কবি ও লাভপুরের আশেপাশে - আমার চোখে তারাশঙ্করের গল্পভুবন

(১)

তারাশঙ্করের বহু কাহিনির শিল্পরূপান্তর ঘটেছে তাঁর নিজের হাতেই। তাঁর অনেক লেখা প্রথমে ছোটগল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও পরবর্তীকালে তার উপর ভিত্তি করে নির্মাণ হয়েছে উপন্যাস বা নাটক। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালী ঘূর্ণি’ এর অন্যতম উদাহরণ। এছাড়াও ‘রাইকমল’ ও ‘মালাচন্দন’ শিরোনামের দুটি ছোটগল্প একত্রিত হয়ে হয়েছে ‘রাইকমল’ উপন্যাস। ‘নুটু মোক্তারের সওয়াল’ গল্পটি অবলম্বন করে তিনি লিখেছিলেন, ‘দুই পুরুষ’ নাটক। ‘মা’ নামের ছোটগল্প থেকে তৈরি হয়েছিল ‘কালিন্দী’ উপন্যাস।

এরকম আরও আছে। তারাশঙ্করের সাহিত্যমানসের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল, তাঁর অসন্তুষ্টি। বারংবার তিনি নিজের লেখা সংশোধন করতেন। ‘গণদেবতা’ উপন্যাসখানি বই হিসেবে প্রকাশ করার সময় প্রথমদিকের কিছুটা অংশ বাদে বাকিটা প্রায় নতুন করে লিখেছিলেন।

‘কবি’ তারাশঙ্করের অন্যতম কালজয়ী সৃষ্টি। এই গল্পেরও একাধিক রূপান্তর ঘটেছে। ১৯৪০ সালে ‘কবি’ ছোটগল্প হিসেবে প্রকাশিত হয় ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়। পরে পাটনার ‘প্রভাতী’ পত্রিকায় ধারাবাহিক উপন্যাস হিসাবে প্রকাশিত হয়েছে। ‘কবি’র নাট্যরূপ দিয়েছিলেন তারাশঙ্কর নিজে। ছোটগল্পটি নিতাই ও ঠাকুরঝির নীরব প্রেমের আলেখ্য। উপন্যাসে বসন চরিত্রটি জুড়ে তাতে ভিন্ন রসের সঞ্চার ঘটেছে।

দীর্ঘকাল তারাশঙ্করের লেখায় স্থূলতার অভিযোগ ছিল। সাহিত্যিক হিসেবে যখন আর কারোর পক্ষে তারাশঙ্করকে অস্বীকার করা সম্ভব ছিল না তখনও কেউ কেউ বলতেন, ‘গল্প লেখে বটে, জমাটও বটে, কিন্তু বড় ‘লাউড’ অর্থাৎ স্থূল। সূক্ষ্মতার অভাব আছে।’

‘কবি’ সম্পর্কে তৎকালীন মূল্যায়নও মিশ্র। অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্য তারাশঙ্করের জীবনীতে লিখেছেন, ‘‘কবি’ গল্পটি সত্যিই উচ্চকোটির প্রেমের গল্প।’ অথচ বন্ধু সাহিত্যিক বনফুল ‘কবি’ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ভালগার’।    

কাহিনির শুরু, নিতাইয়ের কবি রূপে আত্মপ্রকাশের মতো নাটকীয় ঘটনা দিয়ে। নিতাইয়ের পূর্বপুরুষরা পেশাগতভাবে খুনী ও ডাকাত। ব্যতিক্রম কেবল নিতাই। সে পারিবারিক পেশায় থাকতে চায় নি তাই আপন গোষ্ঠীবর্গের কাছে তিরস্কৃত হয়ে গোষ্ঠী ত্যাগ করেছে। প্রথমে মান্দেরি করতে গিয়েছে গোঁসাইয়ের বাড়িতে। মান্দেরি করার অর্থ, গোরুবাছুর, গোয়ালের দেখভাল করা। পরে যখন আবিষ্কার করেছে গোঁসাই ধান চুরি করে, সে গোঁসাইয়ের সংশ্রব ত্যাগ করে রেল স্টেশনে মোট বওয়ার কাজ বেছে নিয়েছে।

