মিটুর বিবর্তন এবং মিটুর উত্তর কাণ্ডে যা যা ঘটে

২০১৭ সালের অক্টোবরে আমরা যে যার টুইটার হ্যাণ্ডেল থেকে বা ফেসবুক টাইমলাইনে হ্যাশট্যাগ দিয়ে লিখেছিলাম: 'মি টু’। ‘আমি-ও’। সেই ঘটনাবহুল অক্টোবরে মাসে সাত সমুদ্র তের নদী পারে এক হলিউডি প্রযোজক, হার্ভে উইন্সটেইন-এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন অভিনেত্রী আলিসা মিলানো। তিনি সরব হয়েছিলেন তাঁর বান্ধবীর যৌন নিগ্রহ নিয়ে। তাঁর সেই টুইটের তলায় ‘#মিটু’  লিখেছিলেন প্রায় দশ হাজার মহিলা। মিলানো অবশ্য ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন অ্যাক্টিভিস্ট তারানা বার্ক-কে। ২০০৬ সালে তিনিই প্রথম যৌন নির্যাতনের শিকার হিসেব নিজেকে চিহ্নিত করতে ‘#মিটু’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করতে বলেন নির্যাতিতদের।

প্রাথমিকভাবে, জোর দেওয়া হয়েছিল ‘অপরাধ’-টির উপর, তার ভয়াবহতা ও ব্যাপ্তি নিয়ে বিশ্বকে সচেতন করতে চাওয়া হয়েছিল। আশা করা হয়েছিল, এর ফলে সহ-সারভাইভারদের মধ্যে গড়ে উঠবে সমমর্মিতার সেতু। তার চেয়েও বড় কথা, যৌন নির্যাতনকে ঘিরে যুগ যুগ ধরে যে গোপনীয়তার বরফ জমে আছে, তা ভাঙতে শিখবে নির্যাতিতরা। এরপর সারা বিশ্বজুড়ে মহিলারা যে হারে হ্যাশট্যাগ মিটু লিখতে থাকেন নিজের প্রোফাইল থেকে, যে হারে কপি-পেস্ট করেন বয়ানটি, তাতে স্পষ্ট হয়, জীবনে কোনো না কোনো সময়ে, ঘরে, পরিবারে, পথে, যানবাহনে, ভিড়ে, ফাঁকায়, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাক্ষেত্রে, প্রমোদক্ষেত্রে, কোথাও না কোথাও তাঁরা সকলেই যৌন হেনস্থার শিকার। তাঁদের সকলেরই শরীরের সীমানা লঙ্ঘন করা হয়েছে তাদের ইচ্ছা-ব্যতিরেকে। শুধু লঙ্ঘন মাত্রা ও পদ্ধতি নানা ক্ষেত্রে নানা রকম। এরপর নানা বিখ্যাত ও অখ্যাত ব্যক্তিত্বকে নির্যাতক হিসেবে চিনিয়ে দিতে থাকেন বিভিন্ন মহিলা। এই জায়গায় এসে গোল বাধে। ‘অপরাধ’-এর পর ‘অপরাধী’-দের নিয়েও মুভমেন্ট মুখর হয়। মুখহীন অপরাধীকে যত সহজে মেনে নেওয়া যাচ্ছিল, ‘নেমিং ও শেমিং'-কে তত সহজে মেনে নেওয়া গেল না। কারণ সেই ব্যক্তিদের সকলেই হার্ভে উইন্স্টেইনের মতো সুবিদিত লম্পট নন। অনেকেই পণ্ডিত, সুভদ্র, শালীন হিসেবে পরিচিত। তাঁদের নামে সোশাল মিডিয়ায় খাপ বসায় অনেকেই বিচলিত হলেন৷ ‘এঁকে তো কখনও তেমন করতে দেখিনি! ইনি তো ভারি অমায়িক! ইনি তো বিদগ্ধ!’ ইত্যাদি যুক্তি শোনা যেতে লাগল।২০১৭ সালের অক্টোবরেই এসে গেল রায়া সরকারের সেই বিখ্যাত তালিকা, যেখানে সারা পৃথিবীর প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় পঁচাত্তর-আশি জন পুরুষ অধ্যাপকের নাম শোভা পেয়েছিল। তাঁরা পাঠদান বা গবেষণায় তত্ত্বাবধানের নাম করে ছাত্রীদের (কেউ কেউ ছাত্রদেরও) যৌন নির্যাতন করেছেন, শোনা গেল। রায়া সরকারের তালিকারও অবশ্য এক পূর্ব-ইতিহাস ছিল। ওই ২০১৭ সালের অক্টোবরেই প্রফেসর ক্রিশ্চিন ফেয়ার হাফিংটন পোস্টে স্বনামধন্য প্রফেসর দীপেশ চক্রবর্তীকে অ্যাবিউজার হিসেবে চিহ্নিত করেন। হাফিংটন পোস্ট পরে নিবন্ধটি তুলে নেয়। পারিপার্শ্বিক চাপ তার কারণ হলেও হতে পারে। হাফিংটন পোস্টের তরফ থেকে যে চিঠি প্রফেসর ফেয়ারকে পাঠানো হয়, সেখানে তাঁর দাবিকে 'ভুল' বা ‘মিথ্যা’ বলা হয়নি। বলা হয়েছিল, তথ্যগুলি 'unverified '। Unverified তথ্য পরিবেশনে হাফিংটন পোস্টের কতটা আপত্তি থাকত বিশেষ কিছু ক্ষমতাশালী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম না এসে পড়লে, তা আলোচনাসাপেক্ষ। ক্যালিফোর্নিয়ার আইনের ছাত্রী রায়া সরকারের লিস্টটি আসে এর প্রতিবাদ হিসেবে। তাঁর লিস্টের নামগুলির মালিকেরা অনেকেই প্রগতিশীল, বামপন্থী ও অন্তত বাচনে লিঙ্গসাম্যের আদর্শে বিশ্বাসী।

