দলিত সাহিত্য কাকে বলে ?

নলিনী বেরার "উঠিল সুয়ারি,বসিলা নাহি" ও শশীভূষণ দাশগুপ্তর "জংলা মাঠের ফসল" - এই দুটি বইয়ের আলোচনাসূত্রে দলিত সাহিত্য কাকে বলে সেই প্রশ্নটিকে নিয়ে চিন্তা উদ্দীপক কিছু কথা এখানে বলেছেন আলোচক।

দলিত সাহিত্য কাকে বলে ? বা আরো স্পষ্ট প্রশ্ন হতে পারে , বাংলায় বা বাংলা ভাষায় দলিত সাহিত্য কাকে বলা হবে? বাংলা বলতে এখানে মান বাংলা নয়, কিন্তু সমগ্র বঙ্গদেশ ভূখণ্ডে যে অজস্র ভাষা , উপভাষা  আছে তার মধ্যে দলিত সাহিত্য বা দলিত ভাষা-সাহিত্য কি ? দলিতদের লেখা সাহিত্য ? [এই অর্থ পশ্চিম ভারতে মোটামুটি বিবর্তিত বা evolved রূপ] ,কিংবা দলিতদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লেখা সাহিত্য? [তা সে যেই লিখুক না কেন ], নাকি দলিতদের লড়াইএর, জীবনচর্যা  নিয়ে লেখা বই? না কি দলিত-সাবর্ণ সংঘাত এবং দলিত বিদ্রোহ বা দলিত assertion  নিয়ে লেখা বই?

এই সব বিভিন্ন চিন্তার মধ্যে দিয়েই এই বিশাল প্রতারক বা ডিসকোর্স এ বেরিয়ে এসেছে দুটি বিশেষ ধরণের বৈশিষ্ট।  এক , যা বহু দিন ধরেই চলে আসছে - আর তা হচ্ছে দলিতদের জীবনযাপনের চালচিত্র বা চলচিত্র , আমরা এই ক্যাটাগরি বা বিভাজনে পেয়েছি  সতীনাথ ভাদুড়ী, মানিক বন্দোপাধ্যায় বা ইদানিং কালে আফসার আহমেদ, আনসারুদ্দিন, কিন্নর রায় বা হামিরুদ্দিন মিদ্যা  র মতো অসাধারণ ক্ষমতাবান লেখকদের  লেখা , আর দুই, সম্পূর্ণ উপভাষায় লেখা বই, [পুরো narration  না হলেও, parole , narrative তো বটেই] যেমন বিশেষ করে নলিনী বেরা।  কবিতা উপভাষায় অনেক লেখা হয়েছে এবং প্রায় সবগুলোই অনবদ্য কিন্তু উপন্যাসের narrative কম হলেও গুরুত্বের  এর দিক থেকে অনেক বেশি জোরদার।

বহুতর উপন্যাসের মধ্যে দুটি বই বেশ কিছুটা দৃষ্টি আকর্ষক , কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপট, এবং ভিন্ন ধারা, মুন্সিয়ানা , ভিন্ন সময় এবং ভিন্ন বিষয়ের।  মিল শুধু একটাই - দুটোকেই কিন্তু দলিত সাহিত্যের ক্যাটেগরিতে ফেলা যায়  - অবশ্যই দৃষ্টিভঙ্গির সাপেক্ষে।  একটি নলিনী বেরা  সংকলিত "উঠিল সুয়ারি , বসিলা নাহি" [দে'জ প্রকাশনের] আর দ্বিতীয় টি সুপ্রিম প্রকাশনের "জংলা মাঠের ফসল" - লেখকের নাম শুনলে এক ধাক্কায় মাটিতে উৎপাটিত হতে হয় - শশী ভূষণ দাশগুপ্ত  - হ্যাঁ যিনি বাংলা সাহিত্যে অনবদ্য গবেষক যাঁর লেখা "শ্রী রাধার ক্রমবিকাশ" একেবারে  এক দুর্দান্ত বিপ্লব। এই একই ব্যক্তি যে এই ধরণের একটি উপন্যাস লিখতে পারেন তা না পড়লে কোনো ভাবেই বিশ্বাস হয় না।

