তথ্যচিত্রের ইতিহাস : আদি পর্ব

ফ্রান্সের চলচ্চিত্রের আবিষ্কারের ঢেউ আরব সাগরে ফেললেও সেই ঢেউ বঙ্গোপসাগরের তীরে এসে পড়ল। ভারতীয় চলচ্চিত্রে বঙ্গসন্তান হীরালাল সেনের নাম যুক্ত হল। শুরু হল এক নতুন ইতিহাস।

 বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির এক অনবদ্য সৃষ্টি হল চলমান চিত্র অর্থাৎ চলচ্চিত্র। এই চলমান চিত্র প্রথমে তথ্যচিত্র (Documentary film) হিসাবেই দৃশ্যমান হয়। বাস্তব ঘটনা নির্ভর, তথ্য সমৃদ্ধ চলচ্চিত্রই তথ্যচিত্র। এখানে কল্পনার কোনও স্থান নেই। বাস্তবের প্রত্যক্ষ রূপ তুলে ধরা তথ্যচিত্রের কাজ। যদিও কল্পিত-কাহিনী ভিত্তিক চলচ্চিত্র(কাহিনী চিত্র)গুলি দর্শকের কাছে বেশি প্রিয়, ফলে সিনেমার ব্যবসা সারা পৃথিবীতে রমরমিয়ে চলছে, তবুও তথ্যচিত্র বাস্তব ঘটনার প্রামান্য-দলিল হিসেবে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। সামাজিক, রাজনেতিক ইতিহাসের সাক্ষ্য-প্রমান বহন করে চলেছে এই তথ্যচিত্র। তথ্যচিত্র বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ভর করে হয়ে থাকে, যেমন-প্রামাণিক, প্রাসঙ্গিক, অবস্থাণগত, তথ্যমূলক, জীবনীকেন্দ্রিক, ব্যক্তিগত, ভ্রমণমূলক প্রভৃতি। ফ্রান্সের লুমিয়ের ব্রাদার্স বিশেষ ‘মুভি’ ক্যামেরা তৈ্রি করার পর বেশ কিছু বাস্তব জীবনের সাধারণ ঘটনার ছবি তুলেছিলেন। ছবি গুলি সেই যুগের বাস্তব জীবনের নানা ঘটনার সাক্ষ্য বহন করে। প্রথম ‘মুভি’ ক্যামেরা তৈরির সঙ্গে সঙ্গে প্রথম তথ্যচিত্রও তৈরি হয়েছিল। তথ্যচিত্র নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সেই একশো পঁচিশ বছর আগের দিনগুলি ফিরে দেখতে হয়। 
গ্রিক ‘কিনেমা’(kinema) শব্দটি থেকে ‘সিনেমা’ (Cinema) শব্দটি এসেছে, যার অর্থ হল ‘গতি’। ‘মুভি’ ক্যামেরা আবিষ্কারের পর প্রথম ‘চলমান ছবি’ বা ‘সিনেমা’(Cinema)তৈরি করেন ফ্রান্সের লুমিয়ের ব্রাদার্স। সেই কারণে ‘সিনেমা’র উদ্গাতা হিসেবে ফ্রান্সের লুমিয়ের ভাতৃদ্বয় –অগস্ত মারি লুই নিকোলা লুমিয়ের (19th october 1862-10th april 1954) ও লুই জঁ লুমিয়ের (5th october1864- 7th june1948) এর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। তাঁদের পিতা শার্ল আতোয়ান লুমিয়ের-এর ‘বঁজাঁশ’ শহরে ছোট আলোকচিত্র পোর্টেট স্টুডিও ছিল। পরে তিনি ফ্রান্সের ‘লিওঁ’ শহরে এসে আলোকচিত্রের প্লেট তৈ্রির ফ্যাক্টরি স্থাপন করেন। প্রথম দিকে ফ্যাক্টরি ভালো চললেও পরের দিকে দেওলিয়া হয়ে যেতে বসে। রুগ্ন ফ্যাক্টারিকে পুনর্জ্জীবিত করার জন্য তাঁদের এক বোন সহ দুই ভাই অক্লান্ত পরিশ্রম করেন এবং সফলও হন। এর পর দুই ভাই মিলে ‘এতিকেট ব্লো’ এর নকশা তৈরি করেন। সেলাই মেশিনের প্রেশার পিনের সাহায্যে প্রতি সেকেন্ডে ষোল ফ্রেম একটি শাটারের মধ্যে দিয়ে চলে যাবে এমন ৩৫ মিলিমিটার প্রশস্ত ছায়াছবি সহ সিনেমাটোগ্রাফির আধুনিক স্ট্যান্ডার্ড ফিল্মের স্পেসিফিকেশন স্থাপন করেন। তাঁরা একটি শান্ত ও হাল্কা যন্ত্র তৈ্রি করেন। 