বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা ও যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি

বঙ্গদেশে - বস্তুত ভারতেই - বিজ্ঞানে যাঁরা নবযুগ আনলেন  তাঁদের জন্ম  ১৮৫৫ থেকে ১৮৬৫-র মধ্যে। এই অর্থে নবযুগ, যে তাঁরা বিজ্ঞানকেই পেশা করে নিলেন - যার পূর্বাভাস আমরা পেয়েছিলাম রাধানাথ শিকদার আর মহেন্দ্রলাল সরকারের মধ্যে। এঁরা সকলেই যে যুগান্তকারী অবদান রাখলেন, তা হয়তো নয়, কিন্তু সিরিয়াস বিজ্ঞানচর্চার ধারাটাকে অনর্গল করে দিলেন। এঁদের কারওই বিজ্ঞান অনুধাবনের পথ সুগম ছিল না। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি (১৮৫৯-১৯৫৬) এই প্রজন্মরই লোক।  যোগেশচন্দ্রর বিজ্ঞানশিক্ষা, বিজ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞান-অধ্যাপনার পথেও বিঘ্ন কিছু কম আসেনি। এমনকি র‍্যাভেন্‌শ কলেজে বিজ্ঞানের শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক হিসেবেও তাঁকে কত যে প্রতিবন্ধকের সম্মুখীন হতে হয়েছে তার বিবরণ মেলে তাঁর  আত্মচরিতে। তবে সেসব প্রতিবন্ধকের চাপ তাঁর স্বাতন্ত্র্যঋদ্ধ মননের পেশিকে আরো সবলই করেছিল।

তিনি ছিলেন একাধারেঃ উদ্ভিদতত্ত্ববিদ, রসায়নবিদ,  সরকারি কলেজের (মূলত কটকের র‍্যাভেন্‌শ কলেজের)  বিজ্ঞানশিক্ষক, বাংলায় বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তক লেখক, পুরাতত্ত্ববিদ, প্রাচীন ভারতের জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাস-রচয়িতা, বাংলার ধর্মীয় ইতিহাস-রচয়িতা এবং বাংলা ভাষার প্রথম বিজ্ঞানসম্মত অভিধান-প্রণেতা, যাঁর কাছে ঋণী ছিলেন স্বয়ং হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

এখানেই শেষ নয়। তিনি ছিলেন লোক-বান্ধব স্বদেশি প্রযুক্তির উদ্ভাবক।  জল তোলার জন্য 'পবনচক্র' (উইন্ড্‌মিল) এবং অতি সহজে বসানো ও চালানো যায় এমন একটি নলকূপের নকশা করেছিলেন তিনি।

ইংরেজি না-জানা প্রাচীনপন্থী ওড়িয়া জ্যোতির্বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর সামন্তর নিজের হাতে বানানো বাঁশের যন্ত্রপাতির সাহায্যে আকাশ পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আধুনিক  পর্যবেক্ষণ কীভাবে এবং কতটা মিলে যায়, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে চমৎকৃত হন যোগেশচন্দ্র।  ওড়িয়া লিপিতে, কিন্তু সংস্কৃত ভাষায় লেখা চন্দ্রশেখরের সিদ্ধান্তদর্পণ  পুঁথিটি তিনি দেবনাগরী হরফে ছাপার ব্যবস্থা করেন। তারপর ১৮৯৯ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ করে সেটির এক দীর্ঘ ভূমিকা লিখে বইটি পাঠান নেচার পত্রিকায় সমালোচনার জন্য। ওই পত্রিকায় উচ্ছ্বসিত প্রশংসা বেরোয় সামন্ত মহাশয়ের কাজের। যোগেশচন্দ্রর মতে, প্রাক্‌-দূরবীক্ষণ যুগের শ্রেষ্ঠ ইউরোপীয় জ্যোতিঃ-পর্যবেক্ষক ডেনমার্কের টাইকো ব্রাহের সঙ্গেই তুলনীয় সামন্ত মহাশয়ের পর্যবেক্ষণ। নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত আলোচনায় বলা হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামন্তর কৃতিত্ব ব্রাহেকে ছাপিয়ে গেছে। সামন্তকে কার্যত ‘আবিষ্কার’ করে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীসমাজের সামনে তুলে ধরার কাজটি করেছিলেন যোগেশচন্দ্র। ওড়িশাবাসী এজন্য তাঁর কাছে চিরঋণী। তাঁর ‘বিদ্যানিধি’ উপাধিটি ওড়িশার পণ্ডিতসমাজেরই দেওয়া। ভারতের বিজ্ঞানের ইতিহাসে তাই চন্দ্রশেখর সামন্তর পাশাপাশি যোগেশচন্দ্রর নামও অক্ষয় হয়ে থাকবে।

