হুল দিবসের স্মরণে দু চারটে কথা

দেড়শো দু'শো বছর আগেকার ঘটনা সাঁওতাল বিদ্রোহ সম্পর্কে এখনো সাধারণ মানুষের যথেষ্ট কৌতুহল আছে। প্রাতিষ্ঠানিক ধারার ছাত্রছাত্রী নয়, আবার ছাত্র জীবনে বিষয় হিসেবে ইতিহাস পছন্দের ছিল না, এমন বহু মানুষ‌ও আছেন। তেমন একজন মানুষ হিসেবে আমি বারবার ছুটে গেছি ভগনাডিহির প্রান্তরে।
 
এই ভগনাডিহির প্রান্তর থেকে হুল অর্থাৎ বিদ্রোহের ডাক দিয়েছিলেন সাঁওতালদের দুই নেতা। তাঁরা দুই ভাই ছিলেন।
 
গত বছর ৩০শে জুন, ২০২০ হুল দিবসে ভগনাডিহিতে কোনো অনুষ্ঠান হয়নি। ভগনাডিহির প্রান্তর থেকেছে নিস্তব্ধ। না কোনো ধামসা মাদল বাজেনি, বাঁশিতে সুর শোনা যায় নি। ছিল না কোনো আড়ম্বর। না আলো জ্বালে নি কেউ!
 
সাঁওতালদের বিদ্রোহের ডাক দিয়েছিল দুই ভাই সিধু-কানু। অপর দুই ভাই চাঁদ এবং ভৈরব তাঁরাও সঙ্গে ছিল। বিদ্রোহ করার জন্য তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকার তাঁদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছিল। চার ভাইয়ের মধ্যে একমাত্র সিধু ছিল বিবাহিত। তার বংশধররা আজও দামিনকো-র ভগনাডিহিতেই বাস করে। 
 
সাত বছর আগে প্রথম গিয়েছিলাম সিধু-কানুর গ্রামে, ওদের বাড়িতে। পরিচিত হ‌ই সিধু-র উত্তরসূরি পঞ্চম প্রজন্মের পুরুষ ভাদো-র সাথে। সিধু-কানুর মর্মর মূর্তির সামনে বসে ভাদো, তাঁর স্ত্রী এবং দুই পুত্রের সঙ্গে ছবি তুলি। ভাদোর সঙ্গে ঘুরে দেখি শক্তি স্থল। যেখানে মহেশ দারোগাকে বধ করেছিল বিদ্রোহীরা, যেখানে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় সিধুকে। দেখেছি ভগনাডিহির প্রান্তরকে। গত বছরের নভেম্বর মাসেও গিয়ে দেখা করি ওদের সঙ্গে। আসলে সাঁওতাল বিদ্রোহের ইতিহাসকে ফিরে দেখে নতুন করে লিখতে চাই। কারণ আমার মনে হয়েছে এই বিদ্রোহের ঘটনাকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলতে চায় প্রতিক্রিয়া শক্তি। সেজন্য শুরু হয়েছে উদ্যোগ। রাষ্ট্রের দায় তাতে কম নয়।
 
রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ...  দামিন-ই-কো বলে কোনো জায়গা কেউ এখন খুঁজে পাবে না, জানতে পারবে না কেউ সাঁওতাল পরগণা বলে একটা নির্দিষ্ট জায়গা কোথায় ছিল! দলিল দস্তাবেজ বের করে গবেষকদের খুঁজে বার করতে হবে সেসব। কিছুটা হয়তো পাবে, বেশিরভাগই চলে যাচ্ছে দৃষ্টির আড়ালে।
 
ভগনাডিহির সেই প্রান্তর এখন ভাগ হচ্ছে। কোথাও রাজপথ তাকে টুকরো করছে, কোথাও অন্য সম্প্রদায়ের শেষকৃত্যের জন্য জায়গা নির্দিষ্ট হচ্ছে। 
 
যে বটগাছের নীচে দাঁড়িয়ে সিধু কানু দুই ভাই স্থানীয় জমিদার, মহাজনদের শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক দিয়েছিল, সেই বটগাছ আজ আর নেই। থাকার কথাও নয়। কারণ সেই ডাক পরবর্তীতে কোম্পানি শাসক ইংরেজদের বিরুদ্ধে গিয়েছিল, সেই ডাক বিদ্রোহীদের কলকাতা অভিমুখে যাত্রা মরীয়া করে তুলেছিল। আর তাই তাকে রুখে দেওয়ার নির্মম চেষ্টা হয়েছিল মাঝপথেই। স্বাধীন দেশেও সেই প্রক্রিয়া বন্ধ হয়নি। মানবতাকে স্তব্ধ করে দেবার মতো শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনি সাঁওতালদের অভ্যুত্থান।
 
 
গত বছর সিধুর বংশধররা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ২০২০-র হুল দিবসে তাঁরা আনন্দ করবেন না। না লকডাউনের জন্য নয়, তাঁদের ঘরে ছিল শোকের আবহ।
 