1888খ্রি: টমাস আলফা এডিশন ও ডব্লিও কে এল ডিক্সন ‘কাইনোটোস্কপ’ আবিষ্কার করলেও তা দিয়ে এক জনের বেশি ছবি দেখতে পারত না। লুমিয়ের ব্রাদারের তোলা ছবি একাধিক ব্যক্তি একসঙ্গে দেখতে পারত। এরপর 1894খ্রিঃ থেকে তাঁদের ফ্যাক্টরিতে কর্মী নিয়োগ করা হয়। ফটোগ্রাফির যন্ত্রপাতি তৈরির ফাক্টরি ফুলেফেঁপে উঠে, ধীরে ধীরে তাঁদের ফ্যাক্টরি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফটোগ্রাফির যন্ত্র তৈরির ফ্যাক্টরি হয়ে উঠে। আমেরিকার জর্জ ইস্টম্যানের ‘কোডাক’ কম্পানি ছিল তখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফটোগ্রাফির যন্ত্র তৈরির কম্পানি। ফরাসি ‘লুমিয়ের’ ভাতৃদ্বয় প্রথম সিনেমার শুটিং করেন 1894খ্রিঃএর গ্রীষ্মো কালে। 1894খ্রিঃ মুভি ক্যামেরা দিয়ে লুমিয়ের ব্রাদার্স তাঁদের ফাক্টরির শ্র্মিকদের ছবি তোলেন। নাম দেন ‘Workers Leaving the Lumiere Factory’, এটি তাঁদের তোলা প্রথম ছবি। 22শে মার্চ 1895খ্রি: প্যারিসের একটি কারখানায় কয়েকজন আমন্ত্রিত অতিথির সামনে প্রথম প্রদর্শিত হয় ছবিটি। এই ছবিতে দেখা গেছে শ্রমিকরা ফাক্টরি থেকে বের হচ্ছে, একটি কুকুর ও একটি বাইসাইকেলও দেখা যাচ্ছে। শ্রমিকদের বেশির ভাগ ছিলেন নারী। ছবিটি 35 এম এম ফরম্যাটে, 17 মিটার দৈর্ঘ্য, 46 সেকেন্ড সময়ের ছিল। তাঁরা 1894খ্রিঃ থেকে 1895খ্রিঃ এর মধ্যে প্রায় 40 টি ছবি তোলেন, সেগুলো বেশিরভাগই এক্ মিনিটের কম সময়ের ছবি। এর মধ্যে ‘The arrival of a train at La Ciotat Station’ ছবিটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। ছবিটিতে প্ল্যাটফর্মে ট্রেন আসা, ট্রেন থেমে যাবার পর যাত্রীদের ওঠানামা্‌, দলবদ্ধ ভাবে হাঁটাচলা করতে দেখা যায়। কথিত আছে,‘The arrival of a train at La Ciotat Station’ ছবি্টি দেখে দর্শক ট্রেন চাপা পড়বে ভেবে ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। দর্শক মুগ্ধও হয়েছিল। বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে লুমিয়ের ভাতৃদ্বয়ের এই প্রচেষ্টা নিঃসন্দহে প্রশংসনীয়। তাঁরাই প্রথম সিনেমার শুটিং ও প্রদর্শনের কৃতিত্ব অর্জন করেন।
 লুমিয়ের ব্রাদার্সের নির্মিত ছবি 1895 খ্রিস্টাব্দের 28 ডিসেম্বর ফ্রান্সের প্যারিস শহরের বুলেভার্ডের গ্র্যান্ড ক্যাফে হোটেলে প্রথম প্রদর্শিত হয়। এই দিন কিছু আমন্ত্রিত আতিথি থাকলেও সাধারণ দর্শক দের জন্য টিকিট কেটে ছবি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। এই দিনটিকে চলচিত্র প্রদর্শনের প্রথম দিন হিসাবে ধরা হয়, এবং সমগ্র বিশ্বে চলচ্চিত্রের জন্মদাতা রূপে তাঁদের নাম সর্বাগ্রে আলোচিত হয়। লুমিয়র ভাতৃদ্বয় পাঁচ- দশ মিনিটের প্রায় হাজার খানেক (1425) ছবি নির্মাণ করেন। তাঁদের ছবির প্রেক্ষাপটে ফুটে উঠেছিল কখনও স্পেনের ষাঁড়ের লড়াই এর চিত্র, কখনও স্টেশনে ট্রেন এসে থামার চিত্র, ঘোড়া ছোটার চিত্র, সামরিক বাহিনীর