বিবর্তনের ধাপে ধাপে মানুষের উদ্ভব

শুনতে ভাল লাগুক আর নাই লাগুক, আমরা সবাই লেজহীন বাঁদরের বা Ape বংশের অন্তর্গত। Apeদের দুভাগে ভাগ করা হয়। একটি ভাগকে বলে গৌণ বা lesser apes, আরেকটি ভাগকে বলে মুখ্য বা greater apes। গৌণ ভাগে আছে সিয়ামাং ও গিবন। মুখ্য ভাগে আছে ওরাং উটান, গরিলা, শিম্পাঞ্জি, বনোবো এবং অবশ্যই মানুষ।

বিবর্তনের ধাপে ধাপে পা রেখে এককোষী জীব থেকে কিভাবে বহুকোষী জীবনের সৃষ্টি হল, সে তথ্য অল্পবিস্তর আজ প্রায় সবারই জানা আছে। বহুকোষীদের প্রধানত দুটি রাজত্বে (kingdom) ভাগ করা হয় , উদ্ভিদ ও প্রাণী। প্রাণীরাজত্বে বহু বর্গের (phylum) প্রাণীর মধ্যে এক বর্গের প্রাণীদের বলা হয় মেরুদণ্ডী (chordata), অর্থাৎ যাদের মেরুদণ্ড আছে। মেরুদণ্ডীদের ভেতর বিভিন্ন শ্রেণী (class) আছে। এক শ্রেণির প্রাণীকে বলা হয় স্তন্যপায়ী (mammals)। এদের সন্তানরা জন্মের পর মায়ের দুধ খেয়ে বড় হয়। স্তন্যপায়ীদের মধ্যে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে (order) বলা হয় Primate। এই নামকরণ করেছিলেন Carolus Linnaeus। তিনি ভেবেছিলেন এরাই সব চাইতে উন্নত (Prime) জীব, যদিও কারা উন্নত জীব আর কারাই বা অনুন্নত এ সম্বন্ধে সঠিক সংজ্ঞা এখনও স্থির করা যায় নি। ডায়নাসোররা অবলুপ্ত হওয়ার প্রায় এক কোটি বছর পরে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৬ কোটি বছর আগে এই স্থলচর জীবদের উদ্ভব হয়। প্রথমে এরা ছিল খুব ছোট। মাটির ওপর খাবারের সন্ধান করত এবং শত্রুর হাত থেকে পালাবার জন্য ঝোপে ঝাড়ে আশ্রয় নিত। ধীরে ধীরে পৃথিবীর পরিবেশ পাল্টাতে থাকে। উষ্ণ অঞ্চলে বিশালাকার উঁচু উঁচু গাছের সৃষ্টি হয়। পরিবর্তিত পরিবেশে Primateরা খাদ্যের সন্ধানে এবং আত্মরক্ষার জন্য এই গাছগুলিতে থাকতে শুরু করে। এদের অনেক প্রজাতি তাদের পূর্বপুরুষদের তুলনায়  আকারে বিশাল হয়। অনেকগুলি প্রজাতি আবার গাছ থেকে মাটিতে নেমে এসে, সেখানে খাদ্যের অনুসন্ধান করতে থাকে। এরা মাটিতেই থাকত, কিন্তু বিপদ দেখলে গাছে উঠে যেত। সময়ের সাথে সাথে নতুন ধরণের প্রজাতি সৃষ্টি হয়, যারা দু পায়ে হাঁটতে শেখে। এদেরই উত্তরসূরি বর্তমান মানুষ। Primate কারা? লেমুর, বাঁদর, হনুমান, গিবন, ওরাং ওটাং, গরিলা, মানুষ ইত্যাদি সবাই Primate শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। সাধারণত সব Primateদের লেজ থাকে। যাদের লেজ থাকে না, তাদের বলা হয় Ape বা লেজহীন বাঁদর। primate-দের এই বিবর্তনের একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ এখানে দিচ্ছি। আজ থেকে অন্তত ৫ কোটি বছর আগে সৃষ্টি হয় প্রাক-বানর বা prosimians। এরা অনেক প্রজাতিতে বিভক্ত হয়ে প্রায় সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। যতদিন পর্য্যন্ত বানরের আবির্ভাব হয় নি, ততদিন পর্য্যন্ত প্রাক-বানররা ঘন জংগলে গাছে গাছে রাজত্ব করেছে। বানরদের উদ্ভবের প্রায় সাথে সাথে প্রাক-বানররা অবলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন  এই প্রাক-বানরদের একটি প্রজাতিরও অস্তিত্ব নেই। আকৃতিগত দিক থেকে এদের বর্তমান লেমুর বা লরিসের সাথে সাদৃশ্য আছে। বাঁ দিকের ছবিটি একটি প্রাক-বানরের, নাম স্মাইলোডেক্টেস। নাকের গড়ন দেখে মনে হয় এদের প্রচণ্ড ঘ্রাণশক্তি ছিল। হাতের ও পায়ের গঠন গাছে চড়া ও শাখা প্রশাখা আঁকড়ে ধরার উপযোগী ছিল। স্তন্যপায়ী জীবদের সাধারণত মাথার খুলির গোড়ায় একটা বড় ফুটো থাকে যার ভেতরে সুষুম্নাকাণ্ড (spinal cord) প্রবেশ করে। ঐ ছিদ্রের আকার দেখলেই বোঝা যায় যে জীবটির মেরুদণ্ড মাটির সাথে সমান্তরাল ছিল (যেমন গরু বা ঘোড়ার মত) না উল্লম্ব ছিল (বানরের মত)। প্রাক-বানরদের সময় থেকেই ধীরে ধীরে primateদের মেরুদণ্ড সোজা হতে শুরু করে। তবে আকৃতিতে এরা বর্তমান লেমুরদের থেকে অনেক ছোট ছিল। প্রাক-বানরদের বিবর্তনের ফলে মোটামুটি সাড়ে তিন কোটি বছর আগে বানর প্রজাতির সৃষ্টি হয়। এই সব বানরকে বলা হয় পুরানো পৃথিবীর বানর (old world monkeys)। এরা চেহারায় খুব ছোট ছিল। কেউ ছিল একটা কাঠবিড়ালির  মত, কেউ বা ছোট কুকুরের মত আয়তনবিশিষ্ট। এরা জন্মাবার প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ বছর পরে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় তিন কোটি বছর আগে কিছু নতুন প্রজাতির বানরের উদ্ভব হয়, যাদের বলা হয় নতুন পৃথিবীর বানর (new world monkeys)। বাঁদরের এই সব নতুন প্রজাতি দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে প্রাক-বানর এবং পুরাতন বাঁদরদের প্রায় নিশ্চিহ্ন করে অরণ্যের গাছগুলির দখল নিয়ে নেয়। এক কোটি বছর ধরে নতুন পৃথিবীর বানররা রাজত্ব চালিয়ে যায়। এদেরই উত্তরপুরুষ লেজহীন বাঁদর বা Apes। আজ থেকে প্রায় দু কোটি বছর আগে লেজহীন বাঁদররা পৃথিবীতে আসে। কাজেই যথার্থ অর্থে এরাই আমাদের খাঁটি পূর্বপুরুষ। আগের পাতায় ডান দিকের ছবিতে একটি প্রাক-শিম্পাঞ্জি দেখানো হয়েছে। 

