প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার সন্ধানে
- 01 February, 2021
- লেখক: প্রদীপ বসু
আজকের ভারতে, মুষ্টিমেয় হিন্দুত্ববাদীরা চাইছেন যে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বদলে ভারত একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হোক। কিন্তু তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন যে, ১৯৪৭ সালে এ প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে গিয়েছিল। বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যারা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবে। জিন্নাহ র মতো যেসব উগ্র ধর্মান্ধ মুসলিম সেদিন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ধারণাকে মেনে নিতে পারেন নি, তাঁরা এদেশ ত্যাগ করে পাকিস্তানে চলে যান। (অথচ, ধর্মের ভিত্তিতে দেশ গঠন যে কতটা অর্থহীন, তার প্রমাণ পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের জন্ম, ইরান-ইরাক যুদ্ধ)। যাইহোক, দেশভাগের সময়, আর বাকি মুসলিমরা,হিন্দু, খৃষ্টান, শিখ প্রমুখেরা ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে থেকে যান। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে সেদিন এদেশে থাকতে তাঁদের কোনো অসুবিধা হয় নি। আজ স্পষ্ট করে বলা দরকার যে, আমরা এই বিপুল সংখ্যক ভারতবাসী, হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খৃষ্টান, বৌদ্ধ, সবাই চাই যে, এ দেশ সেকুলার থাকুক। আমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। যেসব মুষ্টিমেয় উগ্র, ধর্মান্ধ, হিন্দুত্ববাদী নেতাদের আজ বর্তমান ভারতের এই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চরিত্র নিয়ে অসুবিধা হচ্ছে, তাঁরাই বরং সেদিনকার জিন্নাহ ইত্যাদি উগ্র, ধর্মান্ধ, মুসলিমদের মতো এ দেশ ছেড়ে চলে যান। এটা তাঁদের সমস্যা। আমাদের নয়। তাঁদের নিজস্ব ব্যক্তিগত সমস্যার দায় তাঁরা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারেন না। তাঁদের কয়েকজনের ব্যক্তিগত অসুবিধার জন্য আমাদের জীবনকে দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে বিষিয়ে দেবার কোনো অধিকার তাঁদের নেই।
এখন কয়েকজন হিন্দুত্ববাদী বলছেন, মুসলিমদের এদেশ থেকে তাড়ানো হোক। এদেশ হোক হিন্দু রাষ্ট্র। এর উত্তরে আমি বলব যে, এদেশ থেকে মুসলিমদের তাড়ানোর তারা কে? এদেশ যতটা হিন্দুদের, ঠিক ততটাই মুসলিম, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, খ্রিস্টানদের। কারণ ১৯৪৭ সালে ভারত কোন হিন্দু রাষ্ট্র হয়নি। বরং পূর্ণ সচেতন ভাবে, এদেশে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে গ্রহণ করা হয়েছিল। তাছাড়া, সেদিন যেসব মুসলিমরা স্বেচ্ছায় পাকিস্তানে যাননি, যারা অনেক দাঙ্গা-হাঙ্গামার ভয় সত্ত্বেও, নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি সত্ত্বেও, সংখ্যালঘু হয়ে বাঁচার আতঙ্ক সত্ত্বেও, এদেশেই থেকে গিয়েছিলেন, আজ ৭৩ বছর বাদে তাদের এদেশ থেকে তাড়াবার কথা বলার স্পর্ধা আসে কোথা থেকে?
এইসব মুষ্টিমেয় হিন্দুত্ববাদী বলছেন, পাকিস্তান তো মুসলিম রাষ্ট্র, তাহলে ভারত কেন হিন্দু রাষ্ট্র হবে না? কিন্তু, এর বিপরীতে, আমার কথা হলো, আমাদের মডেল তো মৌলবাদী ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তান নয়। তার চাইতে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, বহুত্ববাদী, বৈচিত্র্যপূর্ণ ভারত অনেক ভালো। কয়েকজন হিন্দুত্ববাদী বলছেন যে, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে মেকি ধর্মনিরপেক্ষতা। আমি মেনে নিতে রাজি যে, আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতায় অনেক ত্রুটি আছে। কিন্তু তা বলে তাকে মেকি বলা আদৌ ঠিক নয়। বরং তৃতীয় বিশ্বের অন্য অনেক দেশের তুলনায়, এদেশ বেশি ধর্মনিরপেক্ষ। আমাদের দেশের গনতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাতেও অনেক ত্রুটি নিশ্চয়ই আছে। তবুও বলব, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, নেপাল এরকম অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায়, আমাদের দেশ বেশি গণতান্ত্রিক, বেশি ধর্মনিরপেক্ষ, বেশি বহুত্ববাদী, বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ, বেশি সহনশীল। আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতায় যে ত্রুটি আছে, সেগুলোর উত্তর এটা হতে পারে না যে, পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষতাকেই বিসর্জন দিতে হবে। বিসর্জন দিয়ে একটি হিন্দু রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। এর মানে হল, গামলার স্নানের জলের সাথে শিশুটিকেও ছুড়ে ফেলে দেয়া। বরং আমি বলব, আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতার ত্রুটিগুলোকে সংশোধন করে আরও পরিপূর্ণ, যথার্থ ও সফল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি ভারতকে গড়ে তোলা প্রয়োজন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষতা, ধর্ম-টর্ম, হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক, এসব নিয়ে কয়েকটি কথা আমার মনে এলো। লিখেও ফেললাম। আমার মতামতই যে একমাত্র সঠিক এরকম কোনো দাম্ভিক ভাবনা আমার একেবারে নেই। কেউ কিছু ভুল মনে করলে জানাবেন। বাধিত হব। খোলা মনে আলোচনা চলুক।
প্রথমেই একটি সহজ কথা বলব। হিন্দু, মুসলিম, খৃষ্টান, কোনো ধর্মেরই সংকীর্ণতা, উগ্রতা, গো৺ড়ামি মানবজাতির পক্ষে ভালো নয়। অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা থাকুক। সহনশীলতাই কাম্য। সেটা ব্যক্তি মানুষদের নিজেদের জন্যেও প্রয়োজন। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাসবাদ, হিন্দু- মুসলিম- খৃস্টান মৌলবাদ, এসব সকল সমাজের পক্ষেই খুব ক্ষতিকর।
অসাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্রের সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিই মানব ইতিহাসে এযাবৎ আবিষ্কৃত সহনশীলতার শ্রেষ্ঠতম নীতি। পাশ্চাত্যে এর অর্থ, ধর্মবর্জিত রাষ্ট্রীয় নীতি। আর, ভারতে এর অর্থ, রাষ্ট্র বিশেষ কোনো ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবে না। সর্বধর্ম সমভাব। কিন্তু, রাজনৈতিক দলগুলি যেভাবে বিশেষ বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মাথাদের তোষণ করেছে, তাতে এদেশের অনেক ক্ষতি হয়েছে। তাছাড়া, রাজনৈতিক দলগুলি যেভাবে মুসলিম ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষকে ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করেছে, অথচ, তাদের শিক্ষা-দীক্ষা, বাসস্থান, খাদ্য, বস্ত্র, চাকরি, স্বাস্থ্য, চিকিৎসার ক্ষেত্রে সত্যিকারের উন্নয়ন কিছুই করেনি, তা একান্তই অনৈতিক (রাজেন্দ্র সাচার কমিটি রিপোর্ট দেখুন )।
আমি আরও বলবো, প্রতিষ্ঠিত, প্রবলতম, প্রাতিষ্ঠানিক, প্রধানতম ধর্মগুলির তুলনায়, লালন, চৈতন্য, কবীরদের অপ্রাতিষ্ঠানিক, নিম্নবর্গীয় ধর্ম সমন্বয়ের, ভালোবাসার নীতিতে বেশি আস্থা রাখি। শুধু তাই নয়, নাস্তিক এবং প্রকৃত বামপন্থী, যারা কোনো ধর্মেই বিশ্বাসী নন, তাঁদের প্রতিও গভীর শ্রদ্ধা জানাই। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, ধর্মে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস, এমনকি ঈশ্বরে, আল্লায়, কোনো দেব-দেবীতে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস, এসব যার যার নিজের ব্যাপার। কেউ বিফ খাবেন, নাকি পর্ক খাবেন, বাঙালি হয়ে মাছ খাবেন, নাকি সম্পূর্ণ নিরামিষভোজী হবেন, সেটা তিনিই ঠিক করবেন। তবে, দেশ সবার। আজ বিশেষ করে মনে রাখতে হবে ধর্মের ঊর্ধ্বে দেশ। সে হিন্দুধর্ম হোক, কিংবা ইসলাম, অথবা খৃষ্টধর্ম, যাইহোক না কেন। এটাও মনে রাখতে হবে যে, ধর্ম ও দেশের ঊর্ধ্বে মানবতা। তবে, যথার্থ মানবতা মানে মানব-কেন্দ্রিকতা নয়। যথার্থ মানবতা অন্যান্য প্রাণী, গাছপালা, পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র (ইকোলজি ) এবং প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বশীল।
