মরুর মায়া ও বাজকর : আমার চোখে তারাশঙ্করের গল্পভুবন

(১)

কত স্মৃতি সময়ের স্বাভাবিক স্রোতে হারিয়ে যায়! কত ছবি অস্পষ্ট হয়ে আসে! তারাশঙ্করের গল্পের প্রেক্ষাপট নিয়ে লিখতে গিয়ে নতুন করে অনুসন্ধান করতে হচ্ছে তেমনি অনেক হারিয়ে যাওয়া ও মলিন হয়ে আসা ছবি। বহুবার পড়া কোনও গল্প সম্পর্কে দিনরাত ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মত স্মৃতির ফুলকি ঝলকে উঠে ঝাপসা হয়ে যাওয়া ছবিকে স্পষ্ট করে তুলছে। একটা দৃশ্য হুবহু মিলে যাচ্ছে একটা গল্পের সঙ্গে। তাই স্বতস্ফূর্তভাবেই ‘মরুর মায়া’ গল্পটি চলে এল এই পর্বে। তারাশঙ্করের সাহিত্যজীবনের প্রথমদিকে লেখা গল্প ‘মরুর মায়া’। ১৯৩০ সালে উপাসনা পত্রিকায় গল্পটি প্রকাশ পায়। তাঁর জনপ্রিয় কাহিনিগুলির মধ্যে এ গল্প পড়ে কিনা জানা নেই, তবে এই কাহিনিতেও তাঁর আর পাঁচটি কাহিনির মতো একশ্রেণীর প্রান্তিক মানুষের কথাই উঠে আসে। তারাশঙ্করের গল্পের পরতে পরতে যে সমাজচিত্র ও কালের চিত্র জড়িয়ে থাকে তার অন্যতম উজ্জ্বল স্বাক্ষর এ কাহিনি ।

মরুর মায়া’’ যাযাবরদের গল্প। গল্পে তাদের জীবনচর্যা, পথ-প্রান্তর, খোলা আকাশের প্রতি টান, ঘর বাঁধার প্রতি ঔদাসিন্যের কথা যেমন আছে, তেমনি আছে তাদের স্নেহ ভালোবাসার জন্যে কাঙালপনা অথবা অপরাধ প্রবণতার কথাও। গৃহস্থের বাড়িগুলি দেখে ওদের মনে হয়, ওই খাঁচায় পাখির মত থাকার চেয়ে মাঠ ময়দান ভাল। তাতে কত দেশ, কত জঙ্গল, কত পাহাড়, কত নদী, কত মুলুক দেখা যায়। অন্যদিকে গ্রামের গৃহস্থদের কাছে এরা সর্বতভাবে বর্জনীয়। অসভ্য, বর্বর ও অমার্জিত মানুষ। তবে লেখকের হৃদয় যে খোলা আকাশ। সব শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতা। এই হৃদ্যতার কারণেই ঝিনুকের বুক থেকে মুক্ত তুলে আনেন তিনি। আমাদের সামনে তুলে ধরেন সেই অমূল্য রত্ন। আমাদের চারিপাশের ছোট্ট অঞ্চলটিও আসলে যে নানা স্তরের, নানা সমাজের কোলাজ, নানা জাতি, ভাষা আর বৈচিত্রের মানুষে ভরা এ বিপুল দেশের ক্ষুদ্র সংস্করণ তা প্রতিবিম্বিত হয় তাঁর কাহিনির দর্পণে।

