ভূমি ভাষা ভবিষ্যতের কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়

‘‌‘প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য/‌ ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,/চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য/কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া” পদাতিক কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘মে-দিনের কবিতা’র এই চারটি পংক্তি চিহ্নিত করে একটা বিশেষ যুগ-কে, এক বিশেষ সময়-কে। রাজনীতি আর কবিতা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। সমসাময়িক একাধিক কবির স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের কাহিনি। সদ্য ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেই যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। দলের কাজে তিনি গ্রামবাংলা চষে বেড়িয়েছেন। গরিব মানুষদের সঙ্গে দিন কাটিয়েছেন। তাদের নিয়ে অসংখ্য গদ্য লিখেছেন। দল ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। দলের প্রচার ও প্রসারের কাজে সংসারের সুখশান্তির দিকে ফিরে তাকানো আর হয়ে ওঠেনি এই প্রবাদপ্রতিম কবির। বাংলাদেশের রাজশাহী শহরের এক তরুণ গবেষক হাসিবুল ইসলাম সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে গবেষণা করবেন বলে মনস্থির করেন। কাজে নামার পর বিভাগীয় গবেষণা-তত্ত্বাবধায়ক কবি আবু হেনা মোস্তফা কামালের নির্দেশে তিনি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে কিছু দরকারি প্রশ্ন ও তাঁর প্রকাশিত বইগুলির তালিকা চেয়ে একটি চিঠি লেখেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে ত্বরিত ও ইতিবাচক উত্তর দেন ১ নভেম্বর ১৯৭২ তারিখে। উল্লেখ্য, মাসখানেক বাদে কলকাতায় তাঁদের সাক্ষাৎ হয়েছিল। পরে হাসিবুল ইসলাম ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়: কবি ও কবিতা’ শিরোনামে নিজের স্নাতকোত্তর অভিসন্দর্ভটি জমা দিয়ে ডিগ্রিলাভ করেন। সম্ভবত বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে বিদ্যায়তনিক পর্যায়ে এটিই প্রথম গবেষণা।হাসিবুল ইসলামকে লেখা সেই চিঠিটি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবনের বেশ কিছু গুরূত্বপূর্ণ তথ্যের বাহক। চিঠিতে সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘‘নওগাঁ শহরের জীবন আমার ব্যক্তিত্বের গোড়া বেঁধে দিয়েছিল।’’ কবির ছেলেবেলা কেটেছে রাজশাহীর নওগাঁয়। নওগাঁ শহরটি ছিল চাকরি, ব্যবসা, নানা বৃত্তিতে রত বহিরাগতদের উপনিবেশ। হিন্দু-মুসলমান এবং বাংলার নানা অঞ্চলের মানুষজনদের মেলানো-মেশানো দিলদরাজ আবহাওয়ায় মানুষ হয়েছিলেন। চিঠিতে লিখেছিলেন,
“আমরা বড় হয়েছিলাম স্বাধীনতাসংগ্রামের আবহাওয়ায়। ব্রিটিশ শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে আমাদের মধ্যে ছিল প্রচণ্ড জ্বালা। তারপর আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম শোষকশ্রেণির কোনো জাত নেই। জাতীয়তাবাদ তাদের কাছে মুখোশমাত্র। যখন পড়ে-শুনে একটু চোখ খুলল, তখন আমরা হলাম সেকালের রাগী ছোকরা। পুরোনো মূল্যবোধে আস্থা হারালাম, দেবদ্বিজে ভক্তি উবে গেল। কাউকে মানি না, কিছুতে বিশ্বাস নেই, সমস্ত ব্যাপারেই সন্দেহ—এই রকমের একটা ভাব। ভাঙার দিকেই একান্ত ঝোঁক। এই সময় পেলাম মার্ক্সবাদের খোঁজ। জগৎকে নতুনভাবে দেখতে শিখলাম। বিপ্লবের রাজনীতিকে ব্রত করলাম। লেখা ছেড়ে আন্দোলনে ডুবে গেলাম। এই ব্রতী জীবন আবার আমাকে লেখার রাজ্যে ভাসিয়ে তুলল। তারপর অনেক অভিজ্ঞতা, অনেক ঘাত-প্রতিঘাত। ঠেকেছি শিখেছি। কিন্তু বিশ্বাস হারাইনি।”
বামপন্থার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বামপন্থী’ শব্দটা আমার কাছে খুব সন্তোষজনক নয়। ইংরেজদের সংসদীয় ব্যবস্থায় এটা সরকারের বিরোধীপক্ষকে বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা হতো। আমাদের দেশে এখন ‘বামপন্থী’ বলতে বোঝায় সমাজতন্ত্রবাদী। কিন্তু তার মধ্যে প্রচুর ভেজাল। আমার রাজনৈতিক ভাবনা এবং দলের দলী হওয়ার ক্রমবিকাশ ঘটে সংক্ষেপে এইভাবে: গোড়ায় জাতীয়তাবাদের অনুগামী। ক্রমশ গান্ধীবাদে অনাস্থা, সন্ত্রাসবাদে ঝোঁক, পরে গণ আন্দোলনে আস্থা। ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে বামপন্থীদের সঙ্গে সংযোগ। বামপন্থার সূত্রে মার্ক্সবাদে দীক্ষা। মার্ক্সবাদের সূত্রে শ্রমিক আন্দোলনে (ডক শ্রমিক) যোগ দেওয়া। প্রথমে লেবার পার্টি, পরে কমিউনিস্ট পার্টি। আমার পদাতিক লেখা হয় যখন আমি শ্রমিক আন্দোলনে নবাগত।” চিঠিটিতে মিলেছে তাঁর তখনকার জীবনযাপন-সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা ও দুশ্চিন্তামাখা উদ্বেগের প্রসঙ্গও—
 
