ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রাম : ইতালির অভিজ্ঞতা

 

সাধারণভাবে একটি ধারণা যা বামপন্থী শিবিরেও বিদ্যমান তা হল যে কোনো স্বৈরতন্ত্রই ফ্যাসিবাদ। তা হলে রাশিয়ার জারতন্ত্র ও কি ফ্যাসিবাদ ?  উত্তর হল না। ফ্যাসিবাদ একটি আধুনিক যুগের মতাদর্শ - তা পুঁজিবাদী সম্পত্তি সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে একটি নির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল উগ্র জাতীয়তাবাদী মতাদর্শর ভিত্তিতে সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করার প্রয়াস চালায়। পুঁজিপতি, বিশেষত বড় ও একচেটিয়া পুঁজিপতিদের কাছে একটা বিকল্প হিসাবে হাজির হয় । ইতিহাস দেখিয়ে দিয়েছে যে ফ্যাসিবাদ হল পুঁজিবাদের সবথেকে নির্মম একনায়কতন্ত্রী শাসন

ফ্যাসিবাদের উৎস খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালীন ইতালিতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধর সময় এবং পরবর্তীকালে যে জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ উদ্ভূত হয়েছিল , তার উপর ভিত্তি করে পরবর্তীকালে  ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ জনপ্রিয়তা লাভ করে। এর অর্থ এই নয় যে, যে কোনো জাতীয়তাবাদী মতাদর্শই ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয় । বিভিন্ন দেশের উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রাম জাতীয়তাবাদী মতাদর্শর ভিত্তিতে সংগঠিত হয়। অন্যদিকে শ্রমিক, কৃষক আন্দোলনকে  স্বতন্ত্রভাবে সংগঠিত করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অভিমুখে পরিচালনা করার জন্য কমিউনিষ্ট পার্টিকে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়, যার সফল অভিব্যক্তি ছিল রুশ বিপ্লব।

ফিরে আসি ইতালি ও মতাদর্শর প্রশ্নে। ইতালিতে ফ্যাসিবাদী মতাদর্শর জনক বলা হয় বেনিটো মুসোলিনি এবং গিওভান্নি জেন্টাইলকে। বেনিটো মুসোলিনি (1883-1945) সমাজতান্ত্রিক হিসাবে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন তার জাতীয়তাবাদী প্রবণতার জন্য মুসোলিনি  সোস্যালিস্ট পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হন এবং পরবর্তীকালে ফ্যাসিস্ট দলের প্রতিষ্ঠা করেন। অন্যদিকে গিওভান্নি জেন্টাইল ছিলেন এক সময়ে হেগেল, প্লেটোর মতাদর্শে অনুপ্রাণিত দার্শনিক। ১৯৩২ সালে প্রকাশিত তাদের পুস্তিকা – ‘ফ্যাসিবাদী মতবাদ’- এর মূল প্রতিপাদ্য ছিল -

 

  • “ফ্যাসিবাদী ধারণাটি রাষ্ট্র কেন্দ্রিক – সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রের জন্য। তা উদারনীতিবাদের বিরূদ্ধে। ফ্যাসিজম রাষ্ট্রকেই ব্যক্তির বাস্তব অস্তিত্ব হিসাবে সুনিশ্চিত করে। অতএব, ফ্যাসিস্টদের জন্য, রাষ্ট্রের বাইরে ব্যক্তিসত্বা বা আধ্যাত্মিক কোন কিছুরই মূল্য নেই। এই অর্থে ফ্যাসিবাদ সর্বগ্রাসী।
  • রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী (রাজনৈতিক দল, সমিতি, সিন্ডিকেট, শ্রেণি) থাকবে না। সুতরাং ফ্যাসিবাদ সমাজতন্ত্রের বিরোধী, যা শ্রেণিসংগ্রামের মধ্যে ইতিহাসের  বিকাশকে সীমাবদ্ধ করে এবং রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও নৈতিক বাস্তবতায় প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন শ্রেণিসমূহের ঐক্যকে উপেক্ষা করে।
  • ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র সাধারণভাবে ধর্মের বাস্তবতাকে অস্বীকার করে না এবং সনাতন ধর্ম - ইতালিয়ান ক্যাথলিক ধর্মের প্রতি উদাসীন থাকে না।

