ফিওদর দস্তয়েভস্কির ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট
- 11 November, 2021
- লেখক: সৌভিক ঘোষাল
রুশ সাহিত্যে অসামান্য সৃজনশীলতা নিয়ে এসেছিল ১৮৬০ এর দশকটি। ১৮৬২ তে বেরোয় তুর্গেনিভের ‘ফাদার্স অ্যান্ড সন্স’। ১৮৬৪ তে প্রকাশিত হয় দস্তয়েভস্কির ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’, ১৮৬৬ তে ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’। এর তিন বছর পর ১৮৬৯ এ একই বছরে বেরোয় দস্তয়েভস্কির ‘ইডিয়ট’ আর তলস্তয়ের মহাকাব্যিক আখ্যান ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’। এই দশকে তুর্গেনিভ, দস্তয়েভস্কি ও তলস্তয়ের আরো কিছু বিখ্যাত রচনা বেরিয়েছে। তুর্গেনিভ এর ‘ফার্স্ট লাভ’ (১৮৬০), ‘স্মোক’ (১৮৬৭) তলস্তয়ের ‘কসাক’ (১৮৬৩) বা দস্তয়েভস্কির ‘হিউমিলিয়েটেড অ্যান্ড ইনসাল্টেড’ (১৮৬১), ‘দ্য হাউস অব দ্য ডেড’ (১৮৬২), ‘গ্যাম্বলার’ (১৮৬৭) ইত্যাদির কথা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়।
সাহিত্যের দুনিয়ার এই উথালপাতাল ভীষণভাবেই ছুঁয়ে ছিল সমকালীন রুশ সমাজ ও রাজনীতির বিতর্কের নানা দিককে। বিপ্লবী সাহিত্যিক চেরনিশেভস্কির ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ নামের উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৮৬৩ সালে, যা পরে লেনিনকে অত্যন্ত প্রভাবিত করেছিল। এই বইটি লেনিনের এতই পছন্দের ছিল যে তিনি অন্তত পাঁচবার এটি পড়েছিলেন, আর তাঁর এক বিখ্যাত বইয়ের নাম দিয়েছিলেন এই বইয়ের নামে। চেরনিশেভস্কির লেখালেখি ও সম্পাদনাকর্ম সমৃদ্ধ সোভ্রেমেনিক (এই রুশ শব্দটির অর্থ সমসাময়িক) নামের জার্নালটি এ সময়ে প্রগতিশীল মহলে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং এটির লেখক ও সহসম্পাদক হবার কারণে চেরনিশেভস্কিকে কারাবাসও করতে হয়েছিল। উপন্যাস শিল্পের নিরিখে না হলেও সামাজিক প্রভাবের দিক থেকে দেখতে গেলে এই উপন্যাস ও তার প্রতিক্রিয়া সমূহও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনে করা হয় চেরনিশেভস্কি এই উপন্যাস লিখেছিলেন তুর্গেনিভ এর ‘ফাদার্স অ্যান্ড সনস’ এর প্রতিক্রিয়ায়, আবার চেরনিশেভস্কির এই ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ এর প্রতিক্রিয়াতেই দস্তয়েভস্কি লেখেন তাঁর অতি বিখ্যাত আখ্যান ‘নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড’। সাহিত্য আর সামাজিক রাজনৈতিক জীবন তখন রাশিয়ায় পরস্পরের এত কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছিল, যে একটিকে অন্যটি থেকে কিছুতেই আলাদা করে দেখা বা আলোচনা করা সম্ভব নয়।
পাঠক হিসেবে আমরা এই দশক থেকে শ দেড়েক বছর দূরে দাঁড়িয়ে এখন যখন তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, তুর্গেনিভের অসামান্য সাহিত্যকীর্তিগুলো ফিরে পড়ি, তখন আমাদের স্বাভাবিকভাবেই এই আশ্চর্য সময়টাকে, তার বৈশিষ্ট্যগুলোকে সামগ্রিকতায় বোঝার দরকার হয়। নজর ফেরাতে হয় ইতিহাস, সমাজ, রাজনীতির দিকে। দস্তয়েভস্কির ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট, যা বাংলা অনুবাদে “অপরাধ ও শাস্তি” নামে জনপ্রিয়, আর যার মূল রুশ ভাষায় নাম ছিল, ‘প্লেস্তুপ্লেনিয়ে ই নাকাজানিয়ে’ তার পাঠে প্রবেশের আগে সেদিকে একটু তাকানো যাক।
রাশিয়ায় প্রায় পাঁচশো বছর ধরে, তৃতীয় ইভানের (১৪৪০-১৫০৫ সাল) আমল থেকেই চালু ছিল জারের শাসন। রাশিয়ার সম্রাটরা জার নামে পরিচিত ছিলেন। দেশের অধিকাংশ ভূমি এবং সম্পদ জার, তার পরিবার ও অনুচরদের হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল। আর কোটি কোটি জনসাধারণ বাস করত উপযুক্ত শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, খাদ্য, বিশ্রাম বিহীন অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টের মধ্যে। ইউরোপের অন্যান্য দেশের স্বৈরতন্ত্রগুলির চেয়েও রাশিয়ার অবস্থা ছিল খারাপ। ১৯০৫ সালের বিক্ষোভ আন্দোলন পর্বের আগে পর্যন্ত রাশিয়ায় কোনও সংবিধান বা (এমনকী রাজতন্ত্র নিয়ন্ত্রণাধীন) সংসদীয় ব্যবস্থার চিহ্নটুকু পর্যন্ত ছিল না। রাজনৈতিক ক্ষমতার পাশাপাশি ধর্মীয় বিষয়ের কর্তৃত্বও ছিল জারের হাতে। জার শাসনের কোনও কোনও পর্বে অবশ্য কিছু কিছু সংস্কার হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে জার পিটার দ্য গ্রেট এর আমল (১৬৮২ থেকে ১৭২৫) এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে রাশিয়া এইসময় সাংস্কৃতিকভাবে অনেকটা কাছাকাছি আসে। মস্কো থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সেন্ট পিটার্সবার্গে এবং নতুনভাবে একে গড়ে তোলা হয়। এই আমলে পুরনো মধ্যযুগীয় অনেক ধ্যান ধারণাকে সরিয়ে দিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানচিন্তার প্রসার হয়। এই সংস্কার অব্যাহত থাকে ক্যাথরিন দ্য গ্রেট এর আমলেও (১৭৬২ থেকে ১৭৯৬)।
জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের আমলের (১৮৫৫ থেকে ১৮৮১) আগে থেকেই রাশিয়া একের পর এক কৃষক বিদ্রোহে আলোড়িত হচ্ছিল। ১৮৫০ থেকে ১৮৬০ এর মধ্যে রাশিয়া জুড়ে প্রায় আটশো কৃষক বিদ্রোহ হয়। ১৮৬২ র বসন্তে রাশিয়ার তৎকালীন রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গ এ ছাত্রযুব বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছিল। এই বিদ্রোহের পেছনে একদিকে ছিল রাশিয়ার ভেতরের সঙ্কট, অন্যদিকে ছিল চোদ্দ বছর আগে ১৮৪৮ এ ইউরোপের একের পর এক দেশে ওঠা বিদ্রোহের ঢেউ এর প্রেরণা। ১৮৪৮ এর এই বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল ফ্রান্সে এবং ক্রমেই তা ছড়িয়ে পড়ে অনেকগুলি দেশে। পুরনো ধরনের রাজতন্ত্রের জায়গায় জনগণ চাইছিল সাংবিধানিক গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার সহ বেশ কিছু মৌলিক বদল। বেশ কিছু দেশে এই বিদ্রোহকে দ্রুত দমন করা হয়, অসংখ্য বিদ্রোহীকে হত্যা করা হয় বা কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। বেশ কিছু দেশে জনগণ বিদ্রোহের মাধ্যমে অনেক অধিকার আদায় করে নিতেও সক্ষম হয়। অস্ট্রিয়া আর হাঙ্গেরিতে ভূমিদাসপ্রথার অবসান হয়, নেদারল্যান্ডে শুরু হয় প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র, ডেনমার্কে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের পতন ঘটে। এই বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে উদারনীতিবাদ, জাতিয়তাবাদ ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শ ক্রমশ জনপ্রিয় ও বিস্তৃত হতে থাকে।
জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের (১৮৫৫ থেকে ১৮৮১) আমলের প্রথম দিকে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে (১৮৫৩ থেকে ১৮৫৬) রাশিয়ার শোচনীয় পরাজয় ঘটে এবং ক্রমশ জনপ্রিয়তা হারাতে থাকা জার শাসন আরো অনেকটা বে আব্রু হয়ে যায়। ফলে তলা থেকে বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে প্রশমিত করার জন্য ওপর থেকে কিছু সংস্কারের কথা ভাবা হয় জার শাসনের তরফে। শুরু হয় বহু আলোচিত ভূমিদাস প্রথার বিলুপ্তি (১৮৬১)। প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ অর্থাৎ রুশ জনগণের ৮০ শতাংশই এই সংস্কারের ফলে উপকৃত হচ্ছে - একথা বলা হলেও ভূমিদাস প্রথার বিলুপ্তি জনগণের জীবনের মূল সমস্যাগুলির সমাধান করতে ব্যর্থ হয়। ওপর থেকে লোকদেখানো সংস্কার সত্ত্বেও ভালো ভালো জমিগুলো সবই জমিদারদের হাতে থেকে যায়। কৃষকদের হাতে আসে সামান্য কিছু পতিত বা অনুর্বর জমি। এর সঙ্গেই ছিল চাষীদের জমিতে আবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা। অনুমতি না নিয়ে চাষীরা এলাকা ত্যাগ করতে পারত না। ফলে রাশিয়ার বিপ্লবী চিন্তাধারাকে দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের সংস্কার প্রশমিত করতে সক্ষম হয় নি।
১৮৩৫ থেকে ১৮৬১ র মধ্যে বিদ্রোহীরা দুশো তিরাশি জন জমিদার বা কুলাককে হত্যা করে। এই বিদ্রোহের পুরোভাগে ছিল নারোদনিক বা জনগণের বন্ধুরা। রাশিয়ায় সামন্ততন্ত্রের দ্রুত অবক্ষয় দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু তার জায়গায় আধুনিক পুঁজিবাদ তখনো সেভাবে বিকশিত হয়ে ওঠে নি। ছাত্রযুব এবং জনগণের প্রগতিশীল অংশ সামন্ততন্ত্র এবং জার শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ছিল এবং তা প্রায়শই ব্যক্তিহত্যার পথ বেছে নিত। এরই চরম প্রকাশ দেখা যায় ১৮৮১ সালের ১ লা মার্চ। সেন্ট পিটার্সবুর্গ এর রাস্তায় জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারকে বোমা ছুঁড়ে হত্যা করা হয়। ছ বছর বাদে একইভাবে হত্যার চেষ্টা করা হয় জার তৃতীয় আলেকজান্ডারকে। সেই ব্যর্থ চেষ্টার শাস্তি হিসেবে দু মাস পর ফাঁসিতে প্রাণ বিসর্জন দেন আলেকজান্দার উলিয়ানভ, সম্পর্কে যিনি ছিলেন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের নিজের দাদা।