 

লেজহীন বাঁদর

শুনতে ভাল লাগুক আর নাই লাগুক, আমরা সবাই লেজহীন বাঁদরের বা Ape বংশের অন্তর্গত। Apeদের দুভাগে ভাগ করা হয়। একটি ভাগকে বলে গৌণ বা lesser apes, আরেকটি ভাগকে বলে মুখ্য বা greater apes। গৌণ ভাগে আছে সিয়ামাং ও গিবন। নীচের ছবিতে বাঁ দিকেরটি সিয়ামাং-এর এবং ডান দিকেরটি গিবনের।

 

মুখ্য ভাগে আছে ওরাং উটান, গরিলা, শিম্পাঞ্জি, বনোবো এবং অবশ্যই মানুষ। নীচের ছবিতে বাঁ দিক থেকে পর পর ওরাং উটান, গরিলা এবং বনোবো।

 

নীচের ছবিতে পাশাপাশি শিম্পাঞ্জি ও মানুষ (বর্তমান লেখক ও তার পরিবার)। আমরা পাশাপাশি আছি, কারণ শিম্পাঞ্জি আমাদের নিকটতম আত্মীয়।

 

এতক্ষণ ধরে primateদের বিবর্তন নিয়ে যা কিছু বললাম, তার একটা নির্যাস পরের ছবিতে (এই লিঙ্ক থেকে) আছে।

ছবিতে primate-দের বিবর্তনের ধাপগুলি দেখানো হয়েছে। দেখা যাচ্ছে প্রথমে prosimians বা প্রাক-বানর, তারপর বানরের উদ্ভব হয়েছে। তার পরবর্তি পদক্ষেপ হল apes বা লেজহীন বানর। Ape-দের বিবর্তন বেশ জটিল। আমরা যেটুকু আলোচনা করব, তার জন্য ঐ বিবর্তনের সব কিছু আমাদের বোঝা সম্ভব নয়, বোঝার দরকারও নেই। তবে  Apeদের বিবর্তনের কয়েকটি ধাপের নামকরণ এত কাছাকাছি যে বেশ ধাঁধায় ফেলে দেয়। যেমন Hominoidea, Hominidae, Homininae এবং Hominini। বাঁ দিকের ধাপগুলি পূর্ববর্তি ধাপ, আর ডানদিকের গুলি পরবর্তি ধাপ। অর্থাৎ এই চারটি অন্তর্বর্তি ধাপের প্রথমটি হোমিনয়ডিয়া (Hominoidea), আর শেষটি হোমিনিনি (Hominini)।

