বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতি ও মধ্যযুগের সাহিত্য

বাঙালির জাতিসত্ত্বায় মিশে আছে নিরন্তর খাইখাইপনা আর উৎসবপ্রিয়তা। ভোজবাড়িতে হুলুস্থুল কান্ড কখন যেন তার একান্ত ভালোলাগায় পরিণত হয়েছে। অতীত ইতিহাস ঘেঁটে চর্যাপদের যুগে "হাড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশী" বঙ্গালি দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর, খাদ্য আন্দোলন, লকডাউন পেরিয়ে গ্লোবাল বং হয়েছে। সেই ছাপ পড়েছে তার প্রাত্যহিক খাদ্যাভ্যাস থেকে ভোজবাড়ির আয়োজন সর্বত্র। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে বা বসে নেমন্তন্ন রক্ষা বা উপভোগ করার ব্যাপার স্যাপার সবারই জানা। বাঙালি কবি তাই অবলীলায় লেখেন -

"খাই খাই কর কেন, এস বস আহারে-

খাওয়াব আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে ।

যত কিছু খাওয়া লেখে বাঙালির ভাষাতে,

জড় করে আনি সব, -থাক সেই আশাতে ।

ডাল ভাত তরকারি ফলমূল শস্য,

আমিষ ও নিরামিষ, চর্ব্য ও চোষ্য,

রুটি লুচি, ভাজাভুজি, টক ঝাল মিষ্টি,

ময়রা ও পাচকের যত কিছু সৃষ্টি,

আর যাহা খায় লোকে স্বদেশে ও বিদেশে-

খুঁজে পেতে আনি খেতে- নয় বড় সিধে সে !"

ইতিহাস শতকের হাত ধরে চলুন ঘুরে আসা যাক কয়েক শতকের পুরনো বাংলায়।

মধ্যযুগীয় বাঙালির নবজাগরণের প্রতিভূ শ্রীচৈতন্যদেব একান্তই ভোজনবিলাসী ছিলেন। নিরামিষাশী এই ভক্তহৃদিরঞ্জন মানুষটিকে ঘিরে তাঁর অনুগামীদের নিত্য উৎসব আর আনন্দের ভোজ লেগেই থাকত।কাটোয়ার কেশবভারতীর কাছে সন্ন্যাস গ্রহণের পর তিনি রাঢ় অঞ্চল পরিক্রমা করে শান্তিপুরে অদ্বৈত আচার্যের বাড়িতে যান।মহাপ্রভুর উপবাস ভঙ্গের যে আয়োজন অদ্বৈতাচার্য করেন তাতে পূর্বাশ্রমে বিশ্বম্ভর মিশ্র যা খেতে পছন্দ করতেন তেমন পদ যেমন মোচার ঘন্ট,শুক্তো, বিবিধ শাক,নিম,লাবড়া,ছানাবড়া,  ভাজা,ক্ষীরপুলি, মাষকলাই বড়া,কলার বড়া  লাউয়ের পায়েস ইত্যাদি নানা পদের উল্লেখ পাওয়া যায়।

