নোয়ম চমস্কির চিন্তাজগৎ : ভাষা ক্ষমতা রাজনীতি নিয়ে কথাবার্তা
- 06 April, 2021
- লেখক: লিপিকা ঘোষ
আজ একটি তথ্যচিত্রের গল্প শোনাব। এই তথ্যচিত্রে আছে সমালোচনা, আছে রাষ্ট্র, রাজনীতি, বৈদেশিকনীতি, প্রচারমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীদের সমালোচনা। আর আছে ভাষাতত্ত্বের গন্ধ।
ত্রিশ বছর আগে তৈরি হওয়া এই তথ্যচিত্র আজও সারা বিশ্বে কত প্রাসঙ্গিক দেখুন। দুই পরিচালক পাঁচ বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে বহু বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে তৈরি করেন ছবিটি। মোট সাতটি দেশের তেইশটি শহরে শুটিং করে 120 ঘন্টার আকরিক ফিল্ম থেকে সম্পাদনা করে 2 ঘন্টা 45 মিনিটের একটি অনবদ্য তথ্যচিত্র তৈরি করেন। এতক্ষণে নিশ্চয়ই আন্দাজ করেছেন ছবিটির নাম! পরিচালক পিটার উইনটোনিক এবং মার্ক আচবার 1988 সালে ‘নেসেসারি ইলিউশনস’ নামে একটি কম্পানি তৈরি করেন। এর সঙ্গে ‘ন্যাশনাল ফিল্ম বোর্ড অফ কানাডা’ সহযোগিতায় তৈরি হয় ছবিটি। মাঝেমাঝে আর্থিক অনটন দেখা দিলে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। আবার হঠাৎ করে অপ্রত্যাশিতভাবে আর্থিকসহায়তা এলে কাজ শুরুকরা সম্ভব হয়। 75 মিনিটের একটি তথ্যচিত্র তৈরিকরার পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত ছবিটি হয়ে দাঁড়ায় 165 মিনিটের একটি ছবি। হয়ে ওঠে 185টি গুরুত্বপূর্ণ সূত্রের দৃশ্যদলিল। ছবিটি 1992 সালের 18ই জুন প্রথম প্রদর্শিত হয় অস্ট্রেলিয়ার সিডনি চলচ্চিত্র উৎসবে। সেই উৎসবের মোট 47টি তথ্যচিত্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ‘দর্শকের পছন্দ’এর স্থান কেড়ে নেয়। দ্রুত বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে ফেলে। সারা বিশ্বের দুশোর বেশি শহরে প্রদর্শিত হয় ছবিটি। প্রথম সপ্তাহে সানফ্রান্সিসকোতে আশাতীত বাণিজ্যক সফলতা পেয়ে চমকে দেয় সবাইকে। মোট পঞ্চাশটি উত্সবে যোগ দিয়ে প্রথম বছরেই বারোটি পুরস্কার জিতে নেয় এই ছবি। সে যেন বাঁধভাঙ্গা নদীর দুকুল- ছাপান সাফল্য। এই তথ্যচিত্রটি গত তিন দশকে বিভিন্নদেশে, যুদ্ধবিরোধী, মানবাধিকার আন্দোলনের একটি প্রধান প্রেরণা এবং প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। হবে নাই বা কেন! এ ছবির শিরদাঁড়ায় রয়েছেন এমন একজন ব্যক্তি যাঁর নিজের শিরদাঁড়া ঋজু, কণ্ঠস্বর নির্ভীক। তিনি ঐ দেশেরই নাগরিক, ভাষাবিজ্ঞানী/ ভাষাতাত্ত্ববিদ, দার্শনিক, রাজনৈতিক সমালোচক। হ্যাঁ, তিনি নোয়াম চমস্কি! হ্যাঁ, তথ্যচিত্রটির নাম ‘Manufacturing Consent'।
ভাষাতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে গেলে যে সমস্ত নমস্য পন্ডিত বর্গের নাম স্মরণে আসে তাঁদের মধ্যে অবশ্য অগ্রগণ্য নোয়াম চমস্কি। কেউ কেউ তাঁকে ভাষাতত্ত্বের জনকও বলেন। 