     যোগেশচন্দ্রর আমাদের জ্যোতিষ ও আমাদের জ্যোতিষী (Our Astronomy and Our Astronomers)  একটি অমূল্য গ্রন্থ। একটু উদাহরণ দিই। ভাস্করাচার্যের মতে, পৃথিবী শূন্যেই অবস্থিত, কোনো আধার তাকে ধরে রাখেনি। যোগেশচন্দ্রর প্রশ্ন: 'পৃথিবী যদি শূন্যেই অবস্থিত, তবে নীচে পড়িয়া যাইতেছে না কেন?' এ প্রশ্নের উত্তর তিনি দেন ভাস্করাচার্যের জবানিতেঃ  

পৃথিবীর আকর্ষণ শক্তিবশতঃ শূন্যস্থিত গুরু বস্তু পৃথিবীর দিকে আকৃষ্ট হয়। তখন আমরা মনে করি যেন বস্তুটি পড়িতেছে; কিন্তু বাস্তবিক তাহা পৃথিবীকর্ত্তৃক আকৃষ্ট হইতেছে। পৃথিবীর চারিদিকেই সমান আকাশ, উহা কোথায় পড়িবে? পৃথিবীর যেখানেই  যিনি থাকুন, তিনি তাহাকে তলস্থ এবং আপনাকে তাহার উপরে স্থিত মনে করেন। পৃথিবীর ব্যাসের দুই প্রান্তে দুই মনুষ্য, নদীতীরে দণ্ডায়মান পুরুষও ছায়ার ন্যায় অধঃশিরস্ক থাকেন। আমরা যেখানে দাঁড়াইয়া আছি, অধঃস্থিত মনুষ্যেরাও তেমনই অনাকুলভাবে স্থির আছেন।

ভাস্করাচার্যের এই অকাট্য যুক্তি উপস্থাপন করার পর যোগেশচন্দ্র একটি পাদটীকা যোগ করে লিখেছেনঃ 'উৎপল সুন্দর বলিয়াছেন, "যদি পৃথিবী অবশ্য পড়িবে, তবে কোথায় পড়িবে? অধোদিকে? কিন্তু অধঃটা কি? প্রতিযোগিসাপেক্ষশ্চাধঃ।" পৃথিবীর চরিদিকেই যে আকাশ।' ঊর্ধ্ব, অধঃ, এইসব ধারণাগুলি যে আপেক্ষিক, আপেক্ষিকতা তত্ত্বের হরেক জনবোধ্য বইয়ের কল্যাণে তা আজ সর্বজনবিদিত। কিন্তু আজ থেকে আটশো বছর আগে পৃথিবী গ্রহের সাপেক্ষে এত পরিচ্ছন্ন যুক্তিতে এমন প্রাঞ্জলভাবে বিষয়টিকে পরিবেশিত হতে দেখে অভিভূত হতে হয়।   

বাস্তবিক, এই মহাকাশে আমাদের এই পৃথিবী নামক গ্রহটি কীভাবে অবস্থিত? পুরাণে বলে, তা কারও পিঠে বা মাথায় - ফণায় - চেপে আছে। এ নিয়ে কম তর্কাতর্কি হয়নি ভারতীয় পণ্ডিতদের মধ্যে। নশো বছর আগে ভাস্করাচার্য  (১১১৪-১১৮৫) লিখেছিলেন, পৃথিবী নামক 'এই ভূপিণ্ডের কোন আধার নাই; নিজের শক্তিতে আকাশে দৃঢ়ভাবে অবস্থিত রহিয়াছে। ইহার পৃষ্ঠে সমুদয় চরাচর বিশ্ব দানব মানব দেব দৈত্য বাস করিতেছে।' যোগেশচন্দ্রর প্রশ্নঃ  'তবে  যে পুরাণে পৃথিবীর আধারপরম্পরা বর্ণিত আছে, তার কি?' ভাস্করাচার্যর উত্তর - 'যদি এই পৃথিবীর কোন মূর্ত্তিবিশিষ্ট বস্তু বা প্রাণীরূপ আধার থাকিত, তাহা হইলে তাহার একটি আধার, আবার সেই আধারের একটি আধার আবশ্যক হইত। সুতরাং এই অনুমানে অনবস্থা-দোষ (যাহার শেষ নাই) হইতেছে।'

