মার্ক্সবাদ ও বাস্তুতন্ত্র

গোড়ার কথা

পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের অবক্ষয় ও সংরক্ষণের প্রশ্নগুলি সারা পৃথিবীতেই বর্তমানে খুব জরুরি হয়ে উঠেছে। জীব পরিবেশ এবং বাস্তুতন্ত্রের প্রাণ-বান্ধব সংরক্ষণের প্রশ্নে কার্ল মার্ক্সের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রয়েছে। এই ব্যাপারে কয়েকজন মার্ক্সবাদী চিন্তাবিদ মার্ক্সের নিজের কথার ভিত্তিতে বেশ কিছু ভালো গবেষণামূলক কাজ করেছেন। [Paul MacGarr 2000; Paul MacGarr 2005; Foster 2000; Foster 2008; Foster 2011; Foster 2015; Foster, Clark and York 2010; Burkett 2005; Burkett 2014; Foster and Burket 2014; Saito 2016a; Saito 2016b; Saito 2017] তাঁরা কেউ কেউ দাবি করেন, মার্ক্স (এবং এঙ্গেল্‌সই) ছিলেন প্রথম বাস্তু-সমাজতন্ত্রী। আমি যতটকু কার্ল মার্ক্স এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেল্‌সের রচনাবলি পড়তে পেরেছি—এবং স্বীকার করা ভালো যে খুব বেশি আমার পড়া নেই—তাতে এরকম সিদ্ধান্তের পক্ষে আমিএই মুহূর্তে প্রাণ খুলে সায় দিতে পারছি না। তাঁদের যে বাস্তুতন্ত্র এবং বিশেষ করে পরিবেশ নিয়ে যথেষ্ট ও গভীর উৎকণ্ঠা ছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অন্য প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে, যখনই এরকম উপলক্ষ এসেছে, তাঁরা মানব জাতির এই মৌল প্রাসঙ্গিক মুদ্দাগুলিতে মনোযোগ দিয়েছেন। কিন্তু তাই বলে একথা সত্য নয় যে তাঁরা তাঁদের অধ্যয়নে এবং রচনাবলিতে পরিবেশ কিংবা বাস্তুতন্ত্র নিয়েই মূলত নিমগ্ন ছিলেন। তাঁদের বিচার্য বিষয়গুলির মধ্যে প্রধান ভূমিকা ছিল সমাজ অর্থনীতি রাজনীতি দর্শন বিজ্ঞান ইত্যাদির। কম হলেও আর ছিল শিল্প সাহিত্য ও সমরবিদ্যা।

 

বাস্তব দ্রষ্টার মতো উদ্বেগ

প্রথমেই এই কথাটা পাঠকদের সবাইকে লক্ষ করতে বলি। সেযুগের দুই বড় চিন্তানায়ক হিসাবে মার্ক্স এবং এঙ্গেল্‌স দুজনেই সময় ছাড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত সমাজইতিহাসের ঘটনাক্রম দেখতে পেয়েছেন; চোখে দেখা ঘটনার বাইরেও অনেক কিছু যা সাধারণ মানুষের পক্ষে আপাত দৃষ্টিতে বোঝা অসম্ভব তাঁরা তা ভাবতে পেরেছেন। যেমন, মার্ক্স যখনই কৃষি নিয়ে আলোচনা করেছেন, তিনি বিখ্যাত রসায়নবিদ ইউস্টুস ফন লিবিগের সমালোচনা সম্পর্কে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতেন। রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে করে জমির দীর্ঘমেয়াদি উর্বরতা নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে এবং চাষের নামে “জমির উপর ডাকাতি” হচ্ছে; আশু যেটুকু সুফল পাওয়া যাচ্ছে দীর্ঘমেয়াদে তার তুলনায় জমি এবং কৃষির অনেক বেশি মাত্রায় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে—লিবিগের এই সমালোচনায় তিনি খুবই গুরুত্ব আরোপ করেছেন। পরবর্তীকালে তিনি রাসায়নিক ও জৈব—দুই পদ্ধতির কৃষি নিয়েও চিন্তাভাবনা করেছেন এবং তাঁর ভোট, বলাই বাহুল্য, পেয়েছে জৈব পদ্ধতি।

১৮৬০-এর দশকে পুঁজি গ্রন্থের প্রথম খণ্ড লেখার সময় তিনি সমসাময়িক এক অস্ট্রিয়ান উদ্ভিদবিজ্ঞানীর রচনা পড়ে গভীরভাবে উদ্দীপিত হন [Fraas 1847], যিনি দেখিয়েছিলেন, প্রাচীন কালের কয়েকটি কৃষি সভ্যতায় সমুন্নত অঞ্চলে চাষবাসের স্বার্থে জমি হাসিল করতে গিয়ে ব্যাপকতর অরণ্য মোচনের ফলে সেখানে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়ে যায়। তার পরিণতিতে সেই সব অঞ্চলে এক নিদারুণ বাস্তুতান্ত্রিক বিপর্যয় ঘটে যায়। [Cited by Saito 2016a]নদী নালা শুকিয়ে যেতে থাকে। জমিতে শুষ্কতা বৃদ্ধি পায়। এই সবের সমষ্টিগত প্রতিক্রিয়ায় সভ্যতার ক্ষেত্রগুলি বহু শতাব্দের জন্য মনুষ্য বসতির অনুপযুক্ত হয়ে যায়। সেই সময় এঙ্গেল্‌সকে পাঠানো এক পত্রে (১৮৬৮) তিনি লেখেন, “কৃষির প্রবর্তন এবং তার বিকাশের মাত্রার অনুপাতে চাষিদের অত্যন্ত প্রিয় ‘জলীয় বাষ্প’ হারিয়ে যেতে থাকে . . . এবং ক্রমে ক্রমে স্তেপ তৃণভূমি জেগে ওঠে। কৃষি উদ্ভাবনের প্রথম ফলাফলটা ভালোই, কিন্তু পরিশেষে তা অরণ্য ধ্বংস করে জমিকে ঊষর করে দেয়।”[Marx and Engels 1965, 202]