চলাফেরা কখনও কারখানার শ্রমিকদের উদয়াস্ত পরিশ্রমের চিত্র। প্যারিসের হোটেলে ওঁদের মোট দশটি ছবি প্রদর্শিত হয় ( অনেকের মতে মোট কুড়িটি ছবি প্রদর্শিত হয় )। এই ছবিগুলি বেশির ভাগই 40 থেকে 50 সেকেন্ডের ছবি ছিল অর্থাৎ film strip বা টুকরো ছবি। ছবিগুলি সাদা কালো ছিল, এবং এখনকার মত সবাক নয়, নির্বাক চিত্র ছিল। প্রত্যেকটা ছবি সতেরো মিটার লম্বা। সেদিন যে ছবিগুলি প্রদর্শিত হয়েছিল সেগুলি হল-
1. ‘Workers Leaving the Lumiere Factory’(46 second)
2.‘The decemborkment of the congress of photographer in Lyon’(48 second)
3.‘Horse trick Riders’(46 second)
4.‘Finishing for Goldfish’(42second)
5.‘Blacksmith’ (49 second)
6.‘Baby’s meal’ (41second)
7.‘Jumping on to the Blanket’(41second)
8.‘Cordeliers square in Lyon’(44second)
9.‘The Sea’(38second)।
10.The Gardener(49 second)।
এই সময় সিনেমা সম্পর্কে ‘লুই’য়ের ধারণা হয়েছিল, ‘The Cinema is an invention without a future.’। তাঁর এই ধারণা যে ভুল ছিল, তা প্রমানিত হয় তাঁর বা তাঁদের জীবদ্দাশাতেই। চলমান চিত্র আবিষ্কারের খবর ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়ে আমেরিকা, ইংল্যান্ড সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে- দর্শক দেখে চলমান ছবি, ব্যবসায়ী দেখে লাভের সম্ভাবনা, রাষ্ট্র দেখে জনমত তৈরির হাতিয়ার। সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়ল ব্যবসায়ীরা, শুরু হল রাপ্তানি। কয়েক মাসের মধ্যে চলমান ছবি চলে আসে ভারতে। 1896 খ্রিস্টাব্দে 7 জুলাই লুমিয়ন ভাতৃদ্বয় - এর প্রতিনিধি মরিস সেস্টিয়ার বোম্বাইয়ের (বর্তমান মুম্বাই ) ওয়াটসন হোটেলে তাঁদের সিনেমা প্রদর্শন করেন। সদ্য আবিষ্কৃত মাধ্যম দেখে মুগ্ধ হয় ভারতের ব্রিটিশ শাসক, মুগ্ধ হয় আভিজাত সম্প্রদায়। জীবনের অন্তিম পর্ব পর্যন্ত লুমিয়ের ব্রাদার্স চলচ্চিত্র শিল্প সম্পর্কে তাঁদের বিভিন্ন ভাবনার প্রকাশ ঘটাতে থাকেন। তাঁদের সেই ভাবনা- চিন্তার বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ ‘লুই’ লুমিয়ের চলচ্চিত্রকে বাণিজ্য ও মজার খেলার অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন - ‘It can be used in educationalpurpose also’। মূলত তাদের এই ভাবনাচিন্তা পরবর্তীকালে চলচ্চিত্রের নবরূপে বিশেষভাবে সহায়তা করেছে। সর্বোপরি বাস্তবধর্মী ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে তাঁরা সর্বাগ্রে স্মরণীয়।
