ক্যামেরা, বাস্তব, চলচ্চিত্র
- 06 November, 2020
- লেখক: মানস ঘোষ
কাহিনীমূলক চলচিত্রকে ঘোরতর সন্দেহের চোখে দেখতেন জিগা ভের্তভ । তাঁর মতে কাহিনীচিত্রে রাজত্ব করে গল্পের ভূত । এসব ভূত-গ্রস্থ সিনেমা বুর্জোয়া রুচির অবদান । সদ্যগঠিত বিপ্লবোত্তর সোভিয়েতে জন্ম নিয়েছে নতুন সমাজ নতুন মানুষ । তাকে বোঝা ভূতের কম্ম নয় ।
“We proclaim the old films, based on the romance, theatrical films and the like, to be leprous.
- Keep away from them !
- Keep your eyes off them !
- They’re mortally dangerous!
- Contagious!” - Dziga Vertov ১
চলচ্চিত্র মাধ্যমের সবচেয়ে বড় চারিত্র্য হল তা প্রাথমিকভাবে বস্তু-জগতের ছবিকে উপস্থাপিত করতে পারে । কিন্তু প্রযুক্তি-নির্ভর এই মাধ্যমটির সঙ্গে জলজ্যান্ত বাস্তবের সম্পর্ক স্থাপন করাটা সহজ কাজ নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চলচ্চিত্রকারের ভাবালুতা বাস্তবের আকাড়া রূপটিকে এতটায় ঢেকে ফ্যালে যে তাতে নান্দনিকতা প্রধান্য পেয়ে যায় বাস্তবের থেকে। ভৌত জগতের আধিভৌতিক ইমেজ একেবারেই না-পসন্দ ছিল সোভিয়েত চলচিত্র নির্মাতা জিগা ভের্তভ-এর । তাঁর মত ছিল - চোখ কান খোলা রেখে - ক্যামেরাখানা কাঁধে তুলে রাস্তা-ঘাট , বাজার-লোকালয়, কল-কারখানা , নারী-পুরুষ , শ্রমিক-মেহনতি মানুষের ছবি কাজ-কর্ম চলন-বলনের ছবি তুলে যাও । আর হ্যাঁ , বাস্তবের ঘটনা তোমার তেপায়ার ওপর সাজিয়ে রাখা ক্যামেরার আয়তাকার ফ্রেমে এসে ধরা দেবে একথা প্রাচীনপন্থী আহাম্মক ছাড়া আর কেই বা ভাবতে পারে ।
আধুনিক জীবনে প্রতি মুহূর্তে দৃশ্যের জন্ম হচ্ছে । বাস্তবের সত্য যদি চলচ্চিত্র নয়নে ধরতে চাও তবে ক্যামেরাখানা কাঁধে নিয়ে ব্যস্ত প্রাত্যহিক জীবনের বিশৃঙ্খলার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ো হে । চোখ কান খোলা রাখলে ঠাওর করতে পারবে কোথায় দৃশ্যের জন্ম হচ্ছে । ক্যামেরা তেপায়ার মাথায় বসিয়ে সং-এর মত দাঁড়িয়ে না থেকে বরং দৌড়াও , ঘটনার ঘটমানতার সঙ্গে সংগতি রেখে গতিশীল হও । অবশ্য লক্ষ রাখতে হবে যাতে ক্যামেরার সামনে যে মানুষগুলো রয়েছে তারা হঠাৎ ক্যামেরা-সচেতন হয়ে না ওঠে । কারন সেরকমটা হয়ে পড়লে বাস্তবের নিজস্ব ছন্দটা যায় নষ্ট হয়ে । তাই পারলে একটু আড়াল-আবডাল রেখে ছবি তুলো বাপু । আর হ্যাঁ , স্ক্রিপ্ট বা স্ক্রিন-প্লে শব্দগুলো মাথা থেকে একেবারে ঝেড়ে ফেলা দরকার । চিত্রনাট্য জিনিষটার মধ্যে কেমন একটা নাটক-নাটক আর সাহিত্য-সাহিত্য গন্ধ আছে। ও দিয়ে ' বিশুদ্ধ চলচিত্র ' হয় না । 'বিশুদ্ধ চলচ্চিত্র ' হল প্রাত্যহিক বাস্তবের টাটকা আর প্রাণবন্ত ছবির মন্তাজ ।২
কাহিনীমূলক চলচিত্রকে ঘোরতর সন্দেহের চোখে দেখতেন জিগা ভের্তভ । তাঁর মতে কাহিনীচিত্রে রাজত্ব করে গল্পের ভূত । এসব ভূত-গ্রস্থ সিনেমা বুর্জোয়া রুচির অবদান । সদ্যগঠিত বিপ্লবোত্তর সোভিয়েতে জন্ম নিয়েছে নতুন সমাজ নতুন মানুষ । তাকে বোঝা ভূতের কম্ম নয় । তাই ভূতকে মাথায় চড়ে বসতে দেওয়াও কাম্য নয় । কথাগুলো তিনি ছুঁড়ে দিলেন তাঁর সহকর্মী ও বন্ধু প্রবাদ-প্রতিম চলচিত্রকার সের্গেই আইজনস্টাইনের উদ্দেশে । ততদিনে আইজনস্টাইন শ্রমজীবী মানুষের লড়াই-এর গল্প অবলম্বন করে স্ট্রাইক ও ব্যাটলশিপ পোটেমকিন নামে দুখানা নতুন আঙ্গিকের কাহিনীচিত্র নির্মান করে ফেলেছেন । তিনিও কলম ধরলেন , দাবি করলেন যে তাঁর ছবিগুলো মোটেই প্রথাগত কাহিনীচিত্র নয় । হ্যাঁ গল্প আছে সন্দেহ নেই , তবে কাহিনী বা প্লট একেবারেই গুরুত্ব পায়নি । তাঁর ছবি বিপ্লবী চলচিত্র, কারণ সেগুলো মোটেই বুর্জোয়া সিনেমার মত ‘প্লট নির্ভর’ নয় । বড়জোড় ইতিহাসের গল্পকে একটু মনে করিয়ে দেবার প্রয়াস-মাত্র । ভের্তভ তখন সোভিয়েত চলচিত্রের রাগী যুবক - তিনি মানলেন না সে কথা । ব্যাটলশিপ পোটেমকিন-এর কড়া সমালোচনা করলেন । আইজনস্টাইন গেলেন রেগে । বললেন, ভের্তভ বাস্তবের ছবি দিয়েই তার চলচিত্র নির্মান করে একথা ঠিক, কিন্তু তার সম্পাদনায় যে প্রায়শই অতিদ্রুতগামী মন্তাজ , প্রথাবিরুদ্ধ কায়দার ডিসলভ্ এবং স্পেশাল এফেক্ট সে ব্যবহার করে তা বাস্তবের চিত্রকে তো আর অবিকৃত রাখে না! আর বললেন , মোদ্দা কথা হল সোভিয়েত জনগনের জন্য দরকার ' চলচিত্র -মুষ্টিযোগ ' , ' চলচিত্র নয়ন ' নয় ।৩
যুক্তি ভের্তভ-এর পক্ষেও ছিল । তিনি বললেন যে তাঁর ছবি কেবলমাত্র দৃশ্যের সম্ভার নয় । চলমান বাস্তবের দৃশ্যাবলীকে সেখানে এমনভাবে সম্পাদনা করা হয়েছে যাতে দ্রুতগতির মন্তাজ একপ্রকার তীক্ষ্নাগ্র ছন্দ তৈরী করে । সম্পাদনায় নির্মিত ছন্দ যেন বাস্তবের বস্তু বা ঘটনাগুলির চলন ও গমনের ছন্দের নির্যাস । যেমনটা হয় মায়াকভস্কির কবিতায় । ভের্তভ বললেন যে তাঁর চলচিত্র আসলে শিল্প ও সমাজকে দেখার নতুন দৃষ্টির জন্ম দিতে চায় দর্শকের মননে । আর এই নতুন দৃষ্টিই হল 'চলচিত্র-সর্ত্য ' বা ' কিনো-প্রাভদা ' ।৪
' স্মিচ্-কা ' (smychka) শব্দটার সঙ্গে এককালে বাঙালীর পরিচয় ছিল বোধ হয় - সোভিয়েত দেশ পত্রিকার সুবাদে । যদিও সে পত্রিকা পড়া হত কমই , বরং কাজে লাগত স্কুলের বই এর মোলাট দেওয়ার । স্মিচ্-কা শব্দের অর্থ কাপলিং বা জোড় , যেমন ধরা যাক ' স্মিচ্-কা অব প্রোলেটারিয়েট এন্ড পূওর পেজেন্ট্রি ' ; একটু কব্যিক ঢং-এ যাকে বলা যায় ' স্মিচ্-কা অব দি সিটি এন্ড দি ভিলেজ ' ।৫ জিগা ভের্তভ ১৯২২ - ১৯২৫ এই সময়ের মধ্যে নিউজরিল ছবির একটি সিরিজ নির্মাণ করেন - নাম দেন কিনো প্রাভদা সিরিজ । কিনো প্রাভদা নং ১৮ ও নং ১৯ - দুটি নিউজরিলের সাধারণ বিষয় হল 'স্মিচ্-কা' । এর প্রথমটি যথেষ্ট বাহবা কুড়িয়েছিল । ' পোলেটিক্যাল স্পিরিট ' কে অতিক্রম করে ১৪ মিনিটের এই ছবিতে স্মিচ্-কা শব্দটির অর্থকে ভের্তভ ছড়িয়ে দিয়েছেন জীবনযাত্রার ছবি ও চলচিত্র-শৈলীতে । 'শ্রমিক ও কৃষক-এর ঐক্য’-ই মূল বিষয় সন্দেহ নেই , কিন্তু কিনো প্রাভদা ১৮ মূল বিষয়কে ছাপিয়ে মৃত্যু ও জন্ম , যন্ত্র ও শ্রমিক , স্থিতি ও গতি-র দ্বন্দ্ব ও ঐক্য-কে দেখতে চায় । ছবি শুরু হয় প্যারিস থেকে আনা আইফেল টাওয়ারের চলচিত্র ফুটেজ দিয়ে । পর্দায় ফুটে ওঠে “in the occasion of death of the architect” - আইফেল টাওয়ারের স্থপতি গুস্তভ আইফেল , যিনি সদ্য মারা গেছেন (১৯২৩) - তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ।
ক্যামেরা ফিরে আসে সদ্য জন্ম নেওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের নিসর্গ দৃশ্যে । প্লেন থেকে নেওয়া একটি শট । ক্যামেরা দ্রুতগতিতে ছুটতে থাকে সোভিয়েতের পশ্চিম থেকে পুবের দিকে । গ্রাম থেকে নগরের দিকে ।৬ এক কৃষক শহরে এসেছে কৃষি সম্মেলনে । সকালবেলার নগরের টুকরো টুকরো দৃশ্যের মন্তাজ । তারপর সম্মেলনের মঞ্চ – সমাবেশ, আজস্র মুখের সারি, কবিতা পাঠ, ভাসণ, উল্লাস। শ্রমিক কৃষকের ঐক্যের শপথ । ইতিমধ্যে , একটি নতুন শিশুর জন্মের খবর আসে । নবজাতকের শ্রমিক পিতা ও কারখানার অন্য শ্রমিক কমরেডরা হাসপাতালে আসে নতুন অতিথিকে সোভিয়েত রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নাগরীক হিসাবে স্বাগত জানাতে । কিছুক্ষনের স্থিতি কারখানার চাকা পিষ্টন আর কনভেয়র বেল্টের । সদ্য জন্মান শিশুটিকে ঘিরে গাওয়া হয় ' ইন্টারন্যাশনাল ' । শ্রমিকরা আবার ফিরে আসে কাজে । আবার গতি আর ছন্দের মন্তাজে ঐক্যবদ্ধ হয় মানুষ ও যন্ত্র । আপাতত ছবি শেষ হয়।
আসলে গতি আর ছন্দ দিয়েই জীবন্ত বাস্তবের শ্রমনির্ভরতাকে বুঝতে চেয়েছিলেন জিগা ভের্তভ । কারণ ক্যামেরা নামক যন্ত্রটির বড় গুণ হল তা জীবনের চলমানতাকে সরাসরি রেকর্ড করতে পারে। আর চলমানতার নির্যাস হল গতি ও ছন্দ। দৈনন্দিন জীবনের সমুদ্রে ডুব দিয়ে গতি আর ছন্দের টুকরো তুলে আনাই ভের্তভ-এর ছবির বিশিষ্টতা। ভেরতভের মতে এই হল জনগনতান্ত্রিক চলচ্চিত্র।
তথ্যসূত্র
১. ‘We: Variant of a Manifesto’, Dziga Vertov, 1923.
২. Constructivism in Film : The Man with the Movie Camera : a Cinematic Analysis , Vlada Petric , Cambridge University Press , 1987 .
৩. The Eisenstein Reader , ed. Richard Taylor , BFI , 1998 .
৪. KINO-EYE : The Writings of Dziga Vertov , ed. Annette Michelcon , University of California Press , 1984 .
৫. http://en.wikipedia.org/wiki/Smychka
৬. http://sovietmovies.blogspot.com/2011/06/dziga-vertov-kino-pravda-no-18-1924.html