উরুবা পুরাণে নদী ও নারী

নদী যেমন সভ্যতা ও মানবজীবনের মূল,  তেমন অর্ধেকাকাশ নারী ব্যতীত মানুষ অসম্পূর্ণ। কখনও সে শক্তি আবার কখনও সে মমতাময়ী, কখনও মাতা কখনও বা ভূমি। কখনও তিনি চন্ডী কখনও বা  জগদ্ধাত্রী। মহাকবি কালিদাস " মেঘদূতম" কাব্যে নদীর রূপ বর্ণনায় রমণীকে  উপমা রূপে এনেছেন ।  কবি বুদ্ধদেব বসু সংস্কৃত এই  কাব্যের অনুবাদ এ লিখেছেন, 

" কোনো নদীর ঢেউ রূপসীর ভঙ্গির মতো, 

  কোনো নদী তার ঘূর্ণিরূপে নাভি দেখাচ্ছে,

 কেউ বিরহে কৃশ, কারো বায়ু মিলনোৎসুক প্রিয়ের মতো চাটুকার,

কারও বায়ুতে যুবতীর জলকেলির সৌরভ ভেসে আসছে,"।

 

আবার পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতায় ফুটে ওঠে মন নরম করা সেই কথাগুলো, 

" ভালোবাসলে নারীরা হয়ে যায় নরম নদী,

পুরুষেরা জ্বলন্ত কাঠ।"

 

নারী নদীর মতো চঞ্চল, বেগবতী । নদী আর নারীর সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। পুরাণের পাতা থেকে লোককথায় সমান্তরালে বয়ে চলে তারা। উৎস স্থল থেকে নদী জন্মের স্বাদ পায় আর সাগরের বুকে ঝাঁপিয়ে বিলীন হয়ে যায়। প্রবহমানতার শেষ নেই তার। জীব অনেকটা নদীর মতোই। জন্ম, বহমানতা ও মৃত্যু। স্বাধীনতা, উচ্ছ্বলতা, জীবন, ঊর্বরতার প্রতীক নদী। আর নারী! সেও তো জীবন । চঞ্চল, সৃষ্টিতে সক্ষম  চালিকা শক্তি।

প্রথমেই চোখ রাখি উরুবার জনজাতির পুরাণ কাহিনিতে। উরুবা কাহিনির গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যায়, গল্পে  নদী ও নারী একে অপরের পরিপূরক।  তার আগে জেনে নেই উরুবা গোষ্ঠীর পরিচয়।  উরুবা ভূমি  হল পশ্চিম আফ্রিকার উরুবা জনগণের জন্মভূমি এবং তাদের সাংস্কৃতিক অঞ্চল। 

নাইজেরিয়া, টোগো এবং বেনিন-এর আধুনিক দেশগুলিতে এদের বিস্তার। ইউরোপীয় উপনিবেশের প্রবেশের আগে, এই অঞ্চলগুলোর  একটি অংশ উরুবা দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল।  এই জনজাতির পুরাণে চারজন নদী - দেবীর কথা আছে।  আলোচনায় তাদের পরিচয়, প্রতীক,  পারস্পরিক সম্পর্ক এবং গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করবো।