“ঠিক এই মুহূর্তে আমি একটু অব্যবস্থিত অবস্থায় আছি। একটা আংশিক সময়ের কাজ ছিল, অবস্থাচক্রে সেটা ছাড়তে হয়েছে। এক মাসের সংস্থান আছে। তারপর সংসার অচল। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এই অনিশ্চয়তা আমার জীবনের সঙ্গী।”
 
‘পদাতিক’ থেকে ‘অগ্নিকোণ’ পর্যন্ত বিশেষ এক ধরনের টান ছিল৷ তাঁর স্পর্ধায়, দীপ্তিতে, ঋজুতায়৷ কিন্তু পরবর্তী দীর্ঘকালের কবিতায় এক মমতাময় চোখে দেখা গোটা জীবন আমাদের সমস্ত দিক থেকে জড়িয়ে ধরে৷ সেখানে জীবন আর সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা একাকার হয়ে যায়৷ তাঁর কোনও কোনও কবিতা যেন টুকরো টুকরো অনেক ছবির কোলাজ। ধরা যাক, তাঁর সেই আইকনিক ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক’ কবিতাটির কথাই—
 
“লাল কালিতে ছাপা হলদে চিঠির মতো/আকাশটাকে মাথায় নিয়ে/এ-গলির এক কালোকুচ্ছিত আইবুড়ো মেয়ে/রেলিঙে বুক চেপে ধ’রে/এই সব সাত-পাঁচ ভাবছিল—/ ঠিক সেই সময়/চোখের মাথা খেয়ে গায়ে উড়ে এসে বসল/আ মরণ! পোড়ারমুখ লক্ষ্মীছাড়া প্রজাপতি!/তারপর দড়াম করে দরজা বন্ধ হবার শব্দ।/অন্ধকারে মুখ চাপা দিয়ে দড়িপাকানো সেই গাছ/তখনও হাসছে।”
 
জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া মানুষগুলোর কাণ্ডকারখানা দেখে সস্নেহ হাসি যেন হাসেন এখানে কবি নিজেই। শান-বাঁধানো ফুটপাথে পাথরে পা ডুবিয়ে পাঁজর ফাটিয়ে হাসতে থাকা কাঠখোট্টা গাছটি আসলে সেই মানুষগুলোর প্রতীক, যারা জীবনে হাজারবার ঠোক্কর খেয়েও হাল ছাড়তে চায়নি। তাঁর কবিতায় দেখা পেয়েছি সেই এক ঘোর বিষয়ী বোকা মানুষের, ‘বাঁদিকের বুক-পকেটটা সামলাতে সামলাতে’ যে ইহকাল-পরকাল গোল্লায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। তারপর ‘‘দু-আঙুলের ফাঁক দিয়ে/কখন/খসে পড়ল তার জীবন/লোকটা জানলই না।”
 