এঙ্গেল্‌স এই পাঠের ভিত্তিতেই পরে তাঁর এক অসমাপ্ত প্রবন্ধে দেখান:“প্রকৃতির উপর আমরা মানুষেরা বিরাট বিজয় অর্জন করেছি ভেবে বেশি আত্মপ্রসাদ লাভ করতে যাবেন না। প্রকৃতি এরকম প্রতিটি বিজয়ের বদলে আমাদের উপর প্রতিশোধ নিয়ে থাকে। প্রতিটি বিজয়ের ফলে শুরুতে আমরা যেমনটা চাই সেই মতো ফল লাভ করে থাকি; কিন্তু তার পরেই দ্বিতীয় বা তৃতীয় ধাপে অদেখা অন্য রকম ফলাফল আসতে থাকে, যা প্রথম দিককার প্রাপ্তিগুলিকে নাকচ করে দেয়।” [Engels 1974, 180]

উদাহরণ স্বরূপ, তিনি মার্ক্সের উল্লেখিত সেই বইটি থেকে এরকম কয়েকটি বিপর্যস্ত কৃষি সভ্যতার কথা তুলে আনেন: “The people who, in Mesopotamia, Greece, Asia Minor and elsewhere, destroyed the forests to obtain cultivable land, never dreamed that by removing along with the forests the collecting centres and reservoirs of moisture they were laying the basis for the present forlorn state of those countries.” [Ibid]

বেঁচে থাকলে তিনি হয়ত এই থিসিস শক্তিশালী করতে উপরের তালিকায় হরপ্পা সভ্যতার নামও যুক্ত করে দিতে পারতেন। আগে যাই সন্দেহ হোক, আজ আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি, এই সভ্যতাকে আক্রমণ করে কোনো বহিরাগত শক্তি ধ্বংস করেনি। সিন্ধুগঙ্গা অববাহিকায় দুই সহস্র বছর ধরে ব্যাপকতর অঞ্চল জুড়ে কৃষি ও নগরায়নের স্বার্থে অরণ্য উৎসাদন করে করে সেই সভ্যতার ধারকরা একদিন এক ভয়ঙ্কর বাস্তুতান্ত্রিক বিপন্নতার শিকার হয়। জল শূন্যতার শুষ্ক রথে চেপে থর মরুভূমি এগিয়ে আসে কদম কদম।

তাই তো এঙ্গেল্‌স তখনই আমাদের সাবধান করে দিতে চেয়েছিলেন, “অতএব প্রকৃতি প্রতি পদক্ষেপে আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা বিদেশি জাতির উপর আধিপত্য বিস্তারের মতো করে, বহির্ভূত শক্তি হিসাবে, প্রকৃতির উপর শাসন চালাতে পারি না—কেন না, আমরা আমাদের রক্ত মাংসের শরীর ও মস্তিষ্ক নিয়ে প্রকৃতিরই অংশ হয়ে আছি, তারই মাঝে আমাদের অস্তিত্ব। আমরা যেটুকু প্রভুত্ব অর্জন করেছি তার উৎস হচ্ছে এই যে অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় আমরা প্রাকৃতিক নিয়ম সমূহ জানার এবং তাকে সঠিক ভাবে প্রয়োগ করার খানিকটা সুবিধা পেয়েছি।” [Engels 1974, 180]

এই জানার শক্তিতেই আজকের দিনেও আমাদের কল-কারখানায় সমকালিক বৃহদায়তন উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় দীর্ঘমেয়াদে প্রকৃতির কতটা অদৃশ্য ক্ষতি করছি, তাকে বুঝবার চেষ্টা করতে হবে। কেন না, পুঁজিবাদ—কী সমাজ কী প্রকৃতি—সর্ব ক্ষেত্রেই মাথা ঘামায় কেবলমাত্র তাৎক্ষণিক হাতে-নাতে কী সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে তাই নিয়ে। আর তারপর আমরা বিস্মিত হই যখন দেখি, দীর্ঘ মেয়াদি পরিণামে এক মহা সর্বনাশ নেমে আসছে! [Ibid, 183] শিল্প উৎপাদন, সার্বিক দূষণ আর বিশ্ব উষ্ণায়ণআজ একই শৃঙ্খলে বাঁধা।

আবার মার্ক্সের কথাতে ফিরে যাই।

আজ থেকে দেড় শতাধিক বছর আগে মার্ক্স তাঁর এক মহাগ্রন্থে যা লিখে রেখেছিলেন, পড়লে সত্যিই চমকে উঠতে হয়: “Even an entire society, a nation, or all simultaneously existing societies taken together, are not owners of the earth. They are simply its possessors, its beneficiaries, and have to bequeath it in an improved state to succeeding generations as boni patres familias [good heads of the household].” [Marx 1959, 530; all emphases added] এই হচ্ছে আজকের দিনের আধুনিক বাস্তু-মিত্র সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মৌল নৈতিক আবেদন। আমরা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে আমাদের প্রজন্মে প্রকৃতির থেকে যা কিছু সম্পদ পেয়েছি—জল, বায়ু, জমি, জঙ্গল, খনি—তা আমরা ভোগ করে একালেই নিঃশেষিত করে দিয়ে যেতে পারি না। আমাদের উত্তরকালের জন্যও সব কিছু রেখে যেতে হবে, পারলে গুণে মানে একটু বাড়িয়ে। তাই এই আন্দোলনের চাহিদা মাত্র তিনটে জিনিস: (ক) বায়ু, জল, জমি, ইত্যাদির দূষণ বন্ধ কর এবং প্রাকৃতিক চক্র রক্ষা করে তাদের পরিমাণগত ও গুণগত মান বজায় রাখ; (খ) পৃথিবীকে মানব জাতির বর্তমান প্রজন্মের আস্তাকুঁড় হিসাবে ব্যবহার বন্ধ কর; এবং (গ) ভাবীপ্রজন্মসমূহের স্বার্থে প্রাকৃতিক সম্পদের ক্রমহ্রাস এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের প্রক্রিয়া বন্ধ কর। মানব জাতির সামাজিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এই তিনটি দাবিকে পূরণ না করে মার্ক্সের লক্ষ্যের দিকে এক পাও এগোনো যাবে না—পুঁজিবাদী সমাজেও নয়, সমাজতান্ত্রিক সমাজে তো আরও নয়।

