রসকলি ও গোঁসাইবাবার আখড়া : আমার চোখে তারাশঙ্করের গল্পভুবন

বড় হবার সময় নীতা তার গ্রামে যা দেখেছেন, পরে তারাশঙ্করের লেখা পড়তে পড়তে তার স্মৃতি জেগে উঠেছে বারবার। এই লেখা বড় হবার নানা অভিজ্ঞতা আর তারাশঙ্করের আখ্যানকে মিলিয়ে দেখার প্রয়াস।

রসকলি। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় ছোট গল্প। বাংলার ১৩৩৪, ইংরাজীর ১৯২৭ সালে কল্লোল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই গল্পটিই তারাশঙ্করকে বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছে নিয়ে আসে। মহানগরীর সাহিত্যচর্যায় তারাশঙ্করের সেই প্রথম স্বীকৃতি। উৎসাহদাতা পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় গল্পটির মনোনয়ন পত্রের সঙ্গে লিখেছিলেন, ‘আপনি এতদিন চুপ করে ছিলেন কেন?’

তার পূর্বে তারাশঙ্কর পূর্ণিমা নামক একটি পত্রিকায় কিছু ছোট গল্প লিখেছেন। তারও পূর্বে কবিতা এবং নাটক লিখে লেখক হিসেবে স্বীকৃতি তো পান নি, উলটে একাধিকবার অপমানিত ও আশাহত হয়েছেন। আর প্রতিবারই নানান কাজেকর্মে নিজেকে নিমজ্জিত করে রেখেছেন।

একবার কংগ্রেসের কাজে গিয়েছেন সিউরিতে। রাতে মশার উপদ্রবে ঘুম আসছে না। তখন হাতের কাছে একটি ‘কালিকলম’ পত্রিকা পেয়ে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের লেখা একটি ছোট গল্প পড়েন। পড়ে মনে হয়, বীরভূমের কথা এমন অক্ষরে অক্ষরে ফুটিয়ে তোলা যায়!

এর কিছুদিন পরের কথা। কথাগুলি তিনি ‘আমার সাহিত্যজীবন’এ লিখেছেনঃ

দিন কয়েক পরেই এলাম একটি নিবিড় পল্লীগ্রামে। আমাদেরই মহলে। যেখানে বাসা হল, তার সামনে একটি ছায়া নিবিড় আখড়া, বৈষ্ণবের কুঞ্জ। গ্রামের লোকে বলে কমলিনীর আখড়া, রসিকজনে রসান দিয়ে বলে, কমলিনীর কুঞ্জ! বৈষ্ণব নাই, আছে শুধু কমলিনী বৈষ্ণবী। আমি পৌঁছুবার কিছুক্ষণ পরই ক্ষারে ধোয়া কাপড়খানি পরিপাটী করে পরে শ্যামবর্ণ মেয়েটি হাস্যমুখে সামনে এসে দাঁড়াল। হাতে একখানি ঝকঝকে মাজা রেকাবীতে দু’খিলি পান, পাশে দুটি লবঙ্গ, টুকরো দুয়েক দারুচিনি, একটি ছোট এলাচ, নামিয়ে দিয়ে হেঁট হয়ে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলে - বললে, প্রভুর জয় হৌক।

উঠবার সময় মাথার কাপড় একটু সরে গেল। রাখাল-চূড়া বাঁধা কেশ প্রসাধন চোখে পড়ল। ...

কী একটা কাজে উঠে ঘরের মধ্যে গিয়েছি- কানে এল- আমাদের গোমস্তা বলছে-পানের চেয়ে বৈষ্ণবীর হাসি মিষ্টি।

মনে হল- বৈষ্ণবীর কর্ণমূল পর্যন্ত আরক্ত হয়ে উঠেছে। উঁকি মারলাম। দেখলাম - না তো। সবিনয়ে বৈষ্ণবী আরও একটু হেসে বললে - বৈষ্ণবের ওই তো সম্বল প্রভু!

এই তো! এই তো সেই জীবনের জয়।

...

এরপরই এল পাগলা বৈরাগী পুলিন দাস। লোকে বলে - ক্ষ্যাপা।

পুলিন ওখানেই প্রায় চব্বিশ ঘন্টা থাকে। সেদিন রাত্রে শুয়েই শুনলাম - কমলিনী বলছে পুলিনকে- যাও- বাড়ি যাও।

-কেন?

