ফ্যাসিজমের বাতাবরণে ইতালিয় পদার্থবিজ্ঞান ও এনরিকো ফের্মি

বিজ্ঞানচর্চায় যুগের থেকে পিছিয়ে থাকা দেশে ফ্যাসিজমের বাতাবরণে চিন্তার গলায় বকলস পড়ালে বিজ্ঞানের ও প্রতিভাবান বিজ্ঞানীর কী দশা হয়, ইতালির অভিজ্ঞতা দেখে সে বিষয়ে আজকের ভারতবর্ষে আমাদের কিছু কি শেখার আছে ?

আজ থেকে একাশি বছর আগে ১৯৩৯ এ প্রকাশিত হয়েছিল জে ডি বার্নাল এর ‘দ্য সোশ্যাল ফাংশন অফ সাইন্স’। সারা পৃথিবীতে আজ এই যুগান্তকারী বইটির অভিঘাত নিয়ে প্রচুর আলোচনা চলছে। কোথায় কোথায় বার্নালের ভুল হয়েছিল, তার জন্য মরণোত্তর নির্মম সমালোচনা যেমন তাকে সইতে হচ্ছে, তেমনি অনেকেই এর অসীম ঐতিহাসিক গুরুত্ব নতুন করে অনুধাবন করছেন। বইটি থেকে শিক্ষা গ্রহণের চেষ্টা করছেন। এখানে আমরা একটি ছোট্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো।

ওই বইতে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সমসাময়িক ইতালির বিজ্ঞান চর্চার ওপর ফ্যাসিজমের প্রভাব বিষয়ে বার্নাল মন্তব্য করেছিলেন -

“বিজ্ঞানীদের ওপর এর প্রধান যে প্রভাব পড়েছে তা হল বিজ্ঞানের জগত থেকে তাঁদের বিচ্ছিন্নতা। মুসোলিনি বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য কত যত্ন নিচ্ছেন, বাইরের বিশ্বকে তার পরিচয় দিয়ে মুগ্ধ করার উদ্দেশ্যে আয়োজিত কয়েকটি অত্যন্ত সুসংগঠিত আন্তর্জাতিক কংগ্রেসের অনুষ্ঠান বাদ দিলে, ইতালিয় বিজ্ঞানীদের সঙ্গে অন্যান্য দেশের বিজ্ঞানীদের সংযোগ খুবই কমে গেছে। তার একটা কারণ রাজনৈতিক আস্থাহীনতা, অন্য কারণ যাতায়াতের টাকার অভাব। অপর একটি অসুবিধা হলো ভাষার আড়াল। জাতীয় মর্যাদা রক্ষার্থে বিজ্ঞান চর্চা ইতালিয় ভাষায় প্রকাশ করা আবশ্যিক, কিন্তু ইতিমধ্যে সে ভাষা আর ভাষা হিসেবে সুপরিচিত নয়। ফলত যোগাযোগের যে একটি মাত্র পথ খোলা ছিল সেটাকেও পূর্ণ মাত্রায় ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে ইতালিতে বিজ্ঞান পড়ে আছে বিশ শতকের গোড়ার দিককার সেই অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তরে। ইতালিয় বিজ্ঞান চর্চার পুরনো ঐতিহ্যের নিজস্বতাকে নতুন করে ফিরিয়ে আনা কোনওভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। উদারনৈতিকতাকে দমন করে ফ্যাসিবাদ বৈজ্ঞানিক চেতনাকে গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। অথচ বৈজ্ঞানিক চেতনা বরাবরই ইতালির সঙ্গে নিবিড় ভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল। (এম আই টি, ম্যাসাচুসেটস প্রকাশিত, ১৯৭৩ সংস্করণ, পৃষ্ঠা ২১১-১২।)

‘মুসোলিনি বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য কত যত্ন নিচ্ছেন, বাইরের বিশ্বকে তার পরিচয় দিয়ে মুগ্ধ করার উদ্দেশ্যে আয়োজিত’ এ রকম একটি অত্যন্ত সুসংগঠিত আন্তর্জাতিক কংগ্রেসের অনুষ্ঠানের বিস্তারিত বিবরণ আমরা পাই মেঘনাদ সাহার কাছে। (দ্রষ্টব্য ভোল্টা শতবার্ষিকী, মেঘনাদ রচনা সংকলন, সম্পাদক শান্তিময় চট্টোপাধ্যায়, ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯০৮ শকাব্দ, পৃষ্ঠা ৬১ – ৭৯)