তবুও নিতাইয়ের চিরকালের আকর্ষণ কবিগানে। কোথাও আসর বসলেই সেখানে হাজির হয় সে। স্বপ্ন, নিজেও কবি হবে। তারপর একদিন আত্মপ্রকাশের সুযোগ আসে। আর তারপর?  ‘ভদ্রজনে বলিল- এ একটা বিস্ময়। হরিজনে বলিল- নেতাই তাক লাগিয়ে দিলে রে বাবা।’

শেষপর্যন্ত কবি হিসেবে নিতাই স্বীকৃতি পেয়েছে। একটা ভ্রাম্যমাণ ঝুমুরদলের মূলগায়েন হয়ে মেলায় মেলায় ঘুরে বেড়িয়েছে। সন্ধ্যেবেলা মেলার চরিত্র দিনেরবেলার মিলনক্ষেত্রের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তখন বিনোদনের সময়। জুয়া, মদ ও নাচগানের আসর জমানোর সময়। রুচিসম্মত শিল্পের চেয়েও সেখানে বাহবা পায় অশ্লীল, যৌন সুড়সুড়ি দেওয়া খেউড়। সঙ্গে নাচ ও লাস্য। নর্তকীরা আসলে দেহব্যবসায়ী। এমনই পঙ্কিল পরিবেশের মাঝে নিতাইয়ের মানবিক ও প্রেমিক রূপটি, ঠিক যেন পাঁকের মধ্যে  ফুটে থাকা শতদল। সেই পরিবেশে নিতাইয়ের বাঁধা পদ যেন সমুদ্র মন্থন করে তুলে আনা অমৃত,

‘ভালোবেসে মিটল না আশ- কুলাল না এই জীবনে।

হায়, জীবন এত ছোট কেনে?’ 

(২)

আমার ছোটবেলার স্মৃতিতে বর্ষার গুরুত্ব অন্যতম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যখন পড়তাম, আমার গ্রীষ্মের ছুটি হতো না, হতো বর্ষায়। আমাদের চাষিপ্রধান গ্রাম। পাড়াটিও নির্ভেজাল কৃষকপল্লী। একটা নির্দিষ্ট সময়ে সাড়া জাগত ‘চাষ লেগে গেল’ অর্থাৎ ধান চাষ শুরু হল। তারপর হৈহৈ কাণ্ড, দিনরাত ব্যস্ততা। সেই ব্যস্ততা শেষ হতো ধান পোঁতা শেষ হলে। বলা হতো, ‘চাষ হয়ে গিয়েছে’। আমাদের পাড়া ছাড়িয়ে গ্রামের প্রান্তিক পল্লীটি ছিল বায়েনপাড়া। ওরা নারীপুরুষ নির্বিশেষে কৃষিশ্রমিক। ওরাই মূলত চাষের কাজ করে। যাকে বলা হয় কিরসেনি করা। কেউ কেউ বারোমেসে মান্দের। মনিববাড়ির গোরুবাছুরকে খেতে দেয়, স্নান করায়, গোয়াল পরিষ্কার করে। খেতখামার দেখে রাখে। মুনিব-কিরসেন; এপাড়ার একটি পরিবার এবং ওপাড়ার একটি পরিবারের দীর্ঘস্থায়ী বন্ধন। কিরসেনদের পারিশ্রমিক নানাভাবে নির্ধারিত হতো। মজুরি ছাড়াও এদের দিতে হতো বিড়ি ও আগুন। দিতে হতো স্নানের সময় তেল আর সারাদিনে তিনবেলার খোরাক। নিতান্ত হতদরিদ্র কিরসেন হলে অথবা কৃপণ মনিব হলে ওরা খোরাক না নিয়ে তার মূল্য ধরে নিত। 