-রাগ করবে যে।

-কে?

-কে আবার? তোমার বষ্টুমী। বলেই সে হেসে ছড়া কেটে উঠল- পাঁচসিকের  বষ্টুমী তোমার গোসা করেছে- হে গোসা করেছে।

আমার ঘুম ছুটে গেল। দোয়াত কলম খাতা নিয়ে বসে গেলাম। পেয়েছি। রসকলির পত্তন করলাম।

(২)

তারাশঙ্করের মৃত্যু সত্তরের দশকের গোড়াতেই। আমার জন্ম ওই দশকের শেষের দিকে। যে ভাষা, যে সমাজচিত্র এবং জীবনের কথা তারাশঙ্করের লেখায় ফুটে উঠেছে, প্রায় হুবহু সে রকম একটা পরিবেশ আমার চারিপাশে আমি পেয়েছি গোটা শৈশব ও কৈশোর জুড়ে। সেই সময় বীরভূমের ছোট একটা অঞ্চলই ছিল আমার দুনিয়া। মূলত লাভপুর আর নানুর থানার অন্তর্গত কয়েকটি কৃষিপ্রধান গ্রামকে দেখতে দেখতেই দুনিয়ার সঙ্গে পরিচয়। গ্রামগুলির মধ্যে কোনওটি বর্ধিষ্ণু, সুশিক্ষিত-আলোকপ্রাপ্ত মানুষের বসবাস। কোনওটি আবার প্রত্যন্ত, মানুষজন নিজেদের বিশ্বাস ও কুসংস্কারে আবদ্ধ।

ওই ক্ষুদ্র পরিধিটুকুই বিপুল বৈচিত্রে আমার শৈশবের চিত্তজগত আলোকিত করে রেখেছিল। সে বৈচিত্র প্রাকৃতিক এবং সামাজিক। দুটোই আমাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করত তখন। মুগ্ধও করত। আমি তখনও বাংলা সাহিত্য পড়ি নি। তারাশঙ্কর তখনও আমার কাছে অপরিচিত। আমার চোখে এক একটি গ্রাম ছিল স্বতন্ত্র। প্রতিটি গ্রামের ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র ও রীতিনীতি। এমনকি একই গ্রামে পাড়ায় পাড়ায় ভিন্নতা। ভিন্নতা তাদের রীতি-রেওয়াজ-অভ্যাসে। ভিন্নতা জীবনযাপনে। ‘বিবিধের মাঝে মিলন মহান’ এর অপূর্ব উদাহরণ। সেইসব বৈচিত্র শিশুর চোখে রহস্যে ঘেরা, কল্পনায় মাখামাখি, এক রূপকথার জগত। সামান্য একটি পুকুর নিয়ে চলে যায় কোন রূপকথার জগতে! মনে হয়, ওই পুকুরের অপর পাড়টাই বুঝি তেপান্তরের মাঠ। পথের পাশে ঘন আমবাগান দেখে মনে হয় এই বুঝি বেরিয়ে আসবে মাথায় ফেটি বাঁধা, লাঠি হাতে ঠ্যাঙাড়ের দল।  

ঠাকুমা কোথাও যাব বললেই আমি তখন দুপায়ে খাড়া। ঠাকুমা বছরে কয়েকবার গঙ্গা স্নান করতে যায়। বেশ দূর, বাস বদল করে করে উদ্ধারণপুরে যেতে হয়। এছাড়াও ঠাকুমাকে যেতে হয় মেয়েদের বাড়ি, বাপের বাড়ি, ননদদের বাড়ি এমনকি দাদুর মামার বাড়িও। গ্রামীন উৎসব, পুজো ছাড়াও অন্নপ্রাশন, বিয়ে, শ্রাদ্ধ সবেতেই কুটুম্বিতা রক্ষা করতে হয়। উপরোক্ত কোনও একটিতেও যদি হাজির না থাকে তাহলে কুটুম ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার সম্ভবনা। অর্থাৎ কুটুম্বিতা রক্ষার জন্যে বাড়িতে একটি ঝাড়া হাতপা মানুষ থাকা নিতান্ত বাঞ্ছনীয়। সংসারের বাঁধনে ঠাকুমা যে খুব জড়িয়েমরিয়ে ছিল বলে কখনই মনে হয় নি। ভরা যৌথ সংসারের ভেতরে তিনি পুরোপুরি না হলেও, কিছুটা পাঁকাল মাছের মতো। মোটামুটি মুক্তই ছিল ঠাকুমা। সংসারে শাশুড়ি, জা থাকতেই থাকতেই পুত্রবধূর আগমন ঘটেছিল। হয়ত সেই জন্যেই কোনোদিন নিজেকে সর্বময়ী কর্ত্রী বলে মনেই  করে নি।

