দই - বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতির এক অধ্যায়

সহজপাঠ দিয়েই শুরু করা যাক।

"বাটি হাতে এ, ঐ

হাঁক দেয় দে দৈ"

এ,ঐ দইয়ের জন্য ডাক দিল। তার আগে ই,ঈ ক্ষীর,খই খেতে বসেছে। সেই গন্ধে উ,ঊ আনন্দে ডেকে উঠেছে। এসবের মাঝে ঋ এসে একবার জানান দিয়ে গেছে যে দিনটা মোটেই সুবিধের নয়। জম্পেশ করে একটা ফলারের সম্ভাবনায় দইয়ের অনুপস্থিতি বুঝতে পেরেই মনে হয় এমন আহবান।গ্রীষ্মপ্রধান দেশে হাড়াজ্বালানি গরমে চিঁড়া, মুড়ি, খই, দই, আম, কলা, দুধ, ক্ষীর এতেই যা একটু রস, মিষ্টত্ব আর পরিতৃপ্তি। ডাকঘর নাটকের  রুগ্ন দুর্বল অমল জানালার ধারে বসে দইওয়ালার সাথে দু-দন্ড গল্প করে মনে ভারি শান্তি পায়। চন্ডালিকা নৃত্যনাট্যে প্রকৃতি দইওয়ালার কাছে দই কিনতে গেলে নীচু জাতে জন্ম নেয়ার অপরাধে তাকে বঞ্চিত হতে হয়। দই আবহমান সময়কাল ধরে বাঙালির জীবনের প্রতিদিনের খাবার,ভোজবাড়ির অন্যতম আকর্ষণ , পেটরোগার পথ্য, পেটুকের ভালোবাসা। ভালো নাম্বারের আশায় পরীক্ষা দিতে যাবার আগে কপালে দইয়ের ফোঁটা, ভাইফোঁটায় আয়ুবৃদ্ধি কামনায় কপালে দইয়ের ফোঁটা, বিজয়া দশমীর শেষে সাংসারিক সুখ সমৃদ্ধির প্রার্থনায় দরজায় দইয়ের ফোঁটা।

বাংলায় যা দই,ভারতের অন্যান্য অংশে তার নাম "দহি"। মিষ্টি দইয়ের চমৎকার স্বাদে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ জলযোগ দোকানের দইয়ের নাম দিয়েছিলেন "পয়োধি"। দই মূলত গেঁজিয়ে যাওয়া(fermented) দুধ যার কাছাকাছি  প্রকারভেদ হলো উত্তর ককেশাসের মূলত এলব্রুস অঞ্চলে প্রচলিত  "কেফির", মধ্য এশিয়ার  "কৌমিস" এবং  মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের ইয়োগার্ট। খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০o শতকে এই সকল অঞ্চলের বিস্তীর্ণ চারণভূমিতে পশুপালনের প্রচলন ব্যাপকভাবে ছিল। তাই সহজেই অনুমান করা যায় পালিত পশুর দুধ সংরক্ষণ করতে গিয়ে এসব খাবারের আবিষ্কার।

প্রায় চার হাজার বছর আগে যাযাবর জাতি ‘নোমাডিক’দের সূত্রে দই বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। গৃহপালিত পশুর দুধ বহন করার জন্য তারা প্রাণীর চামড়া দিয়ে বানানো থলে ব্যবহার করতেন যা ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টির আদর্শ পরিবেশ এবং সেই ব্যাকটেরিয়ার সংস্পর্শে গাঁজন প্রক্রিয়ায় ওই থলেতে রাখা দুধ দই হয়ে যেত। মনে করা হয় সমসাময়িককালে একইভাবে হয়তো আরও কিছু অঞ্চলে দইয়ের উৎপত্তি ঘটেছে। প্রথম দই কোথায় তৈরী হয়েছিল তা নির্দিষ্ট করে জানা না গেলেও বুলগেরিয়াকে দইয়ের দেশ বলা যেতেই পারে। দুধকে দইতে পরিণত করে যে ব্যাক্টেরিয়া তার নাম  ল্যাক্টোব্যাসিলাস বুলগেরিকুশ। বুলগেরিয়ার ঐতিহ্যবাহী খাবার ট্যারাটর নামের ঠান্ডা স্যুপ যা দই থেকে তৈরী হয়। সারাদিনের খাবারে কোনোটাতেই দই বাদ পড়ে না।