বিপরীতভাবে এও বলা যায়, আমরা যখন আজকের পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনে ঠিক এই দাবিগুলিই অবিলম্বে কার্যকর করার প্রস্তাব বার বার উত্থাপন করছি, আমরা বস্তুত—তথ্যটা না জেনেও—মার্ক্সেরই অত দিন আগে বলে যাওয়া কথাগুলিকেই স্মরণ এবং পুনরুচ্চারণ করছি।

অনুরূপভাবে, এটাও স্মর্তব্য যে মার্ক্স যে কোনো উৎপাদন ব্যবস্থাকে প্রকৃতি ও মানব শ্রমপ্রক্রিয়ার মধ্যে বাস্তব জীবনের অনিবার্যতায় এক ধরনের “সামাজিক জৈবনিকতা” (social metabolism) হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন এবং ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির ক্ষেত্রে সেই জৈবনিক ক্রিয়ার মধ্যে একটা “ফাটল” লক্ষ করেছিলেন। এই ফাটল তৈরি হয়েছে মুনাফার জন্য জমির অতি-ব্যবহারে, অর্থাৎ, সামাজিক জৈবনিকতার প্রাকৃতিক নিয়ম লঙ্ঘন করার পরিণতিতে। সংকীর্ণ অর্থনৈতিক বিবেচনার আলোকে এই ঘটনা চোখে ধরা দেবে না। তাই তাঁর বক্তব্য ছিল: “জীবন্ত ও সক্রিয় মানব জাতির প্রকৃতির সঙ্গে জৈবনিক বিনিময়ের সম্পর্কের মধ্যে প্রাকৃতিক অজৈব শর্তাবলির ঐক্য, এবং তার ফলস্বরূপ প্রকৃতি থেকে মানুষ যা আত্মসাত করে, তার ব্যাখ্যারও দরকার নেই, তাকে কোনো ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফল হিসাবে ভাবারও দরকার নেই। ব্যাখ্যা আমাদের খুঁজতে হবে মানুষের সক্রিয় অস্তিত্বের সঙ্গে সেই অস্তিত্বের অজৈব শর্তাবলির যে বিচ্ছেদ ঘটে গেছে তার। যে বিচ্ছেদের সম্পূর্ণ কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে কেবল মাত্রমজুরিশ্রম ও পুঁজির সম্পর্কের মধ্যে।”[Marx 1973, 489; মোটা হরফ সংযোজিত]

এটা কার্ল মার্ক্সের কোনো দিব্য দৃষ্টির ব্যাপার ছিল না তিনি তাঁর প্রগাঢ় দ্বান্দ্বিক অন্তর্বোধের ভিত্তিতেই এই ঘটনাটা অনুভব করতে পেরেছিলেন কেন না, তিনি সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থাকে দেখেছিলেন ধনতন্ত্রে প্রকৃতির উপর কী জবাবি-প্রতিক্রিয়া হয় তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে আর এই দ্বান্দ্বিক উপলব্ধিই যৌক্তিক বিবেচনা থেকে তাঁর মধ্যে প্রকৃতি সম্পর্কে আগ্রহ উদ্বেগের জন্ম দিয়েছিল এঙ্গেল্সের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য

তথাপি এটাও স্বীকার করতেই হবে যে সমাজতন্ত্র থেকে সাম্যবাদে উত্তরণের ক্ষেত্রে ধ্রুপদীমার্ক্সীয় তত্ত্বের মধ্যে বাস্তুতন্ত্র রক্ষার সাপেক্ষে একটা বড় রকমের ফাঁক থেকে গিয়েছিল এবং তাঁদের হাতে যে জ্ঞান প্রকরণ ছিল, তাতে সেই ফাঁক দেখতে পাওয়া বা তা পূরণ করতে পারার কথাই নয় আসুন, আমরা আগে সেই ফাঁকটা কোথায় দেখার চেষ্টা করি তারপর তা পূরণ করা যাবে কিনা বিচার করব

 

সাম্যবাদ ও বাস্তুতন্ত্র

সকলেই জানেন, মার্ক্স এঙ্গেল্‌স-রা যে ভবিষ্যত সাম্যবাদী সমাজ সংগঠনের কথা ভেবেছিলেন, সেখানে প্রত্যেকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী সমাজের জন্য কাজ করবে (শ্রম দান করবে) এবং প্রত্যেকে তার প্রয়োজন অনুযায়ী সমাজের থেকে তার প্রাপ্য বুঝে পাবে। এটা সম্ভব হবে যখন সমস্ত ব্যবহার্য দ্রব্যের উৎপাদনে অঢেল প্রাচুর্য তৈরি করা যাবে। প্রকৃতিতে জল বা বাতাস যেমন প্রচুর বা অফুরন্ত বলেই তা নিয়ে কোনো অভাব অভিযোগ কাড়াকাড়ি মারামারি নেই, তাদের পয়সা দিয়ে কিনতে হয় না, তাদের ইচ্ছামতো যত খুশি পাওয়া যায় এবং ফলে তাদের কখনই পণ্য চরিত্র দেখা যায় না (বোতলবন্দি কর্পোরেট জলের কথা এখানে আমরা ধরছি না, এবং মার্ক্স এটা দেখে যাননি), ঠিক তেমনই অন্য সমস্ত জিনিসই যখন অঢেল পাওয়া যাবে, সেগুলো তাদের বর্তমান পণ্য চরিত্র খুইয়ে ফেলবে। তখন তাদের চাইলেই এবং লাগলেই পাওয়া যাবে। বেচাকেনা জমানো ইত্যাদি পণ্য অর্থনীতির সুপরিচিত স্বাভাবিক দোষগুলি সেরকম সমাজে আর থাকবে না। কেন না, তার অনুকূল পরিবেশ আর সেখানে নেই।

