দস্তয়েভস্কির আখ্যান “যাচ্ছেতাই কান্ড

হেনরী মাতিস একবার বলেছিলেন সমস্ত শিল্পেরই বৈশিষ্ট্য হল তাতে সময়ের ছাপ থাকে। কিন্তু মহৎ শিল্প সেটাই যাতে সময়ের ছাপ সুগভীর। এই কথাই খাটে দস্তয়েভস্কির সাহিত্যের ক্ষেত্রে। ফিওদর দস্তয়েভস্কির বাস্তবধর্মী সাহিত্যে উনিশ শতকের রাশিয়ার সমাজজীবনের ছাপ খুব স্পষ্ট। তাঁর বিভিন্ন উপন্যাস ও ছোটগল্পে আমরা যে মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়নের অভিঘাত পাই তা সমকালীন ঐতিহাসিক বাস্তবতার উপর প্রথিত। আমি এই আলোচনায় অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত গল্প “যাচ্ছেতাই কান্ড” (Nasty Story) বেছে নিয়েছি। তৎকালীন রাশিয়ায়ে যে উদারতন্ত্রের আবহাওয়া তৈরিহয়েছিল, যে মতাদর্শগত পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল - তার স্ববিরোধিতা এই গল্পে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।

গল্পটা শুরু হচ্ছে একটা চায়ের আসরে যেখানে প্রলিনস্কি নিমন্ত্রিত। অতিথি আর মাত্র আরেকজন - সেমিওন ইভানভিচ শিপুলেঙ্কো, পদমর্যদায় তিনিও সমান। প্রলিনস্কি উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও মানবদরদী। নিজের উচ্চ আদর্শের জন্য নিজেকে অন্যদের তুলনায় উচ্চাসনে বসাতে অভ্যস্ত। তিনি মনে করেন অধস্তনদের সঙ্গে সম্পর্ক হওয়া উচিত মানবিক, পিতৃতুল্য। মতাদর্শ  অনেকক্ষেত্রেই স্ববিরোধী হয়ে থাকে। একদিকে অধস্তনদের প্রতি সৌহার্দ অপর দিকে তাদের উচ্চ আদর্শে দীক্ষিত করা ও নিজের নৈতিক আদর্শ জাহির করার মধ্যে যে বিরোধিতা তা প্রলিনস্কির চরিত্রকে বাস্তবধর্মী করে তোলে। এই মানবিক আদর্শের খামতি হল সহমর্মিতা। আসরে খানিকটা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তিনি তাঁর নৈতিক আদর্শ তুলে ধরেন। শিপুলেঙ্কো মন্তব্য করেন এই আদর্শ “চালিয়ে যাওয়া” সম্ভব নয়। আমাদের নায়কের কাছে তিনি অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল বিবেচিত হন।

ফেরার পথে প্রলিনস্কি একটা বাড়ি থেকে গানবাজনা, হৈ হট্টগোলের আওয়াজ পেলেন। পুলিশকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন তাঁরই এক অধস্তন কেরানী পসেলদনিভের বিয়ে। তিনি ভাবলেন এই বিয়েতে হঠাৎ উপস্থিত হয়ে ঊর্ধ্বতন ও অধস্তনের মধ্যকার শ্রেণি- কর্তৃত্ব ভাঙবেন। এটাই হবে তাঁর নৈতিক আদর্শের প্রকৃত অনুশীলন। তিনি বিবাহ বাসরে গিয়ে তাঁর আসার কারণ ব্যাখ্যা করবেন ও সবাইকে নৈতিকভাবে উজ্জীবিত করবেন। পসেলদনিমভ গৌরবান্বিত হবে এবং তাঁর এই মহত্ত্বের কথা চারিদিকে রাষ্ট্র হবে। তাঁর উচ্চ আদর্শের জন্য তিনি প্রশংসিত হবেন। শুধু পসেলদনিমভ নয়, তাঁর পরবর্তী প্রজন্মও তাঁর এই মানবিকতার কথা মনে রাখবে।