ডঃ স্টামেন গ্রিগোরভ ১৯০৪ সালে ‘রুকাটকা’ নামের মাটির পাত্রে বানানো দই নিয়ে পরীক্ষাগারে গবেষণার শুরু করেন। ১৯০৫ সালে তিনি আবিষ্কার করেন, গাঁজন প্রক্রিয়ায় দুধ থেকে দই হতে কোন ব্যাকটেরিয়া দায়ী।

মানুষ ক্রমশ বুঝতে পারলো দুধের সাথে অন্য কিছু উপাদান (ব্যাক্টেরিয়া) কোনোভাবে মেশালে যে পানীয় বা কোলয়ডীয় দ্রবণ তৈরী হয় তা বলকারক,সুস্বাদু,হজমে সহায়ক এবং পুষ্টিকর। তাই ওই অঞ্চল থেকে মানুষ যে সকল নতুন অঞ্চলে বসতি স্থাপন করল সেখানেই এসব দুধ গেঁজানো  খাবার তৈরী করতে লাগল। জলবায়ু,আবহাওয়া প্রাকৃতিক উপাদানের ভিন্নতার সাথে সাথে তার স্বাদ পাল্টাতে লাগল। গ্রীক ইয়োগার্টের সাথে মধু আর স্ট্রবেরী, দইয়ের সাথে হিমসাগর আম - সবরী কলা -রসা কাঁঠাল আর দহির সাথে ভাজা মশলা, শসা-পেঁয়াজ এভাবেই দুনিয়া জোড়া দইয়ের কারবার চলতে লাগল।

‘দই কিনতে মধ্যত খাল,

কইনা জুড়িতে মাও ভাল।’

'বাংলার মিষ্টি ' বইটির লেখক, বিশিষ্ট খাদ্য গবেষক হরিপদ ভৌমিকের মতে সমগ্র বঙ্গে উত্তরবঙ্গের দই সবচেয়ে সুস্বাদু এবং উনবিংশ শতকের মাজামাঝি সময় কাল থেকে তার বিপুল খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।তিনি লক্ষ্য করেছেন জলপাইগুড়ি বা পরবর্তীতে ডুয়ার্স জেলার বিভিন্ন গ্রামের নাম যেমন-মহিষবাথান,গরুবাথান,গাইশাল ইত্যাদি দইয়ের সাথে সম্পর্কিত। লোকালয় থেকে দূরে এসব গ্রামের বাথানে রাখালরা গরু চরাতো।উল্লেখ্য যে এই গরু চরানোর গান থেকেই বিখ্যাত 'ভাওয়াইয়া' গানের উৎপত্তি। বিয়ের অনুষ্ঠানে বরকে কনের বাড়িতে এক হাতে দইয়ের বাটি আরেক হাতে চালুনি নিয়ে বরণ করার সময় বাড়ির মহিলারা যে গান করেন সেখানেও দই অবিচ্ছেদ্য অংশ।

"হস্তে লইয়া দইয়ের বাটি

চাইলন বাতি চাইলন বাতি।

বরণ বরে বরের মুচকি হাসি।

চাইলন চালে বৈরাতির ঘর

বরের মুখ দেখে কইন্যার মাও"

বাঙালি বিয়ের অনুষ্ঠানে দই অপরিহার্য।মাছ আর দই ছাড়া আনন্দ অনুষ্ঠান সম্পূর্ণতা পায় না।

উত্তরবঙ্গে মূলত চার ধরনের দই প্রচলিত।

১। ছাঁচি দই: জ্বাল দেয়া ঘন দুধে দম্বল দেয়ার ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা পরে এই দই জমে।পুরনো দইয়ের উপরে পরপর ৫থেকে ৭ দিন একই পদ্ধতিতে দই জমানোর পর স্তুরীভূত যে দই পাওয়া যায়, তার নাম ছাঁচি দই।উৎসব,অনুষ্ঠানে, পালা পার্বনে এই দই সবচেয়ে জনপ্রিয়। ভালো দই কিভাবে কিনতে হবে তা এই অঞ্চলের লোকের মুখের ছড়ায় বলা আছে।