বিশেষ করে বোঝার জন্য পরের পাতায় একটা ছবি দিয়েছি। দেখা যাচ্ছে হোমিনয়ডিয়াতে প্রায় সব রকম Apeকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই ধরণের বৃহৎ পরিবারকে বলা হয় অধিপরিবার (superfamily)। এর পরবর্তি স্তরে আছে পরিবার  (family)। হোমোনিডাই (Hominidae) এই ধরণের একটি পরিবার। এতে গিবন বাদে বাকি Apeরা অন্তর্ভুক্ত। এর পর ওরাং উটানকে বাদ দিয়ে আর একটু ছোট উপপরিবার (subfamily) গঠন করা হয়, যার নাম হোমিনিনাই (Homininae)। হোমোনিনাই থেকে উদ্ভূত হয়েছে গরিলা জাতীয় জীব এবং একটু অন্য ধরণের Ape, যাদের বলা হয়েছে হোমিনিনি। উপপরিবার থেকে ছোট এই ধরণের গোষ্ঠীকে বলা হয় বংশ বা tribe। এখান থেকেই  আনুমানিক ৬০ লক্ষ বছর আগে বিবর্তন দুটো আলাদা ধারায় চলে গেছে। এক ধরণের ক্রম বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে বর্তমানের শিম্পাঞ্জি ও বনোবো। আর একটি ধারা থেকে একের পর এক বিবর্তনের ভেতর দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বর্তমানের মানুষ অর্থাৎ আমরা। কাজেই বর্তমানের মানুষ এবং বর্তমানের শিম্পাঞ্জিদের কোন এক সময় একই পূর্বপুরুষ ছিল। সেই পূর্বপুরুষ থেকে ক্রমাগত পরিবর্তনের সাহায্যে যে সব জীব সৃষ্টি হয়েছিল, আজ আর তাদের কেউই জীবিত নেই। সেই অবলুপ্ত জীবগুলিকে দুটি পৃথক গণে (genus) ভাগ করা হয়। শিম্পাঞ্জিদের গণ হল Pan, আর মানুষ বা মানুষের মত জীবদের গণ হল Homo।

বিবর্তনের রকমফের

পরের পাতার অঙ্কন দেখলে বিবর্তন সম্বন্ধে একটা ভুল ধারণা জন্মাতে পারে। মনে হতে পারে যখন আকস্মিকভাবে একটি প্রজাতির জনৈক বংশধর একটি নতুন প্রজাতির জন্ম দেয়, তাকেই বলা হয় বিবর্তন। এরকম আকস্মিক বিবর্তন অবশ্যই ঘটে, কিন্তু প্রধানত জীবের বিবর্তন হয় ধীরগতিতে ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়ে। কখনও বিবর্তনের ফলে একটি প্রজাতি দুই বা ততোধিক প্রজাতিতে বিভক্ত হয়ে যায়। এই ঘটনাকে বলে cladogenesis। কিন্তু বিভক্ত না হয়ে একটি প্রজাতি ধীরগতি ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়ে যদি নতুন প্রজাতির জন্ম দিতে পারে, তাহলে সেই ঘটনাকে বলা হয় anagenesis। পাশের ছবিতে বিষয়টি বোঝানো হয়েছে। বাঁ দিকের ছবিতে দেখানো হয়েছে ধীর ক্রমবিবর্তন। সামান্য পরিমাণগত পার্থক্য (quantitative changes) ক্রমান্বয়ে একত্র হতে হতে এক সময় একটা গুণগত পরিবর্তন (qualitative change) নিয়ে আসে, এক নতুন প্রজাতির জন্ম হয়। একে বলে anagenesis। ডান দিকের ছবিতে দেখানো হচ্ছে একটি প্রজাতি বিভক্ত হয়ে দুটো প্রজাতির সৃষ্টি করেছে। একেই বলা হয় cladogenesis। পরের পাতার ছবিতে দেখানো হয়েছে যে আমাদের কোনও এক পূর্বপুরুষ বিবর্তনের ফলে দু ধরণের আলাদা প্রজাতির সৃষ্টি করেন, একটি থেকে এসেছে বর্তমানের শিম্পাঞ্জি। আরেকটি থেকে এসেছে বর্তমানের মানুষ। এই আকস্মিক বিবর্তনটি cladogenesis। এই ঘটনা ঘটেছিল প্রায় ৬০ লক্ষ বছর আগে। কিন্তু বর্তমান মানুষের জন্ম হয়েছে মাত্র ২ থেকে ৩ লক্ষ বছর আগে। এই দীর্ঘ ৫৭ লক্ষ বছর ধরে যে ধীর পরিবর্তন ঘটেছে, সেটা হল মুখ্যত anagenesis। বর্তমান প্রবন্ধে আমরা এই ৫৭ লক্ষ বছর ধরে কি কি ধরণের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষ এসেছে তার একটা সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করব। হটাত পরিবেশ দ্রুত পরিবর্তিত হলে আকস্মিক বিবর্তন ঘটে। কিন্তু বিবর্তন সাধারণত ধীরে ধীরে হয়। শ্লথগতিতে ক্রমবিবর্তনের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল ঘোড়ার বিবর্তন। পাঁচ কোটি বছর আগে এদের পূর্বপুরুষ eohippus-এর উৎপত্তি। তারপর বিবর্তিত হতে হতে বর্তমান ঘোড়া equus এসেছে আনুমানিক ২ লক্ষ বছর আগে। এই জন্যই বিবর্তনকে  বলা হয় ক্রমশঃ অগ্রগমনশীল (gradualism)।