উৎপাদনে এরকম প্রাচুর্য আনতে গেলে তার জন্য একদিকে সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদের অবাধ ব্যবহার করতে (এবং তার ফলে তার ক্রমাগত হ্রাস ঘটাতে) হবে, অন্য দিকে সময়ের সঙ্গে সীমাহীন দূষণ ও বর্জ্য বৃদ্ধি করে যেতে হবে। বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য এটা আরও অপ্রতিহতভাবে বেশি করে ঘটবে। এর পরিণামে প্রাকৃতিক সম্পদের ভবিষ্যতে প্রাপ্তিযোগ্য ভাণ্ডারের উপর তিনটি সেক্টরে ক্রমবর্ধমান উৎপাদনের একটা বিপরীত ও অপ্রত্যাবর্ত্য প্রতিক্রিয়া ঘটবে। যার অর্থ হল, মার্ক্স যে মূল বাস্তুতান্ত্রিক নীতির উপর তাঁর সাম্যবাদী সমাজের তত্ত্ব দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন, তার সঙ্গে সেই উৎপাদন ক্রিয়ার অনতিবিলম্বে প্রত্যক্ষ বিরোধ দেখা দেবে। মার্ক্স এবং এঙ্গেল্‌সের রচনাবলি থেকে তন্ন তন্ন করে প্রাকৃতিক সম্পদ ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষার সপক্ষে যত ভালো ভালো এবং মূল্যবান উদ্ধৃতিই খুঁজে খুঁজে তুলে আনা হোক না কেন, এই দ্বন্দ্বের তাতে নিষ্পত্তি হবে না, এর সমাধানও পাওয়া যাবে না।

এই দ্বিমুখী সঙ্কটের সামনে পড়ে মার্ক্সবাদীরাসচরাচর যে রাস্তাগুলি বেছে নেনতার ভিত্তিতে তাঁদের নীচের তিনটি দলে ভাগ করা যেতে পারে: (ক) তাঁরা অধিকাংশই (প্রধানত দলীয় মার্ক্সবাদীরা—কথাটা কোনো কটু অর্থে কেউ নেবেন না; মার্ক্সবাদের বাস্তব চর্চায় দলের ভূমিকা অবশ্যম্ভাবী) উপরোক্ত সমস্যাটির দিকে চোখ বুজে থাকেন, এরকম একটা দ্বন্দ্ব যে তত্ত্বে আছে তা-ই কার্যত মনে মনে অস্বীকার করে বসে থাকেন; সামাজিক রাজনৈতিক মুদ্দা এবং শ্রেণিসংগ্রামের বিষয়ে তাঁদের যাবতীয় মনোযোগ সন্নিবদ্ধ রাখেন, এবং সম্ভবত ধরে নেন, শ্রেণিসংগ্রাম সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারলে স্বভাবতই আর কোনো সমস্যা থাকবে না; (খ) আধুনিক এক দল মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক মনে করেন, মার্ক্স এবং এঙ্গেল্‌সই প্রথম বাস্তুমিত্র সমাজতান্ত্রিক চিন্তাবিদ এবং বর্তমান কালের পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কিত যাবতীয় সমস্যার সমাধানের চাবিকাঠি তাঁদের রচনা সমূহে পাওয়া যাবে। মার্ক্সবাদী তত্ত্বে সাম্যবাদে উত্তরণের প্রশ্নে উৎপাদনে প্রাচুর্য আনয়নের যে একটা সংশ্লিষ্ট থিসিস আছে, সেটা তাঁরা ভুলে যান অথবা ভুলে থাকতে পছন্দ করেন; (গ) তৃতীয় একটি ক্ষুদ্রতর মার্ক্সবাদী গ্রুপ এই সমস্যাটিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে চান এবং তাঁদের মতে, পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের সমস্যার সমাধান মার্ক্সবাদের ব্যাপকতর পরিকাঠামোর মধ্যেই পাওয়া সম্ভব, যদি—এই যদিটি খুব গুরুত্বপূর্ণ—আমরা মার্ক্সবাদের কিছু ছোটখাটো গৌণ থিসিস পরিমার্জনা করতে রাজি থাকি। 

 

প্রাসঙ্গিক সংশোধন

বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে বিকাশমান উৎপাদিকা শক্তির নিরন্তর দ্বন্দ্ব সঙ্ঘর্ষের মধ্য দিয়েই সমাজের ক্রমবিকাশ হয়—মার্ক্সবাদের এটা একটা মৌলিক ও তাত্ত্বিক সিদ্ধান্ত। মার্ক্স এঙ্গেল্‌স প্রবর্তিত ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বা ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার এটাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রকরণ। কিন্তু এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে আপাত অর্থে, উৎপাদিকা শক্তির লাগাতার বিকাশের অর্থ হল প্রাকৃতিক সম্পদের ক্রমাগত হ্রাসপ্রাপ্তি, পরিবেশের ক্রমবর্ধমান দূষণ ও অবক্ষয় এবং বর্জ্যপদার্থের ক্রমসঞ্চয়ন। 