আলেক্সান্দ্র ভোল্টার মৃত্যু শতবর্ষ উপলক্ষ্যে ১৯২৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মুসোলিনি “উত্তর ইতালির কোমো নামক এক ক্ষুদ্র শহরে ... সমগ্র পৃথিবীর পদার্থবিদ ও তাড়িত বিশারদগণের যে কংগ্রেস বা সভার আয়োজন করেছিলেন, তদ্রূপ বৃহৎ আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সভা পৃথিবীতে আর হয় নাই। ... সপ্তাহাধিক কাল ব্যাপিয়া সুন্দরী কোমো নগরী সভা-সমিতি, ভোজ, আনন্দ, ভ্রমণ ও অন্যান্য নানাবিধ আমোদ-প্রমোদে মত্ত হইয়াছিল”। ভারত থেকে মেঘনাথ সাহা ও দেবেন্দ্রমোহন বসু সেই কংগ্রেসে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। কি হয়েছিল সেই কংগ্রেসে ? ১১ ই সেপ্টেম্বর হইতে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক সপ্তাহকাল কংগ্রেসের অধিবেশন হয় এবং ইউরোপের সকল প্রদেশ, (এমনকি রাশিয়া হইতেও; কেবল বলকান স্টেটস হইতে কোনো প্রতিনিধি আসে নাই) আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ভারতবর্ষ, জাপান হইতে প্রতিনিধিরা এই কংগ্রেসে যোগ দিয়াছিলেন”। শুধু বলকান অঞ্চল নয়, চীনেরও কোনো প্রতিনিধি কংগ্রেসে ছিলেন না, সেটা অবশ্য তাঁর উল্লেখযোগ্য বলে মনে হয়নি। এনরিকো ফের্মি আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী এই কংগ্রেসে মেঘনাদ বললেন তাঁর মৌলর জটিল বর্ণচ্ছত্রের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নিয়ে’। (অত্রি মুখোপাধ্যায়, অবিনাশ মেঘনাথ সাহা/ বিজ্ঞান সমাজ রাষ্ট্র, অনুষ্টুপ, ২০১২, পৃষ্ঠা ৬৮।)

মেঘনাদের বিবরণে যেসব ইতালিয় বিজ্ঞানীর নাম পাওয়া যায় তাঁরা হলেন অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি অধ্যাপক কিউ মায়োরাণা এবং ইতালির রাজসভার সদস্য অধ্যাপক গারবাসো। এরা কিন্তু কেউই আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞানী ছিলেন না। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের জ্যোতিষ্করা প্রায় সকলেই উপস্থিত ছিলেন সে উৎসবে। রাদারফোর্ড, জানে, ফন লাউএ, কেনেলি, ডেবাই, লরেঞ্জ, নীলস বর, ডবলিউ আর উড, সামারফেল্ড, পাউলি, হাইজেনবার্গ মিলিকান, প্ল্যাঙ্ক প্রমুখ। আশ্চর্যের ব্যাপার ছিলেন না কেবল জ্যোতিষ্কদের মধ্যে যিনি উজ্জ্বলতম সেই আইনস্টাইন। এত বড় ঘটনার উল্লেখ আমরা মেঘনাদের লেখায় না পেয়ে একটু অবাক হই। আইনস্টাইনের জীবনীকার এব্রাহাম পাইস জানাচ্ছেন আইনস্টাইন ওই কংগ্রেসে আমন্ত্রিত হয়েও যাননি। (আব্রাহাম পাইস - সাবটেল ইজ দ্য লর্ড, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস ২০০৫, পৃ ৪৪৪) অথচ এর মাত্র কয়েক সপ্তাহ বাদেই বেলজিয়ামের ব্রাসেলস এ প্রসিদ্ধ সলভে অধিবেশনে তিনি উপস্থিত ছিলেন। আর সেখানেই করেন তাঁর সেই বিখ্যাত মন্তব্য – ‘ঈশ্বর জগত নিয়ে পাশা খেলেন না’। তার উত্তরে নীলস বর বলেছিলেন, “ঈশ্বর কী করবেন না করবেন সেটা তাকে শেখাতে যাবেন না”। আইনস্টাইন খুবই রাজনীতিসচেতন ও সংবেদী মানুষ ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে প্রথম যে সলভে অধিবেশন হয়, তাতে অধিকাংশ জার্মান বিজ্ঞানীর প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। আইনস্টাইন নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন এবং এর প্রতিবাদে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কোমো অধিবেশন নিয়েও তাঁর সে রকম কোনো আপত্তি ছিল কিনা জানা যায় না। কিন্তু এটা জানা যায় যে সামারফেল্ডের আশঙ্কা ছিল কেমোর এই কংগ্রেস আসলে মুসোলিনির গরিমা কীর্তনের আসর হয়ে উঠবে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য মনের দ্বিধা দূর করে সামারফেল্ড কেমো কংগ্রেসে গিয়েছিলেন।