২০২০-র ১২ জুন তাঁদের এক জ্ঞাতি ভাই রামেশ্বর মুর্মু-র অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল। রামেশ্বর ছিল সিধুর বংশের উত্তরসূরি ষষ্ঠ পুরুষ। তখন‌ও তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পাদন সমাপ্ত হয়নি। তাঁদের সংস্কার মতে পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পাদন সমাপ্ত না হলে কোনও আনন্দ অনুষ্ঠান করা যায় না। সেজন্য পরিবারের পক্ষে মণ্ডল মুর্মু সরকারি বেসরকারি সমস্ত উদ্যোগকে অনুষ্ঠান বন্ধ রাখার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তাঁদের অনুরোধক্রমে সরকারি বেসরকারি সমস্ত প্রতিষ্ঠান হুল দিবসের কর্মসুচি বাতিল করেছিল।
 
লেখিকা হ্যারিয়েট বেচার স্টো-র 'টম কাকার কুটির' কালো মানুষদের কাহিনি ইউরোপ তথা সারা বিশ্বে ঝড় তুলেছিল এক সময়। আমাদের দেশে লেখিকা হ্যারিয়েট বেচার স্টো-র মতো এমন কেউ ছিলেন না যিনি সাঁওতালদের কাহিনি তুলে ধরবেন। স্বাভাবিকভাবে সাঁওতালদের অভ্যুত্থানের সংবাদ শিক্ষিত সমাজের দৃষ্টির আড়ালেই ঘটেছিল।
 
এদেশে ছাপাখানা কিন্তু এসে গিয়েছিল। সংবাদপত্র নিয়মিত ছাপা শুরু হয়েছিল, ছাপা হয়েছিল অসংখ্য ব‌ইপত্র। কিন্তু সাঁওতালদের কাহিনি প্রকাশিত হয়নি। শিক্ষিত সমাজের চোখে ওরা ছিল ছোটলোক, ডাকাত! খেত খামারের অথবা বাড়ির কাজে কখনো কুলি মজুর হিসেবে তাদের কাজে লাগানো হলেও সমাজে তাদের কোনো ভূমিকা স্বীকৃত হয়নি।
 
আজন্ম স্বভাব নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষগুলো অস্ত্র ধরতে কেন বাধ্য হল, সেকথা ভাববার অবসর কারো ছিল না। ঘটনা যখন ব্রিটিশ শক্তিকে পিছু হটতে বাধ্য করেছে তখন রাষ্ট্রযন্ত্রের মুখপত্র কিছু সংবাদপত্রে সাঁওতালদের অত্যাচারের বিবরণ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করিয়েছে, যাতে জনমনে সাঁওতালদের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি জন্ম না নেয়। আর সেনা নামিয়ে সাঁওতাল পল্লীতে পল্লীতে দমন পীড়ন চালিয়েছিল কোম্পানি সরকারের প্রশাসন। সাঁওতাল বিদ্রোহের কাহিনি হলো সাঁওতালদের অস্ত্র ধারণ করতে বাধ্য করিয়ে নির্বিচারে তাদের হত্যা করার কাহিনি।
 
বলতে গেলে একটি ষড়যন্ত্র এবং পরিকল্পিতভাবে মানুষ খুনের কাহিনি।
 
উনিশ শতকের বাংলাদেশ বহু ভাঙ্গাগড়ার মধ্যে দিয়ে চলেছিল। বাংলাদেশের এক শ্রেনির শিক্ষিত শহুরে রাজ অনুগ্রহলোভী বাবু সমাজ সংস্কার, ধর্ম সংস্কার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিল, অন্যদিকে সমাজের নিচু তলার বিশাল একটা অংশের মানুষের মধ্যে চলেছিল অস্তিত্ব রক্ষার সংকট। অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে তারা হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল। পরিবর্তে তারা পেয়েছিল লাঠি, গুলি, ফাঁসির সাজা। যেখানে সেখানে বিচারের নামে প্রহসন করে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। যার কোনো তথ্য সঠিক ভাবে আর কোনো দিনই পাওয়া সম্ভব নয়। সাহিত্য কাব্যে পরবর্তী সময়ে কিছু কিছু ঘটনার উল্লেখ হয়েছে, সেগুলো মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত তথ্য হিসেবে কবি বা সাহিত্যিকরা ব্যবহার করেছেন, সেই সব ঘটনাই মানুষ জানতে পেরেছে পরবর্তী সময়ে। কয়েকজন গবেষক অতি পরিশ্রম করে প্রশাসনিক দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটে অনেক পরে সেই সময়ের ঘটনার প্রকৃত বিবরণ প্রকাশ করেছেন। ইতিহাসের ছাত্রছাত্রী, গবেষণায় আগ্রহী ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় সেই ইতিহাসের কাহিনি কিছুটা জানা সম্ভব হয়েছে। তবুও মনে হয়েছে বাস্তবের ঘটনা ছিল আরও কঠিন, ক্রূরতার সীমা পরিমাপ করা অসম্ভব বলা চলে। 
 