মহাকাশের ভাষায় বরাবরই জড়িয়ে আছে দর্শনের ভাষা। যোগেশচন্দ্র সহজ করে বন্ধনীর মধ্যে যে-জিনিসটাকে 'যাহার শেয নাই' বলে বুঝিয়েছেন, দর্শন ও তর্কশাস্ত্রে  সেটারই গালভরা নাম অনবস্থা-দোষ বা infinite regression. সাদা বাংলায় ব্যাপারটা এইরকমঃ পৃথিবী যদি একটা কোনো কিছুর ঘাড়ে চেপে থাকে, তাহলে সেই জিনিসটাও নিশ্চয়ই অন্য কোনো কিছুর ঘাড়ে চেপে থাকবে। এইরকমভাবে সবকটা জিনিসেরই - সবকটা আধারেরই - আবার একটা করে আধার লাগবে; এই আধার-পরম্পরার তো কোনও শেষ নেই। এর দ্বারা কোনো সিদ্ধান্তে  পৌঁছনো যায় না। তাই এ যুক্তি দর্শনে অগ্রাহ্য, বিজ্ঞানেও।

এর বিকল্প যুক্তিটা ছিল এই যে পৃথিবীটা নিশ্চয়ই মহাকাশে শূন্যে ঝুলে আছে। কিন্তু অতবড় ভূপিণ্ডটা ঝুলে আছে, এটাই বা কীরকম কথা? এর উত্তরে ভাস্করাচার্য যা বলেছিলেন, তার সুন্দর বাংলা করেছেন  যোগেশচন্দ্র –

যদি বল, আধারের শেষ আছে, তবে সেই শেষের আধারটি নিজের শক্তিতে স্থির আছে, বলিতে হইবে। সেই আধারটিই যদি স্বশক্তিতে স্থির থাকিতে পারে, তবে পৃথিবী পারিবে না কেন?

 

অতএব, ভাস্করাচার্যর অকাট্য যুক্তি, পুরাণ যাই বলুক, পৃথিবী কারও ঘাড়ে বা ফণায় চেপে নেই; তা সসম্মানে নিজগুণে ঝুলে আছে মহাকাশে।

ভাস্কর যখন এই কথা লিখছেন, তখনও নিউটনের আপেল পড়েনি। পড়ে-যাওয়া ব্যাপারটা যে আসলে একটা আকর্ষণ-বলের ক্রিয়া,  সেটা তখনই ভাস্করের জানা ছিল। তাহলে কি ভাস্কর নিউটনের ঢের আগেই অভিকর্ষর তত্ত্ব আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন? অনেকে সেই রকম ভেবে জাতীয়তাবাদী তৃপ্তি লাভ করতে চান।  যোগেশচন্দ্র কী বলেন? - 'কোন কোন অল্পজ্ঞ ব্যক্তি ভাস্করের এই যুক্তি দর্শাইয়া নিউটনের আবিষ্কারের গুরুত্ব খর্ব্ব করিয়া থাকেন। তাহাদের জানা আবশ্যক, উভয়ের মধ্যে আকাশ পাতাল অন্তর।' স্বাদেশিকতা তাঁর বৈজ্ঞানিক কাণ্ডজ্ঞান হরণ করতে পারেনি।

এ থেকে আমরা এই শিক্ষা লাভ করি যে, বিজ্ঞানে একটা বৈপ্লবিক ধারণা উত্থাপন করাটাই যথেষ্ট নয়; যতক্ষণ না সেটাকে পরীক্ষা সহযোগে নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসারে প্রমাণ করা যাচ্ছে, ততক্ষণ সেটা  তত্ত্ব বলে মান্য হবে না।