অথচ মার্ক্স যখন উৎপাদিকা শক্তির কথা বলেছিলেন, তিনি প্রধানত মানুষের সৃজনশীল ধীশক্তি বা মনীষার কথা মাথায় রেখে শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন, শুধু মাত্র সেই মনীষার সাধ্য হাতিয়ারগুলিকেই নয়। মার্ক্সবাদীরা এযাবত কাল এই দুটো জিনিসের মধ্যে গুলিয়ে ফেলেছে এবং উপলব্ধির ঝোঁক অনুযায়ী উৎপাদনের প্রাচুর্যের পক্ষে বা বিপক্ষে বলেছে। যদি আমরা এই দুইয়ের মধ্যে তফাত কোথায় বুঝতে পারি, তাহলে দেখব, উৎপাদিকাশক্তির লাগাতার বিকাশ বলতে কোনোমতেই অনিবার্যভাবে উৎপাদনের সীমাহীন বৃদ্ধি বোঝায় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু না কিছু বৃদ্ধি তো হবেই, কিন্তু উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের ব্যবহারিক দিক থেকে এর প্রধান অর্থ দাঁড়াবে উৎপন্নের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি, সেই অনুযায়ী উৎপাদনের বেশি বেশি করে বিশেষায়ন এবং একই দ্রব্য উৎপাদনের চক্রাকার নবীকরণ। আর এই সব ঘটতে থাকবে প্রদান-প্রাপ্তি ম্যাট্রিক্স (input-output matrix)-এর এক আবদ্ধ সুনির্দিষ্ট চক্রাকার প্রক্রিয়ায়। যার ফলে, পুরনো ব্যবহৃত বাতিল দ্রব্য থেকেই প্রায় সমস্ত নতুন দ্রব্য গুণে ও পরিমাণে উৎপন্ন হতে থাকবে (গাছ থেকে গাছের মতোই বোতল থেকে বোতল, ইত্যাদি); এতে প্রাকৃতিক সম্পদের খরচ বৃদ্ধি পাওয়ার বদলে কমে আসতে শুরু করবে(প্রথমে আপেক্ষিক বৃদ্ধির হার কমবে, তারপর বৃদ্ধির হারও কমে যাবে; অবশেষে বৃদ্ধিই পরম মানে থেমে যাবে) এবং সেই অনুপাতেই প্রাকৃতিক পরিবেশে বর্জ্য জমা হওয়ার প্রবণতা প্রায় নির্মূল হয়ে যাবে। মানুষের বিকাশশীল মেধা এক দিন এমন প্রযুক্তির জন্ম দেবে যাতে এই সব কাজ আর স্বপ্ন বা পরিকল্পনা হয়ে থাকবে না। বাস্তব সম্ভাবনা হিসাবে দেখা দেবে।

একটা সময় পর্যন্ত এই প্রবণতা আমাদের দেশেও ছিল। আমাদের ছোটবেলায় আমরা মধু এবং ঘি-এর শিশি দোকানে ফেরত দিলে পরবর্তী ক্রয়ে কিছু ছাড় পেতাম। তাকেই আবার ফিরিয়ে আনা এবং সম্ভাব্য সমস্ত দ্রব্যের ক্ষেত্রে চালু করার কথা ভাবতে হবে। ইতিমধ্যেই তার বেশ কিছু লক্ষণ ফুটে উঠেছে।

দ্বিতীয়ত, মানুষের ধীশক্তির উৎকর্ষবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে উৎপাদিকা শক্তির যত বিকাশ ঘটবে, মানুষ ততই জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে স্বতঃপ্রবৃত্ত ভাবে অগ্রসর হবে। জনসংখ্যার আকারের সঙ্গে যেহেতু—ধনতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র, যে কোনো সমাজব্যবস্থা নিরপেক্ষভাবে—উৎপাদনের পরিমাণের সাক্ষাত সমানুপাতিক সম্পর্ক রয়েছে, এই একটি জায়গায় নিয়ন্ত্রণের ফলে প্রাকৃতিক সম্পদের সুষম ব্যবহার এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা অনেকখানি বাস্তব সম্ভাবনাময়  হয়ে উঠবে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতেই সীমিত অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা এটা বুঝতে পারি, সুতরাং সাম্যবাদী সমাজে শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধুলো, স্বাস্থ্য, সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত, মৃত্যুহার, সামাজিক সুরক্ষা, মানবাধিকার, ইত্যাদির নিরিখে মানব উন্নয়ন সূচকের সুনিশ্চিত ঊর্ধ্বগমনে জনসংখ্যাও প্রতিটি দেশের সাপেক্ষে যুক্তিগ্রাহ্য সীমার মধ্যে ঘোরাফেরা করবে।

তৃতীয়ত, আমরা দেখছি, পুঁজিবাদ আজকে তার সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ের দিনে জল বা বাতাসের মতো প্রকৃতির তথাকথিত অবাধ দানগুলিকেও সমাজের সামষ্টিক ভোগাধিকারের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বাজারের পণ্যে পরিণত করেছে। প্রাচুর্যের সঙ্গে পণ্যমুক্তির যে স্বাভাবিক সম্পর্কের কথা ভাবা হয়েছিল, তা ক্রমেই তার পুরনো নিষ্পণ্যায়নের যুক্তি হারিয়ে ফেলছে। আগামী দিনের কমিউনিস্ট সমাজব্যবস্থাকে পণ্যের বিনিময়মূল্য উন্মূলনের—যোগ্যতর ব্যক্তিদের মধ্যে এবং তাদের দ্বারা আলোচনার ভিত্তিতে—নতুনতর ও অন্যতর উপায় খুঁজে বের করতে হবে। এমন উপায় যেখানে, ব্যবহারমূল্য (অর্থাৎ ব্যবহারিক গুণের সাপেক্ষে বিভিন্ন দ্রব্য) প্রথম দিকে সকলের মধ্যে বৈষম্যহীন অর্থে সমানভাবে, এবং পরবর্তীকালে, যার যতটা করে লাগবে সেই হিসাব অনুযায়ী, বিতরণ করা যাবে। এই প্রস্তাবের কার্যকারিতা বিচার বিবেচনা করে দেখতে হবে সময়ের দাবি অনুযায়ী, মার্ক্সের বা মার্ক্সবাদের কোনো “পবিত্র” সাবেক গ্রন্থপাঠের আলোকে নয়। সাহস এবং আস্থার সঙ্গে! এই ব্যাপারে কিউবার সমাজতন্ত্রে পরীক্ষা নিরীক্ষা জনিত সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতাকে বাজিয়ে এবং যাচাই করেদেখা যেতে পারে। [Levins 2007; Clausen 2007]