যেমন সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক সিধু-কানুকে গুলি করে হত্যা করা হয়নি, তাঁদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। প্রকাশ্যে দিবালোকে তাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়, যাতে পরবর্তী সময়ে কেউ আর রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে আঙুল তুলবার সাহস দেখাতে না পারে। সিধু কানুর গুলিতে মৃত্যু যাঁরা বলেন, সঠিক বলেন না।
 
সাঁওতাল বিদ্রোহে ইংরেজ রাজত্ব অবসানের কথা বলা হয়েছিল, ভদ্র বাঙালি সমাজ তা মানতে পারেনি। সাঁওতাল বিদ্রোহ শুধু অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার কারণে সংঘটিত হয়নি, হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে। সেজন্য দেখা গিয়েছে ওই সময়ে বিভিন্ন ধরনের অত্যাচারের প্রতিক্রিয়াজাত অন্যান্য বিক্ষোভ-অসন্তোষগুলো রাষ্ট্রশক্তি যেভাবে মোকাবিলা করেছে, সাঁওতাল বিদ্রোহ দমনের ক্ষেত্রে তারা আরও নৃশংস নারকীয় ভূমিকা নিয়েছে। 
 
জনমনে এমন আবহাওয়া তৈরি করা হয়েছে যাতে স্থানীয় শোষকশ্রেণী অর্থাৎ জমিদার, মহাজন, ধনী ব্যক্তিরা অর্থ ও বাহুবল নিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের সহযোগিতা করে। অথচ প্রায় এক‌ই সময়ে সংঘটিত নীল বিদ্রোহের ক্ষেত্রে দেখা গেছে বিষয়টি অন্য প্রকৃতির। নীল বিদ্রোহে কয়েকজন জমিদার ইংরেজ রাজশক্তিকে সহযোগিতা তো করেই নি, উপরন্তু বিদ্রোহীদের পরোক্ষে মদত দিয়েছিল। তার কারণ ছিল, নীল বিদ্রোহ রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিল না। ছিল কতিপয় নীলকরদের বিরুদ্ধে। অনেক জায়গায় সেজন্য দেখা গেছে জমিদাররাও চেয়েছে অত্যাচারী নীলকর সাহেবরা উপযুক্তভাবে জব্দ হোক। সাঁওতাল বিদ্রোহের ক্ষেত্রে জমিদার ও তাঁদের আমলাদের অত্যাচার, মহাজনদের অত্যাচার, রাষ্ট্রশক্তির অত্যাচারে ইন্ধন যুগিয়েছিল।
অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ইংরেজ শাসনের সূচনায় মোগল ভুমি রাজস্ব ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেওয়া হয়। চতুর ইংরেজ আর রেজা খাঁ মিলে বাংলাকে শোষণে জর্জরিত করে। তারপর আসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। দেশে এক তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যু হয়, অথচ সরকার ছিল নির্বিকার। 
 
ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার পাকা সিদ্ধান্ত হয় ১৭৯৩ সাধারণাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ইংরেজদের দাক্ষিণ্যপুষ্ট হঠাৎ-বাবুদের সামনে লাভজনক বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরির সুযোগ করে দেয়। তারা সেই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে। প্রাচীন ভূমিব্যবস্থা বিলোপের সাথে সাথে প্রাচীন জমিদার বংশগুলো একে একে ধ্বংস হয়। তৈরি হয় ইংরেজদের তাঁবেদার একদল অসংখ্য নতুন ভুস্বামীশ্রেণি যারা জমিদার হিসেবে আগের জমিদারদের জায়গা দখল করতে চেয়েছিল। এরা প্রায় সকলেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ষোলোআনা আগ্রহশীল ছিল। সেজন্য প্রজা স্বার্থে বা কৃষকদের স্বার্থ পূরণে কোনো ভূমিকাই নেয়নি। সচেতনভাবেই তারা এবিষয়ে একেবারে উদাসীন ছিল। 
 
সেজন্য সাঁওতাল বিদ্রোহকে পরবর্তী সময়ে কৃষকদের বিদ্রোহ বলে অভিহিত করা হয়। যেহেতু সমাজের অন্য অংশের কোনো রকম যোগসূত্র ছিল না, যা ঘটেছিল পরবর্তী সিপাহী বিদ্রোহের সময়; সেজন্য এই বিদ্রোহকে গণ অভ্যুত্থান বা মহাবিদ্রোহ না বলে শুধুমাত্র কৃষক বিদ্রোহ বলেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
 