১৮৬০ এর রাশিয়ায় বিপ্লবী আদর্শ হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এক নতুন ধরনের চিন্তাধারা – নিহিলিজম। এই মতবাদের পক্ষে বিপক্ষে কলম ধরেন তুর্গেনিভ, চেরনিশেভস্কি, দস্তয়েভস্কির মত সেকালের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য প্রতিভারা। পরপর তিন বছরে প্রকাশিত তিনটি ক্লাসিকে নিহিলিজমকে তিনটি আলাদা আলাদা দৃষ্টিকোণে দেখা হয়। ১৮৬২ তে তুর্গেনিভের ‘পিতা-পুত্র’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। ১৮৬৩ তে তার জবাব হিসেবে চেরনিশেভস্কি লেখেন ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ এবং পরের বছর তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায় দস্তয়েভস্কির বিখ্যাত উপন্যাস ‘নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড’ এর মধ্যে। আখ্যানের বাইরে সাহিত্য সমালোচনার জগতেও বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বিতর্কর ঝড় বইতে থাকে।
রুশ নিহিলিজমের প্রতিনিধিস্থানীয় চরিত্র হিসেবে বিখ্যাত হয়ে আছে তুর্গেনিভের ‘পিতা পুত্র’ উপন্যাসের বাজারভ। উপন্যাসের শুরুতে আমরা দেখি এক জমিদার নিকলাই কির্সানভ অপেক্ষা করছেন তাঁর পুত্র আর্কাদির জন্য। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছুটিতে পারিবারিক খামারে আসে। আর্কাদি সঙ্গে করে নিয়ে আসে তাঁর সহপাঠী বন্ধু ডাক্তারির ছাত্র বাজারভকে। বাজারভ শুরু থেকেই তাঁর চমকপ্রদ কথাবার্তা ও ধ্যান ধারণা দিয়ে যে কোনও কারোর ওপর প্রভাব বিস্তারে সক্ষম। বস্তুত আর্কাদি ও অন্যান্য বন্ধুবান্ধবেরা তাঁকে গুরুর আসনেই প্রায় বসিয়ে রেখেছে। পুত্রবন্ধু এই কড়া ধাঁচের যুবকটিকে জমিদার নিকলাই বেশ সম্ভ্রমের চোখেই দেখেন কিন্তু তাঁর দাদা, এক সময়ের মিলিটারি অফিসার ও উচ্চকোটির সমাজে সাড়া জাগানো মানুষ পাভেল কির্সানভ কথায় কথায় তাঁর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। বস্তুত কথার দ্বন্দ্বে তাঁদের ঠোকাঠুকি একবার ভোরবেলার ডুয়েল অবধি পৌঁছে যায়। বাজারভ অক্ষত থাকলেও গুলি ছুঁয়ে যায় পাভেলের হাঁটু, রক্তক্ষরণ ও ক্ষত নিয়ে কদিন বিশ্রামেও থাকতে হয় তাঁকে।
পিতা পুত্র উপন্যাসটি প্রসঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আলোচকেরা দুটি প্রজন্মের দ্বন্দ্বের কথা তুলেছেন। একটি হল নিকলাই বা পাভেল কির্সানভদের চল্লিশের প্রজন্ম এবং একটি হল বাজারভ, আর্কাদিদের ষাট এর প্রজন্ম। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি এক বক্তৃতায় নতুন জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার ভূমিদাস প্রথা অবসানের কথা ঘোষণা করেন এবং ধীরে ধীরে তার বাস্তবায়নের জন্য গোটা রাশিয়া জুড়ে অসংখ্য কমিটি তৈরি করেন। ষাটের দশকের শুরুতে ভূমিদাস প্রথার অবসান ঘটে এবং লক্ষ লক্ষ রুশ ভূমিদাস মুক্তি পায়। কিন্তু দুই প্রজন্মের যে বিতর্কের কথা বলা হয়, তা শুধু ভূমিদাস প্রথার অবসানকে দেখার প্রশ্নে সীমাবদ্ধ ছিল না। ছিল রাশিয়ার সার্বিক পরিবর্তনের প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে অসংখ্য বিষয়কে বিচারের দৃষ্টিকোণের সঙ্গে। বস্তুতপক্ষে পিতা পুত্র উপন্যাসে যে দুই ধরনের মানুষদের তুর্গেনিভ হাজির করেছেন, তারা কেউই ভূমিদাস প্রথার অবসানের বিরোধী নয়। বাজারভদের মতো রাডিক্যালরা তো বটেই, এমনকি নিকলাই বা পাভেল কির্সানভদের মতো লিবারাল হতে চাওয়া জমিদারকুলও অন্তত প্রকাশ্যে এর বিরোধী নন। বড়জোর এর রূপায়ণ কমিটির কার্যকলাপ প্রসঙ্গে ক্ষেত্রবিশেষে খানিক উদাসীন। যারা ভূমিদাসপ্রথার তীব্র বিরোধী, সেই রক্ষণশীলদের কোনও প্রতিনিধিত্ব পিতাপুত্র উপন্যাসে তুর্গেনিভ রাখেন নি।
উনিশ শতকের মধ্যভাগে রাশিয়ায় নিহিলিজম কেবল একটি দার্শনিক দৃষ্টিকোণ হিসেবেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বাকুনিন প্রভৃতির দ্বারা প্রাণিত এই মতবাদ রাষ্ট্র, চার্চ, পরিবার – সমস্ত রকম কর্তৃত্বকে শুধু অস্বীকারই করতে চায় নি, জার শাসিত রাশিয়ার ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনেও সামিল হয়েছিল। যুক্তিবাদ ও বস্তুবাদের ওপর দাঁড়িয়ে ভাববাদী দৃষ্টিকোণগুলিকে যথার্থ নিহিলিস্টের মতোই বাজারভকে দিয়ে খন্ডন করিয়েছেন তুর্গেনিভ, কিন্তু জার শাসনের বিরুদ্ধে নিহিলিস্টরা যে গোপন সংগঠন ও লড়াই এর প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তার কোনও হদিশ আখ্যানের মধ্যে দিতে সাহস করেন নি। এর বদলে বাজারভকে কেবল উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্বে খানিকটা নারী মোহিত যুবক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। জার শাসন জনিত ভয় থেকে বাজারভকে উজ্জ্বলভাবে আঁকার ক্ষেত্রে লেখকের যে পশ্চাদপসরণ, তার ক্ষতিপূরণ তুর্গেনিভ করতে চেয়েছেন বাজারভের মৃত্যুদৃশ্যকে উজ্জ্বল করে তোলার মধ্যে দিয়ে।
বাজারভের মতো চরিত্র - যে মূলত কথায় নয়, ব্যবহারিক কাজে বিশ্বাসী - তাকে কাজ ও সাংগঠনিক পরিচয়ের বাইরে এনে ফেললে চরিত্রটির ওপরেই শুধু অবিচার করা হয় না, উপন্যাসের শিল্প সম্ভাবনাকেও দুর্বল করে ফেলা হয়। বিপ্লবীদের দিক থেকে বাজারভ চরিত্রায়ণ ও পিতাপুত্র উপন্যাসটি সম্পর্কে শৈল্পিক আপত্তির উত্তর হিসেবে পালটা একটি উপন্যাসও লেখা হয়েছিল। পিতাপুত্র প্রকাশের পরের বছরেই, ১৮৬৩ সালে, নিহিলিজম এর ইতিবাচক উপস্থাপন সহ নিকোলাই চেরনিশেভস্কি লিখেছিলেন – ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ নামের এক উপন্যাস। তৎকালীন রাডিক্যাল রুশ যুবকদের মতোই পরবর্তীকালে লেনিনেরও অত্যন্ত প্রিয় বই হয়ে ওঠে এটি এবং রুশ বিপ্লবের প্রস্তুতিপর্ব ও বিপ্লবোত্তর রাশিয়াতেও বইটির বিশেষ জনপ্রিয়তা ছিল। চেরনিশেভস্কি সমকালীন রাশিয়ায় তাঁর প্রগতিশীল চিন্তাধারার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। বস্তুবাদী দর্শন, সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি – অর্থনীতি, নারীমুক্তি বিষয়ে তাঁর বলিষ্ঠ মতবাদ রাশিয়ার প্রগতিশীলদের কাছে তাঁকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে রুশ সমাজের প্রগতিশীল অংশ যে সমস্ত সামাজিক সমস্যাগুলি নিয়ে বিব্রত ছিল, ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ উপন্যাসটিতে চেরনিশেভস্কি তার সমাধানসূত্র হাজির করার চেষ্টা করেন। রুশ সমাজের অসাম্য, সামাজিক দমনপীড়ন ও অর্থনৈতিক পশ্চাদপরতার অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেন পিতৃতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী রুশ পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কাঠামোকে। একে বদলানোর জন্য একটি রাডিক্যাল কর্মসূচীর প্রয়োজনীয়তার ওপর তিনি জোর দেন। রাশিয়ার নিজস্ব মূল্যবোধের সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপের সামাজিক রাজনৈতিক প্রগতিশীল চিন্তাভাবনাকে মেলানোর কথা তিনি বলেন। ব্যক্তির আত্মবোধের জাগরণের প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি এমন এক আর্থিক নীতিমালার কথা চেরনিশেভস্কি বলেন, যেখানে সমৃদ্ধি আর সামাজিক দায়বদ্ধতার মিশেল থাকবে। তাঁর মতে এই সমস্যাগুলির সমাধানের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থী সংস্কার প্রচেষ্টা তেমন কোনও কাজে আসবে না, দরকার হবে পরিবার, সমাজ ও উৎপাদন কাঠামোর আমূল পরিবর্তন। উৎপাদন কাঠামোর ক্ষেত্রে সমবায়নীতির ওপর চেরনিশেভস্কি জোর দিয়েছিলেন। নতুন চিন্তাভাবনার বিকাশের ক্ষেত্রে তার জোর ছিল বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা পদ্ধতির ওপর। সামাজিক ও নৈতিক উন্নয়নে প্রগতিশীল মতাদর্শের আয়ুধে সজ্জিত বুদ্ধিজীবীদের সক্রিয় ভূমিকার ওপর চেরনিশেভস্কি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সামাজিক বোধে শাণিত ও নৈতিক বোধে উন্নত এই ‘নতুন মানুষেরাই’ সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতির আমূল পরিবর্তনের কাজ শুরু করবেন, অন্যদের মধ্যে প্রগতিচেতনা ছড়িয়ে দেবেন এবং ক্রমশ রুশ সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিকে আমূল বদলে দেবেন – এমন এক রূপকল্প ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ উপন্যাসে চেরনিশেভস্কি হাজির করেছিলেন। উপন্যাসের শৈলি বা নান্দনিকতার দিক থেকে আখ্যানের ইতিহাসে সেরকম উল্লেখযোগ্য না হলেও চেরনিশেভস্কির এই উপন্যাসটি সমাজ রাজনৈতিক মতবাদের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তুর্গেনিভের ‘ফাদার্স অ্যান্ড সন্স’ উপন্যাসে (১৮৬২) নিহিলিজম সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত ছিল। তবে এর নায়ক হিসেবে নিহিলিস্ট বাজারভকে যেভাবে চিত্রায়িত করেছিলেন তুর্গেনিভ, তার চরিত্রে যে সব দোষাবহ দিককে সমীকৃত করেছিলেন, তা রাশিয়ার প্রগতিশীলদের অনেককেই খুশি করে নি। এর জবাব হিসেবেই পরের বছর চেরনিশেভস্কির ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ (১৮৬৩) রচিত ও প্রকাশিত হয়। আবার চেরনিশেভস্কির এই উপন্যাসের জবাব হিসেবে তার পরের বছর প্রকাশিত হয় দস্তয়েভস্কির ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’ (১৮৬৪)।
