সেলিনা হোসেনের ছোটগল্প : মাতৃত্বের নতুন রূপ

মানুষ হয়েও তারা ‘মানুষ’ নয়, তারা ‘ঊনমানুষ’। আঁতুড়ঘর আর হেঁশেলের গণ্ডীর ভিতরেই তাদের অবস্থান। পিতৃতন্ত্র তাদের রেখেছে ‘অপর’ করে। তোমাদের পক্ষে অমুকটা শোভা পায় না, তমুকটা করলে লোকে ভালো বলবে না— একরাশ ‘না’ তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। তবু কুঁজোরও তো চিত হয়ে শুতে সাধ হয়। এই চাপিয়ে দেওয়া অপরত্বের বেড়া ডিঙিয়ে পা ফেলার স্পর্ধা যুগে যুগে দেখিয়েছে এই ঊনমানুষেরা। তারা নারী। আজ যতটুকু ন্যায্য জমি তারা আদায় করে নিতে পেরেছে, তার পেছনে রয়েছে অনেকদিনের অনেক লড়াই আর যন্ত্রণা। সবচেয়ে মজার কথা হল, তাদের মধ্যে অনেকে বোঝেই না যে তারা তাদের ন্যায্য পাওনাগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের না বলা কথাগুলো বলার জন্য কলম ধরেছেন বহু শুভবোধসম্পন্ন মানুষ। তেমনই একজন মানুষ সেলিনা হোসেন— আজকের সময়ে বাংলা কথাসাহিত্যের আঙিনায় এক অতিপরিচিত নাম। তাঁর ছোটগল্পগুলির মধ্যে বারেবারে দেখা দিয়েছে ‘না’-এর বেড়া ভাঙতে চাওয়া কিছু নারীচরিত্র। তারা প্রশ্ন করে, চিন্তা করে। ‘অমুকটাই নিয়ম’— এটুকু বলে তাদের কণ্ঠস্বর থামিয়ে দেওয়া যায় না। এমনই কিছু ছোটগল্প বেছে নেওয়া হল এই আলোচনার জন্য— ‘মতিজানের মেয়েরা’, ‘পারুলের মা হওয়া’, ‘দেখা’, ‘জেসমিনের ইচ্ছাপূরণ’।

“তুলি শির কহিলা বালক, ‘ভগবন্,/নাহি জানি কী গোত্র আমার। পুছিলাম/জননীরে, কহিলেন তিনি সত্যকাম,/বহুপরিচর্যা করি পেয়েছিনু তোরে,/জন্মেছিস ভর্তৃহীনা জবালার ক্রোড়ে-/গোত্র তব নাহি জানি।।/শুনি সে বারতা/ছাত্রগণ মৃদুস্বরে আরম্ভিল কথা,/মধুচক্রে লোষ্ট্রপাতে বিক্ষিপ্ত চঞ্চল/পতঙ্গের মতো। সবে বিস্ময়বিকল/কেহ বা হাসিল কেহ করিল ধিক্কার/লজ্জাহীন অনার্যের হেরি অহংকার।/উঠিলা গৌতম ঋষি ছাড়িয়া আসন/বাহু মেলি, বালকেরে করি আলিঙ্গন/কহিলেন, অব্রাহ্মণ নহ তুমি তাত,/তুমি দ্বিজোত্তম, তুমি সত্যকুলজাত।”

