কল্লোলের লেখিকারা

৮৮ বি হাজরা রোডের একটি বাড়িতে বুধবারের এক সকাল। তিরিশ জনের একান্নবর্তী পরিবারটির দুই বধূ সকাল থেকেই দ্রুত হাতে কাজ সারছেন। যেমন করেই হোক আজ দুপুরের মধ্যে সব কাজ শেষ হওয়া চাই । দুজনের মনেই চাপা আনন্দ, উদ্দীপনা। মাঝে মাঝে চোখের ইশারায় কথা হচ্ছে। মন খুলে দুটো কথা বলার সময়ই বা কোথায় ! কর্তাদের আপিসের ভাত, জলখাবার ,আত্মীয় কুটুম কখন কার কী প্রয়োজন, ডাক আসে, ছেলে মেয়েদের কান্নাকাটি, পেটরোগা ছেলেটির জন্য জিওল মাছের ঝোল হবে। দুধটা উনুনে বসানো । 

-দেখো তো বামুন দিদি...

হুড়মুড়িয়ে কাজের ফিরিস্তির একফাঁকে বড় বউ হাত ধরে কাছে টেনে আনে ছোটজনকে

-এদিকে আয় তো। কিছু ভেবেছিস ?

-আগের যা আছে একটু অদল বদল করতে হবে দিদি। তোমার?

- কাল একটা পুরোনো লেখা তোরঙ্গ থেকে বের করেছি । তার আগে এটা দেখ।

আষাঢ় শেষের বেলায় জল ভরা মেঘ ক্রমশ শহর কোলকাতার বুকে অনির্দেশ ছায়া ফেলে এগিয়ে চলেছে ভরা বাদলের আয়োজনে। তেল হলুদ ধোয়া হাত আঁচলে মুছে সন্তর্পনে কুলুঙ্গি থেকে বের করেন নিরুপমা চারভাঁজ করে রাখা কাগজটি আর তারপর ধীরে ধীরে তা মেলে ধরেন ছোট জা উমার সামনে ,

 

নিরুদি,‌‌                                                               ১১/০৭/১৯২১

‌‌

কাল কখন চলে গেলেন বুঝতে পারিনি। একটা কথা বলবার ছিল... একটা অনুরোধমাত্র। মুখে বললেই ভাল হ'ত যাক চিঠিতেই সেটা সেরে নিচ্ছি।

বুধবার আপনাকে কিছু পড়তে হবে। নিজের লেখা। 'না' বলবেন না। কারণ এইটেই আমাদের literary sec এর প্রথম অধিবেশন। সুনীতিদি পড়বেন। দীনেশকে এখনও বাগ মানাতে পারিনি। যে এক- বগগা ছেলে! উমা দেবীও আশা করি আমাদের অনুরোধ রাখবেন। সেদিন কিন্তু আমি কিছুই করব না। শুধু শুনব। কেমন ? একটা লোভ দেখিয়ে রাখি এইখানে। বুধবারে যদি আপনারা সবাই লক্ষ্মী ছেলেমেয়ের মত যা বললাম তা করেন, তাহলে এর পরের বারে লক্ষ্মী ছেলের মত আমিও আপনাদের হুকুম শুনব। নইলে নয়।

এ বিষয়ে সুনীতিদি আর উমা দেবীর সঙ্গে সব কথা বলে রাখবেন। এখনও সময় ঢের আছে। আপনার পুরান লেখা থেকেও কিছু বার করে পড়তে পারেন। আপনার লেখবার ক্ষমতা আছে।ওটা নষ্ট হ'তে আর দেবো না।

আপনারা আমার নমস্কার নিন। 

                               ইতি            

                                        শ্রী গোকুল চন্দ্র নাগ

 

 চিঠি পড়া শেষ হলে এক আশ্চর্য ভালোলাগায় ভাসতে থাকে দুই গৃহকর্ম নিপুণা বধূ। তাদের দৃষ্টি তখন সংসারের সীমানা ছাড়িয়ে এক সৃজন জগতের স্বপ্নের জালে জড়িয়ে পড়ছে। নিছক সেবাদানের হাত দুটি কালি, কলম আর সাদা পাতার আহ্বানে এগিয়ে যেতে চাইছে প্রবল আগ্রহে। সেই জলভরা মেঘ কত না ছায়ার জন্ম দেয়। কত রুদ্ধ, স্তব্ধ অতীত শান্ত পুকুরের জলের মৃদু আন্দোলনে কেঁপে ওঠে...সেদিনের সেই বুধবারের সকাল কোনো ইতিহাসের পাতায় নেই, ঠিক যেমন নেই সেই আশ্চর্য ক্ষণটি যখন দু'শ বছরেরও কিছু আগে 'রান্না ঘরের হেঁসেলের মধ্যে খোড়ীর নীচে' এক নারী লুকিয়ে রাখছেন 'চৈতন্যভাগবত' এর একখানা পাতা , সময় মতো ছেলের তালপাতায় লেখা বর্ণের সঙ্গে মিলিয়ে পড়বেন বলে।অথচ সেই ক্ষণেই হয়ত নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল তিনিই লিখবেন বাংলাভাষার  প্রথম আত্মজীবনীটি। বাংলাভাষায় মেয়েদের সাহিত্য চর্চার প্রসঙ্গে রাসসুন্দরী দাসীর কথা তাই না উল্লেখ করলেই নয়। ১৩০৩ সালে ৮৮ বছর বয়সে তিনি লিখছিলেন তাঁর জীবন কথা। ততদিনে নারী শিক্ষার প্রসার এবং মেয়েদের জন্য স্কুল কলেজ স্থাপিত হওয়ার অন্তঃপুরে কিছুটা আলো এসে পৌঁছেছিল। বিশেষতঃ ব্রাহ্ম সমাজের মেয়েরা এ বিষয়ে অগ্রণী ছিলেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বামাবোধিনী পত্রিকা এবং এডুকেশন গেজেটে প্রায়ই অনেক মহিলার রচনা প্রকাশিত হত তবে তাদের পরিচয় জানা যেত না সেভাবে। উনিশ শতকের শেষ দিকে গিরীন্দ্রমোহিনী দেবী, স্বর্ণকুমারী দেবী এবং কুসুমকুমারী দেবীর নাম এবং রচনা পাঠক পরিচিতি পায়। শুধু তাই নয় নানা সাময়িক পত্র পত্রিকা প্রকাশে মেয়েদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গে মোক্ষদাদায়িনী মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত 'বঙ্গমহিলা'(১৮৭০), জ্ঞানদানন্দিনীর 'বালক' (১৮৮৫) ,স্বর্ণকুমারীর 'ভারতী'( ১৮৭৭ সালে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশ হলেও এর মূল প্রেরণাদাত্রী ছিলেন কাদম্বরী দেবী। ১৮৮৪ সাল থেকে স্বর্ণকুমারীদেবী এটি  পরিচালনার ভার নেন)। সুতরাং সমাজের সর্বস্তরে না হলেও কিছুটা আলোকিত অংশে মেয়েদের লেখা ও সাহিত্য চর্চার কাজ বৃহত্তর নারীসমাজের কাছে প্রেরণা হয়ে ওঠে।