২০১৮ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি ‘এইসময়’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় কবি শঙ্খ ঘোষের একটি সাক্ষাৎকার। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবনের অনেক অজানা তথ্য ও তাঁর কবিতার একটি মনোগ্রাহী পর্যালোচনা এই সাক্ষাৎকারটিতে পাওয়া যায়। শঙ্খ ঘোষের কথায়,
"যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে কবিতার জগতে আমরা দেখেছি, সত্য অর্থে তাঁর কোনও পূর্বসূরি নেই৷ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা মূলত দেশকে ভালোবাসার, ভাষাকে ভালোবাসার, জীবনকে ভালোবাসার কবিতা৷ এর সঙ্গে হয়তো আরও একটু বলা যায় - ভবিষ্যৎকে ভালোবাসার কবিতা৷ কোনও একটা সাক্ষাৎকারে সুভাষদা বলেছিলেন, তিনটে ‘ভ’-এর কথা- ভূমি, ভাষা, ভবিষ্যৎ৷ এক আশ্চর্য সারল্য নিয়ে যে ভাবে তাঁর কবিতা পাঠকের কাছে এসে পৌঁছয়, তার কোনও পূর্বাপর নেই৷"
 
‘পদাতিক’ কাব্যগ্রন্থের ‘অতঃপর’ কবিতাটিতে সুভাষ মুখোপাধ্যায় সরাসরি লিখেছিলেন ‘ভারতবর্ষে একচেটিয়া নেতা গান্ধী’। এ প্রসঙ্গে শঙ্খ ঘোষকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানিয়েছিলেন,
"সমসাময়িক কোনও ব্যক্তিবিশেষের নাম ব্যবহার করায় কবিতার একটা সমস্যা আপনিই তৈরি হয়৷ অনেক দিন পরে ‘মুখুজ্যের সঙ্গে আলাপ’ কবিতায় ছিল ‘ভবিষ্যৎ কথা বলছে , শোনো / ক্র‌ুশ্চেভের গলায়৷ এ কবিতাও আমার একটি ভালোলাগা কবিতা, তা নিয়ে সুভাষদার সঙ্গে কথা বলতে বলতে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এখানে ক্র‌ুশ্চেভ নামটা ব্যবহার করা কি ঠিক হল? একদিন লিখেছিলেন - কমরেড স্ট্যালিন, তুমি সুখে নিদ্রা যাও, এখন বলছেন ক্র‌ুশ্চেভ, ক’দিন পরে তাও পাল্টে যেতে পারে৷’ নানা সময় জুড়ে পথচলতি কথাবার্তায় নানা ধরনের প্রশ্ন আমি অনেক বারই করেছি সুভাষদাকে৷ ওঁর মতো করে একটা কোনও উত্তরও উনি দিয়েছেন৷ কিন্তু এই প্রথম কোনও উত্তর না দিয়ে খানিক নীরবতার পর ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে গেলেন৷ উত্তর একটা পেয়েছিলাম আমি, অনেক দিন পরে, তাঁর ‘চিঠির দর্পণে’ নামে বইটির মধ্যে৷ লিখেছিলেন, কথাটা মিথ্যে হয়ে গেলেও আমাদের সেদিনকার স্বপ্ন আর আবেগটা তো আর মিথ্যে ছিল না৷ বস্তুত, কবিতা শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে স্বপ্ন আর আবেগের উপরেই৷ বস্তু তথ্যের উপরে নয়৷" ‘অতঃপর’ কবিতাটির প্রসঙ্গেই শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন "এই কবিতায় শব্দ আর ছন্দ ব্যবহারের যে অসামান্য মুন্সিয়ানা আছে, আর সেই একই সঙ্গে আছে সে মুন্সিয়ানাকে প্রচ্ছন্ন রাখবার ক্ষমতা৷ সেটাই আমার কাছে এ কবিতার স্মরণীয়তার একটা কারণ৷ কবিতাটা দেখলে মনে হয়, ছোটো ছোটো অনুচ্ছেদে ভাগ করা, গদ্যে লেখা একটি চিঠি৷ একটু নজর করে পড়লে টের পাওয়া যাবে, সমস্তটাই নিখুঁত অক্ষরবৃত্তে সাজানো৷ কিন্তু তারই সঙ্গে কবিতাটাতে আছে নিয়মিত পঙ্ক‌তিগত একান্তর মিল৷"
‘চীন: ১৯৪১’ নামক কবিতাটিকে ‘ক্যানেস্তারা-পেটানো পদ্য’ বলে দাগিয়ে দিয়ে বুদ্ধিজীবী অমলেন্দু বসু বলেছিলেন,
“গণ বক্তৃতার rhetorical declamatory style—অতি অলঙ্কৃত, স্ফীতকন্ঠ রচনাশৈলী—সেটাই যেন ‘পদাতিকে’র পরপর্যায়ী কাব্যের প্রধান শৈলীতে দাঁড়িয়েছে।’’ অধ্যাপক রবিন পালের মতে, “মাঝে মাঝে সব দেশের কবিরাই সময়ের তাগিদে এমন চড়াগলার কবি হয়ে ওঠেন। এটাই, চীৎকৃত ‘উচ্চারণই’, হয়ে ওঠে জরুরী।” (পরবাস-৭০, ৩১ মার্চ ২০১৮) অধ্যাপক রবিন পালের মতে, “মাঝে মাঝে সব দেশের কবিরাই সময়ের তাগিদে এমন চড়াগলার কবি হয়ে ওঠেন। এটাই, চীৎকৃত ‘উচ্চারণই’, হয়ে ওঠে জরুরী।” কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বলেছিলেন, “সুভাষ-প্রতিভাকে রাজনীতি উদরস্থ করে ফেলেছে।”
 
