লাতিন আমেরিকার কথাকার আস্তুরিয়াসের সাহিত্যচর্চার ভূমিকা

লাতিন আমেরিকান কথাকারদের মধ্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার পান আস্তুরিয়াস। ১৯৬৭ সালে। লাতিন আমেরিকান বুম এর সাহিত্যিকদের - যাদের মধ্যে আছেন গার্সিয়া মার্কেজ, কার্লোস ফুয়েন্তেস, হুলিও কোর্তাজার, মারিও ভার্গাস ইয়োসা - সামান্য অগ্রজ তিনি। আস্তুরিয়াসের সমসাময়িক আরো তিন বিখ্যাত লাতিন আমেরিকান কথাকার হলেন বোর্হেস, হুয়ান রুলফো এবং আলেহো কার্পেন্তিয়ের। এই লেখাটি আস্তুরিয়াস চর্চার প্রবেশক।

ষাট সত্তর দশকের বহুচর্চিত 'লাতিন আমেরিকান বুম' সাহিত্যধারার পূর্বসূরীদের প্রসঙ্গ আলোচনায় যাঁর নাম সর্ববাদিসম্মতভাবে এসে পরে তিনি হলেন গুয়াতেমালার কবি, নাট্যকার, সাংবাদিক, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক-সমালোচক মিগুয়েল আঙ্গেল আস্তুরিয়াস(১৮৯৯-১৯৭৪)। তাঁর লেখনী বিশেষ অর্থবহ হয়ে উঠেছে মূলত তাঁর বলিষ্ঠ ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের হাত ধরে--যে প্রতিবাদ গড়ে উঠেছে বৈষম্য ও সামাজিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে, প্রতিবাদ রাজনৈতিক নিপীড়ন ও একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে। নেরুদার মত আস্তুরিয়াসও তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় কাটিয়েছেন নির্বাসনে শুধুমাত্র গুয়াতেমালা এবং ব্যাপক অর্থে সমগ্র দক্ষিণ আমেরিকার একনায়কতান্ত্রিক সামাজিক প্রতিষ্ঠানের একরোখা বিরোধিতা করার জন্য।

    এই প্রতিবাদের উৎস নিঃসন্দেহে স্বদেশী প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসের প্রতি তাঁর একনিষ্ঠ দায়বদ্ধতা, যার ভিত্তি অবশ্যই তাঁর রহস্যময় বহুস্তরীয় চিত্রকল্পসমৃদ্ধ স্বপ্নসম ভাষা। স্পষ্টতই মধ্য আমেরিকার সুপ্রাচীন মায়া সভ্যতার শিকড়ের সন্ধানে তাঁর সাহিত্যযাত্রা গ্রোথিত হওয়ার প্রধান কারণ সম্ভবত মায়া সংস্কৃতির ঐতিহ্যের উপর তাঁর গভীর বিশ্বাস।

   বস্তুত যে লাতিন আমেরিকান সাহিত্যধারা প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী দেশীয় সভ্যতা সংস্কৃতির পুনরুন্মেষের ধারক ও বাহক, আস্তুরিয়াস সেই সাহিত্যসূত্রের অক্লান্ত সৈনিক, এবং বলা যায় ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্তি তাঁর সেই লড়াইয়েরই স্বীকৃতি। আস্তুরিয়াসের সাহিত্যকীর্তি বিশ্বজুড়ে সমালোচক ও পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে কারণ সম্ভবত তাঁর লেখায় ধরা পড়ে মায়া সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মিস্টিসিজ়ম এবং ম্যাজিকাল রিয়ালিজ়ম ও পরাবাস্তববাদের আন্তরিক সংমিশ্রণ। এছাড়াও রয়েছে তৎকালীন গুয়াতেমালার সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অবক্ষয় ও ভয়াবহতার গূঢ়ভাবে ফুটিয়ে তোলা বাস্তবিক চিত্র এবং দেশবাসীর বংশধারাবাহিকতায় প্রাপ্ত মূল্যবোধ ও নৈতিক চেতনার উন্মেষ-আকাঙ্ক্ষা।