ইতিমধ্যে প্রলিনস্কি আরও শ্যাম্পেন ও ভদকা খেয়ে সম্পূর্ণ অচৈতন্য হয়ে পরেন। অন্য কোনও শয্যার অভাবে রাতে তাঁকে নব দম্পতির শয্যায় শোয়ান হয়। আমরা দেখি পসেলদনিমভ তাঁর চুল ছিঁড়ছেন। দস্তয়েভস্কি  এখানে সমাজ জীবনের অভিজ্ঞতা নাটকীয় ভাবে উপস্থাপন করেন। গল্পের নাটকীয়তাই পাঠকে ভাবতে উৎবুদ্ধ করে। এটা স্রেফ সমাজ জীবনের সত্যনিষ্ঠ ছবি আঁকা নয়, কোন রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার চেষ্টাও নয়। লেখকের পক্ষপাতিত্ব খুঁজলে পাওয়া যাবে তাঁর চরিত্র নির্মাণের ভিতর, সমাজ বাস্তবতার সূক্ষতা উন্মোচনের ভিতর। তাঁর ব্যাক্তিগত মতবাদ বা অভিপ্রায়ের মধ্যে নয়।

এই ঘটনার পর আটদিন প্রলিনস্কি অফিসে অনুপস্থিত। মানসিক অবসাদ কাটিয়ে অফিসে গেলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে অধস্তনদের সঙ্গে একটু কড়া ব্যবহার করলেই অবস্থাটা সামাল দেওয়া যাবে। পসেলদনিমভ অন্য দপ্তরে বদলির আর্জি জানাতে তাঁর অবস্থানটা আরেকটু সহজ হয়। লেখক একদিকে নায়কের মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাত যেমন বিশ্লেষণ করেছেন তেমনই পসেলদনিমভের মত কেরানীর দারিদ্র ও অসহয়তাকে বর্ণনা করেছেন। এই দুইয়ের সংঘাতে যে সমাজ চিত্র ফুটে উঠেছে সেটা তৎকালীন রাশিয়ার বাস্তবতা। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জগৎ, সামাজিক সম্পর্কের প্রতি যাদের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। যেখানে সামাজিক সৌহার্দের সেতু দিয়ে শ্রেণিগত বিভেদকে মোছা প্রায় অসম্ভব।

গল্পটা শেষ হয় প্রলিনস্কির “চালিয়ে যেতে পারলু না” এই স্বীকারোক্তির মধ্যে দিয়ে। গল্পটা শেষ পর্যন্ত অসম্পূর্ণ । নায়কের শেষ স্বীকারোক্তি কি বলতে চায় ? উদারনৈতিক মানবতা সম্ভব নয় ? সামাজিক শ্রেণী বিন্যাসের চরিত্র সবসময়ই বিরোধমূলক ? সামাজিক শ্রেণী বিন্যাসের আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমেই নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা হতে পারে ? পাঠ্যের সঙ্গে মতাদর্শের টানাপোড়নই এই প্রশ্ন গুলো জাগিয়ে তোলে। গল্পের এই অসম্পূর্ণতা, এই অব্যক্ততাই যেন গল্পটাকে শক্তিশালী করে। নায়কের মানবিক আদর্শ, শিপুলেঙ্কোর প্রতিক্রিয়াশীল মন্তব্য, প্রলিনস্কির মানবিক আদর্শের অনুশীলনের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা, পসেলদনিমভ ও তার সমকক্ষদের বিরূপতা আমাদের কোন একটা অর্থের দিকে নিয়ে যায় না। গল্পের তাৎপর্য প্রকাশ পায় এই বিভিন্নতায়। কোন কেন্দ্রীয় নির্যাসের পরিবর্তে বিক্ষিপ্ত কিছু ভাবনার সম্ভবনা দেখা দেয়।