“আমরা গাঁয়ের/আমরা শহরের/হাড়কালি মানুষ৷/চলেছি মিছিলে৷/হাতে কী?/নিশান৷/কোথায় যাও?/দমন রাজার/দরবারে৷/থামো -না৷/বাধা দিলেও- না৷/সঙিনে বিঁধলেও -না৷/রাস্তা দাও৷/আমাদের যেতেই হবে৷/মিছিলে৷৷” ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এই কবিতাটি ঘিরে অনেক অভিযোগ উঠে এসেছিল। মিছিল নিয়ে যে সব স্মরণীয় উত্তেজক কবিতা এর আগে লিখেছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, তার তুলনায় এ কবিতা অনেক নিষ্প্রভ। প্রশ্ন উঠেছিল, ‘এর মধ্যে কবিতা কোথায়?’ কবি শঙ্খ ঘোষের মতে, এখান থেকেই কবিতার নতুন ভাষা ও আঙ্গিকের জন্ম তাঁর হাতে৷ এক হিসেবে সেইখান থেকেই হয়তো শুরু হয়েছিল ‘ফুল ফুটুক’ পর্যায়ের কবিতার সম্ভাবনা।
 
অমলেন্দু বসুর মতো একজন রসজ্ঞ মানুষও সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ফুল ফুটুক’ পর্যায়ের কবিতা পড়ে প্রকাশ্যেই হতাশা জানিয়েছিলেন৷ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের গুরুপ্রতিম সোমনাথ লাহিড়ী, তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়কেও তীব্র বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখা গেছে৷ কবিতাটি ছিল, ‘মুখখানি যেন ভোরের শেফালি /নেমে গেল এক্ষুনি /দু-অধরে চাঁদ একফালি /নেমে গেল এক্ষুনি…’৷ একজন ‘বিপ্লবী’ কবি এ সব কেন লিখবেন, এই ছিল ওঁদের অনুযোগ৷ রাজনীতি থেকে কবিতায় আসা মানুষ বলে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে এই ধরনের গঞ্জনা নানা সময়ে নানা দিক থেকে শুনতে হয়েছে বলে জানান কবি শঙ্খ ঘোষ। ১৯৫০-এর দশকের ‘ফুল ফুটুক’-এর পর থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবিতা হয়ে উঠেছে আরও বেশি বহির্মুখী। ব্যঞ্জনহেড়িয়ায় একজন দলীয় কর্মী হিসেবে শ্রমিকদের মধ্যে থাকার সময়েই বস্তুত তত্ত্বের বাইরে থেকে জীবনযাত্রার ছবিকে দেখতে পেয়েছিলেন তিনি৷ আর তারই জন্য তৈরি হতে পেরেছিল ‘সালেমনের মা’-র মতো কবিতা৷ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় বদলের আভাস প্রথম পাওয়া গিয়েছিল ‘অগ্নিকোণ’-এর ‘মিছিলের মুখ’ কবিতাটিতে৷ সেখানে ছিল একটিমাত্র মুখের কথা৷ তারপর সে মুখ অগণ্য মুখ হয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল ‘ফুল ফুটুক’ পর্যায়ের কবিতাগুলিতে৷ আর সেই যে শুরু হল, তার যেন আর শেষ নেই৷ তবে একটা কথা এখানে মনে রাখা দরকার ‘ফুল ফুটুক’ পর্যায়ের জীবন-ঘনিষ্ঠতার আগেও বাংলাকে তিনি দেখেছিলেন গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরেই৷ রিপোর্টাজ তৈরি করবার গরজে৷ তা থেকেই তৈরি হয়ে উঠেছিল ‘আমার বাংলা’ নামে তাঁর আশ্চর্য বইখানি, যা একইসঙ্গে জীবনছবি আর গদ্যরীতির জন্য স্মরণীয় হয়ে আছে৷ সেই দেখার আর গদ্যের ভিতটাও ‘ফুল ফুটুক’ পর্যায়ের কবিতাগুলিকে সম্ভবপর করে তুলতে পেরেছিল বলে অনুমান কবি শঙ্খ ঘোষের।