এরপর তনুশ্রী দত্তের কল্যাণে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বলিউডেও অপরাধী চিনে নেওয়ার হিড়িক পড়ল। এতদিনের জমাট নৈস্তব্ধ্যের বরফে যেন শাবল পড়ল। নানা পাটেকর, বিবেক অগ্নিহোত্রী থেকে বিকাশ বহাল, গুরসিমরন খাম্বা, ‘সংস্কারী’ আলোকনাথ, সুভাষ ঘাই, অনু কাপুর, কৈলাশ খের….দেখা গেল ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়। আরও দেখা গেল, এবার আর শুধু এক্সেল শিট নয়। এবার নামের সঙ্গে এল নির্যাতনের বর্ণনাও৷  

বর্ণনাগুলি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সব নির্যাতনের মাত্রা এক নয়৷ বিনতা নন্দা যেভাবে আলোকনাথের দ্বারা ধর্ষিতা হওয়ার বর্ণনা দিচ্ছেন, তার সঙ্গে এআইবি-খ্যাত খাম্বার সেক্সুয়াল অ্যাডভান্সমেন্টের পার্থক্য আছে। সুভাষ ঘাই-এর স্থূল নির্যাতন আর সৃজিত মুখার্জির কাজ দেওয়ার নাম করে স্কাইপে চ্যাট করতে বাধ্য করার মধ্যে তফাত আছে। অনু কাপুরের লাম্পট্যের সঙ্গে তফাত আছে কৈলাশ খেরের সীমালঙ্ঘনের। কিন্তু সবকটিই যে হেনস্থা, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। এইখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। ভার্মা কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক ধর্ষণ, নির্যাতন, হেনস্থার সংজ্ঞা পরিবর্তন হয়েছিল বটে, কিন্তু নির্যাতন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণারও যেন সংস্কার হল মিটু-র পরে। অনেকক্ষেত্রেই দেখা গেল, নির্যাতিতা নিজেও জানতেন না নির্যাতকের ঠিক কোন পদক্ষেপ থেকে সীমানালঙ্ঘন শুরু হয়। বিনোদন জগতেই হোক বা আকাদেমিক ক্যাম্পাসে, সর্বগ্রাসী পিতৃতান্ত্রিক পরিবেশে পুরুষের কিছু আচরণ যুগ যুগ ধরে এতটাই ‘স্বাভাবিক’ হয়ে উঠেছে যে বাউন্ডারির ধারণা গুলিয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। গবেষণারত ছাত্রী যেমন ধরেই নেয়, গাইডের সঙ্গে অতিরিক্ত কিছু সময় কাটাতে সে বাধ্য, যদি তিনি তেমনটা চান৷ উঠতি নায়িকা যেমন ধরেই নেয়, পরিচালকের সঙ্গে এক-আধবার লং ড্রাইভে যেতে হতেই পারে। এমনকি অল্পবিস্তর অযাচিত শারীরিক নৈকট্যকেও অনেকে ‘স্বাভাবিক’ বলে ভেবেছেন বহুদিন ধরে। ‘কাস্টিং কাউচ’ কথাটিও নেহাতই বিছানা-গন্ধী, যদিও বিছানা পর্যন্ত না গড়ালে যৌন নির্যতন হতেই পারে। কাজ দেওয়ার নাম করে স্কাইপ চ্যাটে বাধ্য করা, অযাচিত ভাবে সহকর্মীর নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রশংসাসূচক বর্ণনা , আলতো পিঠে হাত রাখা, এমনকী ক্ষমতার অপব্যবহার করে মহিলার সঙ্গে অতিরিক্ত কাটাতে চাওয়া— যা কিছুকে হয়ত এতদিন হালকা চালে ‘ফ্লার্টিং’ বলে চালিয়ে দেওয়া হত, যে যে আচরণ এমনকি প্রগতিশীল, বিদ্বজ্জনদের মধ্যেও দুর্লভ ছিল না, সেগুলিও নির্যাতন রূপে চিহ্নিত হল। অন্যপ্রান্তের মানুষটি কতটা ইচ্ছুক, তাঁর সম্মতি আছে কিনা, নির্দিষ্ট কিছু আচরণকে তিনি  নির্যাতন ভাবছেন কিনা— তা গুরুত্ব সহকারে বোঝার প্রয়োজনকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হল।