১৮৪৮ এর ইউরোপ জোড়া বিপ্লবের ঢেউ যখন রাশিয়ায় এসে পৌঁছেছিল, তখন অন্যান্য অনেকের মতো তা স্পর্শ করেছিল সাতাশ বছরের তরুণ দস্তয়েভস্কিকেও। এর তিন বছর আগে, মাত্র চবিশেই দস্তয়েভস্কির প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘পুওর পিপল’ প্রকাশের পরেই সাড়া ফেলেছে। সেই সময়কার বিখ্যাত সমালোচক বেলিনস্কি, তরুণ প্রগতিশীল ও পশ্চিমী মনোভাবাপন্ন লোকেদের মধ্যে যার খ্যাতি তখন তুঙ্গস্পর্শী – দস্তয়েভস্কির এই উপন্যাসটির ভূয়সী প্রশংসা করেন। এই উপন্যাসটির সূত্র ধরেই তরুণ দস্তয়েভস্কির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। দস্তয়েভস্কি ১৮৪৮ এর আলোড়ন তোলা সময়ে রুশ বিপ্লবী মিখাইল পেট্রাশেভস্কি চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ও পেট্রাশেভস্কিকে ঘিরে বিপ্লবীদের যে আলোচনাচক্র বসত সেখানে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেন। সেখানে আলোচনা হত ভূমিদাসপ্রথার অবসান বা রুশ সেন্সরশিপের কঠোরতা থেকে মুক্তির প্রয়োজনীয়তা ও পদ্ধতির ওপর। সমকালীন ইউরোপীয় বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে জার প্রথম নিকোলাস রুশ তরুণদের এইসব প্রগতিশীল উদ্যোগকে শুরুতেই ধ্বংস করার চেষ্টা করেন। আরো অনেকের সঙ্গে গ্রেপ্তার হন দস্তয়েভস্কিও। প্রথমে তাঁর প্রাণদণ্ডেরই আদেশ হয়েছিল, পরে শাস্তি খানিকটা লঘু করে তাঁকে পাঠানো হয় সাইবেরিয়ায় সশ্রম কারাদণ্ডে। এই কারাজীবন দস্তয়েভস্কির দর্শন ও চিন্তায় মৌলিক বদল আনে। সামাজিক প্রগতিচিন্তার চেয়েও তিনি ব্যক্তির স্বাধীনতাকে বেশি গুরুত্ব দিতে আরম্ভ করেন। এই ভাবনা ক্রমশ ব্যাপ্ত ও গভীর হয়। দস্তয়েভস্কি সোসালিজম, নিহিলিজম ইত্যাদি ধারণাকে ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থী বলে মনে করতে থাকেন এবং এগুলিকে রুশী ঐতিহ্যে ঢুকে পড়া পশ্চিম ইউরোপের প্রভাব বলে মনে করেন। চল্লিশের দশকের বেলিনস্কি ও পেট্রাশেভস্কি চক্রের চিন্তার উত্তরসূরী বলা যায় ষাটের দশকের চেরনিশেভস্কিদের। কিন্তু পেট্রাশেভস্কি চক্রের উৎসাহী তরুণ থেকে বদলে যাওয়া মধ্যবয়স্ক দস্তয়েভস্কি চেরনিশেভস্কির চিন্তা ও দর্শনকে মানতে তো পারলেইনই না, তাকে ব্যঙ্গে সমালোচনায় বিঁধতে চাইলেন ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’ নামের নভেলেট এ। চেরনিশেভস্কির ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ এবং তার পরের বছর প্রকাশিত দস্তয়েভস্কির ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’কে পাশাপাশি রেখে পড়লে স্পষ্ট বোঝা যায় কীভাবে দস্তয়েভস্কি সরাসরি চেরনিশেভস্কির দর্শন ও চিন্তার বিরুদ্ধ অবস্থান নিয়েছেন। চেরনিশেভস্কি মনে করেছিলেন যে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই যুক্তিবাদী এবং অধ্যয়ন ও প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার মধ্যে দিয়ে এই যুক্তিবাদকে ছড়িয়ে দিতে পারলে সামাজিক মুক্তি সম্ভব। বিজ্ঞানচিন্তাই প্রগতিচিন্তার সারাৎসার – এটাই ছিল চেরনিশেভস্কি সহ নিহিলিস্ট বা সোশালিস্টদের মত। উপযোগিতাবাদ, যুক্তিবাদ ও সমাজবাদের দর্শনটিকে দস্তয়েভস্কি নির্ধারনবাদ বলে মনে করলেন এবং ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’ থেকে তাকে খারিজ করা শুরু করলেন। মনে রাখতে হবে দস্তয়েভস্কির সমালোচনা ইংরেজ উপযোগিতাবাদী চিন্তাবিদ জেমস স্টুয়ার্ট মিল ও তাঁর গুরু জেরেমি বেন্থামের দর্শনের দিকেও ধাবিত হয়, কারণ চেরনিশেভস্কি যে সব চিন্তাধারা তাঁর লেখায় হাজির করেছিলেন তার অনেকগুলিরই উৎস রয়েছে মিল, বেন্থামের রচনায়।
‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’ এ যে অনামা ‘আন্ডারগ্রাউন্ড ম্যান’কে দস্তয়েভস্কি হাজির করলেন, তিনি প্রথম তারুণ্যে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদকেই মুক্তির পথ ভেবেছিলেন, কিন্তু চল্লিশে পৌঁছে এর সীমাবদ্ধতাগুলি তার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি সামাজিক ইউটোপিয়াবাদকে খারিজ করেন এবং দেখান যে মানুষ মোটেই মূলগতভাবে যুক্তিবাদী নয়, যুক্তির বাঁধনে মানুষের জীবন, চিন্তা ও কাজ বাঁধা থাকে না, সে যুক্তি ও অযুক্তির মিশ্রণে স্বাধীনভাবে নিজের ইচ্ছানুযায়ী পথ চলতে চায়। দস্তয়েভস্কির এই ‘আন্ডারগ্রাউন্ড ম্যান’ এর কাছে জীবনের স্বাধীনতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এবং যুক্তিবাদ, সমাজবাদ প্রভৃতি তার মতে স্বাধীনতার জন্য প্রতিবন্ধক। তার মতে যুক্তিবাদ মানুষকে যান্ত্রিক করে দিতে বাধ্য।
নিরাপত্তা ও সুখই যে মানুষের জীবনের জন্য যথেষ্ট নয়, বরং ক্ষেত্রবিশেষে তা তার স্বাধীনতার হন্তারক – এই ধারণাকে দস্তয়েভস্কি ফিরিয়ে আনেন তাঁর শেষ উপন্যাস ‘দ্য ব্রাদার্স কারমাজোভ’ এ। দ্য গ্রান্ড ইনকুইজিটর এর মধ্যে দিয়ে তিনি দেখান নিরাপত্তা ও সুখ শেষপর্যন্ত কীভাবে মানুষের মহত্তম আকাঙ্ক্ষা স্বাধীনতার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দস্তয়েভস্কির জীবনদর্শন ও উপন্যাসভাবনার এই সামগ্রিকতার মধ্যেই পড়া দরকার বিশ্বসাহিত্যের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’কে।
‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ এর মূল কথা একজন মানুষের তীব্র মনস্তাত্ত্বিক লড়াই, সেখানে সে মূলত নিজের সঙ্গে লড়ে। লড়ে নিজের এই অতীত বিশ্বাসের সঙ্গে যে ভাবত একজন সুপারম্যান সমাজের বৃহত্তর প্রয়োজনে একজন ঘৃণিত নিকৃষ্ট মানুষকে খুনও করতে পারে। তাতে সমস্যার কিছুই নেই, বরং তা প্রয়োজনবাদী দিক থেকে যুক্তিগ্রাহ্যই। কিন্তু বাস্তবে এরকম একজনকে খুন করে ফেলার পর ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ এর নায়ক রাসকলনিকভ তীব্র মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হয়। একসময়ে সে যে ভেবেছিল এই খুন করার আইনী ন্যায্যতা থাকুক বা নাই থাকুক, নৈতিক ন্যায্যতা আছে – সেই ভাবনা সৌধটির ধূলিস্যাৎ হয়ে যাবার কথাই ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট এ দস্তয়েভস্কি সবিস্তারে বলেছেন।
এই উপন্যাসের ইংরাজী অনুবাদের নাম যতই ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ (বা সেই সূত্রে বাংলায় ‘অপরাধ ও শাস্তি’) দেওয়া হোক না কেন, আমরা জানি মূল রুশ এ এই উপন্যাসের নাম ছিল ‘প্রেস্তুপ্লেনিয়ে ই নাকাজানিয়ে’ (преступление и наказание)। এই ‘প্রেস্তুপ্লেনিয়ে' কোনওমতেই প্রথাগত অর্থে শুধু অপরাধ নয়, এটা একধরনের সীমা লঙ্ঘন। অপরাধের আইনী কাঠামোর চেয়ে তা অনেক বেশি নৈতিকতার দিকটির সঙ্গে জড়িত। আর ‘নাকাজানিয়ে’র মধ্যেও রয়েছে আইন বা রাষ্ট্রের তরফে দেওয়া শাস্তির বদলে একধরনের আত্ম-অনুশোচনা জাত শাস্তির ব্যাপার। রাসকলনিকভের (Родион Раскольников) সাইবেরিয়ার কারাবাস এই উপন্যাসে শাস্তি হিসেবে সেভাবে আসেই নি, বরং এই কারাবাসপর্ব ও সেখানে সোনিয়ার উপস্থিতি এক ভেঙে যাওয়া মানুষের ফিরে আসার সূচনাপর্ব হয়ে উঠেছে। রাসকলনিকভের প্রকৃত শাস্তিপর্বটি আইনের দেওয়া কারাবাস পর্বের আগেই শুরু হয়ে গেছে। আইনী শাস্তিটি বরং তার ফিরে আসার পর্ব। উপলব্ধিতে জাগ্রত হয়ে ওঠার পর্ব। সোনিয়াকে নিয়ে জীবনে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখার পর্ব।
দস্তয়েভস্কি এই উপন্যাসে যে প্রশ্নগুলি তোলেন এবং যেভাবে একজন মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার অন্তরমহলে পাঠককে নিয়ে গিয়ে এই প্রশ্নগুলি নিয়ে চিন্তাপ্রক্রিয়ার বিস্তার ঘটাতে থাকেন – তা অসামান্য। উপন্যাসের বাইরের কাঠামোতে একটি ক্রাইম থ্রিলারের ছদ্ম আবরণ রয়েছে, কিন্তু উপন্যাসটিতে নায়কের মনস্তত্ত্বের গহন প্রদেশের উন্মোচন ভেতর থেকে সেই কাঠামোটিকে ধ্বসিয়ে দেয়। বাখতিন দস্তয়েভস্কির উপন্যাসকে যে বহুস্বরের ঘাত প্রতিঘাতের নিরিখে পাঠ করার কথা বলেন, এই আখ্যানকে বুঝতে তার অনুসরণ জরুরী। বিভিন্ন চরিত্রর এখানে শুধু নানাস্বরে কথা বলে না – উপন্যাসের নায়ক তথা কেন্দ্রীয় চরিত্র রাসকলনিকভের মধ্যেই আমরা নানা স্বর, নানা ভাবনার দ্বন্দ্বের এক জীবন্ত প্রকাশ দেখি।
উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদেই রাসকলনিকভের হতদরিদ্র ও অসহায় জীবনযাপনের ছবিটি দস্তয়েভস্কি সামনে আনেন। “যুবকের বাসস্থান খুপরিটা পাঁচতলা দালানের একেবারে টঙে – আসলে একটা চিলেকোঠা। ঘরের চেয়ে কুলুঙ্গির চাইতেই অবশ্য সেটার বেশি মিল। ঘরের টুকটাক কাজের জন্য একজন ঠিকে ঝি, পেত্রোভনা নাস্তাসিয়া আর সেই সঙ্গে দুপুরের খাবার জোগানের কড়ারে যে মহিলা তাকে এই খুপড়িটা ভাড়া দিয়েছিল – সেই প্রাসকোভিয়া (পাশেনকা) জারনিৎসিনা থাকে এক সারি সিঁড়ি নিচে – আলাদা ফ্ল্যাটে। রাস্তায় বেরোতে হলে বাড়িউলির হেঁসেলের পাশ দিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না যুবকের। হেঁসেলের দরজাটা আবার সিঁড়ির দিকটায় – তাও বেশির ভাগ সময় হাঁ করে খোলা। প্রত্যেকবার পাশ দিয়ে যাবার সময় একধরনের অসুস্থ মানসিকতা, একটা ভয় ভয় ভাব যুবককে পেয়ে বসে, লজ্জায় বিরক্তিতে সে ভুরু কোঁচকায়। বাড়িউলির কাছে সে আপাদমস্তক ঋণে জর্জরিত। তাই ভয় – পাছে মহিলার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়।”
রাসকলনিকভের মানসিক গঠন সম্পর্কে কথক পাঠককে শুরুতেই কী জানিয়ে দিচ্ছেন দেখা যাক – “যুবক ভীতু নয়, কুনো স্বভাবের নয়। বরং ঠিক উলটো। কিন্তু বেশ কিছুকাল হল, দেখে মনে হয় সে বিষণ্ণতায় ভুগছে, খিটখিটে হয়ে পড়েছে, উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। সকলের কাছ থেকে সে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে, নিজেকে নিজের ভেতর এতটাই গুটিয়ে ফেলেছে যে শুধু বাড়িউলির সঙ্গে সাক্ষাতে কেন যে কারও সঙ্গে সাক্ষাতেই তার ভয়।”