আমরা আবার ফিরে যাই সেই বিশেষ বুধবারটির কাছে। যে বুধবার বিকেল চারটে থেকে রাত আটটা পর্যন্ত দাশগুপ্ত বাড়ির বাইরের একটি ঘরে নারী পুরুষের সম্মিলিত কন্ঠে শোনা যাবে গান, সাহিত্য আলোচনা। এমন অসম্ভব ঘটনা তৎকালীন কলকাতার বুকে ঘটানোর ক্ষমতা যাদের ছিল তাদের হাত ধরেই যে বাংলা সাহিত্য জগতটি নতুন পৃথিবীর সন্ধান পাবে এমনটাই যেন পূর্ব নির্ধারিত। গোকুল চন্দ্র নাগ নিরুপমা দাশগুপ্তকে এই চিঠি লেখার একমাস সাতদিন আগে অর্থাৎ ১৯২১ সালের ৪ঠা জুন দীনেশরঞ্জন দাশ ও গোকুল চন্দ্র নাগের উৎসাহে স্থাপিত হয় ফোর আটর্স ক্লাব বা চতুষ্কলা সমিতি। সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্র শিল্প ও কারুশিল্প চর্চার জন্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের জন্য এমন একটি সমিতির উপস্থিতি বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলা যায় এবং এটিই আয়োজকদের অজ্ঞাতসারেই হয়ে উঠেছিল ১৯২৩ সালে প্রকাশিত 'কল্লোল' পত্রিকার ভূমিকা স্বরূপ। ক্লাবটির সূচনা কালের চারজন ছিলেন দীনেশরঞ্জন দাশ, গোকুলচন্দ্র নাগ, সুনীতি দেবী ও সতীপ্রসাদ সেন। ক্লাবের নানা কাজে পরবর্তীকালে পুরুষদের পাশাপাশি মহিলাদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিশেষতঃ এই প্রসঙ্গে সুনীতি দেবী, মায়া দেবী, উমা দাশগুপ্ত ও নিরুপমা দাশগুপ্তের নাম করা যেতে পারে। নিমন্ত্রিত মহিলা অতিথিদের মধ্যে ছিলেন শান্তা দেবী, সীতা দেবী প্রমুখ। সেই সময়ের অনেক খ্যাতনামা লেখকের সঙ্গেও ক্লাবটির যোগাযোগ ছিল। কিন্তু নারী পুরুষের এমন সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক এবং যৌথভাবে এমন সৃজন ভাবনার চর্চা তৎকালীন সমাজের বিরোধিতার মুখে পড়ে এবং দু'বছর পর ক্লাবটি উঠে যায়। ক্লাবটির একটি পত্রিকা প্রকাশের ইচ্ছা ছিল। তা পূরণ করা যায়নি।পরে 'ঝড়ের দোলা' (১৯২২)নামে একটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয় সেখানে সুনীতি দেবী, গোকুল চন্দ্র নাগ, মণীন্দ্রলাল বসু ও দীনেশরঞ্জন দাশের লেখা চারটি গল্প ছিল। ক্লাব থেকে আর একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।সেটি হল উমাদেবীর লেখা ছোটদের ছড়া ও গল্পের সংকলন 'ঘুমের আগে'।

 

ফোর আটর্স ক্লাব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মূল দুই  উদ্যোক্তার উৎসাহ ও উদ্যমী মন থেমে থাকেনি। আদ্যন্ত শিল্পী ও সাহিত্যপ্রেমী দুই বন্ধু ঠিক করলেন পত্রিকা প্রকাশ করবেন। লেখার আয়োজন বলতে ছিল ফোর আটর্স ক্লাবের সাহিত্য বিভাগের একটি খাতা, মণীন্দ্রলাল বসু, সুনীতি দেবীর কলমের জোর, 'প্রবাসী' র সঙ্গে যুক্ত সুধীর কুমার চৌধুরীর লেখক যোগাড় করে দেওয়ার আশ্বাস। সর্বোপরি দীনেশরঞ্জন ও গোকুলচন্দ্রের প্রবল আগ্রহ ও আত্মবিশ্বাস। দীনেশরঞ্জন দাশের সেই বহুশ্রুত উক্তি ...

 

"নাম ঠিক করিয়া ফেলিলাম...কল্লোল।গোকুলের ব্যাগে ছিল এক টাকা আট আনা, আমার কাছে ছিল টাকা দুই...এই সম্বল লইয়া দোকান হইতে কাগজ কিনিয়া একটি ছোট প্রেসে কল্লোলের প্রথম হ্যান্ডবিল ছাপা হইল। ৩০ শে চৈত্র সংক্রান্তি... চৈত্র মাসের সং দেখিতে পথে বিপুল জনতা হয়। সেই সুযোগে গোকুল ও আমরা কয়েকজন মিলে হ্যান্ডবিল বিলি করিতে বাহির হইয়াছিলাম। ইহার পূর্বেই কল্লোলের কিছু কিছু কপি প্রেসে ছাপিতে দেওয়া হয়।"

 

অবশেষে বাংলা ১৩৩০(ইংরেজি ১৯২৩সাল) এর পয়লা বৈশাখ প্রকাশিত হয় 'কল্লোল' । তার পর থেকে আগামী সাত বছর অর্থাৎ ১৩৩৬ এর পৌষের শেষ সংখ্যা পর্যন্ত নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও পত্রিকাটির যাত্রাপথ অব্যাহত ছিল। 'কল্লোল' কেবলমাত্র একটি সাহিত্য পত্রিকা নয় একটি সাহিত্য আন্দোলন এবং স্বল্প আয়ুষ্কালেই বাংলা সাহিত্যে আধুনিক ভাবনা ও মুক্ত চিন্তার বাহক হিসেবে লেখক ও পাঠক মহলে স্বীকৃত হয়ে ওঠে। নানা বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও একথা বলা যায় কল্লোল তরুণ লেখকদের কলমকে যেভাবে প্রশ্রয় দিয়েছিল তা সমকালে নতুন নতুন সৃজন ভাবনার সহায়ক হয়ে ওঠে। দুটি বিশ্বযুদ্ধের মাঝের ক্রান্তিলগ্নে আশা,নিরাশায় দোলা পাঠক মনকে দেশ বিদেশের মুক্ত ভাবনা চিন্তার সহায়ক করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কল্লোলের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কল্লোলে যেমন সেই সময়ের খ্যাতনামা লেখকদের লেখা ছাপা হয়েছে তেমনই নতুন লেখকদের। শুরু থেকেই কল্লোল তরুণ লেখকদের কাগজ হয়ে ওঠে। নতুন লেখকদের একেবারে নতুন নতুন গল্প-কবিতা নিয়ে কল্লোলের প্রতিটি সংখ্যা প্রকাশিত হত। কল্লোলের প্রভাবে পুরোনো লেখকদেরও নতুন হয়ে ওঠার প্রবনতা দেখা যায়। সব মিলিয়ে বলা যায় কল্লোল সাহিত্য ভাবনার জগতে রীতিমত আলোড়ন জাগিয়ে তোলে।

কল্লোলের প্রায় প্রতিটি সংখ্যায় মহিলাদের লেখা থাকত।গল্প, কবিতা,কথিকা, গান এবং বিদেশি গল্পের অনুবাদ। কল্লোলের সম্পাদকেরা মনে করতেন মেয়েদের নিজস্ব ভাবনার জগত তাদের কলমে যেভাবে চিত্রিত হবে তা পুরুষদের লেখায় সম্ভব নয়। তাছাড়া পূর্বোল্লিখিত দীনেশরঞ্জনের বোন নিরুপমা দেবীকে লেখা গোকুল চন্দ্র নাগের চিঠি প্রমাণ করে কীভাবে অন্তঃপুরের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে তোলা ও তাদের মধ্যে নিরন্তর সৃজনের চর্চাকে বহমান রাখার প্রচেষ্টা ছিল তাঁর মধ্যে।

