নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে : দেশভাগের যন্ত্রণার আখ্যান

আলপথ ধরে ছুটছে তিন কিশোর কিশোরী। কখনও রঙিন প্রজাপতি, কখনও কোনো অজানা ফুলের ঘ্রাণ কিংবা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সুমিষ্ট ফল কিশোরীটির কোঁচড় ভরে দেওয়ার অভিপ্রায়ে দুই কিশোরের নির্মল প্রতিযোগিতায় সোনালী বালির চরের সব আলো এসে জড়ো হয়েছে কিশোরীর মুখে... সমস্ত আকাশ আজ অবারিত; নিষ্কলুষ সকাল খেলে বেড়াচ্ছে ফসল ভরা ধানের ক্ষেতে। পুকুরঘাটে মাছের ঝাঁক দু'হাতে সরিয়ে ডুব সারছে পরিচ্ছন্ন গৃহস্থ সংসার...অথচ এমন পরিপূর্ণ সজল শ্যামল অঙ্গনেও অন্নের অভাব। শূন্য হাঁড়ি পাতিলে এক বুক ক্ষুধা... ঠান্ডা মেঝেতে পেট চেপেও সে জ্বালার উপশম নেই। গতকাল জোতদারের জমিতে মুনিষ খেটে ফাঁকা হাতে ফিরে ধু ধু মাঠের দিকে তাকিয়ে আছে ফ্যালফ্যালে দুই চোখ। ফজরের নামাজে বসে কেউ দোয়া মাঙছে ঠাকুরবাড়ির পাগলমানুষটার জন্য...ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে বিধর্মীর বাড়িতে শুশ্রূষার উপাচার পাঠাচ্ছে কর্তামা...এই বিপুল বিস্ময়ের একটুকরো মানচিত্রে গ্রীষ্মের পর বর্ষা, বর্ষার পর শরতের আগমন সহজ। অনাবিল তার প্রকাশ। ক্রমান্বয়ে আসছে দীর্ঘ শীত... আবারও মাঠঘাটের প্রবল দহন তুচ্ছ ভুলে মুহূর্তে ছাই করে দিচ্ছে ছেঁচা বেড়ার ঘর...অনাহারের দল ভিড় করছে শালুক বিলে...কেউ বা আর ফিরছে না ঘরে...দুলে উঠছে আসমুদ্রহিমাচল...সেই যে তিন কিশোর কিশোরী ছুটছিল অনন্ত আনন্দের পথে কেবলই মুছে যাচ্ছে তাদের শৈশব। সময় তাদের গায়ে ততদিনে জড়িয়ে দিয়েছে অমোঘ চিহ্নদের... তাদের একজন সামসুদ্দিন, মুসলিম লীগের নেতা। একজন মালতী, হিন্দু বিধবা। তার স্বামী ঢাকার রায়টে প্রাণ হারিয়েছে বলে লজ্জায় সামু এড়িয়ে চলে তাকে আর তৃতীয় জন ইংরেজ বিরোধী কাজের জন্য আত্মপরিচয় গোপনকারী রঞ্জিত। মুসলমানদের আক্রমণ থেকে হিন্দুদের সহায় সম্পত্তি ও হিন্দু নারীর সম্মান রক্ষা করতে ছেলেদের নিয়ে সে গড়ে তুলেছে লাঠিখেলা, ছোরা চালানোর শিক্ষা শিবির...তিরতিরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে টুকরো টুকরো বিভেদের নিশান। তবুও যখন এসে দাঁড়ায় দুই বন্ধু মুখোমুখি, পাশাপাশি বসে থাকে আসন্ন সন্ধ্যার আবছায়ায় তারা মালতীকে নিয়ে ভাবে...ভাবে তার নিরাপত্তা নিয়ে, তার দুর্ভাগ্য নিয়ে...এ যেন ঠিক এক ভূখণ্ড নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের নিজের নিজের অনুভব, অধিকারবোধ, মায়া... জব্বার ও তার সঙ্গীদের হাতে লাঞ্ছিত মালতীর জন্য আজীবন মনঃকষ্টে ভুগেছে সামু । বেশ কয়েকবছর পরে অন্য এক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে..." মালতীর কথা মনে আসতেই আবেগে সে বলে উঠল , আজ আমাদের আন্দোলনের দিন, মায়ের ঋণশোধ করার দিন। আমাদের মা , বাংলামার চেয়ে বড় কিছু নেই। যতদিন ঋণশোধ না হবে ততদিন আমাদের রেহাই নেই..."