আমরা জানতে পারি তার আসল ভয় বাড়িউলিকে বা তার পাওনা গণ্ডা মেটানো নিয়ে নয়, তার মাথায় যে চিন্তাটা ঘুরছে, সেই মারাত্মক চিন্তাটা। “এমন একটা কাজে নামতে যাচ্ছি ... মনে মনে ভাবি, মানুষ সবচেয়ে ভয় পায় কিসে ? সবচেয়ে বেশি ভয় পায় নতুন কোন পদক্ষেপ নিতে, তার নিজেরই নতুন কোনও কথাকে।” অনতি পরেই আমরা জানব যে নতুন পদক্ষেপের কথা রাসকলনিকভের ভাবনায় ঘুরছে, সেটা হল এক মারাত্মক খুনের পরিকল্পনা।
রাসকলনিকভ ভাবতে চেয়েছিল কিছু ব্যতিক্রমী মানুষের সমাজের প্রচলিত নিয়মনীতির বাইরে গিয়ে কাজ করার অধিকার আছে। বিশেষ করে সেই কাজ যদি বেশীরভাগ মানুষের জন্য উপযোগী হয়। আগামীর মহত্তর সৃজনের স্বার্থে বর্তমানের কিছু ধ্বংসাত্মক কাজের ন্যায্যতার কথাও সে ভাবত। রাসকলনিকভ খুনের পরিকল্পনা করে এমন একজনকে, যে সুদখোর অর্থপিশাচ বন্ধকী কারবারি বহু হতভাগ্য মানুষের দুঃখ ও যন্ত্রণার কারণ। উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদেই কথক রাসকলিনকভের সঙ্গে পাঠককে নিয়ে যান সেই সুদখোর বুড়ি আলিওনা ইভানোভনার ঘরে। সেখানে রাসকলনিকভ জরিপ চালায় খুনকে ব্যাপারটাকে মসৃণ করার জন্য, পাঠক বুড়ির সঙ্গে তার পরিচয় সেরে নেবার সুযোগ পায়।
উপন্যাসের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে রাসকলনিকভের সঙ্গে পাঠক চলে আসে এক পানশালায়। এমনিতে পানে অনভ্যস্ত রাসকলনিকভ সেখানে ঢুকে পড়ে খানিকটা বন্ধক দিয়ে হাতে কিছু পয়সা আসায়, আর মূলত নিজের মানসিক উচাটনকে খানিকটা শান্ত করতে। সেখানে এসে তার সঙ্গে আলাপ হয় মার্মেলাদভ নামের এক পানাসক্তর সঙ্গে। সরকারি চাকরি করলেও নিজের মারাত্মক পানাশক্তির জন্য সে চাকরি পয়সা সব কিছুই খুইয়ে বসে। তার জন্য স্ত্রী এবং মেয়েদের অশেষ দুর্গতিতে পড়তে হয়। আগের পক্ষের মেয়ে সোনিয়াকে সংসার সামলাতে নামতে হয় বেশ্যাবৃত্তিতে। তার থেকে টাকা নিয়েও নেশাতুর হয়ে থাকে মার্মেলাদভ। পরে এই সোনিয়াই রাসকলনিকভের প্রেমিকা হয়ে উঠবে, হয়ে উঠবে তার অপরাধ থেকে উত্তরণের প্রধান অবলম্বন। সোনিয়ার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পরিচয় পাঠক বেশ বিস্তারিতভাবেই পেয়ে যান এই পরিচ্ছেদে।
উপন্যাসের তৃতীয় পরিচ্ছেদে রাসকলনিকভের পরিবার, বিশেষ করে তার মা ও বোন ‘দুনিয়া’র সঙ্গে পরিচিত হন পাঠক। গ্রাম থেকে মায়ের একটি দীর্ঘ চিঠি এসে পৌঁছয় রাসকলনিকভের কাছে আর এই চিঠির মধ্যে দিয়েই আসে নানা সংবাদ। রাসকলনিকভকে আদরের ডাক নাম রোদিয়া সম্বোধনে তার মা লেখেন, “আজ দু মাসের ওপর হয়ে গেল চিঠিতে তোর সঙ্গে আলাপ আলোচনার সুযোগ হয় নি। ... আমি যে চুপ করে ছিলাম সেটা আমার নিজের ইচ্ছায় নয়। এর জন্য, আশা করি, তুই আমাকে দোষ দিবি না। তুই তো জানিস আমি তোকে কত ভালোবাসি। তুই আমাদের একমাত্র অবলম্বন, আমার ও দুনিয়ার – আমাদের দুজনের একমাত্র আশা ভরসা।” এই চিঠি থেকেই আমরা জানতে পারি নিজের খরচ চালানোর উপযুক্ত সঙ্গতির অভাবে গত কয়েক মাস হল রাসকলনিকভ ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দিয়েছে। তার ছাত্রছাত্রী পড়ানো ও অন্যান্য আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এও জানতে পারি যে তার মায়েরও গ্রাম থেকে পুত্রকে সাহায্য করার মতো সঙ্গতি নেই। চারমাস আগে পনেরো রুবল সাহায্য পাঠাতেই তাকে পেনশন জামিন রেখে স্থানীয় মহাজনের থেকে ধার নিতে হয়েছিল। বোন দুনিয়া যে বাড়িতে ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা ও পড়ানোর কাজ নিয়েছিল, সেখান থেকেও তাকে চলে আসতে হয়েছিল গৃহকর্তা সভিদ্রিগাইলভের তার ওপর লোলুপ দৃষ্টি পড়ায়। স্বামীকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করেছে, এই বলে দুনিয়াকে দোষী সাব্যস্ত করে সভিদ্রিগাইলভের স্ত্রী তাকে প্রহার করে তাড়িয়েও দেয়। পরে অবশ্য তার ভুল ভাঙে এবং সে দুনিয়া ও সব পরিচিতদের কাছে বারবার ক্ষমা চেয়ে নেয়। এই চিঠিতে যে গুরুত্বপূর্ণ খবরটি তার মা রাসকেলনিভকে দেন তা হল – “দুনিয়ার একটি পাত্র জুটেছে, ওকে বিয়ে করতে চায়। দুনিয়া ইতিমধ্যে মতও দিয়েছে। সেই কথাটাই তোকে জানাতে চাই তাড়াতাড়ি করে। ... পাত্রের নাম পিওতর পেত্রোভিচ লুজিন – কোর্ট কাউন্সিলর। ... বয়স পঁয়তাল্লিশ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু চেহারা যথেষ্ট ভালো – মহিলাদের এখনো মনে ধরার মতো। তাছাড়া মোটের ওপর তিনি বেশ রাশভারী, ভদ্র চেহারার মানুষ, তবে একটু খিটখিটে – মনে হতে পারে সে দাম্ভিক।” মা পুত্রকে এও জানান যে লুজিন হয়ত এর মধ্যেই তার কাছে যাবে এবং প্রথম দৃষ্টিতে ওর ভেতর কোনও কিছুর অভাব দেখতে পেলে রোদিয়া যেন ভাবী জামাইয়ের ওপর মাথা গরম করে হুটহাট কোনও সিদ্ধান্ত না নিয়ে বসে। লুজিন নিজের সম্পর্কে যদিও জানিয়েছে নতুনতম প্রজন্মের ধারণার সঙ্গে সে একমত এবং যাবতীয় কুসংস্কারের সে ঘোর বিরোধী, তবু ‘খানিকটা আত্মম্ভরিতা তাঁর আছে এবং লোকে তাঁর কথাগুলো শুনলে তিনি খুব খুশি হন।’ লুজিনের সঙ্গে দুনিয়ার বিয়ের মধ্যে দিয়ে সঙ্কটে পড়া পুত্র রোদিয়ার সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনার প্রতিও চিঠিতে মা ইঙ্গিৎ দিয়ে রেখেছেন। পিওতর লুজিনের একজন সেক্রেটারি লাগবে এবং বাইরের লোক নয় ঘরের লোক হলেই বেশি সুবিধে হবে এরকম কথা প্রসঙ্গে রাসকলনিকভের কথাও যে এসেছে তা মা ছেলেকে চিঠিতে জানিয়ে রাখেন। বোন দুনিয়া আরো এগিয়ে ভেবেছে যাতে শেষপর্যন্ত রাসকলনিকভ পিওতর পেত্রোভিচ লুজিনের জুনিয়ার, এমনকি আইন ব্যবসার অংশীদারও হতে পারে। চিঠি শেষ করার আগে মা জানিয়ে দেন মেয়েকে নিয়ে তিনি শীঘ্রই সেন্ট পিটার্সবুর্গে আসছেন এবং পুত্রের সঙ্গে মিলনের জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন। ভাবী জামাতা লুজন যে তাদের যাতায়াত ব্যয়ের একাংশ বহন করছেন, এটা জানিয়ে পুত্রকে ভাবী জামাতার প্রতি খানিক নরম করে নেবার চেষ্টাও তিনি করেন।
পরবর্তী চতুর্থ পরিচ্ছেদে আমরা এই দীর্ঘ চিঠি পড়ার পর রাসকলনিকভের মানসিক যন্ত্রণা ও ক্ষোভের পরিচয় পাই। সে ভাবে , ‘ এ বিয়ে হবে না, আমি বেঁচে থাকতে হবে না! চুলোয় যাক পিওতর লুজিন।’ রাসকলনিকভ বোঝে তার বোন রোদিয়া নিজের জন্য, নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য, এমনকি নিজেকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্যও নিজেকে বিক্রি করবে না, কিন্তু অন্যের জন্য করবে। সার কথাটা হল ভাইয়ের জন্য, মার জন্য বিবাহের মাধ্যমে সে নিজেকে বিকিয়ে দিতে চলেছে। সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে এখানে সে নিজেই। তাকে ইউনিভার্সিটিতে আবার পড়ার সুযোগ করে দেওয়া, কোনও অফিসের অংশীদার করে দিতে পারা, তার ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করা – এসবই যে এই বিয়ের মূল লক্ষ্য তা বুঝে রাসকলনিকভ আরো বেশি যন্ত্রণাদীর্ণ ও অস্থির হয়ে ওঠে। এই পরিচ্ছেদের শেষে রাসকলনিকভ রওনা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু রাজুমিখিনের আস্তানার দিকে, এই শহরে একমাত্র যার সঙ্গেই তার খানিক বন্ধুত্ব রয়েছে। এইভাবে উপন্যাসের প্রথম চার পরিচ্ছেদের মধ্যেই আখ্যানের প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রদের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় হয়ে যায়।
উপন্যাসের পঞ্চম পরিচ্ছেদে ঘুমের মধ্যে নানা রকমের স্বপ্ন দেখতে থাকে রাসকলনিকভ। সেই স্বপ্নে একটি খুনের নির্মম ছবি এত স্পষ্ট ছিল যে তার ঘুমও ভেঙে যায়। একটু ঘোড়াকে মাথায় আঘাত করে মেরে ফেলার সেই দৃশ্যকল্পের মধ্যে তার আগামী খুনের পরিকল্পনা যে মিশে গিয়েছে, সেটা ভেবে সে আরো অস্থির হয়ে পড়ে। এই অস্থিরতা ও মানসিক বিকার নিয়েই ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে সে পৌঁছয় বুড়ির বাড়ির চৌকাঠে। সে কীভাবে হত্যাকাণ্ডের উদ্দ্যেশ্যে কুড়ুলটি তুলে কোটের তলায় ঢুকিয়ে নেয়, অস্থির নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় পথ চলে কথক তার বিস্তারিত বর্ণনা দেন। আর তারপরেই আসে সপ্তম পরিচ্ছেদ ও হত্যাকাণ্ডের মারাত্মক ঘটনাটির অনুপুঙ্খ বর্ণনা। একটি খুনেই গোটা বিষয়টি শেষ হয়ে যায় নি। ভেজানো থাকা দরজা খুলে দিদির মৃতদেহ দেখে সে যখন হতবাক, তখন নিরীহ সেই বোনকেও বাঁচার তাগিদে খুন করে রাসকলনিকভ। তারপর জোড়া খুনের দগদগে দাগ নিয়ে সরে পড়ে সেখান থেকে। এই সপ্তম পরিচ্ছেদে এসেই শেষ হয় উপন্যাসের প্রথম পর্বটি।
তবে শারীরিকভাবে সরে পড়লেও এই খুনের আবেশ থেকে সে আর বেরোতেই পারে নি। শেক্সপীয়রের লেডি ম্যাকবেথ যেমন ডানকানকে খুন করার পর সবসময় রক্তের গন্ধ পেত আর সেই সূত্রের করেছিল এই নাটকীয় উক্তি, “All the perfumes of Arabia will not sweeten this little hand”, তেমনি রাসকলনিকভও আর মানসিক যন্ত্রণা তাকে ঘিরে রেখেছে। দস্তয়েভস্কির এই শ্রেষ্ঠ আখ্যান রাসকলনিকভের সেই অপরাধের মানসিক যন্ত্রণা ও শাস্তিভোগেরই কাহিনী। উপন্যাসের প্রথম পর্ব যদি অপরাধ সংগঠনের কথা বলে, পরবর্তী পর্বগুলি বলেছে সেই অপরাধের শাস্তির কথা। এই শাস্তিকে শুধুমাত্র আইনী শাস্তি হিসেবে দেখান নি দস্তয়েভস্কি। রাসকলনিকভের সঙ্কটটা কখনোই ক্রাইম থ্রিলারের পলায়নপর খুনির সঙ্কট নয়। তার সঙ্কট মানসিক যন্ত্রণা ও অপরাধবোধে ক্ষয়ে যাওয়ার। উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব থেকে শুরু হয় মনোবিকলনের সেই অধ্যায়।