কথাগুলো স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয় ফ্যাসিস্ট মতাদর্শের ভিত্তিকে। তা সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রর চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণে - অর্থনৈতিক, সামাজিক, ব্যক্তিসত্ত্বার বিকাশ ঘটানোর পক্ষে। কোনো মতাদর্শই লিখিতভাবে সাধারণ মানুষের ওপর সন্ত্রাসের কথা বলে না। কিন্তু সর্বগ্রাসী রাষ্ট্র এবং তার চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণের মতাদর্শই বিবিধ ধর্ম, জাতি, ভাষা সম্বলিত এক বহুমুখী সংস্কৃতির পরিবর্তে এক অভিন্ন ফ্যাসিবাদী উগ্র জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতির মাধ্যমে সমগ্র জনগণকে  ঐক্যবদ্ধ করতে চায়। তা মুখে বিভিন্ন শ্রেণির ঐক্যর কথা  বললেও পুঁজি এবং শ্রমের সম্পর্কই দ্বন্দ্বমূলক  আর তাই সর্বগ্রাসী রাষ্ট্র, বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে ছাপিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষায় দায়বদ্ধ থাকে। এই জায়গায় তারা কমিউনিস্ট এবং শ্রেণি সংগ্রামের চূড়ান্ত বিরোধী এবং তাদের সম্পর্কে  ঘৃণার মতাদর্শ প্রছার করে, আবার বুর্জোয়া উদারনৈতিকতারও তারা বিরোধী, যদিও সেই সম্পর্কটা ততটা দ্বন্দ্বমূলক নয়।

 

এবার দেখি বাস্তবত এই মতাদর্শর প্রয়োগ কীভাবে ঘটেছিল ইতালিতে। ইতালির শ্রেণিগত বিভাজন প্রাচীন রোমের সময়  থেকেই দেখতে পাওয়া যায়, যখন একাধিক শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে ব্যবসায়িক উদ্যোগ এমনকী  সেই রাজতান্ত্রিক পর্বেও দেখতে পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে ১৬ থেকে ১৮ শতকে বিপুল পরিমাণে ব্যবসা বাণিজ্যের মধ্যে দিয়ে অর্থনীতির বিকাশ ঘটে এবং ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার বিকাশ হয়, যদিও অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল ব্যাপকভাবে বিদ্যমান। পরবর্তীকালে ক্রমান্বয়ে আধুনিক পুঁজিবাদের বিকাশের পদ্ধতিত শিল্পর বিকাশ ঘটে, যদিও  বিংশ শতাব্দীর ইতালি জার্মানির তুলনায় ছিল অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর। অতীতের রাজতন্ত্র ও পোপের আনুকুল্যে বেড়ে ওঠা অভিজাতবর্গ, যার এক বড়ো অংশ ছিল জমিদারকুল, তাদের এক অংশ পুঁজিপতি শ্রেণীতে রূপান্তরিত হলেও গ্রামাঞ্চলে সামন্ততন্ত্র বহুল পরিমাণে বর্তমান ছিল। বড়ো শিল্পের অন্যতম ছিল ফিয়াট গাড়ি যা বিশ্বের অন্যত্র বিস্তার লাভ করে। ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্পের পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগে ব্যাঙ্ক, বীমা, কয়লা জাতীয় শিল্পের বিকাশ ঘটে।