“যাচ্ছেতাই কান্ড” গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৬২ খ্রীষ্টাব্দে। আমাদের মনে রাখতে হবে ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে ভূমিদাস প্রথার অবলুপ্তি হয় রাশিয়ায়। রাশিয়া জুড়ে উদারনৈতিক মানবতার আবহ। দস্তয়েভস্কি নিজেও এর বাইরে নন। তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শও ছিল উদারনৈতিক। তিনি ভূমিদাস প্রথার বিরুদ্ধে কিন্তু জারতন্ত্রের পক্ষে ছিলেন। তিনি ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিরোধী ছিলেন না, প্রাতিষ্ঠানিকতারও বিরোধীও ছিলেননা, অরথোডক্স খ্রীষ্ঠান ধর্মে তাঁর আস্থা ছিল। অর্থাৎ তাঁকে আমূল সংস্কারকামী বা রাডিক্যাল বলা যায়না কোনভাবেই। কিন্তু তাঁর রচনায় তিনি সমকালীন মতাদর্শের সীমাবদ্ধতা দেখাতে সক্ষম। এখানে বলা ভাল যে কোনও শক্তিশালী সাহিত্যের বৈশিষ্ট্যই হল সমসাময়িক শাসকগোষ্ঠির মতাদর্শের অনাবিষ্কৃত ক্ষেত্র (blindspot) গুলো প্রকাশ করা। সাহিত্যিকের নিজের অবস্থান এইধরনের পাঠের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নয়।

এটা একধরনের ব্যঙ্গ্যাত্মক ছোট গল্প। রাশিয়ার উদারনৈতিক সংস্কারের প্রেক্ষাপটেই প্রলিনস্কির আদর্শবাদ। তিনি সমসাময়িক সমাজ মানসিকতার প্রতিভূ। ব্যাক্তিগত মনস্তত্ত্বও সামাজিক ভাবে নির্মিত হয়। তাঁর “উচ্চ আদর্শ”, তাঁর আত্মভিমান ও উচ্চাশারও সামাজিক ভিত্তি রয়েছে। অর্থাৎ সমাজ মানসিকতা অবশ্যই সেই যুগের  সামাজিক সম্পর্কের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই গল্পে রাশিয়ার রাজনৈতিক সমীকরণে কাউন্সিলার ইভান ইলিয়িচ প্রলিনস্কি ও কেরানী পসেলদনিমভের সামাজিক সম্পর্ক এবং তার প্রেক্ষিতে উদারনৈতিক মানবতার আদর্শ কতটা স্ববিরোধী সেটাই ফুটে উঠেছে। দুটো স্ববিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি এই গল্পে কাজ করছে। একদিকে জারিষ্ট রাশিয়ার সমাজ সংস্কারের প্রতি উচ্চপদস্থদের আস্থা অপর দিকে রাশিয়ার সাধারণ মানুষের তার প্রতি উৎকণ্ঠা ও অবিশ্বাস। এই দুটো দিকের ফলে রাশিয়ার তৎকালীন সামাজিক মতাদর্শের সঙ্গে গল্পটার অবস্থান হয়ে ওঠে দ্বান্দ্বিক।

দস্তয়েভস্কি এখানে উপাদান সংগ্রহ করেছেন মানুষের দৈন্যন্দিন মতাদর্শ থেকেই। তাঁর স্বকীয়তা এখানেই যে তিনি এই উপাদানকে এমনভাবে কাহিনীতে রূপান্তর করেছেন, যে আমরা এই মতাদর্শ থেকে খানিকটা দূরত্ব স্থাপন করতে পারি। কাহিনীতে রূপান্তরিত করার ফলে সামাজিক উপাদান গুলো আর সামাজিক উপাদান থাকে না, সেগুলো কাহিনীর উপজীব্য হয়ে ওঠে। ফলত সম্ভব হয় সমাজজীবন থেকে কাক্ষিত দূরত্ব প্রতিষ্ঠা। আর এই দূরত্বই আমাদের মতাদর্শের সীমাবদ্ধতার দিকে ইঙ্গিত করে। তিনি যা বলেননি সেটাই যেন বেশী মাত্রায় অনুরণন করে আমাদের পাঠে।