উনবিংশ শতাব্দির শেষে বিজ্ঞানের আশ্চর্য আবিষ্কারকে ব্রিটিশ সরকার কাজে লাগাতে চায়। দেশি, বিদেশি ব্যবসাদাররাও এগিয়ে আসে লাভের আশায়। ভারতের বোম্বে, কলকাতার মত বড় শহরে চলচিত্র গুলি দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। ভারতে নির্বাক চলচিত্রের সূচনা হয়। বোম্বের ভাত ওয়াদেকর ওই বছরেই একুশ গিনি দাম দিয়ে কিনে আনেন মুভি ক্যামেরা। তৈ্রি করেন ‘পুনারেস’ ও ‘ট্রেন আরাইভিং এট বোম্বে স্টেশন’। থিয়েটার গুলোতে সিনেমা দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। থিয়েটার শুরুর আগে ও শেষ হবার পরে স্বল্প দৈর্ঘের সিনেমা গুলি দেখানো হতে থাকে। বিদেশে জন্ম নেওয়া সিনেমাকে নিজেদের সম্পদ বলে মনে করত ইংরেজরা। ব্যবসায়িক বুদ্ধি সম্পন্ন ইংরেজরা এবং বিদেশি ব্যবসাদাররা প্রথমে থিয়েটার মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করে। বিদেশি কম্পানির হাত ধরে এভাবেই ভারত তথা বাংলাদেশে এসে পৌঁছায় চলচ্চিত্র বা বায়স্কোপ।
 ফ্রান্সের চলচ্চিত্রের আবিষ্কারের ঢেউ আরব সাগরে ফেললেও সেই ঢেউ বঙ্গোপসাগরের তীরে এসে পড়ে। বঙ্গসন্তান হীরালাল সেনের নাম যুক্ত হয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে। বর্তমানে বাংলাদেশের ঢাকা শহরে বাইশ -তেইশ বছরের যুবক হীরালাল সেন স্টিফেন সাহেবের সান্নিধ্যে আসেন। তিনি অধুনা বাংলা দেশের বগজুরির মানিকগঞ্জের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান।  1879 খ্রিঃএ মাইনর পরীক্ষা পাস করে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে  ভর্ত্তি হন। পরে পিতার সঙ্গে  হীরালাল কলকাতার কলেজে ভর্ত্তি হন। আই.এস.সি.পড়ার সময়  চলচ্চিত্রের প্রতি ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়লে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা  বন্ধ হয়ে  যায়। হীরালাল সেনের আদি বাড়ি  বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ জেলায় বগজুরিতে (ঢাকা থেকে প্রায় আশি কি.মি. দূরে) হলেও তাঁর শৈশব কাটে কলকাতায়। প্যারিসের 'পাথে ফ্রেরেস স্টুডিও'র সদস্য, অধ্যপক স্টিভেনসনের একটি নাতিদীর্ঘ ছবি কলকাতার স্টার থিয়েটারে দেখানো হয়’ দ্য ফ্লাওয়ার অফ পারসিয়া’(পারস্যের ফুল)নামে একটি অপেরার সঙ্গে। স্টিভেনসনের ক্যামেরা ধার নিয়ে হীরালাল বানান তাঁর প্রথম ছবি,’এ ডান্সিঙ সিন ফ্রম দ্য অপেরা,দ্য ফ্লাওয়ার অফ পারসিয়া’ ওই অপেরার একটি নাচের দৃশ্য নিয়ে তৈরি। এই সময় তিনি ইংরাজি ও ফরাসি ভাষা শিখেছিলেন। ভাই মতিলাল সেনের সাহায্যে লন্ডনের ‘ওয়ারউইক ট্রেডিং কম্পানী’র চার্লস আরবানের কাছ থেকে তিনি একটি 'আরবান বায়োস্কোপ' কিনে নেন। ঐবছর(1898 খ্রিঃ)তিনি ভাই মতিলালের সহযোগিতায়  ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ কোম্পানি তথা প্রযোজনা সংস্থা ‘রয়্যাল  বায়োস্কোপ কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানির সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির উদ্যোগে একের পর এক চলচ্চিত্র ব্যবসার বিভিন্ন কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠান  গড়ে উঠতে শুরু করে। তখনকার বিভিন্ন খবরের কাগজের নিত্য নৈমিত্তিক বিজ্ঞাপন অনুযায়ী কলকাতায় তখন রয়েল বায়োস্কোপ কোম্পানির দেখাদেখি তেইশটি ঘোষিত কোম্পানি গড়ে উঠেছিল। হীরালাল