অথচ বড় দেরি হয়ে গেছে ততদিনে। হিজল গাছে সামুর ঝোলানো ইস্তাহার একসময় ঘনকালো মেঘের আদলে ঢেকে দিয়েছে মানবজীবনের যা কিছু শাশ্বত সুন্দরের আরাধনা। যা কিছু সঞ্চয়ে ছিল মানবতার...দয়া,মায়া, স্নেহ, প্রেম, প্রীতি সবই নিলামে উঠেছে মৌলবাদের। সেই তিন কিশোর কিশোরীকে জীবনের পথ শুধু বিভ্রান্তই করেনি, কেড়ে নিয়েছে অপার্থিব সেই ভোরের স্বপ্নগুলো যেগুলোর খোঁজে উড়ে গেছে নীলকন্ঠ পাখি... একান্ত সুখের বার্তা... সেই আশ্বাস... সেই আকাঙ্ক্ষা...সেই অঙ্গীকার... 'স্বাধীনতা'!

"Time flies over us , but leaves its shadow behind"

সুদীর্ঘ এই পঁচাত্তর বছরের যাত্রাপথের সূচনাকালীন অগ্নিগর্ভ সময় ও সমরাঙ্গনের সকল রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক মুহূর্তরা যখন ইতিহাসের পাতায় স্তব্ধ হয়ে রয়েছে তাদের মুখর করে তুলতে দারস্থ হতে হল শত শত সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের ওপর সভ্যতার চাকাকে এগিয়ে নিয়ে চলা শাশ্বত মানবের... ইতিহাসের সাক্ষ্য দিতে এলো অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের "নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে"র ঈশম শেখ, আবেদালি, জালালি, জোটন,মনজুর, ফেলু শেখ, বড়কর্তা, শচীন্দ্রনাথ, নরেন দাস, আভারানী ,ফকিরসাহেবেরা... এক  আশ্চর্য রূপকথার আরশিতে ধরা পড়ল 'সময়'...যা চিরতরে হারিয়ে গিয়েও রেখে গেছে তার প্রগাঢ় ছায়া ।

'স্বাধীনতা' । বড় গুরুভার এই শব্দটি মধ্যযুগের নাইটদের সামনে দ্য হোলি গ্রেল এর হাতছানির মতো আলোর পিপাসা জাগিয়ে তুলেছিল গত শতকের পরাধীন দেশবাসীর বুকে। অথচ শব্দটাকে ছুঁয়ে দেখতে পারেনি তারা যারা এনে দিয়েছিল প্রমিথিউস হয়ে স্বর্গের আগুন। এশিয়ার দক্ষিণের এই দেশটি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্যই সুপ্রাচীনকাল থেকে বহির্বিশ্বের আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিল। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও শিখ এই চার ধর্মের উৎসভূমি ভারতবর্ষ। পার্সী, ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্ম এদেশে বারংবার প্রবেশ করেছে কখনও লুন্ঠনকারীর দঃসহ নিষ্ঠুরতায় আবার কখনও শাসকের স্বৈরাচারী শোষণে কিংবা ঔদার্য্যে। ধর্মের প্রসঙ্গটি এই আলোচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেননা কিছু সংখ্যালঘিষ্ঠ বিবেকবান ব্যক্তি জোর গলায় ধর্মনিরপেক্ষতার বাণী প্রচার করলেও মানব সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধ্বংস করার জন্য ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে জুড়ে গোটা পৃথিবীকেই যেখানে ভয়ঙ্কর অভিশাপগ্রস্ততার মধ্যে নিমজ্জিত করা হয়েছে সেখানে আমাদের ভারতবর্ষের স্বাধীনতাও মুক্তি পায়নি তার করাল গ্রাস থেকে। তাই আজও তার ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকার ত্যাগ, বৈরাগ্য, শৌর্য, শান্তি ও আত্মত্যাগের মহিমায় লেগে থাকে এক করুণ বিষাদ...