সূর্যের আলো ফোটার আগেই বায়েনপাড়া থেকে আট দশজনের দল পৌঁছত বাড়িতে। আমাদের কাজ ছিল, তাদের গুনে গুনে বিড়ি আর দেশলাই কাঠি দেওয়া। বিড়ির সংখ্যা বয়স অনুযায়ী নির্ধারিত হতো। মহিলা শ্রমিকরাও ধূমপান করত। তাদের বিড়ির সংখ্যা পুরুষদের চেয়ে কম। হাল, লাঙ্গল আর আনুষঙ্গিক সামগ্রী নিয়ে ওরা চলে যেত মাঠে। বেলা নটা থেকে দশটার মধ্যে মাঠে মুড়ি পাঠাতে হতো। ওটা জল খাবার সময়। একএকজনের জন্যে একএকটা বড় জামবাটি ভর্তি মুড়ি, এক কোণায় আখের গুড় আর এক কোণায় আলুভাজা বা ডিঙ্গিলির (কুমড়োর) তরকারি অথবা কলাইসেদ্ধ। একটা গামছা পেতে তার মাঝ বরাবর বাটি রাখা হতো। বাটির উপর পরপর বাটিগুলো বসিয়ে গামছার কোনাগুলো বেঁধে দেওয়া হতো। খাবার বয়ে নেওয়ার কাজটি বাড়ির বালক করতে পারত, অথবা বাড়ির গরু চড়ানো রাখাল। গেরস্তবাড়ির মেয়েদের মাঠে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। জমির আলে বসে জল খেয়ে ওরা আবার নেমে যেত জমিতে। বাড়ি আসত দুপুর গড়িয়ে। লাইন দিয়ে হাত পেতে দাঁড়াত। আমরা, বাচ্চামেয়েরা আবার একটা কাজ পেতাম। দশানে (পলায়) মেপে মেপে সরষের তেল ঢেলে দিতাম ওদের হাতে। চান করে, ভাত খেয়ে ওরা আবার চলে যেত মাঠে। ফিরত সন্ধ্যেবেলা।

দিনভর হাড়ভাঙা খাটনি খাটলেও মানুষগুলোর বিনোদনের অভাব ছিল না। সেই বিনোদনের অন্যতম হল গান। ওদেরই তৈরি করা, আঞ্চলিক ভাষা ও আঞ্চলিক উচ্চারণে। সন্ধ্যেবেলা দেশি মদ সহযোগে আসর বসত ওদের পাড়ায়। দিনেরবেলাতেও কাজ করত হাসি-আমোদ সহযোগে। গলা ছেড়ে গান গাইত, বীজ মারত, ধান পুঁতত। বাবার কাছে শোনা, একটা গান সেই সময় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।

‘বাঁশপুর, বলাইপুর মাঝেতে কাঁদর,

মেয়েতে মোড়লি করে পুরুষে বাঁদর।’

লাইনদুটো ভালো করে লক্ষ করা যাক। যে অঞ্চলের মানুষ গানটি বেঁধেছে সেখানে দুটি প্রতিবেশী গ্রাম বাঁশপুর ও বলাইপুর। তাদের সীমানা একটি কাঁদর অর্থাৎ চওড়া খাল। যে খালগুলি বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্যে দিয়ে, গ্রামগুলির সীমানা ঘেঁসে গড়ে উঠেছিল জমিতে জলসেচের উদ্দেশ্যে। অর্থাৎ প্রথমে রইল ভৌগলিক বৃতান্ত। এরপর আসছে সময়কাল অর্থাৎ ইতিহাস। ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতা পৌঁছে গিয়েছে একজন মহিলার হাতে। আর, যে মেয়ের হাতে ক্ষমতা সে তার অধীনের পুরুষদের নিজের ইচ্ছে মতো নাচাবে, একথা বলাই বাহুল্য। অতএব পিতৃতন্ত্রের একটি চিরাচরিত মিথও এই গানে মজুত। আরও একটি অন্তর্নিহিত কটাক্ষ এই দুটি লাইনে আছে। ‘অতঃপর গাঁয়ে গাঁয়ে সমস্ত মেয়ে মোড়ল অর্থাৎ কর্তা হয়ে উঠবে। পুরুষরা তাদের কথায় উঠবে বসবে এবং বাঁদরনাচ নাচবে।’     

