আখড়াইয়ের দীঘি ও মুন্ডমালিনীতলা : আমার চোখে তারাশঙ্করের গল্পভুবন

সেবার কীর্ণাহার যাচ্ছিলাম ঠাকুমার ছোটবোনের সঙ্গে। ওঁরও আমাদের গ্রামে শ্বশুরবাড়ি। উনি বাপের বাড়ি গেলেই আমাদের বাড়িতে খবর দিতেন, যদি কেউ যেতে চায়! সেবারে আমি সঙ্গ নিলাম। তারপর ? ... চোখে দেখা অভিজ্ঞতা কীভাবে তারাশঙ্করের গল্পভুবনের সাথে মিলে যায় - এই লেখা থেকে পাঠক সেটাই জানতে পারবেন।

(১)

ছোটবেলায় বাড়ির মজলিশে নানা ধরণের ডাকাতির গল্প তারাশঙ্কর শুনেছিলেন। সেকথা তিনি লিখেছেন তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আমার কালের কথা’য়। শিশু বয়সে ডাকাতির বিবরণ শুনে শিউরে শিউরে উঠেছেন। কত রাত ঘুমোতে পারেন নি! পরবর্তীকালে তিনি বহু বিচিত্র মানুষের সংস্রবে এসেছিলেন। তাঁর অনুসন্ধানী মন তাঁকে সুযোগ করে দিয়েছিল, সেসব মানুষের কথা সরাসরি তাদেরই মুখ থেকে শুনতে। তিনি লিখেছেন, সে আমলে লাভপুরের কাছে-দূরে বেশ কয়েকটি গ্রামের বদনাম ছিল ঠ্যাঙাড়ে ডাকাতদের কারণে। সুঁদিপুর, বামনিগ্রাম, ধনডাঙা, দাশকলগ্রাম। ঐ দাশকলগ্রামেরই এক ঠ্যাঙাড়ে একদিন রাত্রে ভুল করে হত্যা করেছিল নিজের ছেলেকে। ‘ছেলে চিৎকার করে বলেছিল –‘বাবা আমি, বাবা’ । তার দেহখানা ঘুরিয়ে দিতে দিতে বাপ বলেছিল - এ সময়ে সবাই বাবা বলে।’

তারাশঙ্কর বলেছেন, ‘আমার  “আখড়াইয়ের দীঘি” গল্প এবং “দ্বীপান্তর” নাটকের উদ্ভব এখান থেকেই। ক্রোশ-অন্তর দীঘি আর ডাক-অন্তর মসজিদওয়ালা বাদশাহী সড়ক এখানেই; সেই সড়কের উপরে গাছতলায় বসে এক বৃদ্ধ বীরবংশীর মুখে এই পুত্রহত্যার কাহিনী শুনেছিলাম।’

এছাড়াও ঠ্যাঙাড়েদের অত্যাচারের বর্ণনা পাওয়া যায় ‘আমার কালের কথা’য়,

“জান বাঁচাও। জান বাঁ-চা-ও'

আমাদের গ্রামের সিকি মাইল দক্ষিণে সিউড়ি থেকে কাটোয়া যাবার পাকা সড়ক চলে গেছে, সেই সড়ক দিয়ে - ঊর্ধশ্বাসে ছুটে চলে গেল সেই আর্তনাদ। বিপন্ন সেই প্রাণের ভয়- সেই আকুতি এমন ভাবে ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে।

--- সেই হতভাগ্য সামনেই ছুটে গিয়েছে। পেছনে ছুটেছে তাঁর মৃত্যুদূতের মতো পরস্বাপহরী ঠ্যাঙাড়ে। আসে পাশে দু চারটে জঙ্গল বা গ্রাম থাকলেও সেখানে আশ্রয় নেওয়ার কথা ভাবে নি। কেবল সামনে ছুটেছে। সামনে ছিল নদী। লাভপুর থেকে দেড় মাইল দূরে কুয়ে নদীর ঘাট। সেখানে সড়কে ছেদ পড়েছে। সেখানে একটি মর্মান্তিক চিৎকার উঠে সব স্তব্ধ হয়ে যায়। যারা বাঁচানোর জন্য ছুটে গিয়েছিল ‘ভয় নাই ভয় নাই’ বলে, তারা আর কিছু দেখতে পায় না। দূরে ধান ভরা বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্যে কিছু ছায়ামূর্তি মিলিয়ে গিয়েছিল। পরদিন নদীর ঘাটের পাশে দহের বুকে বিদেশী মুসলমানের মৃতদেহ পাওয়া যায়।”

