আলেহো কার্পেন্তিয়েরের জাদুবাস্তবতা - 'এই মর্ত্যের রাজত্ব'

লাতিন আমেরিকান বুম এর তরুণ লেখকদের মধ্যে ছিলেন হুলিও কোর্তাজার (আর্জেন্টিনা), কার্লোস ফুয়েন্তেস (মেক্সিকো), গার্সিয়া মার্কেজ (কলম্বিয়া), মারিও ভার্গাস ইয়োসা (পেরু)। অব্যবহিত আগের লেখকদের মধ্যে ছিলেন বোর্হেস (আর্জেন্টিনা), মিগুয়েল আস্তুরিয়াস (গুয়েতেমালা), আলেহো কার্পেন্তিয়ের (কিউবা), হুয়ান রুলফো (মেক্সিকো) প্রমুখ। কিউবার লেখক ও কাস্ত্রো নেতৃত্বাধীন সরকারের শরিক আলেহো কার্পেন্তিয়েরের আখ্যান ও তার রাজনীতি নিয়ে এই আলোচনা।

১৯৬০ ও ৭০ এর দশকে কয়েকজন তরুণ লাতিন আমেরিকান সাহিত্যিকের লেখা ইউরো আমেরিকান জগতে বিশেষ সাড়া ফেলে। এই সাড়ার সূত্রে অব্যবহিত আগের পর্বের লেখকেরাও বৃহত্তর পরিধিতে পঠিত হতে থাকেন। সব মিলিয়ে এই পর্বটাকে লাতিন আমেরিকান বুম হিসেবে অভিহিত করা হয়। অব্যবহিত আগের লেখকদের মধ্যে ছিলেন বোর্হেস (আর্জেন্টিনা), মিগুয়েল আস্তুরিয়াস (গুয়েতেমালা), আলেহো কার্পেন্তিয়ের (কিউবা), হুয়ান রুলফো (মেক্সিকো) প্রমুখ। আর লাতিন আমেরিকান বুম এর তরুণ লেখকদের মধ্যে ছিলেন হুলিও কোর্তাজার (আর্জেন্টিনা), কার্লোস ফুয়েন্তেস (মেক্সিকো), গার্সিয়া মার্কেজ (কলম্বিয়া), মারিও ভার্গাস ইয়োসা (পেরু)।

এঁদের মধ্যে বোর্হেস নানা নিরিখেই কিছুটা ব্যতিক্রমী। বাকিরা সবাই কিন্তু ইউরোপীয় আখ্যান জগৎ থেকে সচেতনভাবে স্বতন্ত্র হতে চেয়েছেন। সেটা রচনার বিষয় ও প্রকৃতি উভয় দিক থেকেই। তাঁদের লেখায় রয়েছে এক বিশেষ ধরনের রাজনৈতিকতা, যা তাদের লেখার বিষয়বস্তু ও রীতিকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। তাঁরা লাতিন আমেরিকার ইতিহাস জুড়ে যে শোষণ চলেছে ঔপনিবেশিক ও নয়া ঔপনিবেশিক যুগে, তাকে ও তার প্রতিক্রিয়াকে নানাভাবে ধারণ করতে চান তাঁদের গল্প উপন্যাসে। যেমন যে লাতিন আমেরিকান কথাকার প্রথম নোবেল পুরস্কার পাবেন, সেই আস্তুরিয়াসের ‘ব্যানানা ট্রিলজি’। নয়া ঔপনিবেশিক জমানায় আমেরিকান ফ্রুট কোম্পানি লাতিন আমেরিকার বিরাট পরিমাণ জমিই শুধু নিজেদের হস্তগত করেনি, বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়েছে। শ্রম শোষণ ও সম্পদ শোষণের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের রাজনীতিকেও তারা নিয়ন্ত্রণ করেছে প্রবলভাবে ও এইসূত্রেই জন্ম নিয়েছে ব্যানানা রিপাবলিক নামের এক নতুন রাজনৈতিক অভিধা। এই লেখায় আমরা আলেহো কার্পেন্তিয়েরের একটি উপন্যাস পাঠের সূত্রে লাতিন আমেরিকান উপন্যাসে অভিব্যক্ত সম্পদের লুঠতরাজ, শ্রম শোষণ, স্বৈরতন্ত্র এবং সে সবের প্রতিক্রিয়াজাত দ্রোহ রাজনীতির ব্যাপারটি বোঝার চেষ্টা করব।

