ঝিল্লি-ডিসকার্ডস : বাতিল উপকরণই নবনির্মাণের স্তম্ভ

এবারের সাতাশতম কলকাতা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ষষ্ঠদিনে “ঝিল্লি - ডিসকার্ডস” ছবিটি প্রদর্শিত হল। 

পরিচালনা, সম্পাদনা, চিত্রনাট্য, সিনেমাটোগ্রাফি - ঈশান ঘোষ

অভিনয় - অরণ্য গুপ্ত, বিতান বিশ্বাস, সৌরভ নায়েক, শম্ভুনাথ দে, সায়ন দীপ গুহ, রাজু হালদার, ভাস্বতী হালদার, প্রিয়া সাহা রায়।

বিরানব্বই মিনিটের এই ছবিটি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে নয়, বড় পর্দায় দেখার মতোই ছবি। এই ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবিটি প্রতিযোগিতা বিভাগে দেখানো হলে সেরা আন্তর্জাতিক ছবির সম্মানও আদায় করে নেয়। ফেস্টিভ্যালের  ইন্টারন্যাশনাল কম্পিটিশন : ইনোভেশন ইন মুভিং ইমেজ বিভাগে সেরা ছবি বিবেচিত হয়ে রয়েল বেঙ্গল টাইগার পুরস্কার পায়।

ছবিটি দেখতে বসে ধাপার নোংরা কাদাজল, আবর্জনা, পোকাধরা পচাগলা জীবজন্তুর মৃত দেহ, রক্তমাখা হাড়ের স্তূপ দেখে আপনার গা গুলিয়ে উঠতে পারে, নাকে গন্ধ লাগার আশঙ্কায় উদ্বিগ্নও হতে পারেন। সভ্য সমাজের বাতিল করে দেওয়া অশ্রাব্য শব্দ আপনার কানে ঝি ঝি ধরাতে পারে। বিরক্তিতে আপনি উঠে আসতে চাইতে পারেন। কিন্তু চাইলেও উঠতে পারবেন না, পরে কী দেখাবে সেটা জানার জন্য ব্যাজার মুখ করে বসে থাকবেন।

দেখবেন আর ভাববেন এটা তথ্যচিত্র না কাহিনি চিত্র! প্রথম দিকে ছবিটিকে তথ্যচিত্র বলেই মনে হবে। পরে কতগুলো চরিত্র দেখে একটা কাহিনির আভাস পাবেন। সারা ছবি জুড়ে বিশেষ কোনো গল্প নেই, নেই ঝিল্লি নামের কোনো মেয়ে, নেই প্রেম কাহিনি। আছে শুধু আপনার আমার বাতিল করে দেওয়া জিনিস পত্রের স্তুপ। বাতিল করে দেওয়া কোমট, খাবার, শরীরের আবর্জনা, বাতিল পোষ্যের মৃতদেহ, বাতিল স্থান, বাতিল ভাষা, বাতিল আচরণ, বাতিল মানুষ - সবই দেখতে পাবেন এ ছবিতে। দেখতে পাবেন ধাপার পাশে এক হাড় মাড়ায়ের কারখানায় ফেলে দেওয়া মৃত পশুপাখির পচাগলা মাংসর ভিতর থেকে হাড় বের করে শুকিয়ে তাকে গুড়ো করার দৃশ্য। আর গুড়ো হবার পর হাড়ের অবশিষ্ট অংশটি “ঝিল্লি” নাম নিয়ে বাতিল হয়ে পড়ে থাকার ছবি।