1957 সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর ভাষাতত্ত্বের ওপর লেখা অন্যতম সেরা বই ‘Syntactic Structures'। ‘ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’ র শিক্ষক নোয়াম চমস্কির যুগান্তকারী গবেষণার ফসল এই বইটি। এর আগে পরে ভাষাতত্ত্বের ওপর তাঁর অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর তত্ত্বের সারমর্ম হল, মানুষ কেবল অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অর্থাৎ শুনে শুনে ভাষাজ্ঞান অর্জন করে না। তার মৌলিক ভাষাবোধ অন্তর্নিহিত থাকে, তা না হলে একটি শিশু বিচ্ছিন্নভাবে অসম্পূর্ণ কিছু শব্দ ও বাক্য শুনে শুনে দ্রুত ভাষায় ব্যবহার করতে শিখতে পারত না। তাঁর এই মত সর্বজনস্বীকৃত না হলেও তাঁর গবেষণার পরে এই তত্ত্বের আলোচনার মোড় ঘুরে যায়। আজ তাঁকে বাদ দিয়ে ভাষাতত্ত্বের মূল কাঠামো নিয়ে কোনো বিশ্লেষণ সম্ভব নয়।
তবে এটাই চমস্কির একমাত্র পরিচয় নয়। নোয়াম চমস্কির আরো বড় পরিচয় হল তিনি একজন তীক্ষ্মধী, নিরপেক্ষ, আপসহীন, নির্ভীক রাজনৈতিক সমালোচক। গত শতকের ছয়ের দশক থেকেই তাঁর দেশের অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষেত্রটিতে এক অনন্য স্থান দখল করে নিয়েছেন তিনি। নোয়াম চমস্কি তৎকালীন দুনিয়ার প্রতিবাদের অন্য নাম। তিনি আমেরিকার অর্থাৎ নিজের দেশের বৈদেশিকনীতির তীব্র নিন্দা করেছেন, তাঁর প্রতিবাদের লক্ষ্য ছিল মার্কিন প্রচারমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীসমাজ। তিনি অভিযোগ করেছেন, প্রচারমাধ্যম তদানীন্তন রাষ্ট্রনায়ক তথা অর্থনীতির পরিচালকদের মুখপাত্রে পরিনত হয়েছে। আরও দেখিয়েছেন কীভাবে দেশের বুদ্ধিজীবীরা এই প্রভূশ্রেনীর স্বার্থরক্ষায় সর্বদা তৎপর রয়েছেন। আপাত দৃষ্টিতে তাঁরা স্বাধীন হলেও আসলে তাঁরা খণ্ডিত এবং সীমিত।
বস্তুত, ভিয়েতনাম আক্রমণের প্রতিবাদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে আন্দোলনের সূচনা হয় তার শরিক ছিলেন চমস্কি। তিনি শুধু যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনই করেননি, ঐ রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হবার কারণ বিশ্লেষণও করেন।
তবে তিনি সমালোচনা করেই ক্ষান্ত হননি। মার্কিন অধ্যাপক এডওয়ার্ড হারম্যানের সহযোগিতায় বিশদ একটি তাত্ত্বিক কাঠামোর সাহায্যে বিশ্লেষণ করেছিলেন কীভাবে মার্কিন সমাজ আপাত স্বাধীনতার আড়ালে চিন্তার দাসত্ব করছে।
চমস্কি মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রের দর্শনে উদার গণতন্ত্র দেখতে চেয়েছেন। যে শাসন ব্যবস্থায় প্রচারমাধ্যমের মালিক সরকার নয়, প্রচারমাধ্যমের একটা বড় অংশ হবে বেসরকারী। এই ব্যবস্থায় কোনো সেন্সর- এর নিয়ম থাকবে না, থাকবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে বা প্রশাসনের স্বার্থে আঘাত হানতে পারে এমন কোনো মত যে তখন প্রচার করতে দেওয়া হয় না, তা তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংবাদ ফিল্টার বা বাছাই করে প্রচার করা হয় যাতে সাধারণ মানুষের কাছে সত্যটা না পৌঁছায়। অবাঞ্ছিত তথ্য ও ধারণাগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচারমাধ্যম থেকে কীভাবে বাদ পড়ে যায়, কীভাবে বাছাই করা মতামত গুলিই কেবল প্রচার করা হয়, বার বার প্রচার করা হয় সেই রহস্য উদ্ঘাটন করতে চাইলেন চমস্কি।