সাঁওতালরা ছিল অত্যন্ত পরিশ্রমী জাতি। পাহাড় জঙ্গল পরিষ্কার করে তারা চাষযোগ্য জমি তৈরি করেছিল। পাহাড় জঙ্গলের সীমানায় তাঁদের ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে যতটা জমি তৈরি করতে পারবে সবটাই নিষ্করভাবে ভোগ করতে পারবে বা সেই জমির মালিকানা তারা পাবে। কার্যত সেটা ছিল সর্বৈব মিথ্যা। জমির মালিকানা পায় নব্য জমিদাররা। সেজন্য সাঁওতালদের বিরুদ্ধে ইংরেজ রাজশক্তিকে সহযোগিতা করে তারা কেউ রায়বাহাদুর বা রাজা থেকে মহারাজা উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। কেউ কেউ ইংলন্ডেশ্বরীর ভোজসভায় আমন্ত্রিত হ‌ওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করে যারপরনাই আহ্লাদিত হয়েছেন বংশ পরম্পরায়। অথচ রাজশক্তির সমস্ত শোষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে বাংলার এই কৃষক সমাজ।
 
দু একটি সংবাদপত্র অথবা সংবাদপত্রের সম্পাদকের জাতীয়তাবোধ জাগ্রত থাকায় তাঁরা বিষয়টি লঘু দৃষ্টিতে দেখার থেকে বিরত থেকেছেন।
 
২৭.৫.১৮৪০ ‘দি ক্যালকাটা কুরিয়র’ নব্য জমিদারশ্রেনি সম্পর্কে মন্তব্য করেছিল, 'চিরস্থায়ী  বন্দোবস্থের ফলে (বাংলার) কৃষকরা একটুও উপকৃত হয় নি,  উপরন্তু এমন একদল লোকের হাতে তাদের তুলে দেওয়া হয়েছে-যাদের অত্যাচার ও নিপীড়নের কথা সারা ভারতে প্রবাদতুল্য।'
 
ফলে যা হবার তাই ঘটেছিল। চিরাচরিত জমিদার প্রজা সম্পর্কের ক্রম অবনতি ঘটতে থাকে। সম্ভবত এই প্রথম সাধারণভাবে গ্রামবাংলার প্রজারা জমিদার এবং তাদের নায়েব-গোমস্তাদের ঘৃণার চোখে দেখতে শুরু করে। নব্য জমিদারদের হরেকরকম খাঁই মেটানো কৃষকদের পক্ষে সম্ভব না হওয়ায়, নিজেদের পরিবারের পেট চালাবার স্বার্থে তারা হাত পাততে বাধ্য হয়। এই অবস্থায় তৈরি হয় একদল মহাজন। যারা সাগ্রহে এগিয়ে এসে ঋণ দিতে চায় কৃষকদের। কিন্তু পরের বছর যে ভালো ফসল হবেই এমন গ্যারান্টি ছিল না। সেচ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, অনাবৃষ্টি, পোকা বা বন্য পশুদের আক্রমণ ইত্যাদি নানা কারণে উৎপাদিত ফসলের প্রায় সবটাই ঋণ ও সুদের দায়ে কৃষককে দিয়ে দিতে হতো ফসল তোলার সময়। জমিদারের প্রাপ্য আর মহাজনের ঋণ এবং সুদের খাঁই মিটিয়ে কৃষকের হাতে অবশিষ্ট কিছুই না থাকার কারণে সারা বছরের খোরাকিতে তাদের টান পড়ে। ঘুরেফিরে সেই মহাজনের দ্বারস্থ হতে হয় আবার কৃষককে। উপর্যুপরি এইভাবে কয়েক বছর পর দেখা যায় সংশ্লিষ্ট মহাজন হয়েছে প্রকৃত কৃষকের জমির মালিক, আর কৃষক হয়েছে সেই জমির ভাগচাষী। জানা যায় বীরভূমের মহাজনদের সুদের হার ছিল ৫০ শতাংশ। 
 
কোম্পানির আইনে সম্পত্তি ক্রোক ও জমি হস্তান্তরের সুযোগ নিয়ে নব্য জমিদার এবং মহাজন শ্রেণির দ্বারা কৃষকের সর্বনাশ এভাবেই গ্রাম বাংলাকে ধ্বংস করতে শুরু করেছিল। যা সরাসরি আঘাত করেছিল সাঁওতালদের। কারণ তারা পাহাড় জঙ্গল সাফ করে যে জমি তৈরি করেছিল তার কোনো কাগজ ছিল না তাদের কাছে। আর বংশ পরম্পরায় যে জমি তারা চাষ করে এসেছে, একদিন সকালে উঠে জমিতে গিয়ে তারা দেখতে পেল জমিদার, মহাজন এবং ব্রিটিশ আধিকারিকরা সিপাই বরকন্দাজ দারোগা সহ লোকজন ফিতে দিয়ে তাদের জমি জমা সব মাপতে বসেছে।
 
কী ব্যাপার? না খাজনা দিতে হবে। 
 
সাঁওতাল বিদ্রোহের শুরুটা ছিল মহাজনদের বিরুদ্ধে। দেখা গেছে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়লে বহু গ্রাম আক্রমণ করে সাঁওতালরা মহাজনদের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু সাধারণ প্রজার কোনো ক্ষতি করেনি।
 
দামিনকো-র মধ্যে কিছুদিন আগেও সাঁওতাল পরগণা নামে আমরা যে জায়গাটা চিনতাম। সেই জায়গা সাঁওতাল পরগণা নামে নির্দিষ্ট হয় বিদ্রোহের পরে। সাঁওতালদের জন্য সরকারের প্রশাসনের তরফে পুরস্কার হিসেবে।
 