লাল কাঁকরে ভরা অসমতল একটি প্রান্তরের ছবি বর্ণিত হয় গল্পের শুরুতে। লাল মাটির রাঢ় অঞ্চলে, একটি গ্রাম থেকে আর একটি গ্রামের মাঝে যেমন পড়ে আদিগন্ত কৃষি জমি, তেমনি পরিত্যক্ত নিষ্ফলা প্রান্তরও পড়ে। মরু অঞ্চল না হলেও একখণ্ড মরুভূমির মতোই খোলা প্রান্তর পড়ে থাকে গ্রামের বাইরে। সেই প্রান্তরই সহসা ভরে উঠে একদল ভ্রাম্যমান মানুষের আগমনে। লেখকের বর্ণনায়, ‘মুক্ত প্রান্তর একদিন মানুষের কোলাহলে মুখরিত হইয়া উঠে; ছোট ছোট তাঁবু পড়ে, খটাখট খুঁটা গাড়া হয়-। খুঁটায় বাঁধা হয় কুকুরের দল, সবল, দীর্ঘদেহ, হিংস্র- দীপ্তি- ভরা দৃষ্টি।’

এটুকু পড়েই স্মৃতিতে ভেসে উঠে বহুকাল আগের দেখা দৃশ্য। প্রাণে ভয় থাকলেও তীব্র কৌতূহলে আমরা ছুটে যেতাম দেখতে। দূর থেকে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখতাম, ওরা কী করে, কী ভাবে কথা বলে, কী খায়! কাছে যেতে সাহস হতো না। যদি ধরে নেয়! ‘হাঘরে’, ‘পাখমারা’ ‘বেদে’ বা ‘বাজকর’ শব্দগুলো খুব খারাপ আর গালাগালি বলেই জানতাম আমরা। বড়রা ভয় দেখাত, ‘ওরা ছেলেধরা। ধরে নিয়ে গেলে ওদের মতো করে দেবে। আর বাড়ি ফিরতে পারবি না।’      

(২)

আমাদের গ্রামে একটি বড় খেলার মাঠ ছিল। ‘কেলাবের ডাঙা’। ওখানে ছোটরা খেলতে যেত না। মেয়েরা তো যেতই না। ওখানে বড়রা ফুটবল, ভলিবল, ক্রিকেট অথবা হাডুডু খেলত। আমাদের খেলার জন্যে পার্ক বলেও কিছু ছিল না, ছিল পুকুরের পাড়। সেখানেই এক একদিন এক এক রকমের খেলা হতো। পাড়ার সকলের একটা করে খামারবাড়ি ছিল। দাদুদের দুইভাইয়ের খামারবাড়ির ক্ষেত্রফল ছিল একটি ফুটবল মাঠের সমান। সেই খামারবাড়িটা প্রায়শই আমাদের খেলার মাঠ হয়ে উঠত।

খামারবাড়ির কাছেই বড় রাস্তা। বোলপুর-লাভপুর সড়কপথ। ওই রাস্তা থেকে যেখানে একটা গলি রাস্তা আমাদের পাড়ায় ঢুকেছে সেখানেই আছে সাঁকো। বিকেলবেলা সাঁকোর পাড়ে বসে বড়রা গল্প করে। কোনও কোনোদিন অভিনব কিছু ঘটে যায় ওই রাস্তায়। আমরা খেলা ফেলে ছুটে দেখতে যাই।

এ অবশ্য বিকেলের কথা। সকালের দিকে আমাদের খেলেধুলোর অনুমতি নেই। পড়তে বসতে হয়। এবাড়ি, ওবাড়ির জানলাগুলো মুখরিত হয়ে উঠে পড়া মুখস্ত করার চিৎকারে। যার গলা যত বেশি শুনতে পাওয়া যায়, ছাত্র হিসেবে পাড়ায় তার তত সুনাম। সেই প্রাতঃকালীন বিদ্যাচর্চাতেও মাঝে মাঝে ছেদ পড়ে। সবার অনুভবে ধরা পড়ে, অভিনব কিছুর আগমন হয়েছে।