সেন স্টিফেন সাহেবের সান্নিধ্য এসে নতুন দিগন্তের হাতছানি দেখতে পান। স্টিফেন সাহেবের কাছ থেকে সিনেমার নানা কৃৎকৌশলও শিখে নেন। বহু কষ্টে অর্থ সংগ্রহ করে মার্কিন বয়োস্কোপ কম্পানির কাছ থেকে ক্যামেরা, প্রোজেক্টর, স্ক্রিন, ফিল্ম, ও চলচ্চিত্র নির্মাণের যাবতীয় যন্ত্রাদি কিনে আনেন। হীরালাল সেন বিশেষ কৌশলে অক্সিজেন গ্যাস রবারের ব্যাগে ভরে ময়দানে আলোক সহযোগে ছবির প্রদর্শন করেন। পরবর্তীতে এই ব্যাগের বদলে স্টিলের ট্রাঙ্ক ব্যবহার করেন। বিশ্বের তিনিই প্রথম আর্কল্যাম্প প্রোজেক্টর সাহায্যে গ্রামে গঞ্জে ছবি দেখানোর ব্যবস্থা করেন। ওই সময় ‘বোর্ন আন্ড শেফারড’ কম্পানির ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতা হত। সেখানে হীরালালের তোলা ছবি প্রথম স্থান আধিকার করে। কিন্তু চিত্র গ্রাহকের নাম দেখে সাহেবরা বিশ্বাস করেনি যে কোনও ভারতীয় এই ছবি তুলতে পারে। কারণ ইউরোপে জন্ম নেওয়া এই শিল্পকে ইংরেজ রা নিজেদের সংস্কৃতি বলে মনে করত হীরালালকে ওই ছবিটি আবার সাহেবের সামনে তুলে প্রমান করতে হয়েছিল যে, ভারতীয়রাও এমন শৈল্পিক গুন সম্পন্ন ছবি তুলতে পারে। মুভি ক্যামেরা তিনি কিছু টুকরো টুকরো ছবি তুলেছিলেন, কলকাতার রাস্তার ছবি, গঙ্গার ঘাটে সূর্যাস্তের ছবি, গ্রামের বাড়ির পুকুর ঘাটে লোকেদের স্নানের দৃশ্যের ছবি  তুলেছিলেন।
 
 1900খ্রিঃএর শুরুতে ক্ল্যাসিক থিয়েটারের নটরাজ অমরেন্দ্র নাথ দত্তের সঙ্গে আলাপ হয় হিরালালের। অমরেন্দ্র নাথের মঞ্চসফল ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’ নাটকটির কিছু অংশ তিনি ক্যামেরা বন্দি করে তাঁকে দেখান। এর পর বেশ কিছু নাট্যাংশ ক্যামেরা বন্দি করেন, যেমন-সরলা, সীতারাম, ভ্রমর প্রভৃতি। অমরেন্দ্র নাথের সঙ্গে চুক্তি করে ওদের থিয়েটারের মাঝে সিনেমা প্রদর্শন শুরু করেন।
 হীরালাল সেন এই নাটক গুলির টুকরো টুকরো অংশ নিয়ে একটি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের (দু ঘণ্টা) সিনেমা তৈরি করেন। 1903খ্রিঃ এ ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’ নাটকটির সমগ্র কাহিনী  চলচ্চিত্রায়িত হয়। জানা যায় 1903 সালে নির্মিত ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’(মুক্তির তারিখ 23 জানুয়ারি1903)চলচ্চিত্রটি বিশ্বে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনী ভিত্তিক চলচ্চিত্র। কারণ চলচ্চিত্রকার এডউইন এস পোর্টার-নির্মিত ‘গ্রেট ট্রেন রোবারি’(মুক্তির তারিখ 1 লা ডিসেম্বর 1903)পৃথিবীর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনী ভিত্তিক চলচ্চিত্র হিসেবে স্বীকৃত হলেও, তার দৈর্ঘ্য মাত্র বারো মিনিট দশ সেকেন্ড। অন্য দিকে তাঁর আগেই হীরালাল সেন দুই ঘণ্টা দৈর্ঘ্যের, ‘আলিবাবা’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন এবং সারা বাংলা ও ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে তা প্রদর্শন করেন। শুধু ভারতবর্ষেই নয়, বহির্বিশ্বেও জনপ্রিয়তা লাভ করে এই চলচ্চিত্রটি।