উরুবা জাতির অন্যতম প্রধান  দেবী ইয়েমজা (Yyeomoeja)। ইয়েমানা, ইয়েমায়া নামেও তাঁর পরিচয়। yemoja বা Yyeomoeja বা শব্দটি ভাঙলে তিনটি অর্থ ফুটে ওঠে। ' yye 'বা 'Iya' র অর্থ মাতা, 'omo' অর্থাৎ শিশু এবং 'eja' অর্থ মাছ। সম্পূর্ণ অর্থ করলে হয়,  " মা, যার সন্তান মাছ । ইয়েমজা  মৎস কন্যাদের দেবী রূপেও পরিচিত। উরুবা লোককাহিনি অনুসারে পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা ওবালার কন্যা ইয়েমজা। তাঁর পুত্র হলো ওরুঙ্গা। একবার যুবক ওরুঙ্গা  মা ইয়েমজার প্রতি হিংস্র  হয়ে ওঠে। সন্তান এর থেকে অপমানিত হয়ে মনোকষ্টে তিনি  পাহাড়ে গিয়ে কাঁদতে থাকেন। তাঁর নয়নাশ্রু  এবং বিষাদ থেকে সৃষ্টি হয় জল। জল হুহু করে বাড়তে থাকায় পৃথিবীতে বান আসে । বন্যার  প্লাবনে সব ভেসে যেতে থাকে।  ইয়েমজার দুঃখ, কষ্ট থেকেই প্রাণের সৃষ্টি হয় । আবার ইটানস গল্পানুসারে ইয়েমজা উরুবাদের আদি ও আধ্যাত্মিক সত্তা। ওলোফি (পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা) যখন আলোফি ভূমি ( দ্বীপ) সৃষ্টি করেন তখন ওবাতালাকে( মানবজাতির সৃষ্টিকর্তা) দেবী ইয়েমজা সহায়তা করেছিলেন।  সমুদ্রের তলদেশে তাঁর  অধিষ্ঠান। লবণাক্ত জলেই তার বাস। কারও মতে তিনি ওবাতালা, ওকেরে, ওকো, এরিনলের স্ত্রী আবার  অপরদের  মতে তিনি ওগুন, স্যাঙ্গো, ওয়া, ওসুন, ওবা, ওকো র মাতা। ইয়েমজা স্যাঙ্গো, দাদা এবং ইবেজি ( যমজ সন্তান) এই তিন দেবতাদের জন্ম না দিলেও লালনপালন করে  বড় করেছেন। ইয়েজমা গভীর সমুদ্রের মতো  নীল বা শুভ্র বসন পরিহিতা ।  নীল রঙ নিস্তব্ধতা,  প্রশান্তি,  সততা, শীতলতার প্রতীক। অপরদিকে সাদা শান্তি, পবিত্রতা, স্বচ্ছতা, আশা, ইতিবাচকতার প্রতীক। এসকল বিশেষণ দিয়েই গভীর সমুদ্রকে বিশেষায়িত করা যায়। দেবী ইয়েমজা স্বল্প অলংকারে ভূষিতা, যা তাঁর সরলতা কে প্রকাশ করে। তাঁর স্থূল বক্ষ যুগল সন্তান প্রতিপালনের প্রতীক। মায়ের বুকেই সন্তানরা নিরাপদ আশ্রয় পায়। সেদিক থেকে দেখলে সাগরের বুকে অসংখ্য প্রজাতির বাস, তলদেশে তাদের বিচরণ, এরা তো সাগর মাতার সন্তান। গভীর সমুদ্রে  জোয়ার ভাটার চাঞ্চল্য নেই, ঢেউ এর দাপট নেই, আকারহীন জলধি। সমুদ্রের ব্যাপ্তি মায়ের স্নেহ, ভালোবাসার মতো অসীম, অনন্ত।

দেবী ইয়েমজাকে  অ্যামনিওটিক তরলের সাথে তুলনা করা হয়। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে  অ্যামনিওটিক তরল কি সেদিকে দৃকপাত করি। এটি একপ্রকার হলুদাভ তরল। গর্ভাবস্থায় ভ্রুণ এর চারপাশে তরলটি থাকে। অ্যামনিওটিক তরলের অভাবে মায়ের শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।  সাগরের জল এমনভাবেই তার দেহে ঠাঁই পাওয়া প্রাণীর  প্রাণ  বাঁচিয়ে রেখেছে।   উরুবা জনজাতির  গেলেদে সমাজের পৃষ্ঠপোষক যাজক শ্রেণির অন্যতম লিয়াও রা মাছের ফুলকা সহ মুখ চিহ্নিত মুখোশ পরিধান করে উৎসব পালন করেন। এই উৎসবের সাথে ইয়েমজার সংযোগ রয়েছে। এমনকি  নাইজেরিয়ার যমজ শিশু হত্যা প্রথায়ও এই দেবী স্যাঙ্গোকে সহায়তা করেছিলেন।  একটি  ক্যালাবাশে (লাউ জাতীয়) নদীর জল পূর্ণ করে তার ভিতর ওটা (পবিত্র পাথর) রাখা হয়।  সেই পাথরকে মন্দিরে স্থাপন করে ইয়েমজাকে  দেবী রূপে আরাধনা করা হয়।