লাতিন আমেরিকার ম্যাজিক্যাল রিয়ালিজমের প্রথম বিশিষ্ট স্রষ্টা আলেহো কার্পেন্তিয়েরের সাথে রাজনীতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল খানিকটা আকস্মিকভাবেই। ১৯০২ সালে কার্পেন্তিয়েরের ফরাসী বাবা ও রুশ বংশদ্ভূত মা চলে আসেন কিউবাতে, আলেহোর জন্মের ঠিক দু বছর আগে। স্পেনীয় উপনিবেশের হাত ছাড়িয়ে কিউবা তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে। কিউবাতে বিশ্ববিদ্যালয় তখন কেবল জ্ঞানার্জনের সিঁড়ি নয়, নব্য যুবকদের জন্য তা সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতিরও সোপান ছিল। আলেহোর বাবা মা স্বপ্ন দেখেছিলেন সে সেরা শিক্ষার সুযোগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিঁড়ি বেয়ে এক সফল মানুষ হবে। এক পরিযায়ী পরিবারের সন্তান হিসেবে নতুন দেশে নিজেকে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করবে। এই স্বপ্ন থেকেই তাকে ভর্তি করা হয়েছিল সেখানকার সেরা এক বেসরকারী বিদ্যালয়ে। স্কুল ও কলেজ জীবন শেষ করে আলেহো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন স্থাপত্যবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনোর জন্য। আলেহো যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন হঠাৎ করেই একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যান তার বাবা জর্জ কার্পেন্তিয়ের। অনেক খুঁজেও আর তার কোনও সন্ধানই পাওয়া যায় নি। কার্পেন্তিয়ের পরিবারের ওপর হঠাৎই নেমে আসে বিপুল আর্থিক চাপ। এর মোকাবিলায় আলেহো কার্পেন্তিয়েরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনো ছাড়তে হয়, দায়িত্ব নিতে হয় নিজের ও মার ভরণপোষণের। এইসময়ে অর্থ উপার্জনের জন্যই শুরু হয় তার লেখালেখি। এইসময়ে সংবাদপত্রে লেখা ছাড়াও একটি জুতোর কারখানার শ্রমিক ইউনিয়নের জন্য তিনি জুতো নির্মাণের ইতিহাস লেখেন।

শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে এই সম্পর্কের পর শ্রম জগতের সঙ্গে কার্পেন্তিয়েরের যোগ আরো নিবিড় হয় সমকালীন কিউবার বিরোধী রাজনীতি, বিশেষত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের সূত্র ধরে। ১৯২০ র দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে কিউবার রাজনীতি স্বৈরতন্ত্রের হাতে চলে যায়। ১৯২৫ সালে কিউবায় ক্ষমতা দখল করেছিলেন গেরার্দো মাকাদো মোরালেস। মাকাদোর নীতিমালায় একদল খুব ধনী হয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছিলেন। তারা মাকাদো মোরালেসের সমর্থক হয়ে ওঠেন। আর তার পাশে থাকে মার্কিন সরকার ও ব্যবসায়ীরা, মাকাদো যাদের স্বার্থে কাজ করতেন। অন্যদিকে এই স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় কিউবার কমিউনিস্ট পার্টি, বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও ছাত্রদের এক জোট, আলেহো কার্পেন্তিয়ের যার মধ্যে ছিলেন। পড়াশুনো ছেড়ে দিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির সঙ্গে কার্পেন্তিয়ের গভীরভাবে সমন্বিত হয়ে যান। মাকাদো সংবিধান সংশোধন করে তার রাষ্ট্রপতিত্বের মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু অচিরেই এক বিপ্লবী ঢেউ এর মুখোমুখি হয়ে তাঁকে কিউবা ছাড়তে হয়। ১৯৩৩ এর এই গণবিদ্রোহকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেষপর্যন্ত খানিকটা নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়। তারা এমন একটা ব্যবস্থা করে যাতে মাকাদো দেশ ছেড়ে বাহামাসে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেও বিপ্লবীদের হাতে ক্ষমতা না এসে চলে যায় বাতিস্তার হাতে। এইভাবে একটি গণবিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে এক স্বৈরতন্ত্রীর হাত থেকে আরেক স্বৈরতন্ত্রীর হাতে ক্ষমতাই শুধু গেল তাই নয়, কিউবার অর্থনীতির চাবিকাঠি থেকে গেল মার্কিনীদের হাতেই। ১৯৫৯ সালে কাস্ত্রো, চে দের নেতৃত্বে বাতিস্তা সরকারের পতনের আগে পর্যন্ত কিউবায় মার্কিনী মদতপুষ্ট স্বৈরতন্ত্রই বহমান ছিল।