 এরপর তিনি বিজ্ঞাপনের  জন্য কয়েকটি ছবি বানিয়েছিলেন, সেগুলি হল সি কে সেনের ‘জবাকুসুম হেয়ার ওয়েল’ বটকেষ্টো পালের ‘এডওয়ার্ড টনিক’ ডব্লিউ মেজর কম্পানির,’সালসা পিলা’ র বিজ্ঞাপন। 
 তিনি  দুটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। প্রথমটি বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশি আন্দোলনের ওপর তথ্যচিত্র ‘The Grand Patriotic film’, দ্বিতীয়টি পঞ্চম জর্জের দিল্লির দরবারে ‘বঙ্গভঙ্গ রদ’ ঘোষণা ও সম্রাট পঞ্চম জর্জের সস্ত্রীক কলকাতায় আগমনের ওপর ছবি ‘The Visit film’। তদানীন্তন সময়ে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে জনমত গড়তে এই তথ্যচিত্র খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। হীরালালের তিন ঘন্টা দৈর্ঘের তথ্যচিত্র ‘The Grand Patriotic film’( পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের ভাষায় এর নাম, ‘Anti-partition Demonstrationand Swadeshi movement atthe Town Hall,Calcutta on 22nd September)ভারতের প্রথম রাজনৈতিক তথ্যচিত্র। বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার পর সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বঙ্গভঙ্গ বিরধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কলকাতা টাউনহলে অনুষ্ঠিত হয় পাঁচটি বিশাল প্রতিবাদে মহাসমাবেশ, শোভাযাত্রা ও মিছিল। 1905 খ্রিঃ 7ই আগস্ট টউনহলে অনুষ্ঠিত সভায় বিদেশি দ্রব্য বর্জনের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর 22শে সেপ্টেম্বর (1905খ্রিঃ)কলিকাতা টাউন হল-এ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ঐতিহাসিক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় এই সভার সভাপতিত্ব করেন। বিশাল সমাবেশ কলেজ ষ্কোয়ার, গোলদিঘিতেও ছড়িয়ে পড়ে। এই অনুষ্ঠান, মিছিল ও শোভাযাত্রার ছবি তোলেন হীরালাল। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 16ই অক্টোবর (1905)‘রাখি বন্ধনে’র ডাক দেন। সেই সঙ্গে মহামিলনের আকাঙ্ক্ষায় রচনা করেন এক মহাসঙ্গীত–‘বাংলার মাটি বাংলার জল’। এই সময় তিনি রবীন্দ্রনাথের রাখীবন্ধনের দৃশ্য ক্যামেরা বন্দি করেন। অমৃত বাজার পত্রিকা আনুযায়ী 1905খ্রিঃএ এই ছবির বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, ‘আমাদের নিজেদের স্বার্থে খাঁটি স্বাদেশি সিনেমা’। ছবির শেষে গাওয়া হয়েছিল ‘বন্দেমাতরম’ গান। হীরালাল সেন প্রথম চলচ্চিত্রকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেন। তৈ্রি করেন তথ্যচিত্রের ইতিহাস