 দই কেনার সময় পাটকাঠি ঢুকিয়ে বুঝতে হবে দই জমাট কিনা। ছাঁচি দইয়ের উপরিতলের মধ্যের অংশ সাতদিন ধরে দই জমে ঢালু থাকে,তাই সেটা ভালো দই।

২। কাঁচা দই: জল না মেশানো কাঁচা দুধের এই দই জমতে ১থেকে ২দিন সময় লাগে।এই দইও পরপর কয়েকদিন স্তরে স্তরে জমানো হয়।এর অন্য নাম জ্যতি দই।

৩। দগড়া দই: তিনভাগ দুধের সাথে এক ভাগ জল মিশিয়ে দগড়া দই তৈরী হয়।হাল্কা জ্বালে দুধ শুধু ফুটিয়ে তৈরী করা এই দইয়ের অন্য নাম চিকনডাক দই।

৪। গলেয়া দই : গোয়ালা বা গোহেলিয়া থেকে এই দইয়ের নাম এমন হয়েছে।গোয়ালারা প্রতিদিন ঘরের দুধে যে দই পাতেন,সেই সাধারণ দইয়ের নাম 'গলেয়া দই'।দই তৈরীর আগে তারা দুধ থেকে মাখন তুলে নেন।তাই দুধে জলের ভাগ বেশি থাকে।দুধকে হাল্কা ফুটিয়ে দই তৈরী করা হয়।হজমে সহায়ক এই দই প্রাত্যহিক খাবারের তালিকায় সহজেই স্থান করে নিয়েছে।

"দইয়ের অগ্র ঘোলের শেষ"

দই নিয়ে এত গল্পের পর ঘোলেই চুমুক দেয়া যাক।বাংলা ১৩১১ সনে প্রকাশিত 'মিষ্টান্ন পাক' বইটির লেখক বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায় অনেক রকম দই তৈরীর প্রণালী এবং ঘোলের প্রকারভেদ বিষয়ে লিখেছেন।তাঁর মতে দই জমার পর পরিষ্কার, শুকনো পাতলা কাপড়ে দই ঝুলিয়ে রেখে দইয়ের যে জল পাওয়া যায় তাই ঘোল।এছাড়া ছানা কাটার পর যে ছানার জল বা whey তাও একপ্রকার ঘোল।ঘোলের পুষ্টিগুণ অসীম।ঘোল মূলত পাঁচ প্রকার

 ১। জল ছাড়া ও সর মেশানো ঘোলের নাম মন্ড

২। সর যুক্ত ও কল ছাড়া ঘোলের নাম মথিত

৩। যে ঘোলে অর্ধেক জল মেশানো হয় তার নাম তক্র

৪। সরহীন এবং চার ভাগের এক ভাগ জল মেশানো ঘোলকে বলা হয় ছবিকা

৫। আগের চারটি ছাড়া সাধারণ যে দুগ্ধজাত পানীয় তার নাম ঘোল।

বাঙালি পেট রোগা হলেও 'ঘোল খাওয়া'র চেয়ে খাওয়ানোতে আগ্রহী ছিল।বাংলা প্রবচনে ঘোল খাওয়ানোর নিহিতার্থ নাস্তানাবুদ করা।যুগ, বছর, মাস, দিন গড়িয়ে গেছে। পরিবেশগত কারণে জলবায়ু পাল্টেছে। বর্তমান সময়ের গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ঠেলায় দ’য়ে পড়া বং গোষ্ঠী তাই স্বাস্থ্যোদ্ধার এর জন্য ঘোলের দিকে ফিরে তাকিয়েছে।

সাহিত্যে দই

ডাকঘর নাটকের অমল দইওয়ালার হাঁক শুনে তাকে ডেকে আনে।অমল দই কিনবে না জেনেও দইওয়ালা তার সাথে গল্প করে। রোগের কারণে ঘরে বন্দী বালক কল্পনা করে দূর পাহাড়ের গায়ে পুরনোকালের এক বটগাছের ধারের লাল মাটির গ্রামে শামলী নদীর ধারে মেয়েরা লাল শাড়ি পরে কলসীতে জল তুলে রাখে। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে দই বেচার স্বপ্নেই তার বন্দীদশার মুক্তি এমন ভাবতে তার আনন্দ হয়। মনসামঙ্গলে দেবী মনসা গয়লানীর ছদ্মবেশে ধারণ নগরে আসে। দই বিক্রি যে অন্ত্যজশ্রেণির নারীদের বৃত্তি তা গোয়ালা জাতির জীবিকা নির্বাহের মধ্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