 

কল্লোলে কবিতা লিখেছেন সুনীতি দেবী, প্রিয়ম্বদা দেবী, রাধারাণী দেবী, চামেলী প্রভা ঘোষ। গান ছাপা হয়েছে কল্যাণী ঘোষ ও নিরুপমা দেবীর। গল্প লিখেছেন সুনীতি দেবী, সুরমা দেবী, নীলিমা বসু, সরোজমোহিনী দেবী, রাধারাণী দেবী, শৈলবালা ঘোষজায়া, শান্তা দেবী, সীতা দেবী, নৃসিংহদাসী দেবী, অহল্যা বসু, নিরুপমা দেবী, প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, মায়া দেবী, উমা দেবী, অনিন্দিতা দেবী, লীলারাণী গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ। এঁরা সমকালে প্রকাশিত অন্যান্য পত্রিকাতেও লিখতেন।

 প্রিয়ম্বদা দেবী (১৮৭১- ১৯৩৪) বেথুন কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। 'ভারতী' পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। তিনি রবীন্দ্র বলয়ের কবি। সমসাময়িক সকল পত্রিকার সঙ্গেই তাঁর সদ্ভাব ছিল। কল্লোলের বেশ কয়েকটি সংখ্যায় তাঁর কবিতা ছাপা হয়েছিল। তবে কল্লোলের ভাবনায় তেমন প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে মনে হয় না। তিনি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে ছিলেন উজ্জ্বল। অকালে স্বামী ও একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে তিনি সমাজসেবা ও সাহিত্য চর্চাকেই বেঁচে থাকার অবলম্বন করে তোলেন।

 

 

এল শীত, ঘিরে কুয়াশায়,

বরণের ব্যবসায়

পড়ে গেল ছাই,

ধূসরের অধিকার,লাল - নীল নাই আর,

ম্লান মুখে কাঁদে ধরা তাই!

সবুজের বসবাস  ছিল যেথা বারোমাস

আজি সেই দেবদারু দীন,

খালি গায়ে হিম বায়ে কাঁপে সারাদিন!

নেড়া গাছ যেন ভাঙা খাঁচা,

পরান-পাখিটি কাঁচা

সবুজ পাখায়

উড়ে গেছে কোন দেশ, কুলায়ের অবশেষ

পড়ে শুধু করে হায়-হায় !

ডালপালা বাঁকাচোরা , শুকানো বাকলে মোড়া

ঝড়ে উড়ে চলে যাবে বলে

দিন নাই রাত নাই অনিবার দোলে! 

ফুলবন আজিকে উজাড়,

ঝুমকো ফুলের ঝাড়

দোলে না সোহাগে,

কামিনী সে অভিমানে চলে গেছে কোনখানে,

কাঞ্চন প্রবাসী তার আগে।

মাধবী-মালতী-বেলা চলে গেছে ভেঙে খেলা,

উদাসিনী হয়েছে পারুল,

ফোটে না তাম্বুলরাগ দাড়িম্বের ফুল।

পলাশের অনল কোথায় !

গোলাপের আলতায়

ধুইল শিশিরে,

সোনার বরণ চাঁপা, পাতার তলায় চাপা,

একে -একে মরে গেল কিরে?

বর্ণ-গন্ধে প্রাণ ভরা ললাটে চন্দন পরা

করবীর নিয়েছে বিদায়,

"কুসুম ফুলের রং " আর না বিকায় !

 

১৩৩৪ এ কল্লোলের পঞ্চমবর্ষ নবম সংখ্যায় এই কবিতাটি প্রকাশিত হয়। নিসর্গের এক নিঃস্ব, বিবর্ণ রূপের আড়ালে  নিজের জীবনের শূন্যতাই যেন প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর কবিতার অন্তরালে বিষাদের সুর বহমান। কল্লোলের নব যৌবনগাথা তাঁর কলমকে প্রভাবিত না করলেও চল্লিশোর্ধ এই নারীর আধুনিক মনস্কতার ছাপ দেখা যায় জীবনভাবনায়‌। জাপানি শিল্পী ও বিশিষ্ট মনীষী  ওকাকুরার ভালোবাসা তিনি ফিরিয়ে দেননি। আমৃত্যু তাঁদের যোগাযোগ ছিল চিঠিতে। এমনকি তাঁর 'ডিয়ার ফ্রেগ্র্যান্স' এর জন্য ওকাকুরা বাংলা ভাষা শিখতে চাইলে  প্রিয়ম্বদা তাঁকে বাংলা ব্যাকরণ বই পাঠান। কবিতার পাশাপাশি  তিনি লিখেছেন বেশ কিছু মৌলিক গদ্য, শিশু উপন্যাস, অনুবাদ করেছেন বিদেশি শিকার কাহিনী, ও ধর্মগ্রন্থ ও বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কারের কথা।

 

রাধারাণী দেবী( ১৯০৩- ১৯৮৯) ও মূলত কবি। তিনি রাধারাণী দত্ত, অপরাজিতা দেবী এই নামেও লিখতেন। মাত্র তের বছর বয়সে বিবাহ।বছর ঘুরতে না ঘুরতেই স্বামীর মৃত্যু। পরবর্তীকালে লেখালেখির সূত্রে আলাপ নরেন্দ্র দেবের সঙ্গে। কয়েকবছর পর বিবাহ। কন্যা নিজেই নিজেকে সম্প্রদান করেন। এমন আশ্চর্য বিবাহ সংবাদে চমকে উঠেছিল তৎকালীন রক্ষনশীল সমাজ। নরেন্দ্র দেবের সঙ্গে 'কাব্য দীপালি' সম্পাদনা করেছেন। সামাজিক অনুশাসন ও মিথ্যা রীতি নীতি মেনে জড়বৎ জীবনযাপন করতে চাননি কখনও। তাঁর কলমও সেই সাক্ষ্য দেয়। শ্লীলতা ও অশ্লীলতা নিয়ে বিচিত্রা ভবনে যে সভা হয়েছিল তাতে নব্যপন্থীদের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছিলেন। গত শতকের দ্বিতীয় দশকে কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশনে একটা অদ্ভুত বিষয়ে বিতর্ক সভা বসেছিল 'ডিভোর্স উচিত কি না'। সে সময়ে ডিভোর্স শব্দটা মধ্যবিত্ত পরিবারে অপরিচিত ছিল অথচ ডিভোর্সের পক্ষে রাধারাণী দেবীর যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য শ্রোতাদের যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। এই দুঃসাহসিক পদক্ষেপ ও নতুন ভাবনাকে আপন করে নেওয়ার জায়গা থেকেই কল্লোলের সঙ্গে তাঁর প্রাণের যোগ। বিভিন্ন সংখ্যায় তাঁর গল্প, কবিতা ও কথিকা থাকত । ১৩৩৫ এ ষষ্ঠবর্ষের শ্রাবণ সংখ্যায় তাঁর 'পাতানো মা' গল্পটি প্রকাশিত হয়। প্রতিবেশী পরিবারের পিতৃ মাতৃহীন আশ্রিত ভাগ্নে নিতাইকে সন্তান স্নেহে ভালোবেসে ফেলেন বিধবা ছোট বৌ অনুসূয়া।তার শাশুড়িও সন্তানহীনা বিধবা পূত্রবধূর এই অবলম্বনটুকুকে প্রশ্রয় দেন :

'তারপর থেকে নিতু এলেই শাশুড়ি বলেন ...অ' ছোটবৌমা ... তোমার ব্যাটা এসেছে বাছা !'

নিতু অনুসূয়াকে ডাকে...মা !

অনুসূয়া ডাকে...খোকা'

 

নিতাই ক্রমশ বড় হয়। সমাজ সংসার কোনদিনই বা সহজ চোখে দেখতে জানে। তাই আত্মীয়দের বাঁকা কথায় অনুসূয়া আঘাত পান।নিতাইকে দূরে সরিয়ে দিতে বাধ্য হলে শাশুড়িকে বলেন...

"মা, সংসারের লোক কি অন্ধ?...তারা কি মা , চোখে দেখতে পায় না? 

শাশুড়ি সান্ত্বনার স্বরে বলেন...না মা, সবাইকার কি চোখে দৃষ্টি থাকে? ...সংসারে বেশীরভাগ মানুষই চশমা দিয়ে দেখে ! আর তাদের সে চশমার কাঁচ প্রায়ই কালো ‌।কালো-কাঁচের ভিতর দিয়ে কালো রং ছাড়া কিছুতেই তো অন্য রং দেখা যায় না মা ! দুপুরের জ্বলন্ত রৌদ্রও যে সে কাঁচের ভিতর দিয়ে সন্ধ্যার মত ম্লান দেখায় !..."

 

সমাজের সংকীর্ণতাকে এভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন তিনি। রেখেছেন প্রতিবাদ। গল্পের শুরুতে দেখি নিতু বলে...

"মাইমা, আপনারা আর আমায় 'আপনি' বলতে পারেন না। সম্পর্কে ও বয়সে দুইয়েতেই আপনারাই বড় !"

অনুসূয়া একটু ম্লান ব্যথিত হাসি হেসে মৃদুকণ্ঠে বলে... কিন্তু জাতে?

নিতু বলে ওঠে...জাত বলে' মার্কামারা কিছু নেই। পৈতে থাকলেই যদি সবাইকার ব্রাহ্মণত্ব থাকতো তা' হলে দুঃখ ছিল না...

 

সময় এগিয়ে যায়।নিতুর দিক থেকে সম্পর্কের বাঁধন কিছুটা শিথিল হয়ে আসে। তবুও অনুসূয়া অপেক্ষা করে... অপেক্ষা করে মৃত্যুর। জীবন তাকে পরের সন্তানের উপর যে স্নেহের দাবিকে অস্বীকার করেছে মৃত্যু এসে সেই সন্তানের হাতের আগুনকে অধিকারের স্বীকৃতি দেবে বলে।

 

কল্লোলের আর একজন লেখিকা ছিলেন সুনীতি দেবী (১৮৯৪)। ডায়াসেশন থেকে ইংরেজি অনার্স গ্র্যাজুয়েট ও সর্ববিদ্যা পটিয়সী সুনীতি দেবী ছিলেন তৎকালীন কবি বিজয়চন্দ্র মজুমদারের কন্যা ও অধ্যাপক বিজলী বিহারী সরকারের স্ত্রী। ফোর আটর্স ক্লাবের অন্যতম স্তম্ভ ছিলেন তিনি। কল্লোল পত্রিকার সূচনাকালে তাঁর কলমের উপর খানিকটা ভরসা করেই এগিয়েছিলেন সম্পাদক। সেকালের অন্যান্য পত্র পত্রিকায় লিখতেন।'প্রবাসী' তে তাঁর কবিতা ছাপা হত। তবে 'কল্লোল' এ তিনি গল্প ও কথিকা জাতীয় রচনা লিখেছেন বেশি। তাঁর লেখা গল্পে কাহিনীর ঘনঘটা খুব বেশি নেই। বরং রয়েছে একটি 'মুড'কে ধরার চেষ্টা। 'কল্লোল' এর প্রথম সংখ্যায় তাঁর 'বীণা' গল্পটি প্রকাশিত হয়।

খানিকটা আত্মকথার ধাঁচে লেখা গল্পটিতে একটি বীণা কেবলমাত্র যন্ত্রকে ছাপিয়ে মানবী কন্ঠস্বর হয়ে উঠেছে আর শেষ পর্যন্ত তা এসে পৌঁছায় এক পরিণতিহীন ভালোবাসার গল্পে। কেবল অপেক্ষাটুকু রয়ে যায়...

'সে দিনের পর আর আমার প্রভুর বাড়ীতে সঙ্গীতের বৈঠক বসেনি।আমি অন্ধকারে আপন মনে গুণীর পরশ পাবার ধ্যান করছি। বাইরের কোন কোলাহল আমার ছিন্নতন্ত্রীতে আর সুরের স্পন্দন জাগায় না... নতুন তারে নতুন করে কেউ আমায় আর বাঁধবে কি? কে জানে?...

 

কল্লোল এ যে মহিলারা লিখতেন তাঁদের অনেকের লেখায় সমাজের নানা বৈষম্য ও নারী জীবনের বিবিধ সমস্যার পাশাপাশি উঠে এসেছে সমকাল। এ প্রসঙ্গে সুরমাদেবীর নাম উল্লেখ করা যায়। কল্লোলের কালটি রাজনৈতিকভাবে এক বিশেষ অস্থির সময়ের দলিল।একদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত, অন্যদিকে জাতীয় রাজনীতিতে গান্ধীজীর আবির্ভাবে আসমুদ্রহিমাচলের  সামগ্রিকতায় বিহ্বল দেশবাসীর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবরণ এবং সেই আন্দোলনের ব্যর্থতায় স্বরাজ্য দলের নির্মাণ, দেশবন্ধুর মৃত্যু, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, বিশৃঙ্খলা মানুষের জীবনকে অস্থির করে তোলে। কল্লোলের চুতুর্থ বর্ষ (১৩৩৩) ষষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত সুরমা দেবীর 'আলোছায়া' গল্পটিতে দেশপ্রেমের যূপকাষ্ঠে আহুতি দিতে হয়েছে শঙ্কর ও সুফলার প্রেম। যে দেশপ্রেমের দীপ্তি শঙ্করকে সুফলার কাছে এনে দেয় সেই দেশপ্রেমই দুজনকে চিরকালের মতো আলাদা করে দেয়। গল্পটির শেষ শঙ্করের  মৃত্যু সংবাদে। তবে পার্থিব শরীরের মৃত্যু ঘটলেও প্রেম যেন শাশ্বত সুন্দর হয়ে জেগে থাকে সুফলার প্রতীক্ষায়, নির্ভরতায়, বিশ্বাসে আর আত্মত্যাগে।

 