মোট পাঁচটি ফিল্টার বা বাছাইয়ের কথা বলেন। চমস্কি বলেন পাঁচটি প্রকরণের কথা যা দিয়ে বাছাই হয়ে যায় সংবাদ, বাছাই হয় মতামত, চাপা পড়ে যায় সত্য।
তাঁর মতে প্রথম ফিল্টারের নাম হল, প্রচার মাধ্যমের মালিকানা। 1986সালের একটি হিসাবে দেখিয়েছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচারমাধ্যমের পরিচালক 24টি বড় কম্পানির মধ্যে 23টির সম্পদের পরিমাণ 100কোটি ডলারের বেশি। তাইই নয় এই কোম্পানিগুলি নিয়ন্ত্রিত হয় বড় বড় শিল্পপতি বা ব্যবসায়ীদের দ্বারা। এই নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ বেড়েই চলছে।
দ্বিতীয় যে ফিল্টার বা বাছাই প্রকরণের কথা বলেছেন তা হল, বিজ্ঞাপননির্ভরতা। উনিশ শতকের মাঝামাঝি ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী জর্জ লুইস বলেছিলেন যে ধরণের কাগজ বিজ্ঞাপন দাতারা পছন্দ করে তেমন কাগজই সফল হবে। চমস্কি নানা নজির দেখিয়ে বলেছেন কথাটি আজকের দিনে উন্নত দুনিয়ায় আরো বেশি করে সত্য। প্রচার মাধ্যম আরো বেশি করে বিজ্ঞাপন নির্ভর। বিজ্ঞাপনদাতারা যেহেতু শিল্প বাণিজ্যের কর্ণধার সুতরাং প্রথম দুটি ফিল্টার পরস্পরকে আরো শক্তিশালী করে তোলে।
তাঁর মতে তৃতীয় ফিল্টার হল, প্রচারমাধ্যমের সংবাদ সরবরাহকারী বড় সংবাদ সংস্থা বা সরকারি দফতর। সরকার সূত্রে খবর সবদেশেই গুরুত্ব পেয়ে থাকে তার ওপর মার্কিন প্রশাসনের নিজস্ব জনসংযোগব্যবস্থা খুব শক্তিশালী। শুধু পেন্টাগনের নিজস্ব তথ্য সরবরাহের জন্য হাজার হাজার কর্মী নিযুক্ত ছিল। তার সঙ্গে ছিল মার্কিন শিল্প বাণিজ্য জগতের সুবিশাল জনসংযোগব্যবস্থা। এই বেড়াজালের বাইরে বেরিয়ে স্বাধীনভাবে ‘অন্য খবর’ সংগ্রহ করার উৎসাহ এবং সুযোগ কোনওটিই বেশি নয়, ফিল্টার এই ভাবে কাজ করে।
চতুর্থ ফিল্টার বা বাছাইয়ের নাম নিন্দা বা প্রতিবাদ। প্রশাসনের বিরুদ্ধে কোনো সংবাদ প্রচারিত হলে সেই সংবাদ মাধ্যমের তীব্র সমালোচনা করে তাকে কোণঠাসা করা, সরাসরি শাস্তির ভয় দেখান, পরোক্ষে চাপ সৃষ্টি করার ব্যবস্থাও করে রাখত তারা। 1982 সালে মার্কিন প্রশাসনের সমর্থন ও সাহায্যে পরিপুষ্ট সালভাদোর সরকারি বাহিনী যখন শয়ে শয়ে সাধারণ নাগরিকদের হত্যা করছে তখন সংবাদ মাধ্যম গুলি সেই অন্যায় এর বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ফ্রিডম হাউজকে কাজে লাগিয়ে তাদের কণ্ঠ রোধ করা হয়।
তাঁর মতে পঞ্চম ফিল্টারের নাম কমিউনিজম বিরোধিতা। কমিউনিস্ট চক্রান্ত ও প্রভাবের ভয় দেখিয়ে মার্কিন প্রশাসন বহুবছর ধরে বহু প্রতিবাদ স্তব্ধ করেছে।
তাঁর মতে কেবল প্রচার মাধ্যমের প্রতিনিধিরাই নন, সামগ্রিক ভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবীদের আচরণে এই সংযম দৃষ্টিকটূ রকমের বেশি। 1991সালে ইরাক আক্রমণ করা হয়। তখন গোটা দেশ জুড়ে সরকারি জঙ্গি দেখা যায়। নিন্দা দূরে থাক, সরকারের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে প্রায় কোনো বুদ্ধিজীবীই সংশয় পর্যন্ত প্রকাশ করেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবীদের এই সংশয়হীনতাকে তীব্র তিরস্কার করেছেন চমস্কি। তাঁরা যেন সরকারি সিদ্ধান্ত মেনে নিতে প্রস্তুত হয়ে আছেন সর্বদা!