আজ কিন্তু সেই সাঁওতাল পরগণাও নেই। ভেঙ্গে ছ'টা জেলা করা হয়েছে। 
 
সাঁওতাল বিদ্রোহের পূর্বের ইতিহাস সংক্ষেপে বলা চলে—
 
১৮২৩-এ দামিন-ই-কোহ সীমানা নির্দিষ্ট করে সরকারের সম্পত্তি ঘোষিত হয়। 
 
১৮৩৬-এ সাঁওতালদের সেখানে বসবাসে উৎসাহ দেওয়ার জন্য একজন স্পেশাল অফিসার নিয়োগ করা হয়। 
 
১৮৩৭-এ মিঃ পনেটকে এই পদে নিয়োগ করা হয়। 
 
সাঁওতালদের বলা হয় অপরিষ্কৃত জমির জন্য প্রথম তিন বছর তাদের কোনও খাজনা দিতে হবে না। পরের তিন বছর নামমাত্র খাজনা দিতে হবে। এরপর পাঁচ বছরের জন্য জমি লিজ দেওয়া হবে, মাঝিদের পঞ্চায়েত (অর্থাৎ সাঁওতালদের নিজস্ব গ্রাম সমাজ ব্যবস্থা) গ্রামের বার্ষিক খাজনা নির্দিষ্ট করে দেবে। 
 
কোম্পানি সরকার কথা এক রকম বলেছিল, কাজে করেছিল বিপরীত।
 
খাজনা উত্তরোত্তর বেড়েই চলছিল। ১৮৩৭ থেকে ১৮৫৫, যা তথ্য মিলেছে তাতে দেখা গেছে ১৮ বছরে খাজনা বৃদ্ধি পেয়েছে ১০ গুণ। সরকারের এই দৃষ্টিভঙ্গি সাঁওতালদের ক্ষুব্ধ করেছিল। 
 
মিঃ পনেট খাজনা আদায়ের ভার দিয়েছিল স্থানীয় জমিদারদের, জমিদাররা খাজনা আদায়ে কাজে লাগিয়ে ছিল তাদের খাস নায়েব – সুজোয়ালদের। 
 
নায়েব – সুজোয়ালরা খাজনা আদায়ের নামে জমিদারদের মতো তারাও সাঁওতালদের ওপর নানা ধরনের অত্যাচার শুরু করেছিল। নানা রকমের সেস আদায় করতো। 
 
সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক সিধুর অভিযোগ ছিল, নায়েব-সুজোয়ালরা প্রতি গ্রাম থেকে ৫ থেকে ১০ টাকা অতিরিক্ত সেলামী আদায় করে। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের (ব্রিটিশ প্রশাসনের) দৃষ্টি আকর্ষণ করে কোনও প্রতিকার পাওয়া যায়নি। দামিনকো-র ১২১৮ টি গ্রাম থেকে তারা অন্তত ৭৩০৮ টাকা বেআইনি সেস আদায় করেছিল। 
 
সাঁওতালরা যখন জঙ্গল উচ্ছেদ করে পতিত জমি উদ্ধার করে তাকে শস্য শ্যামল করছিল তখন থেকেই আশেপাশের জমিদারদের লুব্ধ দৃষ্টি পড়েছিল সেই সমস্ত জমির ওপর। তাদের পিছু পিছু এগিয়ে এসেছিল মহাজন আর ব্যবসায়ীদের দল। দামিন-ই-কোহতে বাড়তে থাকা জনসংখ্যার পরিসংখ্যান দেখলেই স্পষ্ট হয়। বীরভূমের আশেপাশের অঞ্চল থেকেই তারা এসেছিল। দামিন-ই-কোহ-তে পরপর থানা, আদালত বসতে শুরু হয়। তৈরি হয় আমলা আর পুলিশের দল। আর এরা সবাই নিরীহ সাঁওতালদের শোষণ করবার সুযোগ খুঁজতে থাকে। মহাজনদের অত্যাচার সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। 
 
সাঁওতালদের সবথেকে সংকটের সময় ছিল  বর্ষাকাল। এই সময় তারা কোনো কাজ করবার সুযোগ পেত না। তাদের কোনো উপার্জন ছিল না এই সময়। তাদের কোনো সঞ্চয় অভ্যাস ছিল না। এই সুযোগে মহাজনরা প্রথমে সাঁওতালদের বন্ধু সেজে কিছু টাকা বা শস্যকণা ঋণ দিয়ে তাদের সর্বস্বান্ত করতে শুরু করেছিল। শুধু সুদ নয়, ওজনে ঠকানো (একবার বিশ বল বাবু!), নিরক্ষরতার সুযোগ নিয়ে জাল খত তৈরি করা, প্রতিবাদ করলে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দেওয়া, এসব ছিল মহাজনদের নিত্যকর্মপদ্ধতি।
 