নলিনী বেরার  উপন্যাস যাকে  বলে "হাটুয়া " ভাষায় এক সংকলন। অর্থাৎ জঙ্গল মহলের ওড়িয়া-বাংলা মিশ্রিত পশ্চিম মেদিনীপুরে ভাষায় লেখা অনেক তথাকথিত লোকগাথার সংকলন এবং তার সঙ্গে নলিনী বাবুর নিজের জীবনের অগাধ পান্ডিত্য এবং মহাসমুদ্রের মতো তাঁর সেই অঞ্চলের জীবনের অভিজ্ঞতার ছোট ছোট কাহিনীর সংকলন। একজন মানুষ যাঁর শৈশব ও কৈশোর সেই রাঢ়-প্রান্তিক দক্ষিণ এ গাঁয়ে গঞ্জে "ন্যাংটো ভুতুম সাধের কুটুম" হিসেবে চড়ে  কেটেছে আবার তার পর শহরের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা পেয়ে সরকারি আধিকারিকের চাকরির সুযোগ নিয়ে আবার পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন গ্রামে গঞ্জে চষে  বেড়ানোর অভিজ্ঞতা আছে , তিনি ই পারেন যথাসম্মত মমতায় আর মুন্সিয়ানায় বা এম্প্যাথি তে এই ধরণের উপন্যাস লিখতে।  শহরের বাবু সংক্স্রিতি, বাবু মানুষগুলোর কাছে গায়েঁ র সভ্যতাকে একটা রোমান্টিক কিছু ধরে নেওয়ার বাইরে মানুষগুলোর জীবনচর্যা যে কি কঠিন বাস্তব অথচ কি মায়াময় এবং মোহ -উন্মেচক তার এই মেলানো মেশানো উদাহরণ সৃষ্টি করতে গেলে কিন্তু  নিজেকে ওই জীবনের অংশ হিসেবে বড়ো  হতে হয় , এখানেই এই সাহিত্য দলিত সাহিত্য, নিজে  আঞ্চলিক মধ্যবর্গীও  মধ্যবৃত্তের মানুষ হিসেবে রেখেও যে সহমর্মিতা এবং সহ -আবেগে সিঞ্চিত করা এই মুন্সিয়ানা খুবই উচ্চস্তৰীয় অর্থাৎ এলিট মননশীলতার প্রয়োজন দাবি করে সেটা নলিনী বেরা  হাতে কলমে করে দেখিয়েছেন।

প্রতি মুহূর্তে নাগরিক উন্নাসিকতা [snootynessঅথচ এলিট নয় ] কি হাজারো রকম ভাবে বহমান সংস্কৃতি কে "লোক" এই অভিধার আড়ালে তাতাচ্ছিল্য এবং অমর্য্যদা করে আসছে , তাকে সম্মানের আসনে বসিয়ে একেবারে তাকে ব্রাত্য করে "শিক্ষিত, সংস্কৃতিবানের" দায়েরার  বাইরে অছ্যুৎ করে রেখেছে এবং তা আবার দিন কে দিন বাড়িয়েও রাখছে সেটা উনি তাঁর গল্পচ্ছলে লেখা প্রবন্ধ এবং সন্দর্ভের মধ্যে দিয়ে উপস্থাপন করেছেন।  প্রকৃতিকে romonticizeকরে যে তার পরিবেশ কে অশীলিত বলে পার পেয়ে যাওয়া যায় , আর তাকে একধরণের সাংস্কৃতিক অধমর্ণ হিসেবে রেখে নাগরিক (অ)সভ্যতাকে অভিজ্ঞানিত করা যায় , শুধু তা শিখতে নলিনী বেরা  পড়তে হবে।  আঞ্চলিক ভাষা কে প্রথমে "লোক" আর তার পরে তাকে "উপ" আখ্যা দিয়ে মান ভাষাটিকে ধীরে ধীরে আরো দূরবর্তী করে রাখা একটা সুচিন্তিত প্রকল্প , এই "প্রকল্প" কে অনুধাবন করতে গেলে নলিনীর চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো অভিজ্ঞান ফুটে ওঠে তাঁর গবেষণা ধর্মী প্রবন্ধ গুলোতে , কিন্তু সেখানেও কি অনবদ্য আন্টি-একাডেমিক narrative, যা আমাদের নিরস একাডেমিক এস্টাইল  কে এতো দিন "সম্মৃদ্ধ" করে এসেছে - তার বিপরীতে একটা আন্টি-থিসিস।   