আপনার বাড়ির সামনে আপনারই বাতিল করা যে জিনিস পড়ে থাকতে দেখলে পরিস্কার না করার জন্য পৌরসভাকে গালাগালি করেন, নাকে রুমাল গোঁজেন, সেই আবর্জনা রাস্তা থেকে, পাড়ার মোড় থেকে কুড়িয়ে সারা শহরের বাতিল করা জঞ্জাল যেখানে এনে ঢালা হচ্ছে সেটাকে নাক টিপে ধরে বলেন আস্তাকুঁড়। আর সেই আস্তাকুঁড়ের সব নড়াচড়া করা প্রাণীগুলো পোকা নয়, কেউ কেউ মানুষও। এই আস্তাকুঁড়েও একদল মানুষের বাসস্থান, জন্ম থেকে মৃত্যু এমনকি মৃতদেহ সৎকারের শ্মশানঘাটও। যা দেখবেন তা আপনি কল্পনাও করতে পারেননি কখনো। আবর্জনায় মৃতদেহ সৎকারের দৃশ্য আপনাকে স্তম্ভিত করবে। আবার আপনার আমার বাতিল করে দেওয়া নোংরা আবর্জনা ঘেঁটে এরা বের করে আনে তাদের সংসারের রসদও। হাড়-মাড়ায়ের কারখানায় কর্মচারী আস্তাকুঁড়ের বকুলকে দেখবেন নোংরা, ভাঙা কোমট অনায়াসে ঘাড়ে করে নিয়ে আসে বাড়িতে। পচা গলা জীবজন্তুর পোকাধরা মাংস বাদ দিয়ে হাড় টেনে কারখানায় নিয়ে যায়। এসব দেখে আপনার মনে পড়তে পারে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর “প্রাগৈতিহাসিক” - ভিখুর পচা হাতের ঘায়ে রসকাটা বা পাঁচির দগদগে ঘায়ের বিবরণ পড়ে গা গুলিয়ে উঠবার কথা।

নোংরাজল, কাদা, পচামাংস, রক্ত, হাড়, আবর্জনা বুকে করে শুয়ে থাকা মুকুল শুকনো হাড় উঁচিয়ে উড়োজাহাজের দিকে গুলির তাক করে কেন.... ভাবতে থাকবেন।

ধীরে ধীরে আপনার গা সওয়া হয়ে যাবে যখন দেখবেন এশিয়ার সবচেয়ে বড় আস্তাকুঁড়ের একটি এই ধাপার আবর্জনার পাহাড় এ ছবির পটভূমি। সঙ্গে আছে পার্কে স্ট্রিট, বড় বাজার, হাওড়া ব্রিজের ফুটপাত, হগমার্কেটের ছাদ। শহর জুড়ে জীবনের সঙ্গে লড়াই করে চলেছে কতগুলো তরুণ প্রাণ। তাদের লড়াই অন্য রকম। উন্নত জনজীবনের প্রতিযোগিতায় কেউ ছুটে চলেছে, কেউ হাঁপিয়ে উঠেছে, কেউ অবসাদ লুকোচ্ছে। এরা কখোনো পুরোনো কাপড় বেচে কখোনো সস্তা ঘড়ি বেচে আবার কখোনো আরো বড় স্বপ্নকে ভর করে আরো এগিয়ে সুস্থ ঝকঝকে জীবনযাপন করতে চায়। আবার এরাই একদিন দু’ পয়সা রোজগার করে ফুটের রেস্টুরেন্টে গিয়ে ফ্রাইড রাইস খেয়ে বিলাসিতা করে। এ দৃশ্য আপনাকে মনে করাতেই পারে সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘নোনাজল’এর জাহাজের নতুন বাঙালি খালাসিদের কথা - “যে কখনো পাঁচ টাকার নোট দেখেনি আধুলি বেশি চালায়নি, তার হাতে পনেরো টাকা। সে তখন কাগের বাচ্চা কেনে।“

এদের নুন আনতে পান্তা ফুরানো জীবনে  প্রেম নেই, নারী নেই। যৌবন নিদারুণ ভাবে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। তবু এরা কেউই কোনো মেয়েকে ধর্ষণ করতে ছুটে যায় না বরং উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে গিয়ে নতুন বৌয়ের সঙ্গে সহবাসের অভ্যাস করে গাছের সঙ্গে। এই অসহায় তরুণদেরও যৌনতায় জন্মগত অধিকার আছে - দৃশ্যটি আপনাকে তা স্মরণ করিয়ে দেবে। অনিশ্চিত রোজগারে, ভবিষ্যতহীন বর্তমানে ওরা শুধু স্বপ্ন দেখে নতুন সংসার, নতুন জীবনের। এদের স্বনির্ভরতার দায়িত্বের বিষয়ে রাষ্ট্রের উদাসীনতা আপনাকে উদাসীন করবে । সভ্য সমাজ, উন্নয়নশীল রাষ্ট্র তাদের জন্য না ভাবলেও দেশের স্বাধীনতার দিবসে জাতীয় পতাকা তারা বুক পকেটে রাখে। দেশপ্রেম বুকে নিয়ে এখনও স্বপ্ন দেখে এ দেশের সভ্য ঝাঁ চকচকে সমাজের একজন সভ্য হবার, ডানা মেলে উপরে ওঠার।