 

কিন্তু জীবাশ্ম পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে কখনো কখনো দ্রুত নতুন প্রজাতির জন্ম হয়েছে, তারপর যেন বিবর্তন থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। Stephen J. Gould এই ধরণের ঘটনাকে নাম দিয়েছেন বিরাম ভারসাম্য (punctuated equilibrium)।  এই দু ধরণের বিবর্তনের রকমফের বোঝাতে গিয়ে নীচের ছবির অবতারণা করা হয়েছে। পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে গিয়ে প্রজাপতির বিবর্তন খুব তাড়াতাড়ি হয়। পাশের ছবিতে দেখা যাচ্ছে (a) ছবিতে মূল প্রজাপতি থেকে প্রথমে cladogenesis হয়ে দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে। তারপর থেকে দুটি ধারাতেই একে অপরের নিরপেক্ষভাবে anagenesis ঘটছে। দুটি ধারাতেই ধীরগতিতে বিবর্তন এগিয়ে চলেছে। এটি একটি ক্রমশঃ অগ্রমনশীল বিবর্তনের (gradualism) উদাহরণ। এখানে তীর চিহ্ন দিয়ে সময়ের অগ্রগতি বোঝানো হচ্ছে। আবার (b) ছবিতে দেখা যাচ্ছে বেশ আকস্মিক ভাবেই প্রজাতির পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু একবার বিবর্তিত হওয়ার পর অনেক সময় ধরে আর কোনও বিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এটি একটি বিরাম ভারসাম্যের (punctuated equilibrium) উদাহরণ। হোমিনিন থেকে বর্তমান মানুষের সৃষ্টির এই দীর্ঘ যাত্রাপথে বিবর্তন অধিকাংশ সময়েই  ক্রমশঃ অগ্রগমনশীল, কিন্তু কখনও কখনও বিরাম ভারসাম্যের অবতারণা হয়েছে। পরবর্তি অংশে এই বিষয়েই একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে।

হোমিনিন থেকে মানুষ

ডারউইন তার তীক্ষ্ণ মেধার সাহায্যে বুঝেছিলেন যে Ape-দের মধ্যে শিম্পাঞ্জি মানুষের নিকটতম প্রজাতি। তিনি নিঃসন্দেহ ছিলেন যে আফ্রিকা মানুষের উৎপত্তিস্থল। এই কথাগুলি তিনি তার বিখ্যাত বইতে লিখে গেছেন, কিন্তু এই মতবাদের সমর্থনে কোনও প্রমাণ দিয়ে যেতে পারেন নি। এখন বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে যে সব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে ডারউইনের দুটো ধারণাই সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। আর একটি কথা ডারউইনকে ভাবিয়েছিল। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে আজকের পৃথিবীতে অন্তত স্থলভাগ সম্পূর্ণভাবে মানুষের দখলে। এমন কোনও প্রজাতি আজকের দুনিয়ায় নেই যে মানুষকে হটিয়ে দিয়ে পৃথিবীর কর্ত্তৃত্ত্ব দখল করতে পারে। এই ঘটনা কিভাবে ঘটল। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব কোথায়। এ কথা সত্যি নয় যে জীব যত বিশালাকার হয়, সে তত বেশী অন্য প্রজাতিকে দাবিয়ে রাখতে পারে। স্তন্যপায়ীদের আবির্ভাবের প্রথম যুগে (আজ থেকে প্রায় তিন কোটি বছর আগে) এক ধরণের শিংহীন গণ্ডারের উদ্ভব হয় যাদের বৈজ্ঞানিক নাম Paraceratherium। এদের ওজন ছিল পনের হাজার কিলোগ্রামের ওপর। তুলনায় বর্তমানের সব চাইতে বড় হাতীর ওজন ছয় হাজার কিলোগ্রামের বেশী নয়। এদের কাঁধের উচ্চতা ছিল প্রায় ১৬ ফিট। এরা ছিল নিরামিষাশী। কাজেই এরা দাঁড়িয়েই বড় বড় গাছের মগডাল খেতে পারত। কিন্তু জীবনযুদ্ধে এরা বেশীদিন টিকে থাকতে পারেনি। ঠিক তেমনি অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতি এবং হিংস্র sabre tooth tiger ছিল, যারা প্রায় দশ হাজার বছর আগেও পৃথিবীতে ছিল।