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেও ঠ্যাঙাড়েরা কেমন গোপনে তাদের প্রাচীন পেশা আঁকড়ে আছে তার বর্ণনা পাওয়া যায় এ লেখায়। অন্ধকার ঘনিয়ে আসায় ছলনা করে ভিনদেশী একাকী চাষিকে আশ্রয় দেয় ঘরে। তার গরু কেনার পয়সাটি আত্মসাৎ করবে এই বাসনায়। রাত্রি ঘন হতেই যখন সেই ব্যক্তি গৃহস্বামীর অভিপ্রায় টের পায় তখনই সে প্রাণপণে ছুটে পালায়। ছুটে যায় শুধু সামনে। তারপর কী হয় তার বিবরণ পূর্বেই দেওয়া হয়েছে।

(২)

পৃথিবী যখন ক্ষুদ্র, দৃষ্টির পরিধি যখন সামান্য গণ্ডীতে আবদ্ধ, বহির্বিশ্ব বলতে যখন কেবলমাত্র আপন বাড়ির অঙ্গনের বাইরে কয়েকটি গন্ডগ্রামকে বোঝায়, তখন একটি বাদশাহি সড়কও কল্পনার জগতে অনায়াসে আবিষ্কৃত হয়ে যায় বৈকি। আমার কাছে সেই সময় বিশ্বের দীর্ঘতম সড়ক পথটি ছিল সেই রাস্তা, যেটা লাভপুর থেকে কীর্ণাহার পর্যন্ত চলে গিয়েছে। আসলে রাস্তাটি গিয়েছে আমোদপুর থেকে কাটোয়া। কিন্তু আমি তখনও লাভপুরের এপাশের এবং কীর্ণাহারের ওপাশের মানচিত্র সম্পর্কে অজ্ঞ।

রাস্তার দুপাশে জমি আর ইতস্তত গাছপালা। বড় বড় গাছ। বাবলা, আম, শিরিষ, বট। মাঝেমধ্যে দুএকটা  দীঘিও চোখে পড়ে। কোনোটায় কাকচক্ষু জল টলটল করে। কোনোটায় আবার পদ্ম শালুক ফুটে থাকে। কোথাও পড়ে ছোট ছোট ঝোপজঙ্গল, কোথাও ভাঙাচোরা ক্ষয়পাওয়া সেই কোনকালের পোড়ো বাড়ি। সড়কের পাশেপাশে রেললাইন চলে গিয়েছে এঁকেবেঁকে। তার উপর দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে ঝিকঝিক করে ট্রেন যায়। ছোট লাইনের (ন্যারোগেজ) ট্রেন। কোথাও লাইন হারিয়ে গিয়েছে ধানের জমির আড়ালে, কখনও আবার লাইন জেগে উঠেছে উঁচুবাঁধের উপর। যেতে যেতে রাণীপাড়ায় রাস্তাটার সঙ্গে কাটাকুটি খেলেছে।

রাস্তায় যেতে যেতে দূরে তাকালে একটা দুটো গ্রাম ঠাহর হয়। তবে একেবারে পথের ধারে পড়ে মহেশপুর, মুন্ডমালিনীতলা, গোমাই, আঁকুপুর ও দুর্গাপুর। সেসব পার হয়ে শেষে কীর্ণাহার।

ওই পথটি বহুবার অতিক্রম করার সৌভাগ্য আমার শৈশবে হয়েছিল। আমাদের গ্রাম থেকে ওই পথ অর্থাৎ পাকারাস্তায় পৌঁছনোর দূরত্ব ছিল সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার মতো। ওই রাস্তাটুকু কাঁচা। কাঁচারাস্তা আর পাকারাস্তার মিলনস্থল ছিল লাঘাটা ও দোনাইপুরের মাঝামাঝি একটা জায়গায়। কাঁচারাস্তায় গরুরগাড়ি আর বাইসাইকেল চলাচল করত। পায়ে হেঁটে গেলে মানুষ শর্টকাট পছন্দ করত। সেক্ষেত্রে ওই সড়কপথটি অধরাই থেকে যেত। কারণ তখন মেঠো আলপথই কাম্য। আরও শর্টকাট করতে জমির আল অর্থাৎ দৈর্ঘ্য বা প্রস্থ বরাবর না হেঁটে কর্ণ বরাবর হাঁটা হতো।