তারাশঙ্করের মতে, ‘দেশটাই কবির দেশ। কবি অনেক আছে, কবির কাব্য শুনবার লোকেরই বরং অভাব, শ্রোতা নেই। তাই আগের কালের কবিরা কাব্য রচনা করে তাতে সুর যোজনা করে নিজেকেই শুনাত।’ তিনিও পথে যেতে যেতে থেমেছেন। দেখেছেন। শুনেছেন, চাষ করতে করতে চাষা আক্ষেপ করে গাইছে ‘চাষকে চেয়ে গোরাচাঁদের মান্দেরি ভালো...’। এই গোরাচাঁদ, আর কেউ নয় স্বয়ং শচীমায়ের গোরা।

সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নানাবিধ সংকটের কথাই যে শুধু তারা তাদের গানে বলে, এমন নয়। বৈরাগ্য ও আধ্যাত্মিকতার মতো গভীর অনুভবের কথাও উঠে আসে ওদের গানে। সেকথা ধরা পড়েছে তারাশঙ্করের কাছে। হয়ত সেই কারণেই নিতাইয়ের মতো চরিত্র সৃষ্টি হয়েছে তাঁর হাতে।

(৩)

কবিয়াল হিসাবে নিতাইয়ের স্বীকৃতি পাওয়ার ঘটনাটি ঘটে তার গ্রামের চামুণ্ডার মেলায়। বলা হয়েছে গ্রামের প্রাচীন নাম অট্টহাস- একান্ন মহাপীঠের অন্যতম পীঠ। অর্থাৎ গল্পটি লাভপুরকেই পটভূমি করে তৈরি। লাভপুরের ফুল্লরাতলা একটি অন্যতম সতীপীঠ। তারই প্রাচীন নাম অট্টহাস। মাঘীপূর্ণিমায় ফুল্লরার মেলা শুধু লাভপুর নয়, লাভপুর সংলগ্ন অসংখ্য ছোট ছোট গ্রামগুলির অন্যতম উৎসব। এই উৎসবে এক সময় জমজমাট কবিগানের পালা হতো।

লাভপুর বাস-স্টপে নেমে রাস্তা পেরিয়ে সামান্য হেঁটে গেলেই রেললাইন। গল্পটি যে সময় রচিত তখন লাইন ছিল ন্যারোগেজ; ছোটলাইন। ফুল্লরাতলা যেতে লাইনটি পার হতে হতো স্টেশনেই। স্টেশনে একটা ছোট লাল অফিসঘর ছিল।

নিতাই যখন গোঁসাইয়ের বাড়ির মান্দেরি ছেড়ে আসে, তার প্রাণের বন্ধু ও গুণমুগ্ধ ভক্ত রাজা বায়েন তাকে আশ্রয় দেয় স্টেশন চত্বরেই। রাজা অর্থাৎ নিতাইয়ের রাজন ষ্টেশনে পয়েন্টসম্যানের কাজ করত। রাজার স্ত্রীর বোন একজন পনের-ষোল বছরের কিশোরী। তার পাশের গ্রামে বিয়ে হয়েছে। রাজা তাকে ডাকে ‘ঠাকুরঝি’। সেই সূত্রে নিতাইও ‘ঠাকুরঝি’ বলে। মেয়েটি রোজ দুধ বিক্রি করতে আসে। নিতাইয়ের দুধ এবং চায়ে আসক্তি। সে ঠাকুরঝির কাছে দুধ রোজ নেয়।       