ছান্দোগ্য উপনিষদের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত অবস্থার হেরফের হয়েছে যৎসামান্য। পিতৃপরিচয়হীন সত্যকামদের সহ্য করতে হয় সমাজের চোখরাঙানি, ভর্তৃহীনা জবালাদের নিয়ে চলে কানাকানি। দৃষ্টিভঙ্গির বদলটুকু সীমাবদ্ধ কেবল সমাজের বিশেষ এক স্তরেই। অভিনেত্রী মাহি গিল অবিবাহিতা এবং এক কন্যাসন্তানের গর্বিতা মা। চিত্রপরিচালক একতা কাপুর সারোগেসির মাধ্যমে জন্ম দিয়েছেন এক পুত্রসন্তানের, তিনিও একজন সিঙ্গল মা। অভিনেত্রী সাক্ষী তনওয়ার ২০১৮ সালে দত্তক নেন ন’মাসের কন্যাসন্তানকে এবং এযাবৎ একাই তিনি তাঁর সন্তানের মা ও বাবার দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর ‘দি হিন্দু’ সংবাদপত্রের এক প্রতিবেদনে পাওয়া গেছে জনৈক আইটি মার্কেটিং প্রফেশনাল শোভনা শেঠির বিবৃতি, “Just because I was not married, didn't mean I couldn't have a baby.” একই প্রতিবেদনে মিলেছে আরও একজন সিঙ্গল মাদারের কাহিনি। অনিন্দিতা সর্বাধিকারী, পেশায় চিত্রনির্মাতা ও থিয়েটারকর্মী জানিয়েছেন তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ নন, একাই আইভিএফ পদ্ধতিতে মা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কই, আমাদের মহান সমাজ তো এই মানুষগুলির দিকে আঙুল তুলতে সাহস পায় না! সমাজের সমস্ত ছি-ছি, ধিক্কারগুলো বরাদ্দ হয়তো সেই ভীতু, কোণঠাসা, নিজের মুখে নিজের ইচ্ছেগুলোর কথা বলতে না পারা অসহায় মেয়েদের জন্য। ঠিক যেন ‘মতিজানের মেয়েরা’ গল্পের গুলনূর। ছেলের জন্মের দেড়বছরের মধ্যে বিধবা হওয়া গুলনূরকে ‘শক্ত মেয়েমানুষ’ হতে হয়েছিল খানিক দায়ে পড়েই। ‘শক্ত’ হতে হতে কবেই যে তার মনুষ্যত্ববোধটি খোয়া গেছে, সে হিসেব গুলনূর রাখেনি। সংসারে পুত্রবধূ মতিজান আসার পর প্রথমে পণের জন্য, পরে বংশরক্ষার অজুহাতে উঠতে বসতে তাকে খোঁটা দিয়েছে গুলনূর। অত্যাচারের সীমা গিয়েছিল ছাড়িয়ে। আসলে এসবই উপলক্ষ্য মাত্র। গুলনূর-রা এমন মানুষ, যারা অপেক্ষাকৃত দুর্বলের ওপর অত্যাচার করতে পছন্দ করে। এ এক অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব— অন্যকে ছোট করে, আঘাত দিয়ে, যন্ত্রণা দিয়ে নিজেকে শক্তিশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ইচ্ছে। রক্ষণশীল সমাজের বেয়াড়া বিধিনিষেধগুলো যারা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার সাহস রাখে, সমাজ বাধ্য হয় সেই জেদের সামনে মাথা নোয়াতে। মতিজান প্রথমে ভয় পেয়েছে গুলনূরকে। কিন্তু দিনের পর দিন কোণঠাসা হতে হতে সে বোঝে তার যে কিছু হারাবার নেই। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ অবিশ্বাস্যভাবে বাড়তি জোর পায়। ‘‘সারারাত ও একফোঁটা ঘুমোতে পারে না। বিছানায় ছটফট করে, মেঝেতে গড়িয়ে নেয়। শান্ত থাকার চেষ্টা করেও পারে না।” তার স্বামী আবুল পরনারী আসক্ত, মাতাল, জুয়াড়ি। মতিজানের দিন এনে দিন খাওয়া বাবা এমন ‘সোনার টুকরো’ জামাইকে ঘড়ি-সাইকেল যৌতুক দিতে পারেননি। সেই ‘অপরাধের শাস্তি’ দেওয়া হচ্ছে মতিজানকে। কীভাবে? চুলের মুঠি ধরে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে, গলায় দড়ি দিয়ে ঘরের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয় মতিজানকে। ‘‘সন্ধ্যায় গুলনূর দড়ি ধরে টেনে ডোবার ধারে নিয়ে গিয়ে বলে, হামি আর তুমহাক ভাত খ্যাওয়াবার প্যারমো না। খ্যাও, খ্যাও, ঘাস খ্যাও।” ধীরে ধীরে সংসারের সারসত্যটা বুঝে ফেলে মতিজান। এ রণক্ষেত্রে কেউ কাউকে একইঞ্চি জমি ছেড়ে দেয় না, নিজের জায়গা নিজেকেই করে নিতে হয়। নাকি কেড়ে নিতে হয়? মতিজান প্রতিবাদ করতে শেখে। সানকিতে রাখা ভাত-তরকারি ছিনিয়ে নিয়ে খেতে থাকে, “হামি তো এই বাড়ির কামের মানুষ। কাম করা ভাত খাই। বস্যা বস্যা ভাত খ্যাই না। হামাক ভাত দেয়্যা ল্যাগবি। মানষে কামের মানষক ভাত দ্যায় না?” মতিজানের প্রতিপক্ষের এ প্রথম পরাজয়। শানানো হয় নতুন অস্ত্র— “তুমহার ছাওয়াল হয় না ক্যানহে?” মতিজানের গাঁজাখোর স্বামীটি এ প্রসঙ্গে অস্বাভাবিকরকম উদাসীন। স্বামীর অশ্রাব্য গালিগালাজ, রাতের পর রাত ভালোবাসাহীন যৌনমিলনে ক্লান্ত, বীতস্পৃহ, অতৃপ্ত মতিজান সাড়া দেয় স্বামীর বন্ধু লোকমানের ডাকে। লোকমানের ঔরসে তার গর্ভে আসে সন্তান, তবু গুলনূর যুদ্ধে ক্ষান্ত দেয় না। গুলনূরের অভিযোগ, মতিজান কেন কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছে? পুত্রসন্তান না হলে যে বংশরক্ষা হয় না! ‘‘বছর ঘুরতে আবার লোকমান, এবারও একটি মেয়ের জন্ম দেয় মতিজান। গুলনূর সাত দিন চুপচাপ থাকে। তারপর ঘোষণা দেয়, যে বউ কেবল মেয়ে সন্তানের জন্ম দেয় তাকে সে সংসারে রাখবে না। ছেলে বাড়ি এলে এই বউকে তালাক দিয়ে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেবে।” যেদিন গুলনূর পাড়ার লোক জড়ো করে এ ‘সাধু’সংকল্পটিকে কাজে রূপ দিতে যায়, মতিজান রুখে দাঁড়ায়। গুলনূর চেঁচিয়ে ওঠে, “আজ থিকা হামার সংসারে তুমহার ভাত ন্যাই। হামি হামার ছাওয়ালোক আবার বিয়া করামো। হামার বংশে বাত্তি লাগবে।” এইবার হাসিতে ফেটে পড়ে মতিজান। চূড়ান্ত বিদ্রূপের সঙ্গে সে প্রকাশ করে তার জীবনের অমোঘ সত্য— “বংশের বাত্তি? আপনের ছাওয়ালের আশায় থ্যাকলে হামি এই মাইয়া দুডাও প্যাতাম না।”

সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর ‘প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ’ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘প্রাচীন ভারতে মাতৃত্ব’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন— “বন্ধ্যাত্বের অপবাদ এড়াবার যে তীব্র বাসনা, সেটি সর্বজনীন ঘটনা। সারা পৃথিবীতে এবং যুগ থেকে যুগান্তরে মেয়েরা পুত্ৰ কামনা করেছে এবং অবন্ধ্যাত্ব ঘোচাবার জন্য তপস্যা করেছে; ব্ৰত পালন করেছে, পূজা করেছে, প্রার্থনা করেছে। ভারতবর্ষে এই ব্ৰতগুলি সময়ের সঙ্গে সংখ্যায় বেড়েছে; পরবর্তী শাস্ত্রগ্রন্থে পুত্রসন্তান ধারণ করা ও প্রসব করার জন্য আরও অধিকসংখ্যক বিধান আছে।” সমাজের চোখে বন্ধ্যা নারী অশুভ, বন্ধ্যা পুরুষ কেন অশুভ নয় সে প্রশ্নের উত্তরে সমাজ কিন্তু নিশ্চুপ থেকেছে। প্রাচীনকাল থেকে মেয়েদের আসলে ‘গর্ভ’ ছাড়া কিছু ভাবাই হয়নি। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, মৃগীরোগের কথা— যার ইংরেজি নাম হিস্টিরিয়া, ‘হিস্টিরিয়া’ শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘হিস্টেরা’ থেকে, যার অর্থ জরায়ু! একসময় মনে করা হত, রোগটা শুধু মেয়েদেরই হয়। মেয়েদের রোগ বলে ‘গর্ভ’ সম্পর্কিত একটা শব্দে রোগের নাম রেখে দেওয়া হল। নারী কেবল সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র— সন্তান প্রসব ছাড়া তাদের আর কোনও কাজ থাকতে পারে না। যে নারী এ কাজে পারদর্শিতা দেখাতে অক্ষম, সে সমাজের কোনও উপকারেই আসবে না— এমনটাই ধরে নিয়েছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। কিন্তু কেন এমনটা হল? উত্তর খানিকটা মেলে সুকুমারী ভট্টাচার্যের লেখায়। যাযাবর জীবন ছেড়ে মানুষ বসতি স্থাপন করল, নিজের নামে জমিজমা রাখতে শুরু করল। এরপর প্রশ্ন উঠল, সে মারা গেলে তার কষ্টে সঞ্চিত জমিগুলোর কী গতি হবে? অতএব, আনো উত্তরাধিকারী। সে উত্তরাধিকারী অবশ্যই হবে তার নিজের ঔরসজাত পুত্রসন্তান। পুত্রসন্তান ধারণ করবে মেয়েরা। সন্তানটি যথার্থই পুরুষটির ঔরসজাত তা সুনিশ্চিত করতে বসে গেল মেয়েদের ওপর নানান বিধিনিষেধ। কারণ, পরের ঔরসজাত সন্তানকে তো আর নিজের শ্রমে সঞ্চিত বিষয়আশয় ভোগ করতে দেওয়া যায় না! সুতরাং, যে যার সন্তানের মা’টিকে ‘চোখে চোখে’ রাখো, সে যেন কোনওভাবেই পরপুরুষের শয্যাসঙ্গিনী না হতে পারে। নিতান্তই কোনও পুরুষ ‘বন্ধ্যা’ হলে, রয়েছে নিয়োগপ্রথা, যার অজস্র উদাহরণ ছড়িয়ে আছে পুরাণে, মহাকাব্যে। এক্স ক্রোমোজোম-ওয়াই ক্রোমোজোমের তত্ত্ব ছিল অজানা, পুত্রসন্তানের বদলে কন্যাসন্তান জন্মালে দোষ চাপানো হত মায়েরই ওপর। পিতৃতন্ত্র বেশ সুচারুভাবে তাদের চিন্তাগুলো ঢুকিয়ে দিয়েছে মেয়েদের মনে। যার ফলে মেয়েরাই হয়ে উঠেছে একে অপরের শত্রুস্থানীয়। ‘মতিজানের মেয়েরা’ গল্পে গুলনূরও একজন মেয়ে, মতিজানও এক মেয়ে। মতিজানের গর্ভে সন্তান এলে গুলনূর ‘বাঁকা চোখে তাকিয়ে রূঢ় কণ্ঠে বলে, মাইয়া ছাওয়াল বিয়াবার পারব্যা না।’ কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠ হলে গুলনূর আরও বেশি হিংস্র হয়ে ওঠে। ‘মতিজান ভেতরে ভেতরে শক্ত হয়ে বলে আমি পারলে শত মেয়ের জন্ম দিতাম।’

