যুগসন্ধিক্ষণে দুই প্রজন্মের দ্বন্দ্বের আখ্যান : তুর্গেনিভের পিতা পুত্র

শেলি, কিটস, বায়রনদের প্রায় সমসাময়িক পুশকিনের জন্ম হয় ১৭৯৯ সালে এবং উনিশ শতকের বিশের দশক থেকেই তাঁর কবিতা, আখ্যান ও নাটকগুলি জনপ্রিয় হতে শুরু করে। রাশিয়ার বাইরেও পৌঁছয় পুশকিনের খ্যাতি। প্রায় সকলেই এখন পুশকিনকে আধুনিক রুশ সাহিত্যের প্রথম দিকপাল বলে মনে করেন। পরবর্তী দিকপাল নিকলাই গোগলের জন্ম পুশকিনের দশ বছর পরে, ১৮০৯ সালে। তিনিই ছিলেন নয়া রুশ বাস্তবতাবাদী সাহিত্যের অগ্রদূত। গোগলের ওভারকোট নামক সাড়া জাগানো গল্পটিকে লক্ষ্য করেই শুধু নয়, সামগ্রিক সাহিত্যে প্রতিফলিত বাস্তবতার কথা মনে রেখেই দস্তয়েভস্কি বলেছিলেন যে তাঁরা সকলেই জন্ম নিয়েছেন গোগলের ওভারকোট থেকে। ছোটগল্প ও নাটক – উভয়ক্ষেত্রেই বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়েছেন তিনি। এরপরেই পরপর আবির্ভাব ঘটে রুশ তথা বিশ্ব উপন্যাস সাহিত্যের তিন মহারথীর। ১৮১৮ তে জন্ম হয় ইভান তুর্গেনিভের, ১৮২১ এ দস্তয়েভস্কির আর ১৮২৮ এ তলস্তয়ের। এঁদের চিরায়ত সাহিত্যকীর্তিগুলি যখন প্রকাশিত হচ্ছে তখনই জন্ম হয় পরবর্তীকালের আরো তিন জ্যোতিষ্ক চেকভ (১৮৬০), গোর্কি (১৮৬৮) ও ইভান বুনিনের (১৮৭০)।  রুশ বিপ্লবের মূল কাণ্ডারী লেনিনের জন্মও ১৮৭০ এ।

১৮৫০ ও ৬০ এর দশকে একদিকে তুর্গেনিভ, দস্তয়েভস্কি আর তলস্তয় এর ক্লাসিকসগুলি একের পর এক প্রকাশিত হচ্ছে আর অন্যদিকে রাশিয়ার সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে চলছে উথালপাতাল। রাশিয়ায় দীর্ঘদিন যাবৎ প্রচলিত ভূমিদাসপ্রথাকেই রাশিয়ার পক্ষে সবচেয়ে খারাপ ও দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার বলে প্রগতিশীলেরা এক বাক্যে রায় দিয়েছিলেন। রাশিয়ায় প্রায় পাঁচশো বছর ধরে, তৃতীয় ইভানের (১৪৪০-১৫০৫ সাল) আমল থেকেই চালু ছিল জারের শাসন। রাশিয়ান সম্রাটরাই জার নামে পরিচিত ছিলেন। দেশের অধিকাংশ ভূমি এবং সম্পদ জার, তার পরিবার ও অনুচরদের হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল। আর কোটি কোটি জনসাধারণ বাস করত উপযুক্ত শিক্ষা চিকিৎসা বাসস্থান খাদ্য বিশ্রাম বিহীন অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টের মধ্যে। ইউরোপের অন্যান্য দেশের স্বৈরতন্ত্রগুলির চেয়েও রাশিয়ার অবস্থা ছিল খারাপ। ১৯০৫ সালের বিক্ষোভ আন্দোলন পর্বের আগে পর্যন্ত রাশিয়ায় কোনও সংবিধান বা (এমনকী রাজতন্ত্র নিয়ন্ত্রণাধীন) সংসদীয় ব্যবস্থার চিহ্নটুকু পর্যন্ত ছিল না। রাজনৈতিক ক্ষমতার পাশাপাশি ধর্মীয় বিষয়ের কর্তৃত্বও ছিল জারের হাতে।