"যদি ডাকি রক্তের নদীর থেকে কল্লোলিত হয়ে

বলে যাবে কাছে এসে, ইয়াসিন আমি,

হানিফ মহম্মদ মকবুল করিম আজিজ

আর তুমি?' আমার বুকের 'পরে হাত রেখে মৃত মুখ থেকে

চোখ তুলে শুধাবে সে রক্তনদী উদ্বেলিত হয়ে

বলে যাবে, গগন, বিপিন, শশী, পাথুরেঘাটার'"

জীবনের চেয়ে ধর্ম যখন বড় হয় আর কুৎসিত রাজনীতি যখন ধর্মকে হাতিয়ার করে তখন তার পরিণতি যতখানি ভয়াবহ হতে পারে তা প্রত্যক্ষ করে মানুষ স্বাধীনতা ও দেশভাগ পূর্ববর্তী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়।

১৫ই অগাস্ট , ১৯৪৭ । ক্ষমতা হস্তান্তরের এই তারিখটা ঠিক করেছিলেন ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন। ১৪ই অগাস্ট মধ্যরাতে স্বাধীনতার উৎসব শুরু হল। নয়া দিল্লির সংসদ ভবনে সেদিন রাত ১১টায় প্রথমে 'বন্দে মাতরম্' গান, শহিদদের উদ্দেশে দু' মিনিট নীরবতা। প্রথম দুটি বক্তৃতার পর মাইক্রোফোন হাতে নিলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু , " এই মধ্যরাতে, সারা দুনিয়া যখন নিদ্রায় আচ্ছন্ন , ভারত জেগে উঠল নতুন জন্মের স্বাধীনতায় ।" 

জন্ম হল আরো একটি নতুন দেশ পাকিস্তানের। যার দুটি অংশ ; ভারতের উত্তর পশ্চিমে পশ্চিম পাকিস্তান আর বাংলার একটা অংশ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান। তার আগে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ কেবল ধর্মের কারণে  ভিটেমাটি হারিয়ে উদ্বাস্তু তকমা লাগিয়ে এসে পৌঁছেছে 'নিজের দেশে' । দুই পাকিস্তানের সাধারণ মুসলমানদের বোঝানো হয়েছিল হিন্দুরা তাদের দেশে চলে গেলে জমি জায়গা ব্যবসা বাণিজ্য সবকিছুর একচ্ছত্র মালিকানা হবে তাদের। অভাব দূর হবে চিরতরে।

তাই হিজল গাছে ঝোলানো লীগের ইস্তাহার মালতীকে ছিঁড়তে দেখলে সামু বলত :

-এডা করলি ক্যান?

-ক্যান করুম না। দেশটা কেবল তর জাতভাইদের?

-ক্যান আমার জাতভাইদের হইব। দেশটা তর আমার সকলের।

-তবে কেবল ইসলাম ইসলাম করস ক্যান ?

-করি আমার জাতভাইরা বড় বেশি গরু- ঘোড়া হইয়া আছে। একবার চোখ তুইল্যা দ্যাখ , চাকরি তগ, জমি তগ , জমিদারি তগ। শিক্ষা দীক্ষা সব হিন্দুদের।

তাই জালালির কবরে তারা ইস্তাহার বিছিয়ে দিল। তাতে লেখা আছে 'মুসলিম লীগ ... জিন্দাবাদ...যেন সামুর বলার ইচ্ছা , চাচি , আমরা এই ফসল এবং মাঠ আমাদের জাতভাইদের দিয়ে যাব, আমরা এমন সব সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছি। ধর্ম আমাদের সকলের ওপরে...রসুল আমাদের মহম্মদ, আল্লা এক... তাঁর কোনো শরিক নাই।'

