মেলা ও দধিয়া – বৈরাগীতলা : আমার চোখে তারাশঙ্করের গল্পভুবন
- 07 March, 2021
- লেখক: নীতা মণ্ডল
(১)
‘মেলা’ গল্পটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৩ সালে বঙ্গশ্রীর বৈশাখ সংখ্যায়। প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল সন্ধ্যামণি। সেই সময় বেশ কিছুদিন তারাশঙ্কর কলকাতায় ছিলেন, শ্বশুরবাড়ি সূত্রে আত্মীয়বাড়িতে। তারপর কিছুদিনের জন্যে গ্রামে ফিরে এলেন। সামনে বড়ছেলের উপনয়ন। কিন্তু দেশে ফিরে শান্তি পেলেন না। গ্রামের অবস্থার সঙ্গে তিনি আর সেভাবে খাপ খাইয়ে উঠতে পারছিলেন না। এর আগে রাজনীতি করেছেন। কিন্তু সেই মুহূর্তের গ্রামের রাজনীতি, দলাদলির বিদ্বেষে জর্জর। আজন্ম চেনা মানুষজন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে তাঁর নিজের প্রকৃতি মিলছিল না। বড় নিঃসঙ্গ বোধ করছিলেন। তাঁর মানসিক অবস্থা তখন প্রচণ্ড অশান্ত। সেই অশান্তি কিছুতেই তাঁকে স্থির হয়ে বসতে দিচ্ছিল না। মন চাইছিল বেরিয়ে পড়তে, ছুটে যেতে একটা কিছুর সন্ধানে, যা তাঁর অচেনা, অজানা।
বন্ধু যামিনী রায় পূর্বেই তারাশঙ্করকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, কলকাতায় গিয়ে বসবাস করতে। বলেছিলেন, ‘শ্মশান না হলে শবসাধনা হয় না। প্রত্যেক সাধনায় সাধনপীঠের প্রয়োজন হয়। এ যুগে কলকাতাই হল বাংলার সাহিত্যের শিল্পের সাধনপীঠ।’ কথাটা তারাশঙ্করের তেমন ভালো লাগে নি। তাছাড়া তিনি যে কলকাতায় থাকবেন তার জন্যে যে অর্থের প্রয়োজন তা উপার্জন করার মতো অবস্থা তখন তাঁর ছিল না। মাসে অন্তত পঁচিশটাকা না হলে সে সময় কলকাতায় চলত না। বঙ্গশ্রীতে একটি গল্প প্রকাশিত হলে পাওয়া যেত পনের টাকা। একবার গল্প প্রকাশিত হওয়ার পর পরবর্তী গল্প প্রকাশিত হতে অন্তত ছয় মাস সময় লাগত। সেইজন্যে তিনি স্থির করেন দেশে থেকেই সাহিত্য সাধনা করবেন।
অতঃপর কাঁধে বোঁচকা বেঁধে তিনি নেমে পড়লেন পথে। মাঘ মাসে শ্রীপঞ্চমীর পরদিন শীতলাষষ্ঠীতে বৈরাগীতলায় মেলা বসে। লাভপুর থেকে মাইল পনের দূরে দধিয়া-বৈরাগীতলা। আঞ্চলিক মানুষ বলে, দৈদে-বরিগতলা। বৈষ্ণব সাধক গোপালদাস বাবাজীর আবির্ভাব তিথি উপলক্ষে মেলা বসে। গল্পে অবশ্য বলা হয়েছে, বাবাজীর মহাপ্রয়ান দিবসে মেলা।
