নারীদিবসের উত্তরাধিকার
- 07 March, 2021
- লেখক: শতাব্দী দাশ
ছয় নম্বর তিহার জেলে দেবাঙ্গনা কালিতা ছবি আঁকে। আজ একবছর ধরে সে বন্দী রাজদ্রোহের অপরাধে। এনআরসি-সিএএ আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে অংশ নিয়েছিল সে, নাতাশা, গুলফিশা। দিল্লির দাঙ্গার পর বলা হল, সেই আন্দোলন নাকি দাঙ্গায় উস্কানি দিয়েছে। একদিকে দেবাঙ্গনারা, অন্যদিকে সফুরারা বন্দী হল। অথচ যারা সত্যি দাঙ্গায় ইন্ধন দিল, স্লোগান দিল 'গোলি মারো সালোকো' বা সত্যি গুলি ছুড়ল, তারা জেলের বাইরেই রইল।
দেবাঙ্গনা তিহার জেলে বসে আঁকল, মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে মৎসকন্যারা সাঁতার কাটছে অলীক রাজ্যে মাছেদের সঙ্গে। ছবির নাম দিল 'সুলতানা'স ড্রিম', যা বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতকে মনে করায়। রোকেয়ার একটি ইউটোপিয়ান ছোটগল্প, ১৯০৫ সালে রচিত, হল 'সুলতানার স্বপ্ন', যেখানে ভারতের তথা (হয়ত) বিশ্বের প্রথম ফেমিনিস্ট ইউটোপিয়ার ছবি তিনি এঁকে ফেলেছিলেন। 'সুলতানা'স ড্রিম' - এর ইউটোপিয়ায় নারীরা স্বাধীনভাবে বিচরণ করে। পুরুষরা বদ্ধ থাকে, কারণ তারাই উন্মত্ত আচরণ করে। আবার অনুশোচনা করে শুদ্ধ হলে তারাও মুক্ত হয়।
এক দিকে বন্দী দেবাঙ্গনা কালিতা গারদ-যন্ত্রণায় মধ্যে মুক্তির সেই অলীক রাজ্য আঁকেন। সখিত্ব আর সংহতির কল্পরাজ্য, যা মানচিত্র মানে না৷ অন্য দিকে সুপ্রিম কোর্ট কৃষাণিদের বলে 'মেয়েরা আবার আন্দোলনে কেন?' ধর্ষককে বলে, 'ধর্ষিতাকে বিয়ে করতে চাও?' নির্যাতিতাকে বলে, 'স্বামী-স্ত্রীর মতো সহবাসের ক্ষেত্রে স্বামীর আচরণ যতই নির্মম হোক, তার যৌনকার্যকে কি ধর্ষণ বলা যায়?' পুলিশ জ্বালিয়ে দেয় ধর্ষিতার দেহ অন্ধকারে। জাতীয় পতাকা হাতে ধর্ষকের সমর্থনে মিছিল বের হয়। আক্ষরিক অর্থে ও রূপকার্থে 'নাগরিকত্ব' হারায় নারী।
তবু দেবাঙ্গনা কালিতা ছবি আঁকে। এবং একটি নারীদিবস আবারও এসে পড়ে শপিং মলে, কফি শপে আর হীরের দোকানে 'ছাড়'-এর হাতছানি নিয়ে৷ এসে যখন সে পড়েছেই, তখন তার ইতিহাসকে পুনরুদ্ধার করা যাক। 'নারীদিবসের' পরত ছিঁড়ে 'আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারীদিবস'-কে উদ্ধার করা যাক৷ সেই ইতিহাসে যে প্রতিস্পর্ধা আছে, তা বর্তমান লড়াই-এ পাথেয় হোক।
সাল ১৯০৮, স্থান আমেরিকা। নিউ ইয়র্ক তখন বস্ত্রশিল্পের মূল কেন্দ্র। কর্মীদের ৭০%-ই মেয়েরা৷ অথচ তাদের বরাদ্দ নয় ন্যায্য মজুরি। দৈনিক ৩ থেকে ৪ ডলার পেতেন তাঁরা ( যা থেকে নিজেদেরই কিনতে হত সূচ, সুতো), যেখানে ছেলেদের প্রাপ্য ৭ থেকে ১২ ডলার। বারো ঘণ্টার উপরে শ্রম, আলো-বাতাসহীন ঘুপচি ঘর -এই নিয়ে জীবন। কোথাও আবার কাজ চলাকালীন শৌচাগারে যাওয়ারও অনুমতি ছিল না। ১৮৮৭ সালের আন্দোলনের পর ছেলেদের দৈনিক আট ঘণ্টা কর্মদিবস, উপরি বা বাথরুম ব্রেক- এসব প্রাপ্য হয়েছিল। কিন্তু মেয়েদের জন্য এত সুবিধা কোথায়? তারা তো ভোটারও নয় সে সময়ে। তাদের নেই ইউনিয়ন। কে কর্ণপাত করবে তাদের কথায়?