তাত্ত্বিকভাবে যদিও দীর্ঘ কয়েক বছর ধরেই ‘নো মিনস নো’ একটি নারীবাদী স্লোগান, যদিও যৌনতায় ‘কনসেন্ট’-এর ধারণাও বিবর্তিত হচ্ছে অনেকদিন ধরেই, যদিও ‘নো মিনস নো’-এর পরের ধাপে  '(অনলি) ইয়েস মিনস ইয়েস’স্লোগানের আবির্ভাব ঘটেছে ইতোমধ্যে, যদিও শুধুমাত্র সুস্পষ্ট ‘হ্যাঁ’-কেই আমেরিকার মতো দেশে আইনিভাবে যৌনতায় সম্মতি হিসেবে গ্রাহ্য করার কথা বলা হয়েছে, তবু প্রায়োগিক স্তরে  #মিটু আন্দোলন জনমানসে যৌন নির্যাতনের পরিধির সম্প্রসারণ ঘটাতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে৷ #মিটু মুভমেন্ট নিঃসন্দেহে অভিযোগে দেরি, নির্যাতিতর পোশাকের দৈর্ঘ্য, বাইরে বেরোনো সময় ইত্যাদির ঊর্ধ্বে গিয়ে নির্যাতন নিয়ে জনগণকে ভাবতে শিখিয়েছে।

প্রশ্ন হল, কল আউটের পরে এই কেসগুলিতে কী ঘটে? নির্যাতিতা বেশি অসুবিধা ভোগ করেন না নির্যাতক? যেহেতু ধরে নিচ্ছি পাঠকেরা সকলেই সুভদ্রজন, তাই এটাও ধরে নেওয়া যায় যে তাঁরা যৌন নির্যাতনের অন্তই চাইছেন। তাই এই প্রশ্নও ওঠে যে  এমতাবস্থায় চারপাশের মানুষের কোন ভূমিকা কাম্য? রায়া সরকারের ক্ষেত্রে নির্যাতিতদের নাম উহ্য ছিল। রায়া সরকার নিজে প্রবল সামাজিক চাপ ও অবসাদের কথা বলেছিলেন পরবর্তীকালে। বস্তুত তাঁর তুল্য অবসাদে অনেক নির্যাতককেই পড়তে হয়নি।

এইক্ষেত্রে, কয়েকটি উদাহরণ দিতে চাইব। যেভাবে প্রায়শই কিছু অনলাইন সেমিনারে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ আসে, সেভাবেই, রাজনৈতিক বা আকাদেমিক জগতের বাইরের লোক হয়েও প্রায়শ কিছু তাত্ত্বিক আলোচনা শোনার আমন্ত্রণ পাই। দেখতে পাই, অনেক ক্ষেত্রেই যাঁরা বক্তা বা উদ্যোক্তা, তাঁরা নির্যাতক হিসাবে রায়া সরকারের লিস্টে ছিলেন, বা পরবর্তী সময়ে অন্য কারও দ্বারা অভিযুক্ত হয়েছেন। অভিযুক্ত হয়েছেন বলতে আইনিভাবে নয়, সাক্ষ্যপ্রমাণ সহ নয়, মৌখিকভাবেই হয়েছেন। এই আকাদেমিক ব্যক্তিত্বরা প্রায়শ নিজের ইউনিভার্সিটির বাইরে অন্য ইউনিভার্সিটিতেও বক্তব্য রাখার ডাক পান ও আমরা সাধারণ মানুষেরা শ্রোতা হিসেবে ডাক পাওয়ায় কখনও সখনও সে ব্যাপারে অবহিত হই। যেমন, ইতিহাসের অধ্যাপক বেন জাকারিয়ার নাম রায়া সরকারের লিস্টে আসার বহুদিন পরেও তাঁর ফ্যাসিবিরোধী বক্তব্য শোনার ডাক আমি নিজেই পেয়েছি। তাতে পত্রপাঠ 'না' বলেছি। বেন জাকারিয়ার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অনেকেই তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে স্বাচ্ছন্দ্য দেখিয়েছেন, শুধু শ্রোতা হিসেবে নয়, ব্যক্তিগত স্তরেও। কিন্তু এমন নয় যে এরকম দুএকজন শ্রোতা কমলে কোনো নামি ব্যক্তির বক্তব্য রাখার অধিকার ব্যহত হয়েছে। তাঁরা স্বমহিমায় বিরাজ করেছেন প্রগতিশীল মুখ হিসেবে। মিটু-তে অভিযুক্ত ব্যক্তির পদোন্নতিও হয়েছে, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও হয়েছেন। উদাহরণ: অধ্যাপক বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। আবার দীপেশ চক্রবর্তী প্যারিসে গিয়ে অনারারি ডক্টরেট নিয়ে এসেছেন গত বছরেই।

অন্যদিকে, অভিযুক্তও মনে করতে পারেন, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার কোনো কারণ থাকতে পারে না। সেক্ষেত্রে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তিনি সমাজমাধ্যমকেই বেছে নেন অনেক ক্ষেত্রে। যেমন করেছিলেন অধ্যাপক পার্থ চক্রবর্তী। তাঁর নাম যেহেতু রায়া সরকারের এক্সেল শিটে উঠেছিল, এবং ঘটনার কোনো উল্লেখ ছিল না, কতজন অভিযোগ করেছেন সে ঘরটিও ফাঁকা ছিল, তাই তিনি সমাজমাধ্যমে উক্ত তথ্যগুলি চান। উত্তর পাওয়া যায় না এবং বিষয়টি থিতিয়ে যায়।

বহু ভয়েস রেকর্ডিং সহ অধ্যাপক অংশুমান করের বিরুদ্ধে বর্ণনা সহ অভিযোগও উঠেছিল শিক্ষকের ক্ষমতার অপব্যবহার করে ছাত্রীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের। কিন্তু আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, তাই তিনি বছর দুয়েকের মধ্যেই সসম্মানে সারস্বত জগতে ফিরে এসেছেন। কাঞ্চা ইলাইয়া (এঁরও অপরাধের বর্ণনা পাওয়া যায়নি, কিন্তু রায়া সরকারের লিস্টে নাম ছিল) এখনও সম্মাননীয় দলিত নেতা, সাহিত্যিক ও অধ্যাপক, যাঁর লেখা বিজেপি সিলেবাস থেকে বাদ দেওয়ার তোড়জোড় শুরু করলে আমাদের প্রগতিশীল সমাজ থেকেই প্রতিবাদ শোনা যায়। সারস্বত সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর এঁদের প্রতি চারপাশের মানুষের কী মনোভাব? সাধারণত তাঁরা এঁদের জ্ঞান ও ক্ষমতার দ্বারা আজও প্রভাবিত। তাই চুপ থাকা ও তাঁর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখাকেই শ্রেয় মনে করেন৷

এবার সাম্প্রতিক একটি ঘটনার উল্লেখ করি। বেলুড়ের দর্শনের অধ্যাপক শামিম আহমেদের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ উঠেছে সম্প্রতি। উপরে উল্লিখিত সব কটি কেসের চেয়ে এই কেস কিছু আলাদা। এখানে অপরাধীকে অবাক করে নির্যাতিত থানায় গেছেন। ফলে নির্যাতক অন্যদের চেয়ে খানিক বেশি অসুবিধেয় পড়েছেন। আপাতত তিনি নিজের কলেজে ছুটি নিয়েছেন শোনা যাচ্ছে। পুলিস তাঁকে 'অ্যাবস্কন্ডিং' বলছে। অর্থাৎ এই মুহূর্তে তিনি শুধু মিটুতে নয়, আইনি ভাবে অভিযুক্ত।

শামিম আহমেদের ঘটনাটি আমাদের রাজনৈতিক ও শিক্ষামহলে নির্যাতন নিয়ে আরেকবার ভাবার সুযোগ দেয়। শামিম আহমেদ সংখ্যালঘু বাঙালি মুসলমান সমাজের মুখ ছিলেন। অনেক প্রকাশনারই তুরুপের তাস ছিলেন, কারণ মুসলমান পণ্ডিতের কলমে মহাভারত ব্যাখ্যার এক অন্যতর সামাজিক মূল্য আছে আরএসএস-বিজেপি অধ্যূষিত ভারতে। এমনকী তিনি অভিযুক্ত হওয়ার পর সুচারুভাবে তাঁর অতিঘনিষ্ঠরা গোপনে এটাও প্রচার করতে চান যে তাঁর কুকর্ম নিয়ে সরব হলে নাকি বাংলায় দাঙ্গা বাধবে। কিন্তু দেখা যায়, তেমন কিছুই আদপে ঘটে না৷ মিটু সম্ভবত ইন্টারসেকশনালিটির ধারণাকেও স্পষ্টতর করেছে আমাদের মনে। তাই দলিত কাঞ্চা ইলাইয়া বা মুসলিম শামিম আহমেদরা যৌন নির্যাতক হলে চেপে যাওয়া হোক, এমনটা প্রকাশ্যে আর বলেন না প্রগতিশীলরা। কিন্তু শামিম আহমেদের ঘটনাটি ব্যক্তিগতভাবে আমাদের নাড়া দিয়ে যায় আরও কিছু কারণে।

অনেকের মতো আমার সঙ্গেও ব্যক্তির পরিচয় ঘটে ফ্যাসিবিরোধী এক মঞ্চে যোগ দিয়ে, যা কোনো রাজনৈতিক দল নয় ও যাতে কোনো হায়ারার্কি নেই। এখানে কেউ ঊর্ধ্বতন নয়, প্রতি আহ্বায়কই সমান পদমর্যাদার, তাই কোনো আহ্বায়কের বিরুদ্ধে নারীনির্যাতনের অভিযোগ যে কোনো একজনের জানা থাকলে তিনি বাকিদের তা জানাবেন এটাই কাম্য ( লিখিত নিয়ম নয়, কিন্তু কাম্য)। এক্ষেত্রে দেখা যায়, ক আহ্বায়ক খ আহ্বায়ককে জানিয়েছিলেন বলে জানাচ্ছেন ক-এর বান্ধবী, এবং ক স্বীকৃত হচ্ছেন যে তাঁরা আর কাউকে জানাননি, কারণ প্রমাণ ছাড়া বা ভিক্টিমকে না চিনে এরকম অভিযোগ করা উচিত হবে কিনা বুঝতে পারেননি৷ আমরা কেউই সবটা বুঝি না। নির্যাতন ও অভিযোগের সংজ্ঞাও পাল্টাচ্ছে দিন দিন। যেমন, যে বামপন্থী দলের সঙ্গে শামিম যুক্ত ছিলেন, তাঁদের মধ্যেও প্রশ্ন উঠেছে, সাম্প্রতিক ঘটনার আগেও কি শামিমের বিরুদ্ধে কেউ কাউকে অভিযোগ করেছিল? জানা যাচ্ছে যে, একটি আপত্তিকর চ্যাটের কথা ব্রাঞ্চে জানানো হয়েছিল কিন্তু তা পার্টির সবার কাছে পৌঁছয়নি (আরেক ভিক্টিমের সমাজমাধ্যমের জবানবন্দী অনুসারে)।

কে কী জানত আর কে কী জানত না, তা নিয়ে যে কাদাছোড়াছুড়িটা হল, তা আমার কাছে ইতিবাচক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ, নেতিবাচক কারণে নয়। এর দ্বারা বোঝা যায়, সচেতন মানুষ নিজে কোনো নির্যাতকের নির্যাতনের প্রবণতা সম্পর্কে জানলে বা  সদিচ্ছা থাকলে যে তিনি তাকে সবসময় উচিত গুরুত্ব দিতে পারছেন ও অন্যদের যথোচিত ভাবে সাবধান করতে পারছেন, এমনটা না হতে পারে। তাহলে কি প্রক্রিয়ায় সমস্যা থাকছে? দেখা যাচ্ছে, কেউ আরেক সহযোদ্ধার সঙ্গে গল্পগাছাকে তাঁর 'যৌননির্যাতন বিরোধী কর্তব্য' হিসেবে যথেষ্ট ধরতে পারেন। কেউ অপেক্ষা করতে পারেন সাক্ষ্য প্রমাণের, বা স্বয়ং ভিক্টিমের মুখ থেকে ঘটনা শোনার। কেউ আবার সুযোগের অপেক্ষা করতে পারেন, কখন অন্যদের না-জানা ও তাঁর জানা-কেই মূলধন করবেন নিজেকে সচেতনতর প্রমাণ করতে। এর কোনোটিই নির্যাতন প্রতিরোধক ব্যবস্থা নয়— এটুকু এই ঘটনা থেকে শেখার। নারী নির্যাতন যদি রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হয়, ব্যক্তিগত ঘটনা না হয়, তাহলে সে সম্পর্কে প্রমাণ-সাক্ষ্য ছাড়া জানার অধিকার সকলের আছে। বিশেষত, সেই জানানোর প্রক্রিয়াটি পুরুষে-পুরুষে একান্তে ঘটলে তাকে জানানোর চেয়ে বেশি লকাররুম টক মনে হয়, কারণ এতে করে কোনো সম্ভাব্য নির্যাতিতই সাবধান হতে পারল না।


এবার, সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়া অভিযোগকে অভিযুক্ত অপমানজনক ভাবতে পারেন। অভিযোগকারীকে সম্মানহানির জন্য তিরষ্কারও করতে পারেন। কিন্তু অন্যদিকে, তা অনেক সম্ভাব্য নির্যাতন আটকেও দিতে পারে। আমাদের মনে হয় এটাও বুঝতে হবে, কেন ছোটখাটো চ্যাটের মাধ্যমে বাউন্ডারি টপকানো হচ্ছে বোঝার পরেও, বা নির্দিষ্ট ব্যক্তির যৌন চরিত্র সুবিধের নয় জেনেও, খোলাখুলি অভিযোগে অনীহা। প্রথমত, নির্যাতিতর মনেও এই দ্বন্দ্ব থাকতে পারে যে এই আপাত সুভদ্র মানুষটি কি সত্যি বাউন্ডারি ক্রস করেছেন? করলে কতটা? মেয়েদের পক্ষ নিয়ে বলা যায়, কতটা বাউন্ডারি ক্রস করলে ঠিক কী প্রতিক্রিয়া জানানো উচিত, তেমন কোনো নির্দেশিকা আমাদের ছোটবেলা থেকে শেখানো হয়নি। আমার চ্যাটবক্স খুললেও অযাচিত বাক্যালাপের চেষ্টায় দশবছর আগে আমার নিজের যে প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাবে, তা হল দ্বিধা সহকারে কোনোরকমে অস্বস্তি ব্যক্ত করার। এখন একই ঘটনা ঘটলে সেই উত্তর অনেক সপাট হত। মোদ্দা কথা, অস্বস্তি জানানোর উপায়ই যখন শেখানো হয় না, তখন অভিযোগ তো দূর অস্ত।

এ ঘটনা থেকে এটাও শেখার যে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে পার্টি বা গণমঞ্চের তরফ থেকে চাইলে বহিষ্কার বা সম্পর্কচ্ছেদ করা যায়। কোনো 'বৃহত্তর স্বার্থে' তা স্থগিত রাখার প্রয়োজন ঘটে না। চাপে পড়ে একটি মঞ্চ ও একটি দল ব্যক্তিকে বহিষ্কার করেছে বলে অনেকে বলছেন। কিন্তু যখন চাপ দিয়েও ৯৯% প্রতিষ্ঠান থেকে অপরাধীকে বাদ দেওয়া যায় না, তখন একে সদর্থক ভূমিকা হিসেবেই দেখব।

অন্যদিকে সারভাইভাররা এটা ভেবে দেখতে পারেন যে, তিনি/ তাঁরা নিজে একবার সরব হলে, তাঁর নাম অপ্রকাশিত থাকলেও, যে কোনো সমষ্টি/ প্রতিষ্ঠান / মঞ্চ / দলের উপর বিবৃতি দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা সহজ হয়। এফআইআর করলে এই চাপ আরও বেশি সৃষ্টি করা যায়। বলতেই পারেন, 'ডিউ প্রসেস'-কে কেন পাত্তা দেব? ওটা তো প্রাতিষ্ঠানিকতাকে পাত্তা দেওয়া। যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে 'ডিউ প্রসেস' আর 'মিটু', কোনোটির প্রতিই আমার পক্ষপাত নেই৷ মনে হয়, এরা একে অন্যের পরিপূরক হলে প্রতিবাদটা সার্বিক ও জোরালো হয়।

লিঙ্গ রাজনৈতিক কর্মী নিজের পরিধির মধ্যে কতটা চেঁচামিচি করলেন, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল যিনি লিঙ্গরাজনৈতিক কর্মী নন, অথচ সতীর্থ রাজনৈতিক কর্মী, বা কর্মক্ষেত্রে সহকর্মী, তাঁকে সচেতন ও সেন্সিটাইজ করা৷ কবিতা কৃষ্ণণ একবার এক আলোচনায় বলেছিলেন, 'পার্টির পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে মেয়েরা পার্টির ভিতরে থেকে নিরন্তর লড়ছে, পার্টির পিতৃতন্ত্রের দায় তাদের ঘাড়েই চাপিয়ে দিয়ে কি লাভ আছে কিছু? তাদের লড়াইটা খাটো না করে তাদের উৎসাহিত করুন।' কথাটি যেকোনো সমষ্টির ক্ষেত্রে খাটে৷ অবশ্য যদি ইচ্ছেটা প্রতিকারের হয়।

আমরা যারা এই ব্যক্তির সঙ্গে ফ্যাসিবিরোধী সভা করেছি ২০২১ সালে, যৌথ বিবৃতি দিয়েছি, অবশ্যই তাদের প্রতারিত হওয়ার অনুভূতি হয়। যদিও প্রতারণার দায় প্রতারকের, প্রতারিতর নয়, তবু নিজেদের বিবেচনা নিয়ে সংশয় জন্মায়, একথাও ঠিক৷ লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আমাদের অনেকের কাছে সে ছিল আপাতভাবে সাম্যে বিশ্বাসী মানুষ। যে ব্যক্তি নারীপুরুষ নির্বিশেষে সভাস্থ সকলে চা এগিয়ে দেয়, পরবর্তীকালে জানা যেতেই পারে যে, সে প্রায়শ নিজের ছাত্রদের বেগার খাটাত। একইভাবে অপেক্ষাকৃত বয়োজ্যেষ্ঠ মেয়েদের সঙ্গে ব্যক্তির যে আচরণ, তার সঙ্গে, পরবর্তীকালে দেখা যায়, বয়োকনিষ্ঠ অনেক মেয়ের অভিজ্ঞতা মেলে না। অর্থাৎ একই মানুষের বিভিন্ন রূপ থাকতে পারে নানা মহলে। সুতরাং আমার প্রাথমিক ইম্প্রেশনের ভিত্তিতে কাউকে ক্লিনচিট না দিয়ে নির্যাতিতকেই প্রাথমিক ভাবে বিশ্বাস করতে হবে।

অতীত অভিজ্ঞতা বলে, এরপরেও নির্যাতক বিদ্দ্বজ্জনটি বুধবাজারে ফিরতে পারেন। হয়ত আরও ক্ষমতা বাড়িয়ে, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে দহরম-মহরম বাড়িয়ে। অতীতে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যায়ালয়ের অধ্যাপকটি যেভাবে ফিরেছেন। মিটু-র প্রাপ্তি এই যে, মাঝে কদিন/কমাস/ কবছর এরা মুখখানি লুকিয়ে রাখেন। তাঁদের ক্রমাগত লজ্জা কিন্তু ঐক্যবদ্ধ হলেই দেওয়া সম্ভব ছিল। একে অন্যকে লজ্জা দেওয়াটা সেখানে মুখ্য নয়।

সেই মেয়েকে/ দের সাধুবাদ, যারা জানে যে খেলা যে কোনো দিন ঘুরে যেতে পারে নির্যাতকের দিকে। কিন্তু তবু যারা সমাজমাধ্যমে নিন্দা করেই ক্ষান্ত দেয় না, বরং আইন মোতাবেক অভিযোগ দায়ের করে। অভিযোগ দায়ের করে এমনকী এটাও জেনে যে পুলিসও পিতৃতান্ত্রিক আচরণ করতে পারে।  ব্যক্তিগতভাবে জানি, তাদেরও দ্বিধা হয়, ভয় করে। 'এমপাওয়ার্ড উওম্যান'-এর ধারণা খুব একরৈখিক। অনেক সচেতন মেয়ে 'আমিও নির্যাতিত হয়েছিলাম' এই ধারণাকে মেনে নিতে পারে না৷ ভাবে, তাহলে যদি আমাকে মানুষ 'এমপাওয়ার্ড' না ভাবে? দ্বিধাহীনতাকে এমপাওয়ার্মেন্ট বলে না হয়ত, বলে দ্বিধা জয় করাকে। নির্যাতিত হিসেবে নিজেকে স্বীকার করা, নিজের নির্যাতনের প্রতিকার করা, নিজেকে সারিয়ে তোলাটাই মূল্যবান 'ক্ষমতায়ন'। আজ যারা খুলে বলছে তাদের অভিজ্ঞতা, তারা কালকের সম্ভাব্য নির্যাতিতার কিছু উপকার অবশ্যই করছে৷ নির্যাতক লোকটির শাস্তিবিধান হোক না হোক, এটুকু হচ্ছে। ব্যক্তি এটুকুই করতে পারে৷ এরপর প্রতিষ্ঠানের উপর বাকি দায় বর্তায়। রাজনৈতিক/সাংস্কৃতিক/ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এই নির্যাতকদের তবু ঠাঁই দেবে? আর দায় বর্তায় রাষ্ট্রের উপর। রাষ্ট্র কি মেয়েদের ধর্ষণ করে, মেরে ফেলে, শরীর পুড়িয়ে ফেলার পরই শুধু গোয়েন্দা পাঠাবে? জ্যান্ত মেয়েদের নির্যাতনহীন বাঁচায় রাষ্ট্রের ভূমিকা থাকবে না?

নির্যাতিতা মেয়েটিকে চেনার সূত্রে বলতে পারি, শুধু নিজের জন্য নয়, সে কিন্তু অন্যদের জন্যই আইনি ব্যবস্থা নিতে রাজি হয়েছে৷ বারবার বলেছে, ওই লোকের আকাদেমিয়ার থাকা ছাত্রীদের জন্য বিপজ্জনক। আমি তার কাজকে পরার্থপরতা হিসেবে দেখছি। তাই পাশে দাঁড়ানোকে দায় ভাবছি।

কিন্তু এবার আরেকটি প্রণিধানযোগ্য বিষয়ে দৃকপাত করি, যা ততটা সুখকর নয়। ফেসবুক দেখে মনে হয়েছিল বটে যে সারা শহর উথাল পাথাল হচ্ছে এই ঘটনায়। অথচ আসলে, মেয়েটির পাশে অপদার্থতায় অভিযুক্ত দুচারজন ছাড়া আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না থানায় বা আদালতে বা উকিলের বাড়িতে৷ তাই ভয় হয়, এই ছদ্ম সচেতনতার ফাঁক গলে অভিযুক্তের প্রত্যাবর্তন সহজ হবে না কি?

শেষ পাওয়া খবর অনুয়ায়ী নির্যাতক অন্তর্বতী জামিন পেয়েছে৷ দুদিন আগে। সবচেয়ে ভয়ংকর হল, তার পরেই সে সোশাল মিডিয়ায় আবির্ভূত হয়েছে ও নির্যাতিতর স্লাট শেমিং করছে। সুধীজন তার সেই পোস্ট লাইক-লাভও করছেন। আইনের অনেক ফাঁক। বলা যেতেই পারে, যে যার ইচ্ছে মতো পোস্ট করতে পারে। বলা যেতে পারে, কারও নাম নেওয়া হয়নি। কিন্তু আমরা জানি, এগুলি সেই অবাঞ্ছিত ফাঁকফোকর। মনে প্রশ্ন জাগে, আমরা কি জঙ্গলের রাজত্বে বাস করছি? আমরা কি ভেবে দেখব একটি মেয়ের নিজেরই নির্যাতকের কাছে স্লাটশেমড হতে কেমন লাগে? পরস্পরের খুঁত ধরা ছাড়া আমাদের কি আর কোনো দায় আছে? আমরা কি চুপ থাকব?

আরও কয়েকটি বহুল প্রচারিত ঘটনার উল্লেখ করে শেষ করব। যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই এ'দেশে কতটা কঠিন তা বুঝতে হয়ত এই ঘটনাগুলির উল্লেখ দরকার। মহম্মদ ফারুকির বিরুদ্ধে মামলাটি দেখায়, মেয়েটি 'না' বলেছিল এটা মেনে নেওয়ার পরেও আদালত বলেছিল, তার 'না' এতটা 'সজোর না' ছিল না যে অভিযুক্ত সেটাকে প্রতিরোধ ভাববে! সে তো ব্রীড়াও ভাবতে পারে! হ্যাঁ, আদালত বলেছিল৷ এম জে আকবর একাধিক নারীর যৌন হেনস্থার মুখে পড়া সত্ত্বেও একজনের বিরুদ্ধে করেন মানহানির মামলা! অন্য অভিযোগকারীরা সাক্ষ্য দেওয়ায় মানহানির মামলা মকুব হয়। কিন্তু যদি একজনের পাশে বহু না দাঁড়াত?

