সঙ্ঘ পরিবারের ঘোষণাগারে প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞানভাণ্ডার

বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সেই সুতীব্র শ্লেষ “সবই ব্যাদে আছে” এক কালে অনেক উষ্ণতা ও উষ্মার জন্ম দিলেও হিন্দু সনাতনপন্থী চিন্তকদের শেষ অবধি একটা সম্মানজনক জায়গায় থামতে প্ররোচনা দিয়েছিল বলে আমরা যখন প্রায় নিশ্চিন্ত বোধ করছিলাম, সেই সময় দ্রুত ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা অচিরেই আমাদের ভুল ভাঙিয়ে দিল। বিপুল ভোটে জিতে কেন্দ্রে বিজেপি-সরকার কায়েম হওয়ার পর থেকে প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অবদান নিয়ে আবার নতুন করে হৈ-হুল্লোর শুরু হয়েছে। আর এস এস-এর অনুগামী এক দীননাথ বাত্রা কিছু বই লিখে প্রাচীন ভারতে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের বহু সাঙ্ঘাতিক দাবিদাওয়া উত্থাপন করেছিল। প্রধান মন্ত্রী হয়ে মাঝে মধ্যে দেশে থাকার কোনো এক ফাঁকে ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে নরেন্দ্র মোদী মুম্বাইয়ের এক প্রাইভেট হাসপাতাল উদ্বোধন করতে গিয়ে বাত্রাবিদ্যার অনুসরণে গণেশের হাতির মুণ্ড এবং কর্ণের জন্মকথা উল্লেখ করে প্রাচীন ভারতে যথাক্রমে প্লাস্টিক সার্জারি ও জেনেটিক্স-এর যে কী বিরাট অগ্রগতি হয়েছিল, তা তুলে ধরেন। আশ্চর্যের কথা যে শ্রোতারা, যাঁদের মধ্যে নিশ্চয়ই বেশ কিছু পাশ করা ডাক্তারও ছিলেন, চা সিঙারা স্যান্ডুইচ বিরিয়ানির সাথে সাথে জ্ঞানী মোদীর এই বাণীগুলি অক্লেশে কানের ভেতর দিয়ে মরমে গুদামজাত করে ফেলেন।

তার পরে এক বোম্বেটে কাণ্ড ঘটে ২০১৫ সালেমুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে। সেখানে জাঁকজমক সহকারে পাঁচ ঘন্টার একটা বিশেষ অধিবেশন রাখা হয় প্রাচীন ভারতে ঋগবেদের যুগে কী কী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আয়ত্তে ছিল তার ব্যাখ্যানে। তার শিরোনাম ছিল: “Ancient sciences through Sanskrit”।একজন পাইলট (বিজ্ঞানীদের সভায় পাইলট?) এবং এক স্কুল শিক্ষিকা সেখানে দাবি করেন, সাত হাজার বছর আগেই নাকি ভারতে বিমান চলত। কিছু কাল পরে ফ্রন্টলাইন পত্রিকায় আর একজন বিদ্বান দাবি করেছেন, আর্যভাটের গণিতেই নাকি ক্যালকুলাসের আদি বীজের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। এদিকে আবার ফ্রন্টিয়ার পত্রিকায় একজন গণিতজ্ঞ প্রাচীন গ্রিকদের বিজ্ঞানে অবদানের যাবতীয় কৃতিত্বই ভারতে আমদানি করবার ব্যবস্থা প্রায় পাকাপোক্ত করে ফেলেছেন। বিজেপি-র অন্য এক প্রতিভাধর নেতা বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপচারিতার পরই নাকি হাইজেনবার্গ তাঁর অনিশ্চয়তা সূত্রের সন্ধান পেয়েছিলেন। সঙ্ঘ পরিবার যে খুব বোকা নয় তা আর একবার বোঝা গেল এইভাবে বিজ্ঞানের দুনিয়ায় প্রাচীন ভারতের কৃতিত্ব আর্যাবর্তের বাইরে চারদিকে কিঞ্চিত ভাগ করে দেবার প্রচেষ্টার মধ্যে।

পাঞ্জাবের লাভলি নামক এক (প্রাইভেট) বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত ২০১৮ সালের বিজ্ঞান কংগ্রেসেও শোনা গেল বহু নতুন বচন। এক মন্ত্রী জানালেন, ডারউইনের তত্ত্ব ভুল, কেন না, তাঁর বাপ মা ঠাকুরদা ঠাকুরমা কেউ নাকি বানর থেকে মানুষ হতে দেখেনি। যা কেউ দেখেনি তা সত্য হয় কীভাবে? সত্যিই তো, কীভাবে তা সত্য হয়?

এদিকে আবার প্রতিদিন কেউ না কেউ গোমূত্র পানে ক্যান্সার সহ সমস্ত দুরূহ রোগে আরোগ্য প্রাপ্তির ভরসা দিয়ে যাচ্ছেন। কেউ দিচ্ছেন বিশেষ বটিকা সেবনে মহিলাদের পুত্র সন্তান প্রসবের সুনিশ্চিতি। এবং, এবং . . .