শিল্প বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সংগঠিত শ্রমিকশ্রেণিরও বিকাশ হয়, আর সমগ্র ইওরোপের শ্রেণি সংগ্রামের জের ইতালিতেও আছড়ে পড়ে। ১৮৯০ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে শ্রমিক, কৃষকদের বেশ কিছু  সংগঠিত আন্দোলন লক্ষ করা যায়। ইতালির সোস্যালিস্ট দলের নেতৃত্বে বেশ কিছু জায়গায় ধর্মঘট সংগঠিত হয় ও জমি দখলের কর্মসূচী নেওয়া হয়। তবে সোস্যালিস্ট দলের কর্মসূচী ছিল মূলত সংস্কারবাদী - তারা পার্লামেন্টের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্রীয় সমাজবাদের তত্ত্ব প্রচার করত। এর বিপরীতে বেশ কিছু সিন্ডিক্যালিস্ট প্রবণতা গড়ে ওঠে।

১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইতালির প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক সংকটও ঘনীভূত হয়ে ওঠে। রাশিয়ার জার শাসনকালের মতোই যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সংকট আরো গভীর হয়। যুদ্ধে প্রচুর লোক মারা যাবার পাশাপাশি, ইতালির যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বহু বাসস্থান পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায় ।

ইতালির কৃষি এমনিতেই  উৎপাদনশীল ছিল না, আর যুদ্ধের দরুণ খাদ্য সংকটের জন্ম হয়। ইতালির তৎকালীন দক্ষিণপন্থী সরকার, যারা তাদের ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, তারা এই সংকট নিরসনের যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে নি, উপরন্তু পুঁজিপতি শ্রেণীর স্বার্থে কর্মী সংকোচন, বেতন হ্রাস চলতে থাকে। ইতালির সমাজতান্ত্রিক দলের বিশিষ্ট নেতৃত্ব সুবিধাবাদী নিরপেক্ষ অবস্থান নিলেও বাকী অংশ যুদ্ধবিরোধী অবস্থান নেয় - রাশিয়ার বলশেভিক পার্টি আর তৃতীয় আন্তর্জাতিকের অবস্থান তাদের প্রভাবিত করেছিল। ১৯১৫ – ১৯১৭ এই পর্বে শ্রমিক-কৃষক আন্দোলন সরকারকে আতঙ্কিত করেছিল আর তাই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, হত্যা শুরু হয়। ১৯১৭ সালের মে মাসে তুলনামূলক উদারনৈতিক সরকার ক্ষমতা দখল করে কিছু সংস্কার করলেও তা আন্দোলনকে বিপথগামী করতে পারেনি, বরং ১৯১৭ রাশিয়ার নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাবে শ্রেণিসংগ্রাম তীব্রতর হয়। ১৯১৯ - ২০, এই দুই বছরকে বলা হত ‘দুই লাল বছর’, যে সময়ে শ্রেণিসংগ্রাম এক বিশেষ উচ্চতা লাভ করে। এই সময় বেকারত্ব বেড়ে হয়েছিল ২ মিলিয়ন – যুদ্ধ থেকে আগত সৈনিকরা কাজের সন্ধান শুরু করেছিল। দক্ষিণ ইতালিতে কৃষক সংগঠনগুলির পরিচালনায় কৃষকেরা স্বতঃস্ফুর্তভাবে জমি দখল শুরু করেছিল। ফসল তোলার সময় কৃষি মজুররাও ধর্মঘটে সামিল হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ও ব্যক্তিমালিকানাধীন সংস্থাগুলিতে ধর্মঘট সাধারণ ধর্মঘটের চেহারা নেয়। এক কথায় এটা ছিল  প্রাক বিপ্লবী পরিস্থিতি – যদিও বিপ্লবী অভ্যুত্থান করা হবে কি না, তা ছিল বিতর্কের বিষয়, তবে উত্তর ইতালিতে শ্রমিকরা অধিকাংশ কারখানার দখল নিয়ে, তিন সপ্তাহের জন্য উৎপাদন চালু রাখে, তাদের আশা ছিল এভাবেই হাজার হাজার কারখানা দখলের মধ্যে দিয়ে শ্রমিক শ্রেণির ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা হবে। সমাজতান্ত্রিক দলের ডেপুটিরা পার্লামেন্টে রাজার উপস্থিতির বিরুদ্ধে ওয়াক আউট করলেও তাদের সংস্কারবাদী কর্মসূচীর দরুণ এই গণ আন্দোলনের সঙ্গে যথাযথ সংযোগ করতে পারে নি।