১৯৬০ সালে ‘যখন যেখানে’ গদ্যগ্রন্থটির ভূমিকায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘‘রং-বেরঙের টুকরো কাপড়। জোড়া দিলে হয় বাউলের আলখাল্লা। নিজেদের মধ্যে তাদের যত বৈসাদৃশ্যই থাকুক, বাউলের জীবনই তাদের এক জায়গায় মিলিয়ে দেয়।.. এ বইতেও যদি পায়ের ধুলোয় সেই অমিলের মিল পাওয়া যায়, তা হলেই লেখক খুশি।’’ এখানেই সমালোচকদের দেওয়া তাঁর সম্পর্কে ‘অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াশীল’, ‘জনবিচ্ছিন্ন’, ‘দিকভ্রষ্ট’ তকমাগুলি ধোপে টেকে না। ‘সহজিয়া’ শব্দটাই হয়তো সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে অনুধাবনের মূল চাবিকাঠি বলে মনে করছেন অভীক মজুমদার। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর একটি প্রবন্ধে তিনি বলেন,
‘‘পার্টি এবং তার মধ্যমেধার হাতে অপমানিত হয়েছেন বারংবার, ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন তার চেয়েও বেশি। অর্থকষ্ট, অসম্মান, অনটন কাঁধে নিয়েই কন্যাদের পালনের দায়িত্ব নিয়েছেন, বৈভবহীন অনাড়ম্বর জীবন কাটিয়েছেন আর বইয়ের নাম দিয়েছেন ‘ফকিরের আলখাল্লা’। সে-ও তো পথে পথে ‘সহজিয়া’ গান শোনানোর বৈরাগী মূর্তি!’’ তিনি আরও বলেন, “পায়ে চলা পথের সঙ্গ-অনুষঙ্গে তাঁর সমস্ত কবিতা-গদ্য-ছড়া-কথাসাহিত্য মায় তর্জমাও গ্রথিত.. একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর গ্রন্থনামে ফিরে ফিরে আসে এই চলাচলের প্রসঙ্গ।..‘পদাতিক’ দিয়ে শুরু। তার পর ‘যত দূরেই যাই’, ‘একটু পা চালিয়ে ভাই’, ‘যা রে কাগজের নৌকো’। এমনকি ‘একবার বিদায় দে মা’ বললেই অব্যক্ত ‘ঘুরে আসি’ কথাটা শোনা যায়। ‘জল সইতে’ বা ‘ছড়ানো ঘুঁটি’ নামেও তো সেই পথবিলাসের সুমধুর ইশারা।.. হয়তো সে কারণেই তাঁর কবিতায় এত সমাসোক্তি অলঙ্কার, এত জড়ের স্থবির অস্তিত্বে প্রাণস্পন্দন। পথ জীবন্ত, পথের দৃশ্য জীবন্ত, গাছপালা তো বটেই, এমনকি পাথর-নদী-পাহাড় কিংবা রোদ্দুর-মেঘ-বৃষ্টি সবাই জীবন্ত চরিত্র। একটা জীবন এই সব হরেক প্রাণস্পন্দনকে সঙ্গে নিয়ে চলমান রইলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়।”
প্রায় একই অভিমত অধ্যাপক রবিন পালেরও, ‘‘সুভাষের কবিতায় রাস্তা বা পথের মেটাফর চলে আসে নানা ভাবে।” ‘ফুল ফুটুক’ কাব্যগ্রন্থের ‘এক অসহ্য রাত্রি’ কবিতায় পাচ্ছি—
 
“কী এক গভীর চিন্তায়/কপাল কুঁচকে আছে/চড়িয়ালের রাস্তা।” ‘যতদূরেই যাই’ কাব্যগ্রন্থের ‘রাস্তার লোক’ কবিতায় দেখা যাচ্ছে— “মাথায় লাঠির বাড়ি খেয়ে পড়ে-যাওয়া/গাঁয়ের হাড়-জিরজিরে বুড়োর মতো
রাস্তাটা/একদৃষ্টে তার মুখের দিকে চেয়ে রয়েছে।” ‘পদাতিক’ কবি সুভাষ কার্যত পথে নামেন, জনতার ভিড়ে দাঁড়িয়ে ক্রমশ তাঁর কন্ঠে উচ্চারিত হয়— “রাস্তাই একমাত্র রাস্তা”।
 