' কাহিনী' ও 'ফুলদানী' গল্পগ্রন্থের লেখিকা সরোজ কুমারী দেবী (১৮৭৫- ১৯২৬) 'কল্লোল' এ গল্প লিখতেন। ১৩৩০ এর প্রথম বর্ষের দ্বাদশ সংখ্যায় 'ঝড়ের রাতে' এবং ১৩৩৩ এর চতুর্থ বর্ষের সপ্তম সংখ্যায় 'মাধবীর পত্র' প্রকাশিত হয়। 'ঝড়ের রাতে' নামটিই একটি ভৌতিক গল্পের পরিবেশ তৈরি করে। তিন বন্ধুর চায়ের আড্ডায় মৃত্যুর পর আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্ক ও সেই সূত্রে গল্পটি আসে। মাথায় আকস্মিক চোট পেয়ে বিপত্নীক নেপালবাবু আসন্ন মৃত্যুশয্যায়। তাঁর বোনের বিশ্বাসে নলিনেরও মনে হয় বাইরে প্রবল ঝড়ের শব্দের সঙ্গে একটি অদৃশ্য অস্বস্তিকর উপস্থিতির মতো নেপালবাবুর মৃত স্ত্রীও এসেছেন তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে। অলৌকিক জগতের বিশ্বাসযোগ্য উপস্থাপনায় পাঠক 'willing suspension of disbelief' এ আক্রান্ত হয়ে পড়েন। যদিও গল্পের শেষটা লেখিকা পাঠকের সিদ্ধান্তে ছেড়ে দেন । তিনি কবিতাও লিখতেন। 'অশোকা' ও 'শতদল' তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থের নাম।

 

আরো একজন লেখিকার আবির্ভাব কবি রূপে হলেও উপন্যাস রচনায় নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছিলেন। শরৎচন্দ্রের ভাগলপুরের সাহিত্যসভায় প্রথম তাঁর কবিতা পড়া হয়। 'ভারতী' তে তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে থাকে।তবে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিবারের বালবিধবা নিরুপমাদেবী(১৮৮৩-১৯৫১) রক্ষনশীল জীবনাদর্শে বিশ্বাসী হওয়ায় সমাজ বিরোধিতার ছবি তাঁর লেখায় পাওয়া যায় না। মূলত পল্লীসমাজ তাঁর উপন্যাসের বিষয়বস্তু। 'অন্নপূর্ণার মন্দির'(১৯১৩) তাঁর প্রথম সার্থক উপন্যাস। সুতরাং কল্লোল প্রকাশ হওয়ার অনেক আগে থেকেই সাহিত্য জগতে তিনি পরিচিত। তবে তাঁর পরবর্তী লেখায় মেয়েদের জীবন বদলের ছবি দেখা যায়। এমনকি সমসাময়িক স্বদেশী আন্দোলনের ছায়াপাতও ঘটেছে তাঁর লেখায়। তাঁর লেখা গান ও গল্প প্রকাশিত হয়েছে কল্লোল এ। ১৩৩৩ এর চতুর্থ বর্ষের নবম সংখ্যায় নিরুপমা দেবীর 'মা-হারা' গল্পটি প্রকাশিত হয়। মাতৃ স্নেহ বুভুক্ষাকাতর শিশুটির মা হয়ে উঠতে না পারার অক্ষমতাও যেন অব্যক্ত কষ্ট হয়ে জড়িয়ে থাকে গোটা গল্পের গায়ে...

 

-আপনাকে আমি কি বলে ডাকব বলুন না। কি বলব?

-হায় মাতৃহারা ! দু'দন্ডের পথিকের সঙ্গে তুই কি সম্বন্ধ পাতাইতে চাস। বলিলাম, মাসি-মা বলবে।

- বালক যেন ঈষৎ অনিচ্ছুক ভাবে ধীরে ধীরে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হ্যাঁ ! তার পরে একটু থামিয়া যেন একটু ভয়ের সঙ্গেই বলিল, আমার মা বলে ডাকতে বড় ভাল লাগে। কাছে যখন কেউ থাকে না , চুপি চুপি লুকিয়ে লুকিয়ে ডাকি...মা, ওমা !

 

 বর্ণনার পারিপাট্যেই হোক কি শব্দের ব্যবহারে সর্বত্রই এক কোমল নারীহৃদয়ের স্পর্শ অনুভূত হয়। চরাচরে ব্যপ্ত হয়ে যায় সেই বিষাদ, শূন্যতা...

' বাকপটু শুক শিশু মুহূর্তে মূক হইয়া গিয়া শেষ কয় মুহূর্ত কি ভাবে স্তব্ধ হইয়াছিল। তাহার মুখ দেখিয়া আর সান্ত্বনার মিথ্যাবাক্য উচ্চারণ করিতেও ইচ্ছা হইতেছিল না। ট্রেন ছাড়িয়া দিল, নিশ্চল চক্ষে কালো শুধু উদাসভাবে চাহিয়া আছে দেখিলাম। দেখিতে দেখিতে সে , সে ষ্টেশান সব অদৃশ্য হইয়া গেল ! সেই সায়াহ্ন আকাশতলে সেই উলঙ্গ কালো ছেলেটির মত বিশ্বই যেন বিয়োগ বিধুর ম্লান মুখে বেদনা ভরা নিশ্চল চক্ষে দিগন্তের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া আছে, সারা পথ এমনি মনে হইতেছিল। তাহার বুকে শুধু জমাট কালো রংয়ের ব্যথাই পুঞ্জীভূত ! জলেস্থলে অন্তরীক্ষে শুধু বেদনারই অব্যক্ত স্পন্দন !'

প্রভাবতী দেবী সরস্বতী (১৯০৫ - ১৯৭২) অনুরূপাদেবীর সমগোত্রীয়া হলেও সময়কালের বিচারে তিনি আরও কিছু পরবর্তীকালের। উপন্যাস, ছোটগল্প,নাটক, শিশু সাহিত্য সব মিলিয়ে প্রায় দু'শর বেশি গ্রন্থ রচনা করেন। তবে তিনিও সামাজিক রীতি নিয়মের বিরুদ্ধে যেতে পারেননি। বিধবার প্রেম তাঁর কাছে ছিল নৈতিক অধঃপতনের সমতুল। 'অপরাধিনী', ' শেষের দিক' ,'আশ্রয়' ,' সমাজদ্রোহী' নামে বেশ কিছু গল্প কল্লোলের বিভিন্ন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।

 

নৃসিংহদাসী দেবী ছিলেন কল্লোলের প্রথম দিকের প্রায় নিয়মিত গল্প লেখিকা। ডাক যোগে তাঁর লেখা আসত। তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কারো যোগাযোগ ছিল না। তাঁর লেখায় সাহসিকতা ও  আধুনিক মনস্কতার ছাপ দেখে অনেকেই তাঁকে অপেক্ষাকৃত নবীনা বলেই ভেবেছিলেন। পরে দেখা গেল তিনি শ্রীরামপুরের এক মধ্যবয়স্কা জমিদার বধূ। কল্লোলে প্রকাশিত গল্পগুলি হল, 'মা' , 'যাত্রাপথে', ' শ্রান্তির শেষ', 'খাতা', 'ব্যথা-অশ্রু' , 'পাশের বাড়ী' 'ব্যথার তৃপ্তি' 'ভুলের মূল্য' 'ভবিতব্য' ইত্যাদি। 

 

লীলারাণী গঙ্গোপাধ্যায় সমকালে পরিচিত নাম। তিনি কল্লোলে কিছু গল্প, কথিকা লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র প্রমুখের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ ছিল। তিনি আজীবন সাহিত্য সান্নিধ্য লাভ করেছেন।

 