প্রতিদিনই সকাল থেকে কিছু ভিক্ষুক আসে। অনাথা, অশীতিপর বৃদ্ধবৃদ্ধা, কানা, খোঁড়া মানুষ ‘হরেকৃষ্ণ, হরিবোল’ বলে ভিক্ষাপাত্র এগিয়ে দেয়। একমুঠো চাল ওদের ঝুলিতে ফেলে দিলেই চলে যায় ওরা। ভেতর থেকে ‘ঘুরে এস’ বা ‘জোড়া হাত’ বললে উচ্চবাচ্চ না করে ফিরে যায়। কিন্তু যেদিন বাড়ির দরজায় একতারার টঙ্কার বা খোল খঞ্জনির আওয়াজ উঠে? তখন আমরা বই ফেলে ছুটে যাই। এবাড়িতে একটা গান শুনে পাশের বাড়িতে আর একটা গান শোনার লোভে ওদের পেছনে পেছন ঘুরি গোটা পাড়া। বাউলের দুপায়ে ঘুঙুর, হাতে একতারা অথবা বগলে গাবু, গায়ে আলখাল্লা আর মাথায় ঝাঁকড়া চুল। উঠোন জুড়ে নেচে নেচে গায়, ‘ও রং ফরসা বাহার দেখে পিরীত করো না’ অথবা ‘তু কেনে কাদা দিলি সাদা কাপড়ে’।

বৈষ্ণব বৈষ্ণবীরা আসে পরিষ্কার পরিছন্ন বেসে, কপালে গিরিমাটির তিলক। খঞ্জনি বাজিয়ে কীর্তনের পদ গায়। চন্ডীদাসের কত পদ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পড়ার আগে ওদের মুখ থেকে শুনেই মুখস্ত হয়েছে তা আবিষ্কার করেছি সেগুলো উঁচু ক্লাসে পাঠ্য বইয়ে পড়ার সময়।

‘পিরীতি সুখের      সায়র জানিয়া

নাহিতে নামিলাম তায়

নাহিয়া উঠিয়া       ফিরিয়া চাহিতে

লাগিল দুঃখের বায়’

অথবা

‘বঁধু কী আর বলিব আমি

জনমে জনমে       জীবনে মরণে

প্রাণনাথ হইয়ো তুমি।’

এই পদগুলি ওদের মুখেই প্রথম শোনা। পুরাণের অনেক গল্প প্রথম শোনা বহুরূপী বা পটুয়াদের কাছে।

আরও ছিল। বৃহস্পতিবারে গভীর রাত পর্যন্ত রাস্তায় গরুর পায়ের খুরের শব্দ উঠত খটখট খটখট। রাত শুনশান হয়ে গেলে উপরের বারান্দা থেকে শুনতে পেতাম। মানুষের গলার শব্দও আসত, ‘হা হা পা পা’। রাস্তা ভর্তি গরু নিয়ে ওরা চলেছে লাঘাটার দিকে ওখান থেকে কীর্ণাহার পেরিয়ে যাবে পাচুন্দি। তারাশঙ্করের একাধিক গল্পে এই গরুর হাটের কথা আছে। যারা গরু কেনাবেচা করে তাদের বলে পাইকার। শুনেছিলাম ওদের হাতে লাঠির ডগায় এক গোছা পেরেক লাগানো থাকে। গরু হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হলেই ওটা দিয়ে খোঁচা মারতেই গরু আবার ছুটতে শুরু করে।

একবার একপাল উটও যেতে দেখেছিলাম ওই রাস্তায়। একবারই। গুনেছিলাম, মোট ছাব্বিশটা উট। কোথা থেকে এল, কোথায় গেল সে রহস্য অবশ্য আমরা উদ্ধার করতে পারি নি।