দলিত সাহিত্যের ওপর যা যা লেখা [বিশেষ করে হাটুয়া  ভাষা নিয়ে[ তা নিয়ে বেশ কিছুটা আলোচনা করেছেন নলিনী।  অমিয়ভূষণের লেখার ওপর ওঁর আলোচনা বেশ গভীর।  শবর  চরিত  এ উনি অনেককিছর সামনে আমাদের হাজির করেছিলেন।  শবরদের  অত্যাচার করা  তো সাবর্ণদের জন্মগত অধিকার, আর পুলিশ হলে তো কথাই  নেই, হাতে অসম্ভব ক্ষমতা , আর সমাজ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে ধর্ষণ আর অত্যাচার এর বিরুদ্ধে কে কখন কোথায় আদালতের দরজা নাড়িয়েছে? আর শবর রা আবার কবে মানুষ হলো ? তাই তাদের জন্যে যারা কিছু একটা করতে চায় , তারাও তো শবরদের  করুনা  করে নিজে মহান হতে চায়।  পুরস্কার এর লালসাতেই সাবর্ণরা  ব্রাত্য মানুষের "সেবায়" বড়ো  দড়।  মানুষের জীবনচর্যা  কে নিয়ে সাহিত্য তাদের মতন করে, তাদের চিন্তায়, তাদের ভাষায় বিষয়টি গম্ভীর। মানুষের বাগধারা কিন্তু মানুষের জীবনদর্শনের প্রকাশমুখ।  তাই শব্দগুলো এক একটি হাতিয়ার , হাটুয়া ভাষা, অন্যান্য ব্রাত্য ভাষার এবং বাংলায় আসা, সেই শব্দগুলো আমরা পাই, তার ফর্দ  তিনি হাজির করেছেন।

আমাদের দেশে শিক্ষা সংস্কৃতির বিকাশ এসেছে এক হাঁসজারু মার্কা নাগরিক মানীকরণ  নামক ধাপ্পা থেকে, ব্রিটিশের দালালি করে।  যেখানে সর্বজনের মুখের জবানী একটা "ছোটলোকের" ভাষা, এমনকি মুসলমান শাসনের ফলে ফার্সি শব্দের প্রাবল্য আসলে দেশজ ভাষাকে ছোট করে দেখার জায়গা থেকেই এসেছে , মানে বাইরের থেকে ধার করা যায় কিন্তু দেশজ ভাষা শব্দ নয়. "মেইনস্ট্রিম" মানে সংখ্যালঘু পরজীবীদের পরাস্বপহারীদের ব্যবহারিক শব্দসমূহের সমাহার। আমরা যাকে  মেইনস্ট্রিম বলি তা যে আসলে খালের বা নর্দমার স্রোত সেটা বুঝতে আমরা অপারগ। ভদ্দরনোক হবার জন্যে সংস্কৃত, বা ইঞ্জিরি [ইংরাজি  কথাটি তো ওদের ইংল্যান্ডের মানুষ বলেন না ] বা নিদেন পক্ষে ফার্সি আমাদের লবযের  মধ্যে,কিন্তু লোকজ শব্দ নয় , অর্থাৎ যা আসলে মেইনস্ট্রিম সেটাকেই আমরা ব্রাত্য-অপর বলে মনে করে আসছি , এটাই আমাদের ভেতরে নিহিত দাসত্ত্ব , আমরা পোশাক পড়েছি বিদেশিদের নকল করে , কথা কোয়েছি তাদের নকলে , শিখেছি তাদের শেখানো ধারায় আর নিজেদের ডানা  কাটা বিদেশী পাখি মনে করেছি আর তাই সাবর্ণদের  কাছে এই বাংলায় পরে থাকা একটা দূরদৈব।আর ঠিক তাই প্রতি সুযোগে বিদেশে পালানোর ফিকির সাবর্ণদের  মধ্যে এতো প্রবল।  পড়াশুনো করেছি মানেই বিদেশে "সেটল" করবো।  আর মাঝে মাঝে একটু দেশ দেশ করে কাঁদবো, এই ক্রন্দনবিলাসিতাই আমাদের মতো সাবর্ণ দের  ছোটলোকদের করুনা করার সুযোগ এনে দেয়  . "তিতাস ও সুবর্ণরেখা" প্রবন্ধে নলিনী দেখালেন আমাদের দুটো উৎস , যাকে  আমরা লোকজ বলে আসলে একটা আত্মশ্লাঘা বোধ করি, তার পরেই আসে "অমিয়ভূষণ" ওপর প্রবন্ধ। আমরা সোজা চলে এলাম "প্রান্তজনের ভ্রান্ত অধিকার" এ যেখানে আমরা দেখি সাবর্ণ নাগরিক বাঙালী কি ভাবে এক ডানা  কাটা অনিকেত হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে শ্লাঘা বোধ করে।  ইঞ্জিরি বা মার্কিন সাহিত্যে মার্ক টয়েন  এর পথ ধরে আজ তার সাহিত্য প্রাক্তন দাসেদের বংশোদ্ভূতদের লেখা সাহিত্য , আমরা বিলেতি সাহিত্যে তো দেখছি প্রধান জায়গা নিয়েছে উপমহাদেশের লেখক অর্থাৎ প্রাক্তন নেটিভ দের  বংশোদ্ভূত লেখাগুলো।  কিন্তু আমরা কি নিচ্ছি এই বাংলায় ?