 
সাঁওতাল বিদ্রোহের লড়াইয়ের গল্প সবাই জানেন, তাই সেই গল্প আর করলাম না। 
 
আগেই বলেছি, সাঁওতাল বিদ্রোহের আগে এই এলাকা দামিন-ই-কোহ নামে পরিচিত ছিল। এই এলাকায় আদিবাসী মানুষ কতদিন আগে থেকে বসবাস করছেন, সে সম্পর্কে গবেষণা হয়েছে বলে জানা নেই। তবে প্রতিটি বিদ্রোহের ঘটনার সাথে নারীরা যুক্ত ছিলেন। যে কথা সেভাবে ইতিহাসের পাতায় উল্লেখ করা হয়নি।
 
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বঙ্গবিজয়ের সাথে এখানকার পাহাড়িয়া মালদের যোগ আছে। ৬৪৫ সাধারণ পূর্বাব্দে চীনা পর্যটক হিয়ুয়েন সাঙের ভারতভ্রমণ বিবরণীতে উল্লেখ আছে ওই সময় মৌর্য সাম্রাজ্যের উত্তর সীমান্ত ছিল গঙ্গার সীমা ধরে লখিসারী থেকে রাজমহল পাহাড় আর  দক্ষিণে গভীর জঙ্গল পর্যন্ত। সেখানে হাতি এবং অন্য অনেক জন্তুজানোয়ার ঘুরে বেড়াতো। চম্পার পূর্ব দিকে কজঙ্গল বা কেই-চিঙ্গ-কেলৌ নামে রাজ্য ছিল।
 
কেই-চিঙ্গ-কেলৌ সম্ভবত দামিন-ই-কোহ এলাকা, ভৌগলিক ও ঐতিহাসিক পরিচয় সেই কথাই পুষ্ট করে। পাহাড়িয়ারাই এখানকার আদি ভূমিপুত্র ছিল।
 
১৭৭২-১৭৮২ সালে রানি সর্বেশ্বরী এখানকার পাহাড়িয়াদের নিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। এই হিসেবে সাঁওতাল পরগণা বলে পরবর্তী সময়ে যে জায়গাকে নির্দিষ্ট করা হয়, পাহাড়িয়ারা ছিলেন সেই জায়গার আদি ভূমিপুত্র। 
 
দামিন সংশ্লিষ্ট ছোটনাগপুরে কোল বিদ্রোহ হয়েছিল ১৮৩১-৩২ সালে। সেখানে সিঁদরায় মানকি তথা বিদরায় মানকি-র বোন সুরগা মুণ্ডার স্ত্রী নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৮৫৫-৫৬ সময়ে সাঁওতাল বিদ্রোহে (সিধু,কানু,চাঁদ এবং ভৈরবের বোন) ফুলু মুর্মু তথা ঝানু মুর্মু নারী বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন। এছাড়া যে সমস্ত মহিলাদের নাম পেয়েছি, তাঁরা হলেন রাধা, হীরা, তারা, মৌনি, রাসু, ভব্তেন ও ভবানী (দুজনে এক‌ই পরিবারের সদস্য ছিলেন) প্রমুখ অংশ গ্রহণ করে। সাঁওতাল বিদ্রোহের পরবর্তী সময়ে সিংভূমে ১৮৯৫ থেকে ১৯০০ বিরসা মুন্ডার উলগুনান আন্দোলন হয়। সেই আন্দোলনে মাতাগারু গ্রামের গঙ্গা মুণ্ডারী, কতনা গ্রামের চাঁন্দা মুণ্ডারী, করনফেল গ্রামের সাহা মুণ্ডারী, জমরা গ্রামের গালা মুণ্ডারী, জগদা গ্রামের গৌরী মুণ্ডারী, পীংগু গ্রামের বীজী মুণ্ডারী, হরসাডিহি গ্রামের চসিয়া মুণ্ডারী, জিকিলতা গ্রামের সঞ্জা মুণ্ডারী, বরগলকেল গ্রামের মেদিনী মুণ্ডারী, কিলনাগ গ্রামের রালী মুণ্ডারী প্রমুখ মহিলারা অংশ নিয়েছিলেন। 
 
শেষের আগে একটা কথা না বললে নয়। সাঁওতাল পরগণায় গত তিন বছর ধরে ১৬৫ বছর আগের সেই সব মানুষদের খুঁজে বেড়িয়েছি। যাদের পূর্বপুরুষ বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন।
 
পরাধীন ভারতে নৌবিদ্রোহের নায়কদের অন্যতম বলাই চন্দ্র দত্ত আমার জেলার (বর্ধমান) মানুষ। নৌবাহিনীতে যোগ দেবার আগে পাটনা শহরে এক প্রবীণ মানুষের (বেটা মানুষের মতো মানুষ হ‌ও!) আশীর্বাদ তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর নৌবাহিনীতে যোগদান করেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য সাসপেন্ড হন। তারপর কোর্ট মার্শল ইত্যাদি হ‌ওয়ার পর চাকরি হারিয়ে স্বাধীন ভারতে তিনি যেদিন পাটনা শহরে ফিরেছিলেন, দেখেছিলেন মাত্র এক দশকের মধ্যে শহরের বিরাট পরিবর্তন হয়ে গেছে। সেই প্রবীণ মানুষটির নাম, এমনকি তিনি যে সংবাদপত্র প্রকাশ করতেন সে কথাও বেমালুম ভুলে গেছে পাটনা শহরের সেই গলির মানুষ! বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন, আমরা নাকি ইতিহাস ভুলো মানুষ। কিছু মনে রাখতে চাই না।
 