আর ছিল বেদে আর বাজকর। হঠাৎ করেই ওরা আসত দল বেঁধে। বিশাল দল। সঙ্গে ছেলে, বুড়ো, যুবক, যুবতী, কুকুর, গাধা আর পোঁটলাপুটলি। এসেই তাঁবু গাড়তে শুরু করত। গ্রামের ভেতর খোলা প্রাঙ্গণ, ক্লাবের ডাঙা অথবা আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খোলা প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করত। কদিন থেকে ওরা চলে যাবে সবাই জানে কিন্তু গ্রামের ভেতরে কিছুতেই ওদের ঢুকতে দেওয়া হতো না। শেষে গ্রামের বাইরে পরিত্যক্ত জায়গা বা ভাগারের কাছাকাছি গিয়ে বসতি গড়ে তুলত। ইট দিয়ে তৈরি হতো উনুন। এরপর কদিন গ্রাম থেকেই ওদের উপার্জন হতো। পুরুষরা দড়িদরা নিয়ে ঢোল বাজিয়ে নানা রকম বাজীর খেলা দেখাত। কেউ পাখি শিকার করত। কেউ বহুরূপী সাজত। মেয়েরা গান গেয়ে, নেচে ভিক্ষা করত অথবা যাদুকরী তেল, মাদুলি এসব বিক্রি করত। গ্রামের শিশুরা ওদের গলা পেলেই ভয়ে লুকিয়ে পড়ত ঘরের কোণায়। বড়দের কোলে চেপে ভয়ে ভয়ে ভোজবাজী দেখত।

তবুও কিছু দুঃসাহসী বন্ধুর পাল্লায় পড়ে দূর থেকে ওদের দেখতে যেতাম। দেখতাম কালো অসুরের মতো চেহারার লোক একফালি নেংটি পরে আছে। পরম স্নেহে তার পোষা বাঘের মতো কুকুরের গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করছে। রোগা-প্যাংলা, গা ভর্তি ময়লা উলঙ্গ শিশু খেলছে ধুলো কাদা ঘেঁটে ঘেঁটে। মেয়েরা এ ওর চুল বাঁধছে, উকুন বেছে দিচ্ছে। উনুন থেকে ধোঁয়া উঠছে পাকিয়ে পাকিয়ে। এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছে উচ্ছিষ্ট, পাখির হাড় আর কালিঝুলি মাখা বাসনপত্র। একটা বোটকা গন্ধে ভারি হয়ে আছে চারিপাশ। নাক টিপে ধরে দেখতাম অচেনা ওই জীবনযাপন। ওই তাঁবুতেই মানুষকে মরতে দেখেছি আবার জন্মাতেও দেখেছি। এরপর হঠাৎই একদিন ওরা খুলে ফেলত তাঁবু। আবার বোঁচকা বেঁধে চলে যেত। তখন গ্রামের লোকে বলত, ‘শান্তি! আপদ বিদায় হল।’

(৩)

তারাশঙ্করের জীবনী’’ গ্রন্থে অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘তারাশঙ্করের প্রতিভার উৎসসন্ধানে তাঁর পূর্বপুরুষের কাহিনি যেমন অত্যাবশ্যক তেমনি তাঁর দেশকালের কথাও অপরিহার্য।’

তারাশঙ্কর বীরভূমের সন্তান। বীরভূম বীরের ভূমি। বীর শব্দের অর্থ জঙ্গল। উত্তররাঢ়ের এই অঞ্চল একদা ছিল বনজঙ্গলে ভরা। সেই কারণেই এই অঞ্চল ছিল আদিবাসী প্রধান। বহমান কালের স্রোতে সেই সব আদিবাসীদের জীবনযাপনের উপর হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব পড়লেও বহু উপেক্ষিত ও ব্রাত্য জনজাতি আজও তাদের পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকার বহন করে তাদের সংস্কৃতি ও জীবনচর্যায়।

পশ্চিমবঙ্গের লোক সংস্কৃতির গবেষক বিনয় ঘোষ বলেছেন, ‘নিষাদ ও দাস দস্যুদের বাস ছিল এই অঞ্চল থেকে সাঁওতাল-পরগণা ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। স্তরিত শিলার মত রাঢ়ের লোক সংস্কৃতির স্তরে স্তরে আদিম কৌম সংস্কৃতির উপাদান নানা রূপে ও বিচিত্র বিন্যাসে গ্রথিত হয়েছে।’