জার শাসনের কোনও কোনও পর্বে অবশ্য কিছু কিছু সংস্কার হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে জার পিটার দ্য গ্রেট এর আমল (১৬৮২ থেকে ১৭২৫) এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে রাশিয়া এইসময় সাংস্কৃতিকভাবে অনেকটা কাছাকাছি আসে। মস্কো থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সেন্ট পিটার্সবার্গে এবং নতুনভাবে একে গড়ে তোলা হয়। এই আমলে পুরনো মধ্যযুগীয় অনেক ধ্যান ধারণাকে সরিয়ে দিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানচিন্তার প্রসার হয়। এই সংস্কার অব্যাহত থাকে ক্যাথরিন দ্য গ্রেট এর আমলেও (১৭৬২ থেকে ১৭৯৬)।

কিন্তু জার প্রথম নিকোলাসের শাসন ছিল গণতন্ত্রের নানা প্রশ্নে রাশিয়ার জন্য এক বিভীষিকা। দীর্ঘস্থায়ী এই আমলে (১৮২৫ থেকে ১৮৫৫) রুশ সাম্রাজ্যের বিকাশ বা অর্থনীতির প্রসার হলেও রাশিয়া স্বৈরতন্ত্রের কড়া অন্ধকারে ডুবে যায়। তাঁর শাসনের শুরুতেই সেনা অফিসারদের নেতৃত্বাধীন ডিসেমব্রিস্ট আন্দোলন দাবি তুলেছিল রাশিয়ায় একটি সংবিধান ও প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র থাকুক। এই আন্দোলনকে নির্মমভাবে দমন করার মধ্যে দিয়ে নিকোলাসের শাসন শুরু হয় এবং পরবর্তীকালে সমস্ত বিরোধী মতকেই নৃশংসভাবে দমন করা হয়। ১৮৪৮ সালের প্যারিসের ঘটনাবলী জার শাসনকে আতঙ্কিত করেছিল এবং রাশিয়ার মধ্যেকার যে কোনও ধরনের প্রগতিশীল চক্রকে সন্দেহের চোখে দেখা শুরু হয়। ১৮৪৯ সালের তথাকথিত পেট্রাসেভেস্কি ষড়যন্ত্রর সূত্র ধরে ২ এপ্রিলের পর থেকে শুরু হয় ব্যাপক ধরপাকড়। ৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তার মধ্যে দস্তয়েভস্কি সহ একুশজনের প্রাণদন্ডের আদেশ হয়। পরে অবশ্য প্রাণদন্ড মকুব করা হয়, তবে বিভিন্ন সময়ের কারাবাস অব্যাহত থাকে। ১৮৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মস্কোতে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে গোগলের অকাল মৃত্যুর পর তিনি খবরের কাগজের জন্য গোগলের স্মৃতিতে একটি লেখা লেখেন।  গোগল ছিলেন জার শাসনের ব্যঙ্গাত্মক সমালোচনার জন্য প্রখ্যাত। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে নানা সমালোচনায় বিদ্ধ হয়ে তাঁর ডেড সোলস এর দ্বিতীয় খণ্ডর পাণ্ডুলিপি আগুনে ছুঁড়ে দেন তিনি, মারাত্মক মানসিক যন্ত্রণায় মনোকষ্টে অনশন শুরু করেন। অনশন থেকেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে – এই খবর দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে রাশিয়া জুড়ে। এর প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তীব্র এবং তুর্গেনিভের লেখাটিতেও তার ছাপ ছিল। সেন্ট পিটার্সবার্গের কাগজে এটি সেন্সর করা হলেও পরে মস্কো থেকে একটি সংবাদপত্রে এটি প্রকাশিত হয় ১৩ মার্চ, ১৮৫২ তে। এরপরেই ১৬ মার্চ তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রথমে একমাস তিনি কারাবন্দী থাকেন, তারপর অনেকদিন গৃহবন্দী অবস্থায় কাটাতে বাধ্য হন।

জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের (১৮৫৫ থেকে ১৮৮১) আমলের প্রথম দিকে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে (১৮৫৩ থেকে ১৮৫৬) রাশিয়ার শোচনীয় পরাজয় ঘটে এবং ক্রমশ জনপ্রিয়তা হারাতে থাকা জার শাসন আরো অনেকটা বে আব্রু হয়ে যায়। তলা থেকে বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে প্রশমিত করার জন্য ওপর থেকে কিছু সংস্কারের কথা ভাবা হয়। শুরু হয় বহু আলোচিত ভূমিদাস প্রথার বিলুপ্তি (১৮৬১)। ভূমিদাস প্রথার বিলুপ্তি অবশ্য জনগণের জীবনের মূল সমস্যাগুলি সমাধান করতে ব্যর্থ হয়। ওপর থেকে লোকদেখানো সংস্কার স্বত্ত্বেও ভালো ভালো জমিগুলো সবই জমিদারদের হাতে থেকে যায়। কৃষকদের হাতে আসে সামান্য কিছু পতিত বা অনুর্বর জমি। এর সঙ্গেই ছিল চাষীদের জমিতে আবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা। অনুমতি না নিয়ে চাষীরা এলাকা ত্যাগ করতে পারত না।

জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের আমলের আগে থেকেই রাশিয়া একের পর এক কৃষক বিদ্রোহে আলোড়িত হচ্ছিল। ১৮৫০ থেকে ১৮৬০ এর মধ্যে রাশিয়া জুড়ে প্রায় আটশো কৃষক বিদ্রোহ হয়। ১৮৩৫ থেকে ১৮৬১ র মধ্যে বিদ্রোহীরা দুশো তিরাশি জন জমিদার বা কুলাককে হত্যা করে। এই বিদ্রোহের পুরোভাগে ছিল নারোদনিক বা জনগণের বন্ধুরা। রাশিয়ায় সামন্ততন্ত্রের দ্রুত অবক্ষয় দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু তার জায়গায় আধুনিক পুঁজিবাদ তখনো সেভাবে বিকশিত হয়ে ওঠে নি। ছাত্রযুব এবং জনগণের প্রগতিশীল অংশ সামন্ততন্ত্র এবং জার শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ছিল এবং তা প্রায়শই ব্যক্তিহত্যার পথ বেছে নিত। এই সময়েই রাশিয়ায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে পুরনো সমস্ত কিছুকে নির্মমভাবে অস্বীকারের এক মতাদর্শ, যা নিহিলিজম নামে পরিচিত হয়।

রুশ নিহিলিজমের প্রতিনিধিস্থানীয় চরিত্র হিসেবে বিখ্যাত হয়ে আছে তুর্গেনিভের পিতা পুত্র উপন্যাসের বাজারভ। উপন্যাসের শুরুতে আমরা দেখি এক জমিদার নিকলাই কির্সানভ অপেক্ষা করছেন তাঁর পুত্র আর্কাদির জন্য। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছুটিতে পারিবারিক খামারে আসে। আর্কাদি সঙ্গে করে নিয়ে আসে তাঁর সহপাঠী বন্ধু ডাক্তারির ছাত্র বাজারভকে। বাজারভ শুরু থেকেই তাঁর চমকপ্রদ কথাবার্তা ও ধ্যান ধারণা দিয়ে যে কোনও কারোর ওপর প্রভাব বিস্তারে সক্ষম। বস্তুত আর্কাদি ও অন্যান্য বন্ধুবান্ধবেরা তাঁকে গুরুর আসনেই প্রায় বসিয়ে রেখেছে। পুত্রবন্ধু এই কড়া ধাঁচের যুবকটিকে জমিদার নিকলাই বেশ সম্ভ্রমের চোখেই দেখেন কিন্তু তাঁর দাদা, এক সময়ের মিলিটারি অফিসার ও উচ্চকোটির সমাজে সাড়া জাগানো মানুষ পাভেল কির্সানভ কথায় কথায় তাঁর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। বস্তুত কথার দ্বন্দ্বে তাঁদের ঠোকাঠুকি একবার ভোরবেলার ডুয়েল অবধি পৌঁছে যায়। বাজারভ অক্ষত থাকলেও গুলি ছুঁয়ে যায় পাভেলের হাঁটু, রক্তক্ষরণ ও ক্ষত নিয়ে কদিন বিশ্রামেও থাকতে হয় তাঁকে।

পিতা পুত্র উপন্যাসটি প্রসঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আলোচকেরা দুটি প্রজন্মের দ্বন্দ্বের কথা তুলেছেন। একটি হল নিকলাই বা পাভেল কির্সানভদের চল্লিশের প্রজন্ম এবং একটি হল বাজারভ, আর্কাদিদের ষাট এর প্রজন্ম। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি এক বক্তৃতায় নতুন জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার ভূমিদাস প্রথা অবসানের কথা ঘোষণা করেন এবং ধীরে ধীরে তার বাস্তবায়নের জন্য গোটা রাশিয়া জুড়ে অসংখ্য কমিটি তৈরি করেন। ষাটের দশকের শুরুতে ভূমিদাস প্রথার অবসান ঘটে এবং লক্ষ লক্ষ রুশ ভূমিদাস মুক্তি পায়। কিন্তু দুই প্রজন্মের যে বিতর্কের কথা বলা হয়, তা শুধু ভূমিদাস প্রথার অবসানকে দেখার প্রশ্নে সীমাবদ্ধ ছিল না। ছিল রাশিয়ার সার্বিক পরিবর্তনের প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে অসংখ্য বিষয়কে বিচারের দৃষ্টিকোণের সঙ্গে। বস্তুতপক্ষে পিতা পুত্র উপন্যাসে যে দুই ধরনের মানুষদের তুর্গেনিভ হাজির করেছেন, তারা কেউই ভূমিদাস প্রথার অবসানের বিরোধী নয়। বাজারভদের মতো রাডিক্যালরা তো বটেই, এমনকি নিকলাই বা পাভেল কির্সানভদের মতো লিবারাল হতে চাওয়া জমিদারকুলও এর বিরোধী নন। বড়জোর এর রূপায়ণ কমিটির কার্যকলাপ প্রসঙ্গে ক্ষেত্রবিশেষে খানিক উদাসীন। যারা ভূমিদাসপ্রথার তীব্র বিরোধী, সেই রক্ষণশীলদের কোনও প্রতিনিধিত্ব পিতাপুত্র উপন্যাসে তুর্গেনিভ রাখেন নি।

মতাদর্শ ও জীবন দর্শনের প্রশ্নে, নানা কিছু বিচারের দৃষ্টিকোণ নিয়ে পিতা ও পুত্রদের প্রজন্মের দ্বন্দ্ব এই উপন্যাসে বারবার হাজির হয়েছে। কিন্তু এর পাশাপাশি এটাও আমাদের বিশেষভাবে নজরে আসে যে এই মতাদর্শের দ্বন্দ্ব পরিবারের ভেতরে তাঁদের ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতির বিনিময়ের ক্ষেত্রে বড় কোনও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না। পিতারা – তা সে আর্কাদির পিতা নিকলাই ই হোন বা বাজারভের পিতা ভাসিলিই হোন – তাঁদের পুত্রদের প্রতি বাৎসল্যে ভরপুর। বাহ্যত খানিক ঔদাসিন্য বা মতপার্থক্য সত্ত্বেও আর্কাদি, এমনকি বাজারভও তাঁর পিতার প্রতি আবেগ ও টান অনুভব করেন।

