কল্লোল ও জীবনানন্দ

এখনকার গদ্য বা পদ্য কাব্য আমি ভয়ে পড়ি নে পাছে আমার রুচির সঙ্গে না মেলে। আমি এই কথা মনে করতে ইচ্ছা করি যে নতুন যুগের মন নতুন রীতিতে লিখতে চাইবেই, প্রথম প্রথম হুঁচট খেলেও হয়তো ক্রমে চাল দুরস্ত হয়ে যাবে। সার্থকতা বিচার করবার সময় এখনো আসে নি.....’- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ফাল্গুন, ১৩৩২ (ইং ১৯২৬, ফেব্রুয়ারী-মার্চ)। দীনেশরঞ্জন দাশ সম্পাদিত কল্লোল পত্রিকায় প্রকাশিত হল ‘নীলিমা’ শীর্ষক একটি কবিতা। কবি শ্রী জীবনানন্দ দাশগুপ্ত। কলকাতা শহরের পাংশু, মুমূর্ষু ছবি ফুটে উঠল কবিতায়, চেনা শহর ধরা দিল নতুন ভাবে। তাঁর কবিতায় স্বাতন্ত্র্যের ইঙ্গিত অচিরেই দৃষ্টি আকর্ষণ করল বাংলাদেশের প্রবীণ ও নবীন সাহিত্যবোদ্ধাদের। ভার্জিনিয়া উলফ্ তাঁর প্রুস্ত পাঠের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন,

‘....but I am in a state of amazement; as if a miracle were being done before my eyes. How, at last, has some one solidified what has always escaped... one has to put the book down and grasp. The pleasure becomes physical - like sun and wine and grapes and perfect serenity and intense vitality combined.’

জীবনানন্দের কবিতা পাঠেও কী একই ধরণের অনুভূতি হয়েছিল সমসাময়িক পাঠকদের? অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত তাঁর ‘কল্লোল যুগ’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘হঠাৎ “কল্লোলে” একটা কবিতা এসে পড়ল – ‘নীলিমা’। ঠিক এক টুকরো নীল আকাশের সারল্যের মত। মন অপরিমিত খুশি হয়ে উঠল। লেখক অচেনা, কিন্তু ঠিাকানাটা কাছেই, বেচু চ্যাটার্জী স্ট্রীট। বলা-কওয়া নেই, সটান একদিন গিয়ে দরজায় হানা দিলাম।’ জীবনানন্দ তখনও অপরিচিত অচিন্ত্য কুমারের কাছে, ঠিকানা খুঁজে অচিন্ত্য কুমার একদিন নিজেই চলে গেলেন কবির কাছে। এখানে একটু তথ্যগত ত্রুটি ছিল অচিন্ত্যকুমারের, কারণ ‘নীলিমা’ প্রকাশিত হওয়ার সময়, অর্থাৎ ১৯২৬এ জীবনানন্দ থাকতেন ৬৬ নং হ্যারিসন রোডে, প্রেসিডেন্সি বোর্ডিংয়ে, অধ্যাপনা করতেন সিটি কলেজে।বেচু চ্যাটার্জী স্ট্রীটে জীবনানন্দ ছিলেন বছর দুয়েক, ১৯২৪-২৫ খ্রীষ্টাব্দে। যাই হোক, প্রথম সাক্ষাতেই জীবনানন্দ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভীরু হাসি হেসে অচিন্ত্য কুমারের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন ঘরের ভিতরে, ‘একেবারে তার হৃদয়ের মাঝখানে’, সূত্রপাত হল সখ্যর। অচিন্ত্য কুমার আরও লিখছেন,