সাধারণ মানুষের মুখের কথার, সাবলীল প্রবাদ প্রবচনের যে কতখানি জোর, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা না পড়লে তা বোঝাই যায় না৷ একেবারে শেষ জীবনে পৌঁছে ‘মুখনাড়া’ কবিতাটিতে এ রকমও তিনি অনায়াসে লিখতে পেরেছিলেন—
“দেয়াল ধ’রে আবার সেই/হাঁটি হাঁটি পা-পা,/এখন শুধু হামা দেওয়া বাকি৷/ঠাকুরের ভক্ত একজন/আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেল/যিনি দিয়েছেন/তিনিই সব একে একে ফিরিয়ে নিচ্ছেন৷/আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিল-/কালীঘাটের কুকুর হওয়ার ভয় নেই?” ‘যত দূরেই যাই’ কাব্যগ্রন্থের ‘মেজাজ’ কবিতায় “মিনসের আক্কেলও বলিহারি!/কোত্থেকে এক কালো অলক্ষুণে/পায়ে ক্ষুরঅলা ধিঙ্গি মেয়ে ধরে এনে/ছেলেটার গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে চলে গেল”
কিংবা ‘একটু পা চালিয়ে ভাই’ কাব্যগ্রন্থের ’হিংসে’ কবিতায় ‘‘মুখপুড়িটা তাকাচ্ছে, দ্যাখ!/বলছে, আ মর মিনসে—” অথবা ‘ছড়ানো ঘুঁটি’ কাব্যগ্রন্থের ‘বারোটা বাজার পর্বে’ কবিতার পংক্তিতে এসেছে বহুল প্রচলিত বাংলা প্রবাদ ‘‘বিধিমতে যথাকালে যা কিছু করার ছিল/হয়েছে সমাধা,/সাতমণ তেল পুড়েছে, নেচেওছে রাধা।” এ কথা প্রসঙ্গেই কবি এক আলাপচারিতায় বলেছিলেন, “আমার ভাষায় ছাপ ফেলে যায় মাঠে-ঘাটে গতরে খাটা লোকজন আর কথায় কথায় প্রবাদের বুলি আওড়ানো ছড়া কাটা রাম রহিম যদু মধু। মাটির কোল আর মায়ের কোল— পালটাপালটি করে এইভাবেই আমরা মানুষ হই। তাই জ্ঞান হলে দেশের মাটিতে আর মা-টিতে পিঠোপিঠি একটা সম্পর্ক দাঁড়িয়ে যায়।”
কবি শঙ্খ ঘোষের স্মৃতিচারণে উঠে এসেছে আরও কিছু গুরূত্বপূর্ণ তথ্য,
 