 1911খ্রী:এ দিল্লির দরবারে ভারতের বরলাট লর্ড হার্ডিঞ্জ, সাম্রাট পঞ্চম জর্জের মুখ দিয়ে ‘বঙ্গভঙ্গ রদ’ ঘোষণা করিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে ঘোষিত হয়েছিল কলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লি সরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত, আসামকে বিচ্ছিন্ন করা এবং বঙ্গপ্রদেশ থেকে বিহার ও উড়িষ্যাকে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত – এ সব হীরালাল অসুস্থ শরীরে ক্যামেরা বন্দি করেন তিনি। ততদিনে তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত। দিল্লির দরবার সহ ‘ভিজিট ফিল্ম’এ পঞ্চম জর্জের সস্ত্রীক কলকাতা আগমনের চিত্রও ক্যামেরা বন্দি করেন। মিনার্ভা থিয়েটারে 1912খ্রিঃ 5ই জানুয়ারি ‘ভিজিট ফিল্মে’র আংশিক ছবি (দিল্লির দরবারের অংশটুকু)মুক্তি পায়। ছবিটি 5ই আর 6ই জানুয়ারি দুদিন দেখানোর পর নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। 
 
সেন ভাতৃদ্বয়ের ‘রয়েল বায়োস্কোপ কম্পানি’র সাফল্য দীর্ঘস্থায়ী হইনি। হীরালাল সেন অত্যন্ত অমিতব্যয়ী হওয়ায় এবং থিয়েটারের অভিনেত্রী কুসুমকুমারী দেবীর সঙ্গে বিবাহিত হীরালালের প্রনয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠায় ভাই মতিলালের সঙ্গে বিরোধ বাধে। হীরালালের বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার এবং সৃজনশীলতা্র কারণে কলকাতার আভিজাত সমাজে যাতায়াত ছিল। এক অনুষ্ঠানের মাঝে প্রকাশ্যে টাকা খরচের কৈফিয়ত চাওয়ায় মতিলালকে চড় মারেন হীরালাল। এরপর দুই ভাই আলাদা হয়ে ব্যবসা ভাগ করে নেয়। কিন্তু কেও ব্যাবসা ভালো চালাতে পারেননি। কারণ হীরালালের ছিলনা ব্যবসায়িক বুদ্ধি, আর মতিলালের ছিলনা সৃজনশীলতা। শেষ পর্যন্ত 1913খ্রিঃ নাগাদ ‘রয়্যাল বায়োস্কোপ কম্পানি’ বন্ধ হয়ে যায়। মতিলাল হীরালালের তোলা সমস্ত ছবি নিয়ে নেন আর হীরালাল ছবি তোলার যন্ত্রপাতি কাছে রাখেন- কম্পানির সম্পত্তি এই ভাবে ভাগ হয়। পরবর্তীতে মতিলালের বাড়িতে আগুন লাগলে হীরালালের সব ছবি আগুনে পুড়ে যায়( 27শে 1917খ্রিঃ)। হীরালাল সেন আগে থেকেই ক্যান্সারে ভুগছিলেন। ছবি পুড়ে যাবার দুদিন পরে হীরালাল সেন মারা যান(29 অক্টবর1917খ্রিঃ)। কয়েকটা হ্যান্ডবিল আর কাগজের বিজ্ঞাপন ছাড়া হীরালালের ছবির কোনও প্রমান নেই। তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্র ‘দ্য ডান্সিঙ সিন ফ্রম দ্য অপেরা, দ্য ফ্লাওয়ার অফ পারসিয়া’(1898)তে ছিল থিয়েটারের একটি নাচের দৃশ্য। তৎকালীন সমাজে থিয়েটার ও নাচের দৃশ্যের তথ্য-প্রমাণটাও  ইতিহাস থেকে মুছে যায়। সেদিক থেকে বিচার করলে সেটি ছিল তাঁর প্রথম তথ্যচিত্র। তবে সাক্ষ্য প্রমান না থাকায় এ নিয়ে অনেক মতভেদ রয়ে গেছে। 
 হীরালাল সেন পৃথিবীর সেই প্রথম চলচ্চিত্রকার, যিনি চলচ্চিত্রকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেন এবং ছবি নির্মাণের কারণে রাজরোষে  পড়েছিলেন। তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্র বিশ্ব চলচ্চিত্র ইতিহাসে প্রথম রাজনৈতিক কারণে নিষিদ্ধ হয়। অসুস্থ শরীর আর চরম আর্থিক সংকটের কারণে পারসি ব্যবসায়ী ম্যাডনকে ছবিটি(ভিজিট ফিল্ম)বিক্রি করে দেন। ম্যাডন সেটি কিনে নিজের নামে প্রচার করেন। বাংলায় ম্যাডনও চলচ্চিত্রের ব্যবসা শুরু করেন। এরপর শুরু হয় ম্যাডন থিয়েটারের যুগ। তবে তথ্যচিত্রের জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়।