বরিশাল থেকে ফিরে এসে জীবনানন্দ ডেরা নিলে প্রেসিডেন্সি বোর্ডিংয়ে, হ্যারিসন রোডে, “কল্লোলের” নাগালের মধ্যে। একা-এক ঘর, প্রায়ই যেতাম তার কাছে। কোনো-কোনো দিন মনে এমন একটা সুর আসে যখন হৈ-হল্লা, জনতা-জটলা ভালো লাগে না। সে সব দিন পটুয়াটোলা লেনে না ঢুকে পাশ কাটিয়ে রমানাথ মজুমদার স্ট্রীট দিয়ে জীবনানন্দের মেসে এসে হাজির হতাম। পেতাম একটি অস্পর্শশীতল সান্নিধ্য, সমস্ত কথার মধ্যে একটি অন্তরতম নীরবতা। তুচ্ছ চপলতার ঊর্ধ্বে  একটি গভীর ধ্যানসংযোগ। সে যেন এই সংগ্রামসংকুল সংসারের জন্য নয়, সে সংসারপলাতক। জোর করে তাকে দু-একদিন কল্লোল আপিসে টেনে নিয়ে গেছি, কিন্তু একটুও আরাম পায় নি, সুর মেলাতে পারে নি সেই সপ্তস্বরে। যেখানে অনাহত ধ্বনি ও অলিখিত রং, জীবনানন্দের আড্ডা সেইখানে।

          তীব্র আলো, স্পষ্ট বাক্য বা প্রখর রাগরঞ্জন – এ সবের মধ্যে সে নেই। সে ধূসরতার কবি, চিরপ্রদোষদেশের সে বাসিন্দা। সেই যে আমাকে সে লিখেছিল, আমি ছায়ার মধ্যে কায়া খুঁজে বেড়াই, সেই হয়তো তার কাব্যলোকের আসল চাবিকাঠি। যা সত্তা, তাই তার কাছে অবস্তু, আর যা অবস্তু তাই তার অনুভূতিতে আশ্চর্য অস্তিত্বময়। যা অনুক্ত তাই অনির্বচনীয় আর যা শব্দস্পর্শস্পন্দ তাই নীরবনির্জন, নির্বাণনিশ্চল। বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ নতুন স্বাদ নিয়ে এসেছে, নতুন দ্যোতনা। নতুন মনন, নতুন চৈতন্য। ধোয়াটের জলে ভেসে-আসা ভরাটের মাটি নয়, সে একটি নতুন নিঃসঙ্গ নদী।’

অচিন্ত্যকুমারের ‘কল্লোল যুগ’ এর এই অংশটি পড়ে জীবনানন্দ তাঁকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন,

‘কল্লোলের সেই ঘরটায় আমি দু-চার বার নয়, দুশো বার তো গিয়েছি খুবই, তুমি বিকেলের দিকে আসতে – আমি সকালের দিকে যেতাম। দীনেশরঞ্জনকে সব সময়েই দেখতাম।’

শুধু অচিন্ত্য কুমার নয়, অন্যান্য সাহিত্যিকরাও তাঁর সাথে আলাপ করতে বা দেখা করতে যেতেন। যেমন বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘জীবনানন্দ দাশ-এর স্মরণে’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘হ্যারিসন রোডে তাঁর বোর্ডিঙের তেতলা কিংবা চারতলায় অচিন্ত্য কুমারের সঙ্গে একবার আরোহণ করেছিলাম।’ জীবনানন্দ লিখছেন,

‘....”কল্লোলে”র যুগে আমি কলকাতায় থাকতাম। “কল্লোলে”র শ্রেষ্ঠ লেখকদের সঙ্গে প্রায়ই দেখা, কথাবার্তা হত।’

প্রসঙ্গত: বলা যায় এই পর্যায়ে যে জীবনানন্দকে পাওয়া যায় মোহিতলাল-সত্যেন্দ্রনাথ-নজরুলের প্রভাব তাতে স্পষ্ট, রবীন্দ্রনাথও সুদূর নন। ‘ঝরা পালক’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভূক্ত হয় কবিতাটি।

কল্লোলের বয়সও তখন বেশী নয়। পত্রিকাটির প্রথম প্রকাশ বৈশাখ ১৩৩০(ইং ১৯২৩)। সম্পাদক শ্রী দীনেশরঞ্জন দাশ, সহ-সম্পাদক শ্রী গোকুলচন্দ্র নাগ। পত্রিকার অফিস ১০/২, পটুয়াটোলা লেন। পত্রিকার আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র সাত বৎসর। সমসাময়িক বিশ্বযুদ্ধ, অর্থনৈতিক মন্দা, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আত্ত্বিক ও মানসিক সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রোত্তর নবীন প্রজন্ম রবীন্দ্রনাথের কল্যাণকামী ভাববাদী চিন্তাধারার বিপ্রতীপে মানুষের আচরণ, চিন্তাধারার পিছনে খুঁজে নিলেন ফ্রয়েডীয় বিশ্লেষণ, সাম্যবাদের চর্চা। বুদ্ধদেব বসুরমতে, ‘যাকে কল্লোল যুগ বলা হয় তার প্রধান লক্ষণই বিদ্রোহ, আর সে বিদ্রোহের প্রধান লক্ষই রবীন্দ্রনাথ।’  ভাবাতিশয্যকে দূরে রেখে বাস্তবের মাটি থেকে উঠে এল সাহিত্য সৃষ্টির উপকরণ।

‘রবীন্দ্রনাথ থেকে সরে এসেছিল কল্লোল। সরে এসেছিল অপজাত ও অবজ্ঞাত মনুষ্যত্বের জনতায়। নিম্নগত মধ্যবিত্তদের সংসারে। কয়লাকুঠিতে, খোলার বস্তিতে, ফুটপাতে। প্রতারিত ও পরিত্যক্তের এলেকায়। ’(কল্লোল যুগ, অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত)

জীবনানন্দের নিজের কথায়,

‘এ যুগ অনেক লেখকের – একজনের নয় – কয়েকজন কবির যুগ। সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের একচ্ছত্র প্রভাব অনেকদিন পর্যন্ত অনুভব করার পর এই নতুন কবি-সাধারণ-সংঘ সাহিত্যের কাছে সময়ের দান।’ (কবিতার কথা) সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কথায়, ‘সে-সময় নিশ্চই রবীন্দ্রনাথের সময় ছিল না। ইংরেজের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন, রুশ বিপ্লবের ঢেউ, বিশ্বযুদ্ধের অবশ্যম্ভাবী কুফল আর্থিক সঙ্কট বাংলাদেশে যে-সময় তৈরি করে তুলল তখন রবীন্দ্রনাথের কবিতার চর্চা নবাগত তরুণ কবিদের তৃপ্তি দিতে পারে নি। সেই অতৃপ্তি থেকেই তাঁদের সৃষ্টি- ‘কল্লোল’ যুগ। সে-যুগের শ্রেষ্ঠ দান যে জীবনানন্দ দাশ, কোনো সৎ কবিতা-পাঠকই হয়তো তা অস্বীকার করতে পারবেন না। ‘কবি-সাধারণ-সংঘ’ থেকে উত্তীর্ণ হয়েই তিনি শ্রেষ্ঠ।’

নীলিমা পড়েই বুদ্ধদেব বসু কবিকে সাগ্রহ আমন্ত্রণ করেছিলেন ‘প্রগতি’তে আর ‘তিনিও তার উত্তর দিলেন উষ্ণ অকৃপণ প্রাচুর্যে’। ‘কবি জীবনানন্দ’ প্রবন্ধে বুদ্ধদেব বসুর উল্লেখ: ‘কিছুকাল পূর্বে জীবনানন্দ স্বাক্ষরিত ‘নীলিমা’ নামে একটি কবিতা ‘কল্লোলে’ আমরা লক্ষ করেছিলাম; কবিতাটিতে এমন একটি সুর ছিল যার জন্য লেখকের নাম ভুলতে পারি নি।’ একই প্রবন্ধে তাঁর উল্লেখ: ‘কবে কোথায় জীবনানন্দকে প্রথম দেখেছিলাম মনে পড়ছে না। পাঁচ মিনিট দূরে থেকেও ‘কল্লোল’-আপিশে তিনি আসতেন না, কিংবা কদাচ আসতেন; অন্তত: আমি তাকে কখনো সেখানে দেখিনি।’

জীবনানন্দের ভাই অশোকানন্দ দাশ লিখেছেন,

‘কবি স্বর্গীয়া উমা দেবী তাঁর কাব্য-অনুরাগিণী ছিলেন। হাজরা রোডে তাঁর একটা ক্লাব ছিল, যার নাম ছিল Four Arts Club তাঁরই মধ্যবর্তিতায় দীনেশ দাশের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। অনেক দিন তিনি দীনেশ দাশের কল্লোলের নিয়মিত লেখক ছিলেন।’ (আমার দাদা জীবনানন্দ দাশ, হাওড়া গার্লস কলেজ পত্রিকা, জীবনানন্দ স্মৃতি সংখ্যা) কল্লোলের সম্পাদক দীনেশ রঞ্জন দাশ ছিলেন এই উমা দেবীর জায়ের ভাই।

জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৪। কল্লোলে প্রকাশিত হল ‘সিন্ধু’ কবিতা। ‘মানসী ও মর্মবাণী’ পত্রিকার আষাঢ় ১৩৩৪ সংখ্যায় প্রবল সমালোচিত হল কবিতাটি। সমালোচক সরাসরি আক্রমণ করলেন কবিকে, ‘‘সিন্ধু’ বলিয়াই কি কবিতাটি একেবারে ভাবে ও ভাষায় উদ্দাম ও উচ্ছৃঙ্খল, অবোধ্য ও অসংযত।’‘সমগ্র কবিতাটি এইরূপ নিরর্থক বাক্য ও অসম উপমায় পরিপূর্ণ। ’সন্দেহ নেই সমালোচনায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিলেন জীবনানন্দ, একই সঙ্গে কল্লোল যুগের তথাকথিত ‘উদ্দাম ও উচ্ছৃঙ্খল, অবোধ্য ও অসংযত’ ভাব ও ভাষার প্রবণতায় সাড়া দিতে দ্বিধা বোধ করেন নি তিনি। সঞ্জয় ভট্টাচার্য লিখছেন,

বাংলাদেশের বিশের দশক শুধু স্বাধীনতা-আন্দোলনেই উদ্দীপ্ত ছিল না, রুশ-বিপ্লবের হাওয়ায় সমাজের নীচের তলার মানুষের প্রতি একটা সহানুভূতি জেগে উঠেছিল বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্ত যুব সম্প্রদায়ের হৃদয়ে। সাহিত্যে তার যা-কিছু প্রতিফলন তা করেছেন ‘কল্লোল’-গোষ্ঠী। কিন্তু রুশ সাহিত্য থেকে তাঁদের প্রেরণা আসে নি, এসেছে মার্কিনী কবি হুইটম্যান থেকে, যিনি কৃষক-মজুর শ্রেণীর আত্মীয় হয়ে উঠেছিলেন। এ ধারা কবিতায় তখন অগ্রণী দেখা যায় শ্রী প্রেমেন্দ্র মিত্রকে। ব্যথিত বিশ্বমানবের সঙ্গে আত্মীয়তা স্থাপন করতে চেয়েছেন যেমনি অচিন্ত্যকুমার, তেমনি জীবনানন্দ দাশ।’

‘ঝরা পালক প্রকাশিত হয় ১৩৩৪ সালে। তার ভূমিকায় জীবনানন্দ জানালেন, ‘ঝরা পালকের কতকগুলি কবিতা প্রবাসী, বঙ্গবাণী, কল্লোল, কালিকলম, প্রগতি, বিজলী প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছিল। বাকীগুলি নূতন( কলিকাতা, ১০ই আশ্বিন, ১৩৩৪) দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন ‘কল্লোল’ ছাড়া অপর কোনো কাগজ বিজ্ঞপ্তি করে নি বইখানির। “ ‘কল্লোল’ জীবনানন্দের প্রথম কাব্যের যে সংক্ষিপ্ত সমালোচনা করেছিলেন, ‘তারুণ্যের উল্লাস’ ছাড়াও তাতে ‘মোহিতলাল নজরুলের প্রভাবকে নিজের বৈশিষ্ট্যের পথে ফেরাতে পেরেছেন’ বলে স্বীকার দেখতে পাওয়া যায়।” (জীবনানন্দ দাশ, তাঁর কবিতা, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়)

কল্লোলের অগ্রহায়ণ, ১৩৩৪ সংখ্যায় ‘পুস্তক ও পত্রিকা-পরিচয়লিপি’তে প্র-আদ্যক্ষর স্বাক্ষরিত জনৈক আলোচক লিখলেন,“‘ঝরা পালক’ কবিতার বই, শ্রী জীবনানন্দ দাশগুপ্ত প্রণীত। দাম এক টাকা। কয়েক বৎসরের মধ্যেই শ্রী জীবনানন্দ দাশগুপ্ত কাব্যসাহিত্যে আপনাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। তরুণ কবির সমস্ত কবিতাতেই তারুণ্যের উল্লাস ধ্বনিত। তাঁর ছন্দ ভাষা ভাব সবেতেই বেশ বেগ আছে। ত্রুটি যা-কিছু আছে তা কখন কখন সেই বেগের অযথা আতিশয্য। নজরুল, মোহিতলালের প্রভাব তিনি এড়াতে পারেন নি বটে কিন্তু সে প্রভাবকে নিজের বৈশিষ্ট্যের পথে ফেরাতে পেরেছেন বলে মনে হয়।”

দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে এই প্র-আদ্যক্ষরবিশিষ্ট ব্যক্তিটি হলেন প্রণবদেব মুখোপাধ্যায়, ‘ধূপছায়া’ পত্রের অন্যতম কর্মসচিব যিনি ‘শনিবারের চিঠি’র বিরুদ্ধে জীবনানন্দের আনুকূল্য করেছিলেন।

কল্লোলের পৌষ, ১৩৩৪ সংখ্যায় ‘ঝরা-ফসলের গান’ প্রকাশিত হয় শ্রী জীবনানন্দ দাশ নামে। আবার এর কিছুদিন পরেই ‘প্রবাসী’ মাঘ ১৩৩৪ এর ‘কবি’ কবিতায় পাওয়া যায় ‘দাশগুপ্ত’ পদবীর ব্যবহার। ‘প্রগতি’র পাতায় প্রথম দাশ পদবীর ব্যবহার ‘পরস্পর’ কবিতায়, ভাদ্র, ১৩৩৫এ।

‘পাখীরা’ কবিতাটি কল্লোলে প্রকাশিত হয় বৈশাখ ১৩৩৬এ।  পরে ‘ধূসর পান্ডুলিপি’র অন্তর্গত হয় কবিতাটি। বুদ্ধদেব বসু কবিতাটির প্রশংসা করলেও সজনীকান্ত দাস এই কবিতাটিকে এবার সরাসরি দেগেই দিলেন কল্লোল-মার্কা বলে। ‘শনিবারের চিঠি’তে লিখলেন,

‘কল্লোল-মার্কা অতি আধুনিক কবিতার একটি উদাহরণও এই সংখ্যায় পাওয়া যাইবে। এই কবিতার নাম ‘পাখীরা’। যদিও বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, “মনে পড়ছে ‘পাখীরা’ কবিতা প্রথম পাঠেই আমাদের পক্ষে রোমাঞ্চকর হয়েছিলো ‘স্কাইলাইটে’র জন্য, ‘প্রথম ডিমে’র জন্য, ‘রবারের বলের মতন’ছোটো বুকের জন্য, আর সেখানে ‘লক্ষ-লক্ষ মাইল ধ’রে সমুদ্রের মুখে মৃত্যু ছিলো বোলে....”(জীবনানন্দ দাশ, কবিতা, পৌষ, ১৩৬১)  

কল্লোলে কবিতা প্রকাশিত হলেও জীবনানন্দকে শুধুমাত্র ‘কল্লোলের কবি’ অভিধাতেই যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না, তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল তাঁর বহুমাত্রিক প্রকাশভঙ্গীতে। দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘জীবনানন্দ দাশ:বিকাশ প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে সরাসরিই উল্লেখ করেছেন,‘‘কল্লোলে’র কবি বলতে যা বোঝায় তা তিনি হয়ে উঠতে পারেন নি (যদিও প্রগতিকেরা তা হতে পেরেছিলেন, ‘বন্দীর বন্দনা’র যশ এমন কি নজরুলের, বা প্রেমেন্দ্রের পাশাপাশি পৌঁছেছিল, তার পাশে ‘নীলিমা’ বা ‘পাখীরা’ কবিতা চোখেই পড়ে না।)’  (পৃ: ৫০৫)। এর সপক্ষে প্রমাণ পাই ‘কবিতা’ স্মৃতি সংখ্যায় (পৌষ, ১৩৬১) অশোক মিত্রের ‘আমাদের কবি’ প্রবন্ধে যেখানে অশোক মিত্র লিখছেন,

‘ ‘প্রগতি’ ‘কল্লোলে’র উদ্দাম অধ্যায়ে জীবনানন্দের দিকে তাকাবার মতো অবসর কারো ছিল না। অনেক ব্যক্তিত্বশালী বিচিত্র পুরুষেরা তখন অঙ্গন মুখর করে ছিলেন : বরিশালের নির্জন আকাশ নিয়ে হিজিবিজি কল্পনা কাকলি তাই একপাশে চুপচাপ পড়ে থেকেছে।’

দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন যে কল্লোল জীবনানন্দের অন্যূন বারোটি কবিতা ছেপেছিলেন, তার পাঁচটিই চতুর্থ বর্ষে – প্রথম পরিচয়ের শুরুতে, কিন্তু কল্লোল জীবনানন্দের সমমনস্ক ছিল না। অজিত দত্ত লিখেছেন, ‘ওঁর কবিতা কল্লোল খুব বেশী পছন্দ করত না।’ (কবিতা লেখার কথা, দেশ, সাহিত্য সংখ্যা ১৩৭৯)

কল্লোলে প্রকাশিত জীবনানন্দের কবিতা (গোপালচন্দ্র রায় ও দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় কৃত তালিকা থেকে প্রাপ্ত)

নীলিমা ফাল্গুন ১৩৩২ পৃ: ১০১৬-১০১৭

বেদূঈন বৈশাখ ১৩৩৩ পৃ: ২৬-২৭

আঁধারের যাত্রী জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৩ পৃ: ১১২

মোর আঁখিজল আষাঢ় ১৩৩৩ পৃ: ১১৫

নাবিক শ্রাবণ ১৩৩৩ পৃ: ১৯৫-১৯৬

কোহিনূর কার্তিক ১৩৩৩ পৃ: ৩৯৬

শ্মশান পৌষ ১৩৩৩ পৃ: ৩৯৬

দক্ষিণা চৈত্র ১৩৩৩

সিন্ধু জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৪ পৃ: ১৩৫-১৩৭

ঝরাফসলের গান পৌষ ১৩৩৪ পৃ: ৬৮৬

আদিম ফাল্গুন ১৩৩৬ পৃ: ৮৮৮

পাখিরা বৈশাখ ১৩৩৬ পৃ: ৪৪-৪৫

 

‘ধূসর পান্ডুলিপি’র(১৩৪৩) ভূমিকায় জীবনানন্দ লিখেছিলেন,

‘...আজ যে সব মাসিক-পত্রিকা আর নেই – প্রগতি, ধূপছায়া, কল্লোল – এই বইয়ের  প্রায় সমস্ত কবিতাই সেই সব মাসিকে প্রকাশিত হয়েছিল একদিন।’ পত্রিকাগুলির না-থাকার কথায় যেন লেগে আছে সোনাঝরা দিনগুলিরও হারিয়ে যাওয়ার বিষাদ।

এই ছিল জীবনানন্দের ধূসর জগতে কল্লোলের স্থানাঙ্ক, যা নির্ণয়ে সর্বাধিক সহায়ক হতে পারে নলিনী চক্রবর্তীকে লেখা স্বয়ং জীবনানন্দেরই চিঠির অংশবিশেষ:

‘মানস পরিধি থেকে পূর্বজেরা তখন সরে গিয়েছেন খানিক দূরে, - অনেক দূরে, রবীন্দ্র, বঙ্কিম ও বাংলা সাহিত্যের প্রাক্তন ঐতিহ্যও ধূসরায়িত হয়ে গিয়েছিল বড় বড় বৈদেশিকদের উজ্জ্বল আলোর কাছে। বাংলা সাহিত্যে কল্লোল আন্দোলনের প্রয়োজন ছিল। সাহিত্য ও জীবনের ঘুরুনো সিঁড়ি দুয়ে মিলে এক হয়ে এক পরিপূর্ণ সমাজ-সার্থকতার দিকে চলেছে মনে হয়; কল্লোলের সাময়িকতা সেই সিঁড়ির একটা দরকারী বাঁক।’

তথ্যসূত্র:

১) জীবনানন্দ – গোপালচন্দ্র রায়

২) জীবনানন্দ দাশ:বিকাশ প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত - দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়

৩) কল্লোল যুগ – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

৪) জীবনানন্দ: জীবন আর সৃষ্টি – সুব্রত রুদ্র সম্পাদিত

৫) জীবনানন্দ দাশের কাব্যসমগ্র - দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত

৬) কবি জীবনানন্দ দাশ – সঞ্জয় ভট্টাচার্য