" দধির পসরা লয়্যা শঙ্খিনী নগরে গিয়া

       মনসা বুলেন ঘরে ঘরে।

যেই মত মূল্য ধরে উচিত নাহিক করে

       গোয়ালিনী বাড়ায় বিস্তর।

গোয়ালিনী ডাক্যা কই আমার অমৃত দই

         এক খানি এক এক কাহন।

ভাঙাচুরা বেচি নাই সব দধি একু ঠাঁই

           মূল্য করি লবে কোন জন"

মধ্যযুগীয় বাংলার সমাজে ফলার ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়।কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর 'চণ্ডীমঙ্গল' কাব্যে নিদয়া ফলার খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে। কবি লিখছেন,

 "যদি ভালো পাই মহিষা দই

চিনি ফেলি কিছু মিশায়ে খই,

পাকা চাঁপাকলা করিয়া জড়ো,

খাইতে মনের সাধ বড়ো"

ঘরের মেয়েরা কবেই বা ঠিকঠাক পুষ্টিকর খাবার পেয়েছে। দই-কলার ফলারেই তাই ঘাটতি পূরণের চেষ্টা।মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে আছে,

‘স্নান করি দুর্বলা

খায় দধি খণ্ড কলা

চিঁড়া দই দেয় ভারি জনে৷’

অর্থাৎ, মহিলাদের স্নানের পর মধ্যাহ্ন ভোজের আগে চিঁড়ে-দই-কলা খাওয়ার রীতি ছিল ৷

মঙ্গলকাব্যে এই দইয়ের অনুষঙ্গ বারেবারে এসে পড়েছে। "মজা মওমান মিছরি মিশাইয়া দই" অর্থাৎ মজা মর্তমান কলার সঙ্গে মিছরি মিশিয়ে দই দিয়ে ফলার খাওয়া যে বহু পুরনো অভ্যাস তা এভাবেই বোঝা যায়।

সুকুমার সেন তাঁর 'কলিকাতার কাহিনী' গ্রন্থে লিখেছিলেন, “ক্ষীর-মাখন-ঘি-দই-এগুলো কাঁচা দুধের স্বাভাবিক পরিণাম, কৃত্রিম অথবা স্বাভাবিক। কিন্তু কোনটিই দুধের বিকৃতি নয়। ‘ছানা’ কিন্তু ফাটানো দুধের কৃত্রিম বিকৃতি। ”ছানা দুধের বিকৃতি এই মর্মে অনেক সামাজিক বাধা থাকলেও দই নিয়ে তেমন সমস্যা ছিল না।

মঙ্গলকাব্যের সময়কালে সমাজে ব্রাক্ষ্মণশ্রেণির আধিপত্য প্রবল ছিল।নিজেদের জাতের কৌলিন্য রক্ষায় তারা অন্য জাতের রান্না করা খাবার খেতেন না।কিন্তু যাজনিক কাজে ব্রাক্ষ্মণ ভোজন না হলে পুণ্যফল অধরা।তাই ব্রাক্ষ্মণরা ফলারের বিধান দিলেন।গোড়ার দিকে ফলার বলতে মূলত ফলাহার বোঝানো হত। ক্রমশ ফলারে পাকা ফলার আর কাঁচা ফলার নামে দুইটি রকম এলো। পাকা ফলারে থাকত গমের তৈরী ভাজা খাবার যেমন লুচি এবং লবণ ছাড়া দুধ দিয়ে তৈরী মিষ্টি,ক্ষীর ইত্যাদি।আর কাঁচা ফলারে রান্না না করা সরু মিহি চিঁড়া,ফলমূল,দুধ,ক্ষীর  ইত্যাদি।

১২৬১ সালে রচিত রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নাটকে উত্তম, মধ্যম ও অধম এই  তিন প্রকারের ফলারের উল্লেখ আছে। উত্তম ফলার হলো পাকা ফলার।

"ঘিয়ে ভাজা তপ্ত লুচি দু চারি আদার কুচি

কচুরি তাহাতে খান দুই।

ছকা আর শাক ভাজা মতিচুর বঁদে খাজা

ফলারের জোগাড় বড়ই।।”