 

জগদীশচন্দ্রর ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট যোগেশচন্দ্র

সমসাময়িক বিজ্ঞানজগতের আর এক ধনুর্ধর জগদীশচন্দ্র বসুর কাছে যোগেশচন্দ্র বিশেষ ঋণী ছিলেন। চট্টগ্রাম থেকে ফিরে তাঁকে কিছুকাল প্রেসিডেন্সি কলেজে 'বোস সাহেবে'র ল্যাবরেটরি সহায়কের কাজ করতে হয়েছিল।  এতে যোগেশচন্দ্রর মস্ত সুবিধে হল। বিদ্যায়তনিক পরিচয়ে তিনি উদ্ভিদবিদ্যার এম এ, কিন্তু পদার্থবিদ্যা আর রসায়নে তাঁর অগাধ আগ্রহ। কটকে র‍্যাভেন্‌শ কলেজে তিনি সবই পড়াতেন। তাঁর কথায়, ‘ভূত-বিদ্যা আমার পড়া ছিল, কিন্তু উচ্চাঙ্গের যন্ত্র পাইনি, ক্রিয়া দেখতে পাইনি। এখানে লাইব্রেরিতে বই, ক্রিয়াশালায় যন্ত্র পেয়ে আনন্দ হল। ১০টা হতে ৫টা, কোনোদিন পাঁচ মিনিট বসিনি।‘

    ‘প্রেসিডেন্‌সি কলেজে ঢুকবার ডানদিকের একতলা প্রোফেসর জে সি বোসের লেবরেটরি বা ক্রিয়াশালা। তিনি কলেজে বোস সাহেব নামেই পরিচিত ছিলেন, যদিও সাহেবী পোষাক পরতেন না।‘ যোগেশচন্দ্র ঠিক করলেন, ফটোগ্রাফি শিখবেন।  জগদীশচন্দ্র ফটোগ্রাফির ওস্তাদ। যোগেশচন্দ্রর কথায়, ‘বোস সাহেব তখন ফটো ভাল তুলতে পারতেন। তাঁর দুটা কেমেরা ছিল, একটা হাফ প্লেট আর একটা ফুল প্লেট, বেশী দামের। তখনকার দিনে ছোটটার দাম প্রায় ৮০ টাকা। বলবামাত্র সেটা তিনি আমাকে দিলেন।‘ চলল তাঁর ক্যামেরা চর্চা, পরবর্তীকালে উদ্ভিদচর্চায় যা কাজে লেগেছিল।

    জগদীশচন্দ্রর ল্যাবরেটরির যে-বিবরণ দিয়েছেন যোগেশচন্দ্র, তা অত্যন্ত উপাদেয় ও বস্তুনিষ্ঠঃ  ‘প্রেসিডেন্‌সি কলেজে বহু আড়ম্বর, উপরতলায় ভূত-বিদ্যার লেকচার হত, সেখানে রাজকৃষ্ণবাবু এসিষ্টান্ট দু’তিনজন বেহারা নিয়ে  থাকতেন। নীচের তলায় চারিখানা বড় বড় ঘরে তাড়িত ক্রিয়াশালা, বোস সাহেব কর্তা। কেবল একখানি ঘরে গোটা কয়েক দামী তাড়িত যন্ত্র ছিল। সেখানে এক বেহারী বেহারা, নাম নোনকু, আর এক পলটন-ফেরৎ গোরা কানে খাট মিস্ত্রি ছিল। এইসব ঘরে টেবিলের দেরাজে দেরাজে যন্ত্র ছিল, কি আছে, কে জানে। বিলাত হতে যে বাক্‌স এসেছিল, সে বাক্‌সও খোলা হয়নি। শেষের দিকে এক ছোট ঘরে ষ্টীম এঞ্জিন ও ডিনামো ছিল, মিস্ত্রী ডিনামো চালাত। ৩২টা বড়, বড় তাড়িত আধান (পাত্র, আধার) (accumulator) তাড়িতে পূর্ণ হত। আমার আগে বোস সাহেব সব দেখাশুনা করতেন। তিনি আমাকে প্রত্যহ কিছু না কিছু কাজ বাতলাতেন। তাতে আমারও শেখা হত।‘