বিবাহ বাসরে প্রলিনস্কি কাক্ষিত প্রভাব ফেলতে পারলেননা। তাঁর উপস্থিতির ফলে প্রাথমিক ভাবে আসরের ছন্দ কেটে গেল। পরে যখন সবাই বুঝল সম্মানীয় অথিতি একটু নেশাগ্রস্ত তখন সবাই পুনরায় আমোদ আল্লাদে ব্যাস্ত হল কিন্তু আমাদের নায়ক তাঁর উদার মতাদর্শ বোঝাতে অক্ষম হলেন। এক তো তাঁর নেশাগ্রস্ততার কারণে তিনি ঠিক মত কথা বলতে পারছিলেননা দ্বিতীয়ত তিনি উপলব্ধি করেছিলেন তাঁর হঠাৎ এসে পরায় পসেলদনিমভ সহ অনেকেই অসন্তুষ্ট। “অঙ্গার” পত্রিকার লেখক তো বলেই বসল, তিনি এসেছেন স্রেফ “চাল” মারতে। তাঁর জন্য আনা দুবোতল শ্যাম্পেনের দাম দেবার জন্য সামান্য বেতনের পসেলদনিমভকে কতটা অসন্মান ও অসহয়তার সম্মুখিন হতে হয়েছে তা প্রলিনস্কির ভাবনার পরিসরের বাইরে। এই প্রসঙ্গে লেখক আমাদের কাছে পসেলদনিমভের করুণ জীবন কাহিনী ও নেহাতই অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক ব্যবস্থা হিসেবে তার বিয়ের কথা বর্ণনা করেন। এই গল্পে রাশিয়ার রাষ্ট্রতন্ত্রের প্রতিভূ প্রলিনস্কি ও কেরানী পসেলদনিমভের চরিত্র এমন ভাবে ফুটে ওঠে যে স্পষ্ট হয় ব্যাক্তিবিশেষের সামাজিক সত্তাই তার সচেতনা নির্ধারণ করে। সচেতনা বা আদর্শ সাধারণ ভাবে সত্তার বিকাশ ঘটায়না।

সাহিত্য তথা শিল্পকলার সঙ্গে মতাদর্শের সম্পর্কটা একটু জটিল। মতাদর্শ হল সেই বিশ্বাস বা ধারণা যা মানুষ তার সামাজিক আভিজ্ঞতা থেকে লাভ করে। আমরা জানি মার্ক্সীয় সাহিত্য সমালোচনায় বনিয়াদ (base) ও উপরিসৌধের (superstructure) ধারণা গুরুত্বপূর্ণ। উৎপাদন প্রক্রিয়া হল বনিয়াদ, তার উপর মতাদর্শ একধরনের উপরিসৌধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। মতাদর্শের কাজই হল উৎপাদন প্রক্রিয়া ও তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সামাজিক শ্রেণি বিন্যাসকে মান্যতা দেওয়া। সাহিত্য তথা শিল্প এই মতাদর্শেরই  অঙ্গ। কিন্তু মতাদর্শের অন্যান্য স্তম্ভ যেমন ধর্ম, আইন ইত্যাদির থেকে এর চরিত্র একটু আলাদা। আলথু্সের দেখিয়েছেন সাহিত্য কীভাবে মতাদর্শ - যা কিনা তাঁর মতে মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতার কাল্পনিক তাৎপর্য ( ideology signifies the imaginary ways in which men experience the real world) - তার থেকে দূরত্ব স্থাপন করতে পারে। এই দূরত্বের ফলেই মতাদর্শের চরিত্রটা বোঝান সাহিত্যের পক্ষে সহজ হয়। সাহিত্য যদি এই দূরত্বটা তৈরি করতে না পারত তবে সমকালীন মতাদর্শের অনাবিষ্কৃত ক্ষেত্রের দিকে ইঙ্গিত করতে পারত না।

“যাচ্ছেতাই কান্ড” এ আমরা তৎকালীন উদারনৈতিক মতাদর্শের সীমাবদ্ধতাই দেখব। এখানে আমরা ঘটনা প্রবাহের মধ্যে দিয়ে আমাদের নায়ক ইভান ইলিয়িচ প্রলিনস্কির যাত্রা ও তাঁর মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাতের সাক্ষী হই এবং এই অভিজ্ঞতাই আমাদের তৎকালীন  উদারনৈতিক সংস্কারের চরিত্র বুঝতে সাহায্য করে। বাস্তবধর্মী বর্ণনা ও সত্যনিষ্ঠ চরিত্রায়ন এই ধরনের ভন্ড মতবাদের স্ববিরোধ ফুটিয়ে তোলে। তবে সাহিত্যে বাস্তববাদ একটা বিশেষ রীতি মাত্র, একে বৈপ্লবিক বা প্রতিক্রিয়াশীল বলা যায়না। কাহিনী তার নিজের ভঙ্গিমায় এগোয় এবং নতুন উদারনৈতিক আদর্শের প্রতি যে আশাবাদ তৈরি হয়েছে তা চুরমার করে দেয়। লেখক স্পষ্টত কোন পক্ষ নেন না, তাঁর কাছ থেকে কোন সমাধান সূত্রও দীক্ষিত পাঠক দাবি করেনা। তিনি শুধু বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবনযাপনের আভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। এখানেই তাঁর সার্থকতা।