আর একটি কথা না বললেই নয়। তা হলো এই যে, হিন্দু, মুসলিম, খৃষ্টান সব ধর্মেই , এমনকি সব সমাজেই, ঘৃণ্য পিতৃতন্ত্র ও পুরুষের প্রাধান্য আছে। নারী ও LGBTQIA+ দের ওপর দমনপীড়ন চলে আসছে অবাধে। কোনো মুসলিম মেয়ে বোরখা পরবেন নাকি পরবেন না, কোনো হিন্দু বিধবা আবার বিবাহ করবেন নাকি করবেন না, সেটা তিনিই ঠিক করবেন। কেরালার শবরীমালা মন্দিরে ঋতুমতী হিন্দু মেয়েদেরও প্রবেশের অধিকার থাকা উচিত। ঋতুমতী হওয়াটা কোনো পাপ নয়, এটি নারী শরীরের একটি স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। মসজিদেও মুসলিম মেয়েদের নমাজ পড়ার অধিকার থাকা উচিত। মুসলিম মেয়ে হওয়াটা কোনো অপরাধ বা অপবিত্র ব্যাপার নয়। তিন বার তালাক বলে বিবাহ বিচ্ছেদের যে নিয়ম মুসলিম সমাজে আছে, তা নারীদের পক্ষে অবমাননাকর ও অনৈতিক। এর বিরুদ্ধে মুসলিম নারীদের সংগ্রামকে সমর্থন করতে হবে।
বস্তুত, প্রত্যেকটা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই কিছু ভালো, কিছু মন্দ দিক আছে। কেউ ধোয়া তুলসীপাতা নয়। হিন্দুধর্মের জাতিভেদ প্রথা এক অতি ঘৃণ্য ব্যবস্থা। তথাকথিত নিচু জাত, দলিত, আদিবাসীদের ওপর ভয়াবহ নিপীড়ন তার ফল। যে কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মন্দ দিকগুলো সংশোধনের জন্যে সংস্কার আন্দোলন চাই। হিন্দুদের শবরীমালা হোক, জাতিভেদ হোক, মুসলিমদের মসজিদে মহিলাদের নমাজে বাধা হোক বা তালাক হোক, সংস্কার দরকার। কিন্তু এইসব যে কোনো সংস্কারের দাবি ও সংগ্রাম নিজ নিজ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভেতর থেকে ওঠাটাই সবচেয়ে ভালো।
এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, জনগণের সম্মতি ছাড়াই, অবিভক্ত ভারতের রাজনৈতিক নেতারা মিলে, ইংরেজ শাসকের উসকানিতে, ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ করেছিল। সেটা ছিল মস্তো বড়ো ভুল ও অন্যায়। তার জন্যে নির্মম, অমানবিক মূল্য দিতে হয়েছে এবং আজও হচ্ছে সীমান্তের দুপারের কোটি কোটি নিরপরাধ হিন্দু, মুসলিম,শিখ অসহায় মানুষকে।
এটাও ঠিক যে, পাকিস্তান, বাংলাদেশে হিন্দু, শিখ,খৃষ্টান, শিয়া, আহমদীয়া সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন, মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর, শ্রীলঙ্কায় তামিলদের ওপর, চিনে উইঘুর মুসলিমদের ওপর অত্যাচার তীব্র নিন্দার যোগ্য। (তবে, বাংলাদেশে ইসলামিক মৌলবাদের বিরুদ্ধে কিন্তু সংখ্যালঘু ও সাধারণ মুসলিম জনগণের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম চলেছে) । ১৯৯০ এর দশকে, মুসলিম জঙ্গিদের দ্বারা কাশ্মীরের হিন্দু পন্ডিতদের ওপর ভয়াবহ অত্যাচার ও তাঁদের উৎখাতের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ করতে হবে। ঠিক তেমনি, আজকের দিনে, ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজনের রাজনীতি অতি ভয়ংকর। তাই উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের ধর্মীয় ঘৃণার রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়ে দেবার চক্রান্ত, বাবরি মসজিদ ধ্বংস, গুজরাটের মুসলিম গণহত্যা, দিল্লির সাম্প্রতিক দাঙ্গা, CAA, NRC, NPR এসবের তীব্র বিরোধিতা করা উচিত।
সবশেষে বলব যে, যে কোনো ধর্মীয় সংঘাত, হিংসা, দাঙ্গার ফলে গরীব, শ্রমজীবী শ্রেণীগুলোর, যেমন শ্রমিক, কৃষক, অসংখ্য অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মী, ছোট দোকানদার, সব্জিওলা, ঠেলাওয়ালা, রিকশাওয়ালা, কাজের মাসি, আয়া, অফিসের পিওন, এসব মানুষের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়। তাঁদের ঐক্যও নষ্ট হয়। লাভবান হয় বিশ্বায়িত পু৺জিবাদী ব্যবস্থা, বড়ো বড়ো পু৺জিপতিরা। তাই, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিরোধ সৃষ্টির পেছনে বহু ক্ষেত্রে, তাদের গোপন স্বার্থ ও ষড়যন্ত্র থাকে। এই প্রসঙ্গে একথা বিশেষভাবে বলা প্রয়োজন যে, প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার সংগ্রাম সত্যি সত্যিই সার্থক হতে পারে যখন তার সাথে শ্রেনিগত সংগ্রাম এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার আন্দোলন যুক্ত হচ্ছে। যেমন- দমনকারি শ্রম আইনের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন ট্রেডইউনিয়নগুলির ডাকা সারা ভারত জোড়া ধর্মঘট। যেমন - কৃষক- বিরোধী কৃষি আইনের বিরুদ্ধে লক্ষ লক্ষ কৃষকের সাম্প্রতিক দিল্লি চলো আন্দোলন। কিন্তু সেটা স্বতন্ত্র আলোচনার অপেক্ষা রাখে।