গেরস্ত ঘরের গিন্নী, হলই বা প্রৌঢ়া, একা একা ধেইধেই করে কুটুমবাড়ি যেতে পারে না। তাই ঢাল হিসেবে একজন গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসে। তা না হলেও বাড়িরই একটি শিশু সঙ্গে থাকলে সম্ভ্রম রক্ষা হয়। আমি প্রায়ই সেই দায়িত্ব নিজের ক্ষুদ্র কাঁধে তুলে নিতাম।

কুটুম্বিতা করতে ছেলেরা যে যেত না এমন নয়। তবে ধরণ আলাদা ছিল। ছেলেরা এবেলা গিয়ে ওবেলা ফিরে আসত। কিন্তু মহিলারা কটা দিন থেকে যেত। সে দুচারদিনও হতে পারে আবার পক্ষকালও হতে পারে। এই কুটুমবাড়ি যাওয়া অথবা বাড়িতে কুটুম আসা দুটোই সমান আকর্ষণীয় ছিল আমার কাছে। কোনোদিন বিকেলবেলা খেলাধুলো থেকে ফিরে এসে দেখতাম, কীর্ণাহারের বড়মা এসেছে। বড়মা হল ঠাকুমার মা। গোলাগাল, নরম নরম শরীর। মুখে সব সময় সুগন্ধি পান। দাঁত নেই তাই একটা ছোট হামানদিস্তা আছে বড়মায়ের। মুখে দেওয়ার আগে পানটা ছেঁচে দিতে হয়। গায়ে গা লাগিয়ে বসলে কী আরাম! কোনওদিন দেখতাম এসেছেন কাদোয়ার বুড়িমা। উনি দাদুর মামি। রোগা, কালো, চামড়ায় অগুন্তি কুঞ্চন। একবার এলে মাসখানেক থেকে যান। সংসারে কাজে হাত লাগাতে চান। কুটুম মানুষ, তাই তাঁকে কিছু করতে দেওয়া হয় না। তখন তিনি বাড়ির শিশুদের তেল মাখিয়ে দেন, চান করিয়ে দেন, চুল আঁচড়ে দেন। আবার সন্ধ্যেবেলা যখন শিশুগুলি ঘুমে ঢলে পড়ছে সর্ষের তেল গরম করে এনে পায়ে ঘষে ঘষে মালিশ করে দেন। তাদের সঙ্গে আমাদের সখ্যতা গড়ে উঠে। আমরা গল্প শুনতে চাই। ওরা যখন এবাড়ি ওবাড়ি বেড়াতে যান গিয়ে আঁচল ধরি। যাবো। তারপর যে কত অজানা জগত আবিষ্কার করে ফিরে আসি!

(৩)

সেরকমই একবার গিয়েছি এক আত্মীয়ের বাড়ি। পায়ে হেঁটে যেতে হয়। সাত আট মাইল পথ। মাঠ ভেঙে জমির আলে আলে। গ্রামটিকে কেন্দ্র করে সাত মাইল ব্যাসার্ধের বৃত্ত টানলে কোনও দিকেই পাকা রাস্তা নেই। বর্ষাকালে কাদায় হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যায়। দূর থেকে গ্রাম বলে ঠাহর হয় না। মনে হয় সামনে ঘন জঙ্গল। গ্রামটি ছোট। মোট দশবারো ঘর বাসিন্দা।