নলিনী আরো একটি অসাধারণ বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন " যে জীবন মিথ এর যে মিথ জীবনের " জীবন আর মিথের মধ্যেকার ফারাক যে একটা অলীক কল্পনা সেটা নির্দেশ করার পাশাপাশি আমরা পেলাম একটা প্রশ্ন - জীবন এর প্রাত্যহিক চর্যা এবং যাপন কেন মিথ হবে না ? আসলে যাপন করবো একটা জীবনধারা আর মিথ বানাবো সম্পূর্ণ অন্য জীবনধারা নিয়ে সেটাকেই আদর্শ ধরবো,  এই দাসত্ববোধই আমাদের নিজের মানুষদের থেকে সবর্ণদের অন্যের ভূতকে ভগবান বানানোর কল।  এটাকেই গভর্নমেন্টালিটি বলে , অর্থাৎ শোষকের দর্শন, চালচলন আমাদের পরিচালনা করে নিজের মানুষের নয় , আর তাই নিজের মানুষরা ছোটোলোক আর বিদেশিরা "সাহেব", সাহেবদের আদবকায়দা আর আর্যদের অধ্যাত্বিকতা এটাই সাবর্ণ দের  শিষ্টতা। অর্থাৎ এবার অন্ততঃ  দলিত সাহিত্য আমাদের বুঝতে এবং বলতে শেখাবে সাবর্ণ সংস্কৃতি শুধু দাসত্বের সংস্কৃতি ই নয় , বরং সর্বঅর্থে ছোটলোকের সংস্কৃতি , যা নিজের পড়শীর থেকে না শিখে যারা আমাদের ঘৃণা করে তাদের থেকেই জীবনদর্শনের রস  সংগ্রহ করে।  অর্থসংগতি হলে পশ্চিমারা নগর ছেড়ে গাঁয়ে গঞ্জে ডেরা  বাঁধে আমরা ঠিক তার উল্টো।  গ্রাম থেকে স্বেচ্ছায় উৎপাটিত হয়ে , উদ্বাস্তু হয়ে নগরে অর্ধ-ইতর জীবন যাপন করবার জন্যে মুখিয়ে থাকি এবং করি এবং তার পর "দেশে" গিয়ে ভদ্দরবাবু বনে  যায় কিন্তু বসি না কদাপি।  আমরা পৌঁছে যাই সেই "স্বর্গে" যেখান থেকে "দেশে" ফিরে  মানুষদের একটু আদিখ্যেতা দেখাই  , আর এই প্রকরণের উপাদান হচ্ছে নিজের ভাষা বা "আঞ্চলিক" ভাষা কে "আঞ্চলিক অর্থাৎ ব্রাত্য " ঘোষণা করে তার থেকে যথাসম্ভব পরহেজ থাকা।  ভাষার এই গভর্নমেন্টালিটি বাঙালী সাবর্ণ কে নাকি এক "নাগরিক" সভ্যতা দিয়েছে, এর চাইতে অসভ্যতা কি ই বা হতে পারে। নলিনী বেরা  সেই নির্দেশকদের একজন যা আমাদের সম্বিৎ ফিরিয়ে দেন।  এরই প্রতিফলন , হাতুয়া ভাষায় লেখা বিভিন্ন "মিথের" , নিজস্বকরণ বা পাঞ্চলিকরণ, তিনি যতগুলো পারেন তাদের পূর্ণ কপি হাজির করেছেন। 