একমাত্র তুরিনে ফ্যাকট্রি কাউন্সিল আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বিপ্লবী অনুশীলনের প্রচেষ্টা হয়, কিন্তু সমাজতান্ত্রিক দলের সংস্কারবাদী নেতৃত্ব, যাদের পাল্লা ছিল ভারী – তার এর বিরোধিতা করে।  তবে ফ্যাকট্রি কাউন্সিল এক বিকল্প নেতৃত্ব ও মতাদর্শকে সামনে নিয়ে আসে - যার নেতৃত্বে ছিলেন তরুণ তুর্কী আন্তোনিও গ্রামসি। ইতালিতে তখন বিপ্লবী পরিস্থিতি থাকলেও বা ইতালির সরকারে দুর্বল দক্ষিণপন্থীরা থাকলেও অভাব ছিল রাশিয়ার বলশেভিকদের মতো বিপ্লবী কর্মসূচীর বলে বলীয়ান এক গণভিত্তি সম্পন্ন দলের। কিন্তু এর পাশাপাশি আরো একটা বিষয় ছিল - তা হল - উগ্র জাতীয়তাবাদী এবং ফ্যাসিস্ট মতাদর্শে অনুপ্রাণিত ফ্যাসিস্ট দলের শক্তিশালী গণভিত্তি। অর্থনৈতিক সংকট ও সামাজিক ঘাতপ্রতিঘাতে জর্জরিত মধ্যবিত্ত পেটি বুর্জোয়াদের এক অংশ এবং শ্রমিক - কৃষকদের লুম্পেন এক অংশ ছিল ফ্যাসিস্ট দলের সক্রিয় সমর্থক ও সদস্য। যুদ্ধের সময় ও পরে এই বাহিনী স্যোসালিস্ট পার্টির সদস্যদের উপর সন্ত্রাস চালায় ও হত্যার রাজনীতি নেয়। এ ছিল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বাইরের এক বিশেষ ধরনের সন্ত্রাস। তৎকালীন ইতালির সরকার শিল্পপতিদের পক্ষ নিয়ে দমন পীড়ন চালালেও কখনো কখনো কিছু সংস্কার করতে বাধ্য হয়েছিল। সেই ন্যূনতম সংস্কারও শিল্পপতি, জমিদারদের সন্তুষ্ট করতে পারে নি। বামপন্থী নেতৃত্বের বিপ্লবী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যর্থতা সংকটে  জর্জরিত জনগণকে আরো হতাশ করেছিল, যারা শেষ বিচারে চায় সমাধান। তাই সমাজতান্ত্রিক দল ১৯২০-২১ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হলেও ফ্যাসিস্ট দল দ্রুত গণভিত্তি অর্জন করতে সক্ষম হয়। ইতালির পুঁজিপতি শ্রেণি ফ্যাসিস্টদের সমর্থন করতে শুরু করে। বুর্জোয়ারা পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রর কিছু ভারসাম্য বজায় রেখে বুর্জোয়া শ্রেণিরই প্রতিনিধিত্ব করে, কিন্তু বিশেষ মুহূর্তে , বিশেষত সংকটের সময়, মুনাফার তাগিদে , বুর্জোয়া শ্রেণির প্রয়োজন হয়, এক সন্ত্রাসবাদী একনায়কত্বর। কেবল পুলিশ রাষ্ট্র দীর্ঘমেয়াদী বিচারে এই কাজটা করতে পারে না, তা জনসমর্থন হারিয়ে ফেলে, এই জায়গাটা পূরণ করে ফ্যাসিস্ট দল। ইতালিতে এই শূণ্যস্থান পূরণ করে মুসোলিনীর দল। নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতায় এলেও তার আসার চালিকাশক্তি ছিল পার্লামেণ্ট বহির্ভুত গণ আন্দোলন, যার মতাদর্শ  ছিল পূর্বোল্লেখিত উগ্র জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি পশ্চাদপদ রোমান ক্যাথলিক চিন্তা, উগ্র কমিউনিষ্ট বিরোধিতা এবং স্বাধীন শ্রমিক সংগঠনের বিপরীতে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে শ্রমিক-মালিক সমঝোতা।  সিন্ডিকেট তত্ত্বের প্রয়োজন ছিল জনমুখী মোড়কের জন্য - যাতে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবে শ্রমিক আন্দোলন মাথা ছাড়া না দেয়। ১৯২৫-২৭ এর মধ্যে পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রর ছিটেফোঁটাও অবলুপ্ত করে দেওয়া হয়, যাতে একমাত্র রাজাই মুসোলিনীর অপসারণ করতে  পারে। অন্য সব দলকে বেআইনী ঘোষণা করে এক একনায়কতন্ত্রী  ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। অন্য সব ট্রেড ইউনিয়নগুলির জায়গা নেয় – রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ফ্যাসিস্ট ট্রেড ইউনিয়ন। প্রায় দু দশক এর শাসনে ১৫০০০ এর বেশী লোককে রাষ্ট্র বিরোধী কাজের অভিযোগে বাইরের দ্বীপপুঞ্জে নির্বাসনে পাঠানো হয়।