আমরা মূলত দুই ভাবে কীর্ণাহার যেতাম। বাসে অথবা সাইকেলে। বাসে যেতে হলে গ্রামের মেটে রাস্তা ধরে হেঁটে পূর্বকাদিপুর। তারপরেই ওই শর্টকাট। মাঠের আলে অবতরণ। তারপর একটি আদিবাসীপল্লী, নোয়াপাড়া এবং আমবাগানকে পেছনে ফেলে ময়শাপুর অর্থাৎ মহেশপুর বাসস্ট্যান্ড। লাঘাটা পড়ে থাকত পেছনে। কী দুঃখ! রাস্তার অর্ধেকটা যে দেখাই হল না! লাঘাটা পর্যন্ত হাঁটলে যে আরও অনেকটা হাঁটতে হতো। তাছাড়া বাস যে সব সময় পাওয়া যাবে সে নিশ্চয়তা কোথায়! বাস না পেলে বাকি রাস্তাটা হাঁটতে হবে। সেক্ষেত্রে লাঘাটা থেকে হাঁটার চেয়ে মহেশপুর থেকে হাঁটলে রাস্তা কম হয়। মোটে ছয় কিলোমিটার। তাছাড়া মহেশপুরে ছোটলাইনের ট্রেনটাও দাঁড়ায়। যদি কু-ঝিকঝিক আওয়াজ পাওয়া যায়, অমনি ছুটে গিয়ে ট্রেনে চেপে পড়া যাবে। আর তা হবে অনেকটা লটারি জেতার মতো। আর কপাল খারাপ হলে কীর্ণাহার পর্যন্ত ‘চরণবাবুর ট্যাক্সি’ অর্থাৎ হন্টন। ঠাকুমার সঙ্গে গেলে এই ছিল যাত্রাপথ।

বাবা-কাকার সঙ্গে গেলে অত ঝামেলা ছিল না। ওরা সাইকেলে নিয়ে যায়। বাবা প্রত্যেক রবিবার কীর্ণাহার যায়। সারা সপ্তাহের হাটবাজার করতে। বাবার বড় হওয়া, লেখাপড়া সব কীর্ণাহারে। তাই বাবার কীর্ণাহারের হাটবাজার বেশি পছন্দ। লাভপুর বা বোলপুর যেন বাবার কাছে ব্রাত্য। অমন একটা রূপকথার জগতে বাবা সপ্তাহে সপ্তাহে যায় অথচ আমরা যেতে পারি না। আমাদের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে কেবল পুজোর সময়। পুজোর জামা কেনার জন্যে আমাদের দুইবোনকে বাবা কীর্ণহার নিয়ে যায়। গোটা রাস্তা বাবা কথা বলতে বলতে যায়। দিদি খানিক বড় হয়েছে। দিদিকে মুখে মুখে পড়া ধরে। অংকের যোগবিয়োগ, বাংলা ব্যাকরণ, ইংরাজী গ্রামার। তাতে  মনোযোগ কম পাওয়ার আশংকায় আমি নিজের পড়া বাদ দিয়ে দিদির পড়াগুলো শুনে শুনে মুখস্ত করে রাখি। ও আমার চেয়ে তিন ক্লাস উপরে পড়ে। কিন্তু বাবার মনোযোগ পেতে গেলে ওটা করতেই হয়। সম্ভবত আমার অত্যাচারেই বাবা একদিন পড়ার কথা বাদ দিয়ে গল্প বলতে শুরু করে।

‘সামনের জঙ্গলটা দেখছিস নাম জানিস? ওর নাম মুন্ডমালিনীতলা।’ বলে বাবা সাইকেল দাঁড় করায়। আমরা তিনজনে সাঁকোর পাড়ে বসি। একটা গভীর খাল চলে গিয়েছে রাস্তাকে আড়াআড়ি ছেদ করে। স্থানীয় ভাষায় বলে কাঁদর। তার উপরে সাঁকো। কাঁদরের দুপাশে কাশ আর বেনাগাছের ঝোপ। আরও একটা ঝোপ বাবা চিনিয়ে দেয়। কেতকী বা কেয়া ঝোপ। বাবা বলে, সাপের আখড়া। আর সেই কাঁদরের পাড়ে রাস্তার অদূরে ঝোপ ঘন হয়েছে। আর ঝোপের উপর জেগে আছে বড় বড় গাছের মাথা। শিশু, অর্জুন, শিরিষ, বট। ওই জঙ্গলের মধ্যেই আছে কালীমন্দির। কালীর নাম ‘মা মুন্ডমালিনী’।