কল্লোলে অহল্যা গুপ্ত লিখতেন ‌। প্রথম বর্ষ থেকেই তাঁর লেখা গল্প প্রকাশিত হতে থাকে।'গৌরী' , 'বিধবা' 'কল্যাণী' প্রভৃতি গল্পগুলি পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। 'বিধবা' গল্পে মাধবী ও অজিতের বন্ধুত্ব মাধবীর অকাল বৈধব্যের জীবনের পরম সুখ। মাধবী দিদি মায়ার বাড়িতে থাকে। অজিত মায়ার মেজজা ইন্দিরার ছেলে। বড় জা প্রমদা অজিত ও মাধবীর সহজ সম্পর্ক মেনে নিতে পারেন না। কিন্তু ইন্দিরা নারী হৃদয় দিয়ে মাধবীর দুর্ভাগ্যকে অনুভব করেন। বড়জা প্রমদা মাধবীকে অপমান করলে ইন্দিরা বলেন,

 

-'তুমি একথা বলবে তা আমি অনেক আগেই জানতাম। নেহাৎ নিজের জাতের অপমানটা সইতে পারি না, তাই তোমার কথায় এ বিবাদ করেছিলাম। মাধবী বিধবা বটে কিন্তু সে ও ত মেয়ে।'

 

ছেলের সঙ্গে মাধবীর বিয়ের প্রসঙ্গে তিনি বলেন,

-'' মায়া ওটা আমাদের মজ্জাগত সংস্কার কি না তাই ভয় হয়। কিন্তু আবার মনে হয়, আমরা মেয়েরাই এ সব নিয়ে বেশী নিন্দে রটাই।"

ইন্দিরার মৃত্যু আর অজিত মাধবীর নতুন জীবনের সম্ভাবনার মধ্যে গল্পটি শেষ হয়। পারিবারিক সম্পর্ক ও সামাজিক অনুশাসনের টানাপোড়েন লেখিকার বলিষ্ঠ কলমে যথার্থ চিত্রায়িত হয়েছে।

সেই সময় কল্লোলে যাঁরা লিখছেন তাঁদের মধ্যে রাধারাণী দেবী, নৃসিহংদাসী দেবী ও সুনীতি দেবীর মতো যথার্থ কল্লোলীয় হবার দাবী করতে পারেন নীলিমা বসু। তাঁর অকাল প্রয়াণে কল্লোল পত্রিকার সকল সদস্যই ব্যথিত হন। কল্লোলে তিনি কথিকা ছাড়াও 'বরুণা', 'বুড়ো-ঝি', 'অভিমান', 'ঝরাফুল' নামের গল্পগুলি লেখেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন কল্লোলের বন্ধু ও লেখক মুরলীধর বসুর স্ত্রী। সাউথ সুবার্বন স্কুলের শিক্ষকতার সূত্রে প্রেমেন্দ্র মিত্র ও শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁর ছাত্র ছিলেন।তাই এই দুই লেখকের 'কালি কলম' এ যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে মুরলী ধর বসুর ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না।

নীলিমা বসু তাঁর গল্পের বিষয় নির্বাচনে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর 'ঝরাফুল'  মহিলাদের সমকামিতার গল্প। তবে উপযুক্ত শিল্প নৈপুণ্যের অভাবে তা জীবন সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কল্লোলে প্রকাশিত 'অভিমান' দৈনন্দিন জীবনের ভুল বোঝাবুঝি ,অভিমান ও মধুর সমাপ্তির সহজ গল্প । বিমল জীবনকে ত্যাগের চোখে দেখে। দেশকে সে ভালোবাসে।বিদেশের মিথ্যে আড়ম্বর তার অপছন্দ। সুধাকেও সেই ভাবনার পথে আনতে চায়।নানা ভাবে বোঝায়। কিন্তু সকল কিছুকে অগ্রাহ্য করে সুধা 'একজিবিসনে ' যাওয়াতে সে এত আঘাত পেল যে ফেরার পর সুধার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে তার হয়নি। এদিকে বিমলের সেদিনের ব্যবহার শুধু নয় ছ'মাস আগের একখানি কথাও সুধাকে কষ্ট দেয়। বিমল বলেছিল, " আমি তো তোমায় কিছু বলছি না সুধা। তুমি তোমার মতে চল,---আমাকে আমার মত চলতে দাও। অন্যের  স্বাধীনতায় হাত দেওয়ার অধিকার তোমার নেই।" সুধা তাই মন চাইলেও কিছুতেই এগোতে পারে না অভিমানে , লজ্জায় , রাগে। একটি ঝড় বৃষ্টির রাত তাদের কাছে নিয়ে আসে...

" বাদলের সু্র বড় করুণ ভাবে বিমলের বুকে ব্যথা হানিতেছিল ; একা থাকা তাহার পক্ষে অসম্ভব হইয়া উঠিল। অতি সন্তর্পণে কাছে সরিয়া আসিয়া , তাহার দুই বাহু দিয়া সস্নেহে সুধাকে বুকে টানিয়া লইল । স্বামীর আদরে সুধার ঘুম টুটিয়া গেল, সে ইহারই আশায় আজ কতক্ষণ জাগিয়া কাঁদিয়াছে। এইবারে স্বামীর বুকে মুখ লুকাইয়া , আকুল আবেগে কাঁদিয়া ফেলিল।

আকাশের অবিশ্রান্ত বর্ষণের মধ্যে, ঘরের কোণে দুইটি প্রচন্ড অভিমানীর, এ কয়দিনের অন্তরের জমাট ভাব যেন মুহূর্তেই কাটিয়া গেল।''

১৩৩১ এর অগ্রহায়ণ সংখ্যায় প্রকাশিত এই গল্প চিরন্তন দাম্পত্যের।

 

ক্রমশ মেয়েদের লেখায় একটা পরিবর্তন আসছিল। দীর্ঘদিন সাহিত্যে নারীর নির্মাণ হয়েছে পুরুষের কলমে। তাদের মনের মতো করে। এমনকি অনুরূপাদেবী , নিরুপমা দেবীর মতো লেখিকারা নারীর সমস্যাকে তার 'দুর্ভাগ্য' বলে তা নীরবে সহ্য করাকে সতীত্বের চরম নিদর্শন হিসেবে দেখিয়েছেন। কিন্তু নতুন ভাবনায় জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতে বদল আসতে থাকে।  নিজেদের অধিকার পেতে তারা আর অপরের দয়া দাক্ষিন্যের উপর নির্ভর না করে নিজেরাই তা আদায় করে নেয়। দৃপ্ত কণ্ঠে জানাতে পারে নিজের পছন্দ, অপছন্দ  ,অভিযোগ। শৈলবালা ঘোষজায়া (১৮৯৩-১৯৭৩), শান্তা দেবী (১৮৯২) সীতা দেবী (১৮৯৫-১৯৭৪) এরা ছিলেন এই ভাবনার অংশীদার। এঁরা সকলেই কল্লোল প্রকাশের আগেই লিখতেন এবং 'প্রবাসী' ও 'ভারতী'তে এঁদের লেখা প্রকাশিত হত।

শৈলবালা ঘোষজায়া ছোটবেলা থেকেই বাবাকে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও হেমচন্দ্র পড়ে শোনাতেন। এভাবেই তাঁর মনে সাহিত্য প্রীতি জন্মায়। মাত্র তের বছর বয়সে বর্ধমান জেলার মেমারিতে তাঁর বিয়ে হয়। গোপনে তিনি সাহিত্য চর্চা করতেন। আঠেরো বছর বয়সে লিখলেন 'বীণার সমাধি'। সেই গল্পটি পুরস্কার পেল। ১৩২২ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যা থেকে ফাল্গুন সংখ্যা পর্যন্ত ১১টি কিস্তিতে  'প্রবাসী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর সাড়া জাগানো উপন্যাস 'শেখ আন্দু'। শোনা যায় তাঁর স্বামী নিজেই উপন্যাসের পান্ডুলিপি পত্রিকার দপ্তরে পাঠিয়ে দেন। শৈলবালা ঘোষজায়া সেইসময়ে লিখে আয় করতেন। কর্মহীন স্বামী কলকাতায় যান হোমিওপ্যাথি পড়তে সেইসঙ্গে টাইপ ও শর্টহ্যান্ড শিখতে। লেখালেখি করে শৈলবালা এইসব খরচ যোগান। শৈলবালার যখন ছাব্বিশ বছর বয়স তখন তাঁর স্বামী পাগল হয়ে যান। শত প্রতিকূলতাও তাঁর সৃজন ক্ষমতা নষ্ট করতে পারেনি। 'কর্পূরের মালা' , 'ননীখানসামার ছুটি যাপন', ' বিজয়ার নমস্কার' ,' ভন্ডের সার্থকতা' ,'লাফো', 'গোলাপ সিংহ' নামের ছোটগল্পগুলি পড়লে বোঝা যায় গল্প বলার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। গল্পগুলিতে কোনো চমকপ্রদ ঘটনার ঘনঘটা নেই কিন্তু বলার গুণে ক্ষুদ্র মানুষ, তুচ্ছ মানুষ লেখিকার সহানুভূতির আলোয় ক্ষণিক আলোকিত হয়েই যেন তারা অমূল্য‌ হয়ে ওঠে। 'শেখ আন্দু' উপন্যাসে লতিকা বাগদত্তা। তার হবু স্বামী ডাক্তার। জ্যোৎস্না বিবাহিতা। তবুও তারা মুসলমান ড্রাইভার আন্দুর প্রেমে পড়ে। আন্দুর বলিষ্ঠ পৌরুষ তাদের আকর্ষণ করে। সম্ভবতঃ এই প্রথম কোনো লেখিকা পুরুষের দৈহিক সৌন্দর্যের বর্ণনা দিলেন। লুকিয়ে রাখলেন না নারী মনের অভিব্যক্তি। আন্দুর সঙ্গে সাক্ষাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলছেন..."লতিকার মনের মধ্যে অজ্ঞাত প্রদেশে এক সুপ্ত সমুদ্র অকস্মাৎ সবেগে উছলিয়া উঠিল। অধীরতায় লতিকার কপালের শিরা দপদপ করিতে লাগিল...সে স্পষ্ট স্পন্দিত হৃদপিন্ডটা দুই হাতে চাপিয়া চেয়ারে বসিয়া চক্ষু মুদিল, তাহার মনে হইল, সমস্ত আইন -কানুন বাঁধন ছিঁড়িয়া খুঁড়িয়া মরণোন্মাদ রক্তকেন্দ্র বক্ষের মধ্যে উর্দ্ধশ্বাসে তান্ডব নৃত্য জুড়িয়াছে, কি ভয়ঙ্কর ।" 

শৈলবালা যখন 'শেখ আন্দু' লিখছেন তখনও বিশ্বের পাঠক পড়েননি লরেন্সের লেডি চ্যাটার্লিস লাভার। ললিতা আর আন্দুর মধ্যে ফারাক কেবল সামাজিক অবস্থানের নয়, প্রবল বাধা হয়ে আছে ধর্ম। শৈলবালা সমাজকে এক বৃহত্তর প্রশ্ন তথা সংকটের মুখে দাঁড় করান এই উপন্যাসের মাধ্যমে মাত্র একুশ বছর বয়সে।

১৩৩১ এর পৌষ সংখ্যায় শৈলবালার 'পাহাড়ের পথে' গল্পটি প্রকাশিত হয় কল্লোলে। প্রসাদ বাউড়ী তার মনিব লক্ষ্মীকান্ত কবিরাজের সঙ্গে পাহাড়ে ঔষধের গাছ সংগ্রহ করতে চলেছে। পাথরের পাশে হঠাৎ সে দেখতে পায় তার প্রথম পক্ষের বউ পার্ব্বতীকে। হতদরিদ্র মেয়েটি কাঠপাতা কুড়িয়ে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে কোনোরকমে দিন কাটায়। প্রসাদ পার্ব্বতী ঘরে থাকতেও কয়লার খাদে খাটতে গিয়ে এক প্রখরা মেয়েকে বিয়ে করে আনল। নববধূর একটি পুত্র হওয়ার পর পার্ব্বতীরও একটি পুত্র সন্তান হওয়াতে তার উপর নববধূর অত্যাচার মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। প্রসাদ প্রথম পক্ষের প্রতি উদাসীন রইল। পার্ব্বতী ছেলেকে নিয়ে বাবার বাড়িতে গিয়ে খেটে খেতে লাগল। প্রসাদ তাদের কোনো খবর রাখত না। বহুদিন পর নির্জন পাহাড়ের পথে পার্ব্বতীকে দেখে প্রসাদের একান্তে মিলিত হবার বাসনা জাগে। এমনকি তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নেবার প্রলোভন দেখায়। ফুল দেয়...

'মোড়ের গাছ- পালার আড়ালে আসিয়া পার্ব্বতীর কাঁধের উপর একটা আদরের ধাক্কা হানিয়া প্রসাদ নিম্ন কন্ঠে বলিল "তুর লেগে পাহাড় হতি ফুল আনেছিলাম, তু লিয়ে যা---"

কোঁচড় হইতে এক-মুঠা পাহাড়ী ফুল বাহির করিয়া সে পার্ব্বতীর হাতে গুঁজিয়া দিল। পার্ব্বতী বিনাবাক্যে একবার অর্থহীন দৃষ্টিতে প্রসাদের মুখের দিকে চাহিল, তারপর পিছু ফিরিয়া ফুলগুলি হনুমান মূর্ত্তির উপর ছুঁড়িয়া দিয়া, যুক্তকর কপালে ঠেকাইয়া নমস্কার করিতে করিতে নিজ মনে বিড়বিড় করিয়া কি বলিতে লাগিল। প্রসাদ ক্রুদ্ধ তিরস্কারের স্বরে বলিল, " সাত অনুপাড়ি বিদ্যা তোর ! ফুলগুলা ফাবড়াই দিলি যে ?"

পার্ব্বতী প্রস্থানোন্মুখ হইয়া শান্তকন্ঠে উত্তর দিল," হনুমানজীর কাছে আসিব্বাদ মাগুছি যেন তোর রাতটো ভাল হয় , আর আমার ছেলেটা যেন তোর মত না হয় ।"

কথাটা শেষ করে পার্বতী দ্রুত নামতে থাকে।প্রসাদ আর তার নাগাল পাবে না বুঝতে পেরে অবাক দৃষ্টিতে তার গমন পথের দিকে চেয়ে থাকে। 

সমাজের অনুশাসনকে অগ্রাহ্য করে প্রবল ভালোবাসার ক্ষমতা যেমন নারী রাখে তেমনই রাখে প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা । এই কথা শৈলবালার কলম সগর্বে ঘোষণা করেন আজ থেকে একশ বছর আগেই।

 

শান্তাদেবী ও সীতাদেবী দু'জন ছিলেন প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের দুই কন্যা। বেথুন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করার আগেই এরা 'ফোক টেলস অফ হিন্দুস্থান' অনুবাদ করতে থাকেন। পরবর্তীকালে এঁদের গল্প উপন্যাসের নায়িকাদের আত্মসচেতন ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন রূপ সম্ভ্রম উদ্রেক করে। এঁরা গল্প উপন্যাস দুইই লিখেছেন। প্রথম মহাযুদ্ধের পরের জীবনের যে বদল, নর নারীর সম্পর্কের নানা দিক ,সমস্যা, তাদের সংগ্রাম তাঁদের লেখায় ফুটে উঠেছে। সীতাদেবীর 'চিরন্তনী'র নায়িকা করুণা কলকাতার একটি স্কুলে চাকরি নিয়ে পরিবারের দায়িত্ব পালন করে।এই সংগ্রামের মধ্যে হারিয়ে যেতে থাকে তার জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলো। কৈশোরের প্রেম অবিনাশ নয় বরং প্রকাশের জন্য সে অধীর হয়েছে। প্রকাশের প্রেম তাকে জাগিয়েছে পূর্ণ নারীত্বে। সীতাদেবীর উপন্যাস অনেক বেশি পরিণত। তিনি ছোটগল্পও লিখেছেন। কল্লোলে 'মনস্কামনেশ্বর' নামে একটি গল্প ছাপা হয়। অপর্না নিরুদ্দিষ্ট স্বামী যাতে ফিরে আসে তাই পিসীমার সঙ্গে মনস্কামনেশ্বরের ঘাটে আসে। সেখানে এক নর্তকীর নৌকায় স্বামীকে সে দেখতে পায়। দীর্ঘ আট বছরের অপেক্ষা মুহূর্তে অর্থহীন মনে হয় তার। স্বামীর শেষ চিহ্ন স্বরূপ লকেট শুদ্ধ গলার সোনার হার খুলে সজোরে ছুঁড়ে দেয় নদী বক্ষে ঠিক যেখানে মৃতের অস্থি বিসর্জন করা হয়েছিল। এই অপর্না গল্পের শুরুতে পিসিমাকে বলে,..

" ইচ্ছে তো চিরকালই অনাসৃষ্টি পিসী । কাজেই লোকে সৃষ্টি ছাড়া না হ'তে চেষ্টা করে, ইচ্ছের উপর কারো হাত নেই..."

সেই ইচ্ছে কারো জীবন ভাঙে আবার কারো জীবনকে চরম সত্যের মুখে দাঁড় করায়।

শান্তা দেবীর উপন্যাসেও নারী চরিত্ররা স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। 'ময়ূরপুচ্ছ' এর লিলি,' সিঁথির-সিঁদুর ' এর সাগরিকা, 'পিতৃদায়' এর অলোকা পাঠক মনে চিরস্থায়ী দাগ রেখে যায়। কল্লোলে প্রকাশিত 'তিলোত্তমা' গল্পে সুমতি তার শারীরিক সৌন্দর্যহীনতার কারণে দুঃখিত হয়না, এমনকি গ্রাহ্য করে না বন্ধুদের ঠাট্টা তামাশা। সে তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে যখন তার ভালোবাসা অপমানিত হয়। শেষে মিথ্যা দোষের বোঝা মাথায় নিয়ে তার চলে যাওয়া আসলে অন্যকে শাস্তি দিয়ে যাওয়া। কেননা অনুতাপের শাস্তি বড় কঠিন, দুঃসহ ।

 

মেয়েদের লেখা পড়ার আগেই পাঠক মনে তাকে সীমায়িত করার প্রয়াস ঘটে। অর্থাৎ লেখাটি কেবল ঘরের কথা বলবে, নারীর ব্যক্তিগত সুখ দুঃখ, আক্ষেপ ইত্যাদি যা বাঁধা ছকের বাইরের কিছু নয়। কিন্তু বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্রভাবনা শুরুই হয় পরিবার থেকে এবং পরিবারও যে একটি পলিটিক্যাল ইউনিট যেখানে পুঁজি নির্ধারণ করে সম্পর্কের রসায়ন সেই ভাবনায় কলমের সাথে মননের সঠিক সঙ্গতে রসোত্তীর্ণ সাহিত্য সৃষ্টির সম্ভাবনা থেকেই যায়। কেবল দৃষ্টিটুকু প্রসারিত করতে হবে।

 

কল্লোল পত্রিকা প্রথিতযশা সাহিত্যিকদের রচনা প্রকাশ করে রাতারাতি জনপ্রিয়তার সহজ রাস্তায় হাঁটেনি। বরং পাঠককে তাঁরা লেখক বানাতে চেয়েছেন। সব লেখা খুব উচ্চ সাহিত্য গুণসম্পন্ন না হলেও পরিণতির একটা প্রচেষ্টা অনেক লেখক লেখিকার গল্পের ধারাবাহিক পাঠ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবে একথাও ঠিক ভালো লেখক হয়ে উঠতে গেলে যে সাধনা, জীবন অভিজ্ঞতা ও আত্মবিশ্লেষণ প্রয়োজন হয় তা তাঁরা জানিয়ে দিতেওভোলেননি।কল্লোলের  অফিসে লেখকদের আড্ডা বসত। সেখানে সমকালের অনেক সাহিত্যিক, সাহিত্য যশ প্রার্থী যেমন থাকতেন তেমনিই অনেক সাহিত্যপ্রেমী পাঠকও উপস্থিত থাকতেন। কিন্তু সেই তালিকায় কখনও কোনো মহিলার নাম পাওয়া যায় নি পাঠিকা হিসেবে তো নয়ই, লেখিকা হিসেবেও নয়। তাঁদের সাহিত্য সাধনা চারদেয়ালের বাইরের আকাশ জুড়ে মুক্তি পায়নি কখনোই।এমনকি চারদেওয়ালের মধ্যেও প্রতিকূলতার পাহাড় পেরিয়ে যেতে হয়েছে তাঁদের। ভার্জিনিয়া উলফ বলেছিলেন, লেখার জন্য একটি মেয়ের নিজস্ব একটি ঘর ও অর্থের দরকার। আজ থেকে একশ বছর আগে নিজস্ব একটি ঘরের কথা মেয়েরা ভাবতেই পারত না আর অর্থের প্রয়োজনে তাকে বেরতে হত তখনই যখন সংসার সেই অর্থের উপর নির্ভরশীল হয়। একশ বছরে এই পরিস্থিতি কতটা বদলেছে তা সবথেকে ভালো মেয়েরাই বলতে পারবেন ।হয়ত বলছেনও তাঁদের দিনযাপনে, সাহিত্য, শিল্প সৃজনে । তৈরি করে নিতে চাইছেন নিজস্ব এক পৃথিবী পুরুষের পরিপূরক হয়ে এবং কখনও একেবারে একা। সৃজন থেকে পালনের ভূমিকায় আর কলম সেখানে হয়ে উঠছে তাঁদের শক্তি ও সহায়ক।

 

 

তথ্য ঋণ:

১.কল্লোলের কাল : জীবেন্দ্র সিংহ রায়

২.নারী জাগৃতি ও বাংলা সাহিত্য: ডঃ জ্ঞানেশ মৈত্র

৩. কল্লোল গল্প পঞ্চাশৎ : সংকলন ও সম্পাদনা: বারিদবরণ ঘোষ

৪. বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্প, গল্পকার : ভূদেব চৌধুরী