কিউবায় মাকাদো স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ চলছিল তার সমর্থন এসেছিল আর্জেন্টিনা ও মেক্সিকো থেকেও। ১৯২০ এর দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষানীতির সংস্কারের দাবি উঠেছিল আর্জেন্টিনার কর্ডোবা থেকে। তা অচিরেই লাতিন আমেরিকার নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে ও কিউবা সহ মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ছাত্রদের প্রভাবিত করে। মেক্সিকো বিপ্লবের সাফল্য থেকেও অনুপ্রেরণা এসেছিল কিউবায়। কার্পেন্তিয়েরের রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক জীবন এই সময় থেকে পাশাপাশি চলতে থাকে। সে সময়কার কিউবার দুটি বিখ্যাত পত্রিকা – কার্তেলেস ও সোশ্যাল এ কার্পেন্তিয়ের ধারাবাহিকভাবে লেখালেখি চালিয়ে যান। ইউরোপের আভাগার্দ আন্দোলন বিষয়ে তিনি ছিলেন একজন বিশেষজ্ঞ এবং এই বিষয়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য নানা জায়গায় প্রায়ই তাঁর ডাক পড়ত। আভাগার্দ শিল্পসাহিত্য চর্চার লক্ষ্যে কার্পেন্তিয়ের তাঁর কয়েকজন সহযোগীকে নিয়ে শুরু করেন রেভিস্তা নামে একটি পত্রিকা।

আভাগার্দ আন্দোলন ও রাজনৈতিক সক্রিয়তা এই দুই প্রেক্ষিত থেকেই কার্পেন্তিয়ের কিউবা তথা লাতিন আমেরিকার সমাজ ও ইতিহাসে আফ্রিকান কালো মানুষদের শ্রম, সংস্কৃতি ও অবদান নিয়ে গভীরভাবে আগ্রহী হন ও এই নিয়ে নিবিড় চর্চা শুরু করেন। একজন সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি কিউবার সঙ্গীতে আফ্রিকান কালো মানুষদের ভূমিকাকে খতিয়ে দেখেন। হাইতি ভ্রমণের সূত্রে সেখানকার খামার অর্থনীতিতে কালো মানুষদের শ্রম ও ভূমিকা সম্পর্কে তিনি অবহিত হন। ‘এই মর্তের রাজত্ব’ নামক আমাদের আলোচ্য উপন্যাসটি এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই তৈরি। কালো মানুষদের সংস্কৃতিকে সামনে আনা, ইউরোপীয় সংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যান করা ও বিদ্রোহকে উশকে দেওয়ার মত কার্যক্রমগুলি কার্পেন্তিয়ের ও তার সহযোগীদের সম্পর্কে শাসককে সংশয়ী ও শঙ্কিত করে তোলে। বেশ কিছু কমিউনিস্ট ও অ্যানার্কিস্ট নেতৃত্বের সঙ্গে কার্পেন্তিয়েরকেও জেলে পাঠানো হয় ১৯২৭ সালে। জেল থেকে ছাড়া পাবার পর ১৯২৮ সালে কার্পেন্তিয়ের কিউবা থেকে ফ্রান্সে পালিয়ে যেতে সমর্থ হন। ফ্রান্স থেকেই তিনি বামপন্থীদের পত্রিকা অক্টোবরে কিউবার আন্দোলনের সমর্থনে লেখালেখি চালিয়ে যান। এই সময়ে প্যারিস হয়ে উঠেছিল লাতিন আমেরিকান শিল্পী সাহিত্যিক রাজনৈতিক কর্মীদের মেলামেশা ও আদানপ্রদানের শহর। প্যারিসের ক্যাফেগুলিতে কিউবার কবিদের সঙ্গে পরিচয় হত চিলির কবিদের বা আর্ট গ্যালারিতে আর্জেন্তিনার সুরকারের সঙ্গে মোলাকাত হত মেক্সিকোর চিত্রশিল্পীর। কার্পেন্তিয়ের প্যারিসেই পরিচিত হয়েছিলেন গুয়েতেমালার ঔপন্যাসিক আস্তুরিয়াসের সাথে, পরে যিনি প্রথম লাতিন আমেরিকান কথাকার হিসেবে নোবেল পুরস্কার পাবেন ১৯৬৭ তে। পরিচয় হয়েছিল চিলির কবি, পরবর্তীকালের আর এক বিখ্যাত নোবেল জয়ী পাবলো নেরুদার সঙ্গে। প্যারিস থেকে কার্পেন্তিয়ের প্রায়ই আসতেন মাদ্রিদে, সেখানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় আরেক বিখ্যাত কবি গার্সিয়া লোরকার। এরা সবাই তখন এমন এক নতুন লাতিন আমেরিকার স্বপ্ন দেখছেন, যা স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর গেঁড়ে বসা নতুন মার্কিন নয়া উপনিবেশের জাল থেকেও মুক্ত হয়ে এক প্রকৃত স্বাধীন ভূখণ্ডে পরিণত হবে। তাঁরা শিল্পে সাহিত্যে নিয়ে আসতে চান হারিয়ে যাওয়া মায়া আজটেক ইনকা সভ্যতার স্মৃতি, রূপকথা, প্রবাদকে; প্রতিষ্ঠা দিতে চান লাতিন আমেরিকার নিজস্ব বাস্তবকে।