অর্থাৎ, চারদিকে একটা সাজ-সাজ রব উঠে গেছে। পালটা জবাবে বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদীরা অনেকেই যুক্তি তথ্য দিয়ে প্রমাণ করবার চেষ্টা করছেন, বেদের যুগে এই সব প্রযুক্তি ভারতে বিকশিত হয়নি, সমস্তটাই সঙ্ঘ পরিবারের সদস্যদের মাথার ঘাম খবরের কাগজে পড়ছে। কিন্তু আমার মনে হয়, এইভাবে বললে তর্কযুদ্ধটা অনেক পেছন থেকে শুরু হয়। খানিকটা আত্মরক্ষামূলক কায়দায়। বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের তরফে এরকম আত্মরক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই। আজকের দিনেআসল প্রশ্ন আদৌ এটা নয় যে প্রাচীন ভারতে জিনতত্ত্ব বা প্লাস্টিক সার্জারি ছিল কি ছিল না। প্রশ্নটা হল, এই সব প্রযুক্তি থাকা সেদিন সম্ভব ছিল কিনা। যাবতীয় যুক্তিতর্ক পর্যালোচনা আমাদের প্রথমেসেখান থেকে শুরু করতে হবে।

 

[১]প্রথমপর্ব:বিচার-দ্ধতি

 

মনে রাখা দরকার, বিজেপি-র আমলে প্রাচীন ভারতে যে বিপুল প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে, তার রহস্য ভেদ করতে হলে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিকে খানিকটা সক্রিয় করে নিতে হবে। মনের মধ্যে বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রশ্ন উত্থাপন করবার, যুক্তিতর্ক করবার, উত্তর খুঁজবার, এক রকম অনুশীলন করে নিতে হবে। একমাত্র তারপরই তথ্যের অরণ্যে ঢুকতে হবে। ততক্ষণ ধৈর্য হারালে চলবে না! আসলে এই বৌদ্ধিক অনুশীলনের অভাবেই আমাদের দেশের শিক্ষিত মানুষদেরও মনের জমিনটা, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, খুব তলতলে; বিজ্ঞানের নামে যা-তা জিনিস চট করে বিশ্বাস করে বসতে অসুবিধা হয় না! 

 

১। দৈববাণী নয়

বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির বিকাশের একটা নির্দিষ্ট গতিপথ আছে। তাদের বিকাশ খাপছাড়াভাবে, এলোমেলোভাবে হয় না। তার একটা ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত মানুষ মূলত প্রযুক্তিই আয়ত্ত করেছে। নানা রকম হাতের কাজ। তার পেছনের তত্ত্ব তার জানা ছিল না সেদিন। সেই সব আনুষঙ্গিক তত্ত্ব সে জেনেছে ধীরে ধীরে, অনেক পরে। যেমন, মানুষ ধাতু ব্যবহার করছে প্রায় ছয় হাজার বছর আগে থেকে। কিন্তু ধাতু রসায়ন সে আয়ত্ত করেছে মাত্র দুশ বছর আগে। মৌলিক পদার্থ হিসাবে চিনবার পর। আজ থেকে মাত্র চারশ বছর আগেও পৃথিবীর কোথাও মানুষ আটটার বেশি ধাতুর পরিচয় জানতে পারেনি। সোনা রূপা লোহা টিন দস্তা তামা সিসা পারদ। সেই জন্যই কোনো দেশের জ্যোতিষশাস্ত্রকেই অষ্টধাতুর বেশি কিছু বলতে শোনা যায়নি। এমনকি এই ভারতেও। কিংবা যেমন, আগুনের ব্যবহার। আধুনিক মানুষের কোনো এক পূর্বপুরুষ—হোমো ইরেক্টাস—আগুন আয়ত্ত করেছিল প্রায় ২৮-৩০ লক্ষ বছর আগে। আর দহন সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব মানুষ জানতে পেরেছে মাত্র দু-শ বছর বা তার কিছুকাল আগে থেকে—ল্যাভোয়াশিয়র কাজের মধ্য দিয়ে। একইভাবে মানুষ নদীর জলে নৌকা ভাসিয়েছে বেশ কয়েক হাজার বছর আগে থেকে। সমুদ্রেও জাহাজ নামিয়েছে কম দিন নয়। কিন্তু উদস্থিতিবিদ্যার শুরু হয় আর্কিমিদিসের সময়ে, আর উদ্গতিবিদ্যা (hydrodynamics)-র শুরু হল সবে মাত্র সেই আইজ্যাক নিউটনের হাত ধরে।

এই অবস্থা বহাল ছিল যতক্ষণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমস্যাগুলি ছিল সহজ সরল। প্রকৃতিতে হাতের সামনে সাদামাটা যে সব জিনিসপত্র পাওয়া যায় তাদের নিয়ে যখন কাজ করতে করতে তখন প্রয়াস-ব্যর্থতা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কিছু কিছু জিনিস করে ফেলা সম্ভব ছিল। কিন্তু একটা সময় থেকে চাকা উলটো দিকে ঘুরতে শুরু করল। কোপারনিকাস-উত্তরকালে প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানের বিকাশের প্রক্রিয়াটা ধীরে ধীরে বিপরীত ক্রমে ঘটে চলেছে। বাস্তব জীবনের বিভিন্ন সমস্যাকে সমাধান করার উদ্দেশ্যে প্রথমে এসেছে নানা রকম তত্ত্ব, মৌলিক ধারণা, মূল কিছু সত্য। তার ভিত্তিতে তাকে কাজে লাগানোর মতো প্রযুক্তিগত ভাবনা। যেমন, নিউটনের বলবিদ্যা থেকে এল যন্ত্রবিদ্যা এবং যান্ত্রিক প্রযুক্তির ব্যাপক অগ্রগতি। আলোকবিজ্ঞানের অগ্রগতির পথ বেয়ে এল নানা রকম দেখার যন্ত্রপাতি। লেন্স, টেলিস্কোপ, মাইক্রোস্কোপ, আরও কত কী। একের পর এক। রসায়ন শাস্ত্রের বিকাশের ফলে বহু রকম রাসায়নিক দ্রব্য তৈরি করার কায়দাকানুন মানুষ শিখে ফেলল। জীববিজ্ঞানের যত উন্নতি হতে লাগল, ততই চিকিৎসাশাস্ত্র ভেষজবিদ্যারও উন্নতি হয়ে চলল। ফ্যারাডে-ম্যাক্সওয়েল-এর কাজের আগে বিদ্যুৎ শক্তিকে ব্যবহার করার মতো কোনো প্রযুক্তি মানুষ করায়ত্ত করে উঠতে পারেনি। এইভাবে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার ক্ষেত্রেইকথাটা সমানভাবে সত্য।