    ভৌগলিকভাবে, দক্ষিণ-পূর্ব মেক্সিকো, সমগ্র গুয়াতেমালা এবং বেলিজ় ও হন্ডুরাস এবং এল সালভাদরের পশ্চিমাংশ জুড়ে খ্রিস্টপূর্বাব্দ ২০০০ এর আগে থেকেই মায়া সভ্যতার চাকা ধীরে ধীরে আগুয়ান হতে শুরু করেছিল এবং এই যাত্রার মোটামুটি অন্তিম লগ্ন ধরা হয় ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দকে।ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, গুয়াতেমালায় মায়াজ জীবনধারার অবদমন শুরু হয় ১৫২৪ খ্রিস্টাব্দে পেদ্রো দে আলভারাদোর নেতৃত্বে দেশ স্পেনীয় কর্তৃত্বাধীন হয়ে পড়ার পর। এই ঔপনিবেশিক বিজয় রাজনৈতিক হেজিমনির সর্বাত্মক ফলশ্রুতি হিসেবে মায়া সভ্যতার উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্যগুলিকে বলপূর্বক কেড়ে নিয়েছিল এবং এর ফলে স্থানীয় মায়া জনগোষ্ঠীগুলির অস্তিত্ব সংকটমুখী হয়ে পড়ে যা চার শতাধিক বছরের এক নিন্দনীয় উপাখ্যান। U N Truth Commission-এর তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র ১৯৮০-৮৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শাসক সেনাবাহিনী ছয়শোর বেশি মায়া জনজাতীয় গ্রাম ধূলিস্যাৎ করেছে, অবাধ গণহত্যা ছাড়াও দুই লক্ষাধিক মানুষকে দেশত্যাগী হতে বাধ্য করেছে। উপরন্ত রয়েছে ক্যাথলিক ধর্ম প্রচার মাহাত্ম্য যার ফলে মায়া জনগোষ্ঠীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি লুপ্তপ্রায় হয়ে পড়ে। বিশেষত গুয়াতেমালায় স্পেনীয় উপনিবেশিকদের দাক্ষিণ্যে বিভিন্ন দেশীয় রীতিনীতি ও ধর্মাচার নিষিদ্ধ করা হয়, অগুনতি আজটেক ও মায়া জনগোষ্ঠীয় বহুমূল্যবান গ্রন্থাদি ধ্বংস করা হয় শুধুমাত্র ক্যাথলিক চার্চ ও ধর্মপ্রচারের স্বার্থে। আস্তুরিয়াসের উপন্যাসগুলি এই নিরুদ্ধ ঐতিহ্যকে মূল লাতিন আমেরিকান সাহিত্যস্রোতে পুনরুদ্ধার ও পুনঃসংযোজনের অবিসংবাদিত দাবি।

   সাহিত্যে মায়া সভ্যতা সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য তাঁর এই নিরলস প্রচেষ্টার সূত্রপাত আস্তুরিয়াসের শৈশব জীবনেই। তিনি জন্মসূত্রে ছিলেন 'mestizo' যার আক্ষরিক অর্থ 'অর্ধেক রক্ত'। সাধারণভাবে 'mestizo' তাঁদেরকেই বোঝায় যাঁদের নাড়িতে দেশীয় (indigenous/Indian) ও ইউরোপীয় উভয় রক্তই প্রবহমান। আস্তুরিয়াসের শৈশব কেটেছে গুয়াতেমালার বাজা ভারাপাজের রাজধানী সালামায় তাঁর পিতামহের পরিবারের সান্নিধ্যে যখন তাঁর আইনজীবী পিতাকে ম্যানুয়েল এস্ত্রাদা কাব্রেরার  একনায়কতন্ত্রের বিরোধিতা করার জন্য স্থানান্তরিত হতে হয়।  এই সময়েই তাঁর জীবনের সাথে স্থানীয় জনগোষ্ঠী, তাদের মনন ও সংস্কৃতি এবং নানা রঙে রাঙানো বিস্ময়কর বিভিন্ন লোকগাথার যোগসূত্র স্থাপিত হয়। এই স্থানটির মাহাত্ম্য এখানকার বাতাসে মায়াজ গল্পকথারা স্বপ্নের মতো ভেসে বেড়ায়, যা বলাই বাহুল্য, তাঁর শিশুমনে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে আইন পাশ করার পর তিনি প্যারিসের সরবন্ (the Sorbonne যার বর্তমান নামান্তর University of Paris) আসেন নৃতত্ত্ব এবং এথনোলজির ছাত্র হিসাবে। এই সময়টি তাঁর জীবনচর্চায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই সময়েই মায়া সভ্যতা এবং সংস্কৃতি নিয়ে তিনি বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বিশিষ্ট মায়া বিশেষজ্ঞ জর্জ রেইনো (Georges Reynaud)-র সান্নিধ্যে আসা এই আগ্রহের একটি বিশেষ কারণ। অপরদিকে ফরাসি কবি-লেখক-শিল্পীদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এই সময়েই তিনি surrealistic ভাবধারাকে আপন করে নেন। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে আস্তুরিয়াস প্রাচীন মায়া গ্রন্থ Popol Vu এর স্পেনীয় অনুবাদের কাজে হাত দেন। Popol Vu মায়া সভ্যতা ও সংস্কৃতির এক অনন্য মুখপাত্র। গ্রন্থটি ঔপনিবেশিক আমলে রচিত এবং সম্ভবত কিশে (K'iche') মায়া সম্প্রদায়ের জনৈক অভিজাত দ্বারা  হায়ারোগ্লিফিক গ্রন্থ থেকে প্রতিলিপি কৃত। এই গ্রন্থটিতে বিভিন্ন ক্লাসিক্যাল মায়াজ মোটিফের পুনরাবৃত্তি এবং প্রতীকীকরণের মাধ্যমে জটিল স্তরবিন্যাস সৃষ্টি করা হয়েছে এবং মায়া সংস্কৃতি ও সম্প্রদায়ের নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা প্রকাশিত হয়েছে যা স্পেনীয় উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত 'fatherland'-এর  ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সুতরাং Popol Vu এর প্রাসঙ্গিকতা ও ভূমিকা গুয়াতেমালার সাংস্কৃতিক স্মৃতি পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে অনস্বীকার্য এবং আস্তুরিয়াসের সাহিত্যযাত্রার ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়।