দ্বিতীয়  বইটি গবেষক শশীভূষণ দাশগুপ্ত র লেখা "জংলা মাঠের ফসল" . উফফ! উনি যে এই ধরণের উপন্যাস লিখতে পারেন সেটা কতজনই বা জানতো ? এখানে গবেষণা নেই , আছে চিত্রনির্মান ! বরিশাল অঞ্চলের নাব্য বাদ অঞ্চলে শ্রেণী সংগ্রামের চূড়ান্ত রূপ. সময় এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু লড়াইয়ের ছবি যেমন বাস্তব, তেমন ভয়ঙ্কর এবং তেমনি বাংলার কৃষি মজুর দের  চালচিত্র।  নলিনী  বেরার  লেখায় যখন বর্গবৈষম্যের চিত্র পাই, এখানে পাই বাংলায় সামন্তবাদের শ্রেণীশোষণের ভয়ঙ্কর চিত্র।  শশীভূষণ কমিউনিস্ট ছিলেন কিনা কে জানে কিন্তু কোনো কমিউনিস্ট এতো নির্মোহ আন্টি-রোমান্টিক  ডিটেল এ চিত্রপট আঁকতে পেরেছেন কিনা তা বিতর্কসাপেক্ষ , এমনকি মানিকবাবুকে অনেক পিছিয়ে  ফেলে এসেছেন শশীভূষণ। সামন্তবাদী শোষণ , যে ভাবে প্রকৃতির খামখেয়ালি প্রকৃতি  কে হাতিয়ার করে সুদের শোষন কে ব্যবহার করে এক কৃষক বিলীনকারী অনাচার এবং আর্থিক সামাজিক গণহত্যা কে নামিয়ে এনেছিল বাংলার কৃষকের ওপরে তার চিত্রপট সাজিয়েছেন , যা মোটেই চিত্রকল্প নয় , একেবারে রূঢ় বাস্তব। কি করে সমর্থ কৃষক কে চোর বানিয়ে উৎখাত করে হিন্দু-মুসলমান জোতদারের একত্রেই চরম শোষণ চালাতো তার ছবি আমরা দেখলাম  , তাই এটাও দলিত সাহিত্য কারণ এখানে দলিতদের সামাজিক শোষণের সঙ্গে লড়ে  চলতে হয় সামাজিক এবং আর্থিক শোষণের লড়াই।  পার্টিশন নিয়ে একটা কোথাও না বলে তিনি কিন্তু ইঙ্গিত করেছেন কেন হিন্দু জোতদারদের দেশ থেকে তাড়ানোয় ক্ষেতমজুর মুসলমান দের  এতো উৎসাহ জন্ম নিলো। 