যে বাড়িতে গিয়েছি তাদের যৌথ পরিবার। আমার কাছাকাছি বয়সের ছেলেমেয়ের একটি বাহিনী ওই বাড়িতে আছে। সারাদিন ওদের সঙ্গে বন বাদার, বাতান, মাঠঘাট ঘুরে গ্রাম আবিষ্কার করে এলাম। সন্ধ্যা হতেই ঝুপ করে চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাড়িটা ছিল একেবারে গ্রামের শেষে। তারপরেই খেত। দোতলা মাটির বাড়ির উপরতলায় রেলিংঘেরা টানা বারান্দায় ঢালা বিছানা হয়েছে। বাহিনী সেখানেই হুটোপাটি করছে। কেউ কল্পনাপ্রবণ, কেউ ভীতু, কেউ দুষ্টু। দুষ্টুটা ভয় দেখিয়ে বলল, ‘হুই-ই-ই-ই দ্যাখ। মাঠ পেরিয়ে নদীর ধারে আলো জ্বলচে। কী বলত? ঝিলে (শ্মশানে) মরা পুড়চে।’

‘বাবারে’ বলে মুখ গুঁজে দিই বালিশে।

একজন বলল, ‘না রে। ভয় দেখাইচে। নদীর ধারে ঝিল আচে ঠিকই কিন্তু আলোটো গোঁসাইবাবার আখড়ায় জ্বলচে।’

‘গোঁসাইবাবা কে গো?’

‘এ মা জানিস না? গোঁসাইবাবা আচে, গোঁসাইমা আচে। আর আচে গোপে। ওরা বৃন্দাবন না নবদ্বীপ কোথা থেকে কে জানে, ভিক্ষা করতে করতে এতদূর চলে এসেচে। পাঁচটা গাঁয়ের লোকে তো খুব খুশি। বোষ্টমমানুষ বটে বাবা! ওরা কারোর ক্ষতি করে না। বামুনের পরেই হল ওরা। নদীর পাড়ে এসে উটেচে। সবাই বলেচে, ‘বেশ গো, তোমরা এখানটোতেই থাকো।’ বলবে না? সবাই দেখেই বুঝে গেয়েচে গোঁসাইবাবা যি সি লোক লয়, গা বাঁধতে পারে। লইলে ওই রকম মাঝমাঠে ঝিলের ধারে কেউ থাকতে সাহস করে?’

‘এই কাল যাবি?’

‘গেলেই হল।’

‘ওমা, বললে যে ঝিলের ধার? তোমরা তাও যাও?’

‘যাই তো। জন্মাষ্টমীতে যাই, দোলে যাই। ওরা মোচ্ছব দেয়। খেতে যাই। গেলেই গোঁসাইমা গোবিন্দর পেসাদ দেয়।’

পরদিন সকালে অভিযান গোঁসাই বাবার কুঞ্জে। বাড়ি থেকে বেরিয়েই আমরা একদল কুচোকাঁচা, একপাল ছাড়া গরুর মতন মাঠের এ আল, ও আল ধরে দৌড়তে লাগলাম। শেষে সবার পথ মিলে গেল নদীর ধারে। নদী পেরোলাম। নদীতে যা জল, তাতে পায়ের পাতাটুকুও ভেজে না। জল থাকে বর্ষা থেকে হেমন্তকাল। বাকি সময় যেন একটা বালির রেখা এঁকেবেঁকে চলে যায় মাঠের মাঝখান দিয়ে। গ্রীষ্মকালে নদী শুকিয়ে একেবারে খটখটে। পড়ে থাকে সর্পিল এক খন্ড মরুভূমি।

ওপাড়ে গাছপালায় ঘেরা গোঁসাই বাবার আখড়া। কেউ কেউ বলে কুঞ্জ। আশেপাশে আর দ্বিতীয় বাড়ি নেই। অনেকটা জায়গা জুড়ে আখড়া। চারিদিকে মেহেন্দি আর স্থলকলমির বেড়া। বেড়ার ভিতর কত রকমের ফুলগাছ। কল্কে, করবী, মাধবীলতা, টগর, গন্ধরাজ। গাছের বেড়ার ফাঁকেই একটা বাঁশের আগল। আমাদের দল থেকে একজন আগল ঠেলতে ঠেলতে ঘোষণা করল, ‘মাতাজি আমরা এসিচি।’

ভেতর থেকে উত্তর এল, ‘এস হে আমার নদের চাঁদ।’ তারপর গোটা বাহিনীকে দেখে বলে উঠলেন, ‘আমার গোপাল, আমার সুবলসখা, আমার রাধারানী, রাই বিনোদিনী, ললিতা, বিশাখা...’ এমন সব বিচিত্র নামে ডাকছেন দেখে বুঝলাম আমরা আখড়া দেখতে এসে ওঁদের কেমন ধন্য করেছি!