এদের মধ্যে হাড়ি, ডোম, বাগদী, বাউরীরাই প্রধান। এরা ওস্তাদ লাঠিয়াল হতো। চুরি, ডাকাতি ছিল এদের সবচেয়ে সম্মানীয় জীবিকা। আজও তাদের জীবনচর্যায় অনার্য সংস্কৃতির ছাপ স্পষ্ট।     যদুপতিয়া নামের একটি সম্প্রদায় এদিকে আছে। তারা হিন্দু ও মুসলমানের মাঝামাঝি। এরা মৃতদেহকে কবর দেয় আবার কালী, মনসার পুজোও করে। বিবাহিত মেয়েরা সিঁদুর পরে অথচ এদের বিয়েতে পৌরহিত্য করে কাজী। এরা কেউ বাজীকর, কেউ আবার পটুয়া।

কত ধরণের যাযাবর এই অঞ্চলে ছিল তার সম্যক ধারণা পাওয়া যায় তারাশঙ্করের ‘আমার কালের কথা’’ গ্রন্থে। তিনি বলেছেন ‘একদল দেশী যাযাবর আমাদের দেশে আছে। আমাদের অঞ্চলে বাজীকর বলে। এরা ম্যাজিক দেখায়। মেয়েরা নাচে, গান গায়। সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে এরা গান বাঁধে। মনে আছে ছোটবেলায় শুনেছি-

ও - মহারাণীর মিত্যু হ-ই-ল।

ও - বড়লাট ছোটলাট কাঁদিতে বসিল।’

এদের মেয়েরা সাজ পোশাকে বিলাসিনী। নকল গয়না ও শৌখিন শাড়ি পরে, নথ দুলিয়ে, ভুরু টেনে শরীরে হিল্লোল তুলে সুর করে কথা বলে গৃহস্থের দোরে এসে দাঁড়ায়। কোমরে হাতের কুনুই দিয়ে ধরে রাখে একটা ঝুড়ি। ঝুড়ি নামিয়ে, তুড়ি মেরে গান ধরে।

এছাড়া ছিল বেদের দল। পরুষ নারী নির্বিশেষে ওরা সাপ ধরত। ঝাঁপি খুলে সাপের নাচ দেখাত। তাঁবু, গরুর গাড়ী, গরু, মোষ, কুকুর নিয়ে আসত আর একটা দল। দলে পুরুষ নারী মিলে পঞ্চাশ থেকে চার পাঁচশ মতো লোক থাকত। পায়ে হেঁটে আসত। গ্রাম প্রান্তে গাছতলায় বাসা গাড়ত। শিকার করত ইঁদুর, সাপ ও পাখি। মেয়েরা দুপুরবেলা ভিক্ষা করত। ভিক্ষা করার নামে সুযোগ পেলেই হাতসাফাই করত।

অপেক্ষাকৃত সভ্য বেদের দলও আসত। তাদের মেয়েদের মাথায় রুমাল বাঁধা, পরনে ঘাগরা পাঞ্জাবি। পুরুষদের মাথায় পাগড়ী। এদের মুখের ভাষা মিষ্টি হলেও আচরণ নাছোড়বান্দা। আর ছিল সভ্য বেদে। এরা কেউ সাজত ব্রাহ্মণ পন্ডিত, কপালে তিলক, গলায় তুলসী বা রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে কমন্ডুলু। সংস্কৃত শ্লোক বলে এসে দাঁড়াত বাড়ির দরজায়।

লাভপুরের সামান্য দূরেই শীতলগ্রাম। ওখানে গেলে আজও কঘর বাজীকরের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। পাকুরহাঁসে দেখা পাওয়া যায় পটুয়াদের। সংখ্যায় নগণ্য হলেও বহুরূপীরাও আছে ওই অঞ্চলে।

(৪)