১৯৩৯ এ কিউবার অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয় এবং নিকোলাস গিয়েনের মতো কার্পেন্তিয়েরও দেশে ফেরেন। ইউরোপে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহ এবং ঘরোয়া পরিস্থিতির নানা চাপে বাতিস্তা তখন বামেদের সঙ্গে কিছুটা আপোষ করতে বাধ্য হয়েছেন। দেশে ফিরে কার্পেন্তিয়ের আবার কিছু কিছু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে শুরু করেন। কিন্তু বাতিস্তা সরকারের স্বৈরতন্ত্রী প্রবণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার তাঁর ওপর আক্রমণ নামে এবং তিনি এবার দীর্ঘ সময়ের জন্য দেশান্তরী হতে বাধ্য হন ভেনেজুয়েলাতে। ১৯৪৫ থেকে কাস্ত্রোর নেতৃত্বাধীন কিউবা বিপ্লবের সময় (১৯৫৯) পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন। এই দেশান্তরেই লেখা হয় তাঁর প্রথম সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘এল রেইনো দেল এস্তে মুনদো’ (এই মর্তের রাজত্ব)।

লাতিন আমেরিকার ফরাসী উপনিবেশ হাইতিতে আফ্রিকান ক্রীতদাসদের বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে কার্পেন্তিয়ের লেখেন তাঁর এই আলোড়ন তোলা আখ্যানটি, যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৯ সালে। এর ছয় বছর আগে ১৯৪৩ সালে কার্পেন্তিয়ের হাইতি বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেইসময় অষ্টাদশ ঊনবিংশ শতকের সন্ধিলগ্নে ঘটা দাসবিদ্রোহের কাহিনীগুলির সাথে তার নিবিড় পরিচয় ঘটে। কালো রাজা অরি ক্রিস্তফের কাহিনী সম্পর্কে কার্পেন্তিয়ের বিশেষ কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। এসবের ছায়াপাত ঘটে তার ‘এই মর্তের রাজত্ব’ নামের উপন্যাসে।

ভারতে বাণিজ্য করতে আসার স্বপ্নে মশগুল ক্রিস্টোফার কলম্বাস পঞ্চদশ শতাব্দীর একেবারে শেষভাগে পর্তুগাল থেকে বাণিজ্যতরী নিয়ে বেরিয়ে শেষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছন ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ ও দক্ষিণ আমেরিকায়। এরপর স্পেন ও পর্তুগালের তরফে বেশ কিছু অভিযান চলে গোটা দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জগুলিতে। মায়া, আজটেক ও ইনকা সভ্যতার অতীতকে প্রায় সম্পূর্ণ মুছে ফেলে লুঠেরা কনকিস্তাদাররা। লক্ষ লক্ষ অধিবাসীকে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এর ফলে ঔপনিবেশিক শাসন এক নতুন সমস্যার মুখোমুখি হয়। খনি থেকে সোনা রূপো সমেত নানা সম্পদ আহরণ করাই হোক, বা চাষবাস সহ হরেক শ্রমসাধ্য কাজ করাই হোক – তার জন্য লোকের অভাব দেখা যায়। সেই অভাব পূরণ করতে আফ্রিকা থেকে নিয়ে আসা হয় হাজারে হাজারে মানুষকে। তাদের ক্রীতদাস হিসেবে জুতে দেওয়া হয় নানা কঠোর পরিশ্রমের কাজে, চলে অমানুষিক অত্যাচার। গোটা স্প্যানিশ আমেরিকা বা পর্তুগীজ শাসিত ব্রাজিলের মতো একই অবস্থা ছিল ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ফরাসী উপনিবেশ হাইতিতেও। ফরাসী বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে সেখানেই নয়া দুনিয়ার প্রথম দাস বিদ্রোহ ঘটে এবং সেই বিদ্রোহের সূত্র ধরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয় দেশ হিসেবে উপনিবেশবাদের জোয়াল ছিঁড়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে হাইতি।