 

এদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে সম্ভবত মানুষ। মানুষের কি এমন গুণ আছে যার সাহায্যে সে সব জীবকে হারিয়ে দিয়ে সবার ওপরে চলে এল? মানুষ বিশালাকার নয়, চেহারা ভীতিপ্রদ নয়, তুলনামূলকভাবে অনেক কম শক্তিশালী, অসংখ্য জীবের চাইতে ক্ষিপ্রতায় পিছিয়ে আছে, খুব একটা ঘ্রাণশক্তি বা শ্রবণশক্তি নেই। তাহলে কিভাবে এরা বাঁচার সংগ্রামে জয়ী হল। শিম্পাঞ্জির সাথে এদের মূল পার্থক্য কোথায়? ডারউইন এবং তার সহকর্মীরা দেখলেন শরীরের অনুপাতে মস্তিষ্কের আয়তনে মানুষ অনেক এগিয়ে আছে। খুব সম্ভবত মস্তিষ্কের আয়তন বড় হওয়াই এদের প্রাধান্য পাবার আসল কারণ। হয়ত মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি, চিন্তা করার ক্ষমতা অন্য সমস্ত প্রজাতির উর্দ্ধে একে স্থান দিয়েছে। শিম্পাঞ্জির মস্তিষ্কের আয়তন কম, মানুষের অনেক বেশী। বিবর্তনের নিয়ম অনুসারে হঠাত একদিন কোনও এক প্রজন্মে এই বৃদ্ধি হতে পারে না। এই বৃদ্ধি নিশ্চয়ই ধীরে ধীরে ঘটেছে। তাহলে শিম্পাঞ্জি এবং মানুষের মাঝামাঝি আরও অনেক জীব থাকা দরকার যাদের মস্তিষ্কের অনুপাতও হবে মাঝামাঝি। কিন্তু সেই রকম কোন জীবের সন্ধান পাওয়া গেল না। তাই এদের নাম দেওয়া হল missing link। ডারউইনের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই বিজ্ঞানীরা মিসিং লিঙ্ক-এর সন্ধানে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অনেকেই ভেবেছিলেন এদের সন্ধান পাওয়া যাবে এশিয়ায়। পাওয়াও গেল। জাভা ম্যান, পিকিং ম্যান ইত্যাদি নামগুলি খবরের কাগজে আসতে শুরু করল। কিন্তু শেষ পর্য্যন্ত দেখা গেল মানব প্রজাতির সাদৃশ্য আছে এমন প্রজাতিদের সব চাইতে পুরানো অস্থি আবিষ্কার হতে থাকল আফ্রিকা থেকেই। একটা সম্পূর্ণ নতুন বিজ্ঞানের সূচনা হল, যার নাম প্রত্ননৃতত্ত্ববিজ্ঞান বা paleoanthropology। এই বিভাগের বিজ্ঞানীরা মানুষ কিভাবে সৃষ্টি হল সেই ইতিহাস খুঁজে বেড়ান। তারাই দেখিয়েছেন শিম্পাঞ্জী থেকে বর্তমান মানুষ হঠাৎ তৈরি হয় নি। প্রথমে মানুষের সঙ্গে অনেক সাদৃশ্যপূর্ণ, কিন্তু মানুষ নয় এই ধরণের জীবরা সৃষ্টি হয়েছে। তারাই আবার নানাবিধ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষে পরিবর্তিত হয়েছে। এই বিজ্ঞানীরা মোটামুটি দু ধরণের জিনিষ খোঁজ করতে থাকেন। প্রথম হল প্রাচীন মানুষ বা মনুষ্যপ্রায় জীবদের অস্তিত্বের চিহ্ন সংগ্রহ করা, যেমন কঙ্কালের অবশিষ্টাংশ বা হাড়গোড় বা পায়ের ছাপ। দ্বিতীয় হল ঐ সব জীবদের সাংস্কৃতিক চিহ্ন সংগ্রহ করা, যেমন পাথরের অস্ত্রশস্ত্র বা পাহাড়ের গায়ের ছবি বা এমন সব নক্সা যেগুলি প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি হতেই পারে না। আফ্রিকার তাঞ্জানিয়া, ইথিওপিয়া, কেনিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকাতে মরুভূমি, দুর্গম গুহা বা শুষ্ক গিরিখাতে একের পর এক উদ্ধার হতে শুরু হল আদিম মানুষ বা মানুষ যে সব প্রজাতি থেকে বিবর্তিত হয়ে এসেছিল তাদের সন্ধান। এক বিজ্ঞানী দম্পতি (মেরি ও লুই  লিকি) তাঞ্জানিয়ার ওলডুভাই গিরিখাতে একের পর এক আবিষ্কার করে দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিলেন। নীচে তার একটা সংক্ষিপ্ত সূচী দিলাম। ১৯৫৯ সালে তারা পেলেন মানুষের এক পূর্বসূরির অস্থি। পটাসিয়াম-আর্গন ডেটিং করে জানা গেল এর বয়স ১৮ লক্ষ বছর। ১৯৬৪ সালে তারা তাঞ্জানিয়ায় কিছু অস্থি পেলেন যেগুলি নিঃসন্দেহে মানুষের বেশ নিকটতম পূর্বপুরুষ কোনও প্রজাতির। তারা এর নাম দিলেন  Homo habilis। ইথিওপিয়ায় পাওয়া প্রায় একটা গোটা কঙ্কাল থেকে প্রতিষ্ঠিত হল আমাদের আর এক পূর্বপ্রজাতি, যার নাম দেওয়া হয়েছে Australopithecus afarensis.। ১৯৮৪ সালে লিকি দম্পতির সন্তান রিচার্ড লিকি কেনিয়ায় তুর্কানা হ্রদের পাশে একটি শিশুর সম্পূর্ণ কঙ্কাল আবিষ্কার করেন এবং এই প্রজাতির নাম দেন Homo ergaster