যে কোনো সমস্যাকে এইভাবে ভেবে দেখা যেতে পারে। ধরুন, জিন প্রযুক্তির কথা। এর জন্য আপনাকে জিনের ব্যাপারে জানতে হবে। জিন সম্পর্কে জানার অর্থ হল, জীব কোষ, তার ভেতরে প্রোটোপ্লাজম, প্রোটিন অণু, নিউক্লিয়াস, তার ক্রোমোজোম, তার মধ্যেকার ডি-এন-এ আর-এন-এ, ইত্যাদি জানা দরকার। তার মানে হল জীবের অঙ্গসংস্থান শারীরতত্ত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে হবে। প্রাণীবিদ্যা উদ্ভিদবিদ্যার প্রাথমিক জ্ঞান বিকশিত হল না, কোষ সম্পর্কে কোনো ধারণা জন্মায়নি, অথচ জিনবিদ্যা এবং জিন প্রযুক্তি এগিয়ে গেছে—জ্ঞানের রাজ্যে এমনটা কখনও হয় না।

কিংবা ধরুন, কেউ যদি বলেন, প্রাচীন ভারতে পিথাগোরাসের অনেক আগে থেকেই তাঁর উপপাদ্যটা জানা ছিল, তৎক্ষণাৎ তাঁর কাছে জানতে চাইতে হবে, শুধু একটাই উপপাদ্য তাঁরা জানতেন, নাকি, তাঁরা সামগ্রিকভাবেই জ্যামিতির বিকাশ ঘটিয়েছিলেন? কেন না, কোনো মানবগোষ্ঠীই সমগ্রভাবে জ্যামিতির চর্চা না করে একটা মাত্র উপপাদ্য বের করে হাত গুটিয়ে বসে থাকে না। কোনো গণিতজ্ঞও এমনটা করেছেন বলে আমরা দেখিনি। একইভাবে, গরুর গাড়ি বা ঘোড়ায় টানা গাড়ি থেকে এক লাফে বাষ্পীয় ইঞ্জিন কিংবা পেট্রোল-ডিজেল চালিত গাড়ি এসে যেতে পারে না। মাঝখানে শক্তির ব্যবহার ও তার নিয়ম জানতে হবে, শক্তির উৎস হিসাবে বিভিন্ন জ্বালানির ভৌত-রাসায়নিক ধর্ম সম্বন্ধে জানতে হবে, ধাতুবিদ্যার বিকাশ ঘটতে হবে, তাপগতিবিদ্যার নিয়মকানুন সম্পর্কে অবহিত হতে হবে, এই রকম অনেক কিছু জানার পর তবে বাষ্পীয় ইঞ্জিন বা তেল-চালিত ইঞ্জিনের আবিষ্কার সম্ভব হতে পারে। কেউ যদি এই সব সহযোগী জ্ঞানের বিকাশের ইতিহাস অনুক্ত রেখে একটা বিশেষ কোনো আবিষ্কারের কথা বলতে থাকেন, তাহলে বুঝতে হবে, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বলতে কী বোঝায় সে সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণাই নেই।

 

মিলেমিশে বিকাশ

এবার আর এক দিক থেকেও বিষয়টাকে দেখা দরকার।

বিজ্ঞানের কোনো শাখাতেই একা একা বিকাশ ঘটে না। পৃথিবীর কোথাও এমনটা হয়নি যে, পদার্থবিজ্ঞানের বিকাশ ঘটে গেছে কিন্তু রসায়নের বিকাশ হয়নি, জীববিদ্যা স্থবির হয়ে আছে, গণিতের বিকাশ রুদ্ধ। এরকমটা হয়ত দু পাঁচ দশকের আগে-পরে হলে হতেও পারে। কিন্তু দু পাঁচ শতকের হতে পারে না। এটা কোনো কাকতলীয় ব্যাপার নয় যে কোপারনিকাসের বইটা যে বছর (১৫৪৩) বেরয়, সেই একই বছরে বেরিয়েছে ভেসালিউসের মানবশরীর-গঠন সংক্রান্ত বইটি। গ্যালিলেও যখন টেলিস্কোপ বানিয়ে বৃহস্পতির দিকে তাক করছেন, তখন তাঁকে (এবং সেই সঙ্গে আরও অনেককে) লেন্স সম্পর্কেও ভাবতে হয়েছে। নিউটন যখন আধুনিক পদার্থবিদ্যার বিকাশ ঘটাচ্ছেন, তখন তিনি একই সাথে আধুনিক ক্যালকুলাস গণিতেরও জন্ম দিচ্ছেন। এবং আরও অনেকেই গণিতের নতুন শাখার জন্ম দিচ্ছেন। সেই থেকে পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে যেন তাল মিলিয়েই আধুনিক গণিতের বিকাশ হয়ে চলেছিল।