ফরাসী বিপ্লব ও তার প্রস্তুতির তোলপাড় দিনগুলোয় হাইতিতে সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার ধারণাগুলি ক্রীতদাসদের স্বপ্ন দেখিয়েছিল বন্ধন মুক্তির। পর পর ক্রীতদাস বিদ্রোহর বেশ কিছু ঢেউ এখানে আছড়ে পড়ে খামার ও দাস মালিকদের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে। ক্রীতদাসদের উতরোল বিদ্রোহকে ধরতে চেয়েছে এই আখ্যান। প্রথম বিদ্রোহটির নেতৃত্ব দিয়েছিল মাকান্দাল। এই মাকান্দাল ছিল এক ক্রীতদাস। কাহিনীর সংযোগকারী চরিত্র তি নোয়েলের মতো সেও কাজ করত মঁসিয়ে মেজির খামারে। একদিন আকস্মিক এক দুর্ঘটনায় পেশাই যন্ত্রের মধ্যে ঢুকে যাওয়ায় সে হারিয়ে ফেলে তার একটি হাত। কঠিন পরিশ্রমে অক্ষম বলে আস্তে আস্তে গুরুত্বহীন হয়ে যেতে থাকে সে। তার অদৃশ্য হয়ে যাওয়া তাই প্রথমে তেমন রেখাপাত করে না মালিকের মনে। তি নোয়েল অবশ্য তার অভাব অনুভব করত। এরপর একদিন হঠাৎই তি নোয়েল তার সন্ধান পায়। মাকান্দাল তখন নানান ভেষজের গুণাগুণ নিয়ে গবেষণায় রত। এই সূত্রেই তার হাতে আসে মারণ বিষ। তি নোয়েল সহ বেশ কিছু ক্রীতদাসকে নিজের পরিকল্পনায় সামিল করে নেয় মাকান্দাল। খোঁয়াড়ে আস্তাবলে মারণ বিষ ছড়িয়ে পশুহত্যার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় বিদ্রোহের। আস্তাবল থেকে ক্রমে খামার মালিকদের অন্দরেও ঢুকে পড়ল মারণ বিষ। লক্ষ্য ছিল শাদাদের একেবারে নির্মূল করে স্বাধীন নিগ্রোদের নিজেদের রাজ প্রতিষ্ঠা করা। সেনাবাহিনী নামিয়ে অনেক চেষ্টাচরিত্রের পর বিষের উৎস জানা যায়, চেষ্টা চলে গোটা পরিকল্পনার নেপথ্যে থাকা বিদ্রোহী নেতা মাকান্দালকে ধরার। অবশ্য তাকে তখন ধরা যায় না। তবে মারণব্যধি নিয়ন্ত্রিত হয়। আবার উল্লাস উদ্দীপণায় মেতে ওঠে খামার মালিকদের দল। অন্যদিকে দাসেদের কাছে মাকান্দাল ততদিনে প্রায় রূপকথার চরিত্র। নতুন ভরসা আর সাহসে জেগে ওঠা ক্রীতদাসেরা নিজেদের মধ্যে নানা খবর আর কথা চালাচালি করে। সেখানে মাকান্দাল সম্পর্কে নানা কথাবার্তা বাস্তব পেরনো এক জাদুবিশ্বের লোক করে তোলে তাকে। চার বছর পর জাদু জগত থেকে আবার বাস্তবের জমিতে আবির্ভাব হয় মাকান্দালের, যখন সে ধরা পড়ে আর তার হত্যার আয়োজন করা হয় অজস্র ক্রীতদাসের সামনে। বিদ্রোহের শাস্তি কী সবাইকে সেটা বুঝিয়ে দেওয়াই ছিল উদ্দেশ্য। জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা হয় মাকান্দালকে। তবে সামনের দিকের কয়েকজনই কেবল প্রকৃত ঘটনাটা দেখতে পায়। বাকীদের কল্পনায় মাকান্দাল বাস্তবের বধ্যভূমি থেকে যেন কুহকের রাজ্যে মিলিয়ে যায়।
বিদ্রোহের এই প্রথম স্রোতের পর বছর বারো বাইরে থেকে সব আগের মতোই থাকে যেন। তবে তি নোয়েলের মত অনেক ক্রীতদাসই তাদের সন্তানদের কাছে গানে গল্পে পৌঁছে দেয় মাকান্দালের বিদ্রোহের আখ্যান। এই সময়ই ফ্রান্স থেকে আসে ফরাসী বিপ্লবের বার্তা। সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার মন্ত্রের মধ্যে উপনিবেশের আফ্রিকান ক্রীতদাসদের মুক্তির বার্তাও ছিল মিশে। এই বার্তায় আন্দোলিত নতুন সময়ে নতুন নেতার আবির্ভাব হয় ক্রীতদাসদের মধ্যে, তার নাম বুকমান। জামাইকার লোক সে। ব্যাপকতর ও প্রত্যক্ষ বিদ্রোহের পরিকল্পনা করে সে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী শঙ্খধ্বনির সমবেত নিনাদে বিদ্রোহের সংকেত পাঠানো হয় সমস্ত জায়গায়। অতর্কিতে সমবেত আক্রমণ ধেয়ে আসে ক্রীতদাস মালিকদের দিকে। কচুকাটা করা হয় শত শত শ্বেতাঙ্গ মালিককে। এই বিদ্রোহও শেষ পর্যন্ত দমন করা হয়। যেখানে মাকান্দালকে হত্যা করা হয়েছিল, সেখানেই হত্যা করা হয় বুকমানকেও। তবে তার আগেই অধিকাংশ শ্বেতাঙ্গদের বিষয় সম্পত্তি পরিবারকে ধ্বংস করে দিয়েছে আফ্রিকান বিদ্রোহীরা। সেই ধ্বংসের অভিঘাত এতই বেশি হয় যে বুকমানের মৃত্যুর পরেও টিঁকে থাকা খামার মালিকদের অনেকেই আর হাইতিতে থাকা নিরাপদ মনে করেন না।