   মায়া সংস্কৃতি, এর myths এবং বিভিন্ন mystical কাহিনীর অনবদ্যতা তাঁর সাহিত্যচিন্তায় কতটা প্রভাব ফেলেছিল তাঁর উপন্যাস 'Hombres de maíz' (১৯৪৯) এর পাতায় পাতায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই উপন্যাসে ভুট্টা সংক্রান্ত মায়াজ কল্পকাহিনীর সূক্ষ্ম জাল আস্তুরিয়াসের স্বকীয় ভঙ্গিমায় বিস্তারিত হয়েছে। ভুট্টার ডালপালা থেকে মানুষের সৃষ্টি এই মায়াজ বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে লেখা এই উপন্যাস গুয়াতেমালায় অসাধু, বিবেকবর্জিত সামাজিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ। আস্তুরিয়াস ছাত্রাবস্থা থেকেই একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সক্রিয় অংশ নেন। নতুন আবেগ নিয়ে গুয়াতেমালাকে পুনর্নির্মাণের বাধ্যবাধকতায় বিশ্বাসী হয়ে পড়েছিলেন তিনি যা বাস্তবায়িত হয় এস্ত্রাদা কাব্রেরার একনায়কতন্ত্রের বিরোধিতায় বন্ধুদের সঙ্গে 'la generación del 20'  প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এই প্রতিবাদী আস্তুরিয়াসকে পূর্ণ উদ্যমে পাওয়া যায় ১৯৪৬-এ প্রকাশিত উপন্যাস 'El Señor Presidente'- এ যেখানে নির্মম একনায়ক কর্তৃত্বের অধীনে দেশীয় কৃষকদের দুরাবস্থা বর্ণিত হয়েছে। এই বিষয়বস্তুর আবেদন শুধুমাত্র গুয়াতেমালায় নয়, অন্যান্য লাতিন আমেরিকান দেশগুলির ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য এবং ঠিক এই কারণেই উপন্যাসটির সর্বজনীন জনপ্রিয়তা আজও অম্লান।

  আস্তুরিয়াসের জীবন দর্শনে তাঁর স্বদেশী সমাজ, সংস্কৃতি, myths, ঐতিহ্য গভীর ছাপ ফেলে ছিল; সেই অর্থে বলা যায় গুয়াতেমালা ও এর মানুষ ছিল তাঁর আদর্শ অনুপ্রেরণা। প্রতিটি লেখায়, প্রতিটি শব্দে যা স্বপ্নের মতো অনুরণিত হয়। তিনি সাহিত্য দিয়ে সাহিত্য রচনা করেননি, করেছিলেন গুয়াতেমালার মানুষের পরিচয়কে কেন্দ্র করে।