প্রাচীন কালে কিছু দূর বিকশিত হওয়ার পর মধ্য যুগের এক বিস্তৃত সময় ধরে সারা পৃথিবীতেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ প্রায় অবরুদ্ধ হয়েছিল। সামন্ততন্ত্র থিতু হয়ে বসার পর আর কোনো জায়গাতেই সে নতুন প্রযুক্তি বা উৎপাদন পদ্ধতির বিকাশে আর খুব একটা আগ্রহী ছিল না। সাধারণ মানুষের জীবন ধারণ, খাজনা প্রদান, আর রাজা-বাদশাদের বিলাস ব্যসন চলে গেলেই তারা খুশি ছিল। মধ্যিখানে আরব দেশগুলিতে দশম-দ্বাদশ শতকগুলিতে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাতেই ভালো বিকাশ ঘটেছিল। তারপর সেও নিভে যায়। ইউরোপে নবজারণের যুগে ধনতন্ত্রের উন্মেষকালে পঞ্চদশ শতাব্দ থেকে আবার নতুন করে বিজ্ঞান যুক্তিবাদ এবং প্রযুক্তির বিকাশের দরজা খুলে গেল। তারপর থেকে প্রথমে ইউরোপে, পরে অন্যান্য দেশেও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় এই বিকাশ অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। এই দিক থেকে দেখলে সহজেই বোঝা যাবে, যে দেশে যে সময়ে জিনতত্ত্বের বিকাশ ঘটবে, সেখানে ইতিমধ্যেই বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাতেও অনুরূপ বিকাশ ঘটে যাওয়া প্রয়োজন এবং স্বাভাবিক। পদার্থবিজ্ঞান রসায়ন জীববিজ্ঞান গণিত ভূতত্ত্ব বিবর্তন-তত্ত্ব বংশগতিবিদ্যা ইত্যাদিতে কিছুই জানলাম না, ধাতুবিদ্যার বিকাশ হল না, কিন্তু কোষের মধ্যে জিন খুঁজে পেয়ে গেছি এবং তা নিয়ে নাড়াচাড়া করছি—এটা বাস্তবে সম্ভবই নয়। সাধারণ বুদ্ধিতেই একথা বেশ বোঝা উচিত।

পদ্মবুদ্ধির কথা অবশ্য আলাদা।

আবার, উদ্ভিদ বা প্রাণীর বাইরের চেহারা আপনি না হয় খালি চোখে এবং খালি হাতেই দেখতে পেলেন। কিন্তু ভেতরের গঠন কীভাবে দেখবেন? আঙুল টিপে যদি বা হাড়গোড়ের অস্তিত্ব বা আকার প্রকার টেরও পান, পৌষ্টিকতন্ত্র, কিংবা স্নায়ুতন্ত্র কীভাবে বুঝবেন? তখন তো কাটাছেঁড়া করতে হবে, তার জন্য উপযুক্ত ধারালো এবং সুচালো হাতিয়ার লাগবে। সেই হাতিয়ার বানানোর জন্য আবার ধাতুর জ্ঞান বাড়াতে হবে। ইত্যাদি।

অর্থাৎ, সজীব কোষের ভেতরে জিন খুঁজবার বা নাড়াচাড়া করবার জন্য যে ধরনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যন্ত্রপাতিগুলো চাই সেগুলো আসবে পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞান থেকে, ধাতুবিদ্যার প্রায়োগিক বিকাশ থেকে, যন্ত্রপাতি নির্মাণের যথেষ্ট উন্নতির পথ ধরে। অন্য দিকে, যে ধরনের গবেষণাগারে এই জাতীয় খোঁজার কাজ পরিচালনা করা সম্ভব, তার জন্য চাই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ। তার মানে বিদ্যুৎ সংক্রান্ত জ্ঞান এবং বৃহদায়তন চলবিদ্যুৎ উৎপাদন করার মতো প্রযুক্তি তার আগে আয়ত্তাধীন হওয়া চাই, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই রকমভাবে বহু জিনিস নিয়ে ভাবতে হবে। কেউ যদি এই সব প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে শুধু দাবি করেন যে কোনো এক সময় অমুক জ্ঞান বা তমুক প্রযুক্তি বিকশিত হয়েছিল, তাহলে বুঝতে হবে, তিনি জানেনই না তিনি কী নিয়ে কথা বলছেন। তাঁদের এই সব বিষয়ে কথা বলার আগে টেট জাতীয় একটা পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে আসতে হবে।

 

আবিষ্কারের আবিষ্কার!

আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, পশ্চিমা দেশগুলিতে যে আবিষ্কারগুলি হয়ে গেছে বলে ইতিমধ্যেই জানা আছে, প্রাচীন ভারতে শুধু মাত্র সেই সব আবিষ্কারের কথাই শোনা যায়। এরকম দাবি কাউকে করতে শোনা বা দেখা যায় না যে আমরা অমুক জিনিসটা আবিষ্কার এবং উদ্ভাবন করে ফেলেছি; কিন্তু দ্যাখ, দ্যাখ, ওরা এখনও এটা করে উঠতে পারেনি।

আরও আশ্চর্যের, আমাদের দেশের আবিষ্কার, সেই আদ্যিকালের ঘটনা, অথচ, তার নামটা শুধু পশ্চিমি দেশের দেওয়া তাই নয়, একেবারে টাটকা আধুনিক নাম।