বিবরণ শুনে গা সিরসির করে। রণচন্ডী মা কালী। মানুষকে কেটে কেটে তাদের মুন্ডুগুলো মালা গেঁথে গলায় পরেছে আর সেই সদ্য কাটা মুন্ডু থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে। বাবা বলে, ‘এক সময় এই জায়গাটা ছিল ডাকাত আর মানষুড়েদের আশ্রয়। ডাকাতরা এখানে পুজো করে ডাকাতি করতে যেত আর ফিরে এসে ডাকাতির জিনিস ভাগবাঁটোয়ারা করত। আর মানষুড়েরা রাতের অন্ধকারে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকত।’

‘মানষুড়ে’ শব্দটা কানে শোনা হলেও অর্থ অজানা। কথাটা শুনেছি মারকুটে ছেলেদের বিশেষণ হিসেবে। প্রবল দস্যি মারকুটে ছেলেদের বলা হতো, ‘খুনে’ ‘মানষুড়ে’।

বাবাকে জিজ্ঞেস করতেই বাবা মানে বলে দেয়। মানষুড়ে হল ঠ্যাঙাড়ে। ওরা এক ধরণের ডাকাত। কিন্তু ওদের ডাকাতির একটা বিশেষ ধরণ আছে। ওরা রাস্তার ধারে ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকে নাহলে রাস্তার ধারে কোনও বড় গাছের ডালে উঠে অন্ধকারে মিশে থাকে। রাস্তায় কেউ গেলে একটা ছোট ডাংয়ের মতো লাঠি ছুঁড়ে দেয়। ওই লাঠি গিয়ে ঠিক দুই পায়ের ফাঁকে আঘাত করে।। যাত্রী হুমড়ি খেয়ে পড়লেই মানষুড়েরা পেছন থেকে লাঠির আঘাতে লোকটাকে ঘায়েল করে তার কাছে যা পায় কেড়ে নেয়। অনেক সময় কিছু না পেয়ে রেগেমেগে লোকটাকে মেরেও দেয়।

(৩)

সেবার কীর্ণাহার যাচ্ছিলাম ঠাকুমার ছোটবোনের সঙ্গে। ওঁরও আমাদের গ্রামে শ্বশুরবাড়ি। উনি বাপের বাড়ি গেলেই আমাদের বাড়িতে খবর দিতেন, যদি কেউ যেতে চায়! সেবারে আমি সঙ্গ নিলাম। দুপুরে খাওয়ার পর বেরিয়েছি। মহেশপুরে অপেক্ষা করে করে বাস বা ট্রেন না পেয়ে হাঁটা শুরু হয়েছে। আমরা চারজন। ছোটদিদা, ওর দুই ছেলে আর আমি। ওঁর ছেলেরা আমার পিঠোপিঠি। শীতকালের বেলা দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। দিদা বলছেন, ‘সন্ধ্যে হলেই বা ক্ষতি কী এ তো আর গাঁ-গঞ্জ নয়।’ কীর্ণাহার বর্ধিষ্ণু গ্রাম। সেখানে বাপের বাড়ি হওয়ার দরুন কথাটা ঠাকুমাও সুযোগ পেলেই গর্ব করে বলেন।