মরুর মায়া’ এমনই হাঘরে, চির পথিক, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত গৃহহীনদের গল্প। ওরা দল বেঁধে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যায়। সঙ্গে থাকে হিংস্র কুকুর অথবা ছোট ঘোড়া। দলের ভেতর ছোট ছোট পরিবার থাকে। ওদের জীবিকা নানাবিধ। পুরুষরা শিকার করে, বহুরূপী সাজে অথবা ভোজবাজী দেখায়। মেয়েরা মাদুলি, বাতের তেল, ধনেস পাখির হাড়, কুমিরের দাঁত ইত্যাদি বিচিত্র জিনিসপত্র বিক্রি করে অথবা নাচগান করে ভিক্ষা করে। সুযোগ বুঝে গৃহস্থের ঘর থেকে এটা ওটা চেয়ে বা কেড়ে নেয়। সন্ধ্যেবেলায় তাঁবুতে মাদল বাজে। মেয়েরা নাচে। বাচ্চারা বাঁধনহীন ঘুরে বেড়ায়। ওদের ভয় ডর নেই।

গল্পে এদের জীবনচর্যার পাশাপাশি উঠে আসে একটি পরিবারের কথা। ডগরু আর সানিয়া স্বামী-স্ত্রী। তাদের ছেলে ননকু। ননকু আর পাঁচটা ছেলের মতো দুঃসাহসী নয়। লেখকের কথায়, ‘সে যেন ফুলের তোড়ার মাঝে সৌখীনের রেশমের ফুল।’ আকাশ ভেঙে বর্ষা নামলে সব বাচ্চারা হুল্লোড় করে ভিজতে বের হয়, ননকুর বুকের ভেতরে তখন অজানা কষ্ট জেগে ওঠে। সে উদাস মনে বসে থাকে। ওর সহচরী কাজরী তাই ওকে বলে ‘ডর ফোকনা’ অর্থাৎ ভীতু।

ননকু যখন ওর মায়ের জন্যে কাঁদে, কাজরী সানিয়াকে ডেকে আনে। ননকুর কান্না তো থামেই না, উলটে সানিয়ার হাহাকার শুরু হয়। এখানেই প্রকাশিত হয় ননকু আসলে যাযাবরই নয়। সে চুরি করে আনা বাচ্চা। তবে তাকে আপন স্তন্য দিয়ে, পরম স্নেহে বড় করেছে সানিয়া। তবুও সে ভিন গাছের ছাল হয়েই রয়ে গিয়েছে। হাহাকারে সানিয়ার বুক ফাটে। ডগরু স্বান্তনা দিলে সানিয়া ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে, ‘বেইমান! সুখ তুই খুব দিলি, আবার ওই বেইমান দেবে। একই জাতের বাচ্চা রে তোরা।’

এই ননকুই আবার তার বাপজী ডগরুর বুকের কাছে এসে শান্তি পায়। আর কাজরীর সঙ্গে ননকুর বিয়ে হবে বললে কাজরী তীব্র আপত্তি করে, ‘উ ডর ফোকনাকে আমি সাদি না করব।’

এভাবেই কতদিন কেটে যায়! কত গ্রাম, কত প্রান্তর পেরিয়ে যায় ওরা। ননকু জওয়ান হয়। কাজরীও কৌতুকচপল কিশোরী। দুজনের প্রণয় হয়। মরুর মোহে ডুবে গিয়েও ননকুর উদাসী ভাব কাটে না। ওর এই রীত কাজরীর ভালো লাগে না।

আরও দিন কাটে। ডগরু মৃত্যুশয্যায়। ননকুর মন ভালো নেই। ডগরু সানিয়ার কাছে অনুনয় করে বলে, ‘সেই কাগজটা!’ সানিয়া পুরনো ঝাঁপি থেকে একটি বিবর্ণ কাগজ বের করে দিলে সেটি পড়াতে নিয়ে যায় ননকু। উদ্ধার হয়, তাতে লেখা আছে, ‘অবিনাশ চৌধুরী, জমিদার নগাঁও, জেলা নদীয়া।’ প্রকাশ পায় ডগরু আসলে জমিদারের ছেলে, সানিয়ার বাবা তাকে চুরি করে এনেছিল। এ খবরে ননকু চমকে উঠে। ওর বুকের ভেতরে জমে থাকা একটা ছবি স্পষ্ট জেগে ওঠে। সে শুধোয়। ‘আওর হাম?’