তা না হলে, আমার প্রশ্ন হচ্ছে, প্রাচীন ভারতে যখন গণেশের ধড়ে হাতির মুণ্ড লাগানো হয়েছিল, তার নাম প্লাস্টিক সার্জারি হতে যাবে কেন? যিনি বা যাঁরা এই রোমাঞ্চকর কাজটি করেছিলেন, এবং যিনি বা যাঁরা এই বিরাট দাবি এখন উত্থাপন করছেন, তিনি বা তাঁরা কেউ খাঁটি আর্য সংস্কৃত ভাষায় এর একখানা শিরোনাম খুঁজে পেলেন না? এই যেমন, “অথঃ অন্যশরীরেতর মুণ্ডযোজন” বা এই জাতীয় কিছু? [সংস্কৃত ব্যাকরণে কোনো ভুল হয়ে থাকলে আমাকে ক্ষমা করবেন। এই ভাষা আমার খুব ভালো করে জানা নেই]। আবার প্রাচীন ভারতীয় মুনিঋষিরা যে জিনতত্ত্বের বিকাশ ঘটালেন, তার নাম তাঁরাও রাখলেন সেই জিন দিয়েই? কোষ-কীট, কোষাণু, কোষ-রেণু, এরকম শব্দ লাগালেন না? ব্যাপারটা কেমন যেন সন্দেহজনক বলে মনে হয় না? আমরা দেখেছি, প্রাচীন কালের মানুষেরা যে গাছপালা চিহ্নিত করেছিলেন তাদের নাম দেশি ভাষাতেই রেখেছিলেন। তাঁরা গাছকে বৃক্ষ বলেছেন, অশ্বত্থকে অশ্বত্থ বলেছেন, হর্তুকিকে হরিতকি বলেই ডেকেছেন, ছাতাকে ছত্রাক বলেছেন, ইত্যাদি। কোনো গ্রিক লাতিন আংরেজি নামে ডাকতে হয়নি। একইভাবে তাঁরা সিংহকে সিংহ বলেছেন, বাঘকে ব্যাঘ্র, বেড়ালকে মার্জার, কুকুরকে সারমেয়, ইত্যাদি আর্য সংস্কৃতির শব্দভূষণে পরিচয় দিয়েছেন, কোনো বিদেশি নামে আবাহন করেননি। সুতরাং বোঝাই যায়, সেকালে তাঁদের গ্রিক লাতিন নামের প্রতি কোনো বিশেষ প্রীতি ছিল না। জানার প্রশ্ন না হয় বাদই দিলাম। তাহলে এই সব জায়গায় কেন এরকম ব্যাতিক্রম ঘটছে?

কিংবা, যখন আমরা দেখি, এদেশীয় পণ্ডিতরাও স্কুল কলেজের জীববিজ্ঞানের পাঠ্যবইতে অ্যামিবাকে অ্যামিবা, ডি-এন-এ-কে ডি-এন-এ, জিনকে জিন বলছেন, সহজ সরল মনে ধরে নিই, জিনিসগুলো এ দেশে নতুন; তাই এদের নামকরণে অসুবিধা হচ্ছে। নতুন পারিভাষিক নাম দিলে তাতে অনেক সময় বোঝাতে সুবিধা তো হয়ই না, বরং বাড়তি ঝামেলা হয়। তার থেকে পরদেশি নামগুলিই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিয়ে রাখছি। ছাত্ররা একবারেই এই নতুন বৈজ্ঞানিক শব্দগুলোর আন্তর্জাতিক নামকরণ জেনে যাচ্ছে।

কিন্তু যে সমস্ত আবিষ্কার বহুকাল আগেই এই দেশেই ঘটে গেছে, করেছেন এই দেশেরই মুনিঋষিরা, তাদের বেলায় বিদেশি নামকরণ কেন?

এই রহস্য ভেদ করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, আসলে আমাদের প্রাচীন জ্ঞানীরা শুধু মাত্র সেই সব জিনিসই জানতে বা আবিষ্কার করতে পেরেছেন, যেগুলো বিদেশিরা এখন একে একে আবিষ্কার করতে পেরেছে। এই প্রাচীন আবিষ্কারগুলির খবর যে সঙ্ঘ পরিবারই প্রথম আমাদের শোনালেন তা নয়। একেবারে সেই বঙ্কিমের আমল থেকেই এই কাণ্ড চলে আসছে। ডারউইন সাহেব জীব বিবর্তনের এক তত্ত্ব হাজির করলেন, যা নিয়ে সারা পৃথিবীতেই ঝড় উঠল। সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের দেশের একদল পণ্ডিতও খবর পেলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, এ তো আমাদের অনেক দিনের আবিষ্কার। জন্মান্তর, জাতকের গল্প, কত যোনিতে ভ্রমণ করে তবে মানব জনম—এমনি আরও কত সূত্র তার পাওয়া গেল। মজার কথা হচ্ছে, সূত্রগুলো কিন্তু সহস্রাধিক বছর ধরেই ছিল। কিন্তু তাতে যে উদ্ভিদ ও প্রাণীদের বিবর্তনের খবর ছিল, তা আমরা জানতাম না। ১৮৫৯ সালে ডারউইন যেই বললেন, অমনি আমরা জেনে গেলাম . . .।

কিংবা ধরুন, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব। ইউরোপ থেকে ভারতে চালান হতে একটু সময় লেগেছে। একটু কঠিন কিনা। কিন্তু যেই না চালান হল, সাথে সাথে কিছু জ্ঞানবৃদ্ধ জেনে গেলেন, আরে? এও তো আসলে আমাদেরই জিনিস। ব্রহ্মার একদিন সাধারণ মানুষের কত কল্প মনে নেই? পুরাণেই তো লেখা আছে। মুশকিল হচ্ছে, লেখা তো আগে থেকেই ছিল। কম পক্ষে দেড় দুহাজার বছর আগে থেকেই। তখন কিন্তু জানা যায়নি, এর মধ্যে আপেক্ষিকতা নামক কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বীজ লুকনো আছে। বীজটা ধরা পড়ল যেই ওদের থেকে ব্যাপারটা আমাদের দেশে আমদানি হয়ে এল।