তি নোয়েলের মনিব মঁসিয় মেজি এবং তার মত আরো অনেক খামার মালিকই অবশিষ্ট সামান্য সহায় সম্বল এবং ক্রীতদাসদের নিয়ে কোনওরকমে কিউবার সান্তিয়াগো শহরে এসে ওঠেন। তি নোয়েলেরও বিদ্রোহের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা হয়ে গিয়েছিল। তা কার্যকরী হবার নাটকীয় মুহূর্তে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন তার মালিক মেজি। সে অবশ্য কোনও দয়া দাক্ষিণ্যের জায়গা থেকে নয়, কেবলই কঠিন পরিস্থিতিতে একজন ক্রীতদাসের বাজার মূল্যের হিসাব নিকাশের জায়গা থেকে। কিউবায় এসে জুয়া খেলে নিস্তরঙ্গ অসহায় জীবন কাটতে থাকে মেজির মত একদা খামার ও ক্রীতদাস মালিকদের। জুয়ার টাকা জোগাতে তি নোয়েলকে অন্য একজনের কাছে বেচে দেন মেজি এবং এর অল্প কিছুদিন পরেই তার মৃত্যু হয়। কিউবায় থাকতে থাকতেই তি নোয়েল জানতে পারে হাইতির বুকে সফল দাস বিদ্রোহের কথা। টাকা জোগাড় করে সে ফিরে আসে হাইতিতে। আবিষ্কার করে ভাঙাচোরা সেই খামারবাড়ি, যেখানে সে থাকত দাস হিসেবে। অতীতের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই, এমনই যখন সে ভাবছে তখনই তি নোয়েল মুখোমুখি হয় নতুন রাজা অঁরি ক্রিস্তফের বাধ্যতামূলক শ্রমনীতির সঙ্গে। এই অরি ক্রিস্তফের সঙ্গে কাহিনীতে আগে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন কার্পেন্তিয়ের। তখন সে নিজেও একজন ক্রীতদাস, জমাটি খাবার বানানো বাবুর্চি হিসেবে অবশ্য বেশ নামডাক হয়েছে তার। হাইতির দাস বিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন হাইতি যখন প্রতিষ্ঠা হল তখন সেখানকার প্রধান হলেন ক্রিস্তফ। বিদ্রোহের পর্বে প্রথমে সেনানায়কের পদে উন্নীত হয়েছিলেন তিনি। তারপর স্বাধীন হাইতির শাসক হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ। কার্পেন্তিয়ের ক্রিস্তফের জমানাকে দেখিয়েছেন তি নোয়েলের চোখ দিয়ে, যেখানে সে দেখে এই জমানাতেও চালু হল নতুন ধরনের দাসত্ব। স্বেচ্ছাশ্রম বাধ্যতামূলক করা হল। বিরাট বিরাট অট্টালিকা তৈরি হল, রাজকোষে প্রচুর অর্থ জমা হল, কিন্তু ক্রীতদাস প্রথার অবসানের মধ্যে দিয়ে যে নতুন জমানা তৈরি হল সেখানেও তারা মুক্ত স্বাধীন হল না। বন্দী হল নতুন শ্রমদাসত্বের নিগড়ে। তফাৎ শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের বদলে কালো আফ্রিকানরাই স্বজাতিদের সামনে এখন চাবুক হাতে দাঁড়িয়ে। কার্পেন্তিয়ের অঁরি ক্রিস্তফের বিচ্ছিন্নতা, আতঙ্ক ও আত্মহত্যা পর্বের ব্যঞ্জনাময় ভাষ্য রচনা করেছেন এখানে। ক্রিস্তফের আত্মহত্যার মধ্যে দিয়ে শুরু হওয়া বিশৃঙ্খলার সূত্র ধরে আবার যে নতুন শাসকেরা এল, তাদের হাতেও তি নোয়েল দেখল সেই চাবুক। দেখল আগের অন্যান্য জমানার মতো এ জমানাতেও মুক্তি এল না বাস্তবের মাটিতে।