 

সমস্ত বিজ্ঞানীদের সমস্ত আবিষ্কারের তালিকা সুবিশাল দীর্ঘ। এই দীর্ঘ তালিকা থেকে মূল বিষয় বুঝে ওঠা তাই সহজসাধ্য নয়। সারা আফ্রিকা জুড়ে তন্নতন্ন অনুসন্ধান করে বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে প্রত্ননৃতত্ত্ববিদরা তাদের সম্মিলিত গবেষণায় শিম্পাঞ্জি থেকে মানুষের বিবর্তনের একটা মোটা দাগের ইতিহাস সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকার করে নিয়েছেন। সেই ইতিহাসের সারাংশ নীচে দিচ্ছি।

 

আগেই বলেছি প্রায় ৬০ লক্ষ বছর আগে একই পূর্বপুরুষ থেকে দুটি ধারা বিভক্ত হয়ে বিবর্তনের মাধ্যমে এক ধারা থেকে বর্তমান শিম্পাঞ্জি এবং আর এক ধারা থেকে বর্তমান মানুষের উদ্ভব হয়েছে। আদি প্রজাতিগুলির সাথে বর্তমান মানুষের কিছু সাদৃশ্য এবং বেশ কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। সময়ের সাথে সাথে বিবর্তিত নতুন প্রজাতিগুলি, যারা তুলনামূলকভাবে মানুষের অনেক কাছাকাছি, তাদের Homo genus-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিছু পুরাতন অস্থি থেকে একটি প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যায়, যাদের নাম দেওয়া হয়েছে Sahelanthropus। এরা এই বিভাজনের অব্যবহিত পরেই অর্থাৎ প্রায় ৬০ লক্ষ বছর আগেই জন্মেছিল। এদের মস্তিষ্কের আয়তন শিম্পাঞ্জিদের সমান, কিন্তু এরা মেরুদণ্ড সোজা করে বসতে বা হাঁটতে পারত। এইজন্য এদের মানুষের আদি ধারার সাথে সংশ্লিষ্ট বলে ধরা হয়। কিন্তু যেহেতু মস্তিষ্কের আয়তন ছোট, তাই এদের Homo genus-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। এর পরবর্তি যুগে আসে Ardipithecus।  গ্রীক ভাষায় pithecus শব্দের অর্থ Ape। আর আফ্রিকার আফার ভাষায় আর্ডি শব্দের অর্থ হল মাটি। অর্থাৎ এই সব লেজহীন বাঁদররা মাটিতে ঘুরে বেড়াত। কিন্তু ভাল করে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে এদের পায়ের আঙ্গুলগুলি বেশ বড় ছিল। কাজেই এরা অধিকাংশ সময় গাছে চড়ে থাকত। নীচে নেমে এলে দু পায়ে হাঁটতে পারত। যে জীবটির সম্পূর্ণ মাথার খুলি পাওয়া গেছে, তার নাম দেওয়া হয়েছে Ardipithecus ramidus। তার একটি সম্ভাব্য চেহারা বাঁ দিকের ছবিতে দেওয়া হল। এই জীবটি ৪৪ লক্ষ বছর আগে জীবিত ছিল। একই প্রজাতির আর একটি জীবের অস্থির ভগ্নাংশ পাওয়া গেছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে Ardipithecus kadabba। সে প্রায় ৫০ লক্ষ বছর আগে জীবিত ছিল।