বলাই চন্দ্র দত্ত দশ বছর আগের একজন মানুষের খোঁজ পাননি। আমি তো ১৬৫ বছর আগের মানুষদের খোঁজে একদা সাঁওতাল পরগণা নামে পরিচিত ঝাড়খণ্ডের পাহাড় জঙ্গলে ঘুরেছি। 
 
ভাগ্গিস কার্সটেয়ার্স সাহেব সাঁওতাল বিদ্রোহ সংক্রান্ত হাড়মা'স ভিলেজ ব‌ইটা লিখেছিলেন, আর কিছু মানুষ সেই ব‌ই পড়েছেন। তাই খোঁজখবর করতে খুব একটা অসুবিধায় পড়তে হয়নি। দামিন-ই-কোহ'র নাম পরিবর্তন হয়ে সাঁওতাল পরগণা বা ঝাড়খণ্ডের পাকুড় বা দুমকা জেলার আমড়াপাড়া বা গোপীকান্দর ব্লকের অন্তর্গত হয়ে পিপড়া, সিলিঙ্গি, পাড়েরকোল (গ্রামগুলো বিদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত) গ্রামের নাম যদি পাল্টেও যায় তাহলেও এখনও কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা এগিয়ে এসে বলবেন আমি সিধু'র বংশধর, আমি শ্যাম পারগাণা'র বংশধর, আমি হাড়মা মাঝি'র বংশধর।
 
সাঁওতাল বিদ্রোহের ঘটনাকে এরা এতটাই স্মরণীয় মনে করেন। কিন্তু কারণ শুনলে চমকে যাবেন না?
 
কারণ একটাই, আমাদের স্বাধীন দেশে গোহাটায় গরু কেনাবেচার মতো জনপ্রতিনিধি বিধায়ক এবং সাংসদদের মোটা আর্থিক মূল্যে অর্থাৎ অনেক টাকায় কিনতে পাওয়া যায়। সেখানে এই ধরণের বংশ মর্যাদার কৌলিন্যধারী মানুষদের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও কিছুটা মূল্য আছে। 
 
মানুষের আন্তরিক সহানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে ভোট বৈতরণী পার হ‌ওয়ার জন্য বিদ্রোহের উত্তরসূরিদের প্রয়োজন হয়। কখন‌ও তাঁদের ভোটে দাঁড় করানো হয়, কখনোও বা সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রার্থী তাঁকে নিয়ে ভোট প্রার্থনা করতে প্রচারে বের হন। কিন্তু ইতিহাস থেকে যায় অন্ধকার গলিখুঁজির মধ্যে। ইতিহাসে আলো পড়ে না, তাতে রাবিশ চাপা পড়ে যায়।
 
সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়কদের প্রকৃত বংশধরের খোঁজে আমি প্রত্যক্ষভাবে গো + এষণা = গবেষণা নয়, গো-অন্বেষণে ব্যস্ত ছিলাম বেশ কিছু দিন।
 
ভগনাডিহিতে সিধুর বংশধরদের খুঁজে বেড়াতে আমাকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। কারণ তারা আমার পূর্ব পরিচিত। কিন্তু ভগনাডিহির প্রান্তর খুঁজে পেতে এবারে (২০২০) বেশ বেগ পেতে হয়েছে। ভগনাডিহিতে যে বটগাছ দেখেছিলাম, সেই বটগাছ এখনো দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তাকে ঘিরে যে পাঁচিল উঠেছে সেই পাঁচিল হচ্ছে মুসলিমদের কবরস্থানের সীমানা। বটগাছের নিচে দেখি সদ্য কয়েকটি কবরের মাটি, টাটকা বাতাস কাটছে।
 
সেখানে আমাদের ঘোরাঘুরি করতে দেখে স্থানীয় প্রশাসনের অধ্যক্ষ মহম্মদ দিন আনসারির ছোটো ভাই মহম্মদ সমীর আনসারি রাস্তার পাশে  মোটরসাইকেল স্ট্যান্ড করে রেখে ছুটে এলেন। 
 
কবরস্থানের ওপর ঘোরাঘুরি করছেন আপনারা?
 