এ ছবিতেই আছে আর এক বাতিল চরিত্র। সমকামী হোক বা নপুংসক চম্পাও কিন্তু সমাজে বাতিলের খাতায়। “তৃতীয় লিঙ্গ” চম্পা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে হাসির খোরাক, আর এক বাতিল জনগোষ্ঠীর প্রতীক। স্বাধীনতার এতদিন পরেও “তৃতীয় লিঙ্গ”রা নির্যাতিত আমাদের দেশে। অপরিনত নির্বোধের হাতে “চম্পারা” আজও লাঞ্ছিত। এরা সবাই দেশেরই বর্তমান তরুণ প্রজন্ম।  কেউ পূর্বপুরুষের পেশাকে, ভিটে মাটিকে ভালোবেসে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছে আর কেউ  কদর্য অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে।

 বকুল শুধু তার পেশাকে নয়, আবর্জনার পাহাড়কে, তার চারপাশকে ভালো বেসেছিল, ধাপার আবর্জনা, হাড় মাড়ায়ের কারখানা, ভাগাড়, এ সবই ছিল তার জগৎ, তার বিশ্ব, তার বাংলা। সে জানে এই আবর্জনা নিয়ে, গরিব মানুষদের নিয়ে কেউ ভাবে না, বকুলের - “এখানে এসে সব গল্প শেষ হয়ে যায়” কথার মধ্যে এক দার্শনিকতা খুঁজে পাবেন। আধুনিক সভ্যতার অগ্রগতিকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে, তাদের মত অবাঞ্চিত প্রাণীদের বাঁচার একমাত্র অবলম্বনকে, আচ্ছাদনকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে তৈরি হয় সভ্যতার বিনোদনের বাগান, বিলাসিতার হোটেল। এ ঘটনা আপনাকে রাণু ঘোষের তথ্যচিত্র “কোয়ার্টার নম্বর 4/11”এর কথা মনে করিয়ে দেবে । সেখানেও “ঊষা” কোম্পানির ফেলে যাওয়া শ্রমিকের বাসস্থান ভেঙে, তাদের রাস্তায় বের করে দিয়ে সাউথ সিটির অত্যাধুনিক, বিলাস বহুল আবাসন, শপিং মল তৈরি হয়েছিল। মনে পড়বে মাথা গোঁজার ঠাঁয়ের জন্য শম্ভুপ্রসাদের একলা লড়াই আর তার করুন পরিনতির কথা। এইসব “ছোটলোক”এর বুকের পাঁজরের ওপর তৈরি হওয়া “বড়লোক”এর বিলাসিতার কথা, “নিতে হবে ছলে বলে কেড়ে ও কৌশলে”র কথা, রাষ্ট্রের উন্নয়নের কথা, যুগে যুগে রক্তে যাদের সিক্ত হলো পৃথ্বীতল তাদের কথা।

 সব হারিয়ে দুঃখ ভুলতে বকুলও মজে থাকে ডেনড্রাইটের পুরোনা নেশায়, যে নেশা এতদিন দারিদ্রের জ্বালা, যৌবনের জ্বালা ভুলিয়েছে। সেই নেশার ঘোরেই শহরের নীল দেওয়ালকে প্রেমিকা ভেবে বসে।