মেঘনাদের লেখা থেকে বোঝা যায় মুসোলিনির উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ সফল হয়েছিল। কেননা কোমোতে “অধ্যাপক রাদারফোর্ড বিদেশি সদস্যগণের তরফ হইতে অধিবাসীবৃন্দ ও ইতালিয়ান গবর্নমেন্টকে, তাহাদের আতিথেয়তাকে ও পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানবিদ গণকে একত্র সম্মিলিত করা এরূপ বিপুল উদ্যমে জন্য ধন্যবাদ দেন”। মেঘনাদ নিজে বলেন রোম শহরকে সাজিয়ে তোলার কাজ “মুসোলিনির প্রভাবকালে বিশেষ যত্ন ও পারদর্শিতার সহিত সম্পন্ন হইতেছে। ... মিলিকান আমাকে বলেন যে তিনি ১৭ বছর পূর্বে যখন রোমে আসিয়াছিলেন তখন তাহা আবর্জনা ও নিরানন্দপূর্ণ একটি স্থান ছিল। বর্তমানে শহরের সর্ববিধ উন্নতি, প্রাচীন স্মৃতিগুলি বজায় রাখিতে সর্বসাধারণের চেষ্টা ও দেশবাসীর নৈতিক ও মানসিক প্রসার দেখিয়া তিনি বিস্মিত হইয়াছেন”। ইতালির বিভিন্ন স্থানে সসম্মান বিলাস ভ্রমণের পর “প্রধানমন্ত্রী মুসোলিনী কর্তৃক তাঁহার গৃহে চা সম্মিলনই এবারকার সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব”। মুগ্ধ মেঘনাদ জানান “মুসোলিনী নিজে সর্বশক্তিমান হইলেও যে কোন ভারতীয় জিলা জজের চাইতে কম বেতন গ্রহণ করেন। ডিউক প্রত্যেক সদস্যকে নিজে ব্যক্তিগতভাবে অভিনন্দিত করেন। সমবেত সদস্যের মধ্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত ব্যক্তিগণের স্থান তাহার সহিত এক টেবিলে হইয়াছিল। এই ব্যবস্থা ইচ্ছাকৃত কি আকস্মিক তাহা বলিতে পারি না”। কোথাও কিন্তু সাম্প্রতিক পদার্থবিজ্ঞানে ইতালির কর্মকৃতিত্ব নিয়ে একটি শব্দও নেই। মেঘনাদের মনে এ নিয়ে কোন প্রশ্ন জাগে নি দেখে একটু বিস্মিত হই আমরা। হয়তো প্রবাসী পত্রিকার অ-বিশেষজ্ঞ পাঠকদের কথা ভেবেই তিনি এসব প্রসঙ্গ তোলেন নি।

এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করব ১৯২৬ এ রবীন্দ্রনাথও মুসোলিনির আহবানে ইতালি গিয়েছিলেন এবং আদর আপ্যায়নে প্রতারিত হয়ে তাঁকে দুহাতে শংসাপত্র বিলিয়েছিলেন। এর জন্য বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথকে অনেক সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয় তরুণ বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাও তার দু'বছর পর ইতালি যান এবং ঠিক একই ভুল করেন। এর জন্য তাঁকে কতটা সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছিল জানি না।