বললাম, শ্রদ্ধেয় ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে এবং গবেষক অরুণ চৌধুরীর সঙ্গে এসে দেখেছিলাম, এই বটগাছ এবং ভগনাডিহির প্রান্তর। যেখানে দাঁড়িয়ে সিধু-কানু ১৮৫৫-র ৩০ জুন ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কমপক্ষে দশ হাজার সাঁওতাল সেদিন সেই জমায়েতে হাজির ছিল। 
 
সমীর আনসারি বললেন, না না না। এই জায়গা আমার বাবা দাদাদের বহুত দিন আগে থেকেই কবরস্থান হিসেবে পরিচিত। 
 
বললাম, তাহলে হুল দিবসের আহ্বান কোন জায়গা থেকে দেওয়া হয়েছিল? সেই জায়গাটা কোথায়?
 
উত্তর পেলাম, সে জানি না। 
 
দেখলাম ওই পাঁচিল লাগোয়া কয়েকটি মুসলিম পরিবারের ঘর তৈরি হয়েছে, তারা জটলা করছে। এসব আগে দেখিনি। রাস্তার ওপারে সিধু-র বংশধরদের ঘরবাড়িগুলো তেমনি দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওখানে সাঁওতালদের বসতি। এপারে বেশ কয়েকটি নতুন মুসলিম বসতি গড়ে উঠেছে। দেখেই বোঝা যায় এগুলো সব নতুন।
 
বসতি গড়ে উঠতেই পারে। তাবলে ১৮৫৫-র ৩০ জুনের শালগিরার আহ্বানের জায়গাটা হারিয়ে যাবে? 
 
কথায় কথায় সমীর আনসারির কাছে জানতে পারলাম, স্থানীয় বিডিও এসেছেন সেদিন (২০/১১/২০২০) কাছেই একটি স্থানীয় অফিস বাড়িতে কোনো প্রশাসনিক কাজে। একবার প্রশ্ন করা যায় কিনা ছুটলাম। 
 
না, তিনি নেই। মিটিং শেষ করে চলে গিয়েছেন। জানি না। ঘটনা কাকতালীয় কিনা। আদৌ কী এসেছিলেন?
 
২০১৬ সালের পর সাঁওতাল মুসলিম বিভেদের দেওয়াল তুলে ভগনাডিহিতে রাস্তার পাশে পাঁচিল ঘেরা অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা পুরনো বটবৃক্ষ। আর তার নিচেই মুসলিমদের কবরস্থান। জানি না সেই বটবৃক্ষের চোখে কোনো অশ্রু গড়িয়ে পড়ে কিনা!
 
ওই গাছের ছবি সহ প্রান্তরের ছবি সাঁওতাল বিদ্রোহের কথা লেখা হয়েছে যে সমস্ত ব‌ইতে, প্রায় সব লেখক এবং ঐতিহাসিক তাঁদের ব‌ইয়ে ওই ছবি ব্যবহার করে বটগাছ এবং ভগনাডিহির প্রান্তরের কথা উল্লেখ করেছেন। 
 
আমার মাথায় আসে না, তাহলে সেই জায়গা হাওয়ায় মিলিয়ে যায় কী করে? 
 
উইকিপিডিয়া বলছে, Damin-i-koh (or sometimes referred to simply as Damin) was the name given to the forested hilly areas of Rajmahal hills broadly in the area of present Sahebganj, Pakur and Godda districts in the Indian State of Jharkhand.
 
In 1832, the government set apart a large area in Damin-i-Koh for the settlement of the Santals. The population in this tract increased from 3,000 in 1838 to 82,795 in 1851. (দ্র: Integration of Endogenous Culture Dimension into Development. Retrieved 1 May 2010).
 
নির্বাচিত সাংসদ, সমাজকর্মী এবং ঐতিহাসিকদের কাছে আমার প্রশ্ন, ভগনাডিহির যেখানে দাঁড়িয়ে সিধু কানু হুলের ডাক দিয়েছিলেন সেই ভগনাডিহি গ্রাম র‌ইলো, সিধু কানুদের বাড়ি র‌ইলো, আর ভগনাডিহির প্রান্তরের বেঁচে থাকার কথাটা আপনারা একটু ভাববেন না? জায়গাটা ধ্বংস হয়ে যাবে?
 
তথ্য কৃতজ্ঞতা:
সাঁওতাল বিদ্রোহ সম্পর্কে বাংলা, ইংরেজি এবং হিন্দি ভাষায় লেখা প্রায় সব ব‌ই যা আমাদের দেশে পাওয়া যায়; প্রায় সব ব‌ইয়ের সহযোগিতা নিয়ে কাজ করেছি। এছাড়া বিভিন্ন ওয়েবসাইট, উইকিপিডিয়া এবং সরেজমিনে ঘোরাফেরার সময় বিভিন্ন মানুষের সাক্ষাৎকার ও অভিজ্ঞতায় এই লেখা। বিশেষ কৃতজ্ঞতা: আজাদী কে আন্দোলন কী অদৃশ্য স্ত্রীয়াঁ, কুমারী মীরা রানী, পিএইচডি শিক্ষার্থী, গান্ধী এবং শান্তি অধ্যয়ন বিভাগ, মহত্মা গান্ধী অন্তরাষ্ট্রীয় হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয়, গান্ধী হিলস, ওয়ার্ধা ৪৪২০০১, মহারাষ্ট্র।