মাঘমাসের প্রবল শীতে তারাশঙ্কর আশ্রয় নিলেন একটি গাছতলায়। ভাবলেন, ওই গাছতলা থেকেই তিনি মেলার রূপটি ধরবেন। রাত্রি তিনটে পর্যন্ত মেলার পথে পথে ঘুরলেন। জুয়ার আসরের পাশে দাঁড়িয়ে দেখলেন এক প্রকার উন্মত্ত জনতা। প্রকাশ্য বেশ্যা-বাজারের মধ্যে দাঁড়িয়ে দেখলেন একশ্রেণীর মানুষের পাশবিক উন্মাদনা। তারপর ক্লান্ত হয়ে ফিরে হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় গাছতলায় খড়ের বিছানার উপর লণ্ঠনের শিখা বাড়িয়ে দিয়ে খাতা পেন্সিল নিয়ে বসে সূত্রপাত করলেন ‘মেলা’ গল্পটির।
ইট দিয়ে উনুন তৈরি করে একবেলা খিচুড়ি রান্না করে তাই দিয়ে দুবেলা উদরপূর্তি করেন। কাটিয়ে দেন তিনটি দিন। লিপিবদ্ধ করেন এক বিচিত্র সামাজিক চালচিত্র। মেলার বৈচিত্রময় নানান দিক ধরা পড়ে কথাশিল্পীর চোখে। সৃষ্টি হয় গল্প। ঠিক যেন ছবি। সে ছবি দিন ও রাত্রির। সে ছবি আলো ও অন্ধকারের। বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্রে তা মানব চরিত্রের মতোই রহস্যময় এবং বর্ণময়।
(২)
বীরভূম জেলার সমাজ জীবনের অন্যতম অঙ্গ সম্ভবত গ্রাম্য মেলাগুলি। বারোমাসে তেরো পার্বণের মতো ঢিল ছোড়া দূরত্বে বারোমাসে গোটা তেরোটি মেলা অনায়াসে খুঁজে পাওয়া যায়। মেলাগুলির বেশিরভাগই অখ্যাত। যেমন আমাদের গ্রামেই বছরে দুটো মেলা হয়। একটি মাঘমাসে, অন্যটি চৈত্রমাসে। আমাদের গ্রামদেবতা ইন্দেশ্বর। গ্রামের নাম ইন্দাশ। গ্রামের নাম থেকে শিবের নামকরণ নাকি শিবের নাম থেকে গ্রামের সে বিষয়টি আজও বিতর্কিত। যাই হোক, মোট কথা পুজো উপলক্ষ্যে মেলা হয়। দুটি মেলাই সেভাবে প্রচারিত নয়। আশেপাশে হাঁটা দূরত্বের গ্রামগুলি থেকেই মূলত কিছু মানুষ আসেন। পাশাপাশি গ্রামগুলির মধ্যে কোনটিতে মনসাপুজোয় মেলা বসে, কোথাও কালীপুজোয়। স্কুলের ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে অন্য গ্রামে মেলায় চলে যায় সুযোগ পেলেই। কারণ প্রত্যেক মেলার অন্যতম আকর্ষণ মচ্ছোব। বনভোজনের মতো মাঠের ধুলোর উপর বসে সে অমৃত গ্রহণ করা শিশুদের কাছে আনন্দের, বয়স্কদের কাছে পুণ্যের।
আশেপাশে যখন যে মেলাই বসুক না কেন, শীতকালটা যেন মেলার ঋতু। ওই সময় মেলার ঢেউ আট থেকে আশি, গরিব থেকে ধনী এবং পুরুষ থেকে নারী সবার উপর আছড়ে পড়ে। গ্রামে গ্রামে ধান কাটা শেষ হয়। মানুষের হাতে খানিকটা ফাঁকা সময় ও বাড়তি পয়সা দুই থাকে। তারা চায় উৎসব, আনন্দ, ভ্রমণ। চায় আপন গৃহেকোণের বাইরে হাজার মানুষের একজন হয়ে উৎযাপন করতে।
গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের হাতে সারাবছর পয়সার জোগান থাকত না। তখনও বাজার এত প্রসারিত হয় নি যে, বছরভর হাতের কাছে ইচ্ছে মতো বা প্রয়োজন মতো দ্রব্যটি পাওয়া যাবে। তাই মনে থাকত অপেক্ষা। সেই অপেক্ষার নিরসনে অন্যরকম আনন্দ ছিল। হয়ত প্রৌঢ়ার ঠাকুরঘরের শাঁখ, কম্বলের আসন বা ঠাকুরের নামাবলির প্রয়োজন অনেকদিনের। হয়ত বাড়ির গিন্নীর তিলের খোসা ছাড়ানোর জাঁতাটি ভেঙে গিয়েছে। সে জাঁতা পাথরের নয়, কুমোরের তৈরি মাটির জাঁতা। সে কি আর যেখানে সেখানে পাওয়া যায়? সে পাওয়া যায় কেবল বরিগতলার মেলায়। এতদিন প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে কাজ চালিয়ে নিলেও এবার কিনতে হবে। কারোর হয়ত লাঙ্গলের কাঠে ঘুণ ধরেছে, ভালো বাবলা কাঠের প্রয়োজন। কারোর মাছ ধরার শখ আছে। সে চায় একটা ছোটখাট জাল। যাতে একাই খ্যা দিয়ে (জাল বিছিয়ে) মাছ ধরা যাবে। বালকবালিকাদের চাহিদা খেলনা আর সাজগোজ।
মোটামুটিভাবে এই ছিল পল্লীজীবনে একটি মেলার অবদান। বিনোদন সম্পর্কে সম্যক ধারণা ছোটবেলায় না থাকলেও আরও আকর্ষণীয় কিছু যে মেলায় থাকে তা বুঝতে অসুবিধা হতো না। মেলার বিনোদন ব্যবস্থা নিয়ে মাইকে বিপুল প্রচার হতো গ্রামে গ্রামে। সাদাকালো পোস্টার আটার লেই দিয়ে আটকে দিয়ে যেত ঘুঁটের ছাপ ওয়ালা দেওয়ালের দেওয়ালে। কেউ আবার কয়েকদিন মেলাতেই কাটিয়ে এসে গল্প করত, সারারাত বাউলের আখড়ায় কাটিয়ে আসার, আলকাপ অথবা যাত্রাপালা দেখার অভিজ্ঞতা।
এইসব মেলাগুলি সাধারণত দল বেঁধে যাওয়া হত। রাস্তায় অতিরিক্ত বাসের জোগান দিত প্রশাসন। তবে সব মেলা তো রাস্তার ধারে বসে না। কোনটা বসে গ্রামের ভেতর, কোনটা গ্রামের প্রান্তে, কোনটা আবার নদীর ধারে। সেই মতো গোরুর গাড়ি আসত গ্রামান্তর থেকে। বহু মানুষ আসত পায়ে হেঁটে।
প্রতিটি মেলার নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। সে হতে পারে মেলায় বিক্রীত বহুল জনপ্রিয় দ্রব্য অথবা মেলার বিশেষ বিনোদন ব্যবস্থা কিমবা মেলার নেপথ্যের ইতিহাস। যেমন বল্লভতলার মেলা মাটির বাসনের জন্যে খ্যাত আর মহেশপুর বিখ্যাত শোলার শিল্পদ্রব্যের জন্যে। সেটাকেই ছড়ায় বলা হত,
‘ময়শাপুরের মেলা, কলা আর শোলা।
বল্লভতলার মেলা, হাঁড়ি আর হোলা।...’
জয়দেব কেঁদুলির মেলা বিপুল জনপ্রিয়। বহু পুণ্যলোভাতুর মানুষ অন্তত জীবনে একবার যেতে চাইত সেখানে। বহু দরিদ্র, অশীতিপর বৃদ্ধবৃদ্ধা নামমাত্র সম্বল হাতে নিয়ে তাঁরই মতো অথর্ব সঙ্গীর উপর ভরসা করে বেরিয়ে পড়েন। গঙ্গাসাগর অনেক দূর, সে তুলনায় জয়দেব ‘ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া’। কমবয়সীরা ঠাট্টা করে বলত,
‘ঘটিবাটি কি বিত্যি!
জয়দেব কি তিথ্যি!’