“সুভাষদা অনেক সময় বলতেন, তিনি ভাষা খুঁজে পেয়েছেন তাঁর মায়ের মুখ থেকে৷ হয়তো সেই জন্যেই লাবণ্য মেশানো ঘরোয়া কথাবার্তায় তাঁর অনায়াস দখল কবিতার পর কবিতা জুড়ে দেখা যায়৷ আর সেই সঙ্গে দেখা যায়, কখনও কখনও সেই কাব্যচালের সঙ্গে সন্তর্পণ ছন্দমিলের ব্যবহার৷ মিল যে আছে, তা যেন বোঝাই যায় না৷ ছন্দ যে আছে, তাও যেন বোঝা যায় না৷ অথচ, কথার পর কথা চলেছে৷ প্রথম যুগের ছন্দমিল ব্যবহারের থেকে এ সম্পূর্ণ আলাদা৷ এ যেন এক টলটলে জলের মতো সহজ চালে এগিয়ে চলা কোনও স্রোত৷”
২০০০ সাল নাগাদ রাজা সেন প্রোডাকশন হাউসের উদ্যোগে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি বানানো হয়েছিল। সে ডকুমেন্টারিটিতে স্বয়ং কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পাশাপাশি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, জয় গোস্বামীর মতো দিকপাল কবিদের সাক্ষাৎকারও রয়েছে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার ভাষাশৈলী প্রসঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেন,
“কবিতার ভাষা এক একজন কবি বদলে দেয়। সচরাচর সবাই বলে, জীবনানন্দ দাশ রবীন্দ্রনাথের পরে কবিতার ভাষা বদলে দিয়েছেন। সুভাষদাও কিন্তু এক হিসেবে একটা নতুন ভাষা তৈরি করেছেন। এরকম একেবারে স্বচ্ছ, একেবারে ‘মুখের কথা’র মতো শব্দ দিয়ে কবিতা রচনা করা অথচ তা রসোত্তীর্ণ হওয়া অত্যন্ত শক্ত ব্যাপার। কিন্তু সুভাষদা সেটা আগাগোড়া করে এসেছেন।”
জয় গোস্বামীও দ্বিমত হননি। খুব সাধারণ আটপৌরে ভাষায় সাময়িক প্রসঙ্গ তুলে এনে কীভাবে কবিতাকে একটা আলাদা মাত্রায় নিয়ে যাওয়া যায়, তা হাতে-কলমে করে দেখিয়েছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ‘এই ভাই’ কাব্যগ্রন্থের ‘উত্তরপক্ষ’ কবিতায় এক ক্ষুব্ধ প্রজন্মের কথা উঠে এসেছে— “বাঁধা রাস্তায় পেটোর পর পেটো চমকাতে-চমকাতে/আমরা হাঁক দিই।/আমাদের আওয়াজে বাসুকি নড়ে উঠুক।” জীবনের বাঁধাধরা রাস্তা থেকে যারা বেরোতে চায়, গোটা পৃথিবীটার ভিত নাড়িয়ে দেওয়ার আগুন যাদের মধ্যে আছে, তাদেরই মুখপাত্র হয়ে উঠেছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। এজন্য তাঁর কবিতাকে আক্রমণও কম সইতে হয়নি। তাঁর কবিতা ‘স্লোগানধর্মী’, তাঁর কবিতা ‘চটকদার’, তাঁর কবিতায় নাকি ‘শুধুই চকচকে ঝকঝকে শব্দের ব্যবহার, যা বুদ্ধিকে নাড়া দিলেও হৃদয়কে আচ্ছন্ন করতে পারেনি’— সমস্ত অভিযোগ যে ভিত্তিহীন, তা প্রমাণ করে দিয়েছেন বহুবার বহু কবিতায়। ‘পুপে’ কবিতায় ছোট্ট ছোট্ট হাতে প্রকাণ্ড নীল আকাশটাকে লুফে নিতে চাওয়া এক মেয়ের বাবার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন— “বাপের ঘরে থাকবে নাকো/জানি চিরকাল সে।/সিঁদুর পরতে গিয়ে যখন/খুলবে রুপোর কৌটো;/হঠাৎ মনে হতেও পারে/কী যেন তার ছিল।/হয়তো তখন খুলে দেখবে মুঠো—/প্রকাণ্ড নীল সেই আকাশটা/কখন গেছে উপে।” ‘পদাতিক’ কাব্যগ্রন্থের ‘বধূ’ কবিতায় ধরা পড়ে এক নিঃসঙ্গ বধূর আকুতি— “সবার মাঝে একলা ফিরি আমি/লেকের কোলে মরণ যেন ভালো।” অত্যন্ত সচেতনভাবেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বধূ’ কবিতাটির ছায়া তিনি অনুসরণ করেছেন এ কবিতায়। এসেছে বৈষ্ণব পদাবলীর অনুষঙ্গ-ও।
 
‘পদাতিক’ কবিতাটিতেই দেখি, “বোমাত্মক এরোপ্লেন গান গায় দক্ষিণ সমীরে—/মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান।” যিনি লেখেন “প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য/এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা,/দুর্যোগে পথ হয় হোক দুর্বোধ্য/চিনে নেবে যৌবন-আত্মা”, তিনিই লিখেছেন, “শত্রুপক্ষ যদি আচমকা ছোঁড়ে কামান—/বলব, ‘বৎস! সভ্যতা যেন থাকে বজায়!’/চোখ বুঁজে কোনো কোকিলের দিকে ফেরাব কান।”
 
মৃত্যুর মাত্র বছরতিনেক আগে নির্মিত রাজা সেনের ডকুমেন্টারিতে সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছেন,
“জীবনের ছবিটা আমি ঘরের বাইরে পা দিলেই পাই। একেবারে চালচিত্রসমেত রাস্তার জ্যান্ত মানুষ। এখন পা নেই দেখে কবিতা আমাকে এড়িয়ে চলে। রাস্তায় আমি শুধু ওপরকার ধোঁয়াটাই দেখি আর দেখাই। পাঠক আর শ্রোতারা নিজেদের জ্ঞানগম্যি আর অভিরুচিমতো ধোঁয়ার নীচেকার আগুনটা আঁচ করে নেয়।” এ প্রশ্নও ওঠে, তবে কি ছন্দও আসে পথ-চলা থেকে? আর সেই পথ-চলা থেকেই যুগান্তর আসে বাংলা কবিতার ছন্দে? সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জবানিতেই রয়েছে তার উত্তর, “পথচলা বলতে নানা হাবভাবে নিছক চলা। কখনও চলাটা হয় দুলে দুলে, কখনও নেচে নেচে। আমার কাছে পদ্যে আর গদ্য কবিতায় এইটুকুই যা তফাৎ। আমার ছন্দে কখনও চোখে পড়ার মতো কিছু ঘটে থাকলে তাতে আমার নিজস্ব কোনও হাত নেই।” তাঁর কবিতায় চিত্রকল্পের ব্যবহারের উদাহরণ সুপ্রচুর। ‘‌যত দূরেই যাই’‌–‌এর মতো অসামান্য চিত্রময় কবিতাও তিনি উপহার দিয়েছেন। তাঁর বেশিরভাগ কবিতায় টুকরো টুকরো কিছু গল্পের আভাস পাই। ‘কেন এল না’, ‘মেজাজ’, ‘কাল মধুমাস’ এ ধরনেরই কিছু কবিতা। ‘মোট বারো’, ‘অন্ত্যাক্ষরী’, ‘তেরোস্পর্শ’-র মতো একাধিক গদ্যকবিতা তিনি লিখেছেন। গদ্যকবিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “আমি দেখেছি গদ্যকে উসকে দিলে কখনও তা পদ্য হয়ে যায়। কখনও আবার ঘাড় গোঁজ করে থেকে কিছুতেই কেউ নিজের জায়গা ছাড়তে চায় না।”
 
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বেশ কিছু কবিতায় ‘কালো মেয়ে’র প্রসঙ্গ বারবার এসেছে। তার উৎস খুঁজতে গেলে আলোকপাত করতে হয় তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে। তিনি তাঁর স্মৃতিচারণায় জানিয়েছেন, “আমি যখন বড় হয়ে লিখতে আরম্ভ করি, মা একদিন আমাকে বলেছিলেন, ‘তুই একটা উপন্যাস লেখ আমাকে নিয়ে। একটা কালো মেয়ের কথা।’ আমার সাধ্যে কুলোয়নি। যদিও আমি কালো মেয়ের কথা কিছু কিছু কবিতায় বলেছি।” ‘কাল মধুমাস’ কবিতাটির কিছু পংক্তিতে রয়েছে সেই কালো মেয়েটির কথা— “মা বলতেন :
 
শুনে নে, লিখিস্—/পালকি এসে পৌঁছুল দেউড়িতে/সে পেয়েছে শিবতুল্য বর/বুকের ভেতরে করে আনা/আশা তার মেলে দেবে ডানা—/আলো এল, ঘোমটাও সরাল/কে যেন ককিয়ে উঠল : কালো!/দাঁতে দাঁতে কড়মড় কড়মড়।/সেই থেকে সে রাক্ষসপুরীতে।” ‘মেজাজ’ কবিতার সেই ‘কালো অলক্ষুণে’ বধূটি সন্তানসম্ভবা হয়ে আহ্লাদে ডগমগ হয়ে বলছে— ‘কী নাম দেব, জান?/আফ্রিকা।/ কালো মানুষেরা কী কাণ্ডই না করছে সেখানে।’
 
তথ্যসূত্র :
 
ক) ‘এই সময়’ পত্রিকার তরফ থেকে (২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮) নীলাঞ্জন হাজরার নেওয়া কবি শঙ্খ ঘোষের একটি সাক্ষাৎকার
খ) পরবাস-৭০ পত্রিকায় প্রকাশিত (৩১ মার্চ ২০১৮) অধ্যাপক রবীন পালের প্রবন্ধ ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়র কবিতা’ (ISSN 1563-8685)
গ) সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা, দে’জ পাবলিশিং, ত্রয়োদশ সংস্করণ : ১৪২১ অগ্রহায়ণ, ২০১৪ ডিসেম্বর (ISBN 978-81-295-2239-9)
ঘ) সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত অভীক মজুমদারের প্রবন্ধ ‘আমি যত দূরেই যাই’ (১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯)
ঙ) রাজা সেন প্রোডাকশন হাউস নিবেদিত ‘ডকুমেন্টারি অন পোয়েট সুভাষ মুখোপাধ্যায়’
চ) সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অপ্রকাশিত চিঠি— সংগ্রহ ও ভূমিকা : মুহিত হাসান (প্রথম আলো আর্কাইভ)