ভয়ে গা ছমছম করছে। মুন্ডুমালিনীতলায় পৌঁছনোর আগেই যদি সন্ধ্যে হয়ে যায়! তারপর যদি জঙ্গলের ভেতর থেকে লাঠি উড়ে এসে আমাদের চারজনের পায়ের কাছে পড়ে! আমাদের কাছে কিছু না পেয়ে তো ডাকাতে মেরেই দেবে। বেঁচে থাকবে শুধু ছোটদিদা। যা কিছু পয়সাকড়ি, বাসের ভাড়া সব  তো ওঁর কাছে! মনে মনে ঠাকুরকে ডাকতে শুরু করি। বিপদে পড়েছি তাই বিপদতারিণীকে ডাকি। মুন্ডমালিনী ডাকাতের ঠাকুর। তাই ওঁকে ডাকতে ভরসা হয় না। হঠাৎ পেছন থেকে মোটরগাড়ির শব্দ শুনেই ছোটদিদা ঘুরে দাঁড়িয়ে হাত ইশারা করতেই গাড়ি থেমে গেল। ছোটদিদা বেশ সুন্দর করে শহুরে ভাষায় বলল, ‘ভাই আমি একা মেয়েমানুষ। তিনটে ছেলেমেয়েকে নিয়ে বিপদে পড়েছি, যদি দয়া করে একটু এগিয়ে দেন তো বড় উপকার হয়।’ লোকটা তার গাড়িতে আমাদের চারজনকে তুলে নিল। মুন্ডমালিনীতলাকে নস্যাত করে হুশ করে কখন পেরিয়ে গেলাম রাস্তাটা বুঝতেই পারলাম না। তারপর কীর্ণাহার বাসস্ট্যান্ডের কাছে আমাদের নামিয়ে দিতে ছোটদিদা জোড়হাত করে নমস্কার করে বলল, ‘ধন্যবাদ। অনেক উপকার করলেন।’ মনে মনে যে কতটা কৃতজ্ঞ হয়েছিলাম সেদিন প্রকাশ করার মতো ভাষা ছিল না। তাই ‘ধন্যবাদ’ কথাটার প্রয়োগ প্রথম শেখার স্মৃতি আজও অমলিন।

এরপর ঠাকুমার বাপের বাড়ি পর্যন্ত যেতে রেললাইনটা হেঁটে পেরোতে হল। গেট বন্ধ। ট্রেন আসছে, কাটোয়া যাবে। আমরা যতক্ষণ মহেশপুরে থাকলাম এল না। ট্রেনের যে আসা যাওয়ার নির্দিষ্ট সময় আছে না ভেবে, ভেবেছিলাম প্রাণভয় কাকে বলে শেখাবে বলেই ট্রেনটা দেরি করে এসেছে ।

এই ভয়ের কথা শুনে বাবা বলেছিল, ‘ধুর, তারা কি এখনও আছে নাকি? অভিশপ্ত মানুষ সব। কবেই ঝাড়ে বংশে বিনাশ হয়ে গেছে!’

(৪)

ওদের বংশ যে লোপ পাবে, সে কথা আমরা শুনি ‘আখড়াইয়ের দীঘি’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র কালীচরণ বাগদীর মুখে। সে ছিল হিংস্র দুর্ধর্ষ ডাকাত। ওদের পূর্বপুরুষ নবাবের পল্টনে কাজ করত। ব্রিটিশ আমলে ওরা কর্মচ্যুত হয়। কিন্তু চাষআবাদকে ওরা ঘৃণা করে। বলে, ‘মাটির সঙ্গে কারবার করলে মানুষ মাটির মতোই হয়ে যায়। মাটি হল মেয়ের জাত’। নবারের পল্টন থেকে কর্মচ্যুত হয়ে স্থানীয় জমিদারের বাড়িতে লাঠিয়ালের কাজ পেলেও কোম্পানির রাজত্বে থানাপুলিশের দাপটে তাও ঘুচে যায়। তখনও ওরা বিশ্বাস করে, ‘আমাদের কুলের গরব- লাঠির ঘায়ে, বুকের ছাতিতে।’ অতঃপর গাড়ু বওয়া, মোট বওয়া এবং লোক দেখানো জমিদারের লগদীগিরি করা পেশার আড়ালে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ওরা কুলের গর্বকে বহন করে চলে। জমাট অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে বসে থাকে। থেকে থেকে মদের ভাঁড়ে চুমুক দেয়। আর নেশার ঘোরে মাথার ভেতর আগুন ছোটে। সামনে শিকার পেলেই হাত দুয়েক লম্বা লাঠি ছুঁড়ে মারে, মাটির কোল ঘেঁসে। নিশানা অব্যর্থ। পথিকের পায়ে লাগলে তার পতন অনিবার্য। সঙ্গে সঙ্গে বাঘের মতো লাফ দিয়ে পড়ে শিকারের উপর। একখানা বড় বাঁশের লাঠির আঘাত পড়ে পথিকের ঘাড়ে।