প্রতিদিন ঠাকুরঝি নির্দিষ্ট সময়ে আসে। ঠিক যেন ঘড়ির কাঁটার মতো। তার অনেক আগে থেকে নিতাই চেয়ে থাকে রেললাইনের বাঁকের মুখে। মনে হয়, অনেকটা দূরে দুটো লাইন এক হয়ে হারিয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ তারপরে আর দৃষ্টি চলে না। নিতাই দেখে, ঠিক সেই জায়গায় সহসা একটা স্বর্ণবিন্দুর উদয় হয়। ক্রমে তা এগিয়ে আসে। যেন কাশফুলের মাথায় সোনার মুকুট। কিছুক্ষণের মধ্যে ঠাকুরঝি প্রকট হয়। ঠাকুরঝি দ্রুত হাঁটে। মাথায় ঝকঝকে করে মাজা পেতলের ঘটিতে দুধ আর হাতে একটা ছোট গেলাশ। নিতাইকে রোজের দুধ দিয়ে ঠাকুরঝি গ্রামের ভেতরে যায়। আবার ফেরে এই পথ দিয়ে। তখনও নিতাই চেয়ে থাকে ঠাকুরঝির ফেরার পথে। কোনোদিন ঠাকুরঝি, তার ঘরে এসে বসে দুদণ্ড। নিতাই চা করে। চা খেতে খেতে দুচারটে কথা হয়। নিতাই তার ভাবনার কথা, ধ্যানধারণার কথা বলে। নিতাইয়ের মুখের ভাষা শুনে, নিতাইয়ের কাব্য-প্রতিভা দেখে ঠাকুরঝি মুগ্ধ হয়ে যায়। নিতাইও একদিন আবিষ্কার করে তার গানের প্রেরণা আর কেউ নয়, ঠাকুরঝি। কিন্তু সে যে পরস্ত্রী। তাই নিতাই স্থির করে, পথের ধারেই সে ঘর বাঁধবে আর ঠাকুরঝির আসার পথের দিকে চেয়ে কাটিয়ে দেবে সারা জীবন। ঠিক সেই সময় তার মনে আসে দুটো লাইন,

‘ও আমার মনের মানুষ গো

তোমার লাগি পথের ধারে বাঁধিলাম ঘর।’

এর মাঝে ঠাকুরঝি অসুস্থ হয়। রাজার স্ত্রী বলে, ঠাকুরঝির উপর কারোর কুনজর পড়েছে। তাই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় কালীতলায় ওঝার কাছে। ঠাকুরঝি ঘোরের মধ্যে নিতাইয়ের নাম করে। রাজার স্ত্রী নিতাইকে গালমন্দ করলেও রাজা তাকে ঠাকুরঝিকে সাঙা করার প্রস্তাব দেয়। স্বামী-স্ত্রীর বনিবনা না হলে ছাড়াছাড়ি করে আবার বিয়ে করা (সাঙা) ওদের সমাজে নিন্দনীয় নয়। কিন্তু ঠাকুরঝির ঘর ভাঙতে  নিতাইয়ের মন সায় দিল না। সে চলে গেল একটা ঝুমুরের দলের সঙ্গে।

গল্পে রেললাইনের বাঁকের যে জায়গাটি বলা হয়েছে তাতে বোঝা যায়, ঠাকুরঝি আসত লাঘাটার দিক থেকে। লাঘাটার ওপাশের গ্রামটি দোনাইপুর। দোনাইপুরের কাছাকাছি একটি গ্রাম আছে, পশ্চিম কাদিপুর। মাঠে মাঠে রাস্তা। পশ্চিম কাদিপুরের একজন বয়স্ক মহিলার মুখে শুনেছিলাম, কম বয়সে ওরা, গ্রামের বৌরা সকালে সংসারের কাজ সেরে, চান করে, পরিষ্কার কাপড় পরে ঘটিতে দুধ নিয়ে লাভপুরের বাবুপাড়ায় বিক্রি করতে যেত। তারাশঙ্কর নিতাইকে কীভাবে তৈরি করেছিলেন তা তিনি বলেছেন ‘আমার সাহিত্য জীবন’এ, কিন্তু ঠাকুরঝির কথা বলেন নি। হয়ত ওই ভদ্রমহিলার পূর্ববর্তী প্রজন্মের কোনও বৌকে দেখে তিনি নির্মাণ করেছিলেন ঠাকুরঝিকে।

(৪)