তাঁর প্রথম এককেন্দ্রিক উপন্যাস একুয়ের তুলনায় দ্বিতীয় এই আখ্যানে চরিত্রের সংখ্যা বা বিস্তার অনেক বেশি। তবে কাহিনীর মেরুদণ্ড তি নোয়েল বা দাস বিদ্রোহের নায়ক মাকান্দাল, বুকমান, অরি ক্রিস্তফ থেকে দাস মালিক – উপন্যাসে মূলত পুরুষ চরিত্রেরই ভিড়। পার্শ্ব চরিত্র হলেও একমাত্র উজ্জ্বল নারী চরিত্র পাউলিনা বোনাপার্ট। পাউলিনা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে এখানে আসেন অন্য একটি কারণেও। এখানে যৌনতা মূলত ধর্ষণের হিংস্রতার ভয়াবহতা বা লোলুপ আগ্রাসী কামসর্বস্বতা নিয়েই আসে। পাউলিনার সূত্রেই ইরোটিক যৌনতার বিষয়টি উপন্যাসে এসেছে। নিগ্রো দাস সলিমান যখন পাউলিনার অঙ্গসংবাহন করত, তখন দুজনের মধ্যেই এক অব্যক্ত আবেশ ছড়াতো। প্রথম দিকে পাউলিনার অঙ্গসংবাহনের ভার ছিল ফরাসী দাসীদের ওপর। কিন্তু পুরুষের হাত আরো সবল ও উদ্দীপক হবে, এই ভাবনা থেকে সে নিজেই এই কাজে নিয়োগ করে নিগ্রো ক্রীতদাস সলিমানকে। সলিমান তার গায়ে মালিশ করে দেয় কাগজীবাদামের ক্ষীর,কামিয়ে দেয় তার গায়ের রোম। পাউলিনাকে সে স্নান করাত, আর সে সময় জলের তলায় পাউলিনা নিজের শরীর দিয়ে ঘষে যেত সলিমানের উরুর দু পাশ। দুজনেই অবিশ্রাম কামের তাড়ায় মাতোয়ারা হত। যদি আমরা মাথায় রাখি যে পাউলিনা দুনিয়াজয়ী নেপোলিয়ান বোনাপার্টের বোন তথা ফরাসী সেনানায়ক লেকলার্কের স্ত্রী আর সলিমান এক ক্রীতদাস, তাহলে এই ইরোটিক সম্পর্ক এক অন্য মাত্রায় পৌঁছয়।