মার্ক্সীয় তত্ত্বে এই সামান্য পরিমার্জন এক সামষ্টিক উদ্যোগে করতে হবে তাঁদেরই যাঁরা অর্থনীতি, বাস্তুতন্ত্র, পরিবেশ, ভারসাম্য রক্ষাকারী উন্নয়ন এবং মার্ক্সবাদ—এই সমস্ত বিষয়ে আগ্রহী এবং তাত্ত্বিক জ্ঞান ও বাস্তব প্রয়োগের দিক থেকে যথোপযুক্তভাবে পারঙ্গম। উপযুক্ত প্রস্তুতি ছাড়া, শুধু মাত্র চটকদার শ্লোগানের সাহায্যে বা সেরকম মানসিকতা নিয়ে সাধারণ বুদ্ধির আলোকে এই কাজ করা একেবারেই সম্ভব নয়।

 

মার্ক্স কেন?

এই প্রশ্নটা আমরা শেষ দিকে এসে উত্থাপন করলেও এর গুরুত্ব কিন্তু কম নয়। বাস্তুতন্ত্র, পরিবেশ এবং জীবমিত্র উন্নয়নের সমস্যাগুলি মতবাদ নিরপেক্ষ সামূহিক ও জগত জোড়া বিবেচনাধীন মুদ্দা। মার্ক্সবাদীদের পাশাপাশি অনেক অমার্ক্সবাদীও এই বিষয়ে প্রায় সমান ভাবেই উদ্বিগ্ন এবং সক্রিয়। আর সত্যি কথা বলতে গেলে, এই উদ্বেগের জায়গাটা অমার্ক্সবাদীরাই অনেক দিন আগে থেকে প্রচার এবং আন্দোলন করে সামনে এনেছেন। মার্ক্সবাদীরাই বরং পরিবেশ আন্দোলনে এসেছেন বেশ খানিকটা দেরিতে। পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের বিশিষ্ট সংগঠক সমর বাগচী মার্ক্সবাদের প্রতি আস্থাশীল হয়েও মোহনদাস গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে এই বিষয়ে যে সমস্ত অনুকূল বক্তব্য খুঁজে পেয়েছেন এবং নানা আলোচনায় উল্লেখ করে থাকেন, তার মধ্যেও এই সত্যের আভাস পাওয়া যায়। [বাগচী ২০১০] প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে এই সংক্রান্ত কিছু কিছু সমস্যা নিয়ে ১৯৭০-এর দশক থেকে বৈদ্যায়তনিক চর্চা শুরু করলেও বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট দলগুলি তাদের গণ আন্দোলনের দাবিপত্রে পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র বিষয়ক মুদ্দাগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করেছে ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও দ্য জ্যানেইরো-তে বসুন্ধরা পরিবেশ শীর্ষ সম্মেলন এবং সেখানে কিউবার কমিউনিস্ট নেতা কমরেড ফিদেল কাস্ত্রোর লেখা পুস্তিকা Tomorrow will be Too Late প্রচারের আলোয় আসার পর। [Castro 1992]

তাই যদি হয়, তাহলে মার্ক্সের কথাই এখানে আমরা বিশেষ করে টেনে আনছি কেন?

আনছি, কেন না, মার্ক্সের রচনায় আলোচ্য সমস্যার ব্যাপারে কিছু অবিসম্বাদিত মূল্যবান অভিজ্ঞান তো পাওয়া যায়ই [Saito 2016b], আমার ধারণা অনুযায়ী, তার আরও দুটো খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে:

প্রথমত, মার্ক্সবাদ এই সমস্যার প্রশ্নে একটা সামগ্রিক দ্বান্দ্বিক প্রেক্ষাপট সামনে তুলে আনে। বাস্তুতন্ত্রের পরিঘটনাকে এই মতাদর্শে একটা বিচ্ছিন্ন বিষয় বলে মনে করা হয় না। আবার তথাকথিত “পূর্ণতর” (holistic) দৃক্‌পাতের নামে এখানে বৃহত্তর সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুদ্দাগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়াও হয় না, কিংবা বাস্তুতন্ত্রের বিপর্যয়কে একটা নিছক “মানুষের হাতে তৈরি” বিপদ হিসাবে চিত্রায়িত করা হয় না। এখানে প্রকৃতির বিরুদ্ধে সাধারণ ভাবে মানুষকে নয়, শ্রেণির প্রশ্নকে প্রাথমিক ও যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাস্তুতান্ত্রিক বিপর্যয় অবশ্যই একটি মানব সৃষ্ট পরিঘটনা। কিন্তু এই গ্রহের সব মানুষ তো আর এর জন্য দায়ী নয়, বস্তুত, বেশিরভাগ মানুষই দায়ী নয়। একজন গড়পরতা মানুষ দিনে দশটা প্লাস্টিকের ব্যাগ ছড়িয়ে যে দূষণ ঘটায়, একটা কর্পোরেট বাণিজ্য সংঘ তার কয়েক লক্ষ গুণ পরিমাণে প্রতি দিন প্রকৃতিকে নিঃস্ব এবং দূষিত করে। ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র তাদের এই ধ্বংসযজ্ঞে ঋত্বিকের ভূমিকা পালন করে। সেদিক থেকে বিচার করলে এটা একটা শ্রেণি সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ। অমার্ক্সবাদী বিচারে এই শ্রেণির ভূমিকা প্রায়শ এবং কার্যত উহ্য থেকে যায়। “মানুষের অতিলোভ”, “যন্ত্রসভ্যতা”, “জড়বাদী উন্মত্তস্বার্থ”—ইত্যাদি ভালো ভালো অথচ রসদহীন শব্দবন্ধের তলায় মুনাফাখোর পুঁজিপতি শ্রেণির হিংস্র কার্যকলাপ এবং পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সহযোগী ভূমিকা চাপা পড়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ বা গান্ধীর অসংখ্য ভালো উদ্ধৃতি সত্ত্বেও এই রাষ্ট্র তার মধ্যে আড়ালেই থাকে। বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসের কারণ যদি বা উঠে আসে, কারক ধরা পড়ে না।

দ্বিতীয়ত, মার্ক্সবাদের বিচারধারার পেছনে রয়েছে বস্তুবাদী দার্শনিক ভিত্তি, যার সাহায্যে যে কোনো সামাজিক মানবিক ভৌবনিক সমস্যাকে তার প্রকৃত বাস্তব প্রেক্ষিতে অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণ করা যায়। অন্য বা বিশেষ করে ভাববাদী বিচারধারার আলোকে (বা, সেই অসম্ভব ঘটনা, যাঁরা বলেন তাঁদের কোনো মতবাদ নেই, তাঁদের পক্ষে) এরকম ভাবে বিচার বিশ্লেষণ করা যায় না। মার্ক্সীয় বিচারে একই শ্রেণি বিভক্ত সমাজের প্রেক্ষিতে তার উৎপাদন, বন্টন, বিনিময় ও উপভোগের পদ্ধতির মধ্যে রেখেই মানুষের দ্বারা মানুষের এবং মানুষের দ্বারা প্রকৃতির—এই দুরকম শোষণ প্রক্রিয়াকে বুঝতে হয় এবং বোঝা যায়। এই আলোকেই বুর্জোয়া শ্রেণির তরফে যে বুদ্ধিজীবীগণ ধনতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়িয়ে বাস্তুতন্ত্রের বিপর্যয়ের পেছনে কিছু কিছু পার্শ্ব ও গৌণ ঘটনা—যথা, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, ভোগবাদের কদর্যতা—ইত্যাদিকে মূল কারণ হিসাবে জনগণের কাছে তুলে ধরতে চান, তাঁদের ভুলটা (আসলে, জ্ঞানত বা অগোচরে পক্ষপাতিত্ব) ব্যাখ্যা করা যায়। 

সুতরাং, বাস্তুতন্ত্রের ধ্বংসসাধন ও পরিবেশ অবক্ষয়ের পেছনকার অপরাধ বিশ্লেষণ ও অপরাধী সনাক্তকরণের ক্ষেত্রে একমাত্র মার্ক্সবাদই উপযুক্ত ভূমিকা নিতে পারে। একটা তথ্য অন্যরা ভুলিয়ে দিতে চাইলেও মার্ক্সবাদীরা কখনও স্মরণ করাতে ভোলে না যে যে শ্রেণির প্রতিনিধিরা একদিন ইউরোপ থেকে বিশাল সংখ্যক লোকজনকে এশিয়া আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকায় অভিবাসিত করেছিল, আজ সেই শ্রেণির আধুনিক বংশধররাই ওই সব অঞ্চলে জনসংখ্যার বিস্ফোরণের জন্য চেঁচামেচি করছে। শিল্প দূষণের পাশাপাশি, দৈত্যাকার কর্পোরেটদের তৈরি নষ্টখাদ্য ও পানীয় বহুস্তরীয় প্যাকেটে পুরে বিপণনের কারণেই ভূপৃষ্ঠে এবং সমুদ্রজলে প্লাস্টিক দূষণ ও আবর্জনার পাহাড় জমছে। অটোমোবাইল এসি ফ্রিজ ইত্যাদি উৎপাদন ও ব্যবহার বাতাসে গ্রিনহাউজ গ্যাসের সঞ্চয় অতি দ্রুত হারে বৃদ্ধি করছে। এই রকম সমস্ত ঘটনা থেকে বাস্তুতন্ত্রের ধ্বংসকারক শ্রেণিকে চিনতে হবে, চেনাও যাবে। বিশ্বের জনসমষ্টির যে এক শতাংশ আজ বিশ্বের ৫৮ শতাংশ সম্পদ কুক্ষিগত করে বসে আছে, সারা বিশ্বের যাবতীয় প্রাকৃতিক সম্পদ ক্ষয় ও পরিবেশ ধ্বংসের জন্য তারাই সর্বাধিক পরিমাণে দায়ী। আর চিনতে হবে তাদের পেছনে “গণতন্ত্র” নামক হিজাব পরিধান করে দাঁড়িয়ে থাকা ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রকেও। যে এই এক শতাংশ বিশ্ববাসীর লুটপাটের পাহারাদার, আপতকালে রক্ষাকর্তা।

“মানুষ করছে”, “মানুষের হাতে প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে”—এইভাবে বললে বাস্তুতন্ত্রের আসল ধ্বংসকারীদের আড়াল করে ফেলা হয়। অর্বুদ অর্বুদ আম জনতার ভিড়ে কয়েক লক্ষ পরিবেশ-দস্যু সহজেই লুকিয়ে পড়তে পারে। পড়েও। আর নিরপরাধ মানুষেরা দোষের ভাগী হয়ে যায়। আমাদের এই বিপদ সম্পর্কেও সতর্ক হতে হবে। শ্রেণি বিচারকে সামনে এনে মার্ক্সবাদই একমাত্র এই ব্যাপারে আমাদের সাবধান করে দেয়। অন্য ভাষায় বলতে গেলে, আমরা যদি গূঢ় অপরাধ এবং তার আসল অপরাধীদের চিহ্নিত করতে না পারি, তাহলে তাদের সর্বগ্রাসী থাবা থেকে প্রকৃতিকে কখনই রক্ষা করতে পারব না। পাড়ার নিরীহ মুদির দোকানে সদলবলে গিয়ে দুদিন ধরে প্লাস্টিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রচারের মধ্যেই আমাদের যাবতীয় আন্দোলন সীমাবদ্ধ ও স্তিমিত হয়ে থাকবে। প্লাস্টিক উৎপাদকের টিকিও আমরা ছুঁতে পারব না। তাই আজ এখানে মার্ক্সবাদী বীক্ষণের প্রয়োজন। মার্ক্সীয় চিন্তার আলোকে পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র অধ্যয়নই আমাদের পথ দেখাতে পারে। সেই পথ অবিকল্প ও একমাত্র। 