গল্পটা দুভাবে পড়া হয়ে থাকে। এটাকে দেখা যেতে পারে ব্যক্তির বিশ্বাস ও সেই বিশ্বাসের বাস্তব রূপায়নের মধ্যেকার ব্যাবধান। এখানে বলা যেতে পারে আমাদের নায়ক যে আদর্শে বিশ্বাসী বলে মনে করতেন তা বাস্তবে প্রয়োগ করতে গিয়ে উপলব্ধি করলেন তাঁর আদর্শের ভিত নড়বড়ে। গল্পটাকে আরেক ভাবে দেখলে, রাশিয়ার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের আমলে যে উদারনৈতিক সংস্কারের ধারা শুরু হয়েছিল সেটাই এই গল্পটার উপজীব্য।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতের উপর গুরুত্ব দিলেও সাহিত্যকে শুধুমাত্র সামাজিক দলিল ভাবা যায় না। সাহিত্যে আমরা ইতিহাসের অভিঘাত পেলেও তা পাঠকের কাছে আসে একান্তই সাহিত্য হিসেবে। সেখানে গুরুত্ব পায় তার শৈলী ও বিন্যাস। “যাচ্ছেতাই কান্ড” তাই অবশ্যই সফল ব্যঙ্গ্যার্থক ছোট গল্প যা কৌতুক উদ্রেগ করে। সাহিত্যকে সমাজের দর্পন ভাবার একটা ঝোঁক আছে সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। পিঁয়ের মশেরিকে অনুসরণ করে আমি বলব সাহিত্যে যদি সমাজের প্রতিফলন দেখা যায় তবে তা চূর্ণ বিচূর্ণ প্রতিফলন। গল্পের রেশ টেনে বলি, চায়ের আসরে প্রলিনস্কি ও শিপুলোঙ্কার বিতর্ক, প্রলিনস্কির ভাবনা, পসেলদনিমভের জীবন, তার শ্বশুরের পরিকল্পনা, তার স্ত্রীর বিমুখতা, বিবাহ বাসরে উপস্থিত নিমন্ত্রিতদের বিরূপতা, “অঙ্গার” পত্রিকার লেখকের রূঢ়তা, এই সবই  যেন কতগুলো বিক্ষিপ্ত চিত্র। তার বাইরেও থেকে যায় অধরা কিছু অনুষঙ্গ - যাকে আমি পাঠ্যর অনাবিষ্কৃত ক্ষেত্র বা blindspot বলছি। আমার মনে হয়, গল্পটার বাস্তবধর্মীতা সমাজ জীবনের অনুকরণের চেয়ে বিকৃত করেছে বেশী। তার ফলেই গল্পের ব্যাঙ্গাত্মক দিকটা ফুটে উঠেছে।

সাহিত্যের অনুশীলনই হল সামাজিক জীবনের অভিজ্ঞতাকে সাহিত্যের নিজস্ব শৈলীর মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করা। এই অনুশীলনই শিল্প চর্চা। সামাজিক অভিজ্ঞতা অবশ্যই ইতিহাস নিরপেক্ষ নয়। তাই সার্থক শিল্পীর গুণই হল তাঁর সময়ের মানুষদের বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতাকে এমনভাবে তুলে ধরা যাতে পাঠক সেই অভিজ্ঞতার সূক্ষতা গুলো উপলবদ্ধি করতে পারে। সেই দিক থেকে দস্তয়েভস্কি অবশ্যই সার্থক কথাশিল্পী।

[এখানে ননী ভৌমিকের অনুবাদ অবলম্বন করা হয়েছে। দেখুন, ননী ভৌমিক - তিনটি উপন্যাস, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো]