মার্ক্সের নারীভাবনা

মার্ক্স কি এমন অনেক জায়গা সচেতনেই রেখে গেছেন নিজের লেখাপত্রে, যেখান দিয়ে লিঙ্গরাজনীতির তত্ত্ব সহজেই ঢুকে পড়তে পারে, ডালা পালা ছড়াতে পারে? সেইটে পুনরালোচনা করা দরকার, কারণ মার্ক্সের নারীভাবনাকে বুঝতে সেটি জরুরি।

The revolution did not topple all tyrannies. The evil which one blames on arbitrary forces exists in families, where it causes crises.

অর্থাৎ, (ফরাসী) বিপ্লবেই  সব একাধিপত্য শেষ হয়নি৷ অনেক উপদ্রব লুকিয়ে থাকে আসলে পরিবারের কাঠামোয়, অথচ সেই অমঙ্গলকে আমরা কার্যকারণ-সম্পর্কহীন ভাবি।

 এই সুরে কথা কে বলে থাকতে পারেন? কোনো ছাপ-মারা নারীবাদী, যিনি মনে করেন, শ্রেণি-সংগ্রামই একমাত্র সংগ্রাম নয়? আসলে এক ফরাসি সাংবাদিক পুচেৎ ( Peuchet) আত্মহত্যা নিয়ে লিখতে গিয়ে এসব বলেছিলেন। কিন্তু কথাগুলির প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, ঊনবিংশ শতকে, স্বয়ং কার্ল মার্ক্স।

 মার্ক্সিজমের ও ফেমিনিজমের দ্বৈরথ রয়েছে বলে ঐতিহাসিকভাবে অনেকেই মনে করেন। তা সম্পূর্ণ ভুলও নয়। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত মার্ক্সিস্টরা আলাদা করে নারীদের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে কুণ্ঠা বোধ করতেন। শুধু লিঙ্গ ও পরিবার সংক্রান্ত আলোচনা এসে পড়লে এঙ্গেলস-এর বইটির কথা অবধারিত ভাবে আসত,The Origin of Family, Private Property and the State,  যাতে বস্তুত নির্ধারণবাদ বেশি আর 'দ্বন্দ্ব' কম।  এই বইটি মূলত লুইস এইচ মর্গানের প্রাচীন সমাজ বিষয়ক মতামত, এবং সেই মতামত বিষয়ে মার্ক্সের বিবিধ মতামতের উপর নির্ভর করে রচিত, অন্তত এঙ্গেলস আমাদের এমনটাই জানিয়েছিলেন। কিন্তু ওইটুকুই কি ছিল মর্গান বিষয়ে বা  প্রাচীন, ধনতন্ত্র-পূর্ব সভ্যতা ও পরিবার বিষয়ে মার্ক্সের সম্পূর্ণ বক্তব্য? নাকি মার্ক্স আর এঙ্গেলসের জেন্ডার ও পরিবার সংক্রান্ত ধারণা হল দুটি বৃত্ত, যারা অনেকাংশে পরস্পরের সাথে মেলে, কিন্তু পুরোপুরি নয়?  মার্ক্স কি এমন অনেক জায়গা সচেতনেই রেখে গেছেন নিজের লেখাপত্রে, যেখান দিয়ে লিঙ্গরাজনীতির তত্ত্ব সহজেই ঢুকে পড়তে পারে, ডালা পালা ছড়াতে পারে?

সেইটে পুনরালোচনা করা দরকার, কারণ মার্ক্সের নারীভাবনাকে বুঝতে সেটি জরুরি।  মার্ক্স কি সত্যি নারীস্বাধীনতার প্রশ্নে রক্ষণশীল আচরণ করে গেছেন বা সেই প্রশ্নকে পরবর্তী মার্ক্সিস্টদের মতো উপেক্ষা করে গেছেন?

মার্ক্স আর এঙ্গেলসের ডায়লেক্টিক্সের বোধে যে তফাত আছে,  তা  আমাদের প্রথম বলেন  ইয়র্জ লুকাচ বা টেরেল কার্ভাররা। তার উপর ভিত্তি করে হিদার ব্রাউনের মতো নারীবাদীরা দেখান, তাঁদের লিঙ্গ ও পরিবার সংক্রান্ত বোধও খানিক ভিন্ন। নারীবাদীরা প্রায়শই ইকনমিক ডিটারমিজমের জন্য মার্ক্সের সমালোচনা করেন।  অথচ এঙ্গেলস মার্ক্সের থেকেও অনেক বেশি মনিস্টিক বা একবাদী /   ডিটারমিনিস্টিক বা নির্ধারণবাদী। মার্ক্সের লিঙ্গ-সম্পর্ক নিয়ে বোধ অনেক বেশি সূক্ষ্ম তথা দ্বান্দ্বিক।

এটাও স্বীকার করে নেওয়া ভাল যে, যে নারীবাদীরা এক কালে( সত্তর বা আশির দশকে) মার্ক্সকে এঙ্গেলসের সঙ্গে একীভূত করে 'লিঙ্গ-অন্ধ' ধরে নিয়েছিলেন, তাঁরাও কিন্তু মার্ক্সের ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে মান্য ধরেছিলেন এবং গৃহশ্রমকে সেই আলোকে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছিলেন৷ সে এক অন্য অধ্যায়।

এখন, মার্ক্সের প্রধান ডিসকোর্স অবশ্যই লিঙ্গ-তত্ত্ব ছিলনা। বরং তাঁর নারীস্বাধীনতার ধারণায় ভিক্টোরিয়ান মরালিটির ছায়াও দেখতে পাওয়া কঠিন নয়। তবু তাঁর নিজের নারীমুক্তির ধারণা তাঁর অনুগামীদের থেকে কয়েকশ বছর এগিয়ে ছিল। তাঁর লিঙ্গরাজনীতি বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই আজকের নারীবাদের মতো সুগঠিত ছিল না, তবে নারীবাদ আজ এতখানি গতিশীল হওয়ার পেছনে অবশ্যই মার্ক্স নিজে একটা বড় কারণ।

১৮৪৪ সাল নাগাদ মার্ক্স 'ইকনমিক অ্যান্ড ফিলজফিকাল ম্যানাসস্ক্রিপ্টে' বলছেন, সমাজে নারীর অবস্থান দেখেই সমাজের প্রগতির আন্দাজ পাওয়া যায়। লিঙ্গ রাজনীতিতে প্রশিক্ষিত ছিলেন না, অথচ লিঙ্গকে একটা চলমান বিষয় হিসেবে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, স্থির বিষয় হিসেবে নয়। 'ম্যানাসস্ক্রিপ্ট' আর 'জার্মান ইডিওলজি'তে সমালোচনা করছেন সনাতন প্রকৃতি/সমাজ বাইনারির। মার্ক্স বলছেন, এরা দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন সত্তা নয়, এরা দ্বান্দ্বিক সম্পর্কে রয়েছে, পরস্পরকে পরিবর্তিত করতে সক্ষম। মানুষ শ্রমের মাধ্যমে প্রকৃতির সঙ্গে মিথোষ্ক্রিয়ায় রত। উভয়ই উভয়কে প্রভাবিত করছে।এবার সমাজ বা প্রকৃতি কেউই যদি স্থায়ী না হয়, তবে 'প্রাকৃতিক' বললেই অপরিবর্তনীয় কিছু বোঝায় না। কোনোকিছু কেবল মাত্র একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটেই 'প্রাকৃতিক' মার্ক্সের মতে। এই যে তিনি বলেছেন প্রকৃতি ও মানুষ  উভয়েই পরিবর্তনশীল, সুতরাং আমরা কোনোকিছুকেই 'প্রাকৃতিক ' বলে দেগে দিতে পারিনা, লক্ষ্য করুন,পরবর্তীতে নারীবাদীরাও,এই 'প্রাকৃতিক' কথাটা নিয়েই আপত্তি তুলবেন। যথা, মেয়েরা প্রাকৃতিক ভাবে ক্ষমাশীল, মাতৃসুলভ, কোমল ইত্যাদি তত্ত্ব নাকচ হবে। এই যে ফেমিনিস্টরা আজ জৈবিক লিঙ্গকে একটা স্ট্যাটিক ব্যাপার ধরেন না, ডায়মানিক বিষয় ধরি, এবং বলেন যে ধ্রুব 'জেন্ডার রোল'( সামাজিক লিঙ্গ ভূমিকা)  বলে কিছু হয় না, তা নিয়ত পাল্টাচ্ছে, মার্ক্স ডায়লেক্টিক্স ভালো করে না বোঝালে এভাবে হয়ত তা বলা যেত না। জুডিথ বাটলার তো অসামান্য দক্ষতার মার্ক্সের চিন্তার ধাঁচে  Queer Theory বোঝারও একটি প্রস্তাবনাও তৈরি করেন।

জার্মান ইডিওলজিতে আমরা আরও দেখি, মার্ক্স আর এঙ্গেলস লিঙ্গভিত্তিক পারিবারিক শ্রমবিভাজনকে 'পুরোপুরি প্রাকৃতিক' বলছেন না,  বলছেন 'অনুন্নত উৎপাদন ব্যবস্থায়' কিছু জৈবিক কারণে নারীকে কিছু নির্দিষ্ট কাজ করতে হয়। অর্থাৎ একটা যেন আভাস দিয়ে যাচ্ছেন যে উৎপাদন ব্যবস্থা উন্নততর হলে,  অর্থাৎ প্রযুক্তিগত উন্নতি হলে, নারীদের মুক্তি হবে। যদিও পরবর্তীকালে নারীবাদীরা শুধুমাত্র প্রযুক্তি-নির্ভর ব্যবস্থাপনায় আস্থা রাখেননি। 

অন্তত আরও দুটি জায়গায় অতি সংবেদনার সঙ্গে মার্ক্স নারীসমস্যা আলোচনা করছেন। ঃদ্য হোলি ফ্যামিলি' নামক রচনায় ইউজিন সু-এর গল্পের একটি বেশ্যা চরিত্রর সন্ন্যাসগ্রহণের পরিণতির সমালোচনা করছেন মার্ক্স। বলছেন, তার মুক্তি হতে পারত অন্য উপায়ে। যে অবস্থা অর্থনৈতিক অসহায়তা-জাত, তার জন্য তার মধ্যে নৈতিক ক্যাথলিক পাপবোধ ঢুকিয়ে দেওয়া অর্থহীন। এই বেশ্যাতত্ত্ব, স্লাট-ইমেজ পরে নারীবাদে মুখ্য হয়ে উঠবে।

আবার ১৮৪৬ সালে  আত্মহত্যা সংক্রান্ত লেখায় তিনি দেখান উচ্চবিত্ত মেয়েদের কী কী অবস্থায় আত্মহত্যা করতে হয়। এখানে তিনি গৃহহিংসার কথা বলছেন। তিনি পরপর তিনটি ঘটনার উল্লেখ করেন। প্রথমে এক ঘটনায়  সন্দেহবাতিকগ্রস্ত বরের শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে মেয়েটি আত্মহত্যা করে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বাগদত্তা এক মেয়ে বাইরে একটি মাত্র রাত কাটানোর পর স্রেফ কুৎসার চোটে আত্মহত্যা করে। তৃতীয় ক্ষেত্রে, অবৈধ সম্পর্কে গর্ভপাত করতে ব্যর্থ হয়ে মেয়েটি আত্মহত্যা করে। মার্ক্স বুঝেছিলেন বুর্জোয়া পরিবারতন্ত্রে বিরাট কিছু গলদ আছে, শ্রেণিতত্ত্বের বাইরে তারও আলোচনা প্রয়োজন। এই যে বিষয়গুলি মার্ক্সের আলোচনায় উঠে এক, তার মধ্যে গর্ভপাত সংক্রান্ত মুখ্য আন্দোলন ও আইন বদল হয়েছে বিংশ শতকে। গৃহহিংসা নিয়ে সচেতনতা গড়ে উঠতে একবিংশ শতক গড়িয়েছে। স্বামী কর্তৃক যৌন অপরাধ আজও আইনত দণ্ডনীয় নয় ভারত-সহ বহু দেশে। অথচ এই বিষয়গুলো নিয়ে মার্ক্স কথা বলছিলেন ঊনবিংশ শতকেও। শ্রেণিহীন সমাজ এলে, তবে এ নিয়ে কথা বলবেন বলে, কথা মুলতুবি রাখেননি।

 'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো'-তে মার্ক্স-এঙ্গেলস আবার বুর্জোয়া পরিবার সংক্রান্ত আলোচনায় ফিরলেন, যেখানে পরিবারকে তাঁরা ব্যক্তিগত সম্পদ কুক্ষিগত করার কল হিসেবে দেখালেন ও তা উচ্ছেদ করার প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু যে প্রোলেতারিয়তের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নেই, তারও পিতৃতান্ত্রিক চরিত্র আছে কি? এরূপ পরিবারের বিলোপের পরেই বা কী হবে? তার স্পষ্ট দিশা ছিল না সেই সময়এই জুটির কাছে। মার্ক্স কিন্তু তার নিজস্ব চিন্তনপ্রক্রিয়া বজায় রেখেছিলেন, যার হদিশ পাওয়া যাবে ব্যক্তিগত লেখাপত্রে।

'ক্যাপিটাল' নারীকে দেখল সেই শ্রমিক হিসেবে যাকে দিয়ে কম পারিশ্রমিকে বেশি শ্রম করিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু মার্ক্সের নজর এড়াচ্ছে না, শ্রমিক হয়ে ওঠা নারী তার সনাতন ভূমিকা পালন করতে পারছে না, তার বাড়ি ফিরতে রাত হচ্ছে, সে সংসারের মুখে অন্ন জোগাচ্ছে, হয়ত চাকা উল্টোবাগে ঘুরছে। এরপর 'নারীশ্রম‘-এর প্রশ্নটি জোরালোভাবে উঠতে শুরু করল, যা এতদিন উপেক্ষিতই থেকে গিয়েছিল। মার্ক্স নিজেকে দ্রুত বদলান সময়ের সঙ্গে। ১৮৫৩ সালে প্রেস্টনের স্ট্রাইকে তিনি পুরুষ শ্রমিকদের জন্য 'ফ্যামিলি ওয়েজ' চান। কিন্তু ১৮৬০ সালে প্রথম ইন্টারন্যাশনালের অধিবেশনে নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের সমমর্যাদা দেন৷ তাদের পৃথক পৃথক শ্রমিক হিসেবে দেখেন, 'ফ্যামিলি' হিসেবে নয়। কিন্তু আবার মেয়েদের ভোটাধিকার বিষয়ে মার্ক্সের মূল্যায়ন সর্বজনীন ভোটাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে খুব একটা সাযুজ্যপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। 

পারি কমিউনের পর আরও বদল এল বোধহয় মার্ক্সের দৃষ্টিভঙ্গিতে।   ১৮৮০ সালে  “Programme of the Parti Ouvrier" -এর প্রি-অ্যাম্বেলে লিখছেন- 

That the emancipation of the productive class is that of all human beings without distinction of sex or race.

সর্বোপরি, নিউ ইয়র্ক ট্রিবিউনে  ১৮৫৮ সালে  নারী ও পাগলামি বিষয়ে যা তিনি লিখেছেন, নারীবাদী হিসেবে ব্যক্তিগত ভাবে তাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। 

নিউইয়র্ক ট্রিবিউনে মার্ক্স তখন নিয়মিত লিখছেন। এক  সুপরিচিত অভিজাত পরিবারের বধূকে তাঁর স্বামী  অ্যাসাইলামে পাঠিয়েছেন। তা নিয়ে চলছে কানাকানি, ফিসফাস। মার্ক্স তাঁর কলামে ঘটনাটির উল্লেখ করলেন। লিখলেন,খোপে না ফেলতে পারলেই পুরুষমানুষ নারীকে পাগল ঠাওরায়। লিখলেন,স্বাধীনচেতা ভদ্রমহিলাকে তিনি চেনেন এবং মনে  করেন তাঁর মধ্যে পাগলামির বিন্দুমাত্র লক্ষণও নেই।

এর অনেকবছর পরেও কিন্তু মনস্তত্ত্বের পিতা ফ্রয়েড নিকটজনের যৌন নিপীড়ণের শিকার  এক বালিকার 'অসুখ' ধরতে পারছেন না। সেই বালিকা,ডোরা-কেই বরং তিনি পাগল ঠাওরাচ্ছেন। 'ডোরা'স কেস' পরবর্তীকালে বহুলসমালোচিত হয় ফ্রয়েডবিরোধী নারীবাদীদের কলমে।

অথচ মার্ক্স ভারি সহজে বুঝেছিলেন,তাঁর পরিচিত অভিজাত বধূটি পাগল নন,স্রেফ স্বাধীনচেতা। হয়ত কাকতালীয়, কিন্তু অনেক পরে,গিলবার্ট আর গ্যুবার এর যুগান্তকারী নারীবাদী তাত্ত্বিক  বই-এর নামই হয়েছিল 'The Madwoman in the Attic'।  'Jane Eyre' উপন্যাসের উন্মাদিনী  Bartha Mason সেখানে খোপে-না-আঁটা 'পাগল' নারীদের প্রতীক ও প্রতিনিধি হয়ে উঠেছিলেন।

১৮৭৯ থেকে ১৮৮৩ সাল পর্যন্ত মার্ক্স যা লিখছেন রিসার্চ নোট হিসেবে, বা মর্গ্যান সম্পর্কে, তা আরও উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠল, কারণ যদিও এঙ্গেলস আমাদের বলেছেন মার্ক্স মর্গ্যানকে যেভাবে দেখেছেন, সেভাবেই তিনি 'অরিজিন অফ ফ্যামিলি…' লিখেছেন, কিন্তু আমরা দেখলাম, তার বাইরেও পরিবার নিয়ে মার্ক্সের বেশ কিছু ভাবনা আছে৷ মার্ক্স পরিবারকে শুধুমাত্র এক বৃহৎ ষড়যন্ত্রের ক্ষুদ্রতম একক ধরেননি, পরিবারটিকেই একটি ঐতিহাসিক বিষয় হিসেবে বুঝতে চেয়েছেন৷ নোটবুকে মর্গান সংক্রান্ত নোটে আঁকিবুঁকিতে লিখে রেখেছেন নানা প্রকৃতির পরিবারের নানাবিধ দ্বন্দ্ব। পরিবারও দ্বান্দ্বিকতার আধার, তা মার্ক্স বুঝেছিলেন।

বৈবাহিক সম্পর্কে নারী-পুরুষের মধ্যে যে ক্ষমতার সমীকরণ কাজ করে (এমনকি উচ্চশ্রেণির বিবাহ-সম্পর্কেও নারী প্রলেতারিয়েতের ভূমিকা পালন করে) তা নিয়ে মার্ক্স যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। এসবই আরও বিস্তৃতভাবে তত্ত্বায়িত হবে পরে, যখন নারীবাদীরা ঘোষণা করবেন, 'পার্সোনাল ইজ পলিটিকাল'।

মার্ক্স আপাত সমতার মধ্যেও যেসব অসাম্য থাকে, তাদের দেখতে পেতেন৷ যেখানে এঙ্গেলস বলছেন,ব্যক্তিগত সম্পদ ধ্বংস হলেই নারী এমনিতেই মুক্ত হবে, সেখানে মার্ক্স অবান্তর প্রসঙ্গ টানছেন গ্রীক দেবীদের। দেখাচ্ছেন পিতৃতান্ত্রিক পরিবেশের মধ্যেও তাঁরা কীভাবে তাঁদের  স্বাধীনতার মডেল খুঁজেছিলেন। অর্থাৎ তিনি হয়ত আন্দাজ করেছিলেন, ব্যক্তিগত সম্পদ ধ্বংস করা ছাড়াও, ব্যক্তিগত যাপনের স্তরেও কিছু একটা নবীকরণ দরকার। অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ কমে আসছিল।  কিন্তু থেকে গেছিল দ্বান্দিকতা বা ডায়লেক্টিক্স-এর তত্ত্ব। মার্ক্সের চরমতম নিবেদন তো দ্বান্দ্বিকতার প্রতিই। সেই তত্ত্ব নারীবাদীদের কাজে এসেছে। আগেই বলেছি নেচার -কালচারের বিতর্কটি মার্ক্স উস্কে দিয়েছেন, তাকে নারীবাদীরা ব্যবহার করেছেন নিজ প্রয়োজনে। আবার শ্রমের মূল্য বুঝতে গিয়ে মার্ক্স বুঝেছেন  প্রোডাকশন-রিপ্রোডাকশন তর্কটি, বুঝেছেন উভয়ই শ্রমের আওতায় আসবে।

মার্ক্সীয় শিক্ষা আসলে মার্ক্সীয় কাঠামোকেই অতিক্রমের  উৎসাহ প্রদান করে। সেই তো দ্বন্দ্বের নিগূঢ়তম নির্যাস।  মার্ক্স ঈশ্বর নন, ডিক্টেটর নন, পিতৃতান্ত্রিক পুংচরিত্র নন।   মার্ক্স সেই ব্যক্তি যিনি দ্বন্দ্বহীনতাকেই আসলে অহিফেন বলে জানতেন। আজ যখন কর্পোরেট শক্তি নারীবাদী আন্দোলনকে অ্যাপ্রোপ্রিয়েট করার কাজে রত হয়েছে,  তখন দ্বন্দ্বের কাছে ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় কী?