সমাজবিজ্ঞানের গবেষণা হিন্দু প্রাধান্য ও মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক দুঃখ দুর্দশার মধ্যে কার্য কারণ সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা করেছে। ১৮৭১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলার জনসংখ্যার প্রায় অর্ধাংশ ছিল মুসলমান। ময়মনসিংহ, পাবনা, বরিশাল, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের মতো জেলাগুলোতে শতকরা ষাট ভাগ মানুষ ছিল মুসলমান যারা জীবিকা নির্বাহ করত মূলত চাষি কৃষক ও হিন্দু জমিদারদের খেতমজুর হিসেবে। যদিও কিছু মুসলমান জমিদার পরিবারও ছিল। সরকারি চাকরি ও অন্যান্য কর্মসংস্থানে হিন্দু মুসলমান কর্মচারীদের অনুপাত ছিল ৭:১। বিশ শতকের প্রথমদিককার দাঙ্গাগুলির অন্যতম কারণ ছিল এই অর্থনৈতিক বৈষম্য। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে কোথাও এক শোষক ও শোষিতের সম্পর্ক গড়ে ওঠে  যাদের মধ্যেকার ধর্মগত ও কৃষ্টিগত ফারাক এই সংঘর্ষকে সাম্প্রদায়িক রূপ দেয় আর তাতে অগ্নিসংযোগ করে ব্রিটিশ সরকারের বিভাজন নীতি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ক্ষমতা লিপ্সা।

তবে ১৯২০ সালের পর থেকে অর্থনৈতিক বৈষম্যের ছবি অনেকটাই বদলে যায়। সেই সময় থেকে যথেষ্ট সংখ্যক মুসলিম জমিদারশ্রেণির সৃষ্টি হয়। যতদিন যেতে থাকে বাড়তে থাকে দুই সম্প্রদায়ের পারস্পরিক বিদ্বেষ এবং ১৯৪০ সালের পরবর্তী দাঙ্গাগুলোর সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির সুস্পষ্ট যোগাযোগ ছিল, ছিল ক্ষমতা দখলের ইঙ্গিত। অনেক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন ১৯৪৭ এর দেশভাগ আসলে জিন্নাহ ও নেহরুর মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতারই এক অবশ্যম্ভাবী ও অনিবার্য পরিণতি ছাড়া আর কিছুই নয়। লড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল দু'পক্ষের মানুষদের যাদের মধ্যে ধর্মীয় ও কৃষ্টিগত দূরত্ব থাকলেও ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গাটিতে আন্তরিকতার অভাব ছিল না কখনই। অচৈতন্য মালতীকে মায়ের স্নেহে বুকে আগলে রাখে জোটন। ফকির সাহেব মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করেও অলৌকিকভাবে বাড়ির উঠোনে পৌঁছে দিয়ে ঢেকে দেয় অপমানিত বিধবার সব লজ্জা । শচীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে সামুর ভোটে দাঁড়ানোর কারণ কিছুতেই মাথায় ঢোকে না আবেদালির। বরং পাগলঠাকুরকে রাতে বাইরে দেখে দুর্ভাবনায় অস্থির হয়ে ওঠে সে। এই উপন্যাসের লেখকের কলমে মূর্ত হয়ে উঠা স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সংকটকাল ও দেশভাগের যন্ত্রণা তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার দলিল। ঈশম শেখের মতোই এক দরিদ্র মুসলমান রনাদার কোলে পিঠে বড় হন তিনি। তাঁরা দেশ ছেড়ে এপারে চলে আসার আগে মুসলমান প্রজারা জানতে চায়...

" অ দ্যাশে খাইবেন কী, করবেন কী, না খাইয়া মরলে আমাগ ইজ্জত থাকে?"