শেষোক্ত ঘটনাটি তরুণ তেজপাল কেন্দ্রিক৷ তাঁর বিরুদ্ধে শুনানিতে ভারতীয় আদালত নারীবাদকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। আদালতই বলে, অভিযোগকারিণী 'নারীবাদীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করছেন' (কী ষড়যন্ত্র তা জানা যায় না)। এই রায়ে বারবারই এসেছে নারীর চরিত্র ও তাঁর পূর্ব-সম্পর্কের প্রসঙ্গ। অথচ ২০১৩ সালের আইন সংস্কারের সময় ভার্মা কমিটি এভিডেন্স অ্যাক্টেও কিছু বদল এনেছিল। ৫৩ক সেকশন ঢোকানো হয়েছিল, যেখানে বলা হয়েছিল ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে, যখন অভিযোগকারিণীর 'কনসেন্ট' ছিল কিনা, তা নিয়ে তর্ক হবে, তখন অভিযোগকারিণীর পূর্ব সম্পর্কের কথা আনা যাবে না। এভিডেন্স অ্যাক্টের সেকশন ১৪৬-এও বলা হয় যে অভিযোগকারিণীর চরিত্র বা পূর্ব সম্পর্ক টানা যাবে না। এমনকী আরও দশ বছর আগে ১৫৫-৪ ধারা বাদ দিয়ে বলা হয়েছিল, অভিযুক্ত অভিযোগকারিণীকে চরিত্রহীন বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করতে পারবেন না। এছাড়াও, বিচারক বোধহয় সবচেয়ে সমস্যাজনক কথাটি বলেন: 'ধর্ষক অসম্মতি বুঝতে পারেনি, তাই ধর্ষণ হয়নি।' যে অনুমতির তোয়াক্কা করে না, সেই তো ধর্ষক! বিচারকের উপরিউক্ত (কু)যুক্তিতে তো পৃথিবীর সব ধর্ষকই খালাস পেতে পারে!

এই যখন দেশের অবস্থা, তখন অভিযোগকারিণীর পাশে সমস্ত নারীবাদীরা ফেসবুকে নয়, বাস্তবে দাঁড়াবেন, একত্রে দাঁড়াবেন, এটাই কাম্য ছিল৷ নির্যাতককে লজ্জা দেওয়া ও প্রয়োজন মতো শাস্তি দেওয়া যদি লক্ষ্য হয় এবং যদি নির্যাতিতাকে আগলানো হয় কর্তব্য, তবে এ ভিন্ন আর কোনো উপায় থাকে না৷ আর এতে আমন্ত্রণের প্রশ্ন নেই। স্বতঃস্ফূর্ত যোগদানই কাম্য। সকলেই জানেন কোন থানায় অভিযোগ। নির্যাতিতকে না জানলেও খোঁজ নেওয়ার জন্য সকলেই চেনেন তার বন্ধুদের। দুঃখের ব্যাপার, এতদসত্ত্বেও নির্যাতকের নাম আস্তে আস্তে সোশাল মিডিয়া থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে, চাপা পড়ে যাচ্ছে৷ রয়ে যাচ্ছে কিছু ভালোমানুষির প্রতিযোগিতা৷ নির্যাতকের তাতে পোয়াবারো। অথচ সমাজমাধ্যমও অমিত সম্ভাবনাময় জায়গা৷ এর মাধ্যমে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে এমন আন্দোলনও গড়ে উঠতে পারত যাতে তার নামে তড়িঘড়ি ওয়ারেন্ট বেরোয়! যাতে আগাম জামিনের আবেদন হল কি হল না, তা জানতে একই ব্যক্তিকে বারবার থানায় পাড়ি না দিতে হয়! এমনও  হতে পারত যে ব্যক্তি নয়, শহর জানতে চাইল থানাকে, চার্জশিট দিতে আর কত দেরি?

অভিযুক্তর কলেজে 'লিভ' নিয়েছেন, কিন্তু তদন্ত চলাকালীন কলেজের দ্বারা বরখাস্ত হননি। শামিম আহমেদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র একটি বিবৃতি দিয়েছে যেখানে তাঁরা স্বীকার করেছেন যে তাঁরা ওই অভিযোগ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়েছে এবং যৌন নির্যাতনে তারা জিরো টলারেন্স দেখাবে৷ উল্লেখ্য, নির্যাতিতা এরপর নিজে যে চিঠি তাঁদের পাঠিয়েছেন, তার কোনো জবাব দেওয়ার সৌজন্য তাঁরা দেখাননি। এমনটা হতে পারত যে, রামকৃষ্ণ মিশনের অনুগামী, ভক্ত, শুভাকাঙ্ক্ষী, শিক্ষক, অধ্যাপক, প্রাক্তনী ছাত্ররা, নাগরিকরা খানিক মাথা গলালেন? প্রতিষ্ঠানকে বাধ্য করলেন লোকটিকে বরখাস্ত করতে? এসব কি বড় বেশি চাওয়া?

রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি মেয়ের ন্যায় চাওয়ার লড়াই কত কঠিন, তা যাঁরা জানেন, তাঁদের ফলের চিন্তা না করে, সমালোচনারও চিন্তা না করে, শুধুমাত্র লড়াইয়েই মনোনিবেশ করতে হয়। চেষ্টাটুকুই হাতে আছে।