স্কুল জীবনে শোনা একটা চুটকি গল্পের কথা এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে।

এক আড্ডায় ব্রিটিশ জার্মান আমেরিকান এবং জাপানি প্রকৌশলীদের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে কে কত সূক্ষ্ম জিনিস বানাতে পারে তা নিয়ে। প্রত্যেকেই দারুণ দারুণ সব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির উদ্ভাবনের কথা বলছেন। হঠাৎ তাঁদের খেয়াল হল, সঙ্গে একজন ভারতীয় প্রযুক্তিবিদও বসে আছেন, চুপচাপ সবার কথা শুনছেন, কিন্তু মুখে কিছু বলছেন না। শুধু মুচকি মুচকি হাসছেন। তাঁরা সবাই মিলে তাকে চেপে ধরলেন, “আপনি কিছু বলছেন না কেন ভাই? আপনারা ইন্ডিয়ায় কী বানাচ্ছেনএকটু বলুন।” ভারতীয় কুশলী তখন এক গাল হেসে বললেন, “আমরা যা পারি সেটা করা আপনাদের কারওই সাধ্য নয়। আপনারা যে যাই বানান, আমরা দেশে কিনে এনে তার গায়ে ‘ভা-র-তে-তৈ-রি’ একটা ছাপ মেরে দিই।”

মোদীর জমানায় সেই ছাপাখানার কাজের চাপখুব বেড়ে গেছে।

 

কোথায় পাব তারে?

এবার যা বলব, সেই সমস্যাটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সকলেই জানেন, মানুষ যবে থেকে গ্রন্থাকারে নিজেদেরচিন্তাভাবনা গুছিয়ে লিখতে শিখেছে, একটা ন্যূনতম শৃঙ্খলা সে আয়ত্ত করে নিয়েছে। যে বিষয়ের গ্রন্থ সেই গ্রন্থে সেই বিষয়ের উপরেই প্রধানত আলোচনা থাকে। গণিত নিয়ে যা কিছু সে লিখেছে তা গণিতের গ্রন্থেই লিখে রেখেছে। জ্যোতিষের কথা সে লিখেছে জ্যোতিষের গ্রন্থে। চিকিৎসা বিষয়ক সমস্যা নিয়ে আলোচনা রয়েছে এতদ্বিষয়ক গ্রন্থে। ভারতবর্ষ, এমনকি প্রাচীন ভারতও এই ব্যাপারে কোনো ব্যতিক্রম নয়। পাণিনি “অষ্টাধ্যায়ী”-তে ভাষার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন, গণিত বা ভেষজ নিয়ে কিছু লেখেননি। বেদাঙ্গ জ্যোতিষে কেউ ছন্দ বা ব্যাকরণের কথা খোঁজে না। কালিদাস ভবভূতির নাট্যকাব্যে কাউকে এযাবত জ্যামিতির পাঠ খুঁজতে দেখা যায়নি।

কিন্তু আধুনিক কালে যাঁরা প্রাচীন ভারতে আধুনিক বিজ্ঞানের যাবতীয় আবিষ্কার খুঁজে বেড়ান এবং খুঁজে পেয়েও যান, তাঁরা সকলেই সেই সব বিজ্ঞানের কথা যত্রতত্র খোঁজেন এবং পেয়েও যান। তার জন্য তাঁদের কোনো বিজ্ঞান সংক্রান্ত বইপত্র লাগে না। হয়ত তাঁরা চুম্বক বিষয়ক তত্ত্ব দেখলেন কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে, বিদ্যুৎ সংক্রান্ত হাল হকিকত খুঁজলেন মহার্ণবতন্ত্রে, আপেক্ষিকতা ব্রহ্মাপুরাণে, গ্যোয়েডেল-এর উপপাদ্য শ্রীমদ্ভাগবতে, গণেশের প্লাস্টিক সার্জারি দুর্গাস্তোত্রে, জিনতত্ত্ব মহাভারতে, মহাকর্ষ জ্ঞান কালিকাপুরাণে, এইরকম আর কি। এইভাবে পৃথিবীর কোথাও বিজ্ঞানের কাজকর্ম হয়েছে কিনা, এমনকি প্রাচীন ভারতেও হয়েছে কিনা আমার জানা নেই।

সমস্যাটার গভীরতা বুঝবার জন্য আমি কয়েকটা উদ্ভট সাম্প্রতিক উদাহরণ বানিয়ে বলছি।

ধরুন যদি শোনেন, কেউ বার্ট্রান্ড রাশেলের রচনাবলিতে প্লাস্টিক সার্জারি খুঁজে পেয়েছে, জন ডিউইএর কোনো বইতে কোয়ান্টাম মেকানিক্স আছে বলে জেনেছে, রবীন্দ্রনাথের কাব্য থেকে ডারউইন পাঠ করতে সক্ষম হয়েছে, আগাথা ক্রিস্টির রহস্য উপন্যাসে পিরিয়ডিক টেবিলের সন্ধান পেয়েছে—আপনার কী মনে হবে? নিশ্চয়ই তাকে পাগল বলে মনে হবে আপনার। কিংবা বিপরীতক্রমে, ধরুন, আপনি এই সব বিষয়ে খানিক জানতে চাইলেন, আর আপনাকে সেই ব্যক্তি এই সমস্ত উৎস গ্রন্থের সন্ধান দিলেন—তখনই বা আপনার কীরকম লাগবে? নিশ্চয় সেই ভদ্রলোককে খুব সুস্থ বলে মনে হবে না?

অথচ, যাঁরা আমাদের দেশে প্রাচীন ভারতের মুনিঋষিদের দ্বারা সমস্ত আধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনগুলি করিয়ে নিতে চাইছেন, তাঁদের সূত্রগ্রন্থগুলি ঠিক এই জাতের। বিজেপি সঙ্ঘ পরিবার বা এই জাতীয় লোকেরা যখন এইসব প্রচার করে, তাদের উদ্দেশ্য বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না। তাদের কাছে বিষয়টা আদৌ যুক্তিতর্কের সমস্যাই নয়। তারা আমজনতার কাছে বলেই খালাশ। ভোটে খানিকটা সুবিধা হচ্ছে—এই-ই তাদের কাছে যথেষ্ট। কিন্তু যাঁরা বিশ্বাস করেন, আমি এখানে তাঁদের এই সব দিক ভেবে দেখতে বলছি।

কিছু দিন আগে দেখলাম, একদল লোক দাবি করছেন, ঋগবেদে নাকি পিথাগোরাসের উপপাদ্যের কথা লেখা আছে। কথাটা সত্য হলে পিথাগোরাসের অন্তত এক হাজার বছর আগেই ভারতে এই উপপাদ্যটির জন্ম হয়ে যাওয়ার কথা। সাংঘাতিক ব্যাপার! পরিচিত দু-একজন আমাকে জিগ্যেস করলেন, “আপনি কি জানেন এই ব্যাপারে কিছু?”

আমি তাঁদের বলেছিলাম, “সামান্যই জানি। কিন্তু বলুন তো, ঋগবেদে পিথাগোরাসের উপপাদ্য কেন থাকবে? থাকার কি কথা? ওটা কি জ্যামিতির কোনো গ্রন্থ? গাণিতিক কোনো রচনা? ওতে এসব থাকবে কেন? আপনারা আশাই বা করেন কীভাবে যে ঋগবেদে এরকম কিছু থাকবে? আর যদি সত্যিই থাকত, তাহলে তা কি পিথাগোরাসের নামে থাকত? সে তো থাকত কোনো না কোনো বৈদিক ঋষির নাম ধরে। যাঁরা বলছেন, তাঁরা সেই নামটির কথা বলছেন না কেন? সংশ্লিষ্ট উপপাদ্য প্রসঙ্গে সেই পিথাগোরাসের নামই কেন ঘুরে ফিরে আসছে?”

আর একটা কথাও তাঁদের আমি ভাবতে বলেছিলাম। পিথাগোরাসের উপপাদ্যের প্রধান অনুষঙ্গ হল বর্গক্ষেত্রের ধারণা। অতিভুজের উপরে অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রটি অপর দুই বাহুর উপর অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রদ্বয়ের সমষ্টির সমান। ঋগবেদ হামাম দিস্তা দিয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেললেও তাতে বর্গক্ষেত্রের কোনো উল্লেখই দেখতে পাবেন না কোথাও। কারণটা সেই একই। ওখানে এসব প্রসঙ্গ থাকার কথা নয়। উপপাদ্যটা আসবে কোত্থেকে? আসবেই বা কেন?

একইভাবে জিনতত্ত্ব শুধু মহাভারতেই বা থাকবে কেন? অথর্ব বেদ বা আয়ুর্বেদে নেই কেন? সেখানেই তো প্রধানত থাকার কথা। প্লাস্টিক সার্জারিই বা বিজ্ঞানের আকর গ্রন্থগুলিতে নেই কেন?

এইভাবে সচেতন শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে ভাবতে হবে। যুক্তি দিয়ে উত্তর খুঁজতে হবে। শুধু তথ্য দিয়ে খুঁজতে গেলে আপনাকে মাক্সম্যুলার এবং ওল্ডেনবার্গ-এর যুগ্ম-সম্পাদিত পঞ্চাশ খণ্ডের সেই সুবিখ্যাত “প্রাচ্যের পবিত্র গ্রন্থাবলি” নিয়ে বসে বসে ঘাঁটতে হবে। হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকলে এবং অন্য তেমন কোনো কাজ না থাকলে সেটাও কোনো খারাপ কাজ নয়। তবে অতটা পরিশ্রম করে এই সব ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত আপনি যা জানতে পারবেন, একটু বুদ্ধি প্রয়োগ করে যুক্তি দিয়ে বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে ভাবলে অনেক কম পরিশ্রম করেও আপনি ঠিক তাই দেখতে পাবেন।

 

পরীক্ষার বেজায় চাপ

ক্লান্ত বোধ করছেন?বড্ড তাত্ত্বিক কচকচি হয়ে গেছে এ পর্যন্ত? এবার কিছু কিছু বাস্তব ঘটনার দিকে নজর দিতে বলছেন? নিশ্চয়ই দেব।আর সামান্য একটু ধৈর্য ধরুন। মৌলিক বিচার্য কথাগুলি প্রায় শেষ করে এনেছি।আরও একটা জরুরি কথা শেষ করে নিই চট করে।সেটা হল: বিজ্ঞানে কোনো রকম গোঁজামিল চলে না। কেউ যে কখনও বিজ্ঞানের তত্ত্বেটত্ত্বে গুলতাপ্পি দেয় না,বা, পরীক্ষার ফলে কারচুপি করে না, এমন নয়; তবে দিলেও বেশি দিন তা চলে না। কেন, সেটা বুঝে নেওয়া যাক। তারপর প্রাচীন ভারতের উদ্ভাবনী কীর্তিকাহিনির ভেতরকার গোঁজামিলগুলো নিয়েও কিছু কথা বলা যাবে।যে দুচারটে ঘটনার খুব টাটকা টাটকা প্রচার চলছে চারদিকে তা নিয়েও কিছুটা বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ করা যাবে।বুঝতেও সুবিধা হবে।