গরীবের পাশে তার ঈশ্বর যে কখনো দাঁড়ায় না , বরং গরীবের ওপর শোষণে প্রকৃতির খেয়াল মর্জি কি ভাবে একের পর এক ক্ষেত্রে মজুর কে অনিকেত বানিয়ে এক জনপদ থেকে আর এক জনপদে বিতাড়িত করে জনমজুড়ে পরিণত করে , যে ভাবে এই জন মজুরদের কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক কে গড়ে উঠতে এবং স্থীত হতে না দেওয়া হয় , তার চিত্ররূপ এঁকেছেন লেখক। মজুরদের মানবিক ভাব , ভালোবাসা, অপত্য , দাম্পত্য কিছুই থাকতে নেই , কারণ তারা ব্যক্তির না হলেও সমাজের বাঁধা বন্ধুয়া  মজদুর , যাকে  সমাজ ন্যূনতম ভাত ছড়িয়ে জোগাড় করে আবার মজুরি দেবার বদলে জেলে পুড়ে দেবে।  ভারতবর্ষের দাস ব্যবস্থা এটাই , যেখানে সামন্তবাদ  গ্রামের খেতমজুরের সমস্ত সম্পদ কেড়ে , তাকে জনমজুর বানিয়ে তারপর মহকুমায় মজদুরি করিয়ে সামন্ত প্রভুদের দাস বানায় , এটাই পশ্চিমের ব্যক্তি দাসমালিকত্ত্বর বদলে একটা শ্রেণীগত দাস ব্যবস্থার প্রকরণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সুদের কারবার , যা পুঁজি শোষণ , অর্থাৎ এক ব্যবস্থার থেকে পরের ব্যবস্থায় উত্তরণের সমস্ত রোমান্টিক কল্পনা যে আমাদের দেশে একেবারে অচল, তা একেবারে প্রমান সহ  তিনি দেখিয়েছেন , এখানে প্রত্যেকটি শোষণ ব্যবস্থা তার পূর্ববর্তী ব্যবস্থার প্রত্যক্ষ জেনেটিক সন্তান যা পূর্বজটির সহযোগিতায় একটা নতুন মুখোশ।  নায়ক এর নাম , তার ছেলের নামেও পর্যন্ত গ্রাম বাঙালী জনমজুরের একটা নিজস্বতা ফুটে উঠেছে।  ভালোবাসা যে কি অবান্তর একটি কল্পনা সেটা নায়ক বুঝলো শেষ মুহূর্তে।  শ্রম থাকে, তার মূল্য দেশ গাঁয়ে  পয়সা দিয়ে পরিমাপ হয় না , সেটা এমনকি ভালোবাসার মানুষের কাছেও নয়, বিস্বাসঘাতকতা যে একটা শ্রেণীশোষণ , তার ছবি লেখক দেখিয়েছেন - এটাই দলিত সাহিত্য। দলিতদের শ্রমের কোনো মূল্য হয় না , পরিমাপ তো না ই , তার নির্ধারিত হয় জোতদারের মর্জির ওপর, আর তা আবার পয়সায় না , কিছু ভাতে [কাপড়েও না ], আর বেশিটাই এক অলীক পাটীগণিতে যেখানে পুরোনো কর্জের   ভুক্তিতে , জন মজুরের কিছু করার থাকে না , বাধ্য হতে হয় , কারণ "ঈশ্বরের" দেওয়া পেট জ্বলতেই থাকবে , আর এই সবের পরেই ঈশ্বর তার প্রকৃতি নামক জোতদার কে দিয়ে ট্যাক্স কেড়ে নেয়, অতি ভয়ঙ্কর ভাবে , একেবারে নিঃসহায় , করে হয় ভাসিয়ে না হয় উৎখাত করে , কৃষকের অর্থাৎ জনমজুরের কোনো স্থাবর অস্থাবর কোনো সম্পত্তি ই থাকতে নেই , ঈশ্বর এর এমনটাই নিদান , তবুও এই বিভ্রান্ত মানুষগুলোই ঈশ্বরভীতিতে  কেঁচো ,  আর এই ধর্মীয় শোষণ বাংলার সামন্তবাদের আর এক রূপ, কিন্তু মুসলমান জোতদার , মুসলমান জনমজুরকে শোষণ করে হিন্দু জোতদারকে দিয়ে সুদের কারবারে ঠেলে দিয়ে , তখন কোনো ধর্ম নিদান প্রশ্ন করে না।  অর্থাৎ বহুতর শোষণে যা হাতিয়ার যাকে  দিয়ে ব্যবহার করিয়ে দরিদ্র খেতমজুরকে দাবিয়ে রাখা যায় , তাতে সব রকমের প্রকরণই দস্তুর এবং সিদ্ধ। 

শেষের অংশটি বুক চিরে খুন বার করার চিত্রনাট্য।  একটাই ছত্র , একটাই শব্দ , একটাই আর্তনাদ , শুধু প্রেমিকার নাম!, সে ও শেষ কালে তার দুর্বলতার মধ্যে দিয়ে শ্রেণী  চরিত্র বুঝিয়ে বিস্বাসঘাত করলো, তার বোধহয় কিছু করার ছিল না বলে সমাজ বলবে। .. শেষ হয়ে গেলো এক লড়াকু গ্রামীণ প্রলেতারিয়েত।

দলিত সাহিত্যের বিস্তারের দুটো মেরু, সামাজিক অন্যায় থেকে আর্থিক অন্যায় -পুরোটাই ধরা পরে এই দু ধরণের লেখকের সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্মী লেখার মধ্যে , তাই পাশাপাশি রাখা হলো।  ন্যায়ের [হিন্দি লবজে ]  সংগ্রাম একটাই সংগ্রাম , গ্রামীণ উৎপাদকের লড়াই নাগরিক অসভ্যতার বিরুদ্ধে।