Ardipithecus-এর পরবর্তিকালের কিছু কঙ্কাল পাওয়া গেছে। এদের মস্তিষ্কের আয়তন শিম্পাঞ্জির তুলনায় বড়, কিন্তু মানুষের তুলনায় অনেকটাই ছোট। প্রথমে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাওয়া গিয়েছিল বলে এদের নাম দেওয়া হয়েছে Australopithecus। Australo শব্দের অর্থ দক্ষিণ। তার মানে এরা দক্ষিণের Ape। এরা প্রায় ৪০ লক্ষ বছর আগে প্রথম জন্ম নিয়েছিল এবং ২৫ লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীতে টিকে ছিল। অর্থাৎ জীবনযুদ্ধে এরা বেশ সার্থক। এদের অস্থি সর্বপ্রথম পাওয়া যায় ১৯২৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায়। পুরো বিংশ শতাব্দী ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রত্ননৃতত্ত্ববিদরা দক্ষিণ ও পূর্ব আফ্রিকায় Australopithecus-এর কয়েকশ নমুনা সংগ্রহ করতে পেরেছেন। এদের মধ্যে দুটি নমুনা খুব বিখ্যাত। একটির নাম Australopithecus afarensis। ১৯৭৪ সালে Donald Johanson ইথিওপিয়ায় এই কঙ্কালটি পান। পরীক্ষার পর বোঝা গেল এটি একটি ৩২ লক্ষ বছর পুরাতন মেয়ের কঙ্কাল। তিনি এর নাম দেন  Lucy। এই প্রজাতির প্রথম নমুনা দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯২৪ সালে একটু চুনাপাথরের খনিতে আবিষ্কার করেন Raymond Dart। এর নাম দেওয়া হয় Australopithecus africanus। এটি প্রায় ৩৫ লক্ষ বছর আগেকার একটি তিন বছর বয়স্ক শিশুর কঙ্কাল। Australopithecus গণভুক্ত জীবদের শ্রোণী (pelvis) ও পায়ের গড়ন দেখে পরিষ্কার বোঝা যায় যে এরা দু পায়ে হাঁটত। কিন্তু বর্তমান মানুষের তুলনায় এদের হাত এবং হাতপায়ের আঙ্গুলগুলি অনেক লম্বা ও বাঁকা ছিল। বোঝাই যাচ্ছে এরা গাছে উঠতে এবং গাছে বিশ্রাম নিতে পটু ছিল। এরা খুব সম্ভবত মাটিতে ঘুরে ঘুরে খাবার যোগাড় করত এবং রাত্রে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গাছে উঠে থাকত। যেহেতু এরা ঘন জঙ্গল ও সাভানার পরিবেশে থাকত, তাই এই অভ্যাস তাদের খাদ্যসংগ্রহ ও আত্মরক্ষার জন্য খুব কার্য্যকরী ছিল। Dart যখন এই প্রজাতিকে মানুষের পূর্বপুরুষ হিসাবে প্রস্তাব করলেন, তখন বিজ্ঞানী মহলে সোচ্চার প্রতিবাদ হয়েছিল। প্রায় কুড়ি বছর বাদে সবাই অবশ্য তার প্রস্তাব স্বীকার করে নিলেন। Australopithecusরা চেহারায় খুব একটা বড় ছিল না। প্রাপ্তবয়স্কদের ওজন ৩০ থেকে ৪০ কেজি হত। এদের একটি শাখা আকারে বড় হতে শুরু করে এবং অবশেষে একটি নতুন গণের সূচনা করেন, যার নাম Paranthropus। আমরা এদের নিয়ে আলোচনা করব না, কারণ এরা কোনভাবেই আমাদের পূর্বপুরুষ নয়। নীচে একদম বাঁ দিকে Lucyর যে কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিল তার ছবি। তার ডান দিকে আছে Lucyর সম্ভাব্য চেহারা। মনে রাখতে হবে ইনিই কিন্তু আমাদের আদি মাতা। একদম ডান দিকে দেওয়া হল Australopithecus africanus-এর সম্ভাব্য চেহারা।

পরবর্তি সময়ে পৃথিবীতে আবির্ভুত হল আমাদের নিজস্ব গণ অর্থাৎ Homo গণের প্রজাতি। এরা  Australopithecus থেকে বিবর্তিত হয়ে জন্মেছে। সম্ভবত একটা cladogenesis ঘটেছিল।  Australopithecus বিভক্ত হয়ে দুটি শাখার সৃষ্টি করে। একটি Paranthropus এবং অপরটি Homo। প্রায় ২৩ লক্ষ বছর আগে সৃষ্ট হয় Homo habilis।  Homo শব্দের অর্থ মানুষ। কেন এই জীবগুলিকে মানুষের সমগোত্র হিসাবে ধরা হল, কিন্তু  Australopithecusকে ধরা হয় নি তার কারণগুলি বলা দরকার। মানুষের সমগোত্র হতে হলে তাদের দ্বিপদী (bipedal) হতেই হবে। তার সাথে আরও কিছু গুণ থাকা দরকার। যেমন এরা প্রায় সব সময় দু পায়ে হাঁটবে, আত্মরক্ষার জন্য গাছের ওপর নির্ভর না করে মাটিতেই নিজেদের আশ্রয়স্থল খুঁজে নেবে। অস্থিগুলির হাত পায়ের গড়ন এবং আঙ্গুলের দৈর্ঘ্য ইত্যাদি দেখে বলা যায় যে এরা সব সময় মাটিতে থাকত না রাত্রে গাছে আশ্রয় নিত। Homo habilis  থেকেও মানুষের আরও কাছাকাছি জীব পরবর্তি বিবর্তনে সৃষ্ট হল। ১৮ লক্ষ বছর আগে জন্মায় Homo erectus অর্থাৎ যারা সোজা হয়ে হাঁটতে পারে। আজ থেকে এক লক্ষ বছর আগেও এই প্রজাতির জীব পৃথিবীতে ছিল। এদের দৃষ্টিশক্তি প্রখরত্বর হল। এদের মস্তিষ্কের আয়তন অনেকটা বেরে গেল। নীচের ছবিটা দেখলে বোঝা যাবে Homo genus-এর কি কি বিশেষত্ব ছিল। এই ছবিটা Herman Pontzer-এর লেখা Overview of Hominin Evolution নামক প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে।