"পীত – সুগন্ধি ঘৃতে অন্ন সিক্তকৈল ।

চারিদিগে পাতে ঘৃত বাহিয়া চলিল ।।

কেয়াপত্র – কলার খোলা – ডোঙ্গা সারি সারি ।

চারি দিগে ধরিয়াছে নানা ব্যঞ্জন ভরি ।।

দশ প্রকার শাক , নিম্ব – সুকুতার ঝোল ।

মরিচের ঝাল , ছানা বড়া , বড়া ঘোল ৷৷

দুগ্ধ তুম্বী , দুগ্ধ কুষ্মাণ্ড , বেসরি , লাফরা ।

মোচাঘণ্ট , মোচাভাজা , বিবিধ শাকরা ।।

বুদ্ধ কুষ্মাণ্ড বড়ীর ব্যঞ্জন অপার ।

ফুল বড়ী ফল মূলে বিবিধ প্রকার ।।

নব – নিম্ব প্রত্রসহ তৃষ্ট – বাৰ্তাকী ।

ফুলবড়ী , পটোল – ভাজা , কুষ্মাণ্ড মানচাকী ।।

ভৃষ্ট – মাষ , মুদগা – সুপ অমৃতে নিন্দয় ।

মধুরান্ন , বড়াম্নাদি অম্ল পাঁচ ছয় ।।

মুগ বড়া , মাষ বড়া , কলাবড়া মিষ্ট ।

ক্ষীরপুলী , নারিকেল – পুলী আর যত পিষ্ট ।।

কাঞ্জি বড়া , দুগ্ধচিঁড়া , দুদ্গ – লকলকী ।

আর যত পিঠা কৈল , কহিতে না শকি ।।

ঘৃতসিক্ত পরমান্ন , মৃৎকুণ্ডিকা ভরি ।

চাঁপাকলা – ঘন দুগ্ধ – আম্র তাহা ধরি ।।

রসালা – মথিত দধি , সন্দেশ অপার ।

গৌড়ে উৎকলে যত ভক্ষ্যের প্রকার ।। ” —শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ ।। ( শ্লোক ২০৮-২১৮ )

শ্রীচৈতন্য যখন পুরুষোত্তমপুর বা পুরীতে যান তৎকালীন ঊড়িষ্যার রাজসভার পন্ডিত বাসুদেব সার্বভৌমের বাড়িতে তার জন্য সপার্ষদ এক বিশেষ ভোজসভার আয়োজন করা হয়েছিল।

কৃষ্ণদাস কবিরাজ বিবরণ  দিয়েছেন—

“ বত্রিশ কলার এক আঙ্গেটিয়া পাত,

তিন মান তণ্ডুল তাতে ধরে ভাত।

মধ্যে পাত ঘৃত সিক্ত শাল্যন্ন স্তূপ ।

চারিদিকে ব্যঞ্জন ডোঙ্গা আর মুগসূপ ।।

বাস্তুক শাক পাক বিবিধ প্রকার ।

পটল কুষ্মাণ্ড বড়ী মানকচু আর ।।

চই মরিচ শুক্তা দিয়া সব ফলমূলে ।

অমৃত নিন্দুক পঞ্চবিধ তিক্তঝালে ।।

কোমল নিম্ব পত্র সহ ভাজা বার্তাকী ।

ফুলবড়ী ভাজা আর কুষ্মাণ্ড মানচাকী ।।

নারিকেল শস্যছানা শর্করা মধুর ।

মোচাঘণ্ট দুগ্ধ কুষ্মাণ্ড সকল প্রচুর ।।

মধুরাম্ল বড়াম্লাদি অম্ল পাঁচ ছয় ।

সকল ব্যঞ্জন কৈল লোকে যত হয় ।।

মুগবড়া মাসবড়া কলাবড়া মিষ্টান্ন ।

ক্ষীরপুলি নারিকেল যত পিঠা ইষ্ট ।।

সঘৃত পায়স মৃৎকুণ্ডিকা ভরিয়া ।

তিনপাত্রে ঘনাবর্ত দুগ্ধ রাখে তো ধরিয়া ।।

দুগ্ধ চিড়া কলা আর দুগ্ধ লকলকি ।

যতেক করিল তাহা কহিতে না শক্তি ।।”

পাণিহাটির রাঘব পন্ডিতের আলয়ে তার আগমন উপলক্ষ্যে যে মহাভোজ অনুষ্ঠিত ছিল তার খাদ্যতালিকা ছিল অতি সাধারণ। কৃষ্ণদাস কবিরাজের "চৈতন্যচরিতামৃত" বইতে এর উল্লেখ পাওয়া যায় -

"সেইক্ষণে নিজ লোক পাঠাইয়া গ্রামে,

ভক্ষ‍্য দ্রব্য লোক সব গ্রাম হতে আনে।

চিড়া, দধি, দুগ্ধ, সন্দেশ আর চিনি-কলা,

সব দ্রব্য আনাইয়া চৌদিকে ধরিলা।"

..……

এক ঠাঁই তপ্ত দুগ্ধে চিড়া ভিজাইয়া

অর্ধেক ছানল দধি, চিনি-কলা- দিয়া।

( চৈতন্যচরিতামৃত,অন্ত‍্য – ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ)

উল্লেখ্য যে বঙ্গদেশে সন্দেশের প্রচলন ও পূজার নৈবেদ্যতে তার ব্যবহার শ্রীচৈতন্যদেব সম্ভবত প্রচলন করেন।তার আগে দুধ কাটিয়ে ছানা তৈরী হলেও তা থেকে সন্দেশ তৈরী করা হত না।

