'হেমন্তের পাখি’ : হার না মানতে শেখা লক্ষ অদিতির গল্প
- 07 March, 2021
- লেখক: মনীষা নস্কর
‘শরৎ আর শীতের মাঝে হেমন্ত ঋতুটা যেন কেমনতর। কখন যে একটা পাতলা কুয়াশায় মুখ লুকিয়ে চুপিসারে এসে যায়।’
মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় বড় বদলগুলো বুঝি এমন চুপিসারেই ঘটে যায়। ১৯৯৭ সালে লেখা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের ‘হেমন্তের পাখি’ এমনই এক দিনবদলের গল্প শোনায় আমাদের। অদিতি, সাড়ে ছেচল্লিশের এক গৃহবধূ, যার দীর্ঘ পঁচিশ বছরের বিবাহিত জীবনে পাওয়া বলতে শুধুই এক ভাঙা ভাঙা নিঃসঙ্গতা এবং আপনজনদের কাছে পাওয়া ভালবাসার মোড়কে সন্তর্পণে লুকিয়ে রাখা অসম্মান। মজার কথা এই যে, অদিতি নিজেও বহুদিন পর্যন্ত ভেবে দেখার ফুরসত পায়নি, নিজের অজান্তে সেও কবে যেন বিকিয়ে দিয়ে বসে আছে তার আত্মসম্মানবোধ।
উপন্যাসের শুরুই হয়েছে ‘খাঁচা’ শব্দটি দিয়ে। করকরে আশিটাকায় কেনা এক জেদী বুনো টিয়াকে পোষ মানানোর চেষ্টা করে অদিতি। পাখিওয়ালা বলেছিল, ‘‘একদম তৈরি পাখি, সাত দিনে পোষ মেনে যাবে.. হাত বাড়াবেন, হাতে চলে আসবে! কাঁধে চড়ে ঘুরবে, ঠিক যেন ঘরের ছেলে।’’ খবরের কাগজের ‘পাত্রী চাই’ কলামে এমনই সব চাহিদার কথা লেখা থাকে না? ‘ঘরোয়া’, ‘সুশ্রী’, ‘শিক্ষিতা’..? প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সুচিত্রা ভট্টাচার্যের ‘ফাঁকি’ উপন্যাসে বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের এমনই এক চাহিদা উঁকি দিয়ে গেছে, ‘ওরাও একটা মোটামুটি ঘরোয়া সুশ্রী অথচ চাকরিবাকরি করে এমন মেয়ে খুঁজছে।’ এখন অবশ্য ঘরের কোণায় শো-পিস সেজে পড়ে থাকা ‘ঘরোয়া’ মেয়েদের দিন শেষ, এখন চাই ‘দশভূজা’, ঘরে-বাইরে অলরাউন্ডারটি না হতে পারলে নম্বর যাবে কাটা। ‘হেমন্তের পাখি’ উপন্যাসে খুব অল্প পরিসরের জন্য হলেও জায়গা করে নিয়েছে এমনই এক মেয়ে— অদিতির স্কুলের বন্ধু সুজাতা। সুজাতার শ্বশুরবাড়ি উকিল বউ পেয়ে প্রথম কিছুদিন ছিল আহ্লাদে ডগমগ। কিন্তু বছরখানেকের মধ্যেই ছবি গেল বদলে। বাড়ির বউ সিনিয়রের চেম্বার থেকে যেন একটু বেশিই রাত করে ফিরছে, সংসারে কুটোটি কেন সে নাড়ছে না? সুজাতার কথায়, ‘‘প্রেম করার জন্য ড্যাশিপুশি মেয়ে ঠিক আছে, ভীষণ অ্যাট্রাকটিভ। কিন্তু বিয়ে করলে সব পুরুষই বউকে একটু শাঁখা সিঁদুর নোলকে দেখতে ভালবাসে। নিজে বিছানায় শুয়ে ইউনিয়নের গল্প করতে পারে, বউ কোর্টকাছারির কথা বললেই মনে হবে পাশে একটা আইনের বই শুয়ে আছে।’’ বাধ্য হয়ে সুজাতাকে জলাঞ্জলি দিতে হয় তার কেরিয়ার, বেছে নিতে হয় সাদামাটা সরকারি চাকরি কারণ সংসারে তার মাইনেটাও যে লাগে, ওটা চলে গেলে সুজাতার কর্তার ‘বাজেট ফেল মেরে যাবে’। অতএব সুজাতার মতো চাকরি করা ‘স্বাধীন’ মেয়েদের পায়ে শিকলটা আরও শক্ত হয়ে চেপে বসে। ‘মেয়েরা দশভূজা’, ‘মেয়েরা সব পারে’— এমনতরো গালভরা স্তুতি শুনতে ভারী মিষ্টি লাগে। কিন্তু বাস্তবে এই মূর্তিমান দশভূজাগুলি আছেন কেমন, তার খবর কে রাখে? সুজাতা অফিস থেকে হা-ক্লান্ত অবস্থায় ফিরলেও চা-টা বানানোর দায়িত্ব তার ঘাড়েই এসে পড়ে। কারণ, ওই যে মেয়েরা তো দশভূজা! মেয়েরা সব পারে! মেয়েদের সব পারতে হয়! এরই মাঝে যারা সুজাতার বরের ছাঁচ থেকে আলাদা হন, তাঁরাই হলেন ‘ব্যতিক্রম’, সেসব ‘লক্ষ্মী বর’দের কপালে জোটে ঠাট্টা-তামাশা, তকমা দেওয়া হয় ‘জরু কা গুলাম’। আসলে ‘বাঁদি’ দেখে দেখে যাদের চোখ অভ্যস্ত, ‘গোলাম’ দেখলে চোখে লাগবে বৈকি!
ফিরে আসা যাক অদিতির কথায়। অদিতির স্বামী সুপ্রতিম, লোটাস ইন্ডিয়ার দাপুটে এরিয়া সেলস ম্যানেজার, নৈতিক বোধগুলি তার খানিক ঢিলেঢালা। অদিতির দুই পুত্ররত্ন— পাপাই, তাতাই। দুজনেরই বড় হয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই একটু একটু করে দূরত্ব বেড়েছে তাদের মায়ের সঙ্গে। আমরা যখন ছোট থাকি, আমাদের চেনা বৃত্তটাও থাকে ছোট আর সেই বৃত্তের কেন্দ্রস্থলে থাকে মা-বাবা। মা-বাবার সঙ্গেই সমস্ত গল্প শেয়ার করি, সমস্ত বিষয়ে তাদের ওপর নির্ভর করি। ধীরে ধীরে আমরা বড় হতে থাকি, চেনা ছোট্ট বৃত্তটাও বড় হতে থাকে এবং মা-বাবারা কেন্দ্রস্থল থেকে সরে যেতে থাকেন ক্রমশ পরিধির দিকে। কখনও কখনও তাঁরা একেবারেই বেরিয়ে যান সন্তানের বৃত্ত থেকে। সেজন্য কাউকেই হয়তো দোষী সাব্যস্ত করা চলে না। তবু মায়েদের মন যে মানতে চায় না। অদিতিও সহজ সত্যিটুকু সহজভাবে নিতে পারেনি। সে তার ছেলে পাপাইয়ের ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকতে গিয়ে বাধা পেয়েছে। নিজের আদর্শ ছেলেদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করাটা যে উচিত নয়, এ কথা