কার্পেন্তিয়ের ছিলেন লাতিন আমেরিকান মাটিতে আফ্রিকান ক্রীতদাসদের সূত্রে আসা আফ্রিকি সংযোগসমূহ আবিষ্কারের একজন উৎসাহী গবেষক ও লেখক। সঙ্গীতশাস্ত্রের একজন বিশিষ্ট পণ্ডিত হিসেবে তিনি কিউবার সঙ্গীতে আফ্রিকান উপাদানসমূহ বিষয়ে অসামান্য গবেষণা করেছেন। আফ্রিকা থেকে নিয়ে আসা হাইতির ক্রীতদাসদের বিদ্রোহর কাহিনী যে তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করবে, প্রেরণা দেবে এই ধরনের একটি রচনার জন্য, তা সহজেই অনুমেয়। ক্রীতদাস বিদ্রোহের কথা অবশ্য কার্পেন্তিয়ার একরঙা উজ্জ্বলভাবে এঁকে থেমে যান নি। সেই বিদ্রোহের বিয়োগান্তক পরিণতিকেও তিনি নিয়ে এসেছেন তাঁর আখ্যানে। ইতিহাসের চাকা ঘুরলেও এক শ্রেণিকে যে ঘানি টেনে যেতেই হয়েছে, শাসকের রং বদলালেও ঢং যে সহজে বদলায় না, সেই মর্মান্তিক কঠোর অভিজ্ঞতা কার্পেনিয়ারের এই উপন্যাসে অভিব্যক্ত। এই চিত্রায়ণ নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন উঠেছে। অরি ক্রিস্তফের জমানাকে মূলত সমালোচক ভঙ্গীতেই দেখেছে তি নোয়েল চরিত্রটি। কিন্তু সেই দেখাকেই সার্বিক করে তোলা ইতিহাসের বাস্তবতার কতটা ঘনিষ্ট অনুসরণ অনেকে সেই প্রশ্ন তুলেছেন। নতুন জমানার সমালোচনার জায়গাগুলি আছে নিশ্চয়। তা স্বত্ত্বেও একদিকে ফরাসী সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে হাইতির মতো উপনিবেশের মুক্তি,অন্যদিকে ক্রীতদাসদেরই নায়ক ও দেশনেতা হিসেবে আবির্ভাব - এই জমানার ইতিবাচক দিকগুলিও কম নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর এটাই ছিল ঔপনিবেশিকতার যাঁতাকল থেকে বেরিয়ে আসার দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত। অথচ তাকে তেমন আমল দেয় নি কার্পেন্তিয়েরের ইতিহাস ঘনিষ্ট এই আখ্যান, এরকম অভিযোগ তুলেছেন কেউ কেউ।

বিষয়বস্তু ও তাকে উপস্থাপণের রীতির অভিনবত্ব একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতি ভাবনার সূত্র ধরেই এসেছে কার্পেন্তিয়েরের আখ্যানে। ইউরোপীয় বাস্তবতার থেকে আলাদা এক অন্য ধরনের আখ্যান লিখতে চেয়েছিলেন কার্পেন্তিয়ের, হুয়ান রুলফো, আস্তুরিয়াস বা তাদের পরবর্তীপর্বের গ্যাব্রিয়াল গার্সিয়া মার্কেজ, হুলিও কোর্তাজার, কার্লোস ফুয়েন্তেস, মারিও ভার্গাস ইয়োসার মতো সাড়া জাগানো লাতিন আমেরিকান কথাকারেরা। এই ভিন্ন ধরনের আখ্যান লেখার সূত্রেই উঠে আসে বিখ্যাত ম্যাজিক রিয়ালিজম ঘরানার কথা। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এবং বিশেষভাবে তাঁর ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচিউড’ এর সূত্রে তা গোটা বিশ্বের পাঠকদের কাছে বিশেষ পরিচিত হলেও অনেকেই মনে করেছেন এর প্রকৃত সূত্রপাত আলেহো কার্পেন্তিয়েরের এই আখ্যানের মধ্যে দিয়েই। এই গ্রন্থের প্রাককথনে অবশ্য realismo mágico (ম্যাজিক রিয়ালিজম) শব্দবন্ধটি নয়, Lo real maravilloso (The real wonderful) বা বিস্ময়কর বাস্তবের কথা কার্পেন্তিয়ের তুলেছিলেন। তবে এদের নৈকট্য ও আত্মীয়তা না বোঝার নয়। বিস্ময় আর বাস্তবতাকে কার্পেন্তিয়ের এখানে সার্থকতার সঙ্গে মিলিয়েছেন। বিদ্রোহের প্রথম নায়ক মাকান্দালের শেষ পরিণতির অংশটির কথা ভাবলেই আমরা এটা বুঝতে পারব। পাঠক জানে তার পরিণতির বাস্তবতা, জানে তাকে পুড়িয়ে মারার বিষয়টি। কিন্তু তি নোয়েল বা হাজার হাজার ক্রীতদাসের বিশ্বাস সে জাদুবলে আগুনের আওতা এড়িয়ে মিশে গেছে হাওয়ায়। এবং এই বিশ্বাস তাদের মধ্যে বিশেষ প্রেরণাও সঞ্চার করে। লাতিন আমেরিকার নিজস্ব স্বকীয়তাকে প্রতিষ্ঠা দেবার জন্য ইউরোপীয় বাস্তবতাবাদের থেকে ভিন্ন পথে হাঁটার প্রয়োজন পড়েছিল এবং কার্পেন্তিয়ের এই উপন্যাসে সেই পথচলার এক বলিষ্ঠ সূচনা করেন। পুরাণ আর কিংবদন্তি, আদিম কল্পনা আর ঐতিহাসিক সময়, বাস্তবতা আর স্বপ্ন এখানে কেবলই মিলেমিশে যেতে থাকে।