আফ্রিকার দক্ষিণ পশ্চিম নাইজেরিয়ার উরুবা গোষ্ঠীর অপর  দেবী ওসুন। তিনি  ওড়িশার ( পশ্চিম আফ্রিকা বিশেষত উরুবা জনজাতির  কয়েকজন দেবদেবী ,  সৃষ্টিকর্তা পৃথিবী নির্মানের সময় তাদের পাঠিয়েছিলেন)  প্রতীকী নদী ।  তবে নদী  ছাড়াও পবিত্রতা, ভালোবাসা, উর্বরতা, কামনার সাথে তার সম্পর্ক রয়েছে। ওসুন  রক্ষয়িত্রী, জীবনদায়িনী, মানব জাতির    পালিতা,  আধ্যাত্মিক ভারসাম্যের রক্ষনাবেক্ষনকারিনী এবং মাধুর্যের মাতা।  নদী, শাখা নদী, উপনদীর মিষ্টি জলে তাঁর অধিষ্ঠান।  উরুবার লোককথা অনুযায়ী,  পৃথিবী সৃষ্টির সময় সতোরো জন দেবদেবী মর্ত্যে আসেন। ওসুন তাদের মধ্যে একমাত্র দেবী।  অন্যান্য  সকলেই ছিলেন দেবতা। বোঝা যায় সৃষ্টি নারী ব্যতীত অসম্ভব। মানুষ গড়ার কাজে সকল দেবতা অসমর্থ হলে  একমাত্র দেবী ওসুন পৃথিবীতে মনুষ্যজাতি  সৃষ্টিতে সফল  হন । তাঁর অমৃত জলধারা মর্ত্যে প্রবাহিত করে সকল জীবের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করেন  । 

" Humanity would not exist if Oshun the goddess of life and fertility had not acted."

Fertility শব্দের আক্ষরিক অর্থ উর্বরতা। জৈবিকভাবে নারীর  গর্ভে সন্তান  ধারণের  সক্ষমতা হলো তার উর্বরতা,  সৃষ্টি হয়  প্রাণ  আর প্রকৃতির ক্ষেত্রে নদী বা বৃষ্টির জলে ফসল ফলনের ক্ষমতায় শস্য শ্যামলা হয় বসুন্ধরা । সরস হয় প্রকৃতি। 

তবে কথায় আছে যিনি সৃষ্টি করেন  ধ্বংস করার অধিকার ও তার আছে। কোনো  কোনো লোককাহিনী অনুসারে ,  কখনও  ওসুন মর্ত্যভূমিকে  বন্যায় প্লাবিত করেন  আবার কখনও বা অনাবৃষ্টি বন্ধ ঘটিয়ে  খরা ডেকে আনেন।  এই দেবী  হলুদ বসনা, সালংকার, অসামান্য সুন্দরী। হলুদ রঙ  সুখ, সমৃদ্ধি,  উষ্ণতা, সূর্যোদয়ের প্রতীক। সূর্যোদয় নতুনের সূচনা।