অর্থাৎ ঘটিবাটি বিক্রয়ের মধ্যে যেমন কৌলীন্য নেই, তেমনি তীর্থ হিসেবে জয়দেবেরও কৌলীন্য নেই।
তবুও দলে দলে মানুষ যায় কিছু একটার আকর্ষণে। পৌষের হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডায় কদমখন্ডীর ঘাটে মকরস্নান করে। শুষ্ক অজয়ের বালি খুঁড়ে একঘটি জল মাথায় ঢেলেই বহু আকাঙ্ক্ষিত পুণ্য অর্জন করে। মেলায় অগুনতি আখড়া ও বাউল-কীর্তনের আসর। কত আখড়া স্থায়ী! আঞ্চলিক মানুষ এই সময় এসে দুবেলা অন্ন দান করে। কত অস্থায়ী আখড়াও আসে। সেখানে বিনাপয়সায় ভরপেট খাবার মেলে। সারারাত কীর্তন বা বাউলগান শুনে কাটানো যায়। ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দেওয়া যায় আসরের শতরঞ্চের উপর। তার নীচে মোটা খড়ের গদি। ওই ঠাণ্ডায় মানুষ সত্যি কিসের সন্ধান পায় জানা নেই।
(৩)
বীরভূমের সর্বাধিক জনপ্রিয় জয়দেবমেলা বা শান্তিনিকেতনের পৌষমেলাকে বাদ দিলেও বেশ কিছু বড় মেলা বসে গোটা শীতকাল জুড়ে। তার মধ্যে লাভপুরের ফুল্লরার মেলা এবং লাভপুরের অনতিদূরে দৈদে-বরিগতলার মেলা বৈচিত্র বা জনপ্রিয়তায় তুচ্ছ নয়। মেলাদুটির সঙ্গে পুণ্য সঞ্চয়েরও যোগ আছে। ফুল্লরা বা অট্টহাস, একান্ন সতীপীঠের একটি। মেলা হয় মাঘীপূর্ণিমায়। বরিগতলার মেলা শুরু হয় মাঘমাসের শ্রীপঞ্চমীর পরদিন। একজন বৈষ্ণবসাধকের আবির্ভাব তিথি উপলক্ষে।
নিকটবর্তী গ্রামগুলির মানুষ তো বছর বছর যায়ই, সামান্য দূরের গ্রামের মানুষ যায়, অন্তত একবার ইচ্ছেপূরণ করতে। চারিদিকের গণ্ডগ্রামগুলি থেকে গোরুর গাড়িতে দলে দলে মানুষ আসে। মেলা বসে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। ফাঁকা মাঠ, প্রান্তর ভরে যায় তাঁবুতে। মাঠেরই একপ্রান্তে গোরুর গাড়িগুলি রাখা হয়। বাড়ির মহিলাদের নিয়ে আসে গাড়িগুলি। তাছাড়া মেলায় পাথরের, লোহার বা মাটির জিনিসপত্র কিনলে তা বয়ে নিয়ে যেতে সুবিধা হয়। বর্তমানে দৃশ্য অবশ্য বদলেছে। এখন টোটো চলার ফলে পায়ে হেঁটে বা গোরুর গাড়িতে যাওয়ার চল তেমন নেই। দলগুলিও ছোট হয়ে এসেছে।
মেলা ভিন্ন হলেও তা সাজানো গোছানো বা ব্যবস্থাপনার মধ্যে বেশ কিছু সাদৃশ্য ছিল। মেলাগুলির প্রত্যেকটিতে সাংসারিক জিনিসপত্রের বিকিকিনি চলত। দোকানগুলি বসত মালপত্রের ভিত্তিতে আলাদা আলাদা পট্টি বা পটীতে বিভক্ত হয়ে। যেমন লোহাপটী, কুমোরপটী, কামারপটী, ছুতোরপটী, মনিহারী, কাপড়পটী ও ময়রাপটী ইত্যাদি।