একই জল বাতাস মাটিতে বেড়ে ওঠার সহজাত এই বাঁধন ছিঁড়তেই ছড়ানো হয়েছিল উগ্র মৌলবাদের বিষ।

দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের পরে ঈশম সামসুদ্দিনের জন্য নিয়ে আসত টিনের তলোয়ার। ' সামু ঝকঝকে তলোয়ার দেখে চাচাকে জড়িয়ে ধরত। সে দুগ্গাঠাকুরের তলোয়ারটা বালিশের নিচে রেখে দিত। সকাল হলে সে রাজা সেজে বাড়ি বাড়ি ঘুরে আসত , মাথায় তার আমপাতার মুকুট। সামুর মনে হল ওর সেই আম-জামপাতার মুকুট এখনও কে যেন মাথায় তার পরিয়ে রেখেছে। সে যতই হিন্দু বিদ্বেষের কথা বলুক মাথার আম-জামপাতার মুকুট সে ফেলে দিতে পারেনি। ফেলে দিতে গেলেই দেখেছে ভিতরটা তার হাহাকার করে উঠেছে।'

কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের অনৈক্যকে কাজে লাগিয়ে ভারত সরকার এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করে যাতে তারা কখনোই আর যৌথভাবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে জোরদার করতে না পারে। তবুও সাধারণ হিন্দু মুসলমান নানা সংকটে পাশাপাশি এসেছে ।যেমন রাওলাট আইনের সময় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে ও আইন অমান্য আন্দোলনের প্রথম দিকে। কোনো নেতৃবৃন্দের আদেশের তোয়াক্কা না করে ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে কলকাতার জনগণ আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দিদের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের আচরণের তীব্র প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধ হয় । অথচ কয়েকমাস পরেই কলকাতা, নোয়াখালী ও ত্রিপুরায় তারাই আবার চরম নিষ্ঠুর নির্যাতন ও রক্তপাতে মেতে ওঠে। লক্ষ লক্ষ স্বজন হারা, বাস্তুচ্যুত মানুষের কান্নার শব্দ তোপধ্বনিতে ঢেকে স্বাধীনতা আসে...তবু কি মানুষ খুঁজে পেল  স্বদেশ ? মানুষের অধিকারে বাঁচার সম্মান? নাকি ততদিনে উদ্বাস্তু হয়েছে সবাই?

'কেউ উৎখাত ভিটে মাটি থেকে,

কেউ উৎখাত আদর্শ থেকে।'

সাহিত্য ধরে রেখেছে সেই ক্ষত, অসীম যন্ত্রণার ছবি। সাহিত্যিক অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন পূর্ববঙ্গের নাম থেকে বাংলা শব্দটা বাদ চলে যাওয়ার ব্যথা ভুলতে পারেননি তিনি।  মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ নাম ফিরে আসায় তিনি খুশি হয়েছিলেন । উৎসর্গ করেছিলেন "নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে" উপন্যাসটি তাঁর মা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে। দেশভাগকে অনিবার্য হিসেবে উপস্থাপন করে যে সুখের স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের অচিরেই তার স্বরূপ উদ্ঘাটিত হয়। তাই ১৯৪৭ এর স্বাধীনতার পরেও আরো দু'দুটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ইতিহাস রচিত হল স্বাধীন বাংলাদেশের ললাটে। তখনও তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল জোর করে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া দেশের রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক জনমানস। কখনও কখনও স্বপ্নভঙ্গের ব্যর্থতা পিছনে তাকায়... সোনালী বালির চরে গুমরে ওঠে একবুক শূন্যতা...