এসব দেখে যখন বাড়ি ফিরবেন তখন দেখবেন আপনি ছবির নোংরা আবর্জনা, নোংরা ভাষা সব ভুলে গেছেন, শুধু একটা কাহিনি মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে - বকুল, গনেশ, গুড্ডু, শম্ভুদা, চম্পাদের ঘিরে একটি কাহিনি। আপনার দেশের তরুন প্রজন্মের কাহিনি। আপনার মনে বার বার আসবে আর অজানা কারণে গলার কাছে একটা কান্না দলা পাকাবে। মনে পড়বে ছবির সেই দৃশ্যটি, যেখানে কুড়িয়ে পাওয়া বাতিল কৌটা থেকে কেমিক্যাল স্প্রে করে বকুল নিজের নাম লিখছিল আর নিজের মুখের ছবি এঁকেছিল। বুঝিয়ে দেবে পৃথিবীতে নিজের নাম অক্ষয় করে রাখার মতো সৃষ্টিশীলতা তার মধ্যেও ছিল। বাড়ি এসে কানে বাজতে পারে বকুলের মুখ দিয়ে রক্ত ওঠার পর আর্তনাদ “মা খিদে পেয়েছে......”! ভাববেন, এ দেশে বিকশিত হবার আগে এমন কত বকুলই তো শাখে শাখে ফোটে আর ঝরে যায়। শুনতে পাবেন বকুলের প্রতিবাদ “সরকার আমাদের জন্য কী করেছে?”। আপনার চারপাশের অসংখ্য তরুণের মাঝে খুঁজে পাবেন বকুল, গনেশ, গুড্ডু, চম্পাদের- এদের মধ্যে কেউ জীবনের রাস্তা খুঁজে পায়, কেউ পায় না, কেউ খুঁজতে খুঁজতে সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে, আধুনিক সভ্যতার কাছে “ঝিল্লি” হয়ে যায়।

ছবিতে ছুটন্ত ক্যামেরার ল--ম্বা লম্বা দৃশ্য আপনাকে মনে করিয়ে দেবে আপনারা সভ্যতার ধারক ও বাহকরা নিজেদের পৃথিবীর এক দিক অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন রাখতে গিয়ে আর এক দিকে  আবর্জনার পাহাড় করছেন। আলো আর আধারের মাঝখানে রেখেছেন ঘৃণার, অবহেলার অদৃশ্য,  দুর্ভেদ্য প্রাচীর। আর সেই আবর্জনার বুকে বেঁচে থাকা প্রাণীগুলো সে পোকা হোক বা শুয়োর বা মানুষ, অবাঞ্ছিত বলে বাতিল করেছেন আপনি, আপনারা। অথচ এদের সবার এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার ছিল, আছে। এসব ভেবে গলার কাছে কান্নাটা আবার দলা পাকাবে। এখানেই পরিচালক বাজিমাৎ করেছেন। কোনো গল্প না বলেও আপনাকে এক নতুন জগতের গল্প শোনাবেন যে গল্প প্রত্যেকটা দর্শক নিজের মতো করে বুনবে।

 বাতিল উপকরণ দিয়ে জীবনের নতুন আরশি নির্মাণ করার মতো সাহসী পদক্ষেপ আপনাকে বিস্মিত করবে। লম্বা দৃশ্যগ্রহণে গ্রিক পরিচালক থেও অ্যাঞ্জেলোপোলোস এবং পোস্টারে লা ভন ট্রায়ারের হরর ছবি ‘অ্যান্টি ক্রিস্ট’  থেকে অনুপ্রাণিত হলেও তার ভাবনা ও পরিবেশনায় স্বকীয়তার মজবুত ছাপ রেখেছে, যা আপনাকে মুগ্ধ করবে। পরিচালকের ছকভাঙ্গা দৃশ্যগ্রহণ আর অভিনেতাদের আন্তরিক অভিনয়ে (বিশেষ করে বকুলের ভূমিকায় অরণ্য গুপ্ত, গুড্ডুর ভূমিকায় সায়নদীপ গুহ)  ছবিটি তথ্যচিত্রের ভিত্তিতে কাহিনিচিত্র হয়ে উঠেছে। শেষ পর্যন্ত আপনার ভাবনায় নিশ্চয়ই আসবে নতুন ভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তৈরি এই ছবিটি  বাংলা চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে যাঁরা চিন্তিত তাঁদের স্বস্তি দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রকে নতুন যুগের সন্ধান দিয়েছে বটে!