বিনা পয়সায় অন্নমচ্ছোব জুটলেও ময়রার দোকানে বসে মন ভরে না খেলে মেলা দেখা সম্পূর্ণ হতো না। বিনোদনপটীতেই তাঁবুগুলো সবচেয়ে বড়। কোথাও ঢোকার মুখে বসানো আছে রহস্যময় মূর্তি। কোথাও তাঁবু জুড়ে বিশাল রংবেরঙের ছবি। সার্কাস, মরণফাঁদ, নাগরদোলা ইত্যাদি হাজার রকমের প্রদর্শনী। আরও ছিল। যাত্রাপালা, কবিগান, আলকাপ, ঝুমুর, বোলান ইত্যাদি লোকশিল্পের আয়োজন। পরে তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বড় পর্দা লাগিয়ে চলচিত্রের প্রদর্শনীও।
মেলার আয়োজনে যেমন মিল ছিল, তেমনি মেলা দেখারও একটা গড়পড়তা ছক ছিল। ছোটরা সারা রাস্তা আনন্দে ও উত্তেজনায় কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করতে করতে, গোরুর গাড়ির পেছনে বসে দিগন্তের দিকে চেয়ে চেয়ে পা দোলাতে দোলাতে পৌঁছত মেলায়। কেনাকাটা হবে, উপহার পাওয়া যাবে, নাগরদোলায় চড়া হবে তারপর পছন্দের খাবারটা আদায় করা যাবে বায়না করে।
কিন্তু মেলায় প্রবেশ করেই তাদের নিয়ে যাওয়া হতো একটা গুমটি মতো ঘরে। সেই ঘরটা যত কাছাকাছি আসত, স্পষ্ট হতো কিছু বিচিত্র বাক্যবন্ধ, ‘অমুক মণ্ডল, গ্রামের নাম তমুক, বাবার নাম ...’
প্রথমেই সাবধান করে দেওয়া হতো, ‘হাত ছাড়বে না। ছাড়লেই এই জনসমুদ্রে হারিয়ে যাবে। তবুও যদি সে অঘটন ঘটে তাহলে মাথা ঠাণ্ডা করে এই গুমটি পর্যন্ত আসবে। নিজের নাম, বাবার নাম, গ্রামের নাম বলবে। বলবে কার সঙ্গে এসেছ। ওরা ঠিক মাইকে ডেকে দেবে বাড়ির লোককে।’
শতবার শত উপদেশ শুনেও সঙ্গছাড়া, হাতছাড়া হওয়ার ঘটনা কম ঘটত না। হারিয়ে গেলে তার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সাবধান করলেও বায়না করতে গিয়ে অথবা ভিড়ের চাপে এরকম ঘটনা আখছার ঘটত। আর তখনই পূর্বের শিক্ষা বাষ্পীভূত হয়ে যেত। রাজ্যের ভয় এসে গ্রাস করত। বাবার নাম ভুলে যাবার দশা হত, আক্ষরিক অর্থেই।
এই প্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনা মনে পড়ে। আমাদের গ্রামের ক্ষুদ্র মেলাদুটির একটিতে আমাদের এক পিসি একবার হারিয়ে গিয়েছিল। আমরা গৌরব করে ‘মেলা’ বললেও তা আসলে ছিল চারটি কি পাঁচটি দোকান। এমনিতে প্রত্যেক বালকবালিকার কাছে গ্রামের রাস্তাঘাট আপন হাতের তালুর মতো চেনা তবুও পিসি হারিয়ে যাওয়ার মতো একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার ঘটিয়ে ফেলেছে ভেবে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে শুরু করে। গ্রামে মোটামুটি সবাই সবাইকে চেনে। এক ভদ্রলোক দয়াপরবশ হয়ে এসে নাম জিজ্ঞেস করেন। মণ্ডল পদবিটি পিসির পছন্দ ছিল না। সেটা বদলে ফেলার একটা সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে পিসি উত্তর দেয়, ‘প্রভাতী দাস।’
-বাবার নাম?