মতিজানের মতোই আরও এক মেয়ে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের মুখের ওপর। সে হল পারুল বেগম। সেলিনা হোসেন অত্যন্ত সচেতনভাবেই গল্পের নাম রেখেছেন, ‘পারুলের মা হওয়া’। মা তো কত মেয়েই হয়, কিন্তু এই মেয়েটির কাহিনী একটু আলাদা। তার স্বামীটি কোনও এক অজ্ঞাত কারণে তাকে ফেলে রেখে পালিয়ে গিয়েছে। পারুল ভেবে কূলকিনারা পায় না, কেন তার ‘সামাজিকভাবে কবুলপড়া স্বামী’ এমন কাজ করল। নিজেকেই সে প্রশ্ন করে, তার প্রয়োজন কেন ফুরলো? দেওয়ার মতো ‘শরীর’ তো তার ছিল। তবু কেন তাকে না বলে পালিয়ে গেল? যেতে চাইলে সে তো জোর করে ধরে রাখতো না। অপমানবোধের জ্বালা তাকে কুরে কুরে খেতে থাকে। অন্য কোনও সাধারণ মেয়ে হলে হয়তো দুটো দিন বিলাপ করে নিয়তিকেই মেনে নিত, হয়তো বা অন্য কোনও পুরুষকে অবলম্বন করে ফের জীবনখানা সাজিয়ে নিত, যে সাজ সমাজের চোখে ‘শোভনীয়’, যে সাজে সমাজের ‘সায়’ আছে। পারুল একদিন শুনতে পেল তার স্বামীটি অন্য এক নারীকে বিয়ে করে সংসার পেতেছে। বুকের ভেতরটা পুড়ে গেলেও হেসে বলে, ‘ভালই কইচ্ছে।’ পারুলও নিজের জীবন বইয়ে নিয়ে যায় অন্য খাতে। পারুল একদিন গর্ভবতী হয়। ‘স্বামী ছাড়া মা হওয়া ভাল না মন্দ এ বোধ ওর মনেই আসে না। মা হয়েছে শুধু এই বোধ ওকে সম্পন্ন মানুষ করে দেয়’। তারার মায়ের বাঁকাচোখের প্রশ্নে সে সপাটে জবাব দিয়েছে, ‘প্যাড হইতে স্বামী লাগেনি’! সন্তানের পিতৃপরিচয় সে দিতে চায়না, ‘‘বাপ লাউগব কীয়ের লাই। আঁই বাপ, আঁই মা।’’ প্রসঙ্গত মনে করা যেতে পারে, বুদ্ধদেব বসু’র কাব্যনাট্য ‘প্রথম পার্থ’টির কথা। সে কাব্যনাট্যে কর্ণ চরিত্রটির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে একই সুর— “আমার মনে হয় মাতা একাই সন্তানের জন্ম দেন,/আমার মনে হয় আমরা সকলেই কুমারীর সন্তান—/পিতা শুধু উপলক্ষ— গোত্রচিহ্ন।” সেলিনা হোসেনের পারুল বেগমও সগর্বে বলেছে, “আঁই হোলাহান মানুষ কউরুম। ভাত দিউম, কাপড় দিউম, বাপ দি করিউম কী? ওই তো আইতনরে স্বামী দু’গা হোলামাইরা থুই ভাগি গেছে। কী অইছে? বাপ ধুই হানি খাইবনি? যেগুনের বাপ নাই হেগুন মানুষ হয় না?” মালেকা বেগম— বাংলাদেশের নারীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম একজন পুরোধা। ২০০৬ সাল নাগাদ একটি সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, এতদিন সন্তানের অভিভাবক হওয়ার অধিকার মায়েরা পেতেন না। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এখন মায়েদের অভিভাবক হওয়ার কথাও ঘোষণা করেছে। পারুলকে কি যুদ্ধ করতে হয়নি? সমাজ তেড়ে এসেছে, চোখা চোখা বাক্যবাণে বিদ্ধ করেছে। পারুল কিন্তু নতিস্বীকার করেনি। এইখানে উল্লেখযোগ্য, পারুল কিন্তু স্বাবলম্বী। সে রাস্তায় মাটি কাটার কাজ করে, কাজের বিনিময়ে গম পায়। পারুলকে তাই খাওয়াপরার জন্য কারওর ওপর নির্ভরশীল হতে হয় না। সে স্বামীর অবর্তমানে নিজের পেটটুকু অনায়াসে চালিয়ে নিতে পারে, সন্তানের ভরণপোষণেও তার কোনও সমস্যা হবে না। পারুলের জেদ, আত্মবিশ্বাস, যুক্তির কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছে তার সমাজ। দু’চারটি সন্তানসহ স্বামী পরিত্যক্তা মেয়েগুলি তাকে ‘গোপনে’ বাহবা দিয়েছে— “ভালা কইচ্ছছ। আমরা ময়মুরুব্বির ডরে কথা কইতাম হারি না।” লুকিয়ে কেউ খাবার দিয়ে যায়, কেউ বা উপহার দিয়ে যায় ছেঁড়া শাড়ি। সমাজ ক্রমে ক্রমে নিশ্চুপ হলেও পারুলের ঘরে রাতের অন্ধকারে আসতে থাকে একের পর এক পুরুষ, যারা কোনও না কোনও সময়ে পারুলের সঙ্গী হয়েছে। তাদের সবার প্রশ্ন একটাই, ‘পোলাডার বাপ কি আঁই?’ পারুল বোঝে, “পুরুষ মানুষগুলো পিতৃত্বের কর্তৃত্ব চায়। আর কিছু না সন্তানকে লালন-পালন নয়— ওকে নিজের কাছেও নেবে না— প্রকাশ্যে পরিচয় দিতে স্বীকারও করবে না। শুধু জেনে আনন্দ পেতে চায় যে পারুলের গর্ভে তারই সন্তান।” বলাই বাহুল্য, পারুল সেই আনন্দ কাউকেই দেয়নি। তার সোজাসাপটা যুক্তি, “আমি তো শরীরের কেনাবেচা করি না। আমি কারও কাছে টাকা চাই না— এটা আমার ব্যাবসা না। আমি নিজের আনন্দের জন্য ভোগ করি— যাকে খুশি তাকে— যখন ইচ্ছে হয় তখন।... ওরা কে, যে সন্তানের কর্তৃত্ব জানতে চায়?... কেউ জানবে না আমি কার সন্তানের মা— শুধু আমি, শুধু আমিই ঈশ্বর।”

দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার ২০১১-র ইদসংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল সেলিনা হোসেনের একটি ছোটগল্প— ‘দেখা’। ইসলামধর্মে বিশ্বাস করা হয়, সন্তান আল্লাহর দেওয়া উপহার। দিনমজুর রহমত আলি আজ খেতে পেলে কাল কী খাবে ভেবে দিশেহারা হয়, সে আল্লাহর উপহারে ঘর ভরিয়ে ফেলেছে! তার মেয়ে আটবছরের মোমেনাকে সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ‘‘ধৈর্য ধরো মা, ধৈর্য ধরো। পেট ভরা ভাত দিব একদিন।” আট পেরিয়ে মোমেনা এগারোতে পড়েছে, ঘরে বেড়েছে খাওয়ার মুখ, ভাতের অভাব তাদের ঘোচেনি। বছর বছর আঁতুড়ঘরে ঢোকার ফলে মা আমেনার শরীর গেছে ভেঙে, সংসারের সব কাজ গিয়ে পড়েছে ছোট্ট মোমেনার ঘাড়ে। ‘সংসারে আর একটি বাচ্চা আসবে ভেবে ওর বুক ভার হয়ে যায়।’ অতটুকু মেয়ে তার বাস্তববোধ থেকে প্রশ্ন তুলতে পারে, ‘‘আমাদের ঠিকমতো ভাত নাই। আবার একজন!’’ ছোটভাইটি জন্মালে সে লুকিয়ে কাঁদে। শৈশব, কৈশোরের সমস্ত আনন্দ তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে— “অনেক কাজ! কেবল কাজ! আমি খেলব না?” পরপর সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্য মা আমেনা মনে মনে গালি দেয় তার স্বামীকে, “রাতের বেলা লোকটা একটা দস্যু হয়। মরণ, মরণ!” মোমেনা বড় হয়। একদিন তার মায়ের মনে হয়, মোমেনার বিয়ে দেওয়া দরকার। কারণ, সংসার থেকে ‘খাওয়ার মুখ’ কমাতে হবে। আল্লাহর ‘উপহার’গুলি যে এখন তাদের ‘গলার কাঁটা’! দিনমজুরের মেয়ে মোমেনার বিয়ে হয় এক দিনমজুরের সঙ্গেই। বিয়ের আগে বাবা রহমত আলি তাকে বলেছিল, “সংসার করার সময় মনে কোনও দুঃখ রাখবে না মা।” মোমেনা জিজ্ঞাসা করেছিল, “ভাতের দুঃখ বাজান?’’ জবাবে সে শুনেছিল, ভাতের দুঃখটি তার জীবনে ধ্রুবক। মোমেনা বলে, “না বাজান, আমার এখন আর ভাতের দুঃখ নাই। পেটে সব সয়ে গেছে।” স্বামী জমিরের সঙ্গে সংসার পাতে মোমেনা।

“মোমেনা ঘরে ঢুকে মুখ খোলে।

 জিনিসটা কই?

 আছে।

 দাও। খাই।

 পানি?

 পানি তো সাঁঝের আগেই এনে রেখেছি।

 জমির অবাক হয়ে বলে, আমি তোমার মতো পিলের কথা ভাবি নাই বউ। তোমার এত বুদ্ধি।

 আমি মাকে দেখেছি। মায়ের মতো বোকা হব না।

 তুমি কয়টা সন্তান চাও?

 দুইটা।

 তাই সই। জমির খুশি হয়ে বলে। বেশি নিয়ে লাভ নাই। কেবল কষ্ট।”

দিনমজুরের মেয়ে মোমেনার স্কুলে পড়া হয়ে ওঠেনি, ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের গুরূত্ব সে বুঝেছে নিজের জীবন থেকেই। প্রায় বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পাশ্চাত্যে গর্ভনিরোধক ওষুধ বা contraceptive pill খাওয়াটা কিন্তু সহজ ছিল না। প্রথমত, রোমান ক্যাথলিক চার্চ মেয়েদের এ ধরনের ওষুধ খাওয়া সমর্থন করত না। দ্বিতীয়ত, ১৯৫০-এ আবিষ্কৃত হলেও এই ওষুধগুলি  'licensed drug' ছিল না। দশবছরের বেশি সময় ধরে বহু লড়াই, বহু বিতর্কের পর American Food and Drug Administration (FDA) গর্ভনিরোধক বড়িকে বৈধতা দেয়। একজন মেয়ে সন্তানের জন্ম দেবে কিনা সেটা সে নিয়ন্ত্রণ করবে, অন্য কেউ নয়— এই সহজ কথাটুকু বুঝতেই এতগুলো বছর লেগে গেছে। ২০১১ সালে লেখা এই ছোটগল্পে আমরা পাচ্ছি মুসলিম সমাজের দারিদ্র্যপীড়িত এক মেয়ের আধুনিক ও বাস্তবসম্মত ভাবনা, যে প্রচলিত অন্ধবিশ্বাসের বেড়াজাল ভেঙে বেরিয়ে এসে তার আগামী প্রজন্মকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন দিতে আগ্রহী।

সেলিনা হোসেনের সৃষ্টি আরও একজন অন্যরকম নারীচরিত্র জেসমিন। ২০০৬ সালে লেখা ছোটগল্প ‘জেসমিনের ইচ্ছাপূরণ’— সমাজকে দাঁড় করায় আরও এক জটিল প্রশ্নের সামনে। চোদ্দবছরের কিশোরী জেসমিনের বিয়ে হয় এক লোকের সঙ্গে, গাঁজা-জুয়ার পাশাপাশি যার অন্যতম শখ ছিল কয়েকমাস অন্তর নতুন নতুন বিয়ে করা। জেসমিন সে লোকের পাঁচনম্বর স্ত্রী! বিয়েতে খুশি না হলেও সংসার করায় তার আপত্তি ছিল না। কিন্তু বিয়ে হওয়া ইস্তক স্বামী, শাশুড়ি, জা— কারওর ভালোবাসা, সহানুভূতি মেয়েটি পায়নি। যে বয়েসে মেয়েরা পুতুল খেলে, স্কুলে যায়, সে বয়েসে মেয়েটির বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। হ্যাঁ, বিয়ে ‘দেওয়া’ হয়েছে! সে বিয়ে ‘করেনি’। মাত্র চোদ্দবছর বয়েসে ‘শরীর’ কী, তা বোঝার মানসিকতা তখনও জেসমিনের তৈরি হয়নি। তার মধ্যেই তাকে মা হতে হয়েছে। সেই অবস্থাতেও শারীরিক অত্যাচারের (পড়ুন, বৈবাহিক ধর্ষণ) হাত থেকে তার রেহাই মেলেনি। এমনকি সন্তানপ্রসবের দিনও সে কাউকে পাশে পায়নি। সারাদিন না খেয়ে পড়ে থেকে পেটে তার অসহ্য যন্ত্রণা। জা’কে বলেকয়ে খানিকটা গরম ভাতের ব্যবস্থা করলেও সে ভাত আর তার মুখে ওঠেনি। ‘দুই মুঠা রোজগার করতে পারে যে খাইতে চায়? যাও পাতিলে দুপুরের ভাত আছে ওইটা দিয়ে আসো’— শাশুড়ির হুকুমে জেসমিনকে দেওয়া হয় ঠান্ডা বাসি ডাল-ভাত। পেটের যন্ত্রণায় দিগ্বিবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে জেসমিন সে বাসি ভাতের থালা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। প্রবল ব্যথায় চিৎকার করতে করতে সে সন্তান প্রসব করে। অভিজ্ঞ কোনও মানুষ সে সময়ে তার কাছে ছিল না, কী করলে কী হতে পারে জেসমিন জানতো না। নাভিরজ্জুটি ধরে জোরে টান দেওয়ার ফলে তার জরায়ুটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর মেয়েটি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। রাস্তার কুকুর বিড়ালও হয়তো এতটা কষ্ট পায় না। মাসছয়েক পর জেসমিনের পতিদেবতাটি ছ’নম্বর বিয়ে করে এবং জেসমিন তার ছেলেটিকে নিয়ে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। শুরু হয় তার একক সংগ্রাম। প্রথম মাতৃত্বের অভিজ্ঞতা তার কাছে ভয়াবহ, তাই ইচ্ছে হলেও সে পারেনি নতুন করে কাউকে জীবনের সঙ্গী করে নিতে। ‘দুঃখ পায় এই ভেবে যে, শরীরের সুখ ওর নিজের মতো করে পাওয়া হল না। ছেলেটা বড় হয়েছে, কোনও কোনও মানুষের আচরণ দেখে রাতের বেলা কেঁদে বুক ভাসিয়ে বলেছে, মা তুই বিয়ে করবি না, তুই না থাকলে আমি কার কাছে থাকব?’ পরিস্থিতি আরও জটিল হল, যখন জেসমিন জানতে পারল তার ক্ষতিগ্রস্ত জরায়ুটি কেটে বাদ না দিলে সে আর বাঁচবে না। অপারেশনের জন্য চাই অর্থের সংস্থান। ভরসা এই, পৃথিবীটা শুধুই খারাপ মানুষে ভর্তি নয়। জেসমিনকে বাঁচাতে হাত বাড়িয়ে দিলেন জেবুন্নাহার, যাঁর বাড়িতে জেসমিন পরিচারিকার কাজ করে। ডাক্তার মুনিরা, জেবুন্নাহার দুজনেই জেসমিনকে প্রশ্ন করে, জরায়ু বাদ দেওয়ায় তার সম্মতি আছে কিনা। সম্মতি? জেসমিন যে আর মা হতেই চায় না। অপারেশনের পর জেসমিন বলে, ‘‘আজ থেকে আমি স্বাধীন।’’ কারণ তার যে আর মা হওয়ার ভয় নেই— ‘‘এই জীবনে যা কিছু পাইনি, তার সব এখন আমার চাই। আমার সব ইচ্ছা পূরণ হবে। হাঃ আমি আর মা হব না।”