অগত্যা বাড়ির সমস্ত কাজ সামলে সপ্তাহে পঁচাত্তর ঘণ্টা অবধি কাজ করতে হত তাঁদের। মালিকের মর্জিমাফিক যখন তখন কেটে নেওয়া হত মাইনে, দিতে হত ফাইন। তাই সে বছর (১৯০৮ সালে) ৮ই মার্চ পনের হাজারেরও বেশি মহিলা শ্রমিক নিউ ইয়র্কের লোয়ার ইস্ট সাইট থেকে ইউনিয়ন স্কোয়ার অবধি মিছিল করেন। ভোটদানের অধিকার, মাইনে বৃদ্ধি, এবং শ্রমকাল হ্রাস- এই ছিল দাবি। সেই মিছিলকে সম্মান জানিয়ে আমেরিকার সোস্যালিস্ট পার্টি পরের বছর ১৯০৯ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারিকে 'জাতীয় নারী দিবস' বলেঘোষণা করে।
আবার সেই মিছিল থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে, ১৯০৯ সালের ২২শে নভেম্বর, ক্লারা লেমলিক নামের এক পরিযায়ী ইহুদি শ্রমিক ছেলেদের ইউনিয়নের মিটিং-এ দাঁড়িয়েই মহিলা শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। তিনি সাধারণ ধর্মঘট ডাকেন। দুদিন পর, ২৪শে নভেম্বর তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে পনের হাজার মেয়ে নিউ ইয়র্কের রাস্তায় নামল। পরের ক'দিনে আরও হাজার পাঁচেক। দাবি -কাজের অবস্থার উন্নতি, উপযুক্ত মাইনে, আর ছেলেদের সমান কাজের পরিবেশ। পুলিশ লাঠি চালাল৷ ক্লারার পাঁজরের খান পাঁচেক হাড় ভেঙেছিল। দিনটি ইতিহাসে 'আপরাইজিং অব টোয়েন্টি থাউজেন্ড' নামে খ্যাত। ধর্মঘটের স্লোগান হয়ে দাঁড়িয়েছিল 'রুটি আর শান্তি'। প্রতীক হয়ে উঠেছিল রুটি আর গোলাপ, যা খাদ্যের আর মর্যদার অধিকারের প্রতীক। চারমাস পরে ধর্মঘট উঠেছিল ১০ই ফেব্রুয়ারি, ১৯১০ সালে। ততদিনে অধিকাংশ কারখানাতেই মেয়েরা মালিক বা ইউনিয়নের তরফ থেকে আশ্বাস পেয়েছে যে তারাও ভদ্রস্থ মাইনে পাবে, আটঘন্টার বেশি কাজ করলে উপরি পাবে, পাবে ইচ্ছেমতন বাথরুমে যাওয়ার অধিকার।
এই আন্দোলনকে স্বীকৃতি দিতেই ১৯১০ সালের ২৮ শে ফেব্রুয়ারি কোপেনহেগেনে সোস্যালিস্ট ইন্টারন্যশনালে একটি নির্দিষ্ট দিনকে আন্তজার্তিক শ্রমজীবী নারী দিবস হিসাবে ঘোষণার প্রস্তাব দেন ক্লারা জেটকিন। সেই প্রস্তাব গৃহীত হলেও নির্দিষ্ট কোনও দিন ঠিক হয়নি সমাবেশে।
১৯১১ সালে ১৯ শে মার্চ প্রথম আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস উদযাপিত হয়। জার্মানি, সুইৎজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়ায় এই দিনটি পালন করেন লক্ষাধিক মেয়ে। এর এক সপ্তাহের মধ্যে ঘটে এক দুর্ঘটনা। নিউ ইয়র্কের ট্রায়াঙ্গেল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরি ফায়ারে পুড়ে মারা যান একশ ছিচল্লিশ জন মহিলা শ্রমিক। কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষার প্রশ্ন ঘিরে নতুন করে আবার আন্দোলন শুরু হয়।
১৯১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ রবিবার প্রথমবার রাশিয়ার মেয়েরা আন্তজার্তিক শ্রমজীবী নারী দিবস পালন করেন। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হল। ১৯১৭ সালে রাশিয়ার রাস্তায় যুদ্ধবিরোধী শ্রমিক মেয়েরা নামেন সেই একই 'রুটি আর গোলাপের' স্বপ্ন নিয়ে। তারিখটা ছিল ফেব্রুয়ারির শেষ রবিবার (পশ্চিমি বা জর্জিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৮ মার্চ)। একই দিনে বিশ্বশান্তির পক্ষে মিছিল করেন আরও কিছু দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মেয়েরা৷
এই ঘটনার ঠিক চার দিন পর ১২ই মার্চ জারের পতন হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাশিয়ান মহিলাদের ভোটাধিকার দেয়। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে আন্তর্জাতিক নারীদিবস উদযাপন শুরু হয়। তবে তখনও তা মূলত ইউরোপ আর আমেরিকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল।
১৯৭৫ সালটিকে ইউনাইটেড নেশন আন্তর্জাতিক নারী বছর হিসাবে ঘোষণা করে এবং ৮ই মার্চকে 'আন্তর্জাতিক নারী দিবস'-এর স্বীকৃতি দেয়। 'শ্রমজীবী' শব্দটি বাদ যায়। কিন্তু বাদ দিলেই কি আর শ্রেণি ও লিঙ্গের ইন্টারসেকশনালিটি মুছে ফেলা যায়?