দ্বিতীয় পর্বের প্রথম পরিচ্ছেদে রাসকেলনিকভকে খুনের প্রমাণ লোপের চেষ্টা করতে দেখি আমরা। ‘দ্রুত নজর বুলিয়ে দেখতে লাগল নিজেকে, নিজের আপাদমস্তক, সর্বাঙ্গ, গায়ের ওভারকোটটার আগাপাশতলা – চিহ্ন কি আছে কোথাও ? কিন্তু ওভাবে দেখা সম্ভব হচ্ছিল না। জ্বরের ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে নিজের গা থেকে একে একে সমস্ত জামাকাপড় খুলে সে আবার সবকিছু, সর্বত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। শেষ সুতো আর টুকরো পর্যন্ত ওলট পালট করে দেখল, নিজের ওপর আস্থা রাখতে না পেরে বার তিনেক সে পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি করল।’ এই সতর্কতা থেকে বোঝা যায় খুনের পর অন্তত প্রথমদিকে সে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় খুনের প্রমাণ লোপের জন্য সচেষ্ট ছিল। তবে তার মন যে প্রথম থেকেই অপরাধবোধে দীর্ণ ছিল তা বোঝা যায় অন্য একটি ঘটনায় পুলিশ থানায় ডাক পড়লে যখন সে ভাবে খুনের কারণেই এই ডাক এবং প্রথমেই অপরাধ স্বীকার করে নেওয়া ভালো হবে। তবে গিয়ে যখন সে বুঝতে পারে বাড়িভাড়ার হ্যান্ডনোট সংক্রান্ত এক মামুলি অভিযোগে তাকে ডাকা হয়েছে, সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। একদিকে নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর উদগ্র বাসনায় সে পুলিশ আধিকারিকদের ওপর তম্বী করে, অন্যদিকে যখন আধিকারিকেরা খুনের ঘটনাটি নিয়ে আলোচনা করে তখন উৎকর্ণ হয়ে তা শোনে এবং প্রতিক্রিয়ায় নিজের জ্ঞান হারায়। খুনের পর রাসকেলনিকভের মানসিকতা ও অস্থিরতার জায়গাগুলিকে বিস্তারিতভাবে দ্বিতীয় পর্বের প্রথম পরিচ্ছেদেই তুলে আনেন দস্তয়েভস্কি। পরবর্তী পরিচ্ছেদগুলিতেও রাসকলনিকভের মানসিক অস্থিরতার বিস্তারিত বিবরণ রাখেন আখ্যানকার। বন্ধু রাজুমিখিন, বন্ধুস্থানীয় ডাক্তার জোসিমভ এর উপস্থিতিতে রাসকেলনিকভের ঘরে যে কথাবার্তা, আলাপ আলোচনা চলে সেখানে অসুস্থ অবস্থায় শুয়ে থাকতে দেখি রাসকেলনিকভকে। খুনের প্রসঙ্গে কথাবার্তাতেই সে যে মাঝে মাঝে কেবল উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে তাই নয়, ঘুমের মধ্যেও করতে থাকে নানা অসংলগ্ন আচরণ। আচ্ছন্নতা বা ঘুমের মধ্যেও সে রক্তের চিহ্ন লেগে থাকা পাতলুনের অংশ বা মোজাটিকে খুঁজে বেড়ায় উদভ্রান্তের মতো।
দ্বিতীয় পর্বের প্রথম পরিচ্ছেদে রাসকলনিকভকে খুনের প্রমাণ লোপের চেষ্টা করতে দেখি আমরা। ‘দ্রুত নজর বুলিয়ে দেখতে লাগল নিজেকে, নিজের আপাদমস্তক, সর্বাঙ্গ, গায়ের ওভারকোটটার আগাপাশতলা – চিহ্ন কি আছে কোথাও ? কিন্তু ওভাবে দেখা সম্ভব হচ্ছিল না। জ্বরের ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে নিজের গা থেকে একে একে সমস্ত জামাকাপড় খুলে সে আবার সবকিছু, সর্বত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। শেষ সুতো আর টুকরো পর্যন্ত ওলট পালট করে দেখল, নিজের ওপর আস্থা রাখতে না পেরে বার তিনেক সে পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি করল।’ এই সতর্কতা থেকে বোঝা যায় খুনের পর অন্তত প্রথমদিকে সে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় খুনের প্রমাণ লোপের জন্য সচেষ্ট ছিল। তবে তার মন যে প্রথম থেকেই অপরাধবোধে দীর্ণ ছিল তা বোঝা যায় অন্য একটি ঘটনায় পুলিশ থানায় ডাক পড়লে যখন সে ভাবে খুনের কারণেই এই ডাক এবং প্রথমেই অপরাধ স্বীকার করে নেওয়া ভালো হবে। তবে গিয়ে যখন সে বুঝতে পারে বাড়িভাড়ার হ্যান্ডনোট সংক্রান্ত এক মামুলি অভিযোগে তাকে ডাকা হয়েছে, সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। একদিকে নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর উদগ্র বাসনায় সে পুলিশ আধিকারিকদের ওপর তম্বী করে, অন্যদিকে যখন আধিকারিকেরা খুনের ঘটনাটি নিয়ে আলোচনা করে তখন উৎকর্ণ হয়ে তা শোনে এবং প্রতিক্রিয়ায় নিজের জ্ঞান হারায়। খুনের পর রাসকলনিকভের মানসিকতা ও অস্থিরতার জায়গাগুলিকে বিস্তারিতভাবে দ্বিতীয় পর্বের প্রথম পরিচ্ছেদেই তুলে আনেন দস্তয়েভস্কি। পরবর্তী পরিচ্ছেদগুলিতেও রাসকলনিকভের মানসিক অস্থিরতার বিস্তারিত বিবরণ রাখেন আখ্যানকার। বন্ধু রাজুমিখিন, বন্ধুস্থানীয় ডাক্তার জোসিমভ এর উপস্থিতিতে রাসকলনিকভের ঘরে যে কথাবার্তা, আলাপ আলোচনা চলে সেখানে অসুস্থ অবস্থায় শুয়ে থাকতে দেখি রাসকলনিকভকে। খুনের প্রসঙ্গে কথাবার্তাতেই সে যে মাঝে মাঝে কেবল উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে তাই নয়, ঘুমের মধ্যেও করতে থাকে নানা অসংলগ্ন আচরণ। আচ্ছন্নতা বা ঘুমের মধ্যেও সে রক্তের চিহ্ন লেগে থাকা পাতলুনের অংশ বা মোজাটিকে খুঁজে বেড়ায় উদভ্রান্তের মতো।
দ্বিতীয় পর্বের পঞ্চম পরিচ্ছেদে নিজের ঘরে বোন দুনিয়ার বাগদত্ত লুজিনের সঙ্গে প্রথমবার মুখোমুখি হয় রাসকলনিকভ। এই সাক্ষাৎকার পর্বটি অবশ্য কেবল দুজনের মধ্যেই ঘটে নি। রাসকলনিকভের ছোট্ট ঘরটিতে তখন উপস্থিত তার বন্ধু রাজুমিখিন, বন্ধু ডাক্তার জোসিমভ। মায়ের চিঠি পেয়েই সে ঠিক করে রেখেছিল সে বেঁচে থাকতে লুজিন আর বোন দুনিয়ার বিয়ে সে হতে দেবে না। বোন যে দাদা রোদিয়ার কথা ভেবেই এই বিয়ের মাধ্যমে নিজেকে পিওতর পেত্রোভিচ লুজিনের কাছে বলি দিতে যাচ্ছে, তা তার কাছে স্পষ্ট হয়েছিল। বলা বাহুল্য সাক্ষাৎকারটি রাসকলনিকভের দিক থেকে একেবারেই সৌজন্যসম্মত হয় নি। আর তা শেষ হয় চরম তিক্ততায় যখন রাসকলনিকভ গলা চড়িয়ে লুজিনকে বলে – ‘আপনি যদি ফের আমার মা সম্পর্কে আর একটি কথাও উচ্চারণ করার স্পর্ধা দেখান তাহলে আমি আপনাকে এমন ধাক্কা মারব যে সিঁড়ি দিয়ে ডিগবাজি খেয়ে নিচে নামতে হবে আপনাকে’। এরপর লুজিনই শুধু বেরিয়ে যান, তাই নয়। বেরিয়ে আসে বন্ধু রাজুমিখিন আর ডাক্তার জোসিমভও। তবে রাজুমিখিন বা জোসিমভের মধ্যে এক ধরনের আশঙ্কা দানা বাঁধতে থাকে রাসকলনিকভকে নিয়ে। তারা স্পষ্টভাবে উচ্চারণ না করলেও বোঝা যায় যে খুনের ঘটনার সঙ্গে রাসকলনিকভের সম্পর্ক নিয়ে তাদের মনে ভয় দানা বাঁধছে। তাদের সন্দেহ হচ্ছে রাসকলনিকভের অসুস্থতা ও অস্থিরতার সঙ্গে খুনের ঘটনাটির হয়ত কোনও সম্পর্ক আছে। “ওকে যদি ঠিক জায়গায় ঘা মারা যেত তাহলে কাজের কাজ হত। ... ওর মাথার ভেতরে কিছু একটা আছে – বদ্ধমূল হয়ে আটকে আছে, যার ভার ওর কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে। ... এখানেই আমার ভয়। সত্যিকারের ভয়।” রাজুমিখিনের কথার এই ইঙ্গিতটুকু ধরে তাকে আরো এগিয়ে নিয়ে গিয়ে জোসিমভ বলে, “তুমি লক্ষ করেছ কি, সবেতে ও উদাসীন, সব ব্যাপারে চুপচাপ, কেবল একটা বিষয় ছাড়া – সে প্রসঙ্গ উঠলে ও আর স্থির থাকতে পারে না – সেটা হল খুনের ঘটনা।”
দ্বিতীয় পর্বের শেষ দুই পরিচ্ছেদে আমরা রাসকলনিকভের এমন এক বৈশিষ্ট্য দেখি, যা বুঝিয়ে দেয় নেহাৎ অর্থের লোভে বুড়িকে সে খুন করে নি। নিজের শেষ অর্থটুকুও সে দরিদ্র সাহায্যে অকাতরে দিয়ে দিতে পারে। নিজেকে কপর্দকশূন্য করে ফেলার পর আক্ষেপ তার হয় বটে, কিন্তু অসহায়কে দানের এই প্রবণতা যে তার মজ্জাগত, সে বিষয়ে সংশয় থাকে না। এই পর্বের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে দুক্লিদা নামের একটি মেয়ে তার কাছে ছয় কোপেক চাইলে সে পকেট হাতড়ে পাওয়া পনেরো কোপেক দিয়ে দেয় নিমেষে। ক্রিস্টাল প্যালেসের রেস্তোরায় তিরিশ কোপেক খাবারের বিল মেটানোর সময় ওয়েটারকে রাসকলনিকভ বখশিস দেয় আরো কুড়ি কোপেক। আর পরবর্তী সপ্তম পরিচ্ছেদে মার্মেলাদভের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর তার অসহায় পরিবারের হাতে দিয়ে আসে সে তার কাছে থাকা বিশ রুবল। এই টাকাটাই হয়ে উঠবে মার্মেলাদভের শেষকৃত্যের পাথেয় কিন্তু স্বল্প ও সদ্যচেনা এই মানুষটির পরিবারকে এই সাহায্য করে রাসকলনিকভ হয়ে পড়বে কপর্দকশূন্য।
উপন্যাসের তৃতীয় পর্বটি আগের পর্বদুটি থেকে খানিকটা আলাদা কারণ এই পর্বেই আমরা রাসকলনিকভ ছাড়া উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্রদের অনেকটা বিস্তার আর স্পষ্টতা নিয়ে সামনে আসতে দেখি। দ্বিতীয় পর্বের শেষ অনুচ্ছেদটিতে গ্রাম থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গে এসে পৌঁছতে দেখি আমরা রাসকলনিকভের মা বোনকে। কিন্তু দীর্ঘ চিঠির অপ্রত্যক্ষ চেনাজানার পর্ব পেরিয়ে তাদের বিস্তারিত ও সজীব উপস্থিতি পাঠক প্রথম পান তৃতীয় পর্বের প্রথম পরিচ্ছেদে। রাসকলনিকভের বন্ধু রাজুমিখিনও এই সময়েই প্রথম নিজের স্বকীয়তা ও পূর্ণাঙ্গতা নিয়ে রাসকলনিকভের ছায়া থেকে বেরিয়ে পাঠকের সামনে আসে। পাঠকের সঙ্গে বিস্তারিত চেনাজানা হয় রাজুমিখিন ও রাসকলনিকভের বন্ধুস্থানীয় চিকিৎসক জোসিমভেরও। তৃতীয় পর্বের প্রথম তিন পরিচ্ছেদে রাসকলনিকভ খানিকটা আড়ালেই থাকে, তার ঘনিষ্টবৃত্তের মানুষজনেদের নিজস্ব আলাপচারিতা এগুলিতে প্রাধান্য পায়। চতুর্থ পরিচ্ছেদটি রাসকলনিকভের ঘরে তার উপস্থিতিতে চলা আলাপ আলোচনার বিবরণ সমৃদ্ধ হলেও এর কেন্দ্রে আছে সোনিয়া, মৃত মার্মেলাদভের আঠারো বছর বয়সের ভাগ্য বিড়ম্বিত কন্যা। রাসকলনিকভ ছাড়াও তার মা ও বোন দুনিয়ার মনোজগতেও সে ঢুকে পড়ে এই পরিচ্ছেদেই।
তৃতীয় পর্বের পঞ্চম অনুচ্ছেদটি নানা কারণেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই রাসকলনিকভ বন্ধু রাজুমিখিনের সূত্র ধরে মুখোমুখি হয় পুলিশের গোয়েন্দা পর্ফিরি পেত্রোভিচের। এই আলাপচারিতাতেই উঠে আসে উপন্যাসের একটি কেন্দ্রীয় থিম – অপরাধ সংগঠন তত্ত্ব – যা রাসকলনিকভ হাজির করেছিল মাস কয়েক আগে লেখা তার ‘অপরাধ প্রসঙ্গে’ নামক এক প্রবন্ধে। সাময়িক সমীক্ষা পত্রিকায় প্রকাশিত এই প্রবন্ধে মূল আলোচনাটা ছিল অপরাধ সংগঠনের সমস্ত সময়ব্যাপী একজন অপরাধীর মানসিক অবস্থা কী হতে পারে তাই নিয়ে। তবে গোয়েন্দা প্রবর পর্ফিরির কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঠেকেছিল প্রবন্ধের শেষে উপস্থাপিত এক সূত্রাকার ইঙ্গিতে, যেখানে ব্যক্ত হয়েছিল এইরকম এক চিন্তা যে, ‘দুনিয়ার সমস্ত মানুষ সাধারণ ও অসাধারণ এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত। যারা সাধারণ, তাদের নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে, আইন লঙ্ঘনের কোনও অধিকার তাদের নেই ... আর যারা অসাধারণ তারা যে কোনও রকম অপরাধ সংগঠনের এবং যে কোনও উপায়ে আইন লঙ্ঘনের অধিকারী, একমাত্র এই কারণে যে তারা অসাধারণ।’ পর্ফিরি এইভাবেই রাসকলনিকভের প্রবন্ধের চিন্তাসূত্রটিকে উপস্থাপিত করলেও তাকে খানিকটা অন্যভাবে ব্যাখ্যা করা দরকার বলে রাসকলনিকভ মনে করে সেই আলাপচারিতায়। ‘আমি আদৌ জোর দিয়ে বলিনি যে যারা অসাধারণ তারা অবধারিতভাবে সবসময় সবরকম অনাচার করবে এবং করতে বাধ্য থাকবে ... আমি এই আভাস দিয়েছিলাম যে অসাধারণ ব্যক্তির এমন অধিকার আছে ... অর্থাৎ কিনা আনুষ্ঠানিক অধিকার নয় ... সে নিজেই নিজেকে, নিজের বিবেককে মাত্রা লঙ্ঘনের অধিকার দিতে পারে ... একমাত্র সেই ক্ষেত্রে যেখানে তার আইডিয়া তা দাবি করে। আর তার সে সমস্ত আইডিয়া মানবজাতির পক্ষেও মঙ্গলজনক হতে পারে। ... আমার মতে যদি পরিস্থিতি বিপাকে দেখা যেত যে নিউটন বা কেপলারের আবিষ্কারের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে অথবা ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে একজন, দশজন বা একশজন মানুষ ... এমনকি তার চেয়েও বেশি সংখ্যক মানুষের প্রাণবলি না দিয়ে সেই আবিষ্কার কোনমতে জনসমক্ষে প্রচারিত হতে পারছে না, তাহলে সে আবিষ্কারকে সমগ্র মানবজাতির কাছে সুপরিচিত করে তোলার উদ্দেশ্যে সেই দশজন, এমনকি একশজন মানুষকেও উৎখাত করার অধিকার ... শুধু অধিকার নয়, আমি বলব কর্তব্যও ... নিউটনের থাকত। তা থেকে কিন্তু আদৌ এই সিদ্ধান্তে আসা যায় না যে ডাইনে বাঁয়ে সামনে যাকে খুশি খুন করার অথবা বাজারে নিত্য চুরি করার অধিকার নিউটনের ছিল।’
উপন্যাসের প্রায় মাঝামাঝি অবস্থিত এই পরিচ্ছেদটি উপন্যাসের কেন্দ্রীয় থিমটিকে খুব স্পষ্টভাবে নিয়ে আসে আলোচনাবৃত্তে। উনিশ শতকের ষাটের দশকে নিহিলিজম এর মতবাদটি নিয়ে যখন প্রবল বিতর্ক তৈরি হয়েছিল রাশিয়ার সমাজ ও সাহিত্যে, তখন দস্তয়েভস্কিও সেখানে অংশ নিয়েছিলেন একথা আমরা আগে বলেছি। তুর্গেনিভের ফাদার্স অ্যান্ড সনস এ বাজারভের চরিত্রায়ন, তার মতামতের সীমাবদ্ধতা ও পরিণতি ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে নিহিলিজমের উপস্থাপিত ধরনটিকে যথার্থ বলে মানতে পারেন নি সে সময়ের রাডিক্যালদের প্রধান মুখ চেরনিশেভস্কি। আবার চেরনিশেভস্কির হোয়াট ইজ টু বি ডান সহ নানা লেখালেখিতে প্রকাশিত নিহিলিজমের জয়গান ছিল দস্তয়েভস্কির সমালোচনার অন্যতম নিশানা। নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড এ প্রথমবারের জন্য এই সমালোচনা প্রকাশিত হয়, পরে একে অন্য স্তরে ও গভীরতায় ধরার চেষ্টা আমরা দেখতে পাই ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ উপন্যাসে। এই পরিচ্ছেদেই রাজুমিখিনের কথার মধ্যে নিহিলিস্টদের অপরাধতত্ত্বর সমালোচনাকে উঠে আসতে দেখেছি আমরা। রাজুমিখিন অবশ্য নিহিলিস্ট এর বদলে ব্যবহার করেছিল সমাজতন্ত্রীদের কথা, তৎকালীন রাশিয়ায় যে পরিচয়গুলো ছিল পরস্পর সম্পর্কিত এমনকি অনেক ক্ষেত্র বিশেষ সম নির্দেশকও। রাজুমিখিন সমাজতন্ত্রীদের অপরাধ সংক্রান্ত দৃষ্টিকোণটি তুলে ধরেছে এইভাবে – ‘অপরাধ হল সমাজব্যবস্থার অস্বাভিকতার বিরুদ্ধে একধরনের প্রতিবাদ – এটাই শেষ কথা, এর বেশি কিছু নয়, আর কোন কারণ থাকতে পারে না, আর কোন কারণকে স্বীকার করা যায় না ... সমাজকে যদি স্বাভাবিক করে গড়ে তোলা যায় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সব অপরাধও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, যেহেতু প্রতিবাদ করার কিছু থাকবে না, রাতারাতি সকলে সৎ হয়ে যাবে।’ এই দৃষ্টিকোণটি রাজুমিখিনের কেন গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না, তাও সে জানিয়েছে এরপর। ‘মানুষের স্বভাব বা প্রকৃতিকে উপেক্ষা করা হচ্ছে, তাকে একেবারে বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে, যেন তার কোন অস্তিত্বই নেই। মানবজাতি ইতিহাসের সজীব পথ ধরে শেষপর্যন্ত বিকশিত হয়ে পরিণামে আপনা আপনি স্বাভাবিক সমাজে রূপান্তরিত হবে – এ মত তারা মানে না। বরং তারা মনে করে কোন গণিতবিদের মস্তিষ্কপ্রসূত এক সমাজব্যবস্থা এক নিমেষে সমস্ত মানবজাতিকে সংগঠিত করে ফেলবে এবং পলকের মধ্যে তাদের করে তুলবে সৎ ও নিষ্পাপ। সেটা ঘটবে যে কোন সজীব প্রক্রিয়ার চেয়ে দ্রুত, ইতিহাসের কোন সজীব পথ ছাড়াই।’ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র অবশ্যই রাজুমিখিনের মত সরলভাবে সমাজব্যবস্থা, মানব প্রকৃতি ও ইতিহাসের অগ্রগতিকে দেখে না, কিন্তু বর্তমান পরিসরে আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যেটা তা হল উনিশ শতকের ষাটের দশকের সমাজতন্ত্রীদের ভাবনাচিন্তাকে কীভাবে দেখা হত, তার একটা বয়ান এখানে উপস্থিত। নিশ্চিত যে বিতর্কের সেই ঝোড়ো পটভূমিতে আরো অনেক বয়ান এবং বয়ানগুলির মধ্যে অনেক বিতর্ক নিহিত ছিল। দস্তয়েভস্কি যে চেরনিশেভস্কিদের মত বা নিহিলিস্ট দর্শনকে মানতে পারেন নি এবং এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন তা নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে শুরু করে ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট হয়ে দ্য ব্রাদার্স কারমাজোভ পর্যন্ত পরিণত বয়সের সমস্ত উল্লেখযোগ্য আখ্যানেই স্পষ্ট।
সামাজিক দার্শনিক মতবাদের প্রগতি প্রতিক্রিয়ার ছকে দস্তয়েভস্কির মহত্ত্বকে যে বিচার করা যায় না, বিখ্যাত মার্কসবাদী নন্দনতাত্ত্বিক ও উপন্যাসব্যাখ্যাতা গেয়র্গ লুকাচ আমাদের তা মনে করিয়ে দিয়েছেন। দস্তয়েভস্কি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লুকাচ আমাদের মনে করিয়ে দেন চেকভের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যসূত্র। চেকভ বলেছিলেন একজন শিল্পী সাহিত্যিকের কাজ সঠিক প্রশ্ন তোলা, সেই প্রশ্নের সঠিক উত্তর তিনি দিতে পারলেন কিনা, সেটা আদৌ ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। চেকভ এই প্রসঙ্গে পুশকিনের ‘ইউজিন ওনেজিন’ আর তলস্তয়ের ‘আনা কারেনিনা’র কথা তুলেছিলেন। পুশকিন বা তলস্তয় এখানে কোনও সমস্যারই নিরসন করতে পারেন নি, কিন্তু সঠিক সমস্যাকে তাঁরা অসামান্যভাবে হাজির করেছিলেন বলেই এগুলি কালজয়ী সাহিত্য হিসেবে গণ্য হয়েছে। দস্তয়েভস্কির সাহিত্য বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে লুকাচ এই সূত্রটিকেই অনুসরণ করেছেন। তাঁর মতে দস্তয়েভস্কি সমস্যার যে সমাধানগুলি দেখান সেগুলি যে শুধু পরবর্তীকালের নিরিখেই শুধু ভ্রান্ত ঠেকবে তা নয়, সেকালেও এগুলি ছিল যথেষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রের। কিন্তু তাতে দস্তয়েভস্কির অসামান্যতা বাতিল হয়ে যায় না। তিনি বিশিষ্টতার আসনে বসে আছেন সমস্যাগুলিকে সঠিকভাবে হাজির করতে পারার জন্য, সঠিক প্রশ্নগুলিকে অসামান্যভাবে সামনে নিয়ে আসতে পারার জন্য।
রাসকলনিকভের সমস্যাকে দস্তয়েভস্কি যেভাবে হাজির করতে পারলেন তা কেবল সামাজিক রাজনৈতিক দর্শনের ব্যাপার নয়, একটি চরিত্রের বিশ্বাস ও বাস্তবের তীব্র টানাপোড়েনের বলিষ্ঠ উপস্থাপন। ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট উপন্যাসের এই রাজনৈতিক দার্শনিক বিতর্কগুলি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ এবং দস্তয়েভস্কি অত্যন্ত সচেতন উদ্দেশ্যে এগুলিকে উপন্যাসে হাজির করেছেন। কিন্তু ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্টের মূল আকর্ষণ রাসকলনিকভের চেতনাস্তরে ঘটে চলা প্রতি মুহূর্তের উথালপাতালের অন্তরঙ্গ ভাষ্য, তার ক্রমপরিণতির জীবন্ত চিত্র।
উপন্যাসের চতুর্থ পর্বে রাসকলনিকভের চেতনাস্তরের উথালপাতালের দুটি বিপরীত ছবি ধরা আছে চতুর্থ আর পঞ্চম পরিচ্ছেদে। চতুর্থ পরিচ্ছেদটি যদি সোনিয়ার কাছে তার স্বীকারোক্তি ও আত্মসমর্পণের ইঙ্গিতবাহী হয়, তবে পরের পঞ্চম পরিচ্ছেদটি, যা ঘটে পুলিশ স্টেশনে গোয়েন্দা পর্ফিরি পেত্রোভিচের ঘরে – সেখানে রয়েছে অপরাধ স্বীকারের প্রবণতার বিরুদ্ধে তার তীব্র মরীয়া লড়াই। এই লড়াইয়ে সে যত ভেতর থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে, বাইরে ততই সে মরীয়া হয়ে ওঠে। চতুর্থ পরিচ্ছেদে সোনিয়ার ঘর খুঁজে রাসকলনিকভের সেখানে চলে যাওয়া, সোনিয়ার পায়ে চুমু খাওয়া, তাকে জানানো এই দুনিয়ায় কেবল তারা দুজনেই পড়ে আছে পরস্পরের সঙ্কটে সহভাগী হবার জন্য – সবকিছুর মধ্যেই আকস্মিকতা তীব্র। এই তীব্রতা আরো বেশি কারণ উপন্যাসের চতুর্থ পর্বের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদেই আমরা দেখেছিলাম যে লুজিন ও তার সঙ্গে বোন দুনিয়ার বিবাহ সম্ভাবনাকে কেন্দ্র করে রাসকলনিকভ পরিবারের সঙ্গে বিবাদ ও মনোমালিন্যে জড়িয়ে পড়ছিল, তা প্রায় অপসৃত হয়েছে। উপন্যাসের চতুর্থ পর্বের প্রথম পরিচ্ছেদটিতেও অন্য এক অস্বস্তি আর ক্ষোভের হাত থেকে রাসকলনিকভের খানিক মুক্তি ঘটেছিল। এই পরিচ্ছেদে রাসকলনিকভ প্রথমবারের জন্য প্রত্যক্ষভাবে মুখোমুখি হয় স্ভিদ্রিগাইলভের, মার চিঠি থেকে যার কথা সে শুনেছিল, জেনেছিল তার জন্যই একসময় বোন দুনিয়াকে অশেষ কষ্ট ও অপমান সহ্য করতে হয়েছে। সে দুনিয়ার দিকে শুধু লোলুপ দৃষ্টিই দেয় নি, সেই সূত্র ধরে দুনিয়ার নামে রটেছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা এক কলঙ্কও। পরে অবশ্য স্ভিদ্রিগাইলভের স্ত্রী মার্ফা পেত্রোভ্নার আন্তরিক উদ্যোগে সে কলঙ্ক দূর হয় ও সত্য প্রকাশিত হয়। আমরা দেখি স্ভিদ্রিগাইলভ রাসকলনিকভের কাছে এসেছে স্ত্রী মার্ফার সদ্য প্রয়াণের পর একগুচ্ছ অনুরোধ নিয়ে। একসময় তাদের তরফে দুনিয়ার প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছিল তারই ক্ষতিপূরণ ও অনুতাপ থেকে সম্ভবত মার্ফা তার উইলে দুনিয়াকে তিন হাজার রুবল দিয়ে গেছেন। সেটা যেন দুনিয়া গ্রহণ করে এটা তার আর্জি। তার অন্য আর্জিটি নিজের তরফে। একসময় তার জন্যই দুনিয়াকে অশেষ কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছিল। এই জন্য পরে তার বিবেক যন্ত্রণাও তৈরি হয়েছে এবং সে চেয়েছে দুনিয়া ভালো থাকুক। কিন্তু লুজিনের সঙ্গে দুনিয়ার প্রস্তাবিত বিবাহ দুনিয়ার পক্ষে সুখকর হবে না বলে সে মনে করে এবং দেখা যায় এই একটি রাসকলনিকভের সঙ্গে তার মত একই। রাসকলনিকভের মতো তারও ধারণা আর্থিক সঙ্কট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই দুনিয়া লুজিনকে বিবাহ করতে বাধ্য হচ্ছে। সে এই সঙ্কট মোচনের জন্য নিজের সম্পত্তি থেকে দশ হাজার রুবল দুনিয়াকে দিতে চায়, যাতে সে লুজিনকে বিবাহে বাধ্য না হয়। অবশ্য সে নিজে যে দুনিয়ার প্রতি লুব্ধ বা তার পাণিপ্রার্থী নয়, সেটাও সে স্পষ্ট করে দিয়েছে এবং জানিয়েছে যে তার বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে এবং সে তার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে।
উপন্যাসের চতুর্থ পর্বের তৃতীয় পরিচ্ছেদটিতে সেন্ট পিটার্সবার্গের মতো নতুন জায়গায় এসে পড়া রাসকলনিকভের মা ও বোন আশ্রয় ও ভরসা খুঁজে পায় রাসকলনিকভের বন্ধু রাজুমিখিনের কাছে। স্ভিদ্রিগাইলভ ও তার সদ্য মৃতা স্ত্রী মার্ফার তরফে দুনিয়াকে প্রভূত পরিমাণ ডলার দেওয়ার বিষয়টিও এই পর্বেই রাসকলনিকভ তার মা ও বোনকে জানায়। এই সংবাদ লুজিনকে প্রত্যাখ্যানের ফলে সৃষ্ট আর্থিক সঙ্কটের অনিশ্চয়তাকে অনেকটা কাটিয়ে দিতে সক্ষম হয়। কিন্তু এই সমস্ত স্বস্তির বিষয়গুলি যে রাসকলনিকভের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও মানসিক সমস্যাকে কিছুমাত্র কাটিয়ে দিতে সক্ষম হয় নি, তার প্রমাণ আমরা পাই চতুর্থ পর্বের চতুর্থ ও পঞ্চম পরিচ্ছেদে রাসকলনিকভের দুই বিপ্রতীপ অবস্থানের মধ্যে, যার কথা আমরা এর আগে উল্লেখ করেছি। এমনকি এই পর্বের ষষ্ঠ তথা শেষ পরিচ্ছেদে গোয়েন্দা পর্ফিরি পেত্রোভিচের ঘরে নাটকীয়ভাবে ঢুকে যখন কয়েদী নিকোলাই আচমকা ঘোষণা করে যে সেই অপরাধী, সেই কুড়ুল দিয়ে খুন করেছে আলিওনা ইভানোভনা আর তার বোন লিজাভেতা ইভানোভনাকে – তখনও রাসকলনিকভ কোনও মুক্তির আশ্বাস বা আস্বাদ পায় না। পুলিশ স্টেশন থেকে বেরোবার সময় ‘বাইরের অফিসঘর পার হয়ে যেতে যেতে রাসকলনিকভ লক্ষ করল অনেকগুলো স্থির দৃষ্টি তার দিকে স্থির নিবদ্ধ।’ বোঝা যায় রাসকলনিকভ তার চারদিকে সবার সন্দেহদৃষ্টিকে অনুভব করে চলেছে এবং এ কারণেই নিজ কোটরে সম্পূর্ণ একা থাকার বাসনা তার মধ্যে এত প্রবল হয়ে উঠছে।
পঞ্চম পর্ব থেকে এই উপন্যাস পরিণতির দিকে ধীরে ধীরে তার যাত্রা শুরু করে। পঞ্চম পর্বের প্রথম পরিচ্ছেদটি দুনিয়ার দ্বারা প্রত্যাখ্যাত লুজিনের মানসিক তিক্ততার উদ্ভাসনে পরিপূর্ণ। কিন্তু সেখানেও প্রেমের সমাপ্তির চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে লুজিনের অহংবোধের ওপর নেমে আসা আঘাত এবং বিয়ে ভেঙে যাওয়ার কারণে নানা ধরনের অর্থনষ্টের জন্য লুজিনের মনস্তাপ। লুজিন চরিত্রটির খল দিকটি অবশ্য চরমভাবে প্রকাশ পায় এই পর্বের তৃতীয় পরিচ্ছেদে। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ জুড়ে মার্মেলাদভের শেষকৃত্যের পর আয়োজিত ভোজসভার নানা টুকরো ছবি আমরা দেখেছি, আর তারই শেষ অংশে সেই ভোজসভায় লুজিনের প্রবেশ, একসময়ে যে এখানে আসবে না বলেই সোনিয়াকে জানিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু কেন সে শেষমেষ এল এই ভোজসভায় আর কেনই বা হঠাৎ প্রথম পরিচ্ছেদে সেমিওনভিচ লেবেজিয়াত্নিকভকে দিয়ে তাদের ঘরে সোনিয়াকে ডাকিয়ে এনেছিল, তা স্পষ্ট হয়ে যায় এই তৃতীয় পরিচ্ছেদে। দুনিয়ার সঙ্গে তার বিয়ে ভেঙে দেবার মূল কারিগর দুনিয়ার দাদা রাসকলনিকভের ওপর রাগে সে স্থির করে রাসকলনিকভের প্রণয়িনী বলে অনুমিত সোনিয়াকে চুরির অপরাধে বহু লোকের সামনে অপরাধী সাব্যস্ত করার। সোনিয়ার পরিবারকে ঘরছাড়া করার অভিপ্রায়ে এই অভিযোগের সময় সে বিশেষভাবে সম্বোধন করে বাড়িউলি আমালিয়া ইভানোভ্নাকেও, তাকে উত্তেজিত করে পুলিশ ডেকে সোনিয়াকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। সাইবেরিয়ায় নির্বাসনেরও ভয় দেখায়। লুজিনের ঘৃণ্য কৌশল অবশ্য শেষমেষ ব্যর্থ হয়ে যায় সেইসময় সোনিয়া ও লুজিনের সঙ্গে ঘরে উপস্থিত থাকা লেবেজিয়াত্নিকভের সাক্ষ্যে। লেবেজিয়াত্কনিভ প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে জানিয়ে দেয় “কী ভাবে ওঁর অজ্ঞাতে চুপিচুপি ওকে টাকা গুঁজে দিলেন তা আমি দেখেছি। ... দরজার কাছে আপনি যখন ওকে বিদায় জানাতে গেলেন সেই সময় উনি ঘুরে দাঁড়ালেন, আপনি এক হাতে ওর সঙ্গে করমর্দন করলেন, অন্য হাতে, বাঁ হাতে আপনি চুপিচুপি ওর পকেটে নোটটা গুঁজে দিলেন।” লেবেজিয়াত্কনিভের কাছে তখন ব্যাপারটা দাতব্য বলেই মনে হয়েছিল, কিন্তু চুরির এই ঘৃণ্য অভিযোগের পর তার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল যে গোটা বিষয়টা আসলে লুজিনের দিক থেকে ছিল এক পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। লেবেজিয়াত্কনিভের সাক্ষ্যের পর এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের প্রকৃত কারণটি উপস্থিত জনসমাগমের সামনে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে দেয় রাসকলনিকভ, যেখানে রোদিয়ার সঙ্গে বিয়ে ভেঙে যাওয়া ও তার প্রতিশোধ গ্রহণের বিষয়টি সে ব্যাখ্যা করে। এই ব্যাখ্যায় রাসকলনিকভ এটাও জানিয়ে দেয় যে “ব্যক্তিগতভাবে আমার ওপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করাও ওর উদ্দেশ্য ছিল, যেহেতু সোফিয়া সোমিওন্ভনার সুখ ও সম্মান যে আমার কাছে খুবই মূল্যবান এমন অনুমান করার ভিত্তি তার আছে।” এটি জনসমক্ষে পরোক্ষে হলেও সোনিয়ার প্রতি রাসকলনিকভের অনুরাগের প্রথম উন্মোচন বলা যায়।
পঞ্চম পর্বের চতুর্থ পরিচ্ছেদটি এই উপন্যাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক পর্ব যেখানে রাসকলনিকভ ও সোনিয়া পরস্পর পরস্পরের কাছে নিজেদের অনুরাগ প্রথম স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে ও আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়। সেইসঙ্গে এই পর্বেই রাসকলনিকভ সোনিয়াকে জানিয়ে দেয় সেই খুন করেছে আলিওনা ইভানোভনা ও তার বোন লিজাভেতাকে। প্রথমজনকে কেন সে খুন করেছে তাও সে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে, আর লিজাভেতার খুনটি যে আকষ্মিকভাবে সে ঘরে চলে আসায় বাধ্য হয়ে করেছে তাও জানায়। আলিওনা ইভানোভনাকে খুনের কারণটি সে যেভাবে উপস্থাপন করে এবং এই সূত্রে সোনিয়ার সঙ্গে তার যে কথোপকথন চলে, তা এই উপন্যাসভাবনার কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার অংশ এবং সে কারণেই অতি গুরুত্বপূর্ণ। সোনিয়া এই খুনের কারণ সরল অঙ্কেই বুঝতে চেয়েছে আর সে কারণেই রাসকলনিকভকে প্রশ্ন করেছে, “তোমার তখন অনটন চলছিল! তুমি চেয়েছিলে ... তোমার মাকে সাহায্য করতে – তাই না?” রাসকলনিকভের দেওয়া উত্তরটি অবশ্যই ছিল জটিল ও ভিন্ন। “আমি নেপোলিয়ন হতে চেয়েছিলাম, তাই খুন করি। ... এখন পরিষ্কার তো ?” বলাই বাহুল্য এরকম উত্তরে সোনিয়ার কাছে খুনের কারণ কিছুমাত্র স্পষ্ট না হলেও পাঠক, যিনি এতটা পথ এই আখ্যানের সঙ্গে পাড়ি দিয়েছেন, তিনি বুঝে যান রাসকলনিকভ আসলে কী বলতে চাইছে। প্রথম পর্বের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে অপরাধের এক অন্যরকম দর্শন নিয়ে সরাইখানায় বসে থাকা এক অল্পবয়সী আর্মি অফিসার ও এক ছাত্রের মধ্যে হওয়া আলোচনা রাসকলনিকভ শুনেছিল। সেখানে ছাত্রটি বলেছিল যে সে পারলে বন্ধকী কারবারি ঐ বুড়ি আলিওনা ইভানোভনাকে খুন করত, তার সব টাকাকড়ি ছিনিয়ে নিত। এতে তার বিবেকে একটুও বাঁধত না। অপদার্থ কুচুটে এই বুড়িকে কারোর দরকার নেই, বরং সে কেবল অন্যদের অনিষ্ট করে বেড়াচ্ছে। সে নিজেই জানে না কেন বেঁচে আছে, আর এমনিতেই তার আয়ু আর বেশিদিন নেই। তাকে মেরে যদি তার টাকাগুলো বিলিয়ে দেওয়া যেত, ঠিক কাজে লাগানো যেত, তাহলে শয়ে শয়ে মানুষকে হয়ত ভালোভাবে বাঁচার পথের সন্ধান দেওয়া যেতে পারত, অসংখ্য পরিবারকে বাঁচানো যেত অভাব আর কষ্টের হাত থেকে। এ সবই হতে পারত বুড়ির টাকায়। ছাত্রটির এই কথাগুলো যেন রাসকলনিকভের মনের কথা হয়ে উঠেছিল, “ওকে খুন কর কেড়ে নাও ওর