মাতাজি কী সুন্দর! সকালবেলা পুকুরে ডুব দিয়ে এসেছেন। চুলে গামছা বাঁধা। উঠোনে আলপনা দিচ্ছিলেন। আমাদের একটা দাওয়ায় তলাই (খেজুরপাতার চাটাই) পেতে বসতে দিয়ে আবার আলপনা দিতে লাগলেন।

আখড়ার ভেতরটা ভারি মনোরম! বড় বড় তিনটে নিমগাছ। বেশ দূরে দূরে। তিনটে গাছের পাশে পাশে একটা করে মাটির কুঁড়ে ঘর। বেঁটে বেঁটে ঘরে পুরু করে খড়ের চাল। হাত দিয়েই চালের নাগাল পাওয়া যায়। চালের উপর নিমগাছের ছায়া।

দুষ্টু ছেলেটা ফিসফিস করে বলল, ‘নিমগাছে বেম্মদত্যি থাকে জানিস? কিন্তু এদিকিনি কিচুই করতে পারবে না।’

চালের শীর্ষে ফুলের তোড়ার মতো করে বাঁধা খড়ের গোছা। লাইন দিয়ে পরপর তিনটে খড়ের তোড়া চালটাকে একটা অন্যরকম সৌন্দর্য দিয়েছে। খড়ের চাল তো গাঁয়ে বাড়িতে বাড়িতে আছে কিন্তু অমন সুন্দর আর কোথায়!

আখড়ার তিনটে ঘরের একটা রান্নাঘর, একটা থাকার ঘর আর একটা মন্দির। ভাবলাম, এ আবার কী রকম মন্দির! মন্দির হবে ইটের, উঁচু চূড়াওলা, শান বাঁধানো মেঝে। তবুও এসেছি যখন দেখতে তো হবে। মন্দিরে ছোট ছোট বেশ কিছু মাটির মূর্তি। গৌরনিতাই, গোপাল, রাধাকৃষ্ণ আরও কত কী! আর দেওয়াল ভর্তি পট। রাধাকৃষ্ণ, কৃষ্ণের রাসলীলা, ননীচোর কৃষ্ণ, কালীয় দমন, এইসব।

ঘরের দেওয়ালে ফুল, লতাপাতা আঁকা। মাতাজীর ছেলে গোপীবল্লভ ওরফে গোপে ইশকুল গিয়েছে। অমন স্নিগ্ধ শীতল পরিবেশের জন্যই বোধ হয় আমরা শুয়ে পড়লাম তলাইয়ের উপর। মাতাজী কী করছেন সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম শুয়ে শুয়ে। আলপনা দেওয়া শেষ করে ফুলের মালা গেঁথে পরালেন ঠাকুরকে। কীর্তন গাইলেন। গোঁসাইবাবা এসে কাঁসর ঘন্টা বাজালেন। ঠাকুরের সেবা শেষ হলে প্রসাদ দিলেন আমাদের। তারপর অন্য একটা ঘরের দাওয়ায় সামনে আয়না রেখে সাজতে বসলেন গোঁসাইমা। উঁচু করে খোঁপা বাঁধলেন। তিলকসেবা করলেন। গিরিমাটি দিয়ে নাকের ডগা থেকে কপাল পর্যন্ত তিলক। পরে জেনেছি, ওকেই বলে ‘রসকলি’।

পরিষ্কার পরিছন্ন কাপড় পরে, কাঁধে নিলেন একটা গেরুয়া রঙের ঝোলা। হাতে একটা কাঠবেলের মালা আর খঞ্জনি। এবার গাঁ বেড়াতে যাবেন। গাঁ বেড়ানো মানে পাঁচটা গ্রামে মাধুকরী করে যা পাবেন নিয়ে এসে ফুটিয়ে খাবেন।