1914খ্রিঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন স্তিমিত হয়। ভারতের ব্রিটিশ সরকার মিত্রশক্তিকে সহযোগিতা করার জন্য ভারতবাসীর সমর্থন প্রয়োজন মনে করে। ব্রিটিশ সরকারের তৎপরতায় বিদেশি ব্যবসায়িরা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় স্বল্প দৈরঘ্যের ছবি দেখাতে শুরু করে। থিয়েটারের মাঝে সেনা বাহিনী নিয়োগের ছবি, ট্রেনিংএর ছবি প্রদর্শিত হয়।  এছাড়া কূটনৈতিক বুদ্ধি প্রয়োগ করে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বদের সমর্থন আদায় করতে সমর্থ হয়। ভারত থেকে প্রায় 12 লক্ষ ভারিতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। ভারত হয়ে ওঠে মিত্রশক্তির প্রাচ্যের ঘাঁটি। এই সময় বাংলা ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে আমরা যে সাংবাদচিত্র গুলি পাই সেগুলি সবই তথ্যচিত্র। কিন্তু এগুলির নান্দনিকতা ছিল কম। সব দেশেই স্বল্পদৈ্ঘ্যে্র অনেক চিত্ররূপ তৈ্রি হয়েছিল কিন্তু সেগুলি হয় কোনও ঘটনার চিত্রায়ণ অথবা বিজ্ঞাপন-চিত্র। সেগুলিকে সার্থক তথ্যচিত্র বলা যায় না।
   সা্র্থক তথ্যচিত্র 1919 খ্রিঃএ নির্মিত হয়। এই সময় নির্মিত দুটি তথ্যচিত্র পরবর্তী কালের জন্য পথনির্দেশ করে দেয়। তথ্যচিত্র দুটি হল –রবার্ট হাইন নির্মিত, ‘দ্য কেবিনেট আফ ড. কেলিগ্রি’ এবং রবার্ট ফ্লাহার্টি নির্মিত ‘নানুক অফ নর্থ’। বিশেষ করে ‘নানুক’ ছবিটি গতিময়তায়, আনুসন্ধিত্সায়, বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তোলার লিরিকাল গুণে তথ্যচিত্র সম্পর্কে মানুষের ধারণাই বদলে দেয়। কানাডার তুষার ঢাকা জমিতে এস্কিমোদের জীবন সংগ্রামের ছবি নানুক নামে এক শিকারির মধ্যে দিয়ে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে তার শৈল্পিক ও নান্দনিক মূল্য অসীম। তবে বাংলার সার্থক তথ্যচিত্রের জন্য আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়। 
 
তথ্য সূত্র -
১) সিনেমা সপ্তম শিল্পকলা-বরুন দাশ।
২) ঘরের কথা ও যুগ সাহিত্য।–দীনেশ চন্দ্র সেন।
৩) সোনার দাগ(শতবর্ষের আলোয় ্বাংলা চলচ্চিত্র।গৌরাঙ্গ প্রসাদ ঘোষ।
৪) the early years of Calcutta cinema in sukanto choudhuri edited:Calcutta, The living City,vol 2,Oxford university press,page 293-941
৫) The Motion Picture.-The new york times.7th june 2019.
৬) আনন্দ বাজার পত্রিকা ১৫ই জুন,২০১৯।
৭) আর রেখোনা আঁধারে-সজল চট্টোপাধ্যায়।
৮) ভারতীয় চলচ্চিত্রের পথিকৃত হীরালাল সেন।–প্রভাত মুখোপাধ্যায়।
৯) বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের ইতিহাস।–কালীশ মুখোপাধ্যায় ।