মার্ক্সবাদ বলে যে সমাজতন্ত্র গড়ে উঠবে এক পরিকল্পিত অর্থব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা যখন ভারসাম্য রক্ষাকারী উন্নয়ন (sustainable development)-এর কথা বলেন, তার যা মর্মবস্তু, তা আসলে কমিউনিস্টদের বহুপ্রচারিত সেই পরিকল্পিত উন্নয়ন (planned development) ছাড়া অন্য কিছু বোঝায় না (কথাটা আমার নয়; বলেছেন আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট, নবীন প্রজন্মেরএকজন বামপন্থী কর্মী, ডঃ অরিন্দম মজুমদার [মজুমদার ২০১৮])। শুধু মনে রাখতে হবে, গত শতাব্দের সমাজতন্ত্রে এই পরিকল্পনা বলতে যা এবং যদ্দুর বোঝাত, আগামী দিনের সমাজতন্ত্রে পরিকল্পনার পরিধি তার চাইতে অনেক বড় হবে এবং উৎপাদনের খরচের মধ্যে একটা কেন্নো বা একটা গুল্মকেও বাদ দেওয়া যাবে না। আর এরকম খরচ যোগ্য প্রতিটি প্রাকৃতিক উপাদানকেই তা পুনরুৎপাদনযোগ্য কিনা বুঝে নিয়ে তবে খরচ করতে হবে। অর্থাৎ,পরিবেশ সম্পর্কে আমাদের ধ্যান ধারণারও আমূল পরিবর্তন হয়ে যাবে সেদিন। একটা দেশের জনসংখ্যা অনুযায়ী বাড়িঘর স্কুল কলেজ হাসপাতাল রাস্তাঘাটের জন্য কটা গাছ কাটা যেতে পারে, এলাকা বিশেষে কৃষিতে ভৌম জল ব্যবহার করা যাবে কিনা, গেলে কতটা যাবে—এসবেরও হিসাব ও পরিকল্পনা করতে হবে। পরিবেশের সঙ্গে সংযুক্ত করে তৃণমূল স্তর থেকেই আনুষঙ্গিক পরিকল্পনা ও তার যথাযথ রূপায়ণ করতে হবে।

সেই পরিকল্পনা হবে আরও সার্বিক, আরও সুদূর প্রসারী, আরও সর্বাত্মক। তত্ত্বগতভাবে আমাদের মার্ক্সবাদী বীক্ষণে সেই মতো প্রস্তুতি নিতে হবে।

আজ থেকেই।

 

সহায়ক গ্রন্থসূত্র

 

সমর বাগচী (২০১০), পরিবেশ ও উন্নয়ন; অবভাস, কলকাতা।

অরিন্দম মজুমদার (২০১৮), “পরিবেশ আন্দোলনএবং শ্রেণীসংগ্রাম”; আহ্বান, অক্টোবর ২০১৮।

Paul Burkett (2005), “Marx’s Vision of Sustainable Human Development”; Monthly Review, Vol. 57 No. 5 (October 2005).

Paul Burkett (2014), Marx and Nature; Haymarket Books, Chicago.

Fidel Castro (1992), Tomorrow will be Too Late; National Book Agency, Kolkata.

Rebecca Clausen (2007), “Healing the Rift: Metabolic Restoration in Cuban Agriculture”; Monthly Review, Vol. 59 No. 1 (May 2007).

Frederick Engels (1974), Dialectics of Nature; Progress Publishers, Moscow.

Carl Fraas (1847), Climate and Plant Kingdom in Time (in German); Landshut.

John Bellamy Foster (2000), Marx’s Ecology: Materialism and nature; Monthly Review Press, New York.

John Bellamy Foster (2008), “Ecology and the Transition from Capitalism to Socialism”; Monthly Review, Vol. 60 No. 6 (November 2008).

John Bellamy Foster (2011), “Capitalism and the Accumulation of Catastrophe”; Analytical Monthly Review, Vol. 9 No. 9 (December 2011).

John Bellamy Foster (2015), “Marxism and Ecology”; Analytical Monthly Review, Vol. 13 No. 9 (December 2015).

John Bellamy Foster, Brett Clark and Richard York (2010), The Ecological Rift: Capitalism’s war on the earth; Monthly Review Press, New York.

John Bellamy Foster and Paul Burkett (2017), Marx and the Earth: an Anti-critique; Haymarket Books, Chicago.

Richard Levins (2007), “How Cuba is Going Ecological”; in Richard Lewontin and Richard Levins (2007), Biology under the Influence; Monthly Review Press, New York.

Paul MacGarr (2000), “Why Green is Red: Marxism and the threat to the environment”; International Socialism, Issue: 88; Autumn 2000.

Paul MacGarr (2005), “Capitalism and Climate Change” International Socialism, Issue: 107; Posted: 27 June 2005.

Karl Marx (1959), Capital, Vol. III; International Publishers, New York.

Karl Marx (1973), Grundrisse; Penguin Books, London.

Karl Marx and Frederick Engels (1965), Selected Correspondence; Progress Publishers, Moscow.

Kohei Saito (2016a), “Marx on Ecology: New insights from his Notebooks”; Analytical Monthly Review, Vol. 13 No. 11 (February 2016).

Kohei Saito (2016b), “Why Ecosocialism Needs Marx”; Monthly Review, Vol. 68 No. 6 (November 2016).

Kohei Saito (2017), Karl Marx’s Ecosocialism: Capital, nature and the unfinished critique of political economy; Monthly Review Press, New York.

 

[যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের উদ্যোগে কার্ল মার্ক্সের জন্মদ্বিশতবর্ষ উপলক্ষে

ফেব্রুয়ারি ২০১৮-তে আয়োজিত সেমিনারে প্রদত্ত ভাষণের ইংরাজি খসড়া পত্রের পরিমার্জিত অনুবাদ]