একদিক থেকে দেখলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের থেকেও বেশী বিপজ্জনক ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ ও সংস্কৃতি, কারণ তা মগজধোলাইয়ের কাজ করে। খুব শৃঙ্খলাবদ্ধ উপায়ে পূর্বতন উদারনৈতিক সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে পশ্চাদপদ রোমান ক্যাথলিক সংস্কারকে সামনে নিয়ে আসা হয়। এর সঙ্গেই যুক্ত করা হয় এক আধুনিক সমাজের স্বপ্ন। জনগণকে বোঝানো হয় এর জন্য একনায়কতন্ত্রের প্রয়োজনিয়তা, বলা হয় এক শক্তিশালী নেতা, এক শক্তিশালী রাষ্ট্রই এই স্বপ্নকে সার্থক করতে পারে। তবে গণ আকারে বর্ণবাদী, জাতিবাদী হিংসা মুসোলিনীর শাসনের প্রারম্ভিক পর্যায়ে ছিল না, তা শুরু হয় পরবর্তীকালে, যখন তিনি হিটলারের সঙ্গে হাত মেলান।

 

ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় অর্থনৈতিক বিকাশ যে খুব দ্রুত গতিতে হয়েছে তা নয়। কৃষি ক্ষেত্রে অনুৎপাদক ইতালি শেষ অবধি অনুৎপাদকই থেকে গেছে। প্রাথমিক পর্বে বীমা ইত্যাদির বেসরকারীকরণ ঘটালেও, পরবর্তীকালে এক সময় সরকার দেশের অর্থনীতির ২/৩ অংশ রাষ্ট্রায়ত্তকরণ করে। এ ছাড়াও তারা শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যয় করে। এই পর্বে  অর্থনীতির মডেল ছিল কেইনসীয় মডেল। সমগ্র অর্থনীতি বেসরকারীকরণ করলে, তা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা ইতালির পুঁজিপতিদের ছিল না, আবার ক্ষোভ-বিক্ষোভ যাতে দানা না বেঁধে ওঠে – তার জন্য জনমুখী কর্মসূচী গুলি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এ সবই ছিল সাময়িক - ১৯৪১ সালে দেখা যায় – প্রচুর পরিমাণে ইতালীয়রা বাইরে পাড়ি দিচ্ছে কাজের সন্ধানে – যা আবার তৎকালীন বেকার সমস্যার কিছুটা সমাধান করেছিল। বেতন হ্রাস করে দেওয়াও ছিল একটা সমস্যা। সব মিলিয়ে অর্থনীতির ক্ষেত্রে তা পুঁজিবাদী উদারনৈতিক পর্বের থেকে আলাদা কিছু ছিল না, তবে মতাদর্শের ক্ষেত্রে তা মানুষের সচেতনতাকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিস্ট জোটের পরাজয়ের পর তৈরি হওয়া সংকট সরকার আর সামাল দিতে পারেনি এবং ১৯৪৫ সালে মুসোলিনী সরকারের পতন ঘটে।