“সরু চিঁড়ে শুকো দই মত্তমান ফাকা খই

খাসা মণ্ডা পাত পোরা হয়।

মধ্যম ফলার তবে বৈদিক ব্রাহ্মণে কবে

দক্ষিণাটা ইহাতেও বয়।।”

“গুমো চিঁড়ে জলো দই তিতগুড় ধেনো খই

পেট ভরা যদি নাই হয়।

রৌদ্দুরেতে মাথা ফাটে হাত দিয়ে পাত চাটে

অধম ফলার তাকে কয়।।”

মধ্যম ফলারের সুখো দই হলো জল ঝরানো ঘন দই যা গামছা বেঁধে বয়ে নেয়া যায়।

ব্রাক্ষ্মণদের এই জাতপাতের ছোঁয়াছুঁয়ির বিপ্রতীপে প্রায় পাঁচশো বছর আগে পাণিহাটির গঙ্গার ধারে শ্রীচৈতন্যদেবের অন্যতম পার্ষদ ও সখা নিত্যানন্দের দেয়া দন্ড বা শাস্তি মাথা পেতে নিয়ে রঘুনাথ দাস জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সমাগত সকল ভক্তকে চিঁড়া,দই, খইয়ের ফলার ভোজ করিয়েছিলেন।

"সেইক্ষণে নিজ লোক পাঠাইয়া গ্রামে,

ভক্ষ‍্য দ্রব্য লোক সব গ্রাম হতে আনে।

চিড়া, দধি, দুগ্ধ, সন্দেশ আর চিনি-কলা,

সব দ্রব্য আনাইয়া চৌদিকে ধরিলা।"

..……

এক ঠাঁই তপ্ত দুগ্ধে চিড়া ভিজাইয়া

অর্ধেক ছানল দধি, চিনি-কলা- দিয়া।

( চৈতন্যচরিতামৃত,অন্ত‍্য – ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ)

শ্রীচৈতন্যদেবের নামে খ্যাত নবদ্বীপের আরেক খ্যাতির কারণ লাল দই।অল্প আঁচে দীর্ঘক্ষণ দুধ জ্বাল দিয়ে সাথে বাতাসা বা চিনি দিল হাল্কা  যে রং ধরে তা দইয়ের লালচে আভা আনে।এই দইয়ের অপর নাম 'চাক্কু দই'। এ দই এমনি জমাট যে চাক্কু বা ছুরি ঢুকিয়ে দিলেও তা পরিষ্কার হয়ে বেরিয়ে আসে।এ দইয়ের ভান্ড উলটে দিলেও দই কখনো পড়ে যায় না।

ঊনবিংশ শতকের  সময় থেকে দই ভোজবাড়িতে অপরিহার্য ছিল।বিভিন্ন অঞ্চলের নদীর জল,ঘাস আলাদা হওয়ার কারণে গরু বা মোষের দুধের স্বাদ,ঘনত্ব পাল্টে যায়,তাই দইয়ের স্বাদ,দই পাতার পাত্র পালটে যায়।চন্ডালিকার দইওয়ালা গানে গানে বলেছিল কিভাবে যত্ন করে শ্যামলী গাইকে কঙ্কনা নদীর ধারের কচি ঘাস ভোরবেলা যত্ন করে খাইয়ে নিয়ে আসে।তাই তার দুধের দই ভালো হবে এ ব্যাপারে সে প্রত্যয়ী। দুধের গুণমান ভালো দইয়ের গোড়ার কথা।তাই বরিশালের দই,বগুড়ার দই, ভোলার দই বা মোল্লার চকের দই প্রত্যেকের স্বাদ আলাদা।আর এটাও রীতিমতো পর্যবেক্ষণ করার ব্যাপার দইয়ের পাত্রের আকার,গঠণ,প্রকার বারবার কিভাবে পালটে যায়।

স্থানীয় ইতিহাস অনুসারে,বগুড়া শহর থেকে মোটামুটি ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে শেরপুর উপজেলায় ঘেঁটু ঘোষ সর্বপ্রথম লাল,মিষ্টি দই তৈরী করেছিলেন। ক্রমশ তার বানানো দইয়ের সুখ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।ক্রমশ আরো অনেক দইয়ের ব্যবসা শুরু করেন।দইয়ের স্বাদে মজতে থাকেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ১৯৩৮ সালে বগুড়ার নবাবের আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন বাংলার ব্রিটিশ গভর্নর স্যার জন অ্যান্ডারসন। তাঁকে কাচের পাত্রে বানানো দই খাওয়ানো হয়। সেটা খেয়ে তিনি এতটাই পছন্দ করে ফেলেন যে ইংল্যান্ডে বগুড়ার দই পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।এভাবেই দইয়ের খ্যাতি দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে।

পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দইয়ের স্বাদের অনন্যতার কারণ তার ভূপ্রকৃতি। নদীমাতৃক বাংলাদেশের জালের মতো ছড়িয়ে থাকা অজস্র নদীর চরের সবুজ ঘাস খেয়ে গরু বা মোষ যে দুধ দেয় তার স্বাদ একেক জায়গায় একেক রকম।তাই বগুড়ার দই, গৌরনদীর দই, ভোলার দই প্রতিটিই তার স্বাদে অনন্য।

বগুড়ার দইয়ের কিংবদন্তীতুল্য স্বাদের পাশাপাশি খ্যাতির অন্যতম কারণ তার সরা।এ অঞ্চলের দই পাতা হয় সরা আকৃতির পাত্রে যার প্রায় পুরোটা জুড়েই দইয়ের মাথা।দই পাতার মাটির পাত্র অগভীর হলে তার বিস্তৃত উপরিতল জুড়ে দইয়ের ঘন জমাট অংশ ছড়িয়ে পড়ে।ভোলার কাঁচাদুধের দই পাতার পাত্র মাটির ঘড়ার মতো।ছোট খাড়া কলসীর মতো ভাণ্ডে পাতা এই দইয়ের পুরোটাই ঘনত্বে পাতলা ও হজমকারক।তাই এর মাথা নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতা কারোরই তেমন মাথা ব্যথা নেই।দই পাতার পাত্র মূলত মাটির হলেও মুর্শিদাবাদের দইয়ের খ্যাতি তার ঝুড়ির জন্য।বেতের ঝুড়ির ফাঁকা অংশ দুধের ঘন সরের প্রলেপ দিয়ে ভরাট করা হয়।তারপর ঘন দুধ ঝুড়িতে ঢেলে জমাট দই পাওয়া যায়।

উত্তরবঙ্গে দই জমানোর জন্য বাঁশের ভেতরের ফাঁপা অংশ বা চোঙ ব্যবহার করা হয়।।ওই অঞ্চলে বিশেষ ধরনের বাঁশ  ভাল জন্মায়। মূলত , রাভা,মেচ, গারো, টোটো- এইসব জনজাতি এই ধরনের বাঁশ নিয়ে কাজ করেন বলে ওঁদের মধ্যে এই ধরনের দইয়ের পাত্র বেশি প্রচলিত।

যে কোন অনুষ্ঠানের দইয়ের আকর্ষণ তার মাথা।সমাজের গন্য মান্য ব্যক্তির পাতেই তার পতন অনিবার্য ছিল।দইয়ের মাথা এমনই স্বাদু যে ভালোবাসার মানুষকে দইয়ের মাথা দেয়া হবে এই প্রতিশ্রুতিতে গান চট্টগ্রাম অঞ্চলে লোকগান বাঁধা হয়েছে।

"ও তালতো ভাই, পাশে বইসো

কমু তোরে গুড়া কথা,

তর লাই বলি ন হাই (খাই)

রাখি দইয়(য়ে)র মাথা। "

বরিশালের গৌরনদীর দইয়ের খ্যাতি দেশজোড়া।প্রায় আড়াইশ বছর আগে ডাওরি ঘোষ নামে এক ব্যক্তি গৌরনদীতে তৈরি করেন এই লোভনীয় দই। বর্তমানে এই ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন ঘোষ পরিবারের সদস্যরা।

বরিশাল জেলার দ্বীপ অঞ্চল ভোলার খ্যাতি কাঁচা দুধের দইয়ের জন্য।প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহ্য বহনকারী এও দই অতিথি আপ্যায়নের অন্যতম উপাদন।খাবার হজমে কাঁচা দুধের দধি বাড়তি সহায়তা করায় এর বিপুল জনপ্রিয়তা।