'বুঝি ঈশমের হাতে সে এক মুশকিলাসানের লম্ফ দেখতে পেল। কেন যে এতদিন পর ঈশমচাচার কথা ওর মনে এল সে জানে না। ...সে এতদিন ঈশম চাচার কোনো খোঁজই রাখেনি। ঠাকুরবাড়ির সবাই চলে গেছে... তারপর চাচার কী হল , সে কোথায়, সে জানে না। সে জানে না ঈশম অন্নহীন , ভূমিহীন। ঈশম হয়তো গভীর রাতে তরমুজের জমিতে ফিরে আসতে চায়। ঈশম হয়তো দেখতে পায় তখন তার নীলকন্ঠ পাখিরা সব উড়ে গেছে কোথাও। হাতের তালিতে আর ওরা ফিরে আসবে না। ঠাকুরবাড়ির মানুষদের ও-পারে বুঝি এতদিনে সেই পাখিটার খোঁজ মিলে গেছে। না মিলে গেলে ওরা আবার নদী বন মাঠ পার হয়ে ছুটবে। সামসুদ্দিনের মনে হয়েছিল তার পাখি আকাশে ওড়ে না, নদীর পাড়ে বসে থাকে। দেশভাগের পর পরই সে ভেবেছিল, তবে বুঝি এবারে সব মিলে গেল... কিন্তু হায়, যতদিন যায় সে দেখতে পায় সংসারে সবাই পাখিটাকে ছেড়ে দিয়ে বসে থাকে ... আবার খুঁজে বেড়ায়। পেলে মনে হয় পাখি মিলে গেছে , দুদিন যেতে না যেতেই মনে হয় পাখিটা আর নীলরঙের নয়, কেমন অন্য রঙ হয়ে গেছে। সে বলল, এটা আমাদের জীবন মরণের শামিল। থামলে চলবে না। আমাদের সংগ্রাম চলবে..."

স্বপ্নের সন্ধানে চলে আবহমান কাল। ব্যক্তি মানুষের স্বপ্ন কখনও প্রকান্ড ডানা মেলে আকাশ ছুঁয়ে ফেলে রাষ্ট্রের স্বপ্ন হয়ে যায়। কিংবা ঠিক উল্টোটা। রাষ্ট্র যা ভাবাতে চায় সে তার বিপুল সংখ্যক হাত পা মাথাওয়ালা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। সেই কুহেলিকা জালে হাঁসফাঁস করে মরে মনুষ্যত্ব। নিগূঢ় সব সম্পর্কের মায়া বাঁধন কাটা পড়ে উদাসীন কালচক্রে। জালালির কবরের ইস্তাহার একসময় ভেসে যায় খড়কুটো হয়ে। যা পড়ে থাকে তা মালতীর মতো খুবলানো দেহ মনের এক দেশ, মণীন্দ্রনাথের মতো নিরুদ্দিষ্ট উদারতা , ফেলুর মতো ধ্বংসের বীভৎসতা। মহাকাল শুষে নিয়েছে সামু-মালতী-রঞ্জিতের চুকৈর ফলের শৈশব। আমাদের চারপাশের বৃক্ষলতায় এমন কত স্মৃতি, কত ডাক ভেসে থাকে। আবারও শুকনো ডালে কচি পাতা আসে। উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লেগে থাকে ঈশম শেখের তরমুজ ক্ষেত আগলে রাখার অকৃত্রিম ভালোবাসার ছবি...অন্যের জন্য পাহারা দিয়ে রাখা সুখ, সমৃদ্ধি, ঐশ্বর্য... মালিকানা বদল হল। ঠাকুরবাড়ির হাত থেকে তরমুজ ক্ষেত গেল হাজি সাহেবের ছেলেদের হাতে। হস্তান্তরিত হল ক্ষমতা, বিশ্বাস, নির্ভরতা। ঈশম শেখেরা নিঃস্বই থেকে গেল...শেষ নিঃশ্বাস পড়ার আগে ফিরে এলেও তরমুজের অমৃত আস্বাদ গ্রহণের সাধ অপূর্ণই থেকে গেল তার...মহাপ্রস্থানের পথের শেষ নায়কের মতো তারও সঙ্গী ছিল এক কুকুর।

 