-সুবল দাস।
লোকটি নাম আর পদবি মেলাতে না পেরে শুধোয়, দাদা বা কাকা থাকলে তার নাম বল।
পিসি ওর বড়দার নাম বলে, ‘মুক্তি মণ্ডল।’
অতঃপর মেলায় হারানো পিসি বাড়ি ফিরে আসে।
‘হারানো প্রাপ্তি’র গুমটি দেখিয়ে প্রবেশ করা হতো মেলাপ্রাঙ্গণে। বিচিত্র কলরব, কোলাহল কানে আসত। মাইকে কত রকমের শব্দ। বাউল, কীর্তন তো আছেই তাঁর সঙ্গে আছে হাঁকডাক। কেউ ডাকছে ‘হরেক মাল ছ-আনা’ কেউ অন্যকিছু। বিজ্ঞাপনের রেকর্ড বাজছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে।
এক পটী থেকে অন্য পটী ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা শুরু হয়। হয় দরকষাকষি। লাভ লোকসানের খতিয়ান মেলানো হয়। সার্কাস দেখা হয়, নাগরদোলায় চাপা হয়। শেষে মিষ্টি খেয়ে হাঁড়িভর্তি মিষ্টি ফেরার পথ।
(৪)
তারাশঙ্করের দেওয়া বিবরণ অনুযায়ী, বরিগতলার মেলায় দৈনিক লক্ষ লোকের সমাগম হয়। দশবিশ মাইল দূর থেকে ভক্তরা চাল, ডাল, কাঠ বয়ে এনে খোলে অন্নসত্র। দৈনিক তিন হাজার মন চাল রান্না হয়। অবিরাম হরিধ্বনি ওঠে। লক্ষ লক্ষ টাকার কেনাবেচা হয়। পল্লীজীবনের যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস আসে। দূর দূরান্ত থেকে আসে কাঠের কারবারীরা। কারখানা খুলে বসে। খাট, চৌকি, জানলা দরজা তৈরি হয়। গঙ্গার ধার থেকে আসে বাবলা কাঠের কারবারিরা। তারা তৈরি করে লাঙ্গল। শণ, পাট বিক্রি হয়। কর্মকারেরা তাদের সাময়িক কামারশালা খোলে। সন্ধ্যের পর হরিধ্বনি থামে। অন্নসত্রগুলি বন্ধ হয়ে যায়। ছোট ছোট তাঁবুগুলিতে টিমটিম করে আলো জ্বলে। সার্কাস, ম্যাজিকের তাঁবুতে জ্বলে আসিটিলিনের বাতি। পাঠান, পাঞ্জাবী, বাঙ্গালী জুয়াড়িরা আসে দেশ দেশান্তর থেকে। মেলার একপ্রান্তে বেশ্যাপল্লী। রাত যত বাড়ে চিৎকার চেঁচামিচিও বাড়ে। দুতিনদিন পর পুকুরের জল কাদা হয়ে ওঠে। মাঠ ঘাট হয় পঙ্কিল। বাতাস ভারী হয়ে আসে। তবুও মেলা থাকে এক মাস।
গল্পটি শুরুই হয় মেলার অনুপুঙ্খ্য বিবরণ দিয়ে। একটি দীঘির চারিপাশে মেলা বসে। মেলাটি লেখক আমাদের দেখান একজোড়া শিশুর চোখ দিয়ে। ছয় বছরের বালিকা মণি এবং তার ক্লাস সিক্সে পড়া দাদা অমর বাড়ির সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে মেলায় এসেছে। সঙ্গে কিছু পয়সাও আছে। কিন্তু চারিদিকে এতকিছু কেনার, এতকিছু দেখার! ওরা সামান্য পয়সা দিয়ে কী করবে বুঝতে পারে না। নিজেদের ইচ্ছেগুলো বাতিল করতে করতে দুই ভাইবোন হাত ধরাধরি করে এগিয়ে যায়।