তবে কালস্রোতে মুসোলিনির এইসব মহিমা কীর্তন ভেসে গেছে। বিজ্ঞানের ইতিহাসে ১৯২৭ এর এই কোমো সম্মেলন স্মরণীয় হয়ে আছেন কেবল একটি কারণে। ওই সম্মেলনেই নীল্‌স বর প্রথম তাঁর কমপ্লিমেন্টারিটি সূত্রটি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন। ‘দেশকাল সমন্বয় এবং কার্যকারণ সূত্রের দাবি, এদের ঐক্য - স্বীকৃত বনেদি তত্ত্বগুলোর একটি নির্ণায়ক বৈশিষ্ট্য বলে গণ্য। কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্বের চরিত্রই আমাদের বাধ্য করে এ দুটিকে বর্ণনার পরস্পর সম্পূরক অথচ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বলে গণ্য করতে, যাদের মধ্যে দিয়ে যথাক্রমে পর্যবেক্ষণ আর সংজ্ঞার্থর আদর্শায়িত ভাবরূপ যেন প্রতীকি আকার লাভ করে”।

এনরিকো ফের্মি : আধার ইতালিতে একলা পথিক

১৯৩৯ সালে ইতালিতে পদার্থ বিজ্ঞানের চর্চা ‘পড়ে আছে বিশ শতকের গোড়ার দিককার সেই অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তরে’ - বার্নালের এই মতের মূর্তিমান প্রতিবাদ স্বরূপ এনরিকো ফের্মির কথা তোলা যায়। বার্নাল কি বিচারে ভুল করেছিলেন ? কেননা তিনি যে সময়ের কথা বলছেন ঠিক সেই সময় ইতালিতে ফের্মির উত্থান। ফের্মিয়ন খ্যাত এনরিকো ফের্মি (১৯০১ – ১৯৫৪) নিঃসন্দেহে গ্যালিলিওর পর শ্রেষ্ঠ ইতালিয় বিজ্ঞানী। ১৯২৬ সালে ২৪ বছর বয়সে তিনি স্যাপিয়েঞ্জা ইউনিভার্সিটি অব রোম এ অধ্যাপক পদে নির্বাচিত হন। মুসোলিনি মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী শিক্ষামন্ত্রী, পদার্থবিদ অর্সো মারিও কার্বিনো (১৮৭৬ – ১৯৩৭) তখন ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা ভিত্তিক পদার্থবিদ্যার প্রফেসর ও পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যক্ষ। এই কার্বিনোই একমাত্র লোক যিনি ফের্মির কদর বুঝেছিলেন। তাঁরই উৎসাহে ফের্মিকে ঘিরে গড়ে ওঠে আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞান চর্চার এক তরুণ দল। ১৯২৮ সালে ইতালিয় ভাষায় আধুনিক পদার্থবিদ্যার প্রথম পাঠটি লেখেন ফের্মি, যার শিরোনাম ‘অ্যান্ ইন্ট্রোডাকশন টু এটমিক ফিজিক্স’। এই বছরেই বিবাহ করেন লরা কেপনকে। ১৯২৯ সালের ১৮ মার্চ মুসোলিনি তাকে রয়াল একাডেমি অব ইতালির সদস্য পদে নিয়োগ করেন। মাসখানেক পর ২৭ এপ্রিল তিনি মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট পার্টিতে যোগ দেন।

১৯৩৩ সালে তিনি ‘দুর্বল আন্তঃক্রিয়ার তত্ত্ব প্রস্তাব’ পেশ করেন। ১৯৩৪ এ দেখান ধীরগতি নিউট্রনেরা পরমাণু কেন্দ্রের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত তাড়াতাড়ি আন্তঃক্রিয়া ঘটায়। তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে।