আজও সব মেয়েরাই আদতে শ্রমজীবী। শুধু পারিশ্রমিক পান কেউ কেউ। যেমন পারিবারিক কাজের বা গৃহশ্রমের আজও কোনো পারিশ্রমিক নেই।
আজও মেয়েদের অধিকাংশের নেই জমি বা সম্পদের মালিকানা। ছাঁটাই-এর শিকার পুরুষের চেয়ে বেশি মেয়েরা। এনআরসিতে নাগরিকত্বও মেয়েরাই হারান বেশি। বিনে পয়সার যে শ্রম মেয়েরা দেন বিশ্ব জুড়ে, তার অর্থমূল্য নাকি 'অ্যাপেলের' বার্ষিক আয়ের তেতাল্লিশ গুণ!
অথচ বাইরে তো নয়ই, রাষ্ট্রসংঘের রিপোর্ট অনুসারে গৃহেও অসুরক্ষিত মেয়েরা। আর সেই মেয়েরাই যদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মাথা তোলে ?
সাম্প্রতিক ভারতে সোশাল মিডিয়ায় সরব মেয়েদের ধমক, ধর্ষণের হুমকি জুটতই। চলতি ভাষায় যাকে বলে ট্রলের অত্যাচার৷ কিন্তু এখন ট্রলের জায়গা নিয়েছে রাষ্ট্র স্বয়ং। প্রতিবাদের অধিকার যে নেই নারীর, তা বারবার চোখে আঙুল তুলে বোঝাচ্ছে খোদ সরকার।
দলিত আর মুসলিম নারীর উপর সরকারের রাগ আরও বেশি৷ সফুরা, দিশা, নোদীপ, দেবাঙ্গনা, নাতাশা, গুলফিশা, ইশরাত, সোমা সেন, সুধা ভরদ্বাজ… উদাহরণ ফুরোয় না। এঁরা সকলেই কোনো না কোনো ভাবে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার। অরুন্ধতী রায়, কবিতা কৃষ্ণণ, রাণা আয়ুব….এঁরা সকলেই নিত্য লাঞ্ছিত হন সমাজমাধ্যমে। কারণ ফ্যাসিবাদ কখনও নারীবান্ধব হয়নি৷ যে কোনো সরকারই নারীর প্রতি হিংসায় ঔদাসীন্য দেখায়। বারবার তাকে মনে করিয়ে দিতে হয় নারীর অধিকার। তবু অতি দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিস্ট সরকার নারীবিদ্বেষে আলাদা মাত্রা যোগ করে। তা ঐতিহাসিক ভাবে নারী-অধিকার-বিরোধী।
ফ্যাসিজম দেশকে 'নারীর মতো রক্ষনীয়' ভেবে পূজা করে। অথচ ব্যক্তিনারী হয় লাঞ্ছিত। ফ্যাসিজমে জাতিগত উচ্চম্মন্যতার প্রতিনিধি সর্বদাই উচ্চবংশীয় উচ্চবর্ণীয় পুরুষ, কখনও নারী নয়। ফ্যাসিজম যে নেতার প্রতি অন্ধ আসক্তি দেখায়, সেই নেতাও সর্বদাই এক পুরুষ, সে হিটলার বা মুসোলিনি বা মোদি, যেই হোক। ফ্যাসিজম বিশ্বাস করে, নারীর স্থান গৃহে, তার ভূমিকা গেরস্তালি কাজ, পরিচর্যা ও সন্তান উৎপাদন। সীমা-অতিক্রমকারী নারীকে সে সহ্য করবে কী করে? সে নারী হিন্দু-রাষ্ট্রের খোপে আঁটে না৷
অথচ ক্লারা লেমলিক থেকে ক্লারা জেটকিনদের উত্তরসূরী এই সীমা-লঙ্ঘনকারী মেয়েরাই৷ পেন্ডেন্ট-শোভিতারা নন, পরিবার বা রাষ্ট্রের প্রতি অবনতারা নন। সুতো কল থেকে যে লড়াই শুরু হয়েছিল, সে লড়াই নতুন নতুন রূপে ফিরে এসেছে কালে কালে। আমাদের স্থানে ও কালে সে লড়াই ফ্যাসিবাদী পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে। সে লড়াই-এ স্লোগান আছে। মিছিল আছে। আবার দেবাঙ্গনার আঁকা অলীক রাজ্যের ছবিও আছে। রোকেয়ার কল্পরাজ্যই পারে হিন্দুরাষ্ট্রের বিকৃত ফ্যান্টাসির বিপ্রতীপে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে।