নয়াউদারবাদি অর্থনীতিতে অর্বুদপতিদের রাজত্ব

এই সরকারের সঙ্গে পেশাদার অর্থনীতিবিদদের বনিবনা হয় না বললেই চলে। রঘুরাম রাজন, উর্জিত প্যাটেল, ভিরাল আচার্যরা যদি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে পদত্যাগ করেন তো অরবিন্দ সুব্রামণিয়াম সরে যান মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টার পদ থেকে: রথীন রায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মন্ডলী থেকে, পানাগারিয়া নীতি আয়োগ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন।

অতিদক্ষিণপন্থার জমানায় অর্থনীতিবিদরা ব্রাত্য

২১ বছরের মধ্যে দু-দুজন ভারতীয় অর্থনীতিবিদ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু দেশের বর্তমান শাসক দলের জমানায় ভারতে অর্থনীতির তাত্বিক বা তথ্যভিত্তিক আলোচনা অর্থ বহন করে বলে মনে হয় না। দেশের বাইরে যথেষ্ট কদর পেলেও বর্তমান শাসক দলের প্রবক্তারা সেই সমস্ত ভারতীয় অর্থনীতিবিদদের অধিকাংশকেই অপ্রাসঙ্গিক বুদ্ধিজীবী বা দেশবিরোধী বলে চিহ্নিত করে তাদের ঠাট্টা ইয়ার্কির বিষয়বস্তু করে তুলতে সচেষ্ট।একথা সর্বজনস্বীকার্য যে, কোন সমাজই সর্বাঙ্গসুন্দর নয়; তাই বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদদের কাজই হল বিদ্যমান সামাজিক ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার দিক সম্পর্কে সচেতন করা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ক্ষমতার অলিন্দে থাকা ব্যক্তিবর্গ ও তাদের শাগরেদরা এমনভাবে হামলে পড়ছে যে প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করতে অগাধ সাহসের প্রয়োজন হচ্ছে। অমর্ত্য সেন, কৌশিক বসু, অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জী, রঘুরাম রাজন, উর্জিত প্যাটেল, অরবিন্দ সুব্রামণিয়াম, রথীন রায়, ভিরাল আচার্য প্রমূখ সরকারের অর্থনৈতিক কাজকর্মের সমালোচকদের শাসক দলের মুখপাত্র ও সমর্থকদের তীব্র অশালীন আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে। যে সমস্ত অর্থনীতিবিদদের নাম করা হল, তাদের কয়েকজন বর্তমান সরকার কর্তৃক কোন না কোন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের জন্য নির্দিষ্ট পদে সমাসীন ছিলেন। তাছাড়া, উক্ত অর্থনীতিবিদদের কেউই প্রায় সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সমর্থক নন বা বিশ্বায়নের বিরোধী নয়।  এতদসত্বেও তাঁরা শাসক দলের রোষ ও ক্রোধের শিকার হয়েছে, সময়ে সময়ে তাদের কুখ্যাত আইটি সেলের কুরুচিকর টিপ্পনির বন্যা বয়েছে তাদের ব্যক্তিগত জীবনকে নিয়ে। কেবল অর্থনীতিবিদরাই নয়, বিপান চন্দ্র, ইরফান হাবিব, রোমিলা থাপার, শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, রামশরণ শর্মা, দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ ঝাঁর মত জীবিত বা মৃত ইতিহাসবিদদেরকেও কুৎসিত আক্রমণের মুখোমুখি হতে হয়েছে। কারণ তাঁরা সকল সমযেই সত্যের অনুসন্ধান করে প্রচলিত ধারণাগুলিকে প্রশ্ন করেছেন, কোনো কিছুকেই সনাতন বলে গ্রহণ করেননি। শাসক দলের সমস্ত কর্মসূচি বা গণহত্যা বা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের, অথবা বামপন্থী বিদ্বজ্জনদের, সাংবাদিকদের মিথ্যা অভিযোগে জেলে পোরার বিরোধিতা করেছেন। ফলে সমস্ত বিবেকবান বিদ্বজ্জনকেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে বিদ্যাচর্চাকারী পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বিদেশীদের তাঁবেদার, ‘সিকুলার’, ‘বামৈশ্লামিক’ জাতীয় বিবিধ বিশেষণে অভিহিত করার অবিরাম চেষ্টাই বর্তমান শাসক দলের মেধা ও বিদ্যাচর্চার জগতে প্রকৃত সংযুক্তি।

অর্থনৈতিক তথ্য: রাজা যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ

এই ধরণের আবহে ভারতীয় অর্থনীতি সম্পর্কে তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা অতীব দূরূহ হয়ে উঠেছে। কেবল তাই নয় ভারতীয় অর্থনীতি সংক্রান্ত সরকারিভাবে প্রকাশিত তথ্য বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে বিশ্বের অন্তত ১০৮ জন নামকরা অর্থনীতিবিদ প্রশ্ন তুলেছেন, যদিও সরকার যথাবিহিত সেই অভিযোগকে পাত্তা না দিয়ে ১৩১ জন তাঁবেদার, স্বভাবতই কর্পোরেট বন্ধু চার্টার্ড একাউন্টেন্টকে দিয়ে ভারতীয় জাতীয় হিসাব রক্ষণ পদ্ধতির সমর্থনে নামিয়ে দিয়েছিল। যদিও নিজেদের নামের পিছনে একাউন্টান্ট নামটি থাকলেও জাতীয় হিসাব পদ্ধতি বা সিস্টেম অফ ন্যাশনাল একাউন্টস সম্পর্কে কোনো বিশেষ জ্ঞান চার্টার্ড একাউন্টান্দের থাকে বলে জানা নেই, সেটি সম্পূর্ণ ভাবেই অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানের ব্যাপার। নিজেদের এক্তিযারের বাইরে গিয়ে এই সরকারের পক্ষে চার্টার্ড একাউন্টান্টদের সমাবেশিত করা জানিয়ে দেয় যে, পেশাদারী অর্থনীতিবিদদের থেকে হিসেবরক্ষক-নিরীক্ষকরা শাসক দলের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত, চার্টার্ড একাউন্টান্টরা প্রতিষ্ঠান ও কর্পোরেট সমর্থক হয়ে থাকে কেন না পেশাটির মধ্যেই কর্পোরেট নির্ভরতা রয়েছে, অন্যদিকে অর্থনীতিবিদরা বহুলাংশেই সরকারের দোষ ত্রুটি, গরিবি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য প্রদানে অক্ষমতার দিকটি তুলে ধরে সরকারের বিরাগভাজন হয়ে থাকে, সেটা আরো বেশি হয় যত সরকারটি অধিক স্বৈরতন্ত্রী হয়। ভারতের বর্তমান সরকারের কাছে অর্থনীতিবিদরা কতটা গুরুত্বহীন তা বোঝা যায় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিযার মত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্টানে অর্থনীতিবিদের বদলে একজন সরকারি বশংবদ আমলাকে সর্বোচ্চপদে বহাল করার মধ্য দিয়ে। লক্ষণীয়, এই সরকারের সঙ্গে পেশাদার অর্থনীতিবিদদের বনিবনা হয় না বললেই চলে। রঘুরাম রাজন, উর্জিত প্যাটেল, ভিরাল আচার্যরা যদি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে পদত্যাগ করেন তো অরবিন্দ সুব্রামণিয়াম সরে যান মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টার পদ থেকে: রথীন রায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মন্ডলী থেকে,  পানাগারিয়া নীতি আয়োগ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। একটি সর্বাঙ্গীন দক্ষিণপন্থী শাসক সব সময়েই আজ্ঞাবহ দাস চায়, কোনো স্বকীয়তাকেই সহ্য করতে নারাজ সে। প্রকৃত প্রস্তাবে শাসক যখন অর্থনীতিতে উদারপন্থা বেছে নেয় তখন তার অর্থনীতিবিদদের দরকার পড়ে তার নীতির সমর্থনে যুক্তি সরবরাহের। ফলে অর্থনীতিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে যায় আগেই, সেটি কত   সঙ্গত ও জনমুখী তাকে প্রমাণ করার দায় বর্তায় সরকার সমর্থক অর্থনীতিবিদদের।  উদারপন্থী অর্থনীতি চায় যে, সব কিছুই বাজার নির্ধারিত হবে, পুঁজি যা চাইবে সেটাই হবে, ফলে অর্থনীতি বিষয়টি খুব বেশি হলে কেবল বৌদ্ধিক আলোচনার জগতেই অস্তিত্ব বজায় রাখবে, আর আগেই বলেছি, অর্থনীতির কাজ হবে পূর্ব নির্ধারিত, অবাধ বাজারের সপক্ষে যুক্তি সরবরাহ করা।

অতিমারির সময় বাজার কী করেছে

সারা দেশ যখন কোভিড-১৯ অতিমারির দাপটে তটস্থ, দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত, এমন এক পরিস্থিতিতে শাসক দল কয়েক গন্ডা অর্থনৈতিক আইন জনপরিসরে আলোচনা তো দূরের কথা,  সংসদের উচ্চ কক্ষে  কোনোরকম ভোটাভুটি ব্যতিরেকেই গায়ের জোরে পাশ করিয়ে নিল। একটি কার্যকরী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, যে সমস্ত শ্রমিক ও কৃষকদের স্বার্থের কথা উল্লেখ করে আইন বলবৎ করা হচ্ছে, তাদের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করা দরকার তার কোনো চিহ্নই দেখা গেল না। আইনগুলি একদিকে কৃষকদের উপর অপরদিকে শ্রমিকদের উপর বলবৎ হবে। সরকারের যুক্তি হল, ওই সব আইনের ফলে অর্থনীতি খোলামেলা, কর্মদক্ষ ও স্বনির্ভর হয়ে উঠবে। এটি সর্বজনস্বীকৃত যে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত একটি অবাধ ও মুক্ত অর্থনীতিতে কর্পোরেটগুলিই সিদ্দান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অর্জন করে আর বাকিরা সেই সিদ্ধান্ত রূপায়নে বাধ্য হয়।  ফলে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কর্পোরেটদের অবাধ বিচরণ করতে দিলে সাধারণ মানুষকে বিপুল বাজার উদ্ধবুত ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। কোভিড-১৯ অতিমারি গরিব ও সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকার নিরপাতজতা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাজার অর্থনীতির সীমাবদ্ধতাকে দেখিয়ে দিয়েছে। এও দেখা গেছে যে, ধনীরা এই অতিমারিতে তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি। বরং বহু ক্ষেত্রে তারা আরো সম্পদশালী হয়েছে যেখানে দরিদ্র মানুষ কেবল বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করতে বাধ্য হয়েছে।

কোভিড অর্থনীতি- রাজার হস্ত করে সমস্ত

অক্সফ্যামের প্রতিবেদন অনুসারে পৃথিবীর ৩২টা বৃহৎ কোম্পানি ২০২০ সালে তাদের মুনাফা ১০৯০০ কোটি ডলার বা ৮ লক্ষ কোটি টাকা বাড়াতে চলেছে; অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার অনুমান যে অতিরিক্ত ৫০ কোটি মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে নেমে যেতে চলেছে, ৪০ কোটি কাজ চলে যেতে বসেছে ও ৪৩ কোটি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের বন্ধ হয়ে যাওযার মুখে পড়েছে। ওযাশিংটন ডিসির ইনস্টিটুট অফ পলিসি স্টাডিজ এন্ড ক্লিয়ারওয়াটারের প্রতিবেদন অনুসারে আমেরিকার অর্বুদপতিরা ২০২০র মার্চ মাস থেকে পরবর্তি ৩ মাসে ৫৬৫০০ কোটি ডলার বা প্রায় ৪০ লক্ষ কোটি টাকার অতিরিক্ত সম্পদশালী হয়েছে। আমাজনের মালিক জেফ বেজোস অতিমারির সময়ে যে পরিমাণ অতিরিক্ত সম্পদশালী হয়েছেন যে, তিনি তার ৮৭৬০০০ কর্মচারিদের যদি ১০৫০০০ ডলার বা ৭৫ লক্ষ টাকা করে এককালিন বোনাস দেন তাহলেও অতিমারির শুরুতে তার যা সম্পদ ছিল তার থেকে বেশি থাকবে। বিশ্বের প্রথম ২০০০০ কোটি ডলারের সম্পত্তির মালিক তিনি, তার সম্পদ অতিমারির সময়েই ৯০০০ কোটি ডলার বেড়েছে।

পৌষমাস বনাম সর্বনাশ

ভারতীয় অর্বুদপতিরাও পিছিয়ে নেই। তারাও তাদের ঝোলা ভর্তি করছে। এদের মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য হল মুকেশ আম্বানি, অতিমারির সময়ে বিশ্বে ৪র্থ ধনী ব্যক্তি হিসেবে ধাপে ধাপে উঠে এসেছেন। অতি সম্প্রতি রিলায়েন্স শেয়ারের দাম পড়ে যাোয়ায় কিছুটা সম্পদ কমলেও, তার আগে ২২০০ কোটি ডলারের সম্পদ বাড়িয়ে মোট সম্পত্তির পরিমাণকে ৮০০০ কোটি ডলার বা প্রায় ৬ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছে দিয়েছেন। দেশের অর্ধকের বেশি মানুষ যখন ভাইরাসের ভয়ে দুবেলা দুমুঠো পেট ভরানোর খাবার জোগাড়ের চিন্তায় অস্থির তখন সিরাম ইন্সটিটুট অফ টেকনোলোজির প্রতিষ্টাতা মালিক সাইরাস পুনাওয়ালা ভইারাসের ভ্যাকসিনের উৎপাদনের প্রকল্পের মাধ্যমে সম্পত্তির পরিমাণ ৮৫% বাড়িয়ে নিতে পেরেছেন। যখন সারা দেশ কোভিড-১৯ এর আতঙ্কে অথবা রাষ্ট্রের নির্যাতনের ভয়ে ঘরে বসে থেকেছে বা পরিবহণের অভাবে থাকতে বাধ্য হয়েছে কয়েক ডজন ধনী শিল্পপতি তাদের ব্যবসায় আরো ভয়ানকভাবে চালিয়ে গেছেন । জনগণের ভয়কে কাজে লাগিয়ে ওষুধের কোম্পানিরা জবরদস্ত ব্যবসায় করেছে, বহুক্ষেত্রেই প্রচার মাধ্যম কর্তৃক টকশো ও ভাইরাস নিয়ে আলোচনার সময়ে ভিটামিন, রোগ প্রতিষেধক ইত্যাদির প্রচ্ছন্ন বিজ্ঞাপনের সাহায্যে। সমস্ত বৃহৎ ওষুধ কোম্পানির মালিকরা যেমন, সান ফার্মার দিলিপ সাংভি, ড. রেড্ডিজ ল্যাবরেটরির মালিকরা,অরবিন্দ ফার্মার পিভি রামপ্রসাদ রেড্ডি, সিপ্লার ওয়াই কে হামিদ প্রমূখ অতিমারির সময়ে তাদের সম্পদকে বহুলাংশে বাড়িয়েছে। সরকারের অনলাইন নিয়ে মাতামাতি যেমন রিলায়েন্সের সুবিধে করেছে তেমনি ভারতি এয়ারটেলের মিত্তলকেও বড়লোক করেছে। ওই সময়কালে গৌতম আদানির সম্পদেরও দুর্দান্ত বৃদ্ধি হয়েছে, কারণটি অনুমেয়।

গরিবরা আরো গরিব হয়

আইএলওর এপ্রিল, ২০২০র অনুমান অনুসারে অতিমারি ও তার ফলে আরোপিত ভয়ঙ্কর তালাবন্দির ফলে ভারতের ৪০ কোটি অসংগঠিত শ্রমিকদের আরো বেশি দরিদ্র হয়ে যাওযার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। আইসিআরআইইআর-এর শ্বেতা সাইনি এবং ফুলকি খাত্রির অনুমান অনুসারে যদি ২৫% গড় আয় হ্রাস পায় তাহলে অতিরিক্ত ৩৫ কোটি মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে চলে যাবে কারণ তাদের মাথাপিছু ভোগব্যয় কমে যাবে। তাদের আরো অনুমান ছিল যে মাথাপিছু মাসিক ৩১২ টাকার সরাসরি হস্তান্তর সেই সমস্ত মানুষদের মাথাপিছু ভোগব্যয়কে পুনরায় কোভিড পূর্ববর্তি স্তরে নিয়ে আসতে সক্ষম হবে। অনুরূপ নগদ হস্তান্তরের জন্য মাসে ১৯৫০০ কোটি টাকা লাগত। তাদের হিসেব অনুযায়ী যদি মাসিক ৭৫০ টাকার নগদ দেওয়া  হত তাহলে  দারিদ্র সীমার নিচে থাকা সকল মানুষ দারিদ্র সীমার উপরে চলে আসতে পারত। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে অর্থ লাগত মাসিক ৪৬৮০০ কোটি টাকা। এি প্রয়োজনীয় অর্থের পরিমাণকে যদি আমরা দেশের ৬৩ জন অর্বুদপতিদের সামগ্রিক সম্পত্তি, ২৪৪২২০০ কোটি টাকার নিরিখে দেখি তাহলে ধনীদের উপরে একদফার ১০% সম্পদ কর দরিদ্রদের জন্য ৬ মাসের নগদ হস্তান্তরের জন্য যথেষ্ট হত। কিন্তু তাতো সরকারের দ্বারা হবার নয়। দেশে বৈষম্য এতটাই প্রকট যে, তথ্য প্রযুক্তি ক্ষে্তরের একজন মুখ্য কার্যনির্বাহী কর্তা হ ১০ মিনিটে যা রোজগার করে একজন গৃহপরিচারিকার তা আয় করতে ১ বছর লাগে। ভারতের উপরের ১% ধনী যে সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে তা দরিদ্রতম ৭০%এর নিয়ন্ত্রিত সম্পদের ৪ গুণ।

নয়াউদার অর্থনীতি- কী বেড়েছে, বৃদ্ধি না বৈষম্য

এই বিপুল অসাম্য ও দারিদ্রের দেশে, সর্বশক্তিমান শাসকরা মনে করে যে অর্থনীতির উন্নয়নের দায় দায়িত্ব ব্যক্তি পুঁজির অধীন কর্পোরেট মালিকদের হাতে সম্পূর্ণভাবে ন্যস্ত করতে  হবে, যারা বাজার এবং কেবল বাজারের উপর ভিত্তি করেই সমস্ত উন্নয়ন ঘটাবে। এটা বলা যেতে পারে যে, ভারতে নয়াউদারনীতিবাদী অর্থনীতি চালু করার সহিত অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি, ফ্যাসিবাদী হোক না হোক চরম দক্ষিণপন্থী রাজনীতির এবং ধারাবাহিক সাম্প্রদায়িক হিংসার সঙ্গে একটি চরম বিভাজিত সমাজের  উদ্ভবের সরাসরি সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়েছে। যেনতেন প্রকারেই হোক, বিপুলাকার রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রের উপর নির্ভরশীল  নেহরুবাদি সমাজতান্ত্রিক  অর্থনীতিকে অবাধ নয়াউদারবাদি অর্থনীতির প্রবক্তারা নাকচ করতে তৎপর। যেহেতু ১৯৯১ সালে নয়া অর্থনৈতিক নীতি প্রবর্তনের পরে জিডিপির বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার যেহেতু ১৯৯১ পূর্ববর্তী জিডিপির গড় বৃদ্ধির হারের থেকে বেশি তাই এমনটাই বলা হয় যে নয়াউদারবাদী অর্থনীতির পূর্ববর্তী অবস্থা পরবর্তী অবস্থার থেকে খারাপ ছিল। কিন্তু সরকারিভাবে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে সর্বোচ্চ বার্ষিক জিডিপি বৃদ্ধি ঘটেছে ১৯৮৮ সালে (৯.৬৩%), দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৯৭৫ সালে (৯.১৫%), তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৯৯৯ সালে (৮.৮৫%), ২০১০ সালে চতুর্থ (৮.৫%), ২০১৬ সালে পঞ্চম (৮.২৬%)। এমনকি মাথাপিছু জিডিপি বৃদ্ধিও ১৯৮৮ সালে সর্বোচ্চ (৭.৩%) ছিল, ২.৪% হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি সত্বেও। কিন্তু  ১৯৯১ থেকে চালু করা উদারনীতিকরণ-বেসরকারিকরণ-বিশ্বায়নের ফলে সমাজে সম্পদের বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈষম্যের সূচক গিনি সহগের মান সম্পদের ক্ষেত্রে ১৯৯১ সালে ০.৬৫ থেকে বেড়ে ২০০২ সালে হয়েছিল ০.৬৬; যা ২০১২ সালে বেড়ে ০.৭৪ হয়েছে। সুতরাং, যদিও জিডিপির গড় বৃদ্ধির হার বেড়েছে কিন্তু তা সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্যকে তীব্রতর করেছে।

ভারতীয় অর্থনীতি- ব্রিটিশ রাজ থেকে অর্বুদপতিদের রাজত্বে

নয়াউদারবাদী অর্থনীতি বর্ধিত বৃদ্ধির হারের অনুষঙ্গ হিসেবে কেবল ক্রমবর্ধমান সম্পদ বন্টনের বৈষম্যই সৃষ্টি করেনি। সাথে সাথে আগ্রাসী শিল্পপতিদেরও তৈরি করেছে যারা আরো বেশি সম্পদের জন্য আরো মুনাফার লক্ষ্যে অধিকতর স্বাধীনতা চায়। তাই, রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচারের মাধ্যমে পরিকল্পনা কমিশন সমেত পরিকল্পিত অর্থনীতির বাহানায়  যেটুকু সমাজতান্ত্রিক  অবশিষ্ট ছিল  তাকে বিদায় করা হয়েছে। বেসরকারি কর্পোরেট ক্ষেত্রকে অর্থনীতির উন্নয়নকারী হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। কর্পোরেট ক্ষেত্র কর হারের হ্রাস, ইচ্ছে মত  লে অফ ও ছাটাইএর অধিক নমনীয় শ্রম আইন, কৃষি ক্ষেত্রকে বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করা, রাষ্ট্রায়ত্ব উদ্যোগগুলির বেসরকারিকরণ, বিদ্যুত, জ্বালানীর বিনিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি দাবি করেছে। সামাজিক প্রভাবের জন্য বিগত শাসক দলগুলি সমাজে কর্পোরেট পুঁজির ক্রমবর্ধমান প্রভাব বৃদ্ধিকারী সমস্ত সংস্কারগুলি একসাথে চালু করতে পারে নি। বেসরকারি কর্পোরেট পুঁজির প্রয়োজন ছিল এমন এক শাসকের যে নির্দয়ভাবে অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচিকে চাপিয়ে দিতে পারবে। একটি চরম জাতীয়তাবাদী  অতি দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক সংগঠন তাদের সেই মনোবাসনা পূরণ করতে পারবে। ভারতে সেই সংগঠনকে তৈরি করা হয়েছে। একই সঙ্গে ভ্রাতৃঘাতী দেশভাগের মধ্য দিয়ে ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্ট  একটি প্রতিবেশীও আছে, সাথে দেশে রয়েছে সেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের একটি বড় সংখ্যা। সেই ধর্মের ও সেই প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে জিগির তুলে অনায়াসেই দারিদ্র ও বৈষম্যকে ভুলিয়ে রাখা যায়। বেসরকারি মালিকরা সমস্ত রকমের প্রচারের চমক সৃষ্টি করে জনগণকে ভুল বোঝানোর জন্য অতি দক্ষিণপন্থী সেই রাজনৈতিক সংগঠনকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে সেই দলকে দৃঢ় ভাবে শাসন ক্ষমতায় প্রোথিত করতে সচেষ্ট। বিনিময়ে পুরো অর্থনীতিকে বেসরকারি পুঁজির হাতে তুলে দেোয়া হচ্ছে। বিপুল সংখ্যাক কৃষকের বিরোধিতা সত্বেও রাজ্যসভায় বিধি লঙ্ঘন করে সাম্প্রতিক কৃষি আইনের প্রবর্তন কর্পোরেটের স্বার্থে কৃষি ক্ষেত্রকে উন্মুক্ত করারর জন্য শাসক দলের আগ্রহকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। একই সাথে শ্রম আইনগুলিকে কোনো বিতর্ক ছাড়াই পাশ করানো হয়েছে। এই সমস্ত আইনগুলির প্রভাব স্বল্পকালে নাও বোঝা যেতে পারে। কিন্তু এটি পরিস্কার যে ওই সমস্ত আইন অর্থনীতি, কৃষক ও শ্রমিকদের আরো বেশি করে কর্পোরেটদের মুঠোর মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হল, যার ফলে নিশ্চিতভাবে সমাজ-অ্থনীতিতে বিরাজমান বৈষম্যকে আরো বাড়িয়ে তুলবে। চ্যান্সেল লুকাস ও টমাস পিকেটির কথায় বলা যায়, ভারতীয় অর্থনৈতিক বৈষম্য এখন ব্রিটিশ রাজ থেকে অর্বুদপতিদের রাজত্বে পৌঁছেছে।