অতঃপর ১৯৩৫ সালে মুসোলিনির আবিসিনিয়া আক্রমণ। ফসিজমের সভ্য কাপড়-চোপড় খসে খসে পড়তে লাগল। ১৯৩৮ সালের জুলাই মাসে জারি হল মুসোলিনির কুখ্যাত জাতি ইস্তেহার, যাতে হিটলারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বলা হলো ইতালিয়রা আর্য জাতি সম্ভূত। অনার্যদের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে ইহুদীদের বিরুদ্ধে চালু হলো নানান বিধি-নিষেধ, ইতালিয়ান - ইহুদি বিবাহ নিষিদ্ধ হলো। এনরিকো ফের্মির পত্নী লরা ছিলেন ইহুদী। সুতরাং ফ্যাসিস্ট পার্টির লোক হওয়া সত্ত্বেও ফের্মি প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকেন। চাকরি চলে যায় তাঁর বেশ কিছু গবেষণা সহায়কের। এরই মধ্যে ১৯৩৮ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পান। সস্ত্রীক সেই পুরস্কার গ্রহণ করতে স্টকহোমে গিয়ে ফের্মি দীর্ঘদিনের জন্য দেশান্তরী হন, ১৯৪৯ সালের আগে আর ইতালিতে ফেরেননি। স্টকহোম থেকে চলে যান আমেরিকা। সেখানকারই নাগরিক হয়ে যান। হয়ে ওঠেন ম্যানহাটনের পরমাণু বোমার অন্যতম প্রধান পরিকল্পক। এইভাবে যে একটিমাত্র পদার্থবিদের হাত ধরে ইতালিতে পদার্থবিজ্ঞান নবযৌবন লাভ করেছিল, ‘নিজগুণে’ ফ্যাসিস্টরা তাঁকেও হারালো। হাতে রইল পেন্সিল।

কিন্তু এ তো রাজনৈতিক অসুবিধা। বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে ফের্মি কি কোনো বাধা পেয়েছিলেন ? মুসোলিনি শাসিত ইতালির সারস্বত ইমারতের বেশ উচ্চেই তো ছিল তাঁর স্থান। তিনি মুসোলিনি সমর্থকই ছিলেন। তবু নব্য পদার্থবিজ্ঞানকে আবাহন করার মতো বৌদ্ধিক আবহ কি তিনি পেয়েছিলেন মুসোলিনির ইতালিতে ? ফের্মির ছাত্র জেমস ক্রোনিন তাঁর ফের্মি রিমেমবার্ড বইতে যা লিখেছেন, তা থেকে এর একটা উত্তর পাওয়া যায়। ফের্মি যখন রোম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর হয়ে এলেন –

“তিনি নিশ্চয়ই একটা উপযুক্ত বৈজ্ঞানিক বাতাবরণের জন্য তীব্র আকুতি অনুভব করেছিলেন। তখন সেখানে ছিলেন এক দল বিশিষ্ট গণিতবিদ, যারা বয়সে ফের্মির চেয়ে অনেকটাই বড়ো ... এঁদের মধ্যে তিনজনের সঙ্গে ফের্মির বিশেষ সৌহার্দ্য গড়ে ওঠে। কিন্তু তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক যত চমৎকার-ই হোক, পরস্পরের প্রতি ধারণা যত উচ্চই হোক, তা কিন্তু বৌদ্ধিক আদান-প্রদান গড়ে তোলার পক্ষে যথেষ্ট ছিল না; সে আদান-প্রদান ব্যাহত হত ভিন্ন দৃষ্টিকোণের দ্বারা এবং বয়সের গুরুতর পার্থক্যের দ্বারা। পদার্থবিদদের মধ্যে কর্বিনোই ছিলেন একমাত্র মানুষ যাঁর মন আধুনিক পদার্থবিদ্যার বিকাশধারাকে এবং সাধারণভাবে তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যার অগ্রগতিকে, বিশেষ করে কোয়ান্টাম তত্ত্বকে অনুসরণ করা এবং তার মূল্য উপলব্ধি করার মতো যথেষ্ট পরিমাণে খোলা ছিল, আর ছিল উপযুক্ত প্রস্তুতি। কিন্তু তিনি তাঁর রাজনৈতিক কাজকর্ম এবং ব্যবসায়িক কাজকর্ম নিয়েই মেতে থাকতেন। ইতালিতে পদার্থবিদ্যার যৌবন ফিরিয়ে আনার, পদার্থবিদ্যার অঙ্গনে তরুণ কর্মীদের নিয়ে আসার প্রয়োজনটা তিনি পুরোপুরিই বুঝতেন; কিন্তু বৈজ্ঞানিক কাজকর্মের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগ ছিল সীমিত”।

