহ-র সাথে। এবারে আর শুধরানোর সুযোগ থাকলো না। কারণ ইংরেজদের যেতেই হবে। আর একদিনও ভারত সংসার টানার পয়সা তাদের নেই। এখানে সৈন্য পোষার টাকা তাদের নেই। ‘দিন আনি দিন খাই’ দশা তাদের। মার্কিন ধারে ডুবে গেছেন তারা।

কম্যুনিস্ট পার্টি ক্যাবিনেট মিশনকে প্রিন্সিস্তান মিশন আখ্যা দিয়েছিল। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম দাঁড়ালো, সমাজতন্ত্রের ইজ্জত রাখতে দেশভাগ রোখার চেষ্টা হল না!! দীর্ঘ চার মাস মিটিং করার কি কারণ ছিল কংগ্রেসের? উত্তর নেই। লীগ যেখানে দুটো (পৃথক রাষ্ট্র ও রাজ্যগুলির বিচ্ছিন্নতার অধিকার) গুরুত্বপূর্ণ দাবি থেকে সরে এল সেখানে কংগ্রেস এতটুকুও নমনীয় হল না কেন? উত্তর নেই।

প্রশ্ন হল, যে প্রিন্সিস্তানের ভয় পেয়ে দেশভাগকে আটকানো হল না, সেই প্রিন্সদের কি জব্দ করা গেলো? দেশভাগের পর ভারতের প্রিন্সদের জব্দ করার দায়িত্ব দেওয়া হল বল্লভভাই প্যাটেলকে!! যিনি প্রিন্সদের এতটুকুও বিরক্ত না করার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন ১৯৩৮ সালে। স্বাধীন ও বিভক্ত ভারত প্রিন্সদের আব্দারই মেনে প্রভূত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হল!! কমরেড লেনিন বৃহত্তর স্বার্থে ব্রেস্ট লিতভস্ক চুক্তি করতে পিছুপা হননি। দলের মধ্যে প্রবল বিরোধ সত্ত্বেও। সাম্রাজ্যবাদের সাথে আপোষ করছেন তিনি, এই অভিযোগ সত্ত্বেও। ১৯১৮ সালের সেই শিক্ষা নিয়ে ১৯২০ সাল থেকেই ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি এগোতে পারত। দেশভাগ রুখে দিয়ে ভারতের রাজনীতির লাগাম নিজেদের হাতে তুলে নিতে পারত। মুসলিম সমাজকে জিতে নেওয়ার মধ্য দিয়েই পরিচিতি সত্ত্বার মৌলবাদী রাজনীতিকে প্রতিহত করতে পারতো।