আমরাও গোঁসাইমার সঙ্গে সঙ্গে চলতে শুরু করলাম। সারারাস্তা ঠুংঠুং করে খঞ্জনি বাজিয়ে মৃদুস্বরে গান গাইলেন ‘বহুদিন পরে বঁধুয়া এলে, দেখা না হইত পরাণ গেলে ... দেখা হতো না... পরাণ গেলে আর দেখা হতো না।’ একই লাইন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাইলেন। শেষে পৌঁছেলেন আমাদের সেই কুটুম বাড়িতেই। তবে ঢুকে পড়লেন না। দরজায় দাঁড়িয়ে জোরে খঞ্জনি বাজিয়ে বললেন, ‘রাধারানীর জয় হৌক, জয় গৌরনিতাই।’

ও বাড়ির গিন্নী বসতে কম্বলের আসন দিল। জল বাতাসা দিল। গোঁসাইমা কতক্ষণ বসে বসে গল্প করলেন। কত খবর দিলেন, কত খবর নিলেন। তারপর যখন উঠে পড়বেন, এ বাড়ির একজন রেকাবিতে করে এক রেকাবি ভর্তি চাল, দুটো আলু আর একটা বেগুন নিয়ে এল। ভিক্ষা নয়, সিধে। গোঁসাইমা তাঁর কাঠবেলের মালাখানি বাড়িয়ে দিলেন। মালাটি ভরে গেলে তবে ঝোলার মধ্যে ঢালবেন।

শুনলাম, গোঁসাইমা প্রতিদিন এক গ্রামে আসেন না। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আসেন। ঝুলি ভরে গেলেই ফিরে যান। খাওয়ার পর যা বেঁচে যায় তা রাধাগোবিন্দের ভাণ্ডারে জমা হয়। দোলপূর্ণিমা আর জন্মাষ্টমীতে মহোৎসব হয়। তখন পাঁচটা গ্রামের লোকে আখড়ায় খেতে যায়।

ওই দুষ্টু ছেলেটা বলছিল, ‘বোষ্টম হওয়া অত সোজা লয় বাবা। কথায় বলে ‘সাধ যায় বরিগ্যি হতে, বুক ফাটে মোচ্ছব দিতে!’’ 

শুধু মুষ্টিভিক্ষা সংগ্রহ করে জীবন যাপন করলেই ঠিক বৈষ্ণব ধর্ম পালন হয় না। ফিরিয়েও দিতে হয়। ফেরত দিতে যার বুক ফাটে, সে আর যাই হোক জাত বৈষ্ণব নয়।

(৪)

অনেকবছর পরে তখন বাংলা সাহিত্যের রস পেতে শুরু করেছি। স্বাভাবিক কারণেই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় অন্য ভাবে ধরা দিচ্ছেন চেতনায়। তাঁর লেখা পড়তে গিয়ে বাড়তি কোনও কল্পনা শক্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। প্রেক্ষাপট বা ভাষা সবই চেনা। জলের মত সরল। শুধু সরল না, নতুন করে আবিষ্কারও বটে। গন্ডগ্রামের মানুষেরা প্রায়শই শহুরে মানুষের সামনে গুটিয়ে যায়। তাদের ভাষা, উচ্চারণ, জীবনচর্যা সবই যে অন্যরকম, তাই এই সংকোচে! অথচ সেই ভাষা, সেই রীতিনীতি তারাশঙ্করের যাদু কলমের ছোঁয়ায় কেমন উঠে গিয়েছে কোনও এক প্রাসাদের শিখর চূড়ায়।

রসকলি পড়েছি আর কেবল গোঁসাইবাবার আখড়ার কথাই ভেসে উঠেছে মনের পটে। গোঁসাইমা যেন মঞ্জরীরই রূপ। ওদের কুঁড়েঘরগুলি যেন মঞ্জরীর সেই ঘর। ‘তকতকে ঘরখানি লাল মাটি দিয়া নিকানো, আলপনার বিচিত্র ছাঁদে চিত্রিত; দেওয়ালে খান কয়েক পট- সেই পুরানো গোরাচাঁদ, জগন্নাথ, যুগলমিলন; সবগুলির পায়ে চন্দনের চিহ্ন।’ মঞ্জরীর গাওয়া পদ যেন গোঁসাইমার গলাতেই শুনেছিলাম সেইদিন মাঠের আল বেয়ে আসতে আসতে। গল্পের শেষে মঞ্জরী যেন ও ভাবেই গুনগুন স্বরে কীর্তন গাইতে গাইতে বৃন্দাবনের পথে পা রেখেছিল।

(লেখার সঙ্গের ছবিটি তুলেছেন সৌরভ মণ্ডল)