কালীচরণ নেশার ঘোরে এক বৃষ্টির রাতে নিজের ছেলে তারাচরণকে পথিক ভেবে এভাবেই খুন করে পুঁতে রেখে আসে আখড়াইয়ের দীঘিতে। আখড়াইয়ের দীঘি যে সড়কের উপর অবস্থিত তার বর্ণনা পাই সুরেশবাবুর বয়ানে। ‘এইটেই অতীতের বিখ্যাত বাদশাহী সড়ক। এ রাস্তায় কোনো পথিক কোনো দিন জলের জন্য চিন্তা করেনি। ক্রোশ-অন্তর দীঘি আর ডাক-অন্তর মসজিদ এ পথের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত নির্মিত হয়েছিল, দীঘিগুলি এখনও আছে-’

ক্ষণেক পরেই জানা যায় ডাক-অন্তর মসজিদ কথাটির অর্থ, ‘এক মসজিদের আজানের শব্দ যত দূর পর্যন্ত যাবে, ততদূর বাদ দিয়ে আর একটি মসজিদ তৈরি হয়েছিল।’

উক্ত সড়কের নির্মাতা কোনও এক স্থানীয় বাদশাহ। প্রচলিত তথ্য অনুযায়ী তিনি দিগ্বিজয় করে ফেরার পথে এসব নির্মাণ করতে করতে নিজের রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন। সুরেশবাবু, রজতবাবু এবং রমেন্দ্রবাবু তিনজনের কথোপকথন জমাট হয়ে আসে, যত ওঁরা এগিয়ে যান সেই কুখ্যাত অঞ্চলটির দিকে। সুরেশবাবু বলেন ওই অঞ্চলের প্রচলিত একটি প্রবচনের কথা, ‘আখড়াইয়ের দীঘির মাটি, বাহাদুরপুরের লাঠি আর কুলির ঘাঁটি।– এই তিনের যোগাযোগে এখানে শতশত নরহত্যা হয়ে গেছে।’ কুলির ঘাঁটিতে ওই পথের উপর বাহাদুরপুরের লাঠিয়ালরা রাতেরবেলা ডাকাতি ও মানুষ খুন করত। তারপর সেই মৃতদেহ সমাহিত করত আখড়াইয়ের দীঘির গর্ভে।    

মুন্ডমালিনীতলা জায়গাটিও আমোদপুর থেকে কাটোয়া যাওয়ার ওই সড়কটির উপর। আমার শৈশবে দেখা বিশ্বের দীর্ঘতম রাস্তা। লাভপুর থেকে কীর্ণাহার। বাহাদুরপুরের লাঠিয়ালদের ঘাঁটি-খেলা দেখার সুযোগ না হলেও দুর্দান্ত লাঠিখেলা দেখেছি আমাদেরই গ্রামে দুর্গাপুজোর বিসর্জনের দিন। হাড়ি, বাউড়ি ও বায়েনদের মধ্যে প্রতিযোগিতা। ছয় সাত ফুট লম্বা লাঠি বনবন করে ঘোরে। চোখের পলকে সে লাঠি সামনে থেকে পেছনে, ডান থেকে বামে কখন চলে যায় ধরা যায় না। স্লিংফ্যানের ব্লেডের মতো, লাঠির ঘূর্ণন। লাঠিয়াল তার পেছনে ঝাপসা হয়ে যায়। অপূর্ব দক্ষতায় লাঠির গতিবেগ কমিয়ে এনে একসময় লাঠিকে থামায় ওরা। তারপর লাঠি হাতে মাথা ঝুঁকিয়ে দর্শকদের অভিবাদন করে।

আখড়াইয়ের দীঘি বা কুলির ঘাঁটিও দেখা হয়ে ওঠে নি। তবে মুন্ডমালিনীতলার কাঁদরের গভীর, পেছল খাদটুকু মনে থেকে গিয়েছে ওই কাহিনীর অনুষঙ্গে। মনের পটে ভেসে ওঠেছে অন্ধকারে গাছের ভেতর থেকে উড়ে আসছে হাত দুয়েক লম্বা ফাবড়া। অন্ধকারে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে অসহায় যাত্রী। তারপর ক্ষণিকের জন্যে ছটফটানি আর শেষে অন্তিম গতি হচ্ছে ওই কাঁদরের খাতে।