ইতালির ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রাম শুরু হয়েছিল মুসোলিনী ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই, যার সামান্য উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। ১৯২১ সালে ফ্যাসিস্টদের ক্ষমতা দখলের প্রাক্কালে , দুই সপ্তাহের সংঘর্ষে মৃত্যু হয় ৭১ জনের। ফ্যাসিস্টদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল স্যোস্যালিস্ট, কমিউনিস্ট, মধ্যপন্থী বুর্জোয়া উদারনীতিকরা। এ প্রসঙ্গে যেটা উল্লেখ করার বিষয়, ১৯২১ সালে স্যোস্যালিস্ট দলের বামপন্থী অংশ, নেতৃত্বের বিচ্যুতি - শ্রমিকশ্রেণির কারখানা দখলের পর্বে তাদের বেইমানির পরিপ্রেক্ষিতে সোশালিস্ট দলের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করে, যার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন বোর্দিগা। বোর্দিগা অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে স্যোসালিস্ট দলের মধ্যে বিপ্লবী প্রবণতা তৈরী করেছিলেন, কিন্তু দুভার্গ্যক্রমে তিনি এবং কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের অধিকাংশই অতি বাম বিচ্যুতির শিকার হয়েছিলেন, তৃতীয় আন্তর্জাতিকের চতুর্থ কংগ্রেসের বিশ্লেষণকে তারা মানতে চান নি। তৃতীয় আন্তর্জাতিকের চতুর্থ কংগ্রেস সাধারণভাবে সমাজ গণতন্ত্রী দলগুলির সাথে কমিউনিস্ট দলের যুক্তফ্রন্টের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সমাজ গণতন্ত্রী দলগুলির নেতৃত্ব বেইমানি করলেও তাদের রাজনীতি ছিল বুর্জোয়া শ্রেণি ও শ্রমিক শ্রেণির সমঝোতার রাজনীতি। এই সিদ্ধান্ত ছিল তুলনামুলক নিষ্ক্রিয় পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদ বিরোধী লড়াইকে জোরদার করার জন্য। এটা ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ের জন্য আরো বেশি প্রয়োজনীয় ছিল। ইতালির কমিউনিস্টরা কেবলমাত্র ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ক্ষেত্রে যৌথ আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন, কিন্তু প্রয়োজন ছিল দলগত জোটের - যা নির্বাচনে  অংশগ্রহণ করবে ‘শ্রমিক সরকারের’ স্লোগান তুলে।

১৯২১ এ সমাজতন্ত্রী দল ছিল ইতালির পার্লামেন্টের সর্ববৃহৎ দল, দ্বিতীয়  স্থানে ছিল বুর্জোয়ো উদারনৈতিক দল, আর জাতীয় ফ্যাসিস্ট দল ছিল তিন নম্বরে। মনে রাখতে হবে তখন শ্রমিক কৃষক  আন্দোলনের তেজ অনেকাংশেই নিষ্প্রভ হয়ে এসেছে, তাই শিল্প ক্ষেত্রের বাইরেও বামপন্থীদের দলগুলির জোট দরকার ছিল সামাজিক, সাংস্কৃতিক সব ক্ষেত্রে। বুর্জোয়া উদারনৈতিক দলগুলির সঙ্গে জোটের কথা তখনো আসেনি, যেহেতু তারা সরাসরি পুঁজিবাদের ই প্রতিনিধিত্ব করে আর তাদের সঙ্গে জোট পুঁজির বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক লড়াইগুলি দুর্বল করে। কিন্তু কিছু গুরুতর পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রর দাবীতে এবং ফ্যাসিস্ট সংস্কৃতির আধিপত্যের বিরুদ্ধে এক বৃহৎ ফ্যাসিবাদ বিরোধী মঞ্চর প্রয়োজন হয়ে পড়ে, যদিও তার পাশাপাশি কমিউনিস্ট পার্টিকে আলাদাভাবে শ্রমিক কৃষক কে সংগঠিত করতে হয়।