সে ভাবেনি। পাপাইয়ের ঘনঘন সঙ্গিনীবদল, বিদেশে গিয়ে রিসার্চ করতে চাওয়া অদিতির পছন্দ হয়নি। শেয়ারবাজার নিয়ে মাতামাতি করা তাতাইকে তার মনে হয়েছে ‘ভাবী বানিয়া’। অদিতির মনের এই সংকীর্ণতাগুলোই তাকে দোষে-গুণে পরিপূর্ণ এক রক্তমাংসের মানুষ বানিয়ে তুলেছে, সে আর নিছক উপন্যাসের নায়িকা থাকেনি। প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের ব্যক্তিগত স্পেস দিতে না চাওয়া একজন পোজেসিভ মা ছাড়াও অদিতির আরও অনেকগুলো মুখ এঁকেছেন সুচিত্রা ভট্টাচার্য।
অদিতির দুপুরগুলো ভয়ানক রকমের নিঃসঙ্গ। তার দুপুর কাটে বোকাবাক্সের সামনে বসে এতাল-বেতাল কথা ভেবে। তার সুখ দুঃখের কথা শোনার সময় নেই কারওর কাছে। সবাই যে যার বৃত্তে মশগুল। ব্যালকনির খাঁচায় ঝিমোতে থাকা টিয়া আর সাড়ে সাতশো স্কোয়্যার ফিটের সুদৃশ্য খাঁচায় একলাটি বসে থাকা অদিতি— কোথাও গিয়ে যেন দুজনেই এক হয়ে যায়। পড়ে পড়ে মুখস্থ হয়ে যাওয়া সাপ্তাহিক পত্রিকার ছবি উলটে, দেওয়ালে পিঁপড়ের পদযাত্রা দেখে কাঁহাতক আর সময় কাটে? এমনই এক হেমন্তের নিঃসঙ্গ দুপুরে অপ্রত্যাশিতভাবে হেমেনমামার আগমন অদিতির জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। হেমেন্দ্রনারায়ণ মল্লিক, যিনি একসময়ের স্বনামধন্য লেখক, বর্তমানে লেখক তৈরিই তাঁর একমাত্র নেশা। মানুষটি মনে রেখেছিলেন, অদিতি ছেলেবেলায় লিখত। তিনি অদিতিকে আবার লেখা শুরু করতে বললেন, ঠিক যেমনভাবে খোদ সুচিত্রা ভট্টাচার্যের লেখা শুরু হয়েছিল প্রেমেনমামার তাগিদে। তারা নিউজের পক্ষ থেকে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সুচিত্রা ভট্টাচার্য জানিয়েছিলেন, ‘হেমন্তের পাখি’ উপন্যাসের অদিতি খানিকটা তাঁরই প্রতিচ্ছবি। মাত্র আঠেরো বছর বয়েসে বাড়ির অমতে বিয়ে করার পর তাঁকে প্রচুর স্ট্রাগল করতে হয়। লেখা প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। তিনি যে লিখতে পারেন, তাই-ই ভুলে গিয়েছিলেন অদিতির মতোই। বছরদশেক পর প্রেমেনমামার অনুরোধে আবার একটু একটু করে তাঁর লেখা শুরু। যদিও গল্পের অদিতি লেখা শুরু করেছে ছেচল্লিশে, সুচিত্রা লেখা শুরু করেছেন আঠাশে। সাক্ষাৎকারটিতে সুচিত্রা ভট্টাটার্য অকপটে স্বীকার করেছিলেন, সংসারের ঝামেলা তাঁকে পোহাতে হয়নি, দায়িত্ব নিয়েছিলেন তাঁর স্বামী ও ভাই। তিনি বলেছিলেন, ‘এইগুলো মেয়েদের অর্জন করতে হয়, চেয়ে পাওয়া যায় না, চিৎকার করে পাওয়া যায় না।’ গল্পের অদিতিকেও কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। উপন্যাসে হেমেনমামা চরিত্রটির আবির্ভাব আকস্মিকভাবেই। চরিত্রটির তেমন কোনও ওঠা-পড়া নেই। হেমেনমামা যতটুকু পরিসরে আছেন, আগাগোড়াই অদিতির চরিত্রটির জীবনে এক অনুঘটকের কাজ করে গেছেন। বাড়ি বয়ে এসে অদিতিকে লিখতে বলেছেন বারবার। অদিতির প্রথম লেখা তিনি ছাপানোর ব্যবস্থা করেছেন, সাহিত্যের জগতে তাঁরই হাত ধরে অদিতির প্রবেশ। প্রেমতোষদার বাড়ির সাহিত্যিক আড্ডায় হেমেনমামাই নিয়ে গিয়েছিলেন অদিতিকে। ২০০৩ সালে ঊর্মি চক্রবর্তীর পরিচালনায় উপন্যাসটি চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয় এবং সে ছবিতে হেমেনমামার ভূমিকায় ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অদিতির ভূমিকায় তনুশ্রী শংকর। ছবিতে কিন্তু হেমেনমামার চরিত্রটি অনেক বেশি প্রাণবন্ত, অনেক বেশি সজীব।
তিরিশটাকায় রং করা চড়ুইপাখি কিনলে অদিতিকে শুনতে হয়েছে, “রোজগার তো করো না, টাকার মর্ম বুঝবে কী!” সামান্য এক গোলাপি ফাইলের ছুতোয় সুপ্রতিম তাকে শোনায়, “অফিস তো আর করলে না, দিব্যি শুয়ে বসে জীবন কেটে গেল।” অদিতি যেন ফাঁকি দিয়ে সমস্ত সুখ আদায় করে নিচ্ছে। অথচ অদিতিকে ছাড়া তাদের চারজনের সংসারখানা যে একেবারে অচল, সেকথা সুপ্রতিম ভেবে দেখে না। ছেলেদের শার্টের বোতাম লাগানো থেকে সুপ্রতিমের টাই-মোজা-রুমালটি পর্যন্ত অদিতিকেই এগিয়ে দিতে হয়। তিনটি প্রাপ্তবয়স্ক প্রাণী যে একান্তভাবেই এই একটি মানুষের ওপর নির্ভরশীল, অদিতিও সেকথা মনে করিয়ে দেয় না। অদিতি-সুপ্রতিমের দাম্পত্য জীবনেও আর কোনও উচ্ছ্বাস, উষ্ণতার ছিটেফোঁটাও আমরা দেখি না। দুপুরের ফোনালাপে নেহাতই কেজো কথাবার্তা। নতুন বউকে আদর করে ‘ফুল’ বলে ডাকতো যে সুপ্রতিম সে আজও অদিতিকে ‘ফুল’ বলে ডাকে কিন্তু ‘পুষ্প ভেবে নয়, বোকা ভেবে।’ কথাপ্রসঙ্গে মনে পড়ছে মহীনের ঘোড়াগুলির সেই বিখ্যাত গান, ‘‘এভাবে মেয়েরা সব একে একে ফুল হয়ে যায়/নতুন বাগানে এসে, নিজেকে না ভালবেসে/ফুলের দলেরা শেষে কথা বলে হেসে হেসে/পদ্ম, গোলাপ, জুঁই, চম্পা চামেলী/টগর, শেফালী।/পোড়ার মুখিরা তোরা ফুল হয়ে রয়ে গেলি হায়..”