    যোগেশচন্দ্র স্বেচ্ছায় প্রেসিডেন্সিতে আসেননি। তাঁকে বিশেষ সরকারি আদেশে সেখানে আনা হয়েছিল। একদিকে যেমন ‘বোস সাহেবের’ সংস্পর্শে তিনি হাতে ও কলমে পদার্থবিদ্যার উন্নত চর্চার সুযোগ পেয়ে ধন্য বোধ করলেন, তেমনি কলেজ কর্তৃপক্ষের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিনা কারণে তাঁকে অনেক অশান্তি ভোগ করতে হল। এমনকী তাঁর ‘বেতন বৃদ্ধি স্থগিত হয়েছিল। ষাঁড়ে ষাঁড়ে যুদ্ধ হয়, উলুখড়ের প্রাণ যায়।‘ একদিন তিনি খবর পেলেন, তাঁকে সরানোর মতলব করছে এক পক্ষ।  বোস সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন কিনা। ‘তিনি হেসে বললেন, আমি যখন শুক্রবারে সামনের মাঠে ফটো তুলছিলাম, তখন পেড্‌লার সাহেব দু-তলার বারাণ্ডা হতে দেখছিলেন। বোস সাহেবের হাসির কারণ আছে, আমি এক ঝাঁকামুটেকে ঝাঁকার পিঠে বসিয়েছিলাম।‘  রসায়ন ল্যাবরেটরিতে নতুন এক ক্যামেরা এসেছে, ‘আমি তার লেন্‌স পরীক্ষার নিমিত্ত কাউকে না পেয়ে ঝাঁকামুটেকে বসিয়েছিলাম। প্লেট কোথায় যে তুলব?’ যোগেশচন্দ্রর মতে, ‘ব্যাপারটা কৌতূহলজনক বটে, কিন্তু অন্যে হলে আমাকে ডেকে পাঠাতেন, জিজ্ঞাসা করতেন।‘ তা না করেই পেড্‌লার সাহেব তাঁকে সরাবার মতলব করলেন। যোগেশচন্দ্রর মতে, ‘বোস সাহেবের প্রতি ঈর্ষাও এক কারণ। বোস সাহেব মাত্র চারি বৎসর এসেছেন, এক ক্রিয়াশালা করেছেন, আর দেড়শ টাকা বেতনের এক অ্যাসিষ্ট্যান্ট পেয়েছেন।‘

প্রায় আট মাস তিনি জগদীশচন্দ্রর ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্টান্টের কাজ করেছিলেন। এই আটটি মাস তাঁর জীবনে স্মরণীয় হয়ে ছিল। 

জগদীশচন্দ্রর সঙ্গে এই সম্পর্ক তাঁর দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। তার বহু নিদর্শন আছে।  ১৮৯৬ সালে ইন্ডিয়ান ম্যাগনেটিক সার্ভে সম্বন্ধে জগদীশচন্দ্রর কাছে তথ্য চেয়েছিলেন তিনি। অক্ষমতা জানিয়ে জগদীশচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘আমি ট্রিগোনোমেট্রিকাল সার্ভে-তে খোঁজ নিয়েছিলাম, তারা এবিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেনি।  ... পুরোনো যেসব রেকর্ড আছে সেগুলো খুব নির্ভরযোগ্য নয়।‘  প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, শুধু জগদীশচন্দ্রই নন, চন্দ্রশেখর বেঙ্কটরামনের কাছেও সূর্যাস্তের নানা আভার ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন যোগেশচন্দ্র, এবং রামন সযত্নে তার আট পাতা-জোড়া হাতে-লেখা উত্তর দিয়েছিলেন। যোগেশচন্দ্রর  সজীব বৈজ্ঞানিক আগ্রহর ব্যাপ্তির নিদর্শন এইসব ঘটনা। 

যোগেশচন্দ্র যখন চন্দ্রশেখর সামন্তর সিদ্ধান্ত-দর্পণ ইংরেজিতে অনুবাদ করে মস্ত ভূমিকা লিখে প্রকাশ করেন, যা নন্দিত হয় খোদ নেচার কাগজে, তখন অভিনন্দন জানিয়েছিলেন জগদীশচন্দ্র আর প্রফুল্লচন্দ্র উভয়েই।  ১৮৯৭ সালে ডাক্তারি ছাত্রদের জন্য যোগেশচন্দ্রর  লেখা পদার্থবিজ্ঞানের পাঠ্যবই ক্লাসে পড়ানোর জন্য  শিক্ষাবিভাগের কাছে সুপারিশ করেছিলেন জগদীশচন্দ্র।