 

উৎসের সন্ধানে

 

১) পঞ্চাশটি গল্প: সেলিনা হোসেন’, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, প্রথম সংস্করণ জানুয়ারি ২০১৪, দ্বিতীয় মুদ্রণ জানুয়ারি ২০১৯

২) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিত্রা কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘ব্রাহ্মণ’ কবিতাটির শেষ তিন স্তবকের কিয়দংশ

৩) https://www.thehindu.com/society/meet-the-choice-mothers-single-women-whove-opted-for-parenthood-without-a-partner/article29920954.ece

৪) সেলিনা হোসেন, ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত ‘মতিজানের মেয়েরা’ গল্পগ্রন্থ

৫) সুকুমারী ভট্টাচার্য, প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ,

৬) বুদ্ধদেব বসু, ‘অনাম্নী অঙ্গনা ও প্রথম পার্থ: দুটি কাব্যনাট্য’, দে’জ পাবলিশিং, প্রথম প্রকাশ: নভেম্বর ১৯৭০, প্রথম দে’জ সংস্করণ: কলকাতা পুস্তকমেলা জানুয়ারি ১৯৯১, পুনর্মুদ্রণ: নভেম্বর ২০১৭, পৃষ্ঠা ৯১

৭) আফরোজা খাতুন, ‘বাংলা কথাসাহিত্যে মুসলিম অন্তঃপুর’, দে’জ পাবলিশিং, প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০১১, পৃষ্ঠা ২৪৬

৮) The Qur'an does not specifically refer to contraception or family planning, but in verses forbidding infanticide, the Qur'an warns Muslims, “Do not kill your children for fear of want." "We provide sustenance for them and for you” (6:151, 17:31). Some Muslims have interpreted this as a prohibition against contraception as well, but this is not a widely accepted view.

— 'The View of Contraception and Abortion in Islam', Learn Religions, April 27, 2019.

Source: https://www.learnreligions.com/contraception-in-islam-2004440