সানিয়ার হুমকি অগ্রাহ্য করে মৃত্যুশয্যায় শায়িত ডগরু স্বীকার করে, সেও বাঙালী। বর্ধমানের কালীপুরের জগদীশ রায়ের ছেলে সে। ডগরু তাকে চুরি করে এনেছিল।

এক লহমায় সেই ছোটবেলায় অকারণ মন খারাপ হওয়ার কথা মনে পড়ে যায় ননকুর। ছায়ানিবিড় একটা গ্রাম, ঝকঝকে তকতকে ছবির মত বাড়ি, মুখ মনে না পড়া এক বাঙালী নারী ভেসে ওঠে ওর মানসপটে। প্রচন্ড রাগে সে প্রথমে ডগরুকে মেরে ফেলতে উদ্যত হয়। তারপর বেরিয়ে যায় তাঁবু ছেড়ে। কাজরীর ডাকেও সাড়া দেয় না। সঙ্গে যায় ওর পোষা কুকুর, শের। দিকভ্রান্তের মতো চলতে চলতে এক সময় ননকুর উত্তেজনা প্রশমিত হয়। একটি বাড়ির দাওয়ায় ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দেয় সে। তারপর ওর মানসিক অবস্থা বর্ণনা করেছেন লেখক, ‘ননকু চারিদিক পানে তাকাইয়া দেখে; তাহার গরম বোধ করে, গা দিয়া ঘাম ঝরে। অনন্ত কুটিল বন্ধন চারিধারে- অপ্রশস্ত দীর্ঘ ফালি পথখানি, দুধারে তার বাড়ির বেষ্টনী। মাথার উপর আকাশ- তায় গাছের আচ্ছাদনে ঢাকা, নজরে পড়ে শুধু টুকরা টুকরা আকাশের অংশ। ননকুর মনে হয় একটা অবরোধ। একটা বড় পিঁজরা।’

ননকু ভাবে, ‘এমনই গ্রামখানির একখানি বাড়িতে বাঙালী নারীর বুকে সে ঝাঁপাইয়া পড়িবে, মাইয়া গে- কিন্তু, কিন্তু তাহারা তাহাকে লইবে তো?’

ননকুর আর গ্রামে ফেরা হয় না। সে ফিরে যায় প্রান্তরে। যেখান থেকে উদভ্রান্ত ননকু বেরিয়ে এসেছিল সেখানকার মেয়াদ তখন শেষ হয়েছে। খোঁটা তোলা হচ্ছে, তাঁবু গোটানো চলছে। পোঁটলাপুটলি বাঁধছে সবাই। এবার যাবে অন্য কোনও প্রান্তরে। ননকুও কাজরী আর শেরকে সঙ্গে নিয়ে মিশে যাবে ওই দলে।

এ লেখার শুরুই করেছিলাম ছবির কথা দিয়ে। গল্প শেষ হয়ে গেলেও সে ছবি যেন ফুরোয় না। চোখের আড়ালে হয়ে গেলেও তা থেকে যায় সমাজের কোনও এক কোণে। সভ্য সমাজের ফাঁকে ফাঁকে বর্বর, অনার্যদের প্রান্তর থেকে প্রান্তর ভ্রমণ চলতেই থাকে, যেমন সভ্য ভারতবর্ষের শিরায় শিরায় অনন্তকাল ধরে বয়ে চলে অনার্য ভারতের শোণিত।