টাকাকড়ি। এই টাকার সাহায্যে পরে তোমার জীবন উৎসর্গ কর সমস্ত মানবজাতির সেবায়, সমাজের কল্যাণে। তোমার কি মনে হয়, একটা ছোট্ট, নগণ্য অপরাধ হাজার হাজার সৎকাজ দিয়ে মুছে ফেলা যাবে না ? একটা প্রাণের বিনিময়ে একশটি প্রাণ – আরে এ যে সোজা অঙ্কের হিসাব!” এর সঙ্গেই যদি মিলিয়ে পড়া যায় উপন্যাসের তৃতীয় পর্বের পঞ্চম অনুচ্ছেদে পর্ফিরি পেত্রভিচের সঙ্গে রাসকলনিকভের সেই আলোচনাটি ও তার সূত্র রাসকলনিকভের অপরাধতত্ত্ব বিষয়ক প্রবন্ধটির শেষাংশ – তাহলে আমরা এই উপন্যাসের মূল দার্শনিক প্রতর্কটির কাছাকাছি পৌঁছে যাই আমরা। দস্তয়েভস্কি এই উপন্যাসের আগেই তাঁর আর এক আখ্যান “নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড” এ সমকালীন রাশিয়া জুড়ে চলা নিহিলিজম এর বিজ্ঞানবাদের প্রতি তাঁর আপত্তিকে উপস্থাপিত করেছিলেন। এই আখ্যানে তিনি নিহিলিজম এবং তার প্রেরণা মিল বেন্থাম প্রমুখদের ইউটিলিটেরিয়ানইজম বা প্রয়োজনবাদী দর্শনের মহড়া নিতে চাইলেন। ‘বৃহত্তর মানুষের মহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্র স্বার্থকে বলি দেওয়া অনৈতিক কিছু নয়’, এই দর্শনের সঙ্গেই যুক্ত করে নেওয়া হল অতি বিশিষ্ট কিছু মানুষের বৃহৎ স্বার্থে আইনের স্বাভাবিক সীমাকে অতিক্রম করে যাওয়ার অধিকার। এখান থেকেই বারবার এসেছে নেপোলিয়নের কথা, সোনিয়াকে রাসকলনিকভ খুনের কারণ প্রসঙ্গে বলেছে নেপোলিয়ন হতে চেয়ে তার খুন করার কথা। “আমি যখন খুন করি তখন টাকার দরকার আমার ততটা ছিল না যতটা ছিল অন্য কিছুর। ... আমার তখন জানার দরকার ছিল আমি আর সকলের মতো উকুন না আমি মানুষ ? আমি সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারি কিনা – সে সামর্থ্য আমার আছে কিনা”।
বলা বাহুল্য এই দর্শনকে মেনে নিতে পারেন নি দস্তয়েভস্কি, এর মহড়াই তিনি নিতে চেয়েছিলেন তাঁর এই “অপরাধ ও শাস্তি” উপন্যাসে। তাই এই দর্শনের বলে বলী হয়ে থাকতে পারে নি রাসকলনিকভ এবং তাঁকে মানসিক যন্ত্রণায় দীর্ণ হতে হয়েছে। রাসকলনিকভের যন্ত্রণা থেকে উত্তরণের পথটিকে সোনিয়া যেভাবে চিহ্নিত করেছে, সেখানেই দস্তয়েভস্কির খ্রীষ্টীয় থিওলজির প্রতি আস্থাটি স্পষ্ট হয়েছে। সোনিয়া স্পষ্টভাবে রাসকলনিকভকে তাঁর উত্তরণের পথ নির্দেশ করে জানিয়েছে “যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে, তারই মধ্যে দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে – এটাই দরকার।” এই পথে রাসকলনিকভ অবশ্য তখনি এগোতে রাজী হয় নি। সে সোনিয়াকে বোঝাতে চেয়েছে খুনের ঘটনা স্বীকার করার অর্থ সাইবেরিয়ায় নির্বাসন। বোঝাতে চেয়েছে স্বীকার করার কোনও দরকার নেই। কারণ পুলিশ ও গোয়েন্দাদের কাছে যথেষ্ট প্রমাণ নেই তাকে খুনি বলে প্রমাণ করার। তাই তাকে গ্রেপ্তার করলেও পরে তাকে ছেড়ে দিতেই তারা বাধ্য হবে। অপরাধ স্বীকারের মধ্যে দিয়ে উত্তরণের বদলে অপরাধ গোপন করার ভাবনাই তখনো রাসকলনিকভের মধ্যে যে প্রবলতর ছিল তার রূপক হিসেবেই সোনিয়ার ক্রুশটি গ্রহণ করতে গিয়েও সে প্রত্যাখ্যান করে। “এখন না সোনিয়া। বরং পরে”। আর সোনিয়াও জবাবে জানায় “যখন কষ্ট ভোগ করতে যাবে তখন পরবে। আমার কাছে আসবে, আমি নিজে হাতে পরিয়ে দেব। আমরা প্রার্থনা করব, প্রার্থনা করেই বেরিয়ে পড়ব।” এই সংলাপ বিনিময়ের মধ্যে উপন্যাসের পরিণতির গতিপথটিকে হাজির করেছেন দস্তয়েভস্কি।
উপন্যাসের ষষ্ঠ পর্বের প্রথম ও তৃতীয় পরিচ্ছেদে স্ভিদ্রিগাইলভ এবং দ্বিতীয় পর্বে গোয়েন্দা পর্ফিরির সঙ্গে দীর্ঘ কথোপকথন হয় রাসকলনিকভের। দুজনে দুভাগে জেনেছে যে রাসকলনিকভ ই আসলে খুনদুটো করেছে এবং সেজন্য সে মর্মযন্ত্রণায় দীর্ণ হচ্ছে। স্ভিদ্রিগাইলভ ঘর ভাড়া নিয়েছিল সোনিয়ার ঘরের পাশে এবং সোনিয়ার কাছে রাসকলনিকভ যখন সমস্ত অকপটে খুলে বলছিল তখন আড়ি পেতে সে গোটাটা শোনে। পর্ফিরি অবশ্য তদন্তের ভেতরে ঢুকে গোটাটা বুঝে নিয়েছে। রাসকলনিকভকে মুক্তির বিষয়ে দুজন দুভাবে পরামর্শ দিয়েছে। স্ভিদ্রিগাইলভের পরামর্শ ছিল দেশ ছেড়ে আমেরিকা পালিয়ে যাবার এবং এই কাজে সে সাহায্য করারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। অন্যদিকে পর্ফিরি জানিয়েছিল যে সে যদিও বুঝেছে রাসকলনিকভই খুনি, তবু আদালতে তা বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার মতো পাকা প্রমাণ তার হাতে নেই। তবু সে রাসকলনিকভকে পরামর্শ দিয়েছিল নিজের সমস্ত দোষ স্বীকার করে নেওয়ার। এর ফলে তার শাস্তি তুলনায় কম হবে এবং শাস্তির মেয়াদ শেষেও তার হাতে থাকবে এক দীর্ঘ জীবন। সেই জীবনটা তাকে গ্লানি নিয়ে বাঁচতে হবে না। কিন্তু দোষ স্বীকার না করে আদালতের শাস্তি ভোগ এড়িয়ে গেলেও জীবন তাকে নিষ্কৃতি দেবে না। যে মানসিক যন্ত্রণায় সে ভুগছে, তাই তাকে বয়ে বেড়াতে হবে আবহমান কাল। জীবন্মৃত হয়ে কাটাতে হবে প্রতিটি মুহূর্ত। এই কথাগুলির মধ্যে সোনিয়ার কথার মিল ছিল, তবে সোনিয়া খ্রীষ্টীয় প্রায়শ্চিত্তর ওপর যে জোর আরোপ করেছিল, তা পর্ফিরি সেভাবে করেনি।
উপন্যাসের ষষ্ঠ পর্বের অনেকগুলি পরিচ্ছেদ জুড়ে আছে স্ভিদ্রিগাইলভ। প্রথম ও তৃতীয় পরিচ্ছেদে রাসকলনিকভের সঙ্গে তার কথোপকথন হয় নানা প্রসঙ্গে। চতুর্থ পরিচ্ছেদটি দুনিয়ার সঙ্গে নাটকীয় সাক্ষাৎ, কথোপকথন, ভীতি ও লোভ প্রদর্শনে পরিপূর্ণ। ভীতি বা লোভ কোনওকিছুর মাধ্যমেই অবশ্য দুনিয়াকে সে বশ করতে পারে নি এবং আত্মরক্ষার্থে সে পকেট থেকে পিস্তল বের করে গুলি করে খুন পর্যন্ত করতে চেয়েছে স্ভিদ্রিগালভকে। তার চোখে তীব্র ঘৃণা ছাড়া আর কিছু না দেখে স্ভিদ্রিগাইলভ দুনিয়াকে পাবার আশা চিরতরে ত্যাগ করে এবং নানাজনকে নানাবিধভাবে নিজ সম্পত্তির অংশ দান করে শেষমেষ আত্মহত্যা করে মাথায় গুলি চালিয়ে।
সপ্তম পরিচ্ছেদে রাসকলনিকভ খানিকটা আভাসে মাকে আর স্পষ্টভাবে বোনকে তার অপরাধের কথা খুলে বলে দুজনের থেকেই বিদায় চায়। অষ্টম পরিচ্ছেদে আমরা দেখি রাসকলনিকভের জন্য উদ্বিগ্ন দুই নারী পরস্পরের কাছে বসে আছে। প্রেয়সী সোনিয়া আর বোন দুনিয়া দুজনেরই আশঙ্কা যে রাসকলনিকভ শেষপর্যন্ত আত্মহত্যা না করে বসে। শেষপর্যন্ত সোনিয়াকে আশ্বস্ত করে রাসকলনিকভ তার কাছে আসে, ক্রুশটি চেয়ে নেয় এবং তারপর পুলিশ স্টেশনে গিয়ে তার অপরাধের জবানবন্দী দেয়।
উপন্যাসের উপসংহারে রাসকলনিকভের বিচার, আট বছরের জন্য সাইবেরিয়ার নির্বাসনের দণ্ডাজ্ঞা, সেই নির্বাসনবাস পর্বের নানা অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি, সোনিয়ার সেখানে থাকা ও তাকে দূর ও কাছ থেকে নিয়মিত দেখার কথা শুনি আমরা। জানতে পারি দুনিয়া ও রাজুমিখিনের বিয়ের কথাও। আট বছরের নির্বাসন পর্ব শেষে রাসকলনিকভের বয়েস হবে বত্রিশ এবং সোনিয়ার সঙ্গে সে আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবে এই আশ্বাসের মধ্যে দিয়ে উপন্যাসের সমাপ্তি টানেন কথক। এই উপসংহার পর্বটি অবশ্য অনেক সমালোচককে খুশি করতে পারে নি। এই প্রসঙ্গে মনে করা যায় মিখাইল বাখতিনের বিশ্লেষণকে। বাখতিন দস্তয়েভস্কির উপন্যাসের মহত্বকে খুঁজে পান তার বহুস্বরিকতার মধ্যে। যেখানে কথক - লেখকের নিজস্ব ভাষ্য বা মতামতের চেয়ে প্রধান হয়ে ওঠে চরিত্র পাত্রদের নিজস্বতা। তাদের সংলাপ, আচার আচরণ জগৎ ও জীবনের আলাদা আলাদা দৃষ্টিকোণগুলিকে উপস্থাপিত করে। এই বহুস্বরিকতাকে অতিক্রম করে স্রষ্টা দস্তয়েভস্কির খ্রীষ্টীয় নৈতিকতার ধারণা রাসকলনিকভের দ্বন্দ্ব ও জটিলতাকে উপসংহারে গ্রাস করেছে বলে বাখতিন খুশি হতে পারেন নি। রাসকলনিকভের চরিত্রের ভেতর থেকে খ্রীষ্টীয় নীতিবোধের জাগরণকে অনেকেই স্বাভাবিক বলে মানতে পারেন নি এবং একে চরিত্রের নিজস্ব বাস্তবতার ওপর লেখকের মনোভঙ্গীর সবল আরোপ বলে মনে করেছেন। তবে উপন্যাসের সামগ্রিক সিদ্ধির তুলনায় উপসংহারের শেষ কয়েক পাতা কেন্দ্রিক এই সমালোচনা খুব বড় কোনও বিষয় নয়।
নায়ক রাসকলনিকভকে নিয়ে একটি সামাজিক দার্শনিক তর্কে অবতীর্ণ হয়েছিলেন দস্তয়েভস্কি। কিন্তু নিহিলিজম সংক্রান্ত এই বিতর্কে রাসকলনিকভকে কোনও আইডিয়ামাত্র করে রাখেন নি তিনি। এক জীবন্ত রক্তমাংসের মানুষ করে তুলেছেন তাঁকে। তত্ত্ব আর জীবনের নিজস্ব অনুভূতিমালার দ্বন্দ্বে রাসকলনিকভ আদ্যন্ত দোলায়িত হয়েছে। প্রথমে নিজের লেখা প্রবন্ধে ও খুনের প্রক্রিয়াটির মধ্যে সে তত্ত্বের বাস্তবায়ন ঘটাতে চেয়েছিল। বৃহত্তর মানুষের মহত্তর কল্যাণের জন্য অপরাধ সংগঠনের প্রচলিত গণ্ডী পেরিয়ে যাবার আইডিয়াটিকে বাস্তবায়িত করার পরে সে দেখতে পেল জীবনের টান তত্ত্বের ধরনে চলল না। অকম্পিতভাবে অপরাধকে হজম করে নেবার তত্ত্বটি বাস্তবের মাটিতে ছাড়খার হয়ে গেল। ধূলিসাৎ হয়ে গেল নিহিলিস্টিক আইডিয়ার নির্মিত সৌধটি।
রাসকলনিকভের সঙ্কট ও যন্ত্রণাকে, যুক্তি ও আবেগকে পাঠক প্রতি মুহূর্তে উপলব্ধি করতে পারেন বলেই সে এত জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এর পেছনে রয়েছে আখ্যান নির্মাণে দস্তয়েভস্কির অসামান্য কৃৎকৌশল। সর্বজ্ঞ ও সর্বগ ঔপন্যাসিক এখানে পাঠককে বর্ণনা করে সবকিছু জানান না। বরং রাসকলনিকভের সক্রিয়তা পাঠকের সামনে খোলা থাকে। হাজির থাকে রাসকলনিকভ সম্পর্কে নানাজনের চিন্তাভাবনা, বিশ্লেষণ ও তাকে ঘিরে কথোপকথন। এইভাবেই নায়কের নির্মাণকে জীবন্ত ও অনুভূতিবেদ্য করে তোলেন ঔপন্যাসিক। বিশিষ্ট উপন্যাসকল্পনার সঙ্গে নির্মাণের এই অসামান্য যুগলবন্দী উপন্যাসটিকে পৌঁছে দেয় সাফল্যের শিখরস্পর্শী উচ্চতায়।