কথিত আছে তার উদ্যোগেই বৈষ্ণবভোজনে খিচুড়ির প্রচলন ঘটে।চাল,ডাল,আলু সহযোগে সহজপাচ্য এই খাবার তার খুব প্রিয় ছিল।বহু মানুষের সমাবেশে এমন জিনিস রান্না ও পরিবেশন দুটোই অল্প পরিশ্রম করা সম্ভব।শ্রীচৈতন্য ব্রাক্ষণ্যবাদী অচলায়তনকে ভেঙে জাতির বিচার না করে ভক্তিরসের প্রচার ও প্রসার  করেছিলেন।এখনো অনেক ব্রাক্ষণবাড়িতে পুজোর ভোগে শুধুমাত্র খিচুড়ি নিবেদন করা হয় না কারণ পাঁচশো বছর আগে তার জাত-ধর্ম-বর্ণ জনিত কৌলিন্য খোয়া গিয়েছে।

মঙ্গলকাব্যের ধারার কবি বিজয়গুপ্ত,দ্বিজবংশীদাসের রচনায় বিবিধ মাছ রান্নার বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়।মনসামঙ্গল কাব্যের পাতায় পাতায় মিশে আছে মাছ খাওয়ার আড়ম্বর আর আনন্দ। বাংলার জলাভূমি জুড়ে ছিল মাছ আর ক্ষেতে ছিল সোনার ফসল ধান।তাই মাছে ভাত ছিল বাঙালির দৈনন্দিন ও  উৎসব অনুষ্ঠানের মূল খাদ্য।

মনসামঙ্গল কাব্যে কবি বিজয়গুপ্ত লিখেছেন –

মৎস্য মাংস কাটিয়া থুইল ভাগ ভাগ।

রোহিত মৎস্য দিয়া রান্ধে কলতার আগ। ।

মাগুর মৎস্য দিয়া রান্ধে গিমা গাচ গাচ।

ঝাঁজ কটু তৈলে রান্ধে খরসুল মাছ।।

 ভিতরে মরিচ গুঁড়ো বাহিরে জুড়ায় সুতা।

তৈলে পাক করিয়া রান্ধে চিংড়ির মাথা।।

 ভাজিল রোহিত আর চিতলের কোল।

কৈ মৎস্য দিয়া রান্ধে মরিচের ঝোল।।

ডুম ডুম করিয়া ছেঁচিয়া দিল টই।

ছাইল খসাইয়া রান্ধে বাইন মৎস্য টক।।

মাগুর,খরসুল,বাইন এসব মাছ এখন প্রায় বিলুপ্ত হলেও খাল বিলে এদের স্বাভাবিক বসতি সেসময় ছিল।

দ্বিজবংশীদাসও তাঁর মনসা মঙ্গলকাব্যে বলেছেন

"মেস্যর ব্যঞ্জন রান্ধে তৈল পাক দিয়া

বড় বড় কই মৎস্য, ঘন ঘন আঞ্জি

জিরা লঙ্গ মাখিয়া তুলিল তৈলে ভাজি।

কাতলের কোল ভাজে, মাগুরের চাকি।

চিতলের কোল ভাজে রসবাস মাখি

ইলিশ তলিত করে, বাচা ও ভাঙ্গনা।

শউলের খণ্ড ভাজে আর শউল পোনা

বড় বড় ইচা মৎস্য করিল তলিত।

রিঠা পুঠা ভাজিলেক তৈলের সহিত

বেত আগ পলিয়া চুঁচরা মৎস্য দিয়া।

শক্ত ব্যঞ্জন রান্ধে আদা বাটিয়া

পাবদা মৎস্য দিয়া রান্ধে নালিতার ঝোল।

পুরান কুমড়া দিয়া রোহিতের কোল…"

ইলিশ  মাছ সময়ের সাথে সাথে তার মহার্ঘ্যতা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হলেও প্রায় হারিয়ে গেছে বাচা,ভাঙ্গনা,রিঠা ইত্যাদি মাছ।একই সাথে হারিয়ে গেছে পাট শাক দিয়ে পাবদা মাছ,কুমড়ো দিয়ে রুই মাছ এসব মাছের পদ।

কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী রচিত চন্ডীমঙ্গলে এক মহাভোজের বিবরণ পাওয়া যায় যেখানে দেবীর আদেশে লহনা নির্বাসিতা খুল্লনাকে বাড়ি ফিরিয়ে এনে পঞ্চাশ ব্যঞ্জনে তাকে আপ্যায়িত করেন।বাঙালির মাছপ্রীতির এ এক  অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন।

চণ্ডীমঙ্গলের কবি মুকুন্দরাম লিখছেন -

"কটু তেলে রান্ধে রামা চিতলের কোল।

রুহিতে কুমুড়া বড়ি আলু দিয়া ঝোল।।

কটু তেলে কই মৎস্য ভাজে গণ্ডা দশ।

মুঠি নিঙারিয়া তথি দিলা আদারস।।

বদরি শকুল মীন রসাল মুশুরি।

পণ চারি ভাজে রামা সরল-সফরি।।

কতগুলি তোলে রামা চিংড়ির বড়া।

ছোটছোট গোটা চারি ভাজিল কুমুড়া।।"

চিতল,রুই,কই,পুঁটি(সফরি),শকুল(শোল),চিংড়ি এসব মাছ রান্নায় পেয়াঁজ রসুনের ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায় না।হুসেন শাহী যুগের পরবর্তী সময়ে মাংস খাওয়ার ব্যাপক প্রচলনের সাথে সাথে মাছ, সবজি রান্নাতে পেঁয়াজ,রসুনের ব্যবহার শুরু হয়।আমিষ হিসেবে পরিগণিত পেয়াঁজ,রসুন আর মসুর ডাল আমিষ হিসেবেই গন্য করা হত।বাংলায় মুসলমান শাসনের সাথে সাথে খাদ্যাভ্যাসেও বেশ কিছু পরিবর্তন এল।রমজান মাসের ইফতারি,ঈদের সেমাই,গোস্ত ক্রমশ জায়গা করে নিল। আর নির্বাসিত  নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের হাত ধরে বিরিয়ানির বাংলা বিজয়ের কাহিনী সবারই জানা।

মঙ্গলকাব্যের ধারার শেষ কবি ভারতভন্দ্র রচিত "অন্নদামঙ্গল" কাব্যে ভবানন্দ মজুমদারের স্ত্রী পদ্মমুখীর ব্রাক্ষ্মণ ভোজনের যে অনুষ্ঠান আয়োজন করেন তার খাদ্যতালিকা নিম্নরূপ।

"নিরামিষ তেইশ রাঁধিলা অনায়াসে

আরম্ভিলা বিবিধ রন্ধন মৎস্য মাসে।

কাতলা ভেটুক কই কাল ভাজা কে

শিক-পোড়া ঝুরি কাঁঠালের বীজে ঝোল।

ঝাল ঝোল ভাজা রান্ধে চিতল ফলুই

কই মাগুরের ঝোল ভিন্ন ভাজে কই।

ময়া সোনা খড়কীর ঝোল ভাজা সার

চিঙ্গড়ির ঝোল ভাজা অমৃতের তার।

কণ্ঠা দিয়া রান্ধে কই কাতলার মুড়া

তিত দিয়া পচা মাছ রান্ধিলেক গুড়া।

আম দিয়া ষোল মাসে ঝোল চড়চড়ি

আড়ি রান্ধে আদারসে দিয়া ফুলবড়ি।

রুই কাতলার তৈলে রান্ধে তৈল শাক

মাছের ডিমের বড়া মৃতে দেয় ডাক।

বাচার করিল ঝোল খয়রার ভাজা

অমৃত অধিক বলে অমৃতের রাজা

সুমাছ বাছের বাছ আর মাস যত

ঝাল ঝোল চড়চড়ি ভাজা কৈল কত।

বড়া কিছু সিদ্ধ কিছু কাছিমের ডিম

গঙ্গাফল তার নাম অমৃত অসীম"

লক্ষ্যণীয় এই যে সে সময়ের ব্রাক্ষ্মণ সমাজে মাছ,মাংস খাওয়ার প্রচলন ছিল।ভবদেব তাঁর "প্রায়শ্চিত্ত প্রকাশ " গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে পঞ্চনখ প্রাণীদের মধ্যে গোধা,শশক,সজারু ও কচ্ছপ ভক্ষ্য ছিল।একই সাথে হাঁস,মুরগী,বক,সারস,দ্যতূহ পাখী,উট,শূকর, গরু প্রভৃতি ব্রাক্ষ্ণণশাসিত সমাজে একেবারে অভক্ষ্য হিসেবে উল্লিখিত হওয়ায় মনে হয় যে এগুলি মুলত অন্ত্যজ শ্রেণীর লোকেরা খেতেন।শ্রীহর্ষ রচিত "নৈষধ চরিত" গ্রন্থে নল ও দময়ন্তীর বিবাহ উৎসবের খাদ্য তালিকায় হরিণ,ছাগ ও বিভিন্ন পক্ষী মাংসের উল্লেখ পাওয়া যায়।

 অষ্টাদশ  শতকের কলকাতার ভোজবাড়ির আয়োজন কেমন ছিল তার সুনিপুণ বর্ণণা দিয়েছেন মহেন্দ্রনাথ দত্ত। ব্রাক্ষ্মণ বাড়ি ছাড়া অন্য কোন শ্রেণীর অনুষ্ঠনে ভাতের ব্যবস্থা ছিল না।একমাত্র ব্রাক্ষ্মণ বাড়িতেই সবাই ভাত খেতে পারেন এই ছিল তার কারণ।অপরদিকে কায়স্থ,শুদ্র গৃহস্বামী আয়োজন করতেন লুচি,মিষ্টি ও ফলারের।লুচি,কচুরি,পটল ভাজা,কুমড়ো ছক্কা,বেগুনভাজা,ছোলার ডাল,পাঁপড় ভাজা,চাটনি এই হতো মূল আয়োজন।তখনো আলুর ব্যবহার ব্যাপক ভাবে শুরু হয় নি।এসময়ে কোন ব্যঞ্জন রান্নায় লবণ দেয়া হত না। লবণ দিয়ে রান্না করা খাবার উচ্ছিষ্ট তাই পাতে নুন দেয়া হত।এরপরে আসত মিষ্টির সরা।একটি সরায় পেরাকি,খাজা,গজা,মতিচুর,জিলাপি,পান্তুয়া প্রভৃতি মিষ্টি ও আরেকটি সরায় আতা,মনোরঞ্জন,ক্ষীরপুলি, পেঁড়া,সন্দেশ, বরফি,গুঁজিয়া,গোলাপজাম ইত্যাদি ছানা ও ক্ষীরের মিষ্টির ব্যবস্থা হত।

"তপ্ত তপ্ত তোপসে মাছ গরম গরম লুচি

অজ-মাংস,বাঁধাকপি আলু কুচি কুচি।

শীতের দিনে এসব যদি খাবে হাতা হাতা,

….নম্বর পদ্মপুকুরে শীঘ্র এসো বাবা"

সেকালের বিখ্যাত কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এই চিঠি লিখে জামাইষষ্ঠীর ভোজের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।গোধূম বা গম জাত আটার ব্যবহার বাদশাহি যুগ থেকে বহুল প্রচলিত হয়েছে বলে ঐতিহাসিকরা মনে করিয়েছেন।যদিও

ময়দার ব্যবহার বাঙালি জীবনে এসেছে পর্তুগীজদের হাত ধরে।লুচি,কচুরী,পুরীর রমরমা তার পরবর্তী সময় থেকেই দেখা যায়।

একই সাথে রমজান মাসের রোজা শেষে সন্ধেবেলা ইফতারের কাবাব,ভাজাভুজি ইত্যাদির বিপুল আয়োজনও মোগল যুগের অবদান।আওরঙ্গজেব ও বাহাদুর শাহ জাফরের সময় থেকেই মোগল রাজদরবারের খাবার সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হতে শুরু করে।শিরমাল,জিলিপি তার আগে এত বহুল প্রচলিত ছিল না।হেকিম হাবিবুর রহমান বা মীর্জা নাথানের বর্ণণায় পাওয়া যায় শরবত,নান,কাবাব,কোফতা,কোরমা,বিরিয়ানি,নমকপারা,সমুচা বাংলার নবাবদের ইফতারের ভোজসভার অন্যতম পদ ছিল।আমজনতা রুটি আর চটপটিতে রোজা ভাঙলেও উচ্চবিত্ত সমাজে প্রচলিত ছিল নানখাতাই, তাফতান(বাদাম ও সুগন্ধি দিয়ে তৈরী করা নান)ইত্যাদি বাহারি খাবার।শিক কাবাব,মুর্গা মুসল্লম,শামি কাবাব,টিক্কা কাবাব,তাস কাবাব,হান্ডি কাবাবের মতো এখনকার জনপ্রিয় খাবারের গোড়া পত্তন সেই যুগেই হয়েছিল। রমজানে সিন্ধ্রি বিরিয়ানি, লক্ষ্ণৌইয়া বিরিয়ানি, তেহারি ও মোরগ–পোলাও ঢাকার নবাবরা যে খেতেন  তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৬৩৯ সালে তিনশত শিয়া পরিবার শাহ সুজার হাত ধরে ঢাকায় আসে। তাদের মাধ্যমেও নানা ধরনের বিরিয়ানি ও পোলাও এ অঞ্চলে ব্যাপক প্রসারতা লাভ  করে(যদিও পুষ্পান্ন বা পোলাও মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব ভোজনের অন্যতম আকর্ষণ ছিল)

 বিরিয়ানির প্রচলন বা মাংস মিশ্রিত পোলাওয়ের প্রচলন এর আগে ছিল না। খোরাসানি পোলাও ছিল একটি  অন্যতম সুখাদ্য যার বৈশিষ্ট্য ছিল তার সুঘ্রাণ, এক বাড়িতে এ পোলাও রান্না হলে পুরো পাড়ায় তার খোশবাই ছড়ি পড়ত।

এছাড়া দুধ, মধু, কিশমিশ ও মাওয়া দিয়ে রমজান মাসে শির বেরেঞ্জ নামে বিশেষ একটি খাবার রান্না  করা হতো। সেকালে রোজার সময় সবচেয়ে বেশি বৈচিত্র্য ছিল শরবতে। একেক ধরনের বাদাম দিয়ে তৈরি হতো একেক ধরনের শরবত। আর এসব শরবতে দেওয়া থাকত জাফরান আর দামি সুগন্ধি।

"ঢাকা পুরাণ" বইয়ে মীজানুর রহমান গত শতকের পুরনো ঢাকার ইফতারির তালিকায় যেসব খাবারের নাম উল্লেখ করেছেন,তার মধ্যে কাবাবের সংখ্যাই  বেশি। তখন চকবাজারে ছিল কাবাবের সমাহার। সুতি কাবাব, শামি কাবাব, নার্গিস কাবাব, খিরি কাবাবসহ হরেক রকম সুলভ মূল্যের কাবাব ছিল, যা ধনী–গরিব—সবারই প্রিয় ছিল। তবে ছোটদের কাছে বেশি জনপ্রিয় ছিল কচুরি, খাজলা, গজা, দইবড়া। এসবের সঙ্গে থাকত ডাল পিষে বানানো গরম গরম ফুলুরি।

বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে কোন ভোজই সম্পূর্ণভাবে দেশি,মোগলাই,চাইনিজ বা সাহেবি এমন ফলক সেঁটে দেয়া যায় না।ভুবনায়নের বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক অভিঘাতে ভোজসভার সামাজিক গুরুত্ব ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।শুধুমাত্র অর্থের বিনিময়েই ভোজসভার যাবতীয় পদ এখন ঘরে বসেই উপভোগ করা যায়।পরিবার ছোট হয়ে আসছে।যৌথ পরিবারের হেঁসেলের  চচ্চড়ি, বাটা,শাক,শুক্তো,ভর্তা খেতে এখন ক্লাউড কিচেনই ভরসা।যদিও রান্নাঘরের,ভাঁড়ারের দায় এবং দায়িত্ব দুটোই এখনো মেয়েদের হতেই।বাড়ির বাইরে যেসব মেয়েরা কাজ করেন বা যারা বাড়িতে থেকেই রোজগার করার জন্য কাজ করেন বা যারা  বেকার তাদের সবার ক্ষেত্রেই এই দায়িত্ব ইচ্ছাধীন নয়। শুধুমাত্র দ্বিতীয় লিঙ্গ হওয়ার কারণেই মহিলাদের এই কাজ করে যেতে হয়।ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের ইন্দুবালা  রান্নায় তার দেশজ স্বত্তা ধরে রেখে চুঁইঝালের রান্না,হলুদ গালা চিংড়ির ঝোল,আম কই, কুমড়ো ফুলের বড়াতে যে নারীত্ব নির্মাণ করেছেন তা আংশিক।নিজের জন্মস্থানের প্রতি ভালোবাসায়,সন্তানের দায়িত্বে, কৈশোরের প্রেমের সম্পর্কের আবেগ প্রতিস্থাপনে তার চরিত্রে যে সম্পূর্ণতা এসেছে তাকে শুধুমাত্র নারীত্বের ব্যঞ্জনায় ধরা যায় না।

"ওগ্গরভত্তা রম্ভঅপত্তা, গাইকঘিত্তা দুগ্ধসজুত্তা।

মইলিমচ্ছা নালিতগচ্ছা, দিজ্জই কন্তা খায় পুণবন্তা।"

‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’ থেকে উদ্ধৃত এই শ্লোকে বলা হয়েছে যে সেই পুরুষ পুণ্যবান যার স্ত্রী কলাপাতায় গাওয়া ঘি সহযোগে গরম ভাত,মৌরালা মাছের ঝোল,পাট শাক,সফেন গরম দুধ পরিবেশন করেন।বাঙালির খাবারের ইতিহাসে মেয়েদের স্থান মূলত রান্নাঘরে।অবস্থাপন্ন ঘরের মহিলারা যদিও আর্থিক স্বাচ্ছল্যের কারণে বামুনবৌ বা পাচক ঠাকুরের শ্রমের ফসল ভোগ করেছেন।সলিল চৌধুরীর সুরে অন্তরা চৌধুরীর গাওয়া "ছোটদের গান" সংকলনের জনপ্রিয় একটি গানের ( চন্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত) কবিতার কথা এরকম

"ছি- ছি- ছি- ছি

রানি রাঁধতে শেখেনি !

জ্যাঠাইমাকে বলে,

ঝোলে মশলা দেব কি ?

শুক্তানিতে ঝাল দিয়েছে,

অম্বলেতে ঘি !

ছি -ছি -ছি -ছি

রানি রাঁধতে শেখেনি !

পরমান্ন রেঁধে বলে,

ফ্যান গালব কি ?

ভোজবাড়িতে খোঁজ পড়েছে,

এখন উপায় কী ?

ছি- ছি - ছি - ছি

রানি রাঁধতে শেখেনি !"

রাঁধতে শেখা যে মেয়েদের আবশ্যিক কর্তব্য তা শিশুমনে প্রোথিত করার এমন যথোপযুক্ত উদাহরণ আর কীই বা হতে পারে।

বাঙালির খাবারের ইতিহাসে মেয়েদের স্থান মূলত রান্নাঘরে।অবস্থাপন্ন ঘরের মহিলারা যদিও আর্থিক স্বাচ্ছল্যের কারণে বামুনবৌ বা পাচক ঠাকুরের শ্রমের ফসল ভোগ করেছেন।বিভিন্ন জেলায় ভোজবাড়িতে রান্নার দায়িত্ব এখনো মেয়েরাই দায়িত্ব সহকারে সামলান।তবে ভোজবাড়িতে মেয়েরা পুরুষের সাথে ভিন্ন পংক্তিতে বসে খাচ্ছেন এই ছবির সেপিয়া রঙ এখনো বেশ উজ্জ্বল।গার্হস্থ্য অভ্যাসের কারণেই সেখানেও পুরুষের জন্য উৎকৃষ্ট তুলে রেখে তারপর মেয়েদের ভোজের ব্যবস্থা যেখানে ঘরের মহিলারাই পরিবেশন করতেন। বরং মেয়েলি ব্রতের উদযাপনেই মেয়েদের একান্ত নিজস্ব ভোজের উদযাপন। আধপেটা খেয়ে যাদের দিন কাটে তেমন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত মেয়েদের কাছে নিরম্বু উপবাস খুব কষ্টসাধ্য নয়।এমন ব্রতের নিবৃত্তির খাবারও তাই আড়ম্বরহীন।"পথের পাঁচালী"র সর্বজয়া কুলুইচন্ডীর ব্রতের উদযাপনে কুন্ঠিত হয়েই ধনী বাড়ির মেয়েদের সামনে নিজের যৎসামান্য মটর ডাল বাটা আর কাঁঠালি কলা তার পুঁটলি থেকে বের করেন। মায়ের জন্য অপুর তাই মনকেমন করে।সন্তানের কল্যাণার্থে মায়ের এই ব্রত তাকে ঈশ্বরী পাটনীর চিরন্তন আকুতির কথা মনে করিয়ে দেয়।দুধেভাতে সন্তানকে রাখার প্রত্যাশী মা নিজেকে অভুক্ত রেখেই সন্তান আর পরিবারের মুখে আহার যুগিয়ে যান। নিরন্তর ভোজবাজির রোজনামচায় মায়ের নিজের হাতে তুলে দেয়া আমানি পান্তা আর লঙ্কাপোড়াও তাই মহার্ঘ্য হয়ে যায়।