স্বাধীনতার স্বপ্ন এঁকেছিল একদল মানুষ। মরণপণ সংগ্রামেই তীব্র হয়েছিল সেই স্বপ্নের স্বরূপ। একদল এসে দাঁড়িয়েছিল সন্ধিক্ষণে। প্রবল যন্ত্রণা শেষে উপশমের মতো হাতে এসেছিল স্বদেশ। আগামীর রূপায়ণে সেই স্বপ্নের গা থেকে খসে পড়েছে পালক । স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝের সমীকরণ মিলিয়ে দিতে গিয়ে বারবার প্রকট হয়েছে প্রস্তুতির অভাব, অপরিণামদর্শিতা। তবুও অতীত সংখ্যাগরিষ্ঠের স্মৃতিতে জাগিয়ে রেখেছে জাতীয়তাবাদী আদর্শের বোধ। কিন্তু তারও পরে যারা অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে, যাদের কাছে পৌঁছয়নি পরাধীনতার শৃঙ্খলিত জীবনের আঁচ তাদের কেউ কেউ গল্প শুনেছে, পড়েছে ইতিহাস কখনও হয়ত স্বচক্ষে দেখেছে কোনো স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারীকে কিন্তু আরো আরো পরের প্রজন্ম ? স্মৃতি যখন ফিকে হতে হতে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে এবং যখন তারা বিশ্বনাগরিক ? কেমন তাদের অবস্থান ? কীই বা তাদের ভাবনা দেশকে নিয়ে? কেবল সামরিক খাতে জাতীয় সম্পদের বিপুল ব্যবহার নিয়ে বিতর্কে কিংবা ঘুষঘুষে জ্বরের মতো জিইয়ে থাকা সীমান্ত সমস্যাগুলি প্রবল উত্তাপে ফেটে না পড়া পর্যন্ত অত্যন্ত নিশ্চিন্তে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে জাতীয়তাবাদের চিহ্নসকল। জীবনযাপন শৈলী, ভাষা, রীতিনীতি, খাদ্যাভ্যাস সবই এক নিপুণ সাম্রাজ্যবাদী গ্রাসে , সংকটে সভ্যতা। এই লেখা যখন চলছে তখন আফগানিস্তানে বোরখা না পড়ায় তালিবানদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে তরুণী, লিবিয়ার শরণার্থী শিবিরে রচিত হয়ে চলেছে মানবসভ্যতার কলঙ্কিত অধ্যায়...স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ত বুনে চলছে গোটা পৃথিবীর শৃঙ্খলিত মানবাত্মা।

তাই দীর্ঘ লড়াইয়ের শেষে যে মুক্তি এসেছিল ১৯৪৭ এর ১৫ই অগাস্ট তার মূল্যও বড় কম নয়।এই পঁচাত্তর বছরে আমাদের অর্জন , আমাদের পরাজয় আমাদের না ছুঁতে পারা স্বপ্নগুলো গ্রহণ করুক, সযত্নে লালন করুক আমাদের উত্তরাধিকার। বিশ্বনাগরিকতার মানচিত্রে  স্বদেশের  নীলকন্ঠ পাখিটা যেন চিরকালের মতো হারিয়ে না যায়।

'এই জমির এক অংশে ঈশমের জন্য একটু মাটি চেয়ে নিল সামু। এই জমির নিচে ঈশম চুপচাপ শুয়ে থাকবে... নানারকম ঘাস জন্মাবে কবরে। ফুল ফুটবে ঘাসে। ঈশমের কবরে সামু এবার নতুন একটা ইস্তাহার লিখে রেখে দিল। ইস্তাহারটার নাম বাংলাদেশ। ভূমিহীন অন্নহীন ঈশমের কানে কানে মাটি দেবার আগে বলার ইচ্ছা হল, কিছুই করতে পারিনি এতদিন। স্বাধীনতার মানে বুঝিনি। আপনাকে দেখে মানেটা আমার পরিষ্কার হয়ে গেল।... তারপর থেকেই মাঝে মাঝে আশ্বিনের কুকুর ঈশমের কবরের পাশে ঘোরাফেরা করলে টের পাওয়া যায় মহাবৃক্ষে সেই ক্ষত ক্রমে আবার মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে। অর্জুন গাছটা আরও বড় হচ্ছে। ডালপালা মেলে সজীব হচ্ছে...'

তথ্য ঋণ:

#'দেশভাগ' এর পটভূমি : বাংলা কবিতা ও কথাসাহিত্যে : ড. অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়

#সাম্প্রদায়িকতা : সুরঞ্জন দাস

#বারণরেখা , ভাবনার অন্য ভুবন