পুকুরের উত্তর পাড়ে সারিবদ্ধ মনিহারীর দোকান। দড়ি থেকে ঝুলছে নাগরদোলা। দমের জোরে বনবন করে ঘুরছে, তাতে দুলছে মেমপুতুল। বালিকাটি দাঁড়িয়ে পড়তেই দোকানদার একটি এরোপ্লেন দুলিয়ে দেয়। ছেলেটি দুটো খেলনারই দাম জিজ্ঞেস করে। তারপর বোনের হাত ধরে সরে যায়। প্রবেশ করে জুতোর পটীতে। রাস্তার দুপাশে সারি বেঁধে বসেছে মুচীর দল। অমরের পায়ের জুতোর অবস্থা সঙ্গীন। তাই দেখে একজন সারিয়ে দিতে চায়। মণি জানায় ওদের কাছে পয়সা নেই। মুচী বিনা পয়সাতেই করে দিতে চাইলে লজ্জায় মাথা কাটা যায় অমরের। অপমানের গ্লানিতে বোনকে সে একটি চড় মারে। বোন কাঁদলে তাকে বাজীর প্রলোভন দেখিয়ে সরিয়ে নিয়ে যায়। যেতে যেতে মণি দেখে কী সুন্দর একজোড়া মখমলের চটি! অমর কথা দেয়, আরও ভালো চটি সে বোনকে বড় হয়ে কিনে দেবে।
বড় বড় দোকানগুলির সামনে পথের উপর ছোট ছোট দোকান। কেউ বসেছে শাকসবজি নিয়ে, কেউ বিড়ি, কেউ নকল গয়না। কিছু ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা লাঠির মাথায় হরেক দ্রব্য বেঁধে হেঁকে হেঁকে বিক্রি করছে। পটীটার মোড় ঘুরতেই ওরা দেখতে পায় সারিবন্দি বিশাল তাঁবুগুলি। বাজীঘর। এর পর সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসে। দোকানে দোকানে বাতি জ্বলে উঠে। ওরা যেখানে পৌঁছয়, তারই একটা দিক থেকে ভেসে আসে উৎকট গন্ধ। সে গন্ধ মদ, গাঁজা, বিড়ি, সিগারেট ও সস্তা এসেন্সের মিলিত গন্ধ। সেখানে সারিসারি খড়ের ঘর। ‘বালক বৃদ্ধ, যুবা, বাঙ্গালী, হিন্দুস্থানী, উড়িয়া, মাড়োয়ারী, কাবুলীওয়ালা, হিন্দু, মুসলমান, সাঁওতাল সব ইহার মধ্যে আছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী সব যেন এখানে একাকার হইয়া গেছে। এইটাই আনন্দ-বাজার অর্থাৎ বেশ্যাপটী।’
আনন্দ-বাজারের সঙ্গে লেখক যখন পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেন ঠিক তখন অমর ও মণি দাঁড়িয়ে থাকে বাজীঘরের সামনে। একটি লোক বিচিত্র পোশাকে, বিচিত্র ভঙ্গিমায় লোক জড়ো করছে। অমর সাইনবোর্ডে পড়ছে, ‘কাটা মুন্ডু অফ বোম্বাই’। বাইরে একটা কবন্ধের ছবি এবং একই মানুষের দুটো মুন্ডুর ছবি। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলে এইসব অদ্ভুত সব দৃশ্য দেখতে পাওয়া যাবে। বোনের মুখের দিকে চেয়ে অমর তাকে ডাকে। বলে, ‘আরও বড় বাজী আছে, চল।’
হঠাৎ একটা কলরোল ওঠে, ‘সরে যাও সরে যাও। হাতি।’
আঞ্চলিক জমিদার হাতির পিঠে চেপে বেরিয়েছেন। গোলমালে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। অমর মণির কাপড় চেপে ধরে। মানুষের ধাক্কায় সে অনেকদূর চলে যায়। একটু ফাঁকা জায়গায় পৌঁছে আবিষ্কার করে এতক্ষণ যার কাপড় ধরেছিল সে মণি নয়। ভিড়ের চাপে মণি হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে।