কেন বুদ্ধিজীবীরা এত সহজে সরকারি প্রচারে বিশ্বাসী হয়ে পড়েন তার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন, এই আলোচনার শুরুতেই ফিরে গেলে আমাদের মনে পড়বে চমস্কির ভাষাতত্ত্বের কথা। তাঁর ভাষাতত্ত্বের মূলে রয়েছে অবিভাজ্য এক মানবিকতার ধারনা, যাকে তিনি বলেছেন সৃষ্টিশীল মানবধর্ম। যে মানবিকতাকে কোনো যান্ত্রিক সমাজতত্ত্ব সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, যে মানবিকতা একান্ত ভাবেই মানুষের গুন, তার বৈশিষ্ট্য, যার জোরে সে শৈশবেই ভাষার কাঠামো রপ্ত করে নেয় এক আপাত -বিস্ময়কর স্বতস্ফূর্ত প্রক্রিয়ায়। সমাজ ও রাজনীতির বিশ্লেষণে তিনি এই মৌলিক অন্তর্নিহিত মানবিকতার গুরুত্ব কখনও অস্বীকার করেননি। বুদ্ধিজীবীরা যদি তাদের সুস্থ স্বাভাবিক মানবিকতার বোধকে বিসর্জন দিয়ে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এক বিশেষজ্ঞের আসনে বসেন তবে তিনি কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারেন সেকথা মনে করিয়ে দিয়েছেন চমস্কি।
চমস্কি ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলেন না। তাঁর প্রসিদ্ধি ছিলেন তাঁর নির্ভীক কণ্ঠস্বরের জন্যই। তিনি কেবল মহাপরাক্রমশালী মার্কিন প্রশাসনের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াননি। তিনি সমালোচনা করে ছিন্ন ভিন্ন করেছেন তাঁর দেশের 15%বুদ্ধিজীবীকে। বস্তুত তাঁর প্রতিবাদ মার্কিন সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির মৌলিক অসাম্যের বিরুদ্ধে, ক্ষমতাসীন নেতৃত্বের অন্যায়ের বিরুদ্ধে। আর এর জন্য দেশের বুদ্ধিজীবীদের এগিয়ে আসতে বলেছেন, প্রতিবাদে শামিল হতে বলেছেন। হাভার্ড বিশ্ব বিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে ‘The responsibility of Intellectuals’ শিরোনামের বক্তৃতা দেন, তিনি বলেন-
“ It is the responsibility of the intellectuals to speak the truth and to expose lies.”
1991সালে জেনেভা চুক্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের ওপর অমানবিক বোমা বর্ষণ করে হাজার হাজার সাধারন মানুষের প্রাণ নেয়। ঐ বছর সেপ্টেম্বরে ইরাক ধ্বংস স্তূপে পরিনত হয়। জর্জ বুশ তখনও সেই ভয়াবহ ধ্বংস স্তূপ থেকে পরের বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সাফল্যের রসদ সংগ্রহের স্বপ্ন দেখেন। রাষ্ট্রপুঞ্জকে ব্যবহার করে ইরাকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের চেষ্টা করেন। ইরাক আক্রমণ করে যাদের ক্ষতি হয়েছে তাদের জন্য ক্ষতিপূরণ চান। সে সময় সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোনো দায় জর্জ বুশ -এর ছিল না। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন বিপর্যস্ত, চিন ব্যস্ত তার সমাজতান্ত্রিক বাজারে অর্থনীতির সাধনায়, রাষ্ট্রপুঞ্জ তাঁর হাতের মুঠোয়। ইরাকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য বলা হয় ক্ষতিপূরণ না দিলে নিরন্ন শিশুদের জন্য খাদ্য, যুদ্ধ বিধ্বস্ত ও মহামরীতে আক্রান্ত অগণিত অসহায় নাগরিকদের জন্য জীবনদায়ী ওষুধ সরবরাহ করা হবে না। এই নিষ্ঠুর অন্যায় নিয়ে কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি। কিন্তু চমস্কি প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্ন তুলেছেন নিকারাগুয়ার। নিকারাগুয়া দীর্ঘ দিন ধরে মার্কিন সাহায্যে ও প্ররোচনায় সান্দিনিস্তানের বিরুদ্ধে আক্রমণ চলছিল ততদিনে তার স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস রায় দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিকারাগুয়ায় সন্ত্রাস ও বেআইনি অর্থনৈতিক আগ্রাসন চালিয়েছে। সে জন্য তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। অর্থাৎ যে যুক্তিতে ইরাকের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করে আমেরিকা। সেই যুক্তিতে ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও।
কিন্তু আমেরিকা ইরাকের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করে নিকারাগুয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করল যাতে ক্ষতিপূরণের দাবি ছেড়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত নিকারাগুয়া 1700 কোটি ডলার ক্ষতিপূরণের দাবি ছেড়ে দেয়। কিন্তু সে খবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পত্র পত্রিকায় তেমন গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয় না। চমস্কি দেখিয়েছেন একটি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এই খবর পাঠিয়েছিল,অন্য একটি খবরের সঙ্গে। সেই খবরটি হল আমেরিকায় নিকারাগুয়াকে 26কোটি ডলার ঋনের মঞ্জুর করেছে। লন্ডনে ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকায় দ্বিতীয় খবরটি প্রকাশিত হল, প্রথম খবর উহ্য রেখেই। অর্থাৎ শুধু আমেরিকা নয় সমগ্র পশ্চিম দুনিয়া এই চক্রান্তের শামিল। 1700কোটি ডলার তো পেলেই না উল্টে নিকারাগুয়া ঋন নিল 26 কোটি ডলার। এরপরই আমেরিকার এক নেতৃত্বের মুখে শোনা গেল, ‘সাদ্দাম হোসেনকে শাস্তি পেতেই হবে, ক্ষতিপূরণ দিতেই হবে কারণ তিনি আইনের সমস্ত নির্দেশ লঙ্ঘন করেছেন’। চমস্কি তীক্ষ্ম তীর্যক ভাবে ব্যঙ্গ করে বললেন- ‘আমেরিকা কোনো আইন অমান্য করেনি’। নিজের দেশের সমালোচনা করে এই বিশ্লেষণ কেবল আবেগ আর সততা দিয়ে সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার আপসহীন জিজ্ঞাসা, আর তার উত্তর সন্ধানের জন্য অনলস পরিশ্রম।
চমস্কির চিন্তায় জিজ্ঞাসায় ও পরিশ্রমে কোনো খাদ নেই। তিনি যে বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক প্রচারের প্রতিবাদ করতে চান সে বিষয়ে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করেন অকল্পনীয় পরিশ্রম করে। ভিয়েতনামের যুদ্ধ, নিকারাগুয়ার আন্দোলন, ইরাকের বিরুদ্ধে আক্রমণ, কাম্পুচিয়ার ইতিহাস প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত ও ভূমিকা অন্যায় ও অনৈতিক তা তিনি বিপুল তথ্য সাজিয়ে প্রমাণ করেছেন। রাষ্ট্র নায়কের সমালোচনা করেই ক্ষান্ত হননি, তার আরো বড় লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্র বা প্রশাসন কীভাবে সমাজের বিশেষত আপাত -স্বাধীন পণ্ডিত বর্গের এবং প্রচার মাধ্যমের সমর্থন আলাদা করে সেটা প্রমাণ করা। ফলে সরকারি নথিপত্রের পাশাপাশি সংগ্রহ করতে হয় পণ্ডিতদের পুঁথি, সংবাদ পত্র-পত্রিকার অসংখ্য সংবাদ, প্রবন্ধ, সংগ্রহ করেছেন টেলিভিশনে প্রচারিত বিস্তর প্রচার চিত্রের অংশ। তাঁর প্রতিবাদ এই গভীর গবেষণার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে বলেই তিনি অনন্য।
সমাজের দাদারা কীভাবে তাঁদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সমাজের ঐক্যমত উৎপাদনের চেষ্টা করেন এই তথ্যচিত্রটিতে নির্মাতারা সেটাই দেখানোর চেষ্টা করেন। তাঁরা দেখানোর চেষ্টা করেছেন চমস্কিকে উপলক্ষ করে। এই ছবি নিছক তথ্যচিত্র নয়, আবার জীবনচিত্রও নয়, এর প্রতিটি ফ্রেমে ধরা আছে স্বাধীন চিন্তা ও চেতনার স্বরূপ। পরিচালক পিটার উইনটোনিক ও মার্ক আচবার যে যার মত করে মার্কিন প্রশাসনের নীতি ও কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলনের ধারাটি লক্ষ করছিলেন। সেই ধারার অন্যতম প্রধান চরিত্র নোয়াম চমস্কি কথা তারা জানতেন। দুজনেই পরস্পরকে না চিনে চমস্কিকে নিয়ে ছবি করতে উদ্যোগী হন। আর সেই সূত্রে যোগাযোগ হলে 1988সালে তৈরি হয় ‘নেসেসারি ইলিউশনস’ নামের সংস্থাটি। আর্থিক অনটনের কাজ বন্ধ হলে হাজার হাজার ফিট ফিল্ম ক্যান-বন্দি অবস্থায় ঘরে ফেলে রাখতে হয়েছে। আবার আর্থিক সহায়তা এলে কাজ শুরু হয়েছে। তিনশোর বেশি ব্যক্তি ও সংগঠনের কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা হয়েছে। চমস্কির 23 বছরের কাজ নিয়ে ছবি তৈরি হয়েছে। পরিচালকরা জানিয়েছেন,
-“ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট এর পাঁচ বছরের প্রস্তুতি ও নির্মানের সময় আমরা ছবি তৈরির একটি গণতান্ত্রিক প্রকরণ কাজে লাগাতে চেয়েছি, এই উদ্যোগে অন্যদের জড়িয়ে নেবার চেষ্টা করেছি। সম্পাদনা পর্বে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বহু দর্শককে বারবার দেখানো হয়েছে, তাদের পরামর্শ চাওয়া হয়েছে। এই ছবির বর্তমান রূপটিতে পৌঁছাতে সাহায্য নেওয়া হয়েছে ছয়শো র বেশি মানুষের”।
যে ভাবে তথ্যচিত্র তৈরির কাজটি সম্পন্ন হল, সকলকে জড়িয়ে নিয়ে কাজ করার উদ্যোগ আসলে চমস্কির আদর্শের অনুসারী। বৃহত্তর সমাজের সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণের ভিত্তিতে কাজ করায় বিশ্বাসী চমস্কি। চমস্কি তাঁর বিভিন্ন লেখায়, বক্তৃতায়, সাক্ষাত্কারে বারবার জোর দিয়েছেন নীতি নির্ধারণে এবং পর্যালোচনায় সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের ওপর। চমস্কি সঙ্কীর্ণতা বিরোধী। এই বিরোধেই নিহিত আছে গণতন্ত্রের ধারনা। তথ্যচিত্র নির্মাণে সেই ধারনাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন নির্মাতারা।
তথ্যচিত্র নির্মানের চেনা পদ্ধতিকে দূরে সরিয়ে আদর্শ আর পদ্ধতির মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে চেয়েছেন পরিচালকদ্বয়। তাই এ ছবিতে আলাদা করে কোনো ধারাভাষ্য নেই। বক্তৃতায়, সাক্ষাত্কারে, নীরবতায় বাগ্ময় তিনি নিজেই- নোয়াম চমস্কি। সময়ের ক্রমানুসারে বিষয় দেখানো হয়নি। এটি নিছক তথ্যের চিত্র নয়। সিনেমার নিজস্ব ভাষার তথ্যের গভীর ও দৃষ্টিপ্রসারী ব্যাখ্যা যে সম্ভব তা ও এই ছবি নির্ভুল ভাবে জানিয়ে দেয়।
ছবিতে চমস্কি বারবার এমন পরিবেশে বক্তৃতা করেছেন, যেখানে তাঁকে বাস্তবে দেখার সম্ভাবনা নেই। কখনো তাঁকে দেখা যায় অলিম্পিক স্টেডিয়ামের বড় পর্দায়। কখনো চোখধাঁধানো পণ্য সম্ভারের মধ্যে টিভির পর্দায়। নিউইয়র্ক- এর টাইমস স্কোয়ারে অতিকায় ইলেকট্রনিক বোর্ডে, কখনো আবার গৃহস্থের বসবার ঘরের টিভিতে। পরিচালকরা চেয়েছেন প্রচারমাধ্যমের মূলধারা থেকে ভিন্নমত ভিন্নস্বর কীভাবে হারিয়ে যায়, কীভাবে যথার্থ প্রতিবাদ বা প্রতিস্পর্ধী মতামতকে প্রান্তিক করে দেওয়া হয়, চমস্কি নিজের গবেষণাতে সেটাই দেখিয়েছেন। এই প্রস্তুতিকরণের প্রক্রিয়াটাই তাঁদের ছবিতে, দেখিয়েছেন প্রচার মাধ্যমের চড়া আলোয় ও লক্ষ্য দৃশ্যের ভিড়ে চমস্কিকে দেখিয়ে, নিজস্ব কণ্ঠস্বর শুনিয়ে। একটি দৃশ্যে দেখা যায়, অনেকগুলি টেলিভিশন সাজানো আছে তাতে নানা দৃশ্যের ছবি চলছে তবে অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে। তার মধ্যে একমাত্র টেলিভিশন সেটে চমস্কি কথা বলছেন, শুধু তাঁর দৃশ্যই স্বাভাবিক গতিতে চলছে। উপগ্রহ সঞ্চারিত প্রচারের সমকালীন প্রেক্ষিতে সময়ের ধারণা নিয়ে এই সিনেমা সম্মত পরীক্ষাটি মুহূর্তে এক ভিন্ন মাত্রা অর্জন করে।
তবে তিনি এর সমাধানের কথাও বলেছেন। তাঁর মতে, বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণের সময় ছাত্র-ছাত্রীদের বিদ্যা চর্চার পাশাপাশি সমাজবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের মূল সূত্রগুলি গভীরভাবে বোঝানো দরকার, যাতে তাঁরা সচেতন হয় শিক্ষাকে কীভাবে অপব্যবহার করা হচ্ছে বা বিভিন্ন স্বর্থান্বেষী ব্যাক্তি বা গোষ্ঠী তাদের কাজে লাগাচ্ছে। ভবিষ্যতে অপপ্রচারের স্বরূপ বুঝে নিতে এই প্রাথমিক ধারণা তাদের বিশেষ ভাবে সাহায্য করবে।
এবার আসি আমার দেশে এই তথ্যচিত্র বা চমস্কির তথ্য কতটা প্রাসঙ্গিক সেই প্রসঙ্গে। চমস্কি নিজে বলেছেন ভারতীয় সমাজ, রাজনীতি বা অর্থনীতি সম্পর্কে মন্তব্য করার মত তেমন তথ্য তাঁর কাছে নেই। তাই মন্তব্য করা নিষ্প্রয়োজন মনে করেন। অন্যান্য দেশের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে এখানেই তাঁর পার্থক্য। তিনি কতটা সতর্ক ভাবে মতামত প্রকাশ করেন তা বোঝা যায়।
মিল পাচ্ছেন নিজের দেশের সঙ্গে ? আসলে এই ছবির বিষয়বস্তু বা চমস্কির বিশ্লেষণ করে দেখান অভিযোগ শুধুমাত্র নয়ের দশকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবীদের প্রতি নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচারমাধ্যমের প্রতিও নয়। আমেরিকার মোড়কে বিশ্বের সব দেশের সকল বুদ্ধিজীবীদের প্রতি অভিযোগ তুলেছেন। তিনি তাঁর দেশের বুদ্ধিজীবী আর প্রচারমাধ্যমের উদাহরণ দিয়ে সারা বিশ্বের সকল দেশের সমস্ত বুদ্ধিজীবীদের ও প্রচারমাধ্যমকে সতর্ক করেছেন।
আমার দেশের প্রচারমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে কী আমাদের কোনো অভিযোগ নেই? এই তথ্যচিত্র যে সত্য প্রকাশ করা হয়েছে, চমস্কির বিশ্লেষণে যে অভিযোগ উঠেছে তা আমার দেশের জন্যও একই রকম প্রাসঙ্গিক। আমার দেশের গণতন্ত্রের ধারা যখন বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ জটিলতায় বিপথে পতিত হতে চলেছে তখন বুদ্ধিজীবীদের নিষ্ক্রিয়তা ও প্রচারমাধ্যমের কর্তব্যহীনতা আরো ত্বরান্বিত করছে। তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বোধ জাগিয়ে তুলতে এই ছবি এই ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট’ সারা বিশ্বের সকল দেশের কাছে আজ যতটা প্রাসঙ্গিক, আমার দেশের কাছে ততটাই প্রাসঙ্গিক নয় কি? ভাবুন!
তথ্যসূত্র:
1) তথ্যচিত্রের কথকতা
2) Problems of knowledge and freedom. Noam Chomsky.
3) Manufacturing Consent. Edward S HaHman and Noam Chomsky..