১৯০৪ সালে যোগেশচন্দ্রর মহাগ্রন্থ আমাদের জ্যোতিষী ও আমাদের জ্যোতিষ (Our Astronomers and Our Astronomy) অন্য অনেকের মতো জগদীশচন্দ্রকেও মুগ্ধ করেছিল।  যে-বিপুল পরিশ্রমে ওই বই রচিত হয়েছিল, যে-প্রাঞ্জল বাংলা গদ্যে বইটি লিখিত তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন তিনি। জগদীশচন্দ্রর তালিম খুবই কাজে লেগেছিল যোগেশচন্দ্রর। পরে যখন তিনি র‍্যাভেন্‌শ কলেজে পড়াতেন, তখন জগদীশচন্দ্ররই পথ অনুসরণ করে সেখানে রয়েন্টগেন-রশ্মি উৎপাদন করতেন শুধু নয়, ভাঙা হাড়ের ছবি তুলেও সকলকে অবাক করে দিতেন। জগদীশচন্দ্রর কাছ থেকে একবার একটি 'রুমকর্ফ কয়েল' ধার চেয়েছিলেন তিনি। উত্তরে জগদীশচন্দ্র জানিয়েছিলেন, তাঁর ল্যাবরেটরিতে মাত্র দুটি রুমকর্ফ কয়েল আছে। একটি যদি কোনোক্রমে অকেজো হয়ে যায়, তাহলে তিনি আতান্তরে পড়ে যাবেন। ১৯১৬/১৭ সাল নাগাদ যোগেশচন্দ্র নিজে হাতে রুমকর্ফ বানিয়ে নিয়েছিলেন। কত অসুবিধের মধ্যে এই বিকাশপর্বের বিজ্ঞানীদের ও বিজ্ঞানকর্মীদের কাজ করতে হত, ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়।

প্রফুল্লচন্দ্র-জগদীশচন্দ্র-রামেন্দ্রসুন্দর – সেসময়কার বিজ্ঞানজগতের এই তিন মহীরুহর সঙ্গেই তাঁর ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি খুবই আগ্রহজনক। উল্লেখ করব, মহেন্দ্রলাল সরকারের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ হয়েছিল, রোগী হিসেবে এবং বিজ্ঞানের পাঠ্যবইয়ের লেখক হিসেবে। প্রফুল্লচন্দ্র-জগদীশচন্দ্র–যোগেশচন্দ্র বৌদ্ধিক লেনদেন নিয়ে চর্চা করার প্রচুর অবকাশ আছে। বিষয়টি প্রায় অনালোচিত।

------

Prof. Ray compares the author very properly to Tycho [Brahe, 1546-1601]. But we should imagine him to be greater than Tycho. … We get some notion of the success that attended the work, of how much it is in one man’s power to accomplish, if we examine the differences between the value he assigns to some of the constants of astronomy and those in use with ourselves. The error in the sidereal period of the sun is 206 seconds; of the moon 1 second; mercury 79 seconds; Venus, about 2 minutes; Mars, 9 minutes; Jupiter, an hour; and saturn, rather more than half a day. The accuracy with which he determined the inclination of the planets to the ecliptic is still more remarkable. – Nature, March 9 1899

 

শ্রীযোগেশচন্দ্র রায়, আমাদের জ্যোতিষী ও জ্যোতিষ প্রথম ভাগ  (Our Astronomers and Astronomy: A Short Account of Hindu Astronomy), ২৫ নং রায়বাগান স্ট্রীট, ভারতমিহির যন্ত্রে সান্যাল এন্ড কোম্পানি দ্বারা মুদ্রিত এবং ২৮/৪ অখিল মিস্ত্রীর লেন, শ্রীকেদারনাথ বসু বি. এ. কর্ত্তৃক প্রকাশিত; শক ১৮২৫ (190৩)  পৃষ্ঠা ??