অদিতি যে একসময়ে লিখত, সেকথা মনে রেখেছে তার স্কুলের বন্ধু, তার হেমেনমামা। অথচ সুপ্রতিম অবলীলায় বলে বসে, “ও বিয়ের সময়ে মেয়েদের ওরকম অনেক গুণের কথা শোনা যায়। সবকিছু কি সত্যি বলে ধরে নিতে আছে?’’ এদিকে নতুন বউ অদিতি কবে নুনেপোড়া মাংস রেঁধেছিল, সেইটি বিয়ের পঁচিশ বছর পরেও সুপ্রতিমের মনে আছে! সুপ্রতিম শিক্ষিত, কিন্তু প্রথাগত শিক্ষা যে মানুষকে ‘মানুষ’ করে তোলার শিক্ষাটা দিতে পারে না, এই যা সমস্যা! সুপ্রতিমের এই সামান্য বোধটুকু নেই, সন্তানদের সামনে তাদের মা-কে ‘নির্বোধ’ প্রতিপন্ন করলেই তার পুরুষত্ব বেড়ে চতুর্গুণ হবে না। সে বড়ই মোটাদাগের মানুষ। বহুযুগ পরে অদিতির কাছে হেমেনমামার আগমনের অর্থ তার কাছে এটাই দাঁড়ায়, “ভদ্রলোক নীরব প্রেমিক ছিলেন। না হলে অ্যাদ্দিন পর খুঁজে খুঁজে তোমার কাছে এলেন কেন?” খাঁচার পাখি বেড়াল দেখে ভয় পেয়ে পাখা ঝাপটালে সুপ্রতিম খাঁচাটাকেই চাদর দিয়ে ঢেকে আসে, যাতে পাখি তার শিয়রে শমনের অস্তিত্ব না বোঝে। সংসার তো এভাবেই মেয়েদের ‘কলুর বলদ’ বানিয়ে দেয়, চোখে লাগিয়ে দেয় ‘নিরাপত্তা’, ‘সামাজিক মর্যাদা’-র নামে সুদৃশ্য কিছু ঠুলি। সুপ্রতিমের বন্ধুর পার্টিতে অদিতি কোন শাড়ি পরবে, ঠোঁটে ঘষবে কতটা লিপস্টিক— সে মাপকাঠিও সুপ্রতিমের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে এবং আশ্চর্যজনকভাবে অদিতি কোনও প্রতিবাদও করে না।
উপন্যাসে আরও একটি দিক তুলে ধরেছেন সুচিত্রা। এক ক্ষয়ে আসা ভাই-বোনের সম্পর্ক। ছেলেবেলার খুনসুটি, ভালোবাসাগুলো চাপা পড়ে গেছে এক স্বার্থসর্বস্বতার অন্ধকারে। দাদা অলকেশ অদিতিকে না জানিয়ে সই করিয়ে নেয় গোটাকতক কাগজে, অদিতিকে ছেড়ে দিতে হয় তার বাপের বাড়ির অধিকার। এই সামান্য ছলনাটুকু অদিতিকে গভীরভাবে আঘাত করে। অলকেশ মুখ ফুটে চাইলে কি অদিতি না করতে পারত? ‘মা-বাবা না থাকলেই কি ভাই-বোনের সম্পর্কে অদৃশ্য ঘূণপোকারা এসে বাসা বাঁধে?’ অদিতি জানে না। আরও এক ক্ষয়ে যাওয়া সম্পর্কের টুকরো ছবি পাই দীপক-শর্মিলার দাম্পত্য জীবনে। ‘‘কুড়ি বছর একসঙ্গে ঘর করার পরও পারস্পরিক সম্পর্কে এত বিতৃষ্ণা জমতে পারে? তা হলে সম্পর্ক কথাটার অর্থ কী? শিকড়বিহীন হয়ে শুধু ডালপালা ফুলপাতা মেলে দাঁড়িয়ে থাকা? অথবা দড়ির ওপর হাঁটা? ব্যালান্স করতে করতে? সার্কাসের খেলার মতন?” অদিতি ভেবে থই পায় না। তবু ভাঙাচোরা সম্পর্ক, অবিশ্বাস, স্বার্থপরতা, সন্দেহের কাঁটাগুলোর মাঝেও টুকরো টুকরো ‘ওয়েসিস’ আছে বলেই না জীবন এত সুন্দর। ঝোড়ো বৃষ্টি মাথায় করে হঠাৎ একদিন অদিতির বাড়ি এসে হাজির হয় তার দাদা অলকেশ, সঙ্গে আনে অদিতির ছেলেবেলার গল্প লেখার খাতাগুলো। স্মৃতিপথ বেয়ে অদিতি পৌঁছে যায় সেই রঙিন শৈশবের দিনগুলোয়, যেখানে চোদ্দ বছরের দাদা টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে বোনের জন্য কিনে আনছে তার প্রিয় হজমিগুলি। আপাতদৃষ্টিতে সুখী পরিবারগুলোর অন্দরমহলে অহর্নিশ এক গোপন কাঁটার অস্তিত্ব অদিতি টের পায়। একাধিক সাক্ষাৎকারে সুচিত্রা ভট্টাচার্য জানিয়েছিলেন, তিনি কাউন্সেলিংও করতেন। সেই সূত্রেই অনেক মানুষের মনের অন্দমহলের সঙ্গে তিনি পরিচিত হতে পেরেছিলেন।
অলকেশ-অদিতির সেই কাহিনীই একদিন জায়গা পায় অদিতির প্রথম লেখা ‘ফাটল’-এ। গল্পটি বেশ সুনাম অর্জন করে। অদিতির সামনে খুলে যায় এক নতুন পৃথিবীর দরজা। কিন্তু সমস্যার সূত্রপাত হয় এরপরেই। আসলে সমস্যার বীজটি ছিল সুপ্ত, উপযুক্ত পরিস্থিতিতে ধীরে ধীরে ডালপালা মেলে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে অদিতির সামনে। সুপ্রতিম অদিতির গল্প লেখাটা ধরে নিয়েছিল নিছক সময় কাটানোর উপকরণ হিসেবে। সে কখনই চায়নি অদিতি জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হোক। বাড়ির বউ ঘর-সংসার শিকেয় তুলে সাহিত্যসভায় দৌড়বে, মেলামেশা করবে ‘পরপুরুষের’ সঙ্গে— এসব সুপ্রতিমের ঘোর না-পসন্দ। অদিতির বাড়িতে দুটো সাহিত্যসভা হওয়ার পর অদিতির মালুম হল, যে বাড়িকে সে ‘নিজের বাড়ি’ ভেবে এসেছে এতদিন, সে বাড়ি অদিতির নয়, সুপ্রতিমের। কুৎসিত গালিগালাজে সুপ্রতিম তাকে বুঝিয়ে দেয় ব্যালকনির খাঁচায় ঝুলতে থাকা পাখিটার মতোই অদিতিও এই সাড়ে সাতশো স্কোয়ার ফিটের খাঁচাটার একটা বন্দী পাখিমাত্র, সুপ্রতিমের শেখানো বুলিই তার সম্বল, সুপ্রতিমের খাঁচার বাইরে অদিতির আর কোনও নিজস্ব অস্তিত্ব থাকতে পারে না। ইতিমধ্যে অদিতি দেখে এসেছে হেমেনমামাকে কি সাংঘাতিক এক প্রতিকূল পরিবেশে নীচ, লোভী, রুচিহীন কিছু মানুষের সঙ্গে থাকতে হয়। তবু মানুষটি সদাহাস্যময়, একমাত্র সম্বল পেনশনের টাকায় তিনি স্বপ্ন দেখেন বাংলা সাহিত্যসমাজকে নতুন নতুন লেখক উপহার দেওয়ার। বাড়ি ফিরে অদিতি হেমেনমামাকে একটা চিঠি লেখে, জানায় ‘চেনা সংসারে অচেনা মানুষদের নিয়ে জীবন কাটানোই তার নিয়তি’, গল্প সে আর কখনও লিখবে না। কিন্তু ততদিনে অদিতির ভেতরেই জন্ম নিয়েছে অন্য এক অদিতি, হার না মানতে শেখা অদিতি। খাঁচার টিয়া প্রথমবার অদিতির শেখানো বুলি ‘খুকু’ বলে ডেকে ওঠে। কি এক অজানা আক্রোশে অদিতি খুলে দেয় সে খাঁচার দরজা। দুর্বল ডানা নিয়ে পাখি মুক্তির সম্মোহনী টানে উড়ে যায় দৃষ্টিসীমার বাইরে। আর অদিতি?
“পাখির গতিতে টেবিল থেকে চিঠিটা নিয়ে এল অদিতি। দু’হাতে কুটি কুটি করে ছিঁড়ল। ভাসিয়ে দিল বাইরে।
এক অদিতি লক্ষ অদিতি হয়ে ভাসছে শূন্যে। ভাসছে।”