নিতাই চরিত্রটি সৃষ্টি করার অনুষঙ্গে তারাশঙ্কর লিখেছেন, ‘আমাদের গ্রামে বাউড়ীদের মধ্যে, ডোমেদের মধ্যে কত কবি আছে। তাদেরই একজনকে নিয়ে আমার মানস সরোবরে স্নান করিয়ে আমার কবি উপন্যাসের নায়ক হিসেবে অভিষেক করেছি।’

প্রথম লাইনটি আজও অপরিবর্তিত। গ্রামের নিম্নবর্গের মানুষগুলির উৎসব গানকেন্দ্রিক। ভাঁজো, ভাদুগান, বোলানগান এসবই তথাকথিত অশিক্ষিত, অমার্জিত মানুষের রচনা। অনেক গানেই বিকৃত আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ। অনেক গান যৌনগন্ধী ও অশ্লীলতা দোষে দুষ্ট। তবে গানগুলি তাদের সমাজের ছবিকে সোজাসুজি তুলে ধরে।

এই প্রসঙ্গে ভাঁজোর একটি গান মনে পড়ে। ভাঁজো পরবের অনুষঙ্গে মেয়েরা প্রতীকীভাবে মালিনী হয়। ফুল সংগ্রহ করে, বিক্রি করে। সে রকম একজন মালিনীকে একজন পুরুষ বলছে,

‘সাধের মেলেনী লো সই,

সারারাত ফুল কুড়োলি ফুলের কুঁড়ি কই?’

এর মধ্যে যে একটি মানঅভিমান ও দাবীর গল্প আছে তা স্পষ্ট হয় মেয়েটির দেওয়া উত্তরে,

‘একটা ফুলের লেগে করো রভিমান,

 দুয়ারে লাগিয়ে দোব ফুলেরই বাগান।’

এই দুটি কলিতে কী সুন্দর প্রেমের দৃশ্য ফুটে ওঠে! ঠিক যেমন ঠাকুরঝির খোপায় লাল ফুল দেখে নিতাই গেয়ে ওঠে,

‘কালো চুলে রাঙা কোসোম হের হের নয়ন কোণে!’

আগের কলিটি সে পূর্বেই রচনা করেছিল, যখন দেখেছিল রাজন ‘কালো’ বলায় ঠাকুরঝি কষ্ট পেয়েছে। নিতাই বলেছিল, ‘আমি কিন্তু কালো ভালোবাসি, ঠাকুরঝি।’ তারপরই সে কলিটা বেঁধেছিল,

‘কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কাঁদ কেনে।’ 

একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। একবার বাড়ি গিয়েছি। বাড়ি গেলে, সুযোগ পেলে প্রতিবেশী কিছু গ্রামে আমি প্রতিবার যাই। আত্মীয়তার সূত্রে যাই। আত্মীয়তা না থাকলেও যাই। গ্রামে আমার ভাইদের কেউ বাইকে নিয়ে যায়। তাতে সময় বাঁচে। অনেক সময় কোথায় যাবো, সে পরামর্শ ওরাই আমাকে দেয়। কেউ আবার আক্ষেপ করে বলে, ‘বড্ড কাজের চাপ গো ছোড়দি, নাহলে আমিই তোমাকে অমুক গাঁটা ঘুরিয়ে আনতাম।

সেবারে একদিন লাভপুর গিয়েছি। ফিরতে দুটো বেজে গেল। যেই বাইক থেকে নেমেছি, একজন এসে বলল, ‘তুমি কোথায় ছিলে? একটু আগে আসতে পারলে না, লোকটা এইমাত্র চলে গেল!’

জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে রে?’

‘হঠাৎবাবুকে মনে আছে তোমার? সেই।’

আমরা যখন ছোট ছিলাম, লোকটা বহুরূপী সেজে আসত। তার সাজা নানা চরিত্রের মধ্যে আমাদের প্রিয় চরিত্র ছিল ‘হঠাৎবাবু’। লোকটার পেছন পেছন আমরা যেতাম, আর হাজারটা আজগুবি প্রশ্ন করতাম। লোকটাও আজগুবি উত্তর দিত। কথায় কথায় ছড়া কাটত।

আমরা জিজ্ঞেস করতাম, ‘হঠাৎবাবু তোমার বিয়ে হয়েছে? তোমার বৌয়ের নাম কী?’