করোটিগুলির দিকে লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে যে মাথার খুলি বিবর্তনের সাথে সাথে ক্রমান্বয়ে বড় হয়েছে। ফলে মস্তিষ্কের আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছে। কতটা বেড়েছে তার একটা পরিমাণ ছবির আকারে দেওয়া আছে। পরের কথা হল এরা কি রকম ভাবে হাঁটত। দেখা যাচ্ছে বিবর্তনের ফলে দু পায়ে হাঁটার পরিমাণ বেড়ে গেছে এবং চার পায়ে হাঁটার অভ্যাস তারা পরিত্যাগ করেছে। এরপর দেখতে হয় দাঁত। এখান থেকেই তাদের খাদ্যাভ্যাস সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। দেখা যাচ্ছে তাদের শ্বদন্ত (canine tooth) অনেক হ্রাস পেয়েছে। আর পেষণ দন্ত বা মাড়ির দাঁত (molar tooth) আকারে ছোট হয়ে গেছে। এর অর্থ বিবর্তনের সাথে সাথে তারা শক্ত কঠিন খাবারের বদলে নরম খাবারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। যেমন ফল মূল বা মাংস ইত্যাদি। গাছে আশ্রয় নেবার অভ্যাসও তারা ধীরে ধীরে ছেড়ে দিয়েছে। Homo habilis-এর হাড়গোড়ের পাশে পাথরের অস্ত্র এবং জীবজন্তুর হাড়গোড় পাওয়া গেছে। হাতের আঙ্গুলের সাহায্যে যন্ত্র তৈরি করা মানুষের এক বিশেষ উদ্ভাবন।

Homo erectus থেকে জন্ম নেয় এমন প্রজাতি যারা প্রায় মানুষের মত, কিন্তু তবুও তাদের আধুনিক মানুষের সাথে  বেশ কিছু পার্থক্য আছে। সেই সব প্রজাতিকে বলা হয় Homo sapiens। এদের মধ্যে আছে Homo Heidelbergensis, যারা অস্ত্র ব্যবহার করে গোষ্ঠিবদ্ধ ভাবে শিকার করা শিখেছিল। তার থেকেও বড় কথা এরা আগুণের ব্যবহার করা শুরু করল। চার লক্ষ বছর আগে এরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আর একটি গোষ্ঠী ছিল H. neanderthalensis। এদের মস্তিষ্ক বর্তমান মানুষদের মস্তিষ্কের প্রায় সমান ছিল। এরাও গোষ্ঠিবদ্ধ ছিল। গুহায় থাকত এবং গুহা চিত্রও আঁকতে পারত। বর্তমান মানুষের পূর্বপুরুষরা যাদের অনেক সময় বিশেষভাবে চিহ্নিত করার জন্য বলা হয় Homo sapiens sapiens,  তারা এসেছে প্রায় ২ লক্ষ বছর আগে। এছাড়া আরও কিছু গোষ্ঠী ছিল যেমন Homo Denisovians। আমাদের পূর্বপুরুষদের সাথে এই সব গোষ্ঠীর সাক্ষাত হয়েছিল, তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। এই গোষ্ঠীগুলি আলাদা প্রজাতি ছিল না। তাই এক গোষ্ঠীর ছেলে অপর গোষ্ঠীর মেয়ের সাথে সহবাস করতে পারত। তার প্রমাণ আমরা আমাদের জিনে বহন করি। মানুষের অতীত সম্বন্ধে এই প্রবন্ধে বললাম। মানুষের ভবিষ্যৎ কি? তারা এর পর কি ধরণের জীবে বিবর্তিত হবে। এই সম্বন্ধেও বিজ্ঞানীরা অনেক গবেষণা করেছেন। কিন্তু আপাতত এখানেই প্রবন্ধের ইতি করি। নীচের ছবিতে বাঁ দিক থেকে ডান দিকে পরপর আছে প্রথম লাইনে হোমো হ্যাবিলিস, হোমো ইরেক্টাস। আর দ্বিতীয় লাইনে আছে হোমো নিয়ান্ডারথাল, হোমো ডেনিসোভান।