মেলা তখন লোকে লোকারণ্য। বোনকে খুঁজতে খুঁজতে অমর আনন্দ-বাজারের কোলাহল পেরিয়ে আর একটি ভিড়ের মধ্যে পড়ে। সেখানে ডাইসখেলা চলছে। টাকাপয়সা ঝনঝন করে পড়ছে। খদ্দর পরা একটি যুবক এসে ওকে সেখান থেকে উদ্ধার করে। কিন্তু মণি? অমর যখন স্রোতের মুখে কুটোর মতো ভেসে গিয়েছিল, ঠিক তখনই এক বিপরীত স্রোতের ধাক্কায় সে ঢুকে পড়েছিল বাজীর তাঁবুর ভেতর। প্রথমে নানা রকম রঙ্গ দেখে মণির ভারি আমোদ হয়েছে। দাদাকে তার ভীষণ বোকা মনে হয়েছে। বাজীর খেলা দেখে বেরিয়ে আসার সময় মণি ভাবে, দাদা নিশ্চয় দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু দাদাকে সে কোথাও খুঁজে পায় না। আবার একবার ‘সরো সরো’ চিৎকারে কুটোর মতো ভেসে যায় মণি। যখন থামার অবকাশ পায়, দেখে মেলার বাইরে মাঠে এসে পৌঁছেছে।
সামনে মেলার আলোকরশ্মি দেখে সে আবার ফেরার চেষ্টা করে কিন্তু পথ খুঁজে পায় না। সামনে সারি সারি খড়ের ঘরগুলির পেছনে একটি করে দরজা। মণি একটি দরজায় ধাক্কা দিতেই একটি যুবতী মেয়ে, কমলি বেরিয়ে আসে। মণি হারিয়ে গিয়েছে শুনে সে তার ঘরে নিয়ে যায়। দরজায় পুরুষ কন্ঠ ডাকে কমলিকে। সে দরজা খোলে না। মণিকে কচুরি মিষ্টি খেতে দেয়। মণি তাকে মাসি বলে ডাকে। মেলায় সে কেমন নাগরদোলায় চাপা পুতুল দেখেছে, মখমলের চটি দেখেছে, সেসব কথা বলে। এক ফাঁকে মণিকে রেখে সন্তর্পণে বেরিয়ে যায় কমলি। ফিরে আসে খেলনা নিয়ে। সে সব পেয়ে মণি ভারি খুশি হয়। তারপর চৌকির উপর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে।
কমলির দরজায় আবার ধাক্কা পড়ে। মাসি ডাকছে। বেশ্যাদের অভিভাবক। কমলি খদ্দের নেয় নি, তাই কৈফিয়ত তলব করতে এসেছে। মেলায় ঠাই পেতে জমিদারকে টাকা গুনতে হয়, তা আসবে কোথা থেকে? হঠাৎই মাসির নজর পড়ে চৌকির উপর। মেয়েটি হারিয়ে গিয়েছে শুনে মাসি বলে, ‘বেশ, তবে ভোরের আগেই ওকে সরিয়ে দিতে হবে। সরকারকে বলে আসি আমি। ভাল করে আগড়টা সরিয়ে দে।’
মাসির ইঙ্গিতে কমলি চমকে ওঠে। একথা তার মাথায় আসে নি। আগড় সরাতে গিয়ে সে শিউরে ওঠে, ঝরঝর করে কাঁদে। রাত গভীর হয়। মেলার কোলাহল স্তিমিত হয়ে আসে। পথিকের আনাগোনা কমে। থমথমে অন্ধকারে কমলি মণিকে বুকে তুলে নিয়ে এসে মাঠের অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
মেলায় গিয়ে সবার আগে বাচ্চাদের হারানো প্রাপ্তির গুমটি চিনিয়ে দেওয়ার পিছনে আসলে কতখানি ভয়াবহতার সম্ভবনা থাকে তা ভেবে আমি আজও শিউরে উঠি।