নদীকে কেন্দ্র করে উৎসবের প্রচলন নতুন নয়। গুজরাটের কর্নালি জেলায় প্রতি বছর একটি বিশেষদিনে নর্মদা নদীকে শাড়ি পরিয়ে উৎসব পালনের প্রথা আছে। পুষ্করম একটি জনপ্রিয় হিন্দু উৎসব।  এপ্রিল মাসের একটি নির্দিষ্ট সময়ে  টানা বারোদিন ধরে  বারোটি প্রধান নদীর আরাধনা করা হয়।   প্রতি বারো বছরে একবার জ্যোতিষশাস্ত্রে  নির্ধারিত সময়ে পালিত হয় এই উৎসব।   গঙ্গা, নর্মদা, সরস্বতী, যমুনা, গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরি, ভীম,  তাপ্তি,  তুঙ্গভদ্রা, সিন্ধু এবং প্রাণহিতা নদী এর অন্তর্ভুক্ত। পূর্বপুরুষের উপাসনা, স্নান, এবং নৈবেদ্য প্রদান করে উৎসব পালিত হয়। আফ্রিকার উরুবাদের মধ্যেও নদীকে উৎসব পালনের ইতিহাস আছে। এই জনজাতির  মতে, নাইজেরিয়ার ওসোগবো  শহরটি দেবী ওসুন দ্বারা সুরক্ষিত। প্রাচীন কাহিনি অনুসারে,   একবার শহরবাসীকে ওসুন দর্শন দিয়ে জানান,  যথাযথ নৈবেদ্য,   প্রার্থনার দ্বারা তাঁর আরাধনা  সম্পন্ন হলে  শহরটিকে তিনি  সুরক্ষিত করে  রাখবেন । দেবী ও ভক্তদের সাক্ষাৎ এর ঘটনার  এর পর থেকে  উরুবারা   ওসুন উৎসবের সূচনা  করেন। প্রতি বছর ওসুন ভক্তরা নদীতে গিয়ে পূজার্চনা, বলি দান করে দেবীতে শ্রদ্ধা জানায় এবং সন্তান,  সুস্বাস্থ্য ও সম্পদ কামনা করে।  তবে নদীর প্রতি মানবজাতির কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। উৎসব এর আড়ালে নদীমাতৃক সভ্যতার ছবিটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওসুন  দেবী ব্রাজিল এ Oxum এবং কিউবায় Ochun নামে পরিচিত।  উরুবারা বিশ্বাস করেন,  দেবী ওসুন সর্বত্র বিরাজমান।  

 তিনি   জল, আর্দ্রতা এবং আকর্ষণের মহাজাগতিক শক্তি।  অতএব, এই দেবী  সর্বব্যাপী এবং সর্বশক্তিময়ী। একটি উরুবা প্রবাদের বলা হয়েছে, কেউই জলের শত্রু নয় এবং সেইজন্য প্রত্যেকেরই উচিত তাকে এবং তার অনুসারীদের সম্মান ও শ্রদ্ধা করা। 

" IBA OSUN SEKESE 

PRAISE TO THE GODDESS OF

MYSTERY ".

নারী যদি প্রতীক হয় তবে ভৌগোলিকভাবে আফ্রিকার নাইজেরিয়ায়  বয়ে যাওয়া ওসুন নদীর আলোচনা বাদ দেই কীভাবে? এই নদী উরুবার ভূমির মধ্যবর্তী  দক্ষিণ পশ্চিম নাইজেরিয়া উরুবা অঞ্চলের ভিতর দিয়ে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়েছে। পুরাণে বর্ণিত নদী ওসুন পরবর্তীতে নারীতে রূপান্তরিত  হয়েছে।

উরুবা পুরাণানুসারে, দেবী ওসুন ও দেবী  ইয়েমজা সহোদরা । সৃষ্টির সূচনা থেকেই ওসুন নদী শাসন করতেন না। তিনি ওলোডুমারে ( পুণ্য ও নৈতিকতার দেবতা)   দ্বারা সৃষ্ট।  এই দেবতা  নির্মিত সব কিছুই  ভালোবাসা এবং মাধুর্য বর্জিত ছিলো। সেই অভাববোধ করতে সৃষ্ট হলেন  ওসুন। ওড়িশার সকল  দেবতারা ওসুনের সৌন্দর্যের কারণে  তাকে  অনুসরণ করতেন। একদিন ওগুনের ( লৌহ, ধাতু এবং ধাতব কর্মের  দেবতা)  তাড়নায় ওসুন নদীর জলে  পড়ে যান । জলের ঘূর্ণিতে পাক খেতে খেতে অতলে তলিয়ে যেতে থাকেন তিনি।  সেই বিপদ থেকে ইয়েমজা তাঁকে রক্ষা করেন  এবং পৃথিবীর সকল নদীর আধিপত্য প্রদান করেন ওসুনকে।  তিনি নিজে হয়ে ওঠেন সাগর সম্রাজ্ঞী।  এরপর থেকে দুই বোন ইয়েমজা এবং ওসুন হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে থাকেন।  ভালোবাসা এবং কামনায় ভুলিয়ে রাখেন ওসুন এবং ইয়েমজা মাতৃত্ব, বাৎসল্য, সন্তান  রক্ষা করেন।  মজার ব্যাপার হলো, মানব  জীবনে প্রথমে উপলব্ধ  হয় ভালোবাসা তারপর কামনা, বিবাহ এবং  তারপর আসে সন্তান, মাতৃত্বের ধারণা । মিশরীয় আইসিস, গ্রীক ডায়নার মতো ওসুন  প্রেম, অসুস্থতা নিরাময়, উর্বরতা রক্ষা করেন ।

উরুবা জাতির এক  উপেক্ষিতা দেবী ওবা বা ওবা নানি। তিনি সংগ্রাম, পুনরুদ্ধার, নমনীয়তার দেবী। ওবার প্রতীক জল। ছবিতে দেখা যায় অস্ত্র হাতে তিনি বীরাঙ্গনার ভূমিকায় অবতীর্ণ।  নাইজেরিয়ার উরুবা এবং সান্টারিয়ানদের ( ইস্রায়েলের বাইরে বসবাসকারী ইহুদি যারা ১৯ শতকে কিউবায় বিস্তার লাভ করে)    নদীর দেবী ওবা সময় এবং জীবন প্রবাহকে প্রতিনিধিত্ব করে। জীবন ধারার  সাথে মানুষকে এগিয়ে চলতে হয়। জলধারাও প্রবাহমান। জাম্বিয়ার একটি বিশেষ দিন "কওম্বোকা"। এর অর্থ 'জল থেকে উঠে আসা'। প্রতিবছর  বন্যার কারণে এইদিন  স্থানীয় অধিবাসীরা  সমতল থেকে উচ্চভূমিতে যায়। উরুবাদের বিশ্বাস, দেবী ওবা সকলকে রক্ষা করবেন।  ওসুন ও ওবাকে নিয়ে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে।  স্যাঙ্গো হলেন উরুবাদের বজ্রের দেবতা, খানিকটা আমাদের দেবরাজ ইন্দ্রের মতো। একবার দেবী ওসুন ওবাকে কে জানান, তাঁর  রান্নার একটি বিশেষ পদ স্যাঙ্গোর ভীষণ প্রিয়। সেটি নিজে হাতে করে স্বামীকে খাওয়ালে দেবতা স্যাঙ্গো  ওসুনের মতো তাকেও ভালোবাসবেন। কথাটা শুনেই ওবা কৌতুহলী হয়ে পরেন। ওসুন তাঁর কান দুটি ছিঁড়ে রান্নায় দেওয়ার অভিনয় করেন। ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে একই পদ্ধতি অবলম্বন করে ওবা রান্না করেন। ঘরে ফিরে স্যাঙ্গো খেতে বসতেই বিষয়টি তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়। ওসুনের চাতুরী সম্বন্ধে অনবগত  স্যাঙ্গো তিরস্কার করে ওবাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দেন। কাহিনিতে দুই স্ত্রীর কলহ আসলে রূপক। এর আড়ালে রয়েছে নদীর সংঘর্ষের কথা। মানচিত্রে দেখা যায়,  আফ্রিকার উত্তরে  সাভানা তৃণভূমি থেকে দক্ষিণে বৃষ্টি অরণ্য পর্যন্ত প্রবাহিত ওবা   নদীর জল চাষআবাদ এবং মাছ চাষের কাজে ব্যবহৃত হয়।
 

 আগেই বলেছি দেবতা স্যাঙ্গোর কথা। উরুবা জনজাতির পুরাণ অনুযায়ী বজ্রদেবতা স্যাঙ্গোর তিনজন স্ত্রী। ওসুন, ওবা ও ওয়া। ইতপূর্বে দুই দেবী ওসুন ও ওবার  বিষয়ে আলোচনা করেছি। এবার আসি তৃতীয় স্ত্রী ওয়ার কথায়। দেবী ওয়া বাতাস, ঝড়, বিদ্যুৎ এবং বিধ্বংসি তুফানের দেবী।  " O ya " শব্দের অর্থ " যিনি  সব ছিঁড়ে ফেলেন"। নাইজের নদীর রক্ষয়িত্রী দেবী ওয়া। তাঁর প্রতীক  আগুন এবং জল। আচ্ছা, আগুন এবং জলের সহাবস্থান তো অসম্ভব তাই না? তবে উভয়ই যেমন একদিকে জীবন, উর্বরতা, সৃষ্টিশীলতা এবং সংস্কৃতি, সভ্যতার প্রতীক অপরদিকে  এগুলি ক্ষয়, মৃত্যু,  ধ্বংসকে চিহ্নিত করে। মজার বিষয় হলো অগ্নি শিখা জল দ্বারা নির্বাপিত হয় আর আগুনের তাপে  জল ফুটন্ত অবস্থায় পৌঁছায়। দুটি বিপরীত শক্তি অথচ দুয়ে মিলে যাদু সৃষ্টি করতে পারে। ওয়া এক  দেহে দুই বৈশিষ্ট্যের সমাহার। 

 জল   সম্ভাবনা, তরলতা এবং সৃষ্টির ধারক। 

বেদানুসারে  জল সৃষ্টির স্তম্ভ। ঋকবেদের পরবর্তী অংশ থেকে জানা যায়,  গঙ্গা এবং যমুনা যেখানে মিলিত হয় সেখানে যারা   স্নান করে তাদের স্বর্গ লাভহয়। 

এর ব্যতিক্রমে একটি ঘটনা বলে আলোচনা শেষ করবো। নারীর এতো মর্যাদার পাশাপাশি উরুবা জনজাতির পালিত একটি উৎসব সম্পূর্ন নারী বর্জিত।  ১৯৯৯  সালের জুলাই মাসে আফ্রিকার  সংবাদপত্রের একটি খবর মানুষদের আতঙ্কিত করে তোলে। উরুবা গোষ্ঠী ও   হাউসা গোষ্ঠীর সংঘর্ষে নিহত হয় বহু মানুষ।  উরুবার  "ওরো উৎসব" চলাকালীন  এক  রাতে  বাড়ির বাইরে থাকা একজন হাউসা মহিলাকে হত্যা করেন কয়েকজন উরুবা। 

জানা যায়,   লাগোসের প্রায় আশি  কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত সাগামু শহরে কমপক্ষে ছেষট্টি জন নিহত হয়।   উরুবা গোষ্ঠীর  অভিযোগ,     শনিবারের  রাতে তাদের  'ওরো' উৎসবের সময় উক্ত  হাউসা মহিলাটি  স্থানীয় ঐতিহ্যকে উল্লঙ্ঘন করেছিলেন। এই হত্যার পর  হাউসা সম্প্রদায়ের সদস্যরা প্রতিশোধ নেয় , যার ফলে শুরু হয় মৃত্যু ও ধ্বংসের লীলা। আসলে ওরো   উৎসব চলাকালীন 'হোম-অ্যাট-হোম অর্ডার' নিয়ম বলবৎ থাকে মহিলাদের জন্য। উরুবাদের মতে, ওরো উৎসব এর সময় কোনো মহিলা বাড়ির বাইরে থাকলে বা উৎসব এর আচার আচরণ দেখলে দেবতা রুষ্ট হয়ে মৃত্যুদন্ড দেন।

তবে, সে যাই হোক, উরুবা গোষ্ঠীর নদী ও নারীর গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। নদীর শীতলতা এবং নারীর স্নেহের ছায়া বঞ্চিত নয় উরুবা পুরাণে। অসংখ্য বীর, বলশালী দেবতাদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন উরুবা দেবী সৃষ্টিকে ধারণ করে রেখেছেন।