মেঘনা-তেতুলিয়া নদীতে অনেক চর রয়েছে। বিস্তীর্ণ এসব চর অঞ্চলে প্রচুর মোষ পালন করা হয়।দুধ-দধির ব্যবসাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন চরে গড়ে উঠেছে শত শত মহিষ বাথান।তারা বলেন, মহিষের দুধের দধি তৈরিতে তেমন কোনো বাড়তি ঝামেলা নেই। শুধু কাঁচা দুধটা ছেঁকে মাটির পাত্রটি (টালি) পরিষ্কার করে তাতে দুধ ঢেলে বসিয়ে দিলেই ১৮-২০ ঘণ্টার মধ্যে দই হয়ে যায়।

মোল্লার চকের দই নামেই যাদু আছে।অনুষ্ঠানবাড়িতে অপরিহার্য দই মোল্লার চক থেকে কিনে আনার জন্য উৎসাহীর অভাব এক কালে ছিল না।তেমনি কয়েকজন উৎসাহী ফুড ব্লগারের দৌলতে জানা গেল তার কাহিনী।বাঁদিপোতার গামছা আর মোল্লার চকের দই এমন কিংবদন্তীর প্রচলন যে অঞ্চলের সেখানকার দইয়ের বৈশিষ্ট্য এই যে তা অনায়াসেই গামছা বেঁধে নেয়া যায়।হাটে হাঁড়ি ভাঙলেও ভয় নেই,দই কিছুতেই ভাঙবে না।হারমোনিয়াম সিনেমার একটি দৃশ্যে তার সন্তোষ দত্তের মেয়ের বিয়েতে কালী বন্দ্যোপাধ্যায় দই খেয়ে বলে দিয়েছিলেন সেটা মোল্লার চকের। আর সন্তোষ দত্তের স্বগতোক্তি ছিল, ‘ওই মোল্লার চকেই আমার স্ত্রীর ছ’ ছ’গাছা চুরি চলে যাবে’।

দক্ষিণ বারাসাত থেকে মগরাহাট পেরিয়ে কিছুদূর গিয়ে মোল্লারহাট।সেখানকার সাদার দোকানের বর্তমান মালিক তুহিন ঘোষ জানিয়েছেন মোষের দুধে একটুও জল না মিশিয়ে এই দই তৈরী হয়।রেফ্রিজারেটর পূর্ব যুগে শিয়ালদহ স্টেশনের গ্লোব নার্সারির পাশের হিমঘরে মোল্লার চকের দই মজুত করা থাকত।সেখাম থেকেই কলকাতায় অর্ডার সাপ্লাই হতো।মোল্লার চকের এই দইয়ের বিশেষ নাম পোয়াদি  দই।এই দই টেবিলে রেখে ছুরি দিয়ে কাটলেও এতটুকু জল বেরোত না। দই খেলে হাত ধুতে হত। এত মাঠা থাকত। কারণ দই তৈরিতে কোনও জল ব্যবহার করা হত না। ৪০ সের দুধ ফুটিয়ে ১০ সের করা হত।বিয়েবাড়িতে আইসক্রিম মেনুতে স্থান করে নেয়ার পর পোয়াদি দইয়ের গরিমা অস্তমিত।

 বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায় 'মিষ্টান্ন পাক' বইতে যে অমৃত দধির কথা বলেছেন পোয়াদি দইয়ের প্রস্তুত প্রণালী তার সাথে  বেশ মিলছে।কিন্তু  বিপ্রদাস বলছেন, ‘অমৃত-দধির পক্ষে গাভী-দুগ্ধ-ই উত্তম'। মোল্লার চক আবার মোষের দুধে আস্থাবান।

'মিষ্টান্ন পাক' বইতে দই তৈরীর আরো কিছু পদ্ধতির কথা বলা আছে যার মধ্যে দুটি বেশ ব্যতিক্রমী।পক্ষীর ত্বকে দই জমানোর যে কৌশল বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায় লিখেছেন তা অভিনব।