বাজারভ কেন্দ্রিক এই উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্রগুলিও বেশ জীবন্ত ও পাঠকের মনে তারা দাগ রেখে যায়। পাভেল কির্সানভ ব্যক্তি চরিত্র হিসেবে এবং একটি কালের প্রতিনিধি হিসেবেও বেশ উজ্জ্বল। একদা তিনি মিলিটারি অফিসার ছিলেন, তারপর সেন্ট পিটার্সবার্গের উচ্চকোটির সমাজে রমণীমোহন হিসেবে বিচরণ করেছিলেন। কিন্তু প্রেমের ফাঁদে পড়ে শেষপর্যন্ত প্রতারিত হন ও আজীবন অবিবাহিত নিঃসঙ্গ থেকে যান। ভাইয়ের কাছে খামার বাড়িতে তিনি ফিরে আসেন, ভাইয়ের কাছ থেকে যথোচিত সম্মান ও মর্যাদারও কোনও কার্পণ্য হয় না। কিন্তু এই গ্রামীণ জীবনে নিঃসঙ্গতা কখনো তিনি কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। জমিদারি দেখাশোনার কাজেও সেভাবে কোনও উৎসাহ বোধ করেন নি। আভিজাত্যের অহংকার নিয়ে আত্মমগ্ন অসুখীই থেকে গেছেন।

বিপরীতে তাঁর ভাই নিকলাই অনেকটাই সহজ স্বাভাবিক। জীবনে কোনওদিনই তিনি বিশেষ সফল হতে পারেন নি কিন্তু স্ত্রী পুত্র সংসার জমিদারি নিয়ে সুখী ছিলেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাঁর জীবন বিপর্যস্ত হয়েছে, কিন্তু তিনি জীবনতৃষ্ণা হারিয়ে ফেলেন নি। ফেনেচকার সঙ্গে প্রেম, সন্তান ও সংসার ঘিরে তাঁর মধ্যে সংকোচ কাজ করেছে, কিন্তু তা বেশি বয়স্ক পুত্রের কাছে স্নেহশীল পিতার নতুন সংসার জনিত সংকোচ। ফেনেচকা ও তাঁর বংশগৌরবের পার্থক্যের দিকটি যে পিওতর পরিবারের সবাই শেষ পর্যন্ত অগ্রাহ্য করেছে, তা বুঝিয়ে দেয় রুশ দৃষ্টভঙ্গী ভেতর থেকেই অনেকটা বদলে যাচ্ছিল।

নিকলাই পুত্র আর্কাদির প্রতি যেমন স্নেহশীল, তেমনি বাজারভের প্রতি শ্নেহশীল তাঁর পিতা ভাসিলিও। বস্তুত এই দুই পিতা শুধুই তাঁদের পুত্রদের প্রতি স্নেহশীল তাই নন, পুত্রদের আচার বিচার দৃষ্টিকোণ শিক্ষা মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীলও। এ সবের সঙ্গে সব সময় তারা তাল রাখতে পারেন না, সব কিছু ভালোভাবে বুঝেও উঠতে পারেন না, কিন্তু সেগুলো কখনো তাদের মধ্যে কোনওরকম বিরূপতা তৈরি করে না, বরং এজন্য তারা খানিকটা কুন্ঠিত হয়েই থাকেন। উপন্যাসের শেষ অনুচ্ছেদে অকাল মৃত যুবক পুত্র বাজারভের কবরের সামনে যেভাবে দুই বৃদ্ধ পিতা মাতা ভাসিলি আর আরিনাকে দেখি আমরা, তা বাৎসল্যের করুণ রসঘন ছবি হিসেবে স্মৃতিপটে থেকে যায়।

উপন্যাসের উজ্জ্বলতম নারী চরিত্র নিঃসন্দেহে ওদিনৎসভা। সে সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতি। সবচেয়ে বড় কথা আত্মমর্যাদাবোধে দৃঢ়। পাশাপাশি নিরন্তর আত্মনিরীক্ষাশীল। রাশিয়ায় নতুন প্রজন্মের পুরুষেরাই যে কেবল বদলে যাচ্ছিল তা নয়, মহিলাদের মধ্যেও যে প্রবল প্রত্যয় ও বদল আসছিল – ওদিনৎসভা চরিত্রায়নের মধ্যে তার পরিচয় আছে।

অন্যদিকে ফেনেচকা চরিত্রটি উচ্চকোটির বাইরের সমাজের মেয়েদের আত্মপ্রত্যয়ের ছবিটিকে ধরে রেখেছে। বাজারভের নাগর সুলভ চপলতাকে প্রত্যাখ্যানের শান্ত অথচ দৃঢ় অভিব্যক্তির মধ্যেই শুধু নয়, তার আগের পর্বে বাজারভের সঙ্গে সহজ মেলামেশার মধ্যেও এই প্রত্যয়ের ছাপ রয়েছে। কির্সানভ পরিবারের নিকলাই বা পাভেলের প্রতি আচরণে সে খানিকটা কুন্ঠিত, কিন্তু কাছাকাছি বয়েস ও অনভিজাত বাজারভের সঙ্গে মেলামেশাতে সে অনায়াস। তবে সহজ মেলামেশার মধ্যেও মর্যাদার গণ্ডীটি সে কখনো অতিক্রম করতে দেয় নি।

এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বাজারভকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসটি বিখ্যাত হয়েছে। পিতাপুত্র প্রকাশের আগেই রাশিয়ার ভেতরে ও পশ্চিম ইউরোপে তুর্গেনিভ প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। বস্তুত তখনো দস্তয়েভস্কি বা তলস্তয় নন, তাঁকেই রুশ সাহিত্যের প্রধান মুখ বলে মনে করা হত। পিতাপুত্রই পরবর্তীকালে তুর্গেনিভের শ্রেষ্ঠ রচনা বলে পরিগণিত হয়েছে সর্বত্র, কিন্তু এই উপন্যাসটি ও তার নায়ক বাজারভের চরিত্রাঙ্কনের জন্য তুর্গেনিভের ওপর সমস্ত মহলই বিরূপ হয়েছিলেন। রক্ষণশীলেরা মনে করেছিলেন বাজারভের মতো নিহিলিস্টের জন্য তুর্গেনিভ বড় বেশি মমতা প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে বিপ্লবীরা মনে করেছিলেন নিহিলিস্ট বাজারভকে যথেষ্ট উজ্জ্বলভাবে আঁকেন নি তুর্গেনিভ।

বস্তুতপক্ষে বাজারভ চরিত্র এই আঠাশ পর্বের উপন্যাসের প্রায় আধাআধিতে দুই ভিন্ন চেহারায় অভিব্যক্ত। প্রথম চোদ্দ পর্ব জুড়ে বাজারভ আপোষহীন, উজ্জ্বল। কথাবার্তায় সে কাউকে রেয়াত করে না, মাথাও নোয়ায় না। নিজের মতাদর্শকে সর্বত্রই স্পষ্ট দৃঢ়ভাবে উপস্থাপণ করে।

এই বাজারভই বদলে যায় আন্না ওদিনৎসভার সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলাপের পর। কিন্তু শুধু এক সুন্দরী তরুণীর প্রেমে পড়া জনিত চিত্তচাঞ্চল্যর কারণেই উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্বে বাজারভ তাঁর ঋজুতা ও খরতা হারিয়ে অনুজ্জ্বল হয়ে পড়েছে – এমন নয়। সেই অংশটুকু বরং আইডিয়া থেকে বাস্তব মানুষ হিসেবে বাজারভ চরিত্রায়নে ইতিবাচক ভূমিকাই পালন করেছে। বাজারভ চরিত্রটি সমস্যায়িত হয়েছে ফেনিচকা কেন্দ্রিক আচরণের জন্য। ওদিনৎসভার প্রতি প্রেম নিবেদন যৌবনের স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটেছে, কিন্তু ওদিনৎসভার প্রত্যাখ্যানের পর আর্কাদির গ্রামের খামারে ফিরে এসে যেভাবে সে ফেনেচকাকে অতর্কিতে চুম্বন করেছে, তা কোনও প্রেম নয় বরং তার নাগরসুলভ ছেনালিকে মানসিকতাকেই সামনে এনেছে। এরপরও সে কোনও আত্মদংশনে ভোগেনি, বরং পাভেল কির্সানভ তাঁকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করায় সে তাঁকেও ফেনেচকার প্রেমপ্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কল্পনা করে নিয়েছে। যে বাজারভ সমাজমুক্তির জন্য ব্যগ্র, আদর্শের কথা যার মুখে মুখে ফেরে, নারী প্রশ্নে তাঁর দৃষ্টিকোণ আধিপত্যবাদী ও পুরুষতান্ত্রিকতায় মোড়া কেন থেকে যাবে – এ এক সঙ্গত আপত্তি। এই অসঙ্গতি কি বাজারভ চরিত্রের ভেতর থেকে উঠে আসা না জার শাসনের স্বৈরশাসনের ভয়ে নিহিলিস্ট চরিত্রে খানিক কলঙ্কলেপনে লেখকের সচেতন সাবধানতাজাত আরোপ – তা নিয়ে আলোচনার অবকাশ থেকেই যায়। এর উত্তর যাই হোক না কেন, বাজারভের এই অনুজ্জ্বল দিক যে বিপ্লবীদের খুশি করেনি তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

উনিশ শতকের মধ্যভাগে রাশিয়ায় নিহিলিজম কেবল একটি দার্শনিক দৃষ্টিকোণ হিসেবেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বাকুনিন প্রভৃতির দ্বারা প্রাণিত এই মতবাদ রাষ্ট্র, চার্চ, পরিবার – সমস্ত রকম কর্তৃত্বকে শুধু অস্বীকারই করতে চায় নি, জার শাসিত রাশিয়ার ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনেও সামিল হয়েছিল। যুক্তিবাদ ও বস্তুবাদের ওপর দাঁড়িয়ে ভাববাদী দৃষ্টিকোণগুলিকে যথার্থ নিহিলিস্টের মতোই বাজারভকে দিয়ে খন্ডন করিয়েছেন তুর্গেনিভ, কিন্তু জার শাসনের বিরুদ্ধে নিহিলিস্টরা যে গোপন সংগঠন ও লড়াই এর প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তার কোনও হদিশ আখ্যানের মধ্যে দিতে সাহস করেন নি। এর বদলে বাজারভকে কেবল উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্বে খানিকটা নারী মোহিত যুবক হিসেবে উপস্থাপণ করেছেন। বাজারভের মতো চরিত্র - যে মূলত কথায় নয়, ব্যবহারিক কাজে বিশ্বাসী - তাকে কাজ ও সাংগঠনিক পরিচয়ের বাইরে এনে ফেললে চরিত্রটির ওপরেই শুধু অবিচার করা হয় না, উপন্যাসের শিল্প সম্ভাবনাকেও দুর্বল করে ফেলা হয়। বিপ্লবীদের দিক থেকে বাজারভ চরিত্রায়ণ ও পিতাপুত্র উপন্যাসটি সম্পর্কে শৈল্পিক আপত্তির উত্তর হিসেবে পালটা একটি উপন্যাসও লেখা হয়েছিল। পিতাপুত্র প্রকাশের পরের বছরেই, ১৮৬৩ সালে, নিহিলিজম এর ইতিবাচক উপস্থাপণ সহ নিকোলাই চেরনিসেভেস্কি লিখেছিলেন – ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ নামের এক উপন্যাস। পরবর্তীকালে লেনিন এর অত্যন্ত প্রিয় বই হয়ে ওঠে এটি। অন্তত পাঁচবার তিনি এটা পড়েছিলেন এবং তাঁর এক বিখ্যাত বইয়ের নাম দিয়েছিলেন এই উপন্যাসের নামেই।

জার শাসন জনিত ভয় থেকে বাজারভকে উজ্জ্বলভাবে আঁকার ক্ষেত্রে লেখকের যে পশ্চাদপসরণ, তার ক্ষতিপূরণ তুর্গেনিভ করতে চেয়েছেন বাজারভের মৃত্যুদৃশ্যকে উজ্জ্বল করে তোলার মধ্যে দিয়ে। ১৮৬১ সালে লেখা এই উপন্যাসের একই বছরে পৃথিবীর অন্য এক প্রান্তে এক বাঙালি কবি মাইকেল মধুসূদন একইভাবে লিখছিলেন তাঁর মহাকাব্যর নায়ক মেঘনাদের মৃত্যুদৃশ্য। তা রচনা করতে গিয়ে স্রষ্টার যন্ত্রণার কথাগুলি তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন বন্ধু গৌরদাস বসাককে লেখা চিঠিতে। অনুমান করতে ইচ্ছে হয় বাজারভের মৃত্যুদৃশ্য রচনার সময়ে একই রকম মথিত হয়েছিলেন তুর্গেনিভও। তিনি এই উপন্যাস লেখার সময় বাজারভের নামে একটা ডায়রিও লিখতেন, পরে এক বন্ধুর কাছ থেকে সেটি হারিয়ে যায়। এটি পাওয়া গেলে বাজারভের সঙ্গে স্রষ্টার আবেগ মথিত সম্পর্কের হদিশ হয়ত আমরা পেতাম।

ওদিনৎসভাকে কেন্দ্র করে বন্ধু আর্কাদির প্রতি অদ্ভুত ব্যবহার থেকে ফেনেচকার প্রতি নাগরসুলভ ব্যবহারের কলঙ্ক পেছনে ফেলে বাজারভ আবার এক ভিন্ন মানুষ হয়ে ওঠে শরীরে বিষক্রিয়া ও সম্ভাব্য মৃত্যুর সমস্ত লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে যাবার পর। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও সে কোনও বিলাপ করে না, বরং আশ্চর্য চারিত্রিক দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে একে বাস্তবতা হিসেবেই গ্রহণ করে। আমরা যদি মনে রাখি এই পর্বেও জীবন সম্পর্কে সে বীতস্পৃহ হয়ে পড়ে নি, যদি মনে করি শেষ ইচ্ছা হিসেবে মৃত্যুর আগে ওদিনৎসভার কাছে বার্তা পৌঁছে দেবার ব্যাগ্র আকুতিকে, তাহলে মৃত্যুকে এই দৃঢ়তায় গ্রহণ আরো মহনীয় হয়ে ওঠে। মৃত্যুর কিছু আগে শরীরের শেষ শক্তি দিয়ে শায়িত অবস্থাতেই বিছানার পাশে রাখা ভারি টেবিলটিকে নাড়িয়ে দিয়ে সে পরখ করে নিতে চায় তাঁর মধ্যে টিঁকে থাকা শেষ সময়ের শক্তিকে। আর মৃত্যুর ঠিক আগে কপালে ওদিনৎসভার ঠোঁটের স্পর্শটুকুমাত্র চেয়ে নিয়ে আর তারপর তাকে সরিয়ে দিয়ে সে বুঝিয়ে দেয় – মানসিকভাবেও শেষ মুহূর্তে সে ভেঙে পড়ে নি। নিঃসন্দেহে বাজারভের মৃত্যুদৃশ্য বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকার মতো এক ঘটনা।