সে উত্তর দিত, ‘হঠাৎবাবুর বৌয়ের নাম? ‘আচমকা’।’

শুনলাম, বয়সের ভারে তার শরীর অশক্ত। আর ঘুরে ঘুরে বহুরূপী দেখাতে পারে না। হাটেবাজারে একটা মুখোশ পরে, ছড়া বলে বলে ভিক্ষা করে।

পরদিন ভোররাতে বেরবো। বিকেলে কাকার মান্দেরকে বললাম, ‘একটা ভাদুগান শোনাবে কাকা? ভিডিও করতাম।’ পুরনো লোক। আমাকে শিশু বয়েস থেকে দেখেছে। বলল, ‘কেনে শোনাব না? কিন্তু এইরকম করে তো হবে না। দল ছাড়া, বাজনা ছাড়া হয়? তুমি এতদিন পরে এসেছ, শুনতে চাইছ! আমি চললাম। মাঠে ধান কাটছে ওরা, ওদিকি খবর দিই গা।’

সন্ধ্যে হতেই সে দলবল নিয়ে হাজির। তারপর জমে উঠল আসর। পরপর গান গেয়েই যায়। প্রথমে ভাদুর বন্দনা। তারপর সাম্প্রতিককালের সমস্যা নিয়ে গান। বাজারদর নিয়ে একটি গান, একটি গান করোনা নিয়ে। সেই গানে করোনার উৎসস্থল, রোগের উপসর্গ, প্রতিরোধের বিধান, সাধারণ মানুষের ভোগান্তি এবং সরকারের ভূমিকা সব কিছু মজুত। যেন এ সময়ের আস্ত একটা দলিল। একটা করে গান শেষ হয় আর জিজ্ঞেস করে, ‘বলো এবার কী শুনবে?’

শ্রোতায় ভরে গিয়েছে উঠোন। শ্রোতাদের মতো ওরাও মজে গিয়েছে। এমন সময় ওরা ধরল পাঁচালি। এই গানগুলি সবচেয়ে জনপ্রিয়। অনেকটা কবির লড়াইয়ের মতো। প্রথমে হল দু-কাটাকাটি পাঁচালি। একটা পৌরাণিক কাহিনিকে কবিগানের আদলে দুজন নাটকীয় ভাবে পেশ করল। দুজন চরিত্র, তারা মূলগায়েন। একটা করে লাইন বলে, সেটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দোহাররা একসঙ্গে গায়। ওরা শোনাল শিব-দুর্গার একটা গল্প। কিহিনি পুরাণের হলেও, প্রয়োগ আঞ্চলিক। দুর্গা বাগদীর মেয়ে। বাবার নাম গিরি বাগদী। নেশাভাঙ করা স্বামীর জ্বালায় সন্তান প্রতিপালনের জন্যে সারাদিন বিলে মাছ ধরতে হয় তাকে। তার চরিত্র পরখ করতে স্বয়ং শিব ছদ্মবেশে এসে কুপ্রস্তাব দেয়। শেষপর্যন্ত দুর্গার কাছে শিবের ছলচাতুরি ধরা পড়ে যায়।

ওরা শুধোয়, ‘এবার?’

বলি, যা ইচ্ছে শোনাও।

ওদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন। কিছুটা দ্বিধা যেন! একজন গলা ঝেড়ে বলল, ‘ধরো গো, আমাদের নিজের মতোই ধর দেখি।’

শুরু হল তিন-কাটাকাটি পাঁচালি। শাশুড়ি-বৌয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধ। ছেলে মাঝে মাঝে ফোড়ন দেবে। প্রথমে মিনিট দুএক ঢোল বাজল। দ্রুতলয়ে, বার কয়েক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শাশুড়ির আক্ষেপ দিয়ে শুরু হল গান, ‘হল না গো হল না, মনের মতো হল না।’

ঢোলের বাজনার লয় স্তিমিত হল। শাশুড়িও ধীর লয়ে গাইল,

‘ছেলে আমার শুনলে না গো করেছে বিয়ে

এমন বৌ আনলে ঘরে পাশ করা মেয়ে!’

পাশ করা শিক্ষিত বৌ, তাও ছেলে আর মেয়ে যদি পরস্পর পরস্পরকে নির্বাচন করে সে কি খুব বেশি পরিবারে মনের মতো হয়? ওদের সমাজেও হয় নি।

বিয়ের পর ছেলের বৌ এসে ছেলের মাথাটি পরিপূর্ণভাবে খেয়ে তাকে কামাখ্যার ভেড়ায় পরিণত করে। কি শহর, কি গ্রাম এ এক বহুল প্রচলিত মিথ। গ্রামাঞ্চলে বৌরা স্বামীদের পরিণত করে গোরুতে। অতঃপর একটি পঙক্তি আসেঃ     

শাশুড়িঃ      বেটাকে করেছে গোরু কেমন দেখ না

বৌকে ছেড়ে বেটা আমার থাকতে পারে না।

বৌমাঃ      কী বলব ও শাশুড়ি চম্বুকে টান

সদাই কাঁদে পরাণ।

বৌমার এমন অকপট স্বীকারোক্তি বাস্তবে না থাকলেও গানে আছে। শ্রোতারা না হেসে পারে?

একটা সময় শাশুড়ি কোণঠাসা হয়ে ভয়ানক বাক্যবান প্রয়োগ করে। এও বহুল ব্যবহৃত অস্ত্র। একেবারে আঁতে ঘা।  

শাশুড়িঃ      দুবছর হয়েছে বিয়ে কেমন দেখ না

          এর মধ্যে তিনটে ছেলে লজ্জা লাগে না।

বৌমাঃ      আমাকে গঞ্জনা তুমি দিছ কেনে

          তোমার বেটা জানে।

দীর্ঘ গান চলতে লাগল। দেখলাম গানগুলো একটা খাতায় লেখা। প্রতিটি গানের ভনিতায় স্রষ্টার নাম। ওরা বলে, মাষ্টার। দুটো নাম চোখে পড়ল। চন্দ্রশেখর এবং  রাধাকান্ত। জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় বাড়ি? গ্রামের নাম শুনে যেই তাকিয়েছি, চোখে পড়েছে, শ্রোতামণ্ডলীর মধ্যে একজন ওই মাষ্টারের গ্রামের। জিজ্ঞেস করলাম, চিনিস নাকি লোকটাকে?

বলল, ‘কেন চিনবা না? আমাদের গরু চড়ায়। গো’ল কাড়ে।’ গো’ল কাড়ে অর্থাৎ গোয়ালঘর পরিষ্কার করে। সোজা কথায় মান্দেরি করে। 

অঙ্ক মিলে যাওয়ার মতো কেমন যেন মিলে গেল। সময় পালটেছে কিন্তু সমাজ পালটেছে কি? ‘কবিয়াল’ স্বীকৃতি পেয়ে নিতাই স্থির করেছিল, সে আর কুলিগিরি করবে না! শখের দুধ, চা বর্জন করবে। প্রয়োজনে একবেলা না খেয়ে থাকবে, তবুও না। ও কাজ আর সে কী করে করে, সে যে কবি!

জীবনধারণের জন্যে মনেপ্রাণে কবি হয়েও উঞ্ছবৃত্তি থেকে মুক্তি পায় নি আজও কত নিতাই! তবুও তারা কবিতা, গান, সুর সৃষ্টি করে চলেছে। হয়ত অনন্তকাল করে যাবে। মানুষের ভেতরের শিল্পীসত্ত্বা বা কবিত্ব পেশা মানে না। সৃষ্টির মধ্যেই তার আনন্দ। সৃষ্টিতেই তার মুক্তি।