বিজ্ঞানে প্রতিটি দাবির তিনটি স্তরে পরীক্ষা দিতে হয়। প্রথম পরীক্ষা তার নিজের ভেতরে। যা দাবি করা হল, তার সমর্থনে যে সমস্ত তথ্য যুক্তি বিশ্লেষণ হিসাবনিকাশ উপস্থিত করা হয়েছে তার মধ্যে যুক্তি তর্ক তথ্যের দিক থেকে কোনো অস্পষ্টতা অসঙ্গতি বা অসামঞ্জস্য আছে কিনা। একে বলা যেতে পারে অভ্যন্তরীন সামঞ্জস্য (internal consistency)বাযৌক্তিকসামঞ্জস্য (logical consistency)। সেই সামঞ্জস্য রক্ষার ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হলে যেতে হয় দ্বিতীয় পরীক্ষায়। সেখানে দেখতে হয়, এযাবত প্রচলিত প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তগুলির সাথে নতুন দাবিটির কোথাও কোনো রকম বিরোধ দেখা দিচ্ছে কিনা। একে বলা যায় পারস্পরিক সামঞ্জস্য (reciprocal consistency)বা বাহিরঙ্গিক সামঞ্জস্য (external consistency)। এটা একটা বড় এবং প্রধান পরীক্ষা। যদি পারস্পরিক এরকম কোনো বিরোধ না দেখা যায়, অর্থাৎ, এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একবার হতে পারলে একটা বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পক্ষে অনেকটাই রাস্তা সাফ হয়ে গেল বলে ধরে নিতে হবে।

আর সব শেষে আসে হাতে-কলমে পরীক্ষা (experiment)এবং ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ (application)। যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য দাবি উত্থাপন করা হয়েছে, হয় সেই সিদ্ধান্তের পক্ষে সরাসরি, অথবা, তার থেকে নিষ্কাশিত কোনো উপসিদ্ধান্তের পক্ষে যাচাইয়ের উপযোগী এক বা একাধিক হাতে-কলমে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। যাচাইয়ের পরীক্ষায় যদি সে বাতিল হয়ে না যায়, তবে অন্তত কিছুদিনের জন্য সেই দাবিটি টিকে গেল। সেই সাথে যদি তার কোনো ব্যবহারিক প্রয়োগ ঘটানো যায়, তাহলে তো আরও খাসা। আর তার বিরুদ্ধে কিছু বলার প্রায় কোনো সুযোগই থাকে না। সাধারণত আমরা প্রথম দুটি যাচকাঠি সম্পর্কে খুব একটা খোঁজখবর রাখি না। এই তৃতীয়টিকেই একমাত্র সত্য নির্ণায়ক মাপকাঠি বলে বলে মনে করি। কিন্তু ঘটনা তা নয়। পরীক্ষায় আমি একটা ভ্রান্ত পর্যবেক্ষণ করেও ফেলতে পারি। তখনও প্রথম দুটি যাচকাঠি আমাকে শুধরে দেবে অনেক দূর অবধি। এত রকম কঠিন কঠোর পরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে হয় বলেই বিজ্ঞানে যদি বা কেউ কখনও কিছু গোঁজামিল দিয়েও ফেলেন, তা বেশি দিন ধোপে টেকে না।

তার উপর বিজ্ঞানীদের ইদানিংকালে (গত চারশ বছর ধরে) বড় বড় সম্মেলনে মিলিত হয়ে পাঁচ জনের সামনে নিজের আবিষ্কারের কথা বলতে হয়। সেখানে সকলেই বসে থাকেন যেন ওঁত পেতে—কেউ সামান্য ভুল কিছু বললেই একেবারে চেপে ধরতে। সবচাইতে বড় ব্যাপার, তাতে সাধারণত কে বড় কে ছোট কোনো বাছবিচার হয় না। ১৯১২ সালের সেই ঘটনাটার কথাই ভাবুন। আইনস্টাইন তখন খ্যাতির তুঙ্গে। সেই সময়েহল্যান্ডের কে এক পিটার ডিবাই, লোকে তাঁর নাম তখনও ভালো করে জানেই না, আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তাপের এক ফর্মুলায় দুম করে একখানা সংশোধনী এনে বসলেন। সেটাই কিন্তু বিজ্ঞানে ডিবাই-মডেল নামে স্থায়ী জায়গা পেয়ে গেল। কারণ, উপরের ওই তিনটে যাচকাঠি। আইনস্টাইনের নামডাক কিন্তু তাঁর ফর্মুলাকে বাঁচাতে পারল না।

একই সমস্যা দেখা দেয় বিজ্ঞানের কোনো নামকরা পত্রিকায় নিজের কোনো গবেষণার ফলাফল জানাতে গেলে। পাঠালেই কেউ ছেপে দেবে না। পত্রিকার তরফ থেকে দু-চারজন খ্যাতনামা বিজ্ঞানীর কাছে মতামত চাওয়া হবে। তাঁদের কেউ কেউ দাবিকৃত পরীক্ষাগুলি নিজের হাতে করে দেখে নিতেও পারেন। অতএব জালজোচ্চুরি করা মুশকিল। যদি-বা সঙ্গে সঙ্গে ধরা নাও পড়ে, কিছু দিনের মধ্যেই তা ধরে ফেলবে অন্য লোকে। যে পত্রিকা এইভাবে জালি কারবার যত বেশি আটকাতে পারে তার নামডাক তত বেশি। সেইজন্য সেখানে আপনার একটা বিজ্ঞানপত্র প্রকাশিত হলে বিজ্ঞানের দরবারে তার মূল্যও অনেক বেশি ধরা হয়ে থাকে।