নব্য পদার্থবিদ্যার একমাত্র ইতালীয় দিকপাল এনরিকো ফার্মি কে কী ধরনের বৌদ্ধিক নিঃসঙ্গতার মধ্যে কাজ করতে হয়েছিল, তার কিছুটা আভাস আমরা পেলাম। ইতালির প্রায় সব গণিতবিদ আর পদার্থবিদ পুরনো ধ্যান-ধারণায় নিমগ্ন ছিলেন; আর যে একমাত্র ব্যক্তির নতুন পদার্থবিদ্যাকে আবাহন করার মতন মন ও ক্ষমতা ছিল, সেই অর্সো মারিও কার্বিনো ফ্যাসিস্ট রাজনীতি আর ব্যবসা নিয়ে মেতে থাকতেন। ১৯২১ সালে তিনি হন যুগপৎ শিক্ষামন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী। বিজ্ঞান হিসেবে তাঁর সুনাম ছিল। চৌম্বক ক্ষেত্র নিয়ে তাঁর কাজ কার্বিনো এফেক্ট নামে প্রসিদ্ধ। ইতালিতে তখন কোয়ান্টাম তত্ত্ব পড়ানোই হতো না। কার্বিনোই প্রথম কোয়ান্টাম তত্ত্বের গুরুত্ব বোঝেন এবং ফের্মিকে তিনি বিদেশে পড়তে পাঠান। কিন্তু এই টুকুই। এর চেয়ে বেশি সময় বিজ্ঞানকে তিনি দিতে পারতেন না। সুতরাং এরকম বললে দোষ হয় না যে ফের্মি ছিলেন ইতালিয় পদার্থবিদ্যার এক অতুলনীয় আলোকবর্তিকা, কিন্তু তার চারপাশে ছিল অন্ধকার। প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন আঁধার রাতে একলা পথিক। কেবল অধ্যাপক ও এম কার্বিনোর সঙ্গেই ফের্মি যতটুকু সমানে সমানে বৌদ্ধিক আদান-প্রদান চালাতে পারতেন। দুঃখের কথা ২৩ শে জানুয়ারি, ১৯৩৭ এ কার্বিনোর মৃত্যু হল এবং সে মৃত্যু নানান জটিলতা ডেকে আনল। তাঁর জায়গায় যিনি অধ্যক্ষ হয়ে এলেন সেই অধ্যাপক লো সার্দো ফের্মির কাজের অর্থ বা মূল্য বুঝতেন না। কাবির্নোর মৃত্যু আর অধ্যক্ষ পদে লো সার্দোর নিয়োগের পটভূমিতে ছিল ১৯৩৫ এর অক্টোবরে মুসোলিনির আবিসিনিয়া (ইথিওপিয়া) আক্রমণ। ‘ইথিওপিয়ার যুদ্ধের সময় থেকেই ইনস্টিটিউটের কাজের অধঃপতনের সূত্রপাত’। এর পরে কী ঘটলো তার বিবরণ আমরা আগেই পেয়েছি।

কাজেই ফের্মির মত দিকপালের কথা মনে রেখেই বার্নাল যখন বলেন, ত্রিশের দশকের ইতালিতে পদার্থ বিজ্ঞানের চর্চা কার্যত বিশ শতকের গোড়ার দিককার সেই অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তরেই পড়ে ছিল, তিনি খুব ভুল বলেন না। বিজ্ঞানচর্চায় যুগের থেকে পিছিয়ে থাকা দেশে ফ্যাসিজমের বাতাবরণে চিন্তার গলায় বকলস পড়ালে বিজ্ঞানের ও প্রতিভাবান বিজ্ঞানীর কী দশা হয়, সে বিষয়ে আজ থেকে একাশি বছর আগে জে ডি বার্নাল যে চেতাবনি দিয়েছিলেন তা থেকে আজকের ভারতবর্ষে আমাদের কিছু কি শেখার আছে ?