"একটি পক্ষীর পাকস্থলী দুই ভাগে বিভক্ত করিলে তন্মধ্যে কাগজের ন্যায় একখানি ত্বক বা চামড়া বাহির হইবে।অনন্তর তাহা উত্তমরূপে জলে ধুইয়া পরিষ্কার করিবে।এখন উষ্ণ দুধে এই ত্বক এক ঘন্টা পর্য্যন্ত ঘর্ষণ করিয়া, উহাতেই স্থাপন করিবে,দধি প্রস্তুত হইবে"। আরেকটি উপায় হলো উষ্ণ দুধে আম্রমুকুল চূর্ণ করে দিলে সুগন্ধি ও রুচিজনক দুধ প্রস্তুত হয়।

শ্রীপঞ্চমী তিথিতে বিদ্যার দেবী সরস্বতীর পূজা উপলক্ষে সিরাজগঞ্জ ও চলনবিল-অধ্যুষিত তাড়াশে দইয়ের মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। জেলা শহরের মুজিব সড়ক ও তাড়াশের ঈদগাহ মাঠে এই মেলা বসে। সকাল থেকে বিভিন্ন রকমের বাহারি দই নিয়ে পসারীরা মেলায় আসেন। এনায়েতপুরের কেজির মোড় থেকে রনি মিষ্টান্ন ভান্ডারের দই, ক্ষীরসা দই, রাজাপুরের দই, শেরপুরের দই, বগুড়ার দই, টক দই, শ্রীপুরী দইসহ অনেক রকমের দই মেলায় স্থান পায়। তার সঙ্গে খই, চিড়া, মুড়ি, মুড়কি, বাতাসা, কদমা, মিষ্টি ইত্যাদি বেচাকেনা হয়।জনশ্রুতি আছে  তাড়াশের তৎকালীন জমিদার বনোয়ারী লাল রায়বাহাদুর প্রথম দইমেলার আয়োজন করেন।জমিদারবাড়িতে আসা অতিথিদের আপ্যায়নে এ অঞ্চলে ঘোষদের তৈরি দই পরিবেশন করা হতো। সেই থেকেই তিনদিনের দই মেলার সূত্রপাত যা বর্তমানে একদিন বসে।

দই নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশে নির্মিত একটি ইউটিউব ছবি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। কাহিনীর ঘটনাক্রমে দইয়ের ভুমিকা না থাকলেও বিয়ের দাওয়াতে দই কম পড়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে ক্লাইম্যাক্স জমে ওঠে।

দই নিয়ে এত গল্পগাথার পরেও যা না বললেই নয় তা হলো বাঙালি অনুষ্ঠানে দইয়ের অবলুপ্তি।কলকাতায় ভারতীয় ক্রিকেট দল আশির দশকে যখন খেলতে আসে বিজলী গ্রীল ক্যাটারার তাদের খাবার সরবরাহের দায়িত্ব পায়। সেই সময়ের পত্রিকায় খেলার খবরে প্রকাশিত হয় তাদের দুপুর আর রাতের খাবারের মেনু যেখানে আইসক্রিম ডেজার্ট হিসেবে স্থান পেয়েছিল।পরবর্তীতে বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠানেও এই ক্যাটারার দইয়ের জায়গায় আইসক্রিম পরিবেশন শুরু করে। ব্যস দইয়ের সাম্রাজ্যে চিড় ধরা শুরু হয়। ৯০এর দশকের শেষের দিকে কলকাতাত বিশিষ্ট মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠান বলরাম ও রাধারমণ মল্লিকের উদ্যোগে মিষ্টি দইয়ের মাঝের স্তরে আমের রসালো শাঁস ভরে দিয়ে ম্যাঙ্গো দই তৈরী হয়। ক্রমে স্ট্রবেরী দই, ভাপা দই ইত্যাদির উদ্ভবে সেই চিড় মেরামতের প্রচেষ্টা হয়। আশার কথা এই যে দই এসব নতুন স্বাদে গন্ধে আবার ফিরে আসছে।

দই নিয়ে বাঙালির আবেগ- আহ্লাদ -আস্বাদের কথা বাংলাদেশের বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও গল্পকার বজলুল করিম বাহারের কবিতা দিয়ে শেষ করলাম।

"বাঙালির বড়ো প্রিয় মাছে আর ভাতে
 ভালো হয় শেষে যদি দই পড়ে পাতে,
একবার রসনায় যে পেয়েছে তার,
আর কিছু মুখে নাহি ভালো লাগে তাঁর।
যে কখনো এইসব করেনি গ্রহণ
বৃথাই জীবন তার, বৃথাই যাপন।।