মুসোলিনীর ফ্যাসিস্ট দলের রোমে প্রতিবিপ্লবী ক্যু দে তার মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা দেখিয়ে দেয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ইতালীয় পার্টি সম্পর্কে সমালোচনা কতো সঠিক ছিল। বোর্দিগাদের সোশালিস্ট কমিউনিস্ট জোট বিরোধী মতের বিপরীতে ছিলেন আন্তনিও গ্রামশি, তিনি স্যোসালিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্তফ্রন্টের প্রয়োজনিয়তা অনুভব করেছিলেন। শুরুতে গ্রামশির মতামত সংখ্যালঘু থাকলেও ধীরে ধীরে তা সমর্থন অর্জন করতে থাকে। ১৯২৪ সালের নির্বাচন ছিল এক অর্থে ছিল প্রহসন – ব্যাপক রিগিং এর মধ্যে দিয়ে ফ্যাসিস্ট দল ক্ষমতায় আসে। কিন্ত সমাজতান্ত্রিক দল ২৪ টা আর কমিউনিস্ট পার্টি ১৯ টি আসন পায়। নির্বাচনী প্রহসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় এক সোস্যালিস্ট ডেপুটিকে খুন করা হয়, যার প্রতিক্রিয়ায়  দেশে প্রতিবাদের আগুন জ্বলে যায়। বিরোধী দলগুলি পার্লামেন্ট বয়কট করে। এই পর্বে বিরোধী দলগুলিকে নিয়ে এক ব্লক তৈরী হয়, যার মধ্যে সোস্যালিস্ট, কমিউনিস্ট  এবং বুর্জোয়া দলগুলিও ছিল। এই জোটের মূল কর্মসূচী ছিল গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন । কমিউনিস্ট পার্টি সেই সময় শ্রমিক শ্রেণির সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান দিতে বললে দক্ষিণপন্থী উদারনৈতিক দলগুলি তা প্রত্যাখান করে, কারণ তারা ফ্যাসিবাদ বিরোধী কর্মসূচীকে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক কর্মসূচীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতেই গ্রামশি লেখেন তাঁর বিখ্যাত লেখা - ‘ফ্যাসিবাদও নয়, উদারনীতিবাদও নয়, বরং সোভিয়েত ভিত্তিক বিপ্লবী চিন্তা’ - অর্থাৎ শ্রেণিগত দাবীদাওয়াগুলিকে উপেক্ষা না করে তার ভিত্তিতে শ্রমিক কৃষককে সংগঠিত করা - যাতে বিপ্লবী পরিস্থিতিতে সোভিয়েত গঠনের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতা দখল করা যায়। আসলে তখনো রুশ বিপ্লবের ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব আদর্শগতভাবে জীবিত আর ইতালির ব্যর্থ বিপ্লব থেকে শিক্ষা নেওয়া গ্রামশির বিশ্লেষণ ঠিকই ছিল । গ্রামশির চিন্তাকে মুসোলিনী সরকার এত ভয় পেয়েছিল যে তাকে ১৯২৬ সালে গ্রেপ্তার করে দীর্ঘদিন কারারুদ্ধ করে রাখে এবং পরবর্তীকালে জেলেই তাঁর মৃত্যু ঘটে।

 

আরেকটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে তখনো ফ্যাসিবাদের বিপদ জাতীয় স্তরেই সীমাবদ্ধ ছিল – আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সীমানা ছাপিয়ে গিয়ে তা তখনো সোভিয়েতের অস্তিত্বকে বিপদের মুখে ফেলেনি, যা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। সেই পর্বেও ইতালির জনগণের ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রাম ছিল প্রশংসনীয়। অবশেষে ১৯৪৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে হিটলারের নাজিবাহিনীর পতন হলে তার দোসর